You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঢাকা-কোলকাতার বাস

আগেও লিখেছিলাম, আবারও লিখছি, আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভাষাসংস্কৃতির প্রশ্নটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচিত হওয়া উচিত। বিদেশ-নীতিতে আরও বহুবিধ অগ্রাধিকার থাকবে এবং সেটিই স্বাভাবিক, কিন্তু বাংলাদেশের মতাে দেশের জন্য ভাষা সংস্কৃতি একটি বড় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। সে কারণে আমাদের ভূখণ্ডসংলগ্ন যে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলগুলাে আছে তাদের সাথে আমাদের আদানপ্রদান, যাতায়াত আর ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত হওয়া একান্তভাবে কাম্য। আমরা একে অপরের সহযােগী হিসেবে আবির্ভূত হবে— এটিই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। কারণ আমরা একই ইতিহাস এবং ভাষা সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী, হতে পারে ইতিহাসের সে ঘটনাপ্রবাহ যা সাধারণ মানুষের হাতে তৈরি ছিল না আমাদের বিচ্ছিন্ন করেছে, বিভাজিত করেছে, আমাদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরিয়েছে। কিন্তু আজকের এই আধুনিক যুগেও কেন হাত আমাদের প্রসারিত হবে না একে অপরকে সাহায্য করতে ? উপলক্ষ যদি মানুষ হয়, তাহলে এই বন্ধুত্বের ঘাতকদের পরাজিত করা উচিত। সম্প্রতি দুই পড়শি দেশের সরকারি কর্মকর্তারা একাধিক বৈঠক করে ঢাকা-কোলকাতার মধ্যে সরাসরি বাস সার্ভিস চালু করতে সম্মত হয়েছেন। এই বাস প্রাথমিকভাবে দুই বঙ্গের রাজধানীকে সংযােগ করবে, পরবর্তীতে আজমীর পর্যন্ত চলবে। ঢাকাতে যে কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠক হয়ে গেল তার ফলশ্রুতিতে খুব শিগগিরই দুই দেশের মধ্যে। একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরের সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত হয়েছে। খবরে জেনেছি, আগামী বছরের জানুয়ারিতেই ঢাকা ও কোলকাতার মধ্যে এই বাস চলতে শুরু করবে। প্রায় ৫০ বছর পর দুই বঙ্গের রাজধানী সড়কপথে মিলবে। একজন বাঙালি হিসেবে আমি। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। যদি আর কোনাে নতুন সংকট না ঘটে, তাহলে আমার বিশ্বাস, প্রস্তাবিত সরাসরি বাস চলাচলের এই ঐতিহাসিক সংযােগ সাধারণ মানুষের যােগাযােগ বাড়াতে সহায়ক। হবে। ইতিহাসের তৈরি যে পাপে আমাদের সাধারণ মানুষ বিক্ষত, সেই সাধারণের ক্রমান্বয়ে যুগপ্রাচীন অবিশ্বাস আর অন্ধত্ব থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে আকাশ পথে যাতায়াত করতে এখন একজন যাত্রীকে যেখানে ছয় হাজার টাকা ব্যয় করতে হয় সেখানে সরাসরি বাস সার্ভিস চালু হলে। লাগবে তার দেড় হাজারেরও কম।

সড়ক পথে চলাচল করতে সময় হয়তাে কিছু বেশি। লেগে যাবে, কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য এ পথ অনেকটাই সহনশীল হবে। শুধু ঢাকা-কোলকাতা নয়, আমি মনে করি ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ের সাথেও সরাসরি বাস সার্ভিস চালু হওয়া উচিত। কারণ এ অঞ্চলের লোকজন বা আমাদের দেশের নাগরিকদের মধ্যে যাতায়াত কখনােই থেমে নেই। রাজনীতির যত টানাপােড়েনই থাক না কেন, প্রয়ােজন মানুষকে সীমান্ত পাড়ি দিতে বাধ্য করেছে চিরদিন। বেশির ভাগ মানুষ এখন ট্রেনে-বাসে চেপে বর্ডার পর্যন্ত যাচ্ছে, তারপর রিকশায় বা পায়ে হেঁটে। আর অবস্থাপন্নরা এ অঞ্চলে তাদের যাতায়াত অব্যাহত রেখেছে কোলকাতা হয়ে আকাশ পথে। একইভাবে কোলকাতা বা ভারতের আর কোনাে জায়গা পর্যন্ত পৌছতেও যশাের-বনগাঁ, হিলি বা অন্যান্য সীমান্ত ফাঁড়ি দিয়ে প্রতিদিন চলছে শত শত মানুষ। ওপার থেকেও আসছে শত শত। অতএব যােগাযােগকে কখনাে বা কোনাে সরকারের আমলেই থামিয়ে রাখা যায় নি বা বন্ধ করা সম্ভব হয় নি। তাই একে সাধারণদের সহজলভ্য করতে দোষটা কোথায়? আমার যদি টাকা থাকে তাহলে আমি ভারতীয় দূতাবাস থেকে একটি ডিসা যােগাড় করে প্লেনে উঠে সােজা চলে যেতে পারি কোলকাতা, যেতে পারি দিল্লি বা বােম্বে। আর টাকা না থাকলে নিতান্ত প্রয়ােজনেও আকাশ পথে যেতে পারিনে। বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত, ঢাকা থেকে বাসে চেপে প্রথমে যশাের, তারপর বেনাপােল, এরপর বর্ডার পাড়ি দিয়ে পায়ে টানা রিকশায় কিম্বা অটোরিকশায় চেপে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বনগাঁ । তারপর হয় ট্রেনে না হয় বাসে কোলকাতা। কোলকাতা থেকে যার যার প্রয়ােজন মতাে ট্রেনে চেপে ভারতের বিভিন্ন জায়গায়। কথা হচ্ছে, যাতায়াত আমাদের কখনােই বন্ধ নেই। সেই পাকিস্তান আমলেও নয়, আর এখনাে নয়। একমাত্র ১৯৬৫ সালের ভারতপাকিস্তান যুদ্ধের সময় ক’দিনের জন্য বন্ধ থাকলেও আর কখনােই এটা বন্ধ হয় নি। শুধুমাত্র মােল্লাবাদিদের চাপে কিম্বা ধনিক শ্রেণীর রাজনীতি ব্যবসার প্রয়ােজনে এই যাতায়াত সহজ এবং সুলত হতে পারবে না কেন? যারা বিনে পাসপাের্টে পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরা-আসামের সীমান্ত পাড়ি দেয় সেই স্মাগলারদের জন্য কখনােই তেমন সমস্যা হয় নি।

এরা এক অর্থে স্বাধীন আন্তর্জাতিক নাগরিক! সীমান্তরক্ষীদের সাথে কিম্বা পারাপার করে দেয়ার বিশেষ শ্রেণীর ‘ট্রেডারদের সাথে যােগসাজশে এরা যখন-তখন দুদিকেই চলাফেরা করতে পারে। যখন ইচ্ছে ওখান থেকে এখানে আর এখান থেকে ওবানে চলতে পারে। আর পারে যাদের টাকা আছে তারা। কিন্তু পারবে না শুধু নিয়মসিদ্ধ সাধারণ মানুষরা! এটা কোন ধরনের নীতি। আসলে, সাধারণ মানুষের জন্য সরাসরি এবং স্বল্প মূল্যে যাতায়াত ব্যবস্থার প্রবর্তনের এই সিদ্ধান্তটি, মনে প্রাণে আমি বিশ্বাস করি, এ যুগের দাবি। যারা এর বিরােধিতা করতে চায় তারা শুধুমাত্র তাদের দলীয় বা গােষ্ঠীগত ক্ষুদ্র রাজনীতি স্বাথে তা করে বলে আমি ভাবতে বাধ্য। এদের সবাই এরােপ্লেনে কলকাতা বা দিল্লিবােম্বেতে সরাসরি যাতায়াত করবে, কিন্তু কম খরচে সাধারণ মানুষ যাতায়াত করলেই যত অপরাধ। যে-কোনাে সচেতন আর অসাম্প্রদায়িক মানুষেরই মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে আমাদের এই মাটিতে পাকিস্তানি ধারার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চালু করার নিরন্তর চেষ্টা চলছে। এই শ্রেণীর রাজনীতিবিদরা ধর্ম-চর্চা করে না করে ধর্মের নামে যুগপ্রাচীন এমন এক রাজনীতি যা মানুষকে অন্ধত্ব আর কুসংস্কারে আবদ্ধ করে।

আমি বিম্বিত হই যখন এদেরই কেউ কেউ বলে, ঢাকা-কোলকাতার বাসগুলাে চলতে দেয়া হবে না, সরাসরি যােগাযোেগ চলবে না ইত্যাদি। আমরা নিজেরা আমাদের পােশাক-আশাকে আধুনিক হবাে, চলনে বলনে মুক্ত হবে, কেবলমাত্র রাজনীতি করতে গেলেই প্রাচীনপন্থী হতে হবে কেন? আজকের পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা যা হয় তার বেশির ভাগই হয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। যদি দেখতেই হয় দেখতে হবে আমরা এ বাস সার্ভিসে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি না। লাভবান হচ্ছি। এখানে ইকনােমিক্স’ বড়, কোনাে বিশেষ রাজনৈতিক দলগােষ্ঠীর ‘পলিটিক্যাল এজেন্ডা’ বড় নয়। যদি প্রয়ােজনই হয় তাহলে দেখতে হবে বাসগুলাে দিয়ে বাংলাদেশের সােনাদানা, ঘরবাড়ি, নদ-নদী বা সহায়-সম্পদ সব লােপাট হয়ে যাচ্ছে কিনা বা ভারতীয় বাসগুলাে কেবলমাত্র তাদেরই নাগরিক পারাপার করছে, বাংলাদেশের করছে না। এসব না করে শুধুমাত্র গলাবাজি করে লাভ নেই। বাস দিয়ে, এরােপ্লেন দিয়ে বা নৌকো আর স্টিমার দিয়ে কোনাে দেশের স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্ব পাচার হয়ে যায় না। বাংলাদেশের মতাে দেশের স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্ব যা ত্রিশ। লাখ মানুষের রক্ত দিয়ে গড়া— এতটা ঠুনকো ভাববার কারণ নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই শ্রেণীর রাজনীতিবিদরা আমাদের সমাজে কিন্তু একেবারে ব্যর্থ হয় নি। কখনাে কখনাে এরা সফলও হয়েছে। মন্দও কখনাে কখনাে বিজয়ী হয়। এই ট্র্যাজেডি পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি জাতিগােষ্ঠীকেই কমবেশি বহন করতে হয়েছে। কিন্তু এরপরও বলবাে মন্দচিন্তার প্রবক্তাদের শেষ পর্যন্ত পরাজয় ঘটেছে। শুভচিন্তার বিজয় হয়েছে। আজ যারা ঢাকা-কোলকাতা বা ঢাকা-কোলকাতা-আজমীর ডাইরেক্ট বাস। সার্ভিসের বিরােধিতা করছে—তারা আসলে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে এখনাে। সন্তুষ্ট হতে পারে নি। পাকিস্তানের ধর্মাশ্রিত রাজনীতি ধারার প্রবক্তারা যা চেয়েছিল— সেটিই এরা এত বছর পর আবারও চালাতে চায়। অর্থাৎ এরা চায় ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক বিভাজন। চায় ধর্মের উপলক্ষে এক ভাষা সংস্কৃতির মানুষের বিভক্তি এবং চায় ধর্মের কথা বলে মানবতাকে আরও খণ্ডিত করতে। তাই বলি, শুভবুদ্ধিসম্পন্নদের সরবে প্রতিবাদ করতে হবে, কারণ আমাদের সমাজে এরাই মেজরিটি’। এ উপমহাদেশের মানুষরা ধর্মকে উপলক্ষ করে অনেক রক্তপাত দেখেছে। যে ধর্ম মানুষের ব্যক্তিক সম্পদ বা একান্ত ব্যক্তিক আরাধনার বিষয়, সেই ধর্ম দিয়ে এরা মানুষেরই রক্তের হােলি খেলেছে। পাপিষ্ঠরা যে আচরণ করে এই শ্রেণীর মাজনীতিবিদরা তাই করেছে। তবু তাদের সে স্পৃহা কমে নি। এরা আসলে মাজনাতিবিদ নয়, রাজনীতির ট্রেডার’- এদের চিহ্নিত করতে না পারলে সমাজের প্রগতি বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য।

জুলাই ১৯৯৭

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ হারুন হাবীব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!