You dont have javascript enabled! Please enable it! আক্রান্ত কবি শামসুর রাহমান - সংগ্রামের নোটবুক

আক্রান্ত কবি শামসুর রাহমান

ধর্মীয় মৌলবাদীদের অপকর্মের আরেকটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হলাে জননন্দিত কবি, বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি, মুক্ত প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণে আমাদের সাংস্কৃতিক প্রতীকপুরুষ শামসুর রাহমানকে হত্যার চেষ্টা। আমাদের জাতির, আমাদের ডাষাসাহিত্যের সৌভাগ্য যে, এই ষড়যন্ত্র শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। ঘাতকেরা কেউ পালিয়েছে, কেউ ধরা পড়েছে এবং পুলিশ, যতােটা শুনেছি, এই ষড়যন্ত্রের অনেকটাই উদ্ঘাটন করতে সমর্থ হয়েছে দ্রুত গতিতে। আমার পেশাগত কর্মস্থলে বসে ১৮ জানুয়ারির রাতে ঘটনাটি যখন প্রথম জানতে পাই, তখন বেশ খানিকক্ষণ আমি নির্বাক হয়ে ছিলাম। শুধুই ভাবছিলাম, এ কী সমাজ আমাদের! অন্তত এ কাজটি কী করে সম্ভব! সংবাদ সংস্থার টেলিপ্রিন্টারে রাত সাড়ে ন’টারও খানিকক্ষণ পর দ্রুত গতিতে সংবাদটি সম্প্রচারিত হচ্ছিল বিভিন্ন সংবাদপত্র আর রেডিও-টেলিভিশনে। আমার বিশ্বাস ছিল পরদিন দেশবাসী হতচকিত হয়ে উঠবে, কবি শামসুর রাহমান আক্রান্ত’, বিস্মিত হয়ে উঠবে এ খবরে । কিন্তু রাত সাড়ে ন’টারও পর অনেকটা আকস্মিকভাবে ১৯ তারিখে ঈদ হবে ঘােষণা হওয়ায় সংবাদপত্র আর বেরােয় নি । ভয়ংকর এই খবরটি তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদপত্রগুলাে আর প্রচার করতে পারে নি। ভাবতে অবাক লাগে, শামসুর রাহমানের মতাে একজন আপাদমস্তক নিরহংকার অজাতশত্র মানুষকে, একজন বয়ােবৃদ্ধ কবিকে হত্যা করারও প্রচেষ্টা নেয়া হলাে শেষ পর্যন্ত। ধর্মীয় অন্ধতা বা ফেনাটিসিজম ব্যাপারটি যে মানুষকে কতটা বিবেকবুদ্ধিহানি করে তােলে, কতটা বিচার শক্তিহীন করে, সত্তর বছর বয়স্ক একজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণকে আক্রমণ করতে যাওয়াই তার বড় প্রমাণ। আসলে ধর্মীয় উন্মাদনা আর ধর্মের নামে রাজনীতি ধর্ম থেকেই মানুষকে অনেক দূরে ঠেলে দেয়, এই সাধারণ বিষয়টিও অনেকের মনে থাকে না। ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা ঘনিষ্ঠভাবে জানিনে আমি কবিকে। যৎকিঞ্চিৎ পরিচিতি ছাড়া তেমন ঘনিষ্ঠ যােগযােগও ঘটে নি তার সাথে আমার। তবে শামসুর রাহমান আমার অস্কেয়জন, এ বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্দিধায় বলা যায় আজ তিনি বাংলা ভাষার প্রধান কবি। শুধু তাই নয়, শামসুর রাহমানকে আমি বা আমরা ভালােবাসি তার অনন্য শিল্প-প্রতিতার জন্যে, তাঁর প্রগতিশীল বিশ্বাস আর নিরবচ্ছিন্ন স্বাধীনতাচর্চার জন্যে, যে-সত্য আর সুন্দরের কথা লিখতে গিয়ে বলতে গিয়ে তিনি আজ আক্রান্ত সেই সত সুন্দর আর কল্যাণের পথে তার সাহসী পদযাত্রার জন্যে। শামসুর রাহমান অন কারণ তিনি একদিকে কবিতার মিছিলে, অন্যদিকে গণমানুষের মিছিলে, অণ্ড’ মিছিল রাজনৈতিক দলগােষ্ঠীর বাইরে বেরিয়ে মানবতা আর সমাগমুক্তির “

উচ্চারণ করে। বাংলাদেশের মতাে দেশে যে-কোনাে বিবেকবান মানুষকেই যে-শ্লোগান উচ্চারণ করতে হয়, একজন সমাজ-সচেতন কবিকে, একজন দায়িত্বশীল লেখককে সে শ্লোগান উচ্চারণ করতে হয় তার চেয়েও ঢের বেশি। আর শামসুর রাহমান তাই করেছেন সাহসে, প্রত্যয়ে এবং বিশ্বাসে। কী লিখেন কবি শামসুর রাহমান? কী বলেন এই বয়ােবৃদ্ধ কবি? আমি যদ্র বুঝি, যদ্র জানি, তিনি বলেন তার নিজের বােধ আর বিশ্বাসের কথা। মানুষের আধুনিকতার কথা। কল্যাণের কথা। তার কলমে উচ্চারিত হয় সুন্দর আর সৌহার্দ্য। । তিনি প্রচারিত করেন দেশের মুক্তিযুদ্ধের গীত। আমাদের জাতীয় স্বাধীনতার লাখাে শহীদের কাছে আমাদেরকেই পৌছে দেন শামসুর রাহমান তার কলমের কালিতে। আর এই যদি তার অপরাধ হয়ে থাকে, এই যদি তার পাপ হয়ে থাকে কোন কোনাে বিশেষ মহলের কাছে তাহলে আমি বলব, হে কবি, এই পাপ আপনাকে করতে হবে— যদ্দিন আপনি বাঁচেন। আপনাকে সত্য, সুন্দর আর মানবতার গান গাইতেই হবে। যদ্দিন আপনি বাঁচেন, তদ্দিনই আপনাকে বলতে হবে ধর্মান্ধতার গ্রাসে কোনাে সমাজের মুক্তি নেই। ধর্মীয় উগ্রতায় কোনাে সমাজের অগ্রগতি নেই। না মুসলমানের, হিন্দুর, না খ্রিষ্টানের। ধর্ম ব্যক্তির একান্ত চর্চার বিষয়, সমাজের নয়, রাষ্ট্রের নয়, রাজনীতিরও নয়। আর একমাত্র মানবধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এর বাইরে যে ধর্ম, সে তাে ধর্ম অধর্মের সামিল। আমি বিশ্বাস করি, শামসুর রাহমান আমাদের এ সমাজের এক মহীরুহ। এবং আমার আরও বিশ্বাস, তিনি বিস্ময়করভাবে সুফলা। অনেক বৃক্ষের মতাে তিনি অপয়া বা নিলা নন। এই মহীরুহের ফল আর বিস্তৃত ছায়ার আঙিনা ক্রমান্বয়েই বাঙালির এক। বড় গর্বের আশ্রয় হয়ে উঠছে। তাঁর কবিতা যেমন সমৃদ্ধ করেছে আমাদের সাহিত্যকে তেমনি ব্যক্তি শামসুর রাহমান বাঙালির ঘরের আঙিনায় পাতা শ্রদ্ধার শতরঞ্চিতে আসন পাচ্ছেন আজ, নিঃসঙ্কোচে। দেশের সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের এই কবি স্থান করে নিয়েছেন সব ভূখণ্ডের বাঙালি হৃদয়ে। সীমান্ত তাকে বাঁধতে পারে নি। এই অর্জন একদিকে যেমন একজন জনপ্রিয় কবির, তেমনি প্রাতঃস্মরণীয় এক বাঙালির। কবি আর ব্যক্তি শামসুর রাহমান সে-কারণেই অভিন্ন, যিনি কালের অনেক প্রতিভাধরকে ছাপিয়ে উঠে ধর্ম-বর্ণ ভেদে বাঙালির মনমানসে ভিত গেড়েছেন শক্তভাবে।

অথচ, আমাদের কী দুর্ভাগ্য, সেই শামসুর রাহমানকেই হত্যা করার প্রয়ােজন পড়ে কারও কারও এ সমাজে। ধিক, এরই নাম নাকি রাজনীতি, এরই নাম নাকি ধর্মসাধনা। আমাদের এই বাঙালি সমাজের দুর্ভাগ্যের শেষ কই! ধর্মকে কে কোথায় উপেক্ষা করতে বলেছে আমি জানিনে। কেউ যদি বলে থাকে সে তার নিজের বােধ কিম্বা বিশ্বাস যার সাথে একমত হতেই হবে এমন দিব্যি আমার নেই। কিন্তু ধর্মকে যারা লালন করেন, পালন করেন, সেই অগণিত পৃথিবী-জোড়া মানুষ, সেও তাে তাদের বােধ, বিশ্বাস এবং অধিকার। এ বিশ্বাস থেকে যারা মানুষকে উৎখাত করতে চায়, আমি কখনাে তাদের দলে নই। কারণ আমি ধর্মের অপরাধ দেখি না, যতােটা দেখি ধর্মের অপব্যাখ্যাকারীদের, ধর্মীয় কুংকারের, ধর্মের নামে যারা মানুষকে বিভাজিত করে তাদের, এবং ধর্মকে যারা রাজনীতিতে টেনে এনে ব্যবসার পুঁজি বানাতে চায় তাদের। আমাদের সমাজের দুর্ভাগ্যটা হচ্ছে ধর্মের রাজনীতিকরণের ব্যাপারটি যেখানে কমবার কথা জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের সাথে সাথে, মানুষের মনে যুক্তিবাদিতার বীজ বপনের সাথে সাথে, সেখানে একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ কেবলমাত্র তাদের নিজেদের স্বার্থে সমাজবিবর্তনের স্বাভাবিক সেই পরিণতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। ধর্মের নামে সমাজের সাধারণদের উত্তেজিত করছে। একটি সমাজের জন্যে এ যে কত বড় পাপ তা কি কেউ ওরা বুঝবে। আসলে কে ওদের বােঝাবে, কাউকে হত্যা করে বা কিছুসংখ্যক মানুষকে হত্যা করে কোনাে বিশ্বাসকেই কেউ কোনােদিন মুছে দিতে পারে না, এবং সে-বিশ্বাস যদি আরও জাতির মুক্তিযুদ্ধের রক্তের সাথে গেঁথে থাকে। ছলেবলে-কৌশলে একজন শামসুর রাহমানকে হত্যা করলে যে হাজার শামসুর রাহমান জেগে উঠবে, এই বােধটুকুও ওদের নেই। এই দেশে সাতাশ বছর আগের এক ব্যাপক গণযুদ্ধে স্বাধীনতাকামীরা, প্রগতির ঝাণ্ডাধারীরা, মুক্তবুদ্ধির সমর্থকেরা বিজয়ী হয়েছিল। পরাজিত হয়েছিল ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী প্রগতির শত্রু এবং ধর্মান্ধরা। আর মাত্র সাতাশ বছরে কি এতাে কিছুই ঘটে গেছে যে সেই ইতিহাস পাল্টে দেয়া যাবে। কিছুসংখ্যক মানুষকে হত্যা করলেই কি সেই মাটিসিক্ত চেতনাকে ধুয়েমুছে ফেলা যায়। বাংলাদেশের মাটির বিশ্বাস কি এতােই ঠুনকো ? প্রশ্ন আরও আছে।

গেল আঠারাে তারিখের ওই আঘাত কি কেবলমাত্র ব্যক্তি শামসুর রাহমানের ওপর। যে শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক-অপরাধীদের বিচারের কথা বলেন, যে শামসুর রাহমান সব ধরনের বন্দিত্ব থেকে মানুষকে মুক্ত করতে চান, যেকবি স্বাধীনতার সঙ্গীত রচনা করেন, রাহমুক্তির উপসনা করেন- এ আঘাত তাে সেই শামসুর রাহমানের ওপরই। অতএব মুক্তমনের মানুষকে, স্বাধীনতাপ্রিয় প্রতিটি মানুষকে অবশ্যই এ আঘাতকে মূল্যায়ন করতে হবে বৃহত্তর সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিসরে। সচরাচর আমার কবির বাসায় যাওয়া হয় না। অনেক আগে একবার মাত্র গিয়েছিলাম। পরদিন, অর্থাৎ ঈদের দিন কী মনে করে গিয়ে পৌছলাম শামসুর রাহমানের শ্যামলীর দোতলা বাসঘনটায়। ভাবলাম, আক্রান্ত কবিকে একবার দেখে আসি। এতাে বড় একটা ঘটনা ঘটল, অবশ্যই একবার যাওয়া উচিত। দেখলাম, দুয়ারে পুলিশ বসানাে হয়েছে। বােঝাই গেল সরকার থেকে ঘটনাটিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, একজন কবির বাড়ির আঙিনায় পুলিশের প্রহরাকে আমার কাছে অসহনীয় লাগল। বড় বেশি কষ্টের মনে হলাে। ঘটনার অনেক কিছুই জানা হলাে কবির বাড়িতে গিয়ে। শুনলাম কবিপত্নী আহত হয়েছেন। কবি নিজেও কমবেশি আহত। ঘটনাচক্রে আঘাতগুলাে মারাত্মক হয় নি এই যা। বাড়ির সদস্য আর পড়শিদের ত্বরিত ব্যবস্থা না হলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারত। দেখলাম কবির শুভার্থীরা এক এক করে সবাই আসছেন। একে একে আসছেন আমাদের শিল্পসাহিত্যের পুরােধা ব্যক্তিদের অনেকেই। সবার মুখেই গভীর উৎকণ্ঠা 

