You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাঙালির খণ্ডিত নববর্ষ, খণ্ডিত রবীন্দ্র-নজরুল

গেল ১লা বৈশাখে প্রায় একই ধরনের একটি লেখা আমি লিখেছিলাম। লিখেছিলাম, কারণ, আমার ধারণা, আমাদের নববর্ষ ক্রমশই খণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রাণের রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল দ্বিখণ্ডিত হচ্ছে। অথচ সবাই তা চেয়ে চেয়ে দেখছি। আমার আরও ধারণা যে, বাঙালির বারাে মাস বঙ্গের জীবনকে এমনই প্রভাবিত করে যে, আমরা যতােই পশ্চিমী’ কিম্বা ‘আধুনিক’ হই নে কেন, আমাদের মাটি জলবায়ুর প্রভাব থেকে আমরা কখনােই বেরােতে পারি না। ইংরেজির জানুয়ারি আমাদের অনেক বেশি আপন হয়েছে, অস্বীকার করি নে। কিন্তু বৈশাখের তাপকে আমরা যেমনটা অনুভব করি, তেমনটা কি আর কোথাও পাই। আমার তাে মনে হয় পৌষ-মাঘের আবহাওয়া আমাদের গ্রাম-বাংলাকে যেভাবে কাপিয়ে দেয়, শিহরিত করে, ডিসেম্বরজানুয়ারি তা পারে বলে সন্দেহ। আর চৈত্রের কথা তাে বলাই বাহুল্য। চৈত্র মানেই এই বাংলার চিরায়ত এক খা খা রূপ— তা সে পূর্ববঙ্গ হােক কি পশ্চিমবঙ্গ। ইংরেজির কোন মাসে তা পড়ল তা পঞ্জিকা গুণে আবিষ্কার করার বিষয় হয় মাত্র। এবং ভাদ্রের আকাশে চোখ ফেলে একমাত্র ভাদ্র ছাড়া আর কী মনে হয়। আমাদের নতুন পঞ্জিকা মতে ১৪০৫ সালের পহেলা বৈশাখ পড়েছিল এপ্রিলের ১৪ তারিখ । ১৪০৬ সালের ১লা বৈশাখ এপ্রিলের ১৪। তবে এই বাংলাদেশের কোথাও কোথাও এপ্রলের ১৫ তারিখেও বাংলা শুভ নববর্ষ পালিত হয়েছে। না, শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা আসাম-ত্রিপুরার বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চলেই নয়, খােদ বাংলাদেশেও অনেকে এপ্রিলের ১৫ তারিখকেই বৈশাখের ১লা দিন ধরে নানান চিরন্তন আনুষ্ঠানিকতা সেরেছে। দৈনিক গুলােতে দেখেছি, আগের বছর আমাদের ব্যবসায়ীরা তাদের হালখাতা খুলেছেন মঙ্গলবার, এবারে বুধবার অর্থাৎ এপ্রিলের ১৫ তারিখ। কারণ আমাদের নতুন এবং ওদের সনাতনী পঞ্জিকার সৃষ্ট বিভ্রাটে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও বিভ্রান্তি দেখা গেছে। যুগ যুগ ধরে তারা যে পঞ্জিকা দেখে তাদের কাজকর্ম সেরেছেন হঠাৎ নতুন কিছু চাপিয়ে দিলে যা হয়! অতএব সনাতনী পথেই তারা তাদের ১লা বৈশাখের কাজকর্ম সেরেছেন। হালখাতার পর্ব সেরেছেন। গান-বাজনার আয়ােজন করেছেন।

