You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলা ভাষার আরেক রক্তমাখা দিন

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস অবিভক্ত বাঙালি জাতির ইতিহাস পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ঢাকার বুকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্যে বাঙালি তরুণদের রক্তদান সমগ্র বাঙালি জাতিরই রক্তদান। সে কারণে দেশভাগ কিংবা ভৌগােলিক বিভাজনকে অস্বীকার করে পূর্বতন পূর্ববঙ্গের একুশে ফেব্রুয়ারি সমগ্র বাংলা ভাষাভাষীর জাতীয় পর্বের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য। সে দিনের পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান আজ স্বাধীন বাংলাদেশ যা বাংলা ভাষা সাহিত্যের প্রথম ভুবন। কলকাতা যদিও উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি রেনেসাঁর কেন্দ্রবিন্দু এবং এখনও বাংলা ভাষা-সাহিত্যের সুবিশাল অঙ্গন, তবু এ কথা অনস্বীকার্য যে, ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের সুবাদেই ঢাকা আজ বাংলা ও বাঙালির প্রথম ভুবন। কারণ বঙ্গের এই খণ্ডেই প্রথম বাংলা ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, পূর্ববঙ্গের এ মাটিতেই বাঙালি জাতির রক্তাক্ত স্বাধীনতার আন্দোলন হয়েছে এবং এ ভূখণ্ডই বাঙালির জাতীয় ইতিহাসের প্রথম স্বাধীন এবং সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র হবার যােগ্যতা অর্জন করেছে। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ বাংলাকে দুই খণ্ডে বিভাজিত করেছে। এপার এবং ওপার যার পরিচয়। কিন্তু বাঙালির বা বাংলা ভাষা-সাহিত্যের তৃতীয় ভুবন হিসেবে যে অঞ্চলটির অস্তিত্ব রয়েছে তার খোঁজ খবর আমাদের বেশির ভাগই হয়ত রাখি নি। বিজিকুমার ভট্টাচার্য আসামের বরাক উপত্যকার অন্যতম পরিচিত একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন। নাম ’সাহিত্য’। বাংলা সাহিত্যের এই বয়ােজ্যেষ্ঠ কর্মী তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘সাতচল্লিশের স্বাধীনতা এবং দেশ বিভাগ বাংলা সাহিত্যের ভুবনকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করে দিল। এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার মধ্যে গড়ে ওঠে এক বিশাল রাজনৈতিক দেয়াল। বাংলা সাহিত্যের জগতও ভাগ হয় দুটি প্রধান ভাগে, যাকে আমরা বাংলা সাহিত্যের প্রথম এবং দ্বিতীয় ভুবন বলে চিহ্নিত করি। এই দুই ভুবনকে মেনে নিতে পাঠক কিংবা সমালােচকদেরও তেমন অসুবিধা হয় কিন্তু এই দুই ভুবনের বাইরেও নানাবিধ বাস্তব কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যে বাংলা সাহিত্যের একটি জগৎ গড়ে উঠেছে তার খবর এখনও অনেকের কাছে পৌছাই নি। বাঙালির ভাষা সাহিত্যের এ যাবতকালের স্বীকৃত দুই বনের বাইরে যে তৃতীয় ভুবনের অস্তিত্ব তা ক্রমান্বয়ে বৃহত্তর বাঙালি সমাজের দৃষ্টিগােচর হচ্ছে। বিলম্বের এ কারণও অবশ্য অজ্ঞাত নয়।

বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বাংলা ভাষা সাহিত্যের যে তৃতীয় ধারাটি ক্রমান্বয়েই বিকশিত হচ্ছে তা আসাম এবং ত্রিপুরায় । যা ১৯৪৭ সালের পর  থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারত নামে পরিচিত। আমি নিজে এ অঞ্চলের ভাষা সাহিত্য চর্চার কিছুটা খোঁজ রাখি। সেখানকার অনেক ভাষাভাষির মধ্যে বাঙালিরা তাদের স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে। সে কারণে আমার মনে হয়েছে, বাংলা ভাষা সাহিত্যের তৃতীয় ভুবনের মর্যাদার যে দাবি তা নিতান্তই যুক্তিসঙ্গত। ওদের সাহিত্য শুধু বাংলা ভাষাকে নয়, গােটা বাংলা সাহিত্যকেও অনেকখানি সমৃদ্ধ করতে পারে। আমরা খোঁজ রাখি না বলেই তা স্বীকৃতির আওতায় পড়ে না— এ কোনাে যুক্তি হতে পারে না। আমরা যে জানি না সে ব্যর্থতা আমাদের, কিন্তু আমাদের না জানা কখনই সব জানার গৌরব হতে পারে না। যেমন আমরা ক’জনে জানি, ১৯ মে ১৯৬১ বরাক উপত্যকায় বা আসামের শিলচরে বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্যে কতগুলাে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল। কিংবা ক’জনেই বা জানি, ২১ জুলাই ১৯৭২ বাংলা ভাষার জন্যে আসামের করিমগঞ্জে কী নৃশংস রক্তপাত হয়েছিল। ঢাকার বুকে বাহান্নর মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের আত্মমর্যাদার গর্বিত ইতিহাস। ঠিক এমনিভাবে বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি মাত্র আট বছরের মাথায় বরাক উপত্যকার শিলচরে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে যে যুবারা আত্মবলি দিয়ে গেছেন, সেটিও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৬১ সালের ২০ মে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতার প্রধান প্রতিবেদনটি হচ্ছে এ রকম : বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতিদানের দাবিতে কাছাড় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে যে আন্দালন শুরু হইয়াছে, আজ প্রথম দিনেই সশস্ত্র পুলিশ শিলচর শহরে শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্র সত্যাগ্রহীদের উপর বেপরােয়া গুলি চালাইয়া বালিকা ও শিশুসহ আটজনকে ঘটনাস্থলেই নিহত করিয়াছে। শিলচর রেলওয়ে স্টেশন কম্পাউন্ডে এই বর্বর ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়। চারজন বালিকাসহ প্রায় ৩০ জনের শরীরের ঊর্ধ্বাংশ গুরুতররূপে আহত হইয়াছে।’

বাংলা ভাষাকে সরকারি মর্যাদার দাবিতে গােটা বরাক উপত্যকা সেদিন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল। মাতৃভাষা যে কতটা প্রাণের, মাতৃভাষার মর্যাদার প্রশ্ন যে কতটা হৃদয়ের তার আরেক দৃষ্টান্ত বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলন। অপ্রতিরােদ্ধ ভাষা দাবিকে পরাস্ত করতে পুলিশ সেদিন নির্বিচার গুলিবর্ষণ করেছিল। সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছিল। পুলিশি নির্যাতনে আহত হয়েছিল অগণিত বাঙালি। নিগৃহীত হয়েছিল অগণিত সাধারণ মানুষ। কিন্তু এত কিছুর পরও আন্দোলন থামে নি। শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষিত হয়েছে। গােটা আসামের মধ্যে বরাক উপত্যকা প্রায় পুরােটাই বাঙালি অধ্যুষিত। বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে খিলাফত অসহযােগ আন্দোলনও এই উপত্যকায় ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। কিন্তু ষাটের দশক থেকে শুরু হয়ে একষট্টিতে পরিণতি পাওয়া বাংলা ভাষা আন্দোলন বরাক উপত্যকাকে যেভাবে আন্দোলিত করেছিল তার তুলনা নেই। এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ১৯৪৭ সালের উপমহাদেশ বিভক্তির পরপর। আসামের গােপীনাথ বরদলৈ মন্ত্রিসভার এক সিদ্ধান্তে এটি প্রচার করা হয় যে, আসামে যে সব অসমীয়া রয়েছে তারা আসামে বসবাস করতে পারবে কিন্তু পরিবর্তে তাদের আনুগত্যের প্রমাণ দিতে হবে। সিদ্ধান্তটি স্বভাবতই বাঙালিদের ভাল লাগে নি। ফলে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে বিভেদ বাড়তে থাকে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাঙাল খেদাও আন্দোলন জোরদার হয়। ভাষার প্রশ্নে আসামের যুগপ্রাচীন বাসিন্দারা বিভক্ত হতে থাকে। মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদের শাসনামলে অসমীয়াকে রাজ্যের সরকারি ভাষা করার দাবি প্রবল হতে থাকে। এতে রাজ্যে রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয়।

একদিকে দাবি আসাম অসমীয়াদের অন্যদিকে তথাকথিত আনুগত্য প্রকাশে বাংলা ভাষাভাষিদের প্রবল অস্বীকৃতি। এই প্রেক্ষিতে ১৯৬০ সালের এপ্রিলের ১৬ তারিখে শিলচরে এক প্রতিবাদ সভা ডাকা হয়। প্রবীণ জননেতা আবদুল মতলিব মজুমদার এতে সভাপতিত্ব করেন। ভাষা প্রশ্ন বিবেচনার জন্য ১৯৬০ সালের ২১ ও ২২ এপ্রিল আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভা বসে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে এ সভাতে অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব পাস হয়। প্রস্তাবের বেশ প্রতিবাদও হয়, কিন্তু লাভ হয় না। কংগ্রেস কমিটির এ সিদ্ধান্ত প্রবলভাবে নাড়া দিল রাজ্যের বাংলাভাষী জনগােষ্ঠীকে কাছাড়ের কংগ্রেসীরা প্রতিবাদে পাল্টা সিদ্ধান্ত নিল। তারা শিলচর, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দিতে সভা-সমাবেশ করতে শুরু করল। এ পরিস্থিতির মধ্যে শিলচরে বাংলা ভাষা সম্মেলনের প্রস্তুতি চলতে থাকল বিভিন্ন জায়গায় বাঙালিরা আক্রান্ত হতে থাকল। নাজিরা এবং মরিয়ানি রেলস্টেশনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বাঙালি যাত্রীদের মারধর করা হলাে। তাদের দোকানপাট লুট করা হতে থাকল। ঠিক এ পরিস্থিতিতে দ্বারিকানাথ তেওয়ারীর সভাপতিত্বে বাঙালিদের এক বড় সভা অনুষ্ঠিত হলাে শিলচরে। আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২-৩ জুলাই, ১৯৬০ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন চপলাকান্ত ভট্টাচার্য এবং এর উদ্বোধক কাজী আবদুল ওদুদ। কাজী নজরুল ইসলামের দুর্গম গিরি কান্তার মরু গান দিয়ে সম্মেলন শুরু হয় এবং এতে যে প্রস্তাব পাস করা হয় তাতে রাজ্যভাষা সংক্রান্ত কোনাে বিল পাস না করতে সরকারকে অনুরােধ জানানাে হয়। ঠিক এ সময় গৌহাটিতে পুলিশের গুলিতে একজন অসমীয়া ছাত্রের মৃত্যু ঘটল। এ নিয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু হলাে। নিরাপত্তার খাতিরে বাঙালিরা ব্ৰহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে শরণার্থী হয়ে বরাক উপত্যকায় আসতে শুরু করল। পরিস্থিতি যখন আরও কিছুটা অবনতি ঘটল তখন শিলচর ও করিমগঞ্জে ছাত্র সংগ্রাম সমিতি গঠিত হলাে।