আর অবিশ্বাস। টেলিফোনের পর টেলিফোন। সবাই জানতে চান, কবি এখন কেমন আছেন। সবারই জিজ্ঞাসা, এই সমাজ কি এতােটাই পচে গেছে যে কবি শামসুর রাহমানকে পর্যন্ত আঘাত করার উদ্যোগ নেয়া হতে পারে। কিন্তু সমাজের রূঢ় বাস্তবতাটি হচ্ছে এই, হঁা, এই অভাবিত আঘাতটিই করা হয়েছে। কবিকে দেখলাম অনেকটাই দুঃখ ভারাক্রান্ত। আমার একেকটি কথার উত্তর দিচ্ছেন ঠিক কিন্তু ঘটনাটিকে তিনি যেন মন থেকে ভুলতে পাচ্ছেন না। শুভার্থীদের কেউ কেউ উ প্রকাশ করছেন ধর্মীয় মৌলবাদীদের আস্ফালনে। কেউ আবার অভিযােগও করছেন, এই বলে যে, সরকার যদি একোত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করত, যদি আইন প্রয়ােগকারী সংস্থাগুলাে বিদেশী মদদপ্রাপ্ত ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের আস্তানাগুলােকে আগে থেকেই শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিত তাহলে হয়তাে এমন একটি কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটত না। কিন্তু একমাত্র পুলিশি ব্যবস্থায় পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে বলে আমার অন্তত মনে হয়।  এই পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তনের জন্যে প্রয়ােজন আরও বেশি সামাজিক সচেতনতা। তথাকথিত ধর্মবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানাে। প্রয়ােজন আরও বেশি মুক্তিযুদ্ধকে আঁকড়ে ধরা। এগতি আর আধুনিকতার জন্যে যে-শিক্ষার প্রয়ােজন সে শিক্ষায় সাধারণদের শিক্ষিত করে তােলা। সমাজকে বিজ্ঞানমনস্ক করা। নতুন প্রজন্মের মানুষকে অন্তত এই কথাটি বলা যে, ধর্মান্ধতার খাচায় তাদের মুক্তি নেই। মুক্তি ঘরের সংকীর্ণতার বাইরে তাকানােতে। উন্মুক্ততায়। অনেক কথার পর কবি বলেন, তিনি আসলে পুরাে ব্যাপারটিতেই বিস্মিত, শুছিত। তাকে অন্তত কেউ এভাবে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করতে পারে- এ তিনি। কম্মিনকালেও ভাবতে পারেন নি। কথায় কথায় জানালেন, হয়তাে এই তার বড় অপরাধ যে, তিনি তার নিজের বিশ্বাসের কথা বলেন। নিজের বােধে শিল্পৰ্চচা করেন। মানুষের কল্যাণের কথা উচ্চারণ করেন। মুক্তবুদ্ধি আর সামাজিক অন্ধতার সমালোচনা করেন। এবং জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা নিঃসঙ্কোচে বলে থাকেন। বল্লেন, এই যদি তার অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে সে-অপরাধ তিনি করতে প্রস্তুত। কারণ তিনি স্বাধীনতায় আস্থাশীল, কুসংস্কারে নয়। কথাগুলাে শুনে আমার প্রিয় কবির প্রতি আর-একবার আমি মাথা নােয়ালাম। মনে মনে বল্লাম, প্রিয় কবি, আপনি দীর্ঘজীবী হােন!

জানুয়ারি, ১৯৯১

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ হারুন হাবীব