বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৯শে মে, বুধবার, ১৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১
বাংলাদেশ–সেনেগাল সহযোগিতা
আফ্রিকা মহাদেশের একটি রাষ্ট্র হল সেনেগাল। বাংলাদেশ এশিয়ার নব্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশ। দুটিই অনুন্নত, লক্ষ্য তাদের অভিন্ন। মুসলিম প্রধান এ দুটি দেশ ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাসী, সমাজতন্ত্র তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। সেনেগালের প্রেসিডেন্ট লিওপোল্ড সেদার সেনঘর এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গত পরশু দু’ঘণ্টাব্যাপী এক আলোচনা সভায় মিলিত হয়ে দু’দেশের এক অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে কথা বলেন। দ্বিপাক্ষিক এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী সম্পর্কে তারা ঐকমত্য পোষণ করেন। বিশদ আলোচনা হয় তাদের মধ্যে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং উপমহাদেশের ঘটনাবলী নিয়ে। আলোচনা শেষে পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেন, উভয়পক্ষ সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত নির্যাতিত জনতার প্রতি তাদের সমর্থনের কথা পুনরায় উল্লেখ করেন।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ এবং সেনেগালের মধ্যে একটি সাধারন শুভেচ্ছামূলক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তির মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো দুই বন্ধু প্রতিম দেশ একে অপরের কাছ থেকে কাঁচামাল আমদানির ব্যাপারে পরস্পরকে সর্বাধিক আনুকূল্য প্রদান করবে। দুই দেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি যৌথ কমিশন গঠনের ব্যাপারেও তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এই কমিশন বছরে অন্ততঃ একবার করে বৈঠকে বসবে। তাদের উপরে দায়িত্ব থাকবে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানোর ব্যাপারে বিভিন্ন সুপারিশ প্রণয়ন করা। চুক্তি স্বাক্ষরের পর সেনেগালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ আসানেসেক সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ থেকে সেনেগালের পাট ও পাটজাত দ্রব্য, চা ও অন্যান্য পণ্যের প্রয়োজন। অপরদিকে বাংলাদেশ ফসফেট সার, রক ফসফেট, ক্লিংকার ও সিমেন্ট আমদানি করতে আগ্রহী। এছাড়া সেনেগালের রাজধানী ডাকারে বাংলাদেশ এবং সেনেগালের যৌথ উদ্যোগে একটি চটকল স্থাপনের বিষয় নিয়েও লিওপোল্ড সেদার সেনঘর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে আলোচনা হয়।
মিঃ সেনঘরের এই প্রথম সফর হলেও বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল। গত পরশু রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির দেয়া ভোজসভায় তিনি এদেশের এবং জনসাধারণের ভূয়শী প্রশংসা করে বলেন, বাঙালি জাতি বরাবর তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অবশেষে তারা স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং তার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ দেশে ও বিদেশে অগ্রগতি সাধিত করেছে। তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অগ্রগতিকে বাস্তবধর্মী বলে আখ্যায়িত করেন।
সেনঘর কবি, তিনি রাষ্ট্রনায়ক। শুধু রাজনীতির কূট বিশ্লেষণেই তিনি সবকিছুর বিচার করেন না। অনুভূতি এবং চিন্তা চেতনার আলোকে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাই পাকিস্তানের নানাপ্রকার অপপ্রচারের মুখেও শ্রেণীর প্রথম আফ্রিকান রাষ্ট্র যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কবি-রাষ্ট্রনায়ক সেনঘরের ভাষায় বলতে গেলে, বাংলাদেশের জনসাধারণ যেহেতু জাতি হিসেবে একতাবদ্ধ হয়ে থাকার সাধারণ ইচ্ছা পোষণ করতো এবং সে কথাটা যেহেতু তারা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন তাই সেনেগাল বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নিয়েছিল।
