মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন সাংবাদিকতা
মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন সাংবাদিকতা নিয়ে এযাবৎ তেমন বিস্তৃতভাবে আলােচনা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যদ্র হয়েছে তা সেদিনের ঘটনা-দুর্ঘটনার ওপর কিছুটা পর্যালােচনা, যার অধিকাংশ কিংবা প্রায় প্রতিটি উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে বিদেশী সংবাদপত্র কিংবা বিদেশী সংবাদ মাধ্যম থেকে। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন সাংবাদিকতার ব্যাপারটি আসলে একাধিক প্রেক্ষাপটে আলােচিত হবার দাবি রাখে। প্রথমত, একজন সাংবাদিক, দেশী-বিদেশী তিনি যে-কেউই হােন না কেন, পেশাগত কারণে কীভাবে এবং কী পরিস্থিতির মধ্যে সেদিন নিজেকে যুক্ত করেছিলেন, তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা। সেদিক থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিকতার ব্যাপ্তি অনেক, যা আজকের আলােচনার ব্যাক্তিকে অনেকটাই বাড়িয়ে দেবে। কারণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিকতা, অর্থাৎ যুদ্ধ শুরুর পর থেকে শেষ পর্যন্ত যে সাংবাদিকতা— তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের দেশীয় সাংবাদিকদের দিয়ে হয় নি। সেদিনের অবরুদ্ধ স্বদেশভূমিতে সাংবাদিকতার কাজটি যতটা না হয়েছে দেশীয় সাংবাদিকদের হাতে, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি হয়েছে পরদেশী সংবাদজীবীদের হাতে। এ পরিস্থিতির পেছনে অবশ্য যােগ্য কারণও ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র কর্মকাণ্ড মূলত শুরু হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত থেকে, যে কালাে রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী অতর্কিতে ঢাকা শহরে হামলা চালিয়ে এবং নির্বিচারে বাঙালি নিধনযজ্ঞে লিপ্ত হয়। পরদিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষিত হয় চট্টগ্রাম থেকে। প্রথমত বিন্নিভাবে হলেও ক্রমান্বয়ে চলতে থাকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে প্রতিরােধ-সাম। এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় প্রতিটি সংবাদপত্র। অন্যদিকে পাকিস্তানের সামরিক শাসকরাও বসে থাকে নি। তারা বন্দুকের জোরে সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলােকে পূন:প্রকাশ করতে বাধ্য করে এবং বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ করতে চায় যে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। তারা কঠোর ‘সেন্সরশিপ আরােপ করে সংবাদপত্রের কণ্ঠ রােধ করে, যাতে যে-নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ তারা চালিয়েছে বা চালিয়ে যাচ্ছে তা লােকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায়।
আজ ভাবতে অনেকটাই অস্বাভাবিক মনে হতে পারে, কিন্তু ২৬ মার্চ থেকে সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানের কোনাে খবরের কাগজই বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যা-নিপীড়নের কোনাে খবর ছাপতে পারে নি এবং এই Tuth Bockout চলেছে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত। অথচ সেদিনের পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশের এই একই কাগজগুলাে ২৫ মার্চ পর্যন্ত দুঃসাহসে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে সমর্থন যুগিয়েছে। ইত্তেফাক, পূর্বদেশ, সংবাদ, আজাদ এবং পাকিস্তান অবজারভার উনসত্তরের গণআন্দোলনের পক্ষে কাজই করেছে শুধু নয়, ষাটের দশকে আমাদের সে-সাংবাদিকতা, আমাদের পুরােধা সাংবাদিকদের যে দেশপ্রেম, সাহস আর প্রজ্ঞা, সেই দেশপ্রেম, সাহস আর প্রজ্ঞা না থাকলে একটি মুক্তিযুদ্ধের জন্য আমাদের এই মাটি এতটা দ্রুত তৈরি হতাে কি নাসেটিও অবশ্যই ভাববার বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের পুরাে নয় মাসে গােটা পূর্ব পাকিস্তান ছিল অবরুদ্ধ রক্তাক্ত ভূখণ্ড সেদিনের অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি সংবাদপত্র কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হতে পাকিস্তানের সামরিক শাসক কিংবা গণহত্যায় মত্ত দখলদার বাহিনীর হাতে। প্রধান দৈনিক ইত্তেফাক’ এবং সংবাদ’, সেই সাথে ইংরেজি দি পিপল’ এবং ‘গণবাংলা’-র অফিসগুলােকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করেছে। কারণ একে তাে এগুলাে বাঙালি মালিকানায় ছিল এবং অন্যদিকে এরা বাঙালি জাতীয়তাবাদী। আন্দোলনকে জোরদার সমর্থন করত। সংবাদ অফিসের আগুনে মারা গেছেন। প্রগতিশীল লেখক এবং সাংবাদিক শহীদ সাবের। শুধু তাই নয়, একই সাথে পাকিস্তানিরা হামলা চালিয়েছে পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তান আর পাকিস্তান অবজারভার অফিসে বন্ধ হয়ে গেছে ফয়েজ আহমদ সম্পাদিত দুঃসাহসী কাগজ স্বরাজ, আব্দুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত ‘আওয়াজ’ এবং শেখ ফজলুল হক মণি সম্পাদিত বাংলার বাণী’। বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, বিশেষত সংবাদপত্র জগতের মধ্যমণি যারা, তারা গােড়া থেকেই ছিলেন পাকিস্তানি শাসকদের প্রধান শত্রু। অতএব পত্রিকা চালাবার মতাে শারীরিক নিরাপত্তা ছিল না তাদের নিজেদের বা পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের। আগেই বলেছি, ২৫ মার্চের অতর্কিত সামরিক অভিযানের পরদিন থেকে আমাদের বেশির ভাগ সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যায়। এরপর যেগুলাে বেরিয়েছে তারা পাকিস্তানিদের জয়গান করতে বাধ্য হয়েছে। সাংবাদিকদের মধ্যে বেশির ভাগ হয় আত্মগোপন করেছিলেন, নয়তাে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিতে সীমান্তের দুর্গম পথে নেমেছিলেন। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের হাতে বাঙালি নিধনযজ্ঞ, হানাদারদের হাতে নিরন্তর মানবাধিকার লঙ্কন, গণহারে লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ এবং সার্বিক ধ্বংসযজ্ঞ কিংবা স্বাধীনতাকামীদের সশস্ত্র তৎপরতার খবরগুলাে প্রচারের বিন্দুমাত্র কোনাে সুযােগ ছিল দেশীয় সংবাদপত্রের । আমাদের দেশীয় সংবাদপত্রের পাতাগুলাে তখন হত্যাকারীদের বয়ানে মনগড়া এক ইসলাম ধর্মের নামাবলি গায়ে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা আর শত্র’ শেখ মুজিবুর রহমান, আর সেই সাথে শক্রদেশ ভারতের বিরুদ্ধে বিষােদ্গার করতেই ব্যস্ত ছিল।
অবশ্য তারা মন থেকে এসব করেছে বলে ডাববার কারণ নেই। এখানে একটি কথা বলে রাখা উচিত যে, মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানিদের চাপে পড়ে ঢাকা বা অন্যানা জায়গা থেকে যেসব দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল তারা পাকিস্তানি প্রশস্তির ফাঁকে মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতার খবরগুলাে সুকৌশলে প্রচার করত। মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে কোথাও কোনাে আক্রমণ হলে কিংবা হানাদার বাহিনী কোথাও