বাংলার বাণী
৪ঠা আগস্ট, শনিবার, ১৯৭৩, ১৯শে শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুনরায় ঘোষণা করেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। অটোয়ায় কানাডার একটি পত্রিকার প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু এ কথা বলেছেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন—প্রতিশোধ নেবার জন্যে নয়—মানবতার বিরুদ্ধে যারা অপরাধ সংঘটিত করেছে ন্যায় বিচারের জন্যেই তাদের বিচার করতে হবে। কানাডীয় পত্রিকার প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দ্ব্যর্থহীনভাবে পুনরায় এ কথা ঘোষণা করে আর একবার বিশ্ব বিবেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কানাডীয় পত্রিকার নাম ‘গ্লোব এন্ড মেইল’। এ প্রসঙ্গে উপমহাদেশীয় শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের স্থায়ী সমাধানের কথাও উল্লেখ করেছেন। উপমহাদেশের শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্যে বর্তমান কতকগুলো সমস্যার সমাধানের বাস্তব পথ খুঁজে বের করতে হবে। ভারত-বাংলাদেশ যুক্ত প্রস্তাব এ ব্যাপারে যে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ সে কথাও বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছেন। বস্তুতঃপক্ষে উপমহাদেশের সমস্যা আজ সবচেয়ে প্রকট যেটি সেটি হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বরাবর তার সুস্পষ্ট অভিমত পোষণ করে এসেছে। বিশ্বের সকল জাতিই যুদ্ধাপরাধী বিচারের নীতি সম্পর্কে বাংলাদেশের অভিমত জানেন। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে অস্পষ্ট কোন মতামত দেয়নি। অথচ এ বিষয়টি কেন্দ্র করেই পাকিস্তান ও তার শাসকগোষ্ঠী টালবাহানা করছে। ক্রমাগত বিচারটিকে জটিল করে তুলছে। যুদ্ধাপরাধীদের যাতে করে বিচার না হয় তার জন্যে তারা বিশ্বের সকল দেশের কাছেই ধর্ণা দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের অভিমত অনুযায়ী তা হবার নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশে হবেই। এটা দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নিরঙ্কুশ অভিমত। এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত থাকা উচিত নয়। বস্তুতঃপক্ষে দেশ স্বাধীন হবার পর পরই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন বাংলার মাটিতে যারা মানবেতর ঐতিহাসিক জঘন্য অপরাধ করেছে তাদের বিচার করা হবে। পরবর্তীকালে সরকার অনেক বিচার বিবেচনা করে নব্বুই হাজার যুদ্ধবন্দীর মধ্য থেকে মাত্র ১৯৫ জনকে বিচার করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। বিচারের ব্যাপারেও অপরাধীদের যথেষ্ট সুযোগ দানের কথা বলা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে বাংলাদেশে তারা যে অমার্জনীয় অপরাধ করেছে শুধু তার জন্যে নয়। বিশ্বের ইতিহাসে একটি স্থায়ী উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্যেও। যারা যুদ্ধের নামে গণহত্যা পরিচালনা করে, যারা নারী শিশু-বৃদ্ধ হত্যা করে—যারা নারী নির্যাতন করে, যারা অকাতরে সম্পদ বিনষ্ট করে তাদের শাস্তি দেওয়া নৈতিক ও মানবিক কর্তব্য। যদি এ ধরনের অপরাধের জন্যে কাউকে বিনা বিচারে ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে তা কোনক্রমেই মানবতার স্বপক্ষে বলের আমরা মনে করি না। বিশ্বের বিবেকবান মানবজাতিও নিঃসন্দেহে এই ধরনের অপরাধীদের শাস্তি না হওয়া আশা করে না। বাংলাদেশের এ অভিপ্রায় কোন প্রকার প্রতিহিংসাপ্রসূত নয়—একথা আজ সর্বজন স্বীকৃত। যদি বাংলাদেশের প্রতিহিংসা থাকতো তা হলে মাত্র ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বিচার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো না। একই অন্যায়ের জন্যে নব্বুই হাজারকেই বিচার করা হতো। একটি মহাবিপ্লবের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হবার পর যুদ্ধাপরাধীদেরকে এমনভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে অত্যন্ত ধৈর্য ও শান্তিপ্রিয়তার নমুনা প্রদর্শন করেছে। আমরা যেহেতু উপমহাদেশের নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ও মৈত্রীতে বিশ্বাসী সেহেতু স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে উদ্ভূত সকল সমস্যার সম্মানজনক মীমাংসা আশা করি। আর সে কারণে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত প্রস্তাব ঘোষিত হয়েছে। পাকিস্তানের শুভবুদ্ধির উদয় হবে কি না আমরা জানিনা, তবে বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে আমরা বলবো—যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতেই হবে তাতে করে যে যত ষড়যন্ত্রই করুক না কেন।