নতুন খাতা খুলেছেন আগের দিনে বাঙালির নববর্ষ পালনের রীতি সীমিত ছিল কেবলমাত্র একটি কি দুটি বিশেষ শ্রেণীর মধ্যে। সেকালে বাংলা নববর্ষ অর্থবহ আনন্দের দিন ছিল ব্যবসায়ী বা মহাজনদের, যারা গরিব কৃষকদের প্রান্তিক চাষীদের কাছে বাকিতে পণ্য বিক্রি করত, ঋণ দিত এবং বছরের পয়লা দিনে তা পরিশােধের চেষ্টা করত নতুন খাতা খুলে। সাধারণ কৃষক বা গ্রাম-গঞ্জের গরিব শ্রেণী নববর্ষকে বুঝত তখন হালখাতা’ নামে, যা তাদের কাছে তেমন সুখকর একটি ব্যাপার ছিল না। বাদ্যবাজরাও যে কখনাে কখনাে সুখের হয় না। প্রাচীন বাংলার হালখাতা তার এক প্রমাণ। ব্যবসায়ীরা বাদ্যবাজনা বাজিয়ে নতুন খাতা খুলত, মিষ্টিমুখ করাত আর ঋণগ্রস্ত কৃষক বছরের শুরুতে সেই খাতায় তাদের নাম তুলতাে পুরননা পাওনা বুঝিয়ে, যদ্র সম্ভব। আমার ধারণা, হালখাতা সংস্কৃতির মাঝ দিয়ে আমাদের প্রাচীন বাংলার অর্থনীতির কমবেশি একটি চেহারাও বেরিয়ে আসে নিঃসন্দেহে। আমাদের ছেলেবেলাতেও নববর্ষের আদি এই রূপ আমরা দেখেছি। আসলে পয়লা বৈশাখের ইদানীংকার যে সাংস্কৃতিক রূপান্তর— তা একেবারেই প্রাচীন নয়। তবে দুঃখ দৈন্য আর মহাজনদের দেনা বুঝিয়ে দেবার দিনক্ষণ হলেও ১লা বৈশাখ একেবারে নিরানন্দ ছিল না তখনাে। চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজনের মেলা, যদিও তা হিন্দু সম্প্রদায়েরই মুখ্যত, সে মেলাতে মিশে যেত হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। গঙ্গা-খাজা, পুতুল আর মাটির কলস, বাসন, খেলাধুলা, হরেক রকমের তৈজসপত্র ভরা। থাকত সে মেলায প্রাচীন সেই মেলাপ্রথা আজ অবশ্য অনেকটাই সীমিত। হিন্দু বাড়িতে চৈত্র সংক্রান্তি আর ১লা বৈশাখের ধর্মীয় আচারের ব্যাপারগুলােও এখন আর আগের মতাে নেই। কী আজকের বাংলাদেশ কী পশ্চিমবঙ্গ কোথাও আগের রীতিনীতি নেই। উবে যাচ্ছে পুরননা, আসছে নতুন। শহরাঞ্চলগুলিতে হালখাতার হাঁকডাক এখন আর নেই বললেই চলে। সেকালের গ্রামীণ সমাজ দ্রুত আধুনিক নগর সমাজে পরিণত হচ্ছে। বিদ্যুতায়ন হচ্ছে। যােগাযোেগ অবিশ্বাস্যভাবে সহজ হচ্ছে। কৃষিকাজ যান্ত্রিক হচ্ছে, কলকারখানা গড়ে উঠছে। ফসলের ফলন আর তার পদ্ধতির রূপান্তর ঘটছে, ব্যবসা বা ব্যবসায়ীর চেহারা পাল্টাচ্ছে, জীবন ধারণের পদ্ধতি বদলাচ্ছে, এমনকি এক মানুষের হাতে আরেক মানুষের শােষণের চেহারাটিও বদলে যাচ্ছে। কাজেই ধরেই নেয়া যায় বাংলা নববর্ষের সেই প্রাচীন চেহারা আমাদের সমাজে আর ফিরে আসবে না।

কিন্তু আমাদের নববর্ষ তা আমাদেরই। একে যদি আমরা মনেপ্রাণে গেথে নিতে না পারি তাহলে আমরা কী বাঙালি থাকি। দুঃখ হয় তথাকথিত আধুনিকতার’ নামে জোর করে পশ্চিমী’ হবার সুবাদে আমাদেরই একশ্রেণীর তরুণ ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’-এ যেভাবে হই-হুল্লোড় করে। আমরা পশ্চিমী শিল্প-উন্নত দেশগুলাে। থেকে অনেক কিছুই শিখতে পারি, অনস্বীকার্যও তা, কিন্তু ওদের অসভ্যতা আর। বেলেল্লাপনাগুলােকেও কি আমাদের আত্মস্থ করতে হবে। শুধু বাংলাদেশে কেন, এখনকার পশ্চিমবঙ্গ আর আসাম-ত্রিপুরাসহ গােটা বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে নববর্ষ উদযাপন বাঙালি জীবনের আধুনিক এক সাংস্কৃতিক রূপ। রবীন্দ্রনাথ আর তার শান্তিনিকেতনকে ঘিরে বাংলা নববর্ষ নতুন এক মাত্রায় উদ্ভাসিত হয়েছিল। সেই ধারা শেকড়ও গাড়ে বাঙালি মানসে যথেষ্ট। ১৯৪৭ সালে ভারত  উপমহাদেশের রাজনীতি-ধারায় অ-সাম্প্রদায়িকতাবিদ্ধ হয় বাঙালি, কর্তিত হয় তার ভূখণ্ড। এই রক্তাক্ত রাজনৈতিক বিভাজনের পরও অনেকদিন বাংলা নববর্ষের তেমন হেরফের হয় নি। তবে ইদানীং হচ্ছে। যেন অনেকটাই তার দুই চেহারা হয়ে উঠছে। পাকিস্তানি ধর্মীয় জিগিরে সেদিনের পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে কিছু কালের জন্যে হলেও বাঙালির নববর্ষ উদযাপন তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। একশ্রেণীর রাষ্ট্রপালিত(!) বুদ্ধিজীবীরাও সুযােগ গ্রহণ করে তখন। তারা কাল্পনিক পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতে শুরু করে এবং সরাসরি সে আঘাত চলতে থাকে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযােগিতায়।