সুদূর আফ্রিকার অনুন্নত দেশ সেনেগাল আর এশিয়ার সাগর তীরবর্তী দেশ বাংলাদেশ এক সুরে একই ভাষায় সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বর্ণবৈষম্যবাদ এর বিরুদ্ধে নিন্দায় সোচ্চার। দুটি দেশেরই তাদের অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধির জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সমঝোতার নীতিতে আস্থাবান। উপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ ছিন্ন করে বাংলাদেশ এবং সেনেগাল তাদের জনসাধারণের সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণে তাদের কর্ম প্রচেষ্টাকে নিয়োজিত রেখেছে। দুই দেশের বন্ধুত্ব আরো নিবিড় হোক অর্থনৈতিক উন্নয়নে দু’দেশের সহযোগিতা আরো বৃদ্ধি পাক এবং সারা দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ এবং সেনেগালের মতো অন্যান্য শান্তিপ্রিয় দেশের উদ্যোগ এবং ভূমিকা বাস্তব ফল লাভের দিকে এগিয়ে যাক-এই আমাদের কামনা। এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার অনুন্নত ও উন্নয়নশীল এবং সাম্রাজ্যবাদী চক্রের যাঁতাকলে পিষ্ট জাতিসমূহের এই ক্রমবর্ধমান সংহতি ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নির্যাতিত এবং শোষিত মানুষের মনে আশার ইঙ্গিত বহন করে।
সকলি গরল ভেল
আরব-ইসরাইল যুদ্ধের অবসান গল্পের জাতিসংঘ যে শাণিত প্রস্তাব প্রদান করেছিল তা নীতিগতভাবে স্বীকৃত হলেও বাস্তবে তা আজও হয়নি। বিভিন্ন এলাকায় সীমান্ত সংঘর্ষ আজও অব্যাহত রয়েছে। সাম্প্রতিককালের যুদ্ধবিরতির ফর্মুলা নিয়ে বহু কথোপকথন ও বাকবিতণ্ডা হয়েছে কিন্তু কোন কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ হেনরি কিসিঞ্জার গত একমাস ধরে দামেস্ক থেকে তেল আবিব এবং জেরুজালেম থেকে আবার সিরিয়া ছুটাছুটি করেছেন সৈন্য পৃথকীকরণের ব্যাপারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গত পরশু রাতে যে সংবাদ পাওয়া গেছে তাতে সিরিয়ার বলিষ্ঠ মনোভাবের কাছে ডঃ হেনরি কিসিঞ্জারের কূটনীতি মার খেয়েছে। ফলে সৈন্য পৃথকীকরণ প্রশ্নটি ব্যর্থ হয়ে গেছে।
আরব রাষ্ট্রগুলো যে নীতিতে অটল ছিল তা হল- প্যালেস্টাইনীদের ন্যায়সঙ্গত দাবি। এদিকে গোলান অঞ্চলে তুমুল লড়াই চলছে। ডঃ হেনরি কিসিঞ্জার একমাস তেলআবিব, দামেস্ক দূতিয়ালি করে ও শেষ পর্যন্ত সিরিয়া ও ইসরাইলী সৈন্য পৃথকীকরণ প্রশ্নের কোন চুক্তিতে পৌঁছুতে পারেননি। সংবাদে প্রকাশ, ডঃ কিসিঞ্জার গতকাল ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ওয়াশিংটন ফিরে গেছেন। রয়টারের এক সংবাদে জানা গেছে, সৈন্য পৃথকীকরণ প্রশ্নে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সিরিয়া মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি। কোন কোন বিষয়ে সিরিয়া আলোচনা করতেই অস্বীকৃতি জানিয়েছে। প্যালেস্টাইনীদের ন্যায় সঙ্গত দাবীর প্রশ্নটিতে সিরিয়া অটল থেকেছে। কমান্ডো প্রশ্ন উত্থাপিত হলে বৈঠকে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। সিরিয়া সোজাসুজি জানিয়ে দিয়েছে, ‘যে যারা কমান্ডোদের সম্পর্কে আলোচনা করতে চায় তাদের কর্তব্য প্যালেস্টাইনি সমস্যার সমাধান করা এবং কমান্ডোদের বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করা। এই সম্পর্কিত কোন প্রকার কথা বলার চেষ্টাকে সিরিয়া সময়ের অপচয় বলে উল্লেখ করেছে। জানা গেছে সিরিয়াল নিরপেক্ষ অঞ্চল। জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চল ও সৈন্য ও অস্ত্রের পরিমাণ নির্ধারণ এর