ক’ওয়েলথ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু
কানাডার রাজধানী অটোয়ায় কমনওয়েলথ সম্মেলন শুরু হয়েছে। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো কমনওয়েলথের ভবিষ্যতেকে আরো কল্যাণমুখী এবং আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। মিঃ ট্রুডো কমনওয়েলথের সদস্যভুক্ত নবীনতম রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বাগত জানিয়েছেন। এবারের কমনওয়েলথ সম্মেলনে ছ’টি মহাদেশ থেকে বত্রিশ দেশের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী কিংবা তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যোগদান করেছেন। সম্মেলনের চেয়ারম্যান কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো উদ্বোধনী ভাষণে অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, বিশ্বের কোথাও শক্তি প্রয়োগ কিংবা হামলার মাধ্যমে কোন সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেছেন যে, কমনওয়েলথের বিগত সিঙ্গাপুর সম্মেলনের পর বিশ্বে ব্যাপক এবং তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এই সময়ে চীন জাতিসংঘের সদস্য হয়েছে, মস্কো এবং পিকিংয়ের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটেছে, মারণাস্ত্র সীমিত করার প্রথম পর্যায়ের আলোচনা সফল হয়েছে। এছাড়া বৃটেন সাধারণ বাজারের সদস্যভুক্ত হয়েছে। অটোয়ায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সম্মেলন নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান কমনওয়েলথের সদস্যপদ প্রত্যাহার করেছে। বাংলাদেশ এবং বাহামা প্রথমবারের মতো এবারকার সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং কমনওয়েলথ সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করে এবারের সম্মেলনটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন। আমরা আশা করছি, বঙ্গবন্ধু এবারের সম্মেলনে বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রশ্নে বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং অন্যান্য মানবিক জটিলতা সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করবেন। কমনওয়েলথকে যেহেতু সদস্য রাষ্ট্রগুলোর একটি ‘সুখী পরিবার’ বলে চিহ্নিত করা হয়, সেহেতু এই সম্মেলনে পারস্পরিক হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে সমস্ত পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে ঘরোয়া আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। কমনওয়েলথ সম্মেলনের এটাও একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কমনওয়েলথ সম্মেলনে অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় না, তবে বিশ্বশান্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে শান্তির স্বপক্ষে প্রস্তাবাবলী গৃহীত হওয়াটা বিচিত্র ব্যাপার নয়।
এবারের কমনওয়েলথ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু নিশ্চয়ই তাঁর স্বকীয় বক্তব্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং উপমহাদেশের সমস্যা সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করবেন। বঙ্গবন্ধুর এই অভিমত উপমহাদেশীয় ঘুর্ণাবর্তে হয়তো প্রশংসিত করতেও পারে।
এ পর্যন্ত লন্ডনেই কমনওয়েলথ সম্মেলন বেশীর ভাগ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তৃতীয়বারের মতো এবারে অটোয়ায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ সম্মেলন। এ সম্মেলনের আলোচ্যসূচী পূর্বাহ্নে নির্দিষ্ট না থাকলেও কল্যাণকামিতাই কমনওয়েলথ সম্মেলনের মুখ্য ভূমিকা। বাংলাদেশের সামনে আজ নানা সমস্যার পর্বত মাথাচাড়া দিয়ে রযেছে। এইসব সমস্যাদি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু নিশ্চয়ই আলোকপাত করবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলছেন আর যা ঘটছে