ছাত্র সংগ্রাম সমিতির বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এবং তাদের প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশের আঘাত আসতে থাকল। আসামে বাঙালিদের এই দুরবস্থায় কোলকাতাতেও সভা-সমাবেশ-প্রতিবাদ শুরু হলাে। চালিহা সরকার বসে থাকল না। ভাষা বিল পেশ করা হলাে বিধানসভায়। বাঙালি বিধায়করা এই বিলের প্রবল বিরােধিতা করলেন, কিন্তু তাতে লাভ কিছুই হলাে না। রাজ্য সরকারের ভাষা বিল শেষ পর্যন্ত গৃহীত হলাে বিধানসভাতে। বিধানসভায় ভাষা বিল পাশের পর থেকে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠতে থাকে। শিলচরের এক সম্মেলনে বিলের তীব্র প্রতিবাদ করা হয়। অবিলম্বে এই বিলের সংশােধনী আনতে দাবি জানানাে হয়। বাঙালিদের ওপর অসমীয়াকে না চাপাতে হুঁশিয়ারি জানানাে হয়। বলা হয়, এতে বাঙালি সমাজে মৌলিক অধিকার ও মাতৃভাষার সম্মান রক্ষিত হবে না। বাঙালিরা এ সিদ্ধান্ত কিছুতেই মানবে না। ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কাছাড় জেলা জনসম্মেলন অনুষ্ঠিত হলাে করিমগঞ্জে। সভাপতিত্ব করলেন হাইলাকান্দি লােকাল বাের্ডের প্রাক্তন সভাপতি আব্দুর রহমান চৌধুরী, প্রধান অতিথি শরৎচন্দ্র নাথ। সম্মেলনে গৃহীত মূল প্রস্তাবে রাজ্য সরকারকে একটি চরমপত্র দেয়া হলাে। এতে বলা হলাে, ১৩৬৭ বঙ্গাব্দের ৩০ চৈত্রের মধ্যে ভাষা আইনের যথাযথ সংশােধনী যদি আনা না হয় তাহলে কাছাড়ের জনসাধারণ অহিংস গণআন্দোলনের সূচনা করবে। আরেক প্রস্তাবে কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলাে। গঠন করা হলাে শিলচর, হাইলাকান্দি এবং করিমগঞ্জের জন্যে আলাদা সংগ্রাম কমিটি।

কিন্তু এ চরমপত্র সরকারের মধ্যে কোনাে রকম ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল না। এদিকে সংগ্রাম কমিটি গঠনের পর থেকে রাজ্যভাষা বাংলার দাবি ব্যাপক আকার ধারণ করতে থাকল। একদিকে চলতে থাকল হরতাল-অবরােধ-মিছিল-পিকেটিং, অন্যদিকে সান্ধ্য আইন ও পুলিশী নির্যাতন। বাংলাকে অন্যতম রাজ্যভাষা করার দাবিতে ১৯ মে থেকে কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ সমগ্র বরাক উপত্যকায় লাগাতার হরতালের ডাক দিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে আসামের রাজ্যপাল শ্রী নাগেশের উপস্থিতিতে রাজ্য মন্ত্রিসভার জরুরি সভা বসল। কিন্তু সঙ্কটের কোনাে সুরাহা হলাে না। গােটা বরাক উপত্যকা অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠতে থাকল। হরতালের প্রথমদিনেই শিলচরে নিরস্ত্র জনতার ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করল। ঘটনাস্থলেই শহীদ হলাে ১১ জন। এদের মধ্যে একজন মহিলা প্রতিবাদী। আহত হলাে ৩০জন। পরদিন অর্থাৎ ২০ মে, কেবলমাত্র শিলচরেই ৪০ হাজার বাঙালি নরনারীর এক সুবিশাল মৌন মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করল। গােটা বরাক উপত্যকার ঘরে ঘরে কালাে পতাকা উড়ল। শিলচরের হত্যাকাণ্ডে পশ্চিমবঙ্গেও প্রবল প্রতিক্রিয়া হলাে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গােটা কাছাড়ে হরতাল-অবরােধ অব্যাহত থাকল। গােটা এলাকায় অচলাবস্থায় সৃষ্টি হলাে। পাথারকান্দিতে আবার পুলিশ লাঠিচার্জ করল। গুরুতর আহত হলাে ৩২ জন ভাষাসৈনিক। ২৪ মে শিলচরের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হলাে। শােক মিছিল হলাে ১১ শহীদের চিতাভস্ম নিয়ে কোলকাতায়। কোলকাতা প্রদেশ কংগ্রেস কেন্দ্রের কাছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রস্তাব করল। আসাম সফররত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে বাঙালি নেতৃবৃন্দ স্পষ্ট জানিয়ে দিল কোনাে আপােসই সব হবে না যদি না বাংলাকে অন্যতম রাজ্যভাষার মর্যাদা দেয়া না হয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় দাবি জানালেন প্রতিটি রাজ্যকেই বহু ভাষাভাষী রাজ্য বলে স্বীকৃতি দিতে হবে। এ প্রস্তাবকে সমর্থন জানালেন পশ্চিবঙ্গের মার্কসবাদী নেতা জ্যোতি বসু।

