You dont have javascript enabled! Please enable it!

পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলা, কী যায়-আসে আমাদের

সম্প্রতি ভারতের অন্যতম রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের নাম বদলে বাংলা রাখার একটি বেসরকারি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে রাজ্যের বিধানসভায়। একই সঙ্গে বৃটিশের দেয়া ক্যালকাটা’ নামের বানানটিও তারা পরিবর্তন করে কলকাতা’ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ৩০৯ বছরের প্রাচীন বানান রীতি বদলে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে রাজ্যের শাসক বামফ্রন্ট এবং বিরোধী দলের সদস্যরা। এই নাম পরিবর্তনের বিষয়ে বিধানসভায় তারা কোনাে বিরােধ বাধান নি, বরং সবাই মিলে একযােগে রাজ্য এবং রাজধানী-দুটোরই নাম এবং বানান পরিবর্তনে ঐকমত্য পােষণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন নিয়ে বাংলাদেশের কিছু প্রতিক্রিয়া পত্রিকান্তরে চোখে পড়ে আমার একটি কাগজ বাংলা’ নাম নিয়ে বেশ আপত্তি আছে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের এবং অন্যটি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে বলে বিস্তারিত প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। এ ব্যাপারে আমার নিজের প্রতিক্রিয়া কিছুটা স্নি। পশ্চিমবঙ্গ, যার নাম এখন বাংলা’ রাখার প্রস্তাব এসেছে, সেটি ভারতের অন্যতম রাজ্য। সে দেশের বিধানসভায় সরকার এবং বিরােধীদলীয় সদস্যরা মিলে যদি কিছু সিদ্ধান্ত নেন এবং সে সিদ্ধান্ত যদি তাদের নিজেদের প্রয়োজনে হয়, তাহলে আরেক দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের কি বলার থাকে! আমাদের দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু ইতিহাস হচ্ছে এই, আজকের এই বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ কিংবা প্রস্তাবিত বাংলা’-এ দুই ভূখণ্ডই ১৯৪৭ পর্যন্ত এক বঙ্গভূমি ছিল, ছিল। পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গ। শুধু এ দুই বসে কেন, লাহাের, করাচি, দিল্লি, কলকাতা, বম্বেতে ঘুরে বেড়াতে কারুরই কোনাে সঙ্কট হত না। পাসপাের্ট-ভিসার প্রয়ােজন হত না। ‘৪৭-এর ব্রিটিশশাসিত ভারত যখন সাম্প্রদায়িকতার বিভাজনে ভারত এবং পাকিস্তান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলাে তখনই পূর্ববঙ্গ, অর্থাৎ আমাদের এই বাংলাদেশ, হয়ে গেলাে পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিমবঙ্গ চলে গেলাে ভারতে। এ হচ্ছে এই উপমহাদেশের ইতিহাস-যা এ যাবৎ সবাই মেনে নিয়েছে। কিন্তু এই যে দেশ বিভাগ, বাংলা ভাষাভাষীর এবং একই ইতিহাস-ঐতিহ্যের মানুষের এই যে বিভাজন, তা কতটা করুণ আর রক্তাক্ত হয়েছিল, ইতিহাসের পাঠকমাত্রই তা সকলের জানা।