আবার খবর এসেছে পুলিশ ফাঁড়ি লুটের—খবর এসেছে লঞ্চ ও ট্রেন ডাকাতির-খবর পাওয়া গেছে বাজার লুটের। বাজার লুট—লঞ্চ ও ট্রেন ডাকাতিটাই এতদিন ছিলো একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ইদানীংকালে থানা লুট—থানা থেকে—থানার পুলিশের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার ঘটনাটাও যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর শেষ কোথায় কে জানে। কিছু দিন আগে লৌহজং থানা লুট হয়েছে—লুট হয়েছে সেখানকার বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র। লুট হয়েছে ছাত্রা থানা এবং ভোলার আরেকটি থানাও। সবখানেই দুর্বৃত্তরা নাকি পুলিশদের মারধর করে-আহত করে সব অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিয়ে গেছে। তবে সৌভাগ্য যে, কোথাও কোন পুলিশ কিন্তু দুর্বৃত্তদের গুলিতে শহীদ হননি—এবং দুর্ভাগ্য এই যে, কোথাও কোন পুলিশের গুলিতে কোন দুর্বৃত্ত নিহত হয়নি, এমনকি আহত হয়ে পড়েও থাকেনি।
দেশের বিভিন্ন স্থানে লঞ্চ, ট্রেন, বাজার, ব্যাংক ডাকাতি যখন হরদম চলছে-রাহাজানি আর হাইজ্যাকিং যখন বেশ ভালোভাবেই জমে উঠেছে-থানা লুট-থানার অস্ত্রশস্ত্র লুট যখন প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দেখা দিচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুল মালেক উকিল বলেছেন : থানাগুলোতে পুলিশের শক্তি বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তাদের দুর্বৃত্ত ও সমাজবিরোধীদের দমনকল্পে সুসজ্জিত করে তোলা হচ্ছে। গত মার্চ মাসে স্বরাষ্ট্র দপ্তরে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর উকিল সাহেব এ ধরনের কথা আরো বলেছেন এবং তাঁর এ বক্তব্যের যথার্থ প্রমাণ পাওয়াও গিয়েছিল। কিন্তু থানা লুট থামেনি—রাহাজানি-হাইজ্যাকিং ব্যাংক ডাকাতি, লঞ্চডাকাতি, ট্রেন ডাকাতি বন্ধ হয়নি। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তা বেড়েছে অনেক বেশী করে। দেশর উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের কোন কোন এলাকায় আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন অবশ্য বেশ সন্তোষজনভাবেই ঘটেছে। সেজন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সরকার ও দেশের জনগণের সাথে আমরাও সন্তোষ প্রকাশ করি। কিন্তু রাজধানী ঢাকার আশে-পাশে, লৌহজংয়ে-ঘিওরে যেসব ঘটনাগুলো পর পর ঘটতে শুরু করেছে, তাতে করে কি আমাদের সেই সন্তোষটা কাপুরের মত উবে যায় না?
এক অসমর্থিত খবরে প্রকাশ, লৌহজং থানা যখন লুট হয় তখন সেখানে সাতজন এ.এস.আইয়ের নেতৃত্বে যে সংখ্যক পুলিশ ও তাদের হাতে যে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল—দুর্বৃত্তরা সে তুলনায় অনেক কম সংখ্যক ও অনেক কম অস্ত্রের অধিকারী ছিলো। লুট হবার কিছুদিন আগে ঐ থানা থেকে কয়েকজন কুখ্যাত ডাকাত ও দুর্বৃত্তকে নাকি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো। যদি এই খবরটি সত্য হয়, তবে যদি প্রশ্ন করা হয় যে, লৌহজং থানা লুটের ব্যাপারে ঐ থানায় যারা আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন—দুর্বৃত্তদের হামলাকালে যারা সেখানটায় ছিলেন—তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বা যোগসাজশ না থাকলেও শৈথিল্য ছিলো—তা হলে সেটা কি অবান্তর হবে? সেই আলোকে ঘিওরের প্রশ্নেও কি একথা উঠে না? সরকার বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি বিষয়টা জরুরী ভিত্তিতে তদন্ত করে দেখবেন?
দুর্বৃত্তদের দমন, সমাজবিরোধীদের দমন, আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, ব্যাংক লুট—থানা ডাকাতি, রাহাজানি হাইজ্যাকিং, ট্রেন ডাকাতি বন্ধ করা প্রশাসন যন্ত্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব এবং তারা সে দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর। এতে কোন প্রশ্নের অবকাশ নেই। কিন্তু যাদের নিয়ে প্রশাসন যন্ত্রের এই তৎপরতা তারা যদি শিথিল হয়ে পড়েন বা কোন শৈথিল্য প্রকাশ করেন—তবে কি হবে?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক