You dont have javascript enabled! Please enable it! বাঙালিকে মনের সীমান্ত ভাঙতে হবে - সংগ্রামের নোটবুক

বাঙালিকে মনের সীমান্ত ভাঙতে হবে

এটা সত্য যে, বাংলাভাষী মুসলমানদের অনেকের মধ্যেই জাতীয়তা সংকটের সুরাহা হয় নি। বাংলাভাষা হিন্দুদেরও অনেকেই ধর্ম কেন্দ্রিক জাতীয়তা দোষে নিজেদের। আবন্ধ রেখেছেন সমভাবে। যে কারণে বাঙালি, তার হাজার বছরের ইতিহাসঐতিহ্যের পরেও, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখনাে হয় হিন্দু বাঙালি নয় মুসলিম বাঙালি খুব সুপ্তভাবে নয়, ধর্মের এ পরিচয় প্রায় প্রকাশ্যেই এ বিভক্ত উপমহাদেশের বাঙালি জনগােষ্ঠিকে বিভাজিত করেছে। এখনাে যা করছে। সে কারণেই আমরা জাত পরিচয়ে সর্বাংশে বাঙালি হয়ে উঠি নি। ধর্মের কোন্দল বা পরিচয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের বৃহত্তর জাতিসত্তাকে আক্রান্ত করেছে। বাঙালির জন্য এ এক ট্রাজেডি, যা তার অনেক দুর্দশার কারণ আমার বিশ্বাস জাত-পরিচয়ের এই সংকট বাঙালির যৌথ এবং বৃহত্তর প্রগতি বিকাশের পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায়। বাঙালি অনেক ক্ষেত্রেই বাঙালি, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তারা এক বাঙালি সস্তার প্রধানতম শত্রু ও যে সত্তায় ধর্ম-বিশ্বাস মানুষকে বিভাজিত করে না সেই সত্তায় বৃহত্তর বাঙালি সমাজ আজো পৌছতে পারে নি। এ আমাদের নিদারুণ জাতীয় এক ব্যর্থতা এ বিভাজন বাঙালিকে সর্বাংশে মানুষও যেমন করে নি— বাঙালিও করে নি একই সঙ্গে। ত্রিপুরার কবি-বন্ধু অরুন্ধতী রায় তাই কবিতা লেখেন, ‘বাংলার মুখ দেখি নি আমি পৃথিবীর রূপ তাই দেখা হয় নি আমার  দেখি নি বাংলা একাডেমী বা রমনার প্রান্তর ওরা শুধু বাসা বেঁধে আছে আমার মনের ভেতর। অরুন্ধতী রায়ের এই আকুতি সমগ্র বাঙালির আকুতি- সে বাঙালি কে কোথায় আছেন বা কোন ভূখণ্ডে আছেন— তা বড় নয়। বাঙালি, ধর্মাশ্রিত রাজনীতিবিদদের শত অপকর্মের পরও নৃতাত্ত্বিক এবং জাতিগতভাবে এক এই সত্তাকে সাময়িক বিভাজিত করা যেতে পারে চিরদিনের জন্যে নয়। রাজনীতিবিদদের হাতে তৈরি যে অন্তত সীমান্ত সেটাই শেষ সত্য নয়। আমি আমার অন্তর-উপলব্ধি থেকে কথাটি আজ। উচ্চারণ করছি। এই চৌদ্দশ’ শতকে বাঙালি অতীতের অনেক ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠবে, অনেক অপরাধ আর ভ্রান্তিমােহ তার শুধরাবে, এও আমার বিশ্বাস। আজকের এ যুগ নিজেকে চিনবার যুগ পৃথিবী শুদ্ধই এ প্রয়াস শুরু হয়েছে। কারণ, নিজেকে না চিনলে অপরকেও চেনা যায় না। আমাদের যুগগুলােকে যতটা অবহেলায় আমরা কাটাতে চাই, ঠিক ততটা অবহেলায় তারা আসলে কাটে না। এককালের পূর্ববঙ্গের ১৯৫২ সাল, আর ১৯৭১ সে কারণে স্বতন্ত্র অবিধায় আবির্ভূত।

বাঙালির জীবনে ১৪শ’ সাল আর অন্যান্য নতুন সালের মতাে স্মৃতিতে দাগ না কেটেও চলে যেতে পারত কিন্তু তা হয় নি। এর প্রধানতম কারণ রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির গহীনঅন্তর— যে অন্তর পৃথিবীর আর সব জাতি-গােষ্ঠীর সমার্থক নেয়, সংগত অর্থেই। এই চৌদ্দশ’ সালের স্মৃতিময় উদযাপনে দেখেছি, বাঙালি বাঙালিকে চিনতে চায়— এমন এক আকুতির পুনরুজীবন এখন ঘটছে। ঢাকা এবং আমাদের স্বাধীন এই বাঙালির রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি নাগরিক জীবনে বাঙালি সত্তার পুনরুজীবন ঘটছে। যেমনি ঘটতে শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায়, আসামের নানান জনপদে, এমনকি পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও। আমার এই লেখাটি বেরুবে ১৪০৩ সালের ১ বৈশাখে। এই চৌদ্দশ’ শতকে, যে শতক শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কাব্যধন্য হয়ে এবং বিশ কোটি বাঙালির জীবন-হেঁয়া আবেগে, সেই শতকে জাতি সত্তার বিরুদ্ধে বাঙালি তার আপন সৃষ্ট অপরাধ বুঝতে পারবে, এ আমার এক গভীর আত্মবিশ্বাস। বাঙালি একাধিক ভূখণ্ডে আজ ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতিবিদের হাতে বিভক্ত। দেশ বিভাগ এক বাঙালিকে ভূখণ্ডগতভাবে বহুধা বিভাজিত করেছে। কিন্তু বাংলা ভাষা কখনাে বিভাজিত হয় নি। বাংলা সাহিত্য বিভাজিত হয় নি, বাংলা কৃষ্টিসত্যতা আজো বিভক্ত হয় নি। বাংলা ভাষায় কবিতা আজ বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামে একইভাবে সমাদৃত।

সমাদৃত বাংলা ভাষার গল্প-চিত্রকলা, উপন্যাস রাজনীতির খণ্ডিত সীমান্তের এপারে এবং ওপারে। বহুকাল ধরেই ঢাকায় একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের বাঙালিদের মতাে একইভাবে হৃদয়কম্পন তােলে ত্রিপুরাতে, আসামে এবং পশ্চিমবঙ্গে। ১৯ মে রাজ্যের অন্যতম ভাষা বাংলার দাবিতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলাে ১১জন বাঙালি যােদ্ধা-নারী এবং পুরুষ অগণতান্ত্রিক অহমীয়া অধিকারের বিরুদ্ধে। অথচ কতজনেই বা আমরা সেই ইতিহাস জানি ? যে কারণে বলি, রাজনীতির সীমান্ত থাকলে থাক, না থাকলে না থাক, আমাদের মনে সীমান্ত ভাঙাটাই এই চৌদ্দশ’ শতকের বড় কাজ। ধর্ম এক অন্তর বিশ্বাস। এ বিশ্বাসে যারা অন্ধ, বিশেষত যারা অন্যের ধর্মে শ্রদ্ধাশীল নয়, তারা ধার্মিক হয় না কখনাে। ধর্ম সহনশীলতা শেখাবার কথা বলে, প্রতিটি ধমেই। কার্যত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এর উল্টোটা হয়েছে। আগেকার কালে ধর্মের বাহিনী রাজ্য দখল করত এবং তা করতে গিয়ে ধ্বংস, রক্তপাত ঘটাত। সম্প্রতিককালে রাজ্য দখল হয় না, হয় ধর্মের অসহিষ্ণু ঘােড়ায় চড়ে পাশের বাড়ি বিজয়। ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনীতির পুরনাে প্রবৃত্তি লােপ পায় নি। এ প্রবৃদ্ধি মানবতার জন্যে যেমন শুভ নয়, শুভ নয় তেমনি সমাজ প্রগতির জনন্য। বাঙালিকে তাই বাঙালি হতে হবে সর্বাগ্রে। কপট রাজনীতিবিদদের হাতে, ধর্মান্ধদের হাতে, ধর্মীয় মৌলবাদিদের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে বাঙালিকে জাতীয়তাবােধে উজীবিত হতে হবে। যে সীমান্ত মানুষকে, মানবতাকে বিভাজিত করে, সেই সীমান্তকে ভাঙতে হবে। বাঙালির ললাট যত বড় বড় কষ্ট তার লজ্জার কন্টক তিলক পরিয়ে দিয়েছে— তার প্রায় প্রতিটি সভ্যতাহীন কপট রাজনীতির ফসল। বাঙালির নিজের বলে একটা বিশ্ব আছে, হাজার বছরের ইতিহাস আছে। সেই সভ্যতা আর আপন ইতিহাসঐতিহ্যই বাঙালিকে বিজয়ের কোরাস গাইতে প্রলুব্ধ করতে পারে।

মার্চ, ১৯৯৬

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ হারুন হাবীব