প্রশ্ন একমত হতে পারেনি। এদিকে মাউন্ট হারমান পর্বত অঞ্চলের সিরিয়া-ইসরাইলি বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ট্যাংক বহরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এবং লেবানন সীমান্তেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। গত পরশুদিন গোলানের হার্মন পর্বত অঞ্চলে সিরিয়া-ইসরাইল বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। সিরিয়া সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন মিঃ কিসিঞ্জারের সৈন্য অপসারণ আলোচনায় ইসরাইলের সম্পূর্ণ সৈন্যাপসারণ প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত। তার মতে সৈন্যাপসারণ সহযোগিতা জাতিসংঘ প্রস্তাব বাস্তবায়নের প্রাথমিক পদক্ষেপ এবং তাদের মৌলিক দাবির বাস্তব উপলব্ধি। তাদের এই মৌলিক দাবি হচ্ছে–রণাঙ্গন থেকে সম্পূর্ণ সৈন্যাপসারণ এবং প্যালেস্টাইনীদের ন্যায্য দাবি সংরক্ষণ। সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেছেন–শান্তির পদক্ষেপের যেকোনো বাধা-বিপত্তির জন্য ইসরাইলই দায়ী থাকবে। সিরিয়া মার্কিন জনগণের বিরোধী নয় কিন্তু ইসরাইলকে মার্কিন সমর্থন নীতির বিরোধী।
মধ্যপ্রাচ্যের ডঃ হেনরি কিসিঞ্জারের তথাকথিত শান্তি মিশন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে গেছে। আমরা ইতিপূর্বে আশঙ্কা করেছিলাম এমনটি হবে বলে। কেননা একদিকে মিঃ কিসিঞ্জারের উদ্যোগ গ্রহণ অন্যদিকে ইসরাইলি বাহিনীর অব্যাহত আগ্রাসন তৎপরতা বিশ্বজনমতকে হতাশ করে তুলেছিল। গত পনেরই মে তিনজন প্যালেস্টাইনি গেরিলা লেবানন সীমান্তবর্তী মালোতে একটি স্কুল আক্রমণ করে এবং নব্বই জন ছাত্রছাত্রীকে আটক রেখে তার বিনিময় গ্রেফতারকৃত গেরিলাদের মুক্তি দাবি করে। এ ব্যাপারে সরকার যে মুহূর্তে গেরিলাদের মুক্তিপণ দাবি প্রশ্নের একটি আপোষমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ঠিক সেই মুহূর্তে ইসরাইলি বাহিনী মালোতে স্কুলটির উপর সর্বপ্রকার আক্রমণ চালায়। তাতে বহু শিশুও উল্লেখিত তিনজন গেরিলা মৃত্যুবরণ করে। পরদিন ইসরাইলি বাহিনীর বিমান আক্রমণ চালায় পালিস্টানি উদ্বাস্তু শিবির গুলোর উপর। বেশ ক’জন উদ্বাস্তু এ হামলায় প্রাণ হারায়। এছাড়া গোলান পার্বত্য এলাকায় তুমুল যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছেই। ডঃ হেনরি কিসিঞ্জারের শান্তি আলোচনাও এরই মধ্যে চলেছে। আরব রাষ্ট্রগুলোর যে একটি ন্যায় সঙ্গত আপস-মীমাংসায় পৌঁছুতে রাজি তা অতীতের বিভিন্ন কার্যকলাপেও প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু বারবার ইসরাইলি বাহিনীর উগ্রপন্থা অবলম্বন ও প্যালেস্টাইনীদের মুক্তির প্রশ্নে নেতিবাচকতা সকল শান্তি প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। সাম্প্রতিককালের এই প্রচেষ্টা ও ইসরাইলের উগ্ৰ প্যালেস্টাইনীদের প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রান্ত নীতির দরুন ব্যর্থ হয়ে গেল। ইজরায়েলের নতুন সরকার গঠন নিয়ে আজও নানা জটিলতা চলছে। মিসেস গোল্ড মায়ারের পদত্যাগের পরও অনিবার্যভাবে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা তাদের কেটে উঠতে সময় লাগবে। এদিকে নতুন সরকারের যুদ্ধবাজ দায়ান যোগ দিতে নারাজ। সবকিছু মিলিয়ে ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সুবিধার নয়। ঠিক এই অবস্থাকে কেন্দ্র করে মার্কিন সরকার যে সকল মধ্যপ্রাচ্য নীতি’ অবলম্বন করে চলেছে তা আদৌ ইসরাইলী পক্ষে শুভ হবে কিনা তা বিবেচ্য। ইসরাইলের শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ও মার্কিন নীতির কোন সুফল বয়ে আনতে পারবে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে বলে আমরা মনে করি না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক