You dont have javascript enabled! Please enable it!

প্রকৃত মুক্তিযোেদ্ধাদের তালিকা এবং সম্মান

এই বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার মুক্তিযুদ্ধের সরকার হবে, জাতির মুক্তিসংগ্রামের চেতনায় উদ্ভাসিত হবে। এটিই হবার কথা ছিল। আরও হবার কথা ছিল, যে বাংলাদেশ মুক্তিযােদ্ধাদের রক্তে জন্ম নিয়েছে, তাদের ত্যাগের মহিমায় যে দেশের পতাকা তৈরি হয়েছে, সেই মুক্তিযােদ্ধারাই বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণ করবে। এ প্রত্যাশাও অপ্রাসঙ্গিক ছিল না যে, যুগ যুগ ধরে এ দেশের প্রতিটি নাগরিক তাদের জাতির বীর সন্তানদের মাথা নুয়ে শ্রদ্ধা জানাবে। কিন্তু এসবের বেশি কিছু হয়েছে বলে কেউ-ই আমরা দিব্যি দিয়ে বলতে পারি নে। মুক্তিযুদ্ধের ২৭ বছর ইতােমধ্যেই গেছে। প্রতিবারেই কিছু কিছু রণাঙ্গন-সাথীদের সাথে ডিসেম্বর আর মার্চ মাসে দেখাসাক্ষাৎ হয় ঢাকায়। সে দেখাসাক্ষাৎ সাম্প্রতিক বছরগুলােতে বেশ বেড়েছে বলতেই হবে। মান্যবর রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বঙ্গভবনে একটি সংবর্ধনার আয়ােজন করে। অন্যদিকে গেল কয়েক বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রাষ্ট্রীয়ভাবে বীর মুক্তিযােদ্ধা, রাত্রীয় পদকপ্রাপ্ত, যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সম্মানে সংবর্ধনার আয়ােজন করছেন। আমি বলতে বাধ্য, এই দুটি অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রতিবারই আমি একাত্তরের রণাঙ্গনে ফিরে যাই। ভাবি, যে একাত্তর একদিন জাতীয় স্বাধীনতার জন্য আমাদের যুদ্ধক্ষেত্রে নিক্ষেপ করেছিল, এই একাত্তর আজ কত দূরে। ডিসেম্বর ১৭ তারিখের সকালে জাতীয় সংসদ ভবনের উত্তর প্লাজার মনােরম উদ্যানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দেয়া সংবর্ধনায় সংবর্ধিত সহযােদ্ধাদের অনেককেই ভাগ্যবান বলে মনে হলাে। চেহারায়, পােশাকে-আশাকে, পদবিতে অনেকেই প্রতিষ্ঠিত তারা জীবনে। কিন্তু অর্ধেকেরও বেশি যারা তারা জীবনযুদ্ধে পরাজিত ভগ্ন শরীর, সংকট আর বয়সের ভারে ক্লান্ত, জবুথবু চেহারার এসব মুক্তিযােদ্ধা একদিন কী প্রবল বিক্রমে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল আজকের নতুন প্রজন্মের মানুষেরা কি একবার তা ভাবার চেষ্টা করবে। একটি কথা আমার বারবার মনে হয়, মুক্তিযােদ্ধারা কি শুধুমাত্র তাদের সম্মান বা মর্যাদা চায়, নাকি আরও কিছু। এমনিতে বক্তৃতা-বিবৃতিতে তাদের সম্মানিত করা হয়, নিঃসন্দেহে। উপাধি দেয়া হয়। দেশমাতৃকার সূর্যসন্তান, জাতির অহঙ্কার এবং বীর বাঙালিসহ আরাে অনেক কিছু। তাহলে এটা অবশ্যই ধরে নেয়া যায়, মৌখিক সম্মানের প্রশ্নে একেবারে মন্দ নেই আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা।

প্রশ্ন হচ্ছে, বক্তৃতা-বিবৃতির এই সনটিই কি মুখ্য। নাকি জীবন বাজি রাখা সেইসব যুবকদের, যারা জাতির বন্দিত্ব ঘুচিয়েছে, অন্য হাতে তুলে পাকিস্তান হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছে, এবং তাদের মধ্যে আজও যারা বেঁচে আছে, এবং তাদের মৌখিক মর্যাদার বাইরেও আরাে কিছু পাবার আছে। কিংবা রাষ্ট্রেরও বিবেকের জবাবদিহিতা আছে এইসব দেশপ্রেমিকদের স্বীকৃতি দেয়ার, তাদের সম্মানিত করার। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই মুক্তিযােদ্ধাদের পুনর্বাসন নিয়ে একটা জাতীয় পরিকল্পনা হওয়া উচিত ছিল। সে পরিকল্পনায় শিক্ষাগত যােগ্যতা, পেশাগত মান আর অন্যান্য প্রয়ােজনীয় দিক বিবেচনা করে যুদ্ধ-ফেরত মুক্তিযােদ্ধাদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়ােজিত করলে পরবর্তীতে যে হতাশা এবং বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল, আমার বদ্ধমূল ধারণা, তা অনেকটাই নিরসন হতাে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে একটি জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের কথাও শুনেছিলাম সেই বাহাত্তর-তিয়াস্তরে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয় নি বা করার জন্য প্রয়ােজনীয় সময়ও পায় নি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার। যুদ্ধের নতুন দেশকে গুছিয়ে নিতেই ঘটল পচাত্তরের রক্তপতি। শুরু হলাে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র। আর সেই থেকে ঘুরে গেল স্বাধীন বাংলাদেশের চাকা। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকল দেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা। মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করতে যারা অত্র হাতে তুলে নিয়েছিল তারা পর্যন্ত পঁচাত্তর পরবর্তীকালে সমাদৃত হলাে নতুন রাষ্ট্রশক্তির হাতে। রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসিত হলে মুক্তিযুদ্ধের ঘাতকেরা। রাত্রীয় নীতি-নির্ধারিত হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ পরিপন্থী। সে ছিল এ জাতির এক বড় দুর্ভাগ্যের কাল। গেল সাতাশ বহরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সূর্যসন্তানদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। বেশির ভাগই হতাশাগ্রস্ত, জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন। এদের কেউ কেউ আদর্শবিচ্যুৎ হয়েছেন, কেউ আবার নিজেদের পারিবারিক বা ব্যক্তি যােগ্যতায় শিক্ষাদীক্ষায় সমাজে প্রতিষ্ঠিতও হয়েছেন। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, মুক্তিবাহিনীর বেশিরভাগ সদস্য আজও নিরন্ন, যাদের বেশিরভাগই গ্রাম-গঞ্জে বাস করেন, যাদের খোজ রাখার কথা কারও মনে থাকে না। একজন অতি সাধারণ মানুষের মতাে যাদের পরিচিতি নেই। ক্ষোভ বা দাবি জানাবার সুযােগ নেই। আক্ষেপ জানাবার কৌশল জানা নেই। এদের মধ্যে কেউ-বা রিকশা চালায়, কেউ দিনমজুরিতে কাজ করে, কারও স্ত্রী-সন্তানেরা বড়লােকের বাসাবাড়িতে ঝি-চাকরানির কাজ করে, এমনকি কাউকে আবার ভিক্ষা পর্যন্ত করতে হয়। অথচ একবার কি আমরা ভাবব, এই এঁরাই বাংলাদেশকে তৈরি করেছে। এরাই দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে! মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে অবস্থাসম্পন্ন লােকের অভাব আছে এ কথা আমি মানতে রাজি নই।

কিন্তু তাদের সংখ্যা কতজন? মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি গণযুদ্ধ আর সে গণযুদ্ধে অংশ। নিয়েছিল বেশিরভাগই ছাত্র, শিক্ষক, তরুণ কৃষক, তরুণ সাধারণ গ্রামীণ শ্রমিক-জনতা এবং সেদিনকার সাধারণ চাকরিজীবীরা সেনাবাহিনী, সেদিনকার ইপিআর এবং পুলিশের যারা এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তারা ছিলেন এক-একটি সংগটিত পেশাদার বাহিনীর লােক এদের চাকরি ছিল, এবং পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার কারণে কমবেশি আর্থিক ও অন্যান্য সুযােগ-সুবিধেও কিছু তাদের জুটেছিল। এদের মধ্যে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন তাদের পরিবার পরিজনরা কমবেশি কিছু পেয়েছিলেনও। হয়তাে তা তেমন কিছুই নয়। কিন্তু তাও তাে পেয়েছিলেন। কিন্তু গ্রামীণ সাধারণ-সমাজ থেকে যারা মুক্তিবাহিনীতে গিয়েছিলেন, তারা কী পেয়েছেন আজও পর্যন্ত। না স্বীকৃতি, না কোনাে সুযােগ, না সম্মান ? আমি নিদ্বিধায় বলতে পারি, এই গণযােদ্ধাদের সম্মান দেয়া হলে এ দেশের বৃহত্তর মুক্তিযােদ্ধাদেরকে রাষ্ট্রীয় সম্মান থেকে বাদ রাখা হবে। কারণ মুক্তিযুদ্ধ কোনাে কনভেনশনাল ওয়ার ছিল না। এ যুদ্ধের প্রাণশক্তি ছিল সাধারণ মানুষ যারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। একটা কথা খুবই প্রাসঙ্গিক বলে উল্লেখ করছি। একটি জাতির মুক্তিযুদ্ধ করার মতাে এতবড় এক গৌরব যাদের কপালে জুটে, তাদের জন্যে সম্মানই তাে যথেষ্ট। এ কথাও অনেকে বলে থাকেন যে, মুক্তিযােদ্ধারা কেবলমাত্র সম্মানই চায়, স্বীকৃতিই চায়, আর কিছু নয়। কিন্তু আমার বদ্ধমূল ধারণা যে, আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের বৃহত্তর অংশ, বিশেষ করে যারা অশিক্ষিত এবং গ্রামগঞ্জবাসী, তারা এযাবৎ না পেয়েছে সম্মান, না পেয়েছে সুবিধে। অথচ, ফুলেফেঁপে মােটা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিরােধীরা। সেই সাথে একশ্রেণীর সুযােগসন্ধানী মুক্তিযােদ্ধারা। রাজাকার-আল-বদরের পৃষ্ঠপােষকরা টাকার মালিক হয়েছে, সম্পদের মালিক হয়েছে, আর তাদেরই প্রতিষ্ঠানের সেবা করে, তাদেরই অনুগ্রহে জীবন ধারণ করতে হয়েছে মুক্তিযােদ্ধাদের বা তাদের সন্তানসন্ততিদের যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের এ ট্রাজেডির কথা কোনাে মুক্তিযােদ্ধা কি ভুলতে পারে? যে-দেশটি গড়ে ওঠার কথা ছিল, এবং তা সর্বতােভাবে সঙ্গতও ছিল, মুক্তিযােদ্ধাদেরই হাতে, সে দেশ গড়ে উঠেছে এক উল্টো পথে। সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনাে দেশে এমন নজির নেই। কাজেই আজ যখন মুক্তিযােদ্ধাদের তালিকা তৈরির কথা উঠেছে, সমাজে তাদের সম্মানের সাথে প্রতিষ্ঠার কথা উঠেছে সে, প্রক্রিয়াকে তখন সমর্থন জানাবার যৌক্তিকতা আছে বলে আমি মনে করি। অনেকের ভিন্ন যুক্তি থাকতে পারে, কিন্তু আমার বিশ্বাস, ইতিহাস সংরক্ষণের স্বার্থেই প্রকৃত মুক্তিযােদ্ধাদের, যারা রণাঙ্গনে লড়েছিলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করেছিলেন, যারা বিভিন্ন সম্পৃক্ত কাজে জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবনবাজি রেখে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের সকলের একটি জাতীয়ভিত্তিক ডকুমেন্টেশন প্রয়ােজন।

এই ডকুমেন্টেশন প্রয়ােজন আমাদের স্বাধীনতার মহান ইতিহাস সংরক্ষণের স্বার্থে, যাতে যুগ যুগ ধরে এই নামগুলাে, এই মুখগুলাে বেঁচে থাকে, এদের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ যুগ যুগ ধরে স্বীকৃত হয়। শুধু তাই নয়, দেশের প্রতিটি প্রান্তে, যেখানে যেখানে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরােধ হয়েছে, যেখানে যেখানে একেকজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন সেইসব প্রতিটি স্থানে স্মৃতির মিনার গড়ে উঠুক। আমি প্রস্তাব করি, বাংলাদেশ মুক্তিযােদ্ধা সংসদ এমন উদ্যোগ গ্রহণ করুক- যাতে দেশের প্রতিটি থানা শহরে, প্রতিটি জেলা শহরে, নগরে-বন্দরে পাথরে খােদাই করে লেখা হয় সেইসব বীর মুক্তিযােদ্ধাদের নাম— যাদের রক্তে, যাদের আত্মত্যাগে পাকিস্তানিদের নাগপাশ থেকে এই প্রিয় স্বদেশভূমি স্বাধীন হয়েছিল ১৯৭১-এ। আমি মুক্তিযােদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় অফিসে খুব একটা যাই নি এযাবৎকাল। তবে নিজের এলাকায় গেলে বন্ধু এবং স্নেহাস্পদ রণাঙ্গন সাথীরা অনেকেই অনেকবার থানা কমান্ড কাউন্সিলে নিয়ে গেছেন হাত ধরে। বিগতদিনে মুক্তিযােদ্ধা সংসদকে যেভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে, তাতে শুধু আমি কেন, অনেক মুক্তিযােদ্ধাই সঙ্গত কারণে মুক্তিযােদ্ধা সংসদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। আর যাই হােক, মুক্তিযােদ্ধাদের দলীয়করণ করা উচিত হয় নি। তবে আমার বিশ্বাস, প্রতিটি মুক্তিযােদ্ধারই একটি বিশেষ দল আছে, সেটি হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে, ধর্মান্ধতার বিপক্ষে, সামাজিক প্রগতিশীলতার পক্ষে এবং সত্য ও সুন্দরের পক্ষে। সংসদের বর্তমান নেতৃবৃন্দ প্রকৃত মুক্তিযােদ্ধাদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরিতে হাত দিয়েছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না, কাজটি খুব একটা সহজ নয়। কারণ এর আগেও এক-দু’বার এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় নি। বিপুলসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা সেই তালিকার ব্যাপারে আগ্রহ দেখান নি। কাজেই সে প্রচেষ্টাই ভেস্তে গেছে। কিন্তু এবার, আমার সর্বতাে বিশ্বাস, প্রেক্ষাপট এবং পরিস্থিতি ভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক শক্তি এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় দেশজুড়েই একটা সাড়া পড়ে গেছে এই তালিকা নিয়ে। মুক্তিযােদ্ধাদের কী দেয়া হবে বা কী তারা পাবেন, সেটি বড় কথা নয়, তারা চান জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। যারা এযাবৎকালে মুক্তিযােদ্ধাদের সাটিফিকেট পর্যন্ত নেন নি, তারাও আজ মুক্তিযােদ্ধাদের জাতীয় তালিকায় নিজেদের নাম তুলতে আগ্রহী হয়েছেন। কাজও বেশ এগিয়েছেন শুনেছি ।

কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল এক মত বিনিময় সভায় সম্প্রতি জানা গেল, সুষ্ঠুভাবে সারা দেশ জুড়েই এই তালিকা তৈরির কাজ এগিয়ে চলেছে বললেন, তারা যে বাছাইএর প্রক্রিয়া নির্ধারণ করেছেন, তাতে অনেক অ-মুক্তিযােদ্ধাই বাদ পড়ে যাচ্ছে। শুনলাম, এমনও নাকি হয়েছে যে, এযাবৎকালে বেশ কিছু আলবদর আর রাজাকারও বিভিন্ন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃত্ব দিয়েছিল তারাও বাদ পড়েছে। শুধু আমি কেন, সেদিন ঢাকার মগবাজারের কেন্দ্রীয় মুক্তিযােদ্ধা সংসদের কার্যালয়ে উপস্থিত অনেক বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধারাই ছিলেন যাঁরা এই প্রথমবারের মতাে সংসদের কার্যালয়ে আসেন। ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের খ্যাত সংগঠকদের এবং আওয়ামী লীগ। ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ-পন্থী অন্যান্য দলমতের বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা নেতৃবৃন্দ। এঁদের প্রায় অনেকেই এই প্রথমবারের মতাে সংসদের কার্যালয়ে এলেন। সবাই একবাক্যে মুক্তিযােদ্ধা সংসদের অধুনা উদ্যোগকে সমর্থন জানালেন। তবে বললেন, যাতে তালিকা তৈরির এ প্রক্রিয়ায় একজন প্রকৃত মুক্তিযােদ্ধাও বাদ না পড়ে, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। হতে পারে মুক্তিযােদ্ধারা সবাই বর্তমানের সরকারি দল করেন না, হতে পারে তিনি বিরােধী কোনাে রাজনৈতিক দলে আছেন, কিন্তু তার মানদণ্ড ১৯৭১ আমি এ কথা অনস্বীকার্যভাবেই মানি যে, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতাসীন হবার পর দেশ জুড়েই উপেক্ষিত মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে একটা সাড়া পড়ে গেছে।

যে মুক্তিযােদ্ধা দীর্ঘ ২৭ বছরে কিছু পান নি বা কিছু পাবার প্রত্যাশাও করেন নি, নীরবেনিড়তে জীবনযাপন করেছেন, কষ্ট করেছেন কিন্তু মুখ খুলেন নি, এমনকি বাহাত্তরের সার্টিফিকেটটি পর্যন্ত নেন নি, তিনিও আজ ভাবছেন, পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে, এবং এখন তিনি বেরিয়ে আসতে পারেন, স্বীকৃতি দাবি করতে পারেন। সেকারণেই বলি, মুক্তিযােদ্ধা সংসদকে প্রখর নিরপেক্ষতা এবং প্রভূত যােগ্যতা আর সহনশীলতার সাথে প্রকৃত মুক্তিযােদ্ধাদের তালিকা তৈরি করতে হবে। একবার নয় বারবার করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে যাতে একজন প্রকৃত মুক্তিযােদ্ধাও বাদ না পড়েন। কারণ একজন মুক্তিযােদ্ধার কাছে সে মুক্তিযােদ্ধা নয়- এ অপবাদ বড় বেশি কষ্টের। মুক্তিযুদ্ধের পর রণাঙ্গন ফেরা যােদ্ধারা জীবনের তাগিদে কে কোথায় ছিটকে পড়েছেন, তার হিসেব কে রাখে? আমাদের আর্মি, বিডিআর এবং পুলিশের ব্যাপারে যা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সম্ভব হয়েছে, গ্রামগঞ্জের সাধারণ মুক্তিযােদ্ধাদের ব্যাপারে তা হয় নি। হওয়া সম্ভবও ছিল না। অথচ তাদের বাদ রেখে মুক্তিযােদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি কিছুতেই সম্ভব নয়। উচিতও নয়। আর এতে বিজয়ী হবে মুক্তিযুদ্ধবিরােধী শক্তি যারা আজও আরেকটি পাকিস্তান বানানাের স্বপ্ন দেখে। মুক্তিযােদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের হাতে আজ এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। এ দায়িত্ব একাত্তরের বীর যােদ্ধাদের নামকে ইতিহাসে গ্রন্থিত করার। আমি আশা করি, এ গুরু দায়িত্ব পালন করতে সংসদের বর্তমান নেতৃত্ব সফল হবেন। যদি না হন, তাহলে, মুক্তিযােদ্ধাদের তালিকা তৈরির মূল উদ্দেশ্যটিই কেবল ব্যর্থ হবে সেই সাথে মুক্তিযােদ্ধারা আর একবার বিভাজিত হবে পাকিস্তানপন্থী ধর্মীয় মৌলবাদীরা আরেক দফা অগ্রসব হবে। আমাদের সামাজিক প্রগতি যে-অন্ধকারে ছিল। সেই অন্ধকারেই থেকে যাবে।

মার্চ, ১৯৯৭

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ হারুন হাবীব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!