আক্রান্ত হলে বেশিরভাগ কাগজ সে-বরগুলাে পরিবেশন করত বেশ কায়দা করে। ঘটনার বয়ান দিয়ে তারা বলত, ‘সশস্ত্র দুষ্কৃতকারীদের’ কিংবা ‘ভারতীয় চরদের’ হাতে ‘অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড ঘটেছে। ঘটনা পরিবেশনায় যদিও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, কিন্তু এর পরও দেশবাসীর জানতে বাকি থাকত না মুক্তিযােদ্ধারা সক্রিয় রয়েছে, সীমান্ত অঞ্চলে তারা সংগঠিত হচ্ছে এবং পাকিস্তানিদের বর্বরতার সুযােগ্য জবাবও তারা দিচ্ছে। সেদিন অবরুদ্ধ বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের খবর বিশ্বজুড়ে প্রচারের ক্ষেত্রে বেশি অবদান রেখেছিল ভারত, ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, কানাডা আর অস্ট্রেলিয়ার। প্রধান সংবাদপত্রগুলাে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সংবাদপত্রগুলাের মধ্যে যেগুলাে। বেশি অবদান রেখেছিল, সেগুলাে হচ্ছে কলকাতার যুগান্তর’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, আনন্দবাজার পত্রিকা’ এবং ‘স্টেটসম্যান’, নতুন দিল্লির টাইমস অব ইন্ডিয়া’, ‘পাইওনিয়ার’, ‘হেরাল্ড’, ‘হিন্দুস্থান টাইমস’ এবং সেদিনের মাদ্রাজ বা আজকের চেন্নাই-এর প্রভাবশালী ‘দি হিন্দু’। সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচন পরবর্তীকালীন সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধের পুরােটা সময় এসব প্রধান ভারতীয় দৈনিক মুক্তিবাহিনী এবং প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে সর্বাত্মক সমর্থন যুগিয়ে গেছে। এদেরই নিরবচ্ছিন্ন সমর্থনের কারণে ভারতীয় জনগােষ্ঠীর পক্ষে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি মনেপ্রাণে সমর্থন জোগানাে সম্ভব হয়েছিল। পশ্চিমা বিশ্বের খ্যাতিমান যে-কাগজগুলাে পাকিস্তানি বর্বরতাকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে যুদ্ধরত বাঙালি জনগােষ্ঠীর সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে বিশ্বজোড়া সমর্থন গড়ে তুলেছিল, তাদের প্রধানতম হচ্ছে ইংল্যান্ডের অবজারভার’, ‘গার্ডিয়ন’, ‘সানডে টাইমস’, ‘টেলিগ্রাফ’ এবং ইকনােমিস্ট’। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পােস্ট’, নিউইয়র্ক টাইমস’, ‘ক্রিশচিয়ান সায়েন্স মনিটর’ এবং টাইম’ ও ‘নিউজউইক’ ম্যাগাজিন। এদের সাথে ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউনের কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিকতার আরেকটি দিক এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। সেটি অবশ্য রণাঙ্গনের। সীমান্তবর্তী বিভিন্ন মুক্তাঞ্চল আর ভারতীয় অঞ্চলগুলাে থেকে বিঘ্নি পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমেও সাংবাদিকতার দুরূহ কাজটি করা হয়েছে তখন। আমার বিশ্বাস, আমাদের প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রগুলাে যে-কাজটি পারে নি বা যা তাদের পক্ষে সে-মুহূর্তে যা করা সম্ভব ছিল না, সে দায়িত্বটি পালন করেছে সীমান্তবর্তী ক্ষুদ্র এই অনিয়মিত কাগজগুলাে। এই কাজটি ছিল আমাদের মুক্তিসগ্রামে নিষ্ঠাবান সহযােগীর কাজ যা স্বাধীনতাকামীদের মনােবল বাড়িয়েছে এবং বিশ্ববাসীর সামনে বাঙালিকে আরেকবার আধুনিক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমার ধারণা, মুক্তিযুদ্ধে। রণাঙ্গন সাংবাদিকতা বলতে যা আমরা সাধারণভাবে বুঝে থাকি প্রধানত তা এটিই।
শুরুতেই বলে রাখি, আমার এই লেখাটি মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন সাংবাদিকতার ক্ষুদ্র পরিসর একটি আলােচনা মাত্র। এই বিষয়টিতে পূর্ণাঙ্গ তথ্যসমৃদ্ধ বিবরণ লিপিবদ্ধ করা সময়সাধ্য গবেষণার বিষয়। আমি শুধু আমার সীমিত ব্যক্তিঅভিজ্ঞতার আলােকে এ লেখাটি লিখছি। এখানে আরেকটি বিষয় প্রাসঙ্গিক বলেই উল্লেখ করতে চাই। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সম্ভব হয়েছে একটি দীর্ঘ ধারাবাহিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলে এবং তা পরিচালিত হয়েছে এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে যাতে গােটা জাতি অংশগ্রহণ করেছিল। কোনাে জাতির মুক্তিযুদ্ধের মতাে বিশাল-ব্যাপক জনযুদ্ধ কখনােই নিছক সামরিক কর্মকাণ্ড হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ কোনাে সাধারণ যুদ্ধ বা কনভেনশনাল ওয়ারফেয়ার’ নয় বা কোনাে ফুটবল ম্যাচও নয়, যা কোনাে ঘােষণা দিয়েই শুরু বা শেষ করা যেতে পারে। যদিও ১৯৭৫-এর রক্তাক্ত পালাবদলের পর প্রায় দুই যুগ ধরে একাত্তরের ঘটনা প্রবাহকে নিছক একটি সামরিক কর্মকাণ্ড বলে চালাবার চেষ্টা হয়েছে। চেষ্টা হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করার, বাস্তালি জাতিসত্তার মূলে কুঠারাঘাত করার। যে-কথা বলছিলাম, সফল একটি যুদ্ধ পরিচালনা করতে সমরাস্ত্র যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়ােজন যুদ্ধকালীন প্রচারযত্নের। যুদ্ধের সময় ইনফরমেশন’ এবং মটিভেশন” তাই একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এগুলো কেবলমাত্র বাইরের লােকের জন্যেই প্রয়ােজন নয়, একই সাথে প্রয়ােজন যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর মনােবল রক্ষার্থেও। পৃথিবীর বিজ্ঞি দেশে যেখানে জাতীয় স্বাধীনতার লক্ষ্যে জনযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে সেখানেও এ কাজগুলােকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের জন্য সুখবরটি হচ্ছে এই, মুক্তিযুদ্ধের পরিচালনাকারী রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেটি জানতেন। সে-কারণে মুজিবনগর সরকারের নিয়ন্ত্রণে পুরােদমে কাজ শুরু করেছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’- যা। হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধানতম প্রচারযন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল বলেই ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে বাংলাদেশের একটি বেতার কেন্দ্র চলতে পেরেছিল, এটি বলতে কারও বিধী থাকা উচিত নয়। এ বেতার কেন্দ্রের প্রথম সম্প্রচার ঘটে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে এবং আগরতলা হয়ে কোলকাতায় একে যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত সফলভাবে পরিচালনা করেন আমাদেরই আত্মত্যাগী কিছু শব্দসৈনিক এবং সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী। অন্যদিকে প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল জয় বাংলা’ সাপ্তাহিক যা ছিল যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র।
আমার সৌভাগ্য যে, প্রবাসী সরকারের এই দু’টি মাধ্যমের সাথেই সম্পৃক্ততা ছিল। আমার রণাঙ্গন থেকে একজন যুদ্ধ সংবাদদাতা হিসাবে অর্থাৎ প্রথমত কিছুদিনের জন্য ‘জেড ফোর্স’ এবং এবং পরে উত্তর-ময়মনসিংহের ১১ নম্বর সেক্টর থেকে যা ছিল আমার স্মৃতির রণাঙ্গন। মুক্তিযুদ্ধে মূলত একজন গেরিলা যােদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ করেও যুদ্ধ সাংবাদিকতার সাথে আমার যে ঐতিহাসিক যােগ তা ছিল আমার ব্যক্তি জীবনের বাড়তি এক অর্জন। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে আসাম হয়ে ত্রিপুরা পর্যন্ত চলতে হয়েছে আমাকে বার যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে। রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে ঘুরে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে হয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ আর ‘জয় বাংলা পত্রিকার জন্য। প্রচারপত্র লিখতে হয়েছে একের পর এক, ছাপিয়ে আনতে হয়েছে সেগুলাে আসামের গেীহাটি থেকে। একদিকে ময়মনসিংহ এবং বৃহত্তর রংপুর নিয়ে এগারাে নম্বর সেক্টরের প্রাণকেন্দ্র মহেন্দ্রগঞ্জ, অন্যদিকে আসাম-মেঘালয়ের সীমান্তে তেলঢালায় জেড ফোর্স হেড কোয়াটার্স, একই সাথে পাহাড়ি সীমান্তের শিবিরগুলােতে অবস্থানরত শরণার্থী আর মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতিবিদ এদের সবার সাথেই দিনের পর দিন যােগাযােগ রাখতে হয়েছে আমাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের এম.এ. শেষ পর্বের ছাত্র আমি তথন। ঢাকার কিছু কিছু কাগজে সবেমাত্র লিখতে শুরু করেছি। সেদিনকার এপিপি’র। প্রতিনিধি হয়েছি আমার নিজের জেলা (তখনকার মহকুমা) জামালপুরের। অতএব সে সুবাদে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের যৎকিঞ্চিৎ সাংবাদিকতা করার ঐতিহাসিক সুযােগটুকু আমি গ্রহণ করেছিলাম পুরােপুরি। হয়তাে-বা এটিও সত্যি যে, জাতির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একজন নবীন সাংবাদিক হয়েও রণাঙ্গন সাংবাদিকতার যৎকিঞ্চিৎ কাজ। আমার হাতে সম্পন্ন হবার বিধিলিপি ছিল। ‘জয় বাংলা’ পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন আওয়ামী লীগের আব্দুল মান্নান, যদিও পত্রিকায় তার নাম লেখা থাকত আহমদ রফিক বলে। তিনি প্রবাসী সরকারের তথ্য বিভাগের প্রধান হিসাবে এই দায়িত্ব পেয়েছিলেন। কাগজটি ছাপা হতাে কলকাতা থেকে এবং এটি বিতরণ করা হতাে যুদ্ধরত বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে। ‘জয় বাংলায় একদিকে যেমন থাকত যুদ্ধের প্রচারধর্মী খবর আর সংবাদ বিশ্লেষণ, থাকত প্রবন্ধ, কবিতা আর যুদ্ধ পরিস্থিতির মূল্যায়ন; অন্যদিকে ছাপা হতাে পাকিস্তানিদের গণহত্যার খবর, নির্যাতন আর দেশ-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনের সংবাদ। মুক্তিযােদ্ধাদের মাঝ থেকে বিভিন্ন রণাঙ্গনে এর কিছু প্রতিনিধিও নিয়ােগ দেয়া হয়েছিল।
খবর সংগ্রহের ক্ষেত্রে মুক্তিযােদ্ধা, শরণার্থী, মুজিবনগর সরকার, কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম, ভারতীয় বিএসএফ-এর জনসংযোগ বিভাগ ইত্যাদি ছিল ‘জয় বাংলা’র মূল সংবাদসূত্র। এছাড়াও বিবিসি, আকাশবাণী, ভয়েস অব আমেরিকা এবং রেডিও অস্ট্রেলিয়া থেকেও খবর নেয়া হতাে। আমার হাতে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে পর্যায়ক্রমে দু’টি ক্যামেরাও এসে জুটেছিল। একজন আলােকচিত্রী না হয়েও যে-কারণে স্বাধীনতার রক্তাক্ত ইতিহাসের বহু ফটোগ্রাফ আমার ক্যামেরায় বন্দি হয়ে আছে। শুধু প্রিয় স্টেনগানটিই নয়, একই সাথে কলম আর ক্যামেরা ছিল আমার মুক্তিযুদ্ধের প্রিয় সহচর। সে-কারণে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের অসংখ্য ছবি তুলবার সুযােগ হয়েছিল আমার একজন ফটোসাংবাদিক না হয়েও। আগেই উল্লেখ করেছি, প্রবাসী সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের বাইরেও প্রায় সীমান্ত জুড়ে, বিশেষত ভারত সীমান্তের ছােট ছােট শহর থেকে অসংখ্য পত্রিকা বেরিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে। এই কাগজগুলাের বেশির ভাগই নিয়মিত ছিল না, আকার প্রকারেও বড় বা উঁচুমানের কিছু ছিল না, কিন্তু আমি বলতে বাধ্য, এই প্রকাশনাগুলাে মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করেছে প্রভূতভাবে। এগুলোর সাথে, স্বীকার করতেই হবে, সীমান্তের ওপারের বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এবং ভারতীয় বাতালি সাংবাদিকদের, প্রেস মালিকদের আর অর্থ যোগানদাতাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সৌভাগ্য ছিল যে, আমরা ভারতীয় সীমান্তের প্রতিটি অঞ্চলে বাংলাভাষী জনসংখ্যার অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছিলাম যারা তাদের প্রাণের সবটুকু আবেগ আর। সততা দিয়ে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে এবং এই বাংলাভাষীরা বেশির ভাগই ছিল আবার পূর্ববাংলা থেকে ছিটকে পড়া সাতচল্লিশের দেশত্যাগী হতভাগা। মানুষ। ‘জয় বাংলা’ নামে ত্রিপুরা এবং আসাম সীমান্তেও আরাে কয়েকটি পত্রিকা সেদিন বেরিয়েছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে, যাদের একটির সম্পাদক ছিলেন প্রফুল্ল কুমার সরকার। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠক মাত্রেই জানবেন, ক্ষুদ্র ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরা ১৯৭১ সালে হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনের প্রধান এক কেন্দ্রবিন্দু। ভৌগােলিক অবস্থানের কারণেই সেটা অবশ্য সব হয়েছিল।
বিশ্বের সংবাদপত্রগুলাের কাছে আগরতলা হয়ে উঠেছিল সেদিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ‘ডেটলাইন’। যেত্রিপুরার মােট জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখের মতাে, সেই ত্রিপুরাকে ঠাই দিতে হয়েছিল সেদিন ১৪ লাখের ওপর শরণার্থী। ত্রিপুরায় সেদিনের মূল পত্রিকা ছিল দৈনিক সংবাদ’- যার সম্পাদক ছিলেন ভূপেন দত্ত ভৌমিক (সম্প্রতি ভূপেন বাবু মারা গেছেন বলে খবর পেয়েছি)। ত্রিপুরার এ কাগজটি সেদিন সকল অর্থেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান দৈনিকে রূপান্তরিত হয়েছিল। অন্যদিকে সাপ্তাহিক সমাচার’ নামে আরও একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন নিবেদিতপ্রাণ বাঙালি অনিল ভট্টাচার্য। টেবলয়েড সাইজের এই কাগজটিও ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ্য সমর্থক। ত্রিপুরার অন্য কাগজগুলাের মধ্যে জাগরণ’ এবং সিপিআই (এম-এল)-এর মুখপত্র দেশের কথা’ও মুক্তিযুদ্ধে সহযােগীর ভূমিকা রেখেছে। এছাড়াও হয়তাে-বা শুধুমাত্র বাঙালি হবার কারণেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, রণাঙ্গনের রিপাের্টিংয়ে বেশ কয়েকজন ভারতীয় সাংবাদিক নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। এঁদের মধ্যে আজ যাদের কথা মনে করতে পারছি তারা হচ্ছেন স্টেটসম্যানের অমূল্য গাঙ্গুলি, সত্যব্রত চক্রবর্তী এবং মনােজ মিত্র, আনন্দবাজার-এর অসীম দেবরায় এবং তুষার পণ্ডিত, যুগান্তর-এর অনিল ভট্টাচার্য (সিনিয়র) এবং সেই সাথে আগরতলার অনিল ভট্টাচার্য, পিটিআই থেকে মানিক চৌধুরী, মধুসূদন গুহ রায়, আকাশবাণী থেকে সনৎ মুখার্জি এবং ইউএনআই থেকে কে কে চাড়া। এদের বাইরেও অসংখ্য ভারতীয় সাংবাদিক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহ করে তাদের নিজস্ব মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন যাদের নাম আজ মনে করতে পাচ্ছিনে। তবে পশ্চিমী সাংবাদিকদের মধ্যে সাইমন ড্রিং, কলিন স্মিথ, সিডনি সেনবার্গ, সিরিল জন, আলােকচিত্রী মিশেল রবার্ট, লুই হেরেন, নিকলাস টমালিন, পিটার আর হেনরিস এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত এন্থনি ম্যাসকারনহাসের কথা আমাদের সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করতে এখানে দু’জন ভারতীয় সাংবাদিকের কথা আমি উল্লেখ করতে চাই যারা অবরুদ্ধ বাংলাদেশে রিপােটিং করতে এসে আর কখনও তাদের ঘরে ফিরে যান নি। এই দুই তরুণ ভারতীয় সাংবাদিকের একজন সুরজিৎ ঘােষাল আর অন্যজন দীপক ব্যানার্জি। বেনাপােল হয়ে এরা দুজন যুদ্ধরত বাংলাদেশে নিজেদের পরিচয় গােপন করে প্রবেশ করেছিলেন গণহত্যার খবর সংগ্রহ করতে। আগরতলার খ্যাতি আলােকচিত্রী রবীন সেনগুপ্ত এবং প্রবীণ সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যের মতে এই দুই ভারতীয় সাংবাদিক ২৪ মার্চ পর্যন্ত বিল্পি ঘামগয়ে ঘুরে পাকিস্তান বাহিনীর বিভিন্ন অত্যাচারের ছবি ও খবর সংগ্রহ করেন। কিন্তু কুমিল্লাতে দু’জনেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং পরিণামে নৃশংসভাবে তারা নিহত হন।
সেদিন দেশত্যাগী সাংবাদিক এবং মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন ভারতীয় অঞ্চল থেকে যে পত্রিকাগুলাে বেরিয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল ‘দি পিপল’, বাংলার বাণী’, ‘বাংলার মুখ’, ‘নয়া বাংলা, বাংলাদেশ সংবাদ’, ‘প্রতিরােধ’, ‘সােনার বাংলা’, ‘দাবানল’, ‘সগ্রামী বাংলা’, মুক্তিযুদ্ধ’, ‘স্বাধিকার’, ‘গ্রেনেড’ ইত্যাদি। এ ছাড়াও ছিল সন্দীপ থেকে ধলেশ্বরী’, ‘স্বাধীনতা’ এবং সেদিনের রংপুরের রৌমারী মুক্তাঞ্চল থেকে ‘অগ্রদূত’ যার সাথে আমার নিজেরও কিছুটা সম্পৃক্ততা ছিল। এই পত্রিকাগুলাে অর্থ, কাগজ এবং ছাপাখানার অভাবে নিয়মিত হতে পারে নি, সুদর্শনও হতে পারে নি, কিন্তু এই অপ্রতুলতা সত্ত্বেও এগুলাে একদিকে যেমন শরণার্থীদের মনােবল চাঙ্গা করেছে, অন্যদিকে সাহস যুগিয়েছে মুক্তিবাহিনীকে পাকিস্তানি হানাদারদের রুখতে। আসামের করিমগঞ্জ থেকেও একাধিক কাগজ বেরিয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করতে। এদের মধ্যে ভূপেন্দ্র কুমার সিংহ সম্পাদিত দৃষ্টিপাত, হরেন্দ্র চন্দ্র সেন সম্পাদিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী সাপ্তাহিক ‘প্রান্তীয় সমাচার’ এবং ‘যুগশক্তি’। ‘জয় বাংলা’ নামে এখান থেকে আরেকটি পত্রিকা বেরিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চল থেকেও একাধিক কাগজ বেরিয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করতে। সেগুলাের প্রতিটির খোঁজ আজ আমার হাতে নেই। তবে যেকাগজগুলাের কথা আমি উল্লেখ করেছি, তাদের অনেকগুলির কপি আজও আমি। রেখেছি। এ আমার নিতান্ত ব্যক্তি স্মৃতি সংরক্ষণের প্রয়াস, পেশাগত কোনাে দায়িত্ব। থেকে নয় এসব কাগজের প্রতিটির পেছনে ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের আবেগ, শ্রম আর দেশপ্রেম একই সাথে ছিল সীমান্তের ওপারের বাংলাভাষী বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর নিঃশর্ত সমর্থন যার সাথে পেশার কোনাে টান ছিল না। ছিল দেশপ্রেম আর পাকিস্তানি। হানাদারদের পরাজিত করে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের অপ্রতিরােধ্য এক বাসনা।
মাছ, ১৯৯৭
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ – হারুন হাবীব