সে ছিল বাংলা নববর্ষের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ওপর বড় ধরনের এক সাম্প্রদায়িক আঘাত, সৌভাগ্যক্রমে যার প্রতিঘাতও হয়েছিল, ঠিক তখনি না হলেও কিছুকাল পর। সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রনাথকে উপেক্ষা করার মতাে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু তারা তা পারেন নি। পারা সম্ভবও ছিল না। কারণ রবীন্দ্রনাথ বাঙালির সাংস্কৃতিক আত্মা, যাকে বিভাজন করার চেষ্টা ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র। বাঙালির জীবনে অনেক ব্যর্থতা আছে, পাপও আছে অনেক। কিন্তু সাফল্য কি একেবারে কম। সম্রাট আকবর হিজরী সনের সাথে সঙ্গতি রেখে সন গণনার যে পদ্ধতি বের করেছিলেন, তার সাথে বাংলা সনের আদি ইতিহাস গাথা আছে। বৈশাখের প্রথম দিনটি নাকি স্থির করা হয়েছিল খাজনা আদায়ের সুবিধের জন্যে। এর আগে নতুন বছর শুরু হত অগ্রহায়ণে, যদি বা এই সব গণনায় এক ধরনের বৈপরীত্য আছে, কিন্তু আকবর প্রচলিত পঞ্জিকাই আমাদের মাটিতে শেষ পর্যন্ত স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানি আমলের প্রথম দিকে আকবরের সমন্বয়বাদী রাষ্ট্রনীতি, এবং সেই সাথে তার অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদি আর ধর্মনিরপেক্ষ উদারনীতির দিকটিকে ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়। চেষ্টা হয় বাংলা নববর্ষকে ঘিরে রবীন্দ্রনাথের হাতে গড়া নবসাংস্কৃতিক উৎসবের চেহারাকে পর্যন্ত ভুলিয়ে দেয়ার।

অবশ্য তথাকথিত ধর্মবাদীরা শেষ পর্যন্ত সফল হয় নি। জাত বিভাজনের রাষ্ট্রীয় চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সেদিনের পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানে, ষাটের দশকের শুরু থেকে, ১লা বৈশাখকে ঘিরে গড়ে উঠতে থাকে বাঙালির এক নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলন। বাংলা নববর্ষ পেতে শুরু করে এক নতুন দ্যোতনা। বাঙালির জেগে ওঠার প্রেরণা ঐ সব সাংস্কৃতিক আন্দোলন থেকে প্রভূত উপকৃত হয়। গড়ে ওঠে এক নতুন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই আন্দোলন গড়ে ওঠে মূলত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে। কিন্তু এর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে যায় সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতেও। বলতে বাধ্য, ষাটের দশকের শুরু থেকে বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরবর্তী রাজনৈতিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এ হচ্ছে ১লা বৈশাখ উদ্যাপনের কিম্বা অধুনা বাংলা নববর্ষ পালনের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত, যার সীমাবদ্ধতা আজকের বাংলাদেশ বা সেদিনের পূর্ব বাংলা কিম্বা পূর্ব পাকিস্তানে। ঔপনিবেশিক ভারত ভেঙে সেদিনের অখণ্ড বঙ্গভূমি খণ্ডিত হলেও বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি কখনাে খণ্ডিত হয় নি, খণ্ডন করাও যায় নি, যদিও বাংলার এই রাজনৈতিক খণ্ডনকে পুঁজি করে বাঙালিকে দুই জাতি বানাবার চেষ্টা কম হয় নি। তবে সাম্প্রতিককালে আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলা নববর্ষও দুটো হয়ে গেছে। বাংলাদেশে একদিন ১লা বৈশাখ পালিত হচ্ছে আবার পশ্চিমবঙ্গ আসাম-ত্রিপুরার বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে পালিত হচ্ছে অন্যদিন। শুধু তাই নয়, পঞ্জিকার এই বিভ্রান্তির ফলে বাঙালির গর্বের রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীগুলােও এপারে এবং ওপারে আলাদা আলাদা দিনে পালিত হচ্ছে। যেমন এবারের ২৫শে বৈশাখ পালন করেছি আমরা মে মাসের ৮ তারিখ, অর্থাৎ শনিবার। অন্যদিকে কোলকাতাসহ অন্যান্য জায়গায় হলাে তা মে’র ৯ তারিখ, অর্থাৎ রােববার। দূরদর্শনে দেখলাম, ঢাকার গুণী শিল্পী মিতা হক কোলকাতায় গিয়ে দিব্যি রােববারে রবীন্দ্র জয়ন্তীতে গান গাইলেন। অর্থাৎ বােঝাই যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথও দ্বিখণ্ডিত হচ্ছেন। এবং আমরা ক্রমশই তা মেনে নিচ্ছি। কেউ কোনাে প্রতিবাদ করছি না। বাংলাদেশে নববর্ষ পালন করে গিয়ে কোলকাতায় পরদিন আবার পয়লা বৈশাখ পালন করা যাচ্ছে এখন। আমি জানি না, সুদূর উত্তর আমেরিকা আর ইউরােপে বসবাসরত বাঙালিরা কী করছেন। হয়তােবা কেউ একদিন কেউ অন্যদিন। অর্থাৎ ভারতের বাঙালিরা একদিন আর আমরা অন্যদিন। অথচ ইংরেজি নববর্ষের তাে এই সংকট হচ্ছে না। আরবি, চৈনিক বা জার্মান নব-বর্ষেও নয় ।