১৯৪৭-এর বঙ্গ বিভাগ কোটি কোটি মানুষকে, লাখ লাখ পরিবারকে দেশান্তরিত করেছিল। বাপ-দাদা বা পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ফেলে লাখ লাখ পরিবারকে নি হয়ে ছাড়তে হয়েছিল তাদের প্রিয় মাতৃভূমি, প্রিয় স্বদেশ এবং এই রক্তাক্ত দেশ ভাগের অধ শতাব্দীর পর, এখনাে সে রক্ত এবং কান্নার চিহ্ন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আমাদের চারপাশে। আমরা যদি বিবেকবান হই, আমরা যদি অন্ধ না হই, তাহলে সেই আর্তনাদের চিহ্ন আজো আমাদের চোখে পড়বে। বিশ্বমানবতার ইতিহাসে এমন সকরুণ ঘটনাবলী, সেই চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে, একমাত্র এই বাংলা এবং পাঞ্জাবেই কেবল ঘটেছিল। আমাদের সাহিত্যে, গবেষণায় সেই আর্তনাদের, হৃদয়হেঁড়া বিভাজনের কাহিনী আছে অগণিত। সাদত হাসান মান্টোর গল্পগুলাে পড়লে আজো শিউরে উঠতে হয় মানুষের সেই করুণ আর্তনাদে  কিন্তু আমি সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। শুধু বলতে চাই, পশ্চিমবঙ্গের নাম তাদের লােকেরা যদি বাংলা’ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়- তাতে আমাদের কতটা যায়-আসে  খােদ পশ্চিমবঙ্গেই অবশ্য এই প্রস্তাবের কমবেশি বিরােধিতা লক্ষ্য করা গেছে। পত্রিকায় দেখলাম, প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি এবং মমতা ব্যানার্জিসহ বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ এই নামকরণের শক্ত সমালােচনা করেছেন। শ্রদ্ধেয় অন্নদাশংকর রায় এবং মৃণাল সেনসহ আরাে কেউ কেউ এই প্রস্তাবটিকে মেনে নেন নি। কিছু কিছু পত্রপত্রিকাতেও বিধানসভার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালােচনা হচ্ছে। কিন্তু এসব তাে গেল পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব ব্যাপার। একটি দেশের একটি রাজ্যের নিজস্ব বিষয় নিয়ে তাদের নিজেদের চিন্তাভাবনা কিংবা তর্কবিতর্ক। আমি সত্যি সত্যিই বুঝতে অক্ষম এইসব ব্যাপার নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার কতটা যুক্তি আছে! ওদের রাজ্যের নাম ওরা যা খুশি রাখতে পারে, এ ওদের নিজস্ব চিন্তা, রুচি এবং ধ্যান ধারণার বিষয়। আমাদের বাংলাদেশ তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাবে কোন যুক্তিতে। আমাদেরই একটি প্রধান কাগজ প্রতিবেদন ছাপিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের নাম যদি ‘বাংলা’ হয় তাহলে ‘আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালােবাসি’-এ জাতীয় সঙ্গীত আমরা আর গাইব কী করে? আমি জানি না, আমার যে শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির বরাত দিয়ে প্রশ্নটা তােলা হয়েছে, তিনি ঠিক এভাবেই কথাটা বলেছিলেন কিনা।

পশ্চিমবঙ্গের নাম যদি বাংলা’ হয় এবং আমি যদি আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালােবাসি’ সঙ্গীত গাই— তাতে কোনাে সঙ্কট হতে পারে বলে তাে মনে হয় না। কারণ এ সঙ্গীতের রচয়িতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি রাষ্ট্রগতভাবে ‘৪৭-পূর্ব অখণ্ড ভারতের। সেদিনকার পশ্চিমবঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানে তিনি নাগরিকত্ব নেন নি কিংবা বাংলাদেশেরও নয়। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি। রবীন্দ্রনাথ বাঙালি। এবং রবীন্দ্রনাথ ওদের এবং আমাদের সমান এবং যৌথ। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের নাম বাংলা রাখা হলেই তার গান আমরা গাইতে পারব না কেন? তাহলে অন্য গানগুলাে নিয়ে কী হবে? আমরা কী একবারও ভেবে দেখি নি পশ্চিমবঙ্গ হচ্ছে ভারতের একটি রাজ্য, যার কোনাে নিজস্ব জাতীয় সঙ্গীত নেই। সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু কবি’ এবং ‘বিজাতীয় কবি’ হিসেবে প্রচার করার অপচেষ্টা কম হয় নি। পাকিস্তান আমলের অনেকদিন রবীন্দ্রনাথকে রেডিও-টেলিভিশন থেকে সতর্কতার সঙ্গে বাদ রাখা হয়েছিল। মােল্লাবাদী পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবী আর রাজনীতিবিদরা কাজী নজরুল ইসলামের মতাে। উদারপন্থী মানুষকেও কাফের আখ্যায়িত করেছিল। কাজী আব্দুল অদুদ ও সৈয়দ মুজতবা আলীর মতাে মানুষকেও মােল্লাবাদীরা কম জ্বালায় নি। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য, সেই একই রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণা, এবং একই রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। এবং সত্য আরাে আহে। সেই একই রবীন্দ্রনাথের গান ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। আসলে পশ্চিমবঙ্গের নাম বদলের ব্যাপারটিকে কেউ কেউ যেভাবে দেখতে চেষ্টা করছেন, আমি সেভাবে চাইছি না। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, যার সৃষ্টির পেছনে সুদীর্ঘ ধারাবাহিক গণআন্দোলন আর সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ইতিহাস আছে। আছে ৩০ লাখ মানুষের আত্মাহুতি। অন্যদিকে ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে এই, পশ্চিমবঙ্গ বা আজকের প্রস্তাবিত বাংলা’ ভারতের বহু রাজ্যের একটি। কিন্তু এরপরও যে সত্যটিকে মানতে হবে তা হচ্ছে আমরা বাঙালিরা, একই ভাষা, সাহিত্য আর সংস্কৃতির মানুষেরা সীমান্তের এপারে এবং ওপারে বসবাস করি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরােধী তথাকথিত ধর্মাশ্রয়ী কূটবুদ্ধিসম্পন্নদের কথা বাদই দিই। ওরাতাে দুই বঙ্গ বা ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি চাইবেই না। সে তাদের নিজস্ব এক রাজনীতি যা নিয়ে ওরা এখনাে তৎপর।