কিন্তু তখনও রাজ্য সরকার দাবি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাল। এরপর পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটল। রাজ্যের প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে প্রবল প্রতিরােধ গড়ে উঠতে থাকল। পরিস্থিতি সামলাতে কাছাড় জেলাকে উপদ্রুত এলাকা হিসাবে ঘােষণা করা হল। চরম অচলাবস্থা শুরু হলাে আসাম রাজ্যে। শেষ পর্যন্ত রাজ্য সরকারের নমনীয় মনােভাব লক্ষ করা গেল। গ্রেফতারকৃত ২৯০জন ভাষাসৈনিককে সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হল। জুলাই মাসে হাইলাকান্দিতে পুলিশ আবার গুলিবর্ষণ করল। এই পরিস্থিতিতে গঠিত হলে নিখিল আসাম বঙ্গ ভাষাভাষী সমিতি। দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে যা দেখা যায় তাতে আসামের সরকার প্রথমদিকে সমঝােতার কথা একেবারে ভাবে নি, কিন্তু পরে তারা আপােসের দিকে পা বাড়ায়। শেষ পর্যন্ত পণ্ডিত নেহরুর কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যস্থতায় রাজ্য সরকার বাধ্য হয় বাংলাকে কাছাড় বা বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে। ১৯৬১ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলন এবং ১৯ মে কাছাড়ের শিলচরে পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রেক্ষিতে বেসরকারি তদন্ত কমিশনের রিপাের্টের কয়েকটি অংশ তুলে ধরে আমি আমার এই লেখাটিয় শেষ টানছি। এন.সি, চ্যাটার্জী কমিশনের এই রিপাের্টে বলা হয়, ‘ আমাদের সামনে পেশ করা সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে আমরা নিশ্চিত যে কাহাড়ের জনসাধারণ পরিচালিত আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল এবং মারাত্মক উস্কানি সত্ত্বেও তারা ছিল অহিংস নীতিতে অবিচল। কিন্তু সরকারের সশস্ত্র ক্ষমতা প্রদর্শন সাধারণ মানুষের ওপর বিপরীত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং তাদের মনােবল বাড়িয়ে তােলে। আমাদের সামনে যে সমস্ত তথ্য উপস্থাপিত এবং যে সব স্থান আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তাতে জ্ঞানবুদ্ধি দ্বারা আমরা নিশ্চিত যে, গুলি চালানােসহ পুলিশের সব কাজই অপ্রয়ােজনীয় এবং অসঙ্গত।’ এই কমিশন তার রিপাের্টের একেবারে শেষে যে মন্তব্যটি করেছে তা নিম্নরূপ : “নিজেকে প্রকাশের জন্য মানুষের মাতৃভাষার অধিকার এক মৌলিক মানবিক অধিকার। এই অধিকারকে অস্বীকার করা কিংবা দমনের মাধ্যমে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা কোনােটাই মঙ্গল হবে না।’

মে ১৯৯৭

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ হারুন হাবীব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!