পৃথিবী জুড়ে ১লা জানুয়ারি একই দিনে সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে। কেবলমাত্র আমরাই নিজেদের বিভাজিত করছি। বিভাজিত করছি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। আমাদের বাংলা একাডেমী কিছুকাল আগে যে পঞ্জিকা নিরূপণ করেছে তাতে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিলকে ১লা বৈশাখ ধরা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ইংরেজি পঞ্জিকার যতই হেরফের হােক— এই দিনের হেরফের হবে না। যদূর জানি, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারে হাত দিয়েছিলেন। অবশ্য তিনি তা শেষ করে যান নি। বাংলা একাডেমী একটি কমিটির মাধ্যমে পরে তার পূর্ণতা দিয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ১লা বৈশাখ পড়ছে এপ্রিলের ১৫ তারিখ, ওদের প্রচলিত পঞ্জিকা মতে। আমি নিজে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কেউ নই, তবু বলতে পারি, এ সংকটের একটা আশু সমাধান টানা উচিত। আমরা কতটা শুদ্ধ আর ওরা কতটা পরিশুদ্ধ, এর চেয়ে বেশি বিবেচনায় আনা উচিত— এ দ্বন্দ্বে আমরা অবচেতনে বাঙালির বাঁধনকে আবারও হালকা করছি কিনা। একই ভাষাভাষী, একই প্রকৃতি আর একই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের যে বাঙালি তাদের নববর্ষ কেন দুইদিন হবে, এ প্রশ্ন অবশ্যই করা যেতে পারে। করছিও আমি তা শক্তভাবে। প্রশ্ন করা যেতে পারে রবীন্দ্র আর নজরুল জয়ন্তীর মতাে বাঙালির জাতীয় উপলক্ষগুলােকে কেনইবা আমরা ভিন্ন ভিন্ন দিনে পালন করব। বাংলা ভাষাভাষীরা আগে পূর্ব আর পশ্চিমবঙ্গে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন তা নেই। বঙ্গ খণ্ডের গা জুড়ে বাংলা ভাষাভাষীদের তৃতীয় একটি ডুবন গড়ে উঠেছে আসাম আর ত্রিপুরায় সেখানেও বহুকাল থেকে চর্চা হচ্ছে বাংলা ভাষাসাহিত্যের। ইউরােপ আর উত্তর আমেরিকাতেও বাঙালিদের আরও দুটো শক্ত ভুবন গড়ে উঠেছে। দিন যতােই যাবে- এ বনগুলাে আরও বেশি শক্তিশালী হবে। বাঙালি এক ভূখণ্ডে বসবাস করবে- এমন ভাববার যুক্তি নেই, কিন্তু সব ভূখণ্ডের বাঙালিদের নববর্ষ হবে একটি, সব ভূখণ্ডের বাঙালিদের রবীন্দ্র আর নজরুল জয়ন্তী একই দিনে পালিত হবে এ ইচ্ছেটা সঙ্গত কারণেই করা যেতে পারে। বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের বিদষ্ট গুণীজনদের অবশ্যই এই সংকট নিয়ে ভাবতে হবে। অবশ্যই এ বিভাজন ঠেকাতে হবে। আর এ সংকট সমাধান করতে ব্যর্থ হলে আমরা ক্রমান্বয়েই নিজেরা নিজেদের বিভাজিত করব।

এপ্রিল, ১৯৯৮

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ হারুন হাবীব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!