পৃথিবী উদার হচ্ছে, সামাজিক আর ধর্মীয় কুসংস্কার দ্রুত অপসারিত হচ্ছে; কিন্তু এই শ্রেণীর লােকেরা অন্ধ থাকতে ভালােবাসে। না, আমি এদের নিয়ে মােটেও ভাবি নে। শিক্ষার হার যতাে বাড়বে, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির প্রসার যতাে ঘটবে- মানুষ ততােই যুক্তিবাদী হবে এবং এই শ্রেণীর লােকেরা ততােই পিছু হটবে। হটতেই হবে। কাজেই যে যাই বলুক, আমি একই ভাষাভাষীর এই মানুষদের মধ্যে নিগুঢ় সম্বন্ধ চাই, বন্ধুত্ব চাই, যাতায়াত চাই, আদান-প্রদান চাই। যে ধর্মীয় জিগির আমাদের মনের মধ্যে একটি দেয়াল সৃষ্টি করেছিল সেই মনের দেয়াল আমি ভাঙতে চাই। সে কারণেই অত্যন্ত জোরের সঙ্গে আমি ঢাকা-কলকাতার মধ্যে সরাসরি বাস সার্ভিসকেও সমর্থন জানিয়েছি। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় গৃহীত বেসরকারি এই প্রস্তাবটি ভারতীয় লােকসভায় উপস্থাপিত হবে, কারণ রাজ্যটির নাম পরিবর্তন করতে হলে, আমার যতটুকু ধারণা, রাষ্ট্রের সংবিধানেও পরিবর্তন আনতে হবে। কাজেই প্রক্রিয়াটি যতটা সহজ ভাবা হচ্ছে হয়তাে ততটা সহজ নয়। কিন্তু এতাে আগেভাগেই আমাদের কেউ কেউ যেভাবে বিতর্ক শুরু করেছেন, এবং কেউ কেউ এমনও বলছেন যে, এ নাম পরিবর্তনের মধ্যে। অবশ্যই একটি দুরভিসন্ধি রয়েছে, আমি অন্তত এসব অতি— অগ্রিম আশঙ্কার সঙ্গে একমত হতে পারি না। পারি না, কারণ, আমাদের এই দেশে, যৌক্তিক কারণ ছাড়াও যেভাবে যত্রতত্র ভারতকে টেনে এনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চলে, আমার ধারণা, তাতে কেউই আমার আদপে লাভবান হই না। শুধু আমাদের দেশেরই বা বলি কেন, খােদ ভারতেরও ধর্মান্ধ এবং ধর্মীয় মৌলবাদী গােষ্ঠীর প্ররােচনায় মুসলমানবিরােধী রাজনীতির যে সাম্প্রদায়িক আবহ তৈরির চেষ্টা করা হয়, এবং আজো হচ্ছে, আমি তারও ঘােরর সমালোচক।

জানুয়ারি, ১৯৯৮

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ হারুন হাবীব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!