প্রথম আত্মসমর্পণ
যে-কোনাে বাঙালির কাছে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য দেখার সুযোেগ ছিল অপরিসীম এক সৌভাগ্য। কারণ একদিকে ওরা ছিল বর্বর এক বাহিনী অন্যদিকে বাঙালির স্বাধীনতার নৃশংস প্রতিপক্ষ। সে কারণে পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত বা বন্দি করতে বাঙালি যােদ্ধাগণ জীবন দিতে পিছ পা হয় নি। অবশ্য যুদ্ধের শেষ দিকে আহত হবার কারণে ঢাকার রমনা রেসকোর্সে পাকিস্তানিদের ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণের দৃশ্যটি নিজের চোখের দেখা হয় নি আমার। ময়মনসিংহের এক হাসপাতালে সেদিন পড়ে থাকতে হয়েছে আমাকে। সেদিন ব্যর্থতা জীবনের শ্রেষ্ঠতম। কানের কাছে রেডিও নিয়েই কেবল ঘাতকদের পতনের ধারাবিবরণী শুনেছি। ঢাকা যেতে পারি নি, কিন্তু যুদ্ধরত স্বদেশভূমিতে মুক্তিবাহিনীর হাতে হানাদার সৈন্যদের প্রথম আত্মসমর্পণের বিরল ঘটনাটির অন্যতম সাক্ষী হবার সুযােগ ঘটেছিল আমার ১৬ ডিসেম্বরেরও বারােদিন আগে। উত্তর-ময়মনসিংহের এক কামালপুর রণাঙ্গনে। নভেম্বর ১০ সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহের আহত হলেন ভয়ঙ্কর এক সম্মুখ সমরে। রণক্ষেত্র কামালপুরে পাকিস্তানি মর্টারের আঘাতে তার একটি পা খোয়া গেল। জীবন বাঁচাতে প্রথমে তাকে মেঘালয়ের তুরা, পরে আসামের গােয়াহাটিতে নেয়া হলাে তড়িঘড়ি করে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহযােগিতায়। এগারাে নম্বর সেক্টরের ডাক্তার বন্ধু প্রেমাংকুর রায় তাহেরের প্রায়-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া পাটাকে বেশ খানিকক্ষণ টিকিয়ে। রাখতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওটাকে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হলাে। তাহের কিন্তু জ্ঞান হারালেন না। সহযােদ্ধাদের উদ্দেশে বললেন, তােমরা কেউ ডিফেল ছেড় না। আঘাত চালিয়ে যাও শত্রুকে নিজেদের দুর্বলতা বুঝতে দিও না। এখানে দাড়িয়ে থেক না। যাও। বিস্ময়কর হলেও সত্য, এমন একটি বড় দুর্ঘটনার পরও যুদ্ধ থামে নি। আঘাতের পর আঘাত চলছিল কামালপুরের দুর্ভেদ্য পাকিস্তানি ঘাটিতে। কারণ এ ঘাঁটির পতনের পরই কেবল মুক্তিবাহিনী অগ্রসর হতে পারবে শেরপুর-জামালপুর হয়ে ঢাকার দিকে। পরিকল্পনাটা সে রকমই ছিল। নভেম্বরের শেষ। নয় মাসের যুদ্ধের প্রায় শেষ সময়। প্রতিটি রণাঙ্গণে মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ঘটছে। ক্রমশই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে হানাদার বাহিনী। রাজাকার আর পাকিস্তানিদের স্থানীয় দালালরা বেশির ভাগই প্রাণ বাঁচাতে সটকে পড়ছে। খােদ পাকিস্তানি জান্তারা পর্যন্ত বুঝতে পারছে, এই বঙ্গ খণ্ডে তাদের চব্বিশ বছরের তাবেদারি শেষ হতে চলেছে। শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার। তবু যুদ্ধ চালাচ্ছে ওরা নিজেদের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে। এ ছাড়া ওদের উপায় নেই।
এদিকে শােনা যাচ্ছে মার্কিনি নিক্সন প্রশাসন সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছে বঙ্গোপসাগরে। দৃশ্যতই ভেঙে পড়া পাকিস্তানিদের মনােবলকে চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে। মিঃ নিক্সনের প্রশাসন ১৯৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করেছে। বিরােধিতা করেছে সেদিনের গণচীন, সেদিনের আরব বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্র- যা ছিল আমাদের জন্যে বড় এক দুর্ভাগ্য। অন্ততপক্ষে ওরা নিক্রিয় থাকলেও আমাদের লােকক্ষয় কম হত। রক্তক্ষয় কম হত। আমি জানিনে, আজ তারা তাদের পররাষ্ট্রনীতির ভুলগুলাে বুঝতে পারবে কিনা। সেদিনের সােভিয়েত ইউনিয়ন আর ভারত সপ্তম নৌবহর পাঠানাের মার্কিনি সিদ্ধান্তের প্রবল বিরােধিতা করে যাচ্ছে তখন। নতুন দিল্পি আর মস্কো প্রায় এক যােগে বলছে, ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্ত সেনাবাহিনীর গণহত্যায় সহযােগিতা করার সামিল। দিন কয়েক থেকেই পরিস্থিতি আমার কাছে ভিন্ন মনে হচ্ছে। আগে যেভাবে চলছিল ঠিক সেভাবে নয়। আমাদের সেক্টরের উর্ধ্বতন সেনা কর্তৃপক্ষের সাথে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের রাত জেগে সলাপরামর্শ চলছে। ১ ডিসেম্বর থেকেই পরিস্থিতি কেমন ওমােট রূপ ধারণ করছে। ইতােমধ্যে ক্ষিপ্ত পাকিস্তানিদের আক্রমণের লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়েছে ভারত। ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় রাষ্ট্রপতি সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করলেন। আমরা লক্ষ করছি, মেঘালয়ের ক্যাম্পগুলির চারপাশে বিভিন্ন ভারতীয় রেজিমেন্টের সৈন্যদের ভিড় বাড়ছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারত প্রধান মিত্র শক্তি আর ভারতীয় বাহিনী হচ্ছে মুক্তিযােদ্ধাদের মিত্র বাহিনী। কাজেই যুদ্ধাবস্থায় ওদের অনেকের সাথেই আলাপ পরিচয় ঘটেছে। কারও কারও সাথে বন্ধুত্বও গড়ে উঠেছে। যুদ্ধে আমার হাতে স্টেনগানের সাথে বরাবর একটি ক্যামেরা থাকত। যুদ্ধের সাংবাদিকতাও আমার বাড়তি কাজ ছিল। সে কারণেও আমার সাথে মিত্র বাহিনীর জন-কয়েকের পরিচয় ঘটেছিল। গার্ডস রেজিমেন্টের মেজর মালহােত্রাকে কাছে পেয়ে একবার জিজ্ঞেস করলাম, সত্যি সত্যি তােমরা কি আমাদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধে নামছ? মালহােত্রা সামান্য মুচকি হাসলেন। তারপর বল্লেন, ডােন্ট ওয়েস্ট টাইম। গেট ইওরসেলফ রেডি। ইমিডিয়েটলি। ডিসেম্বরের তিন তারিখেই শােনা গেল পাকিস্তান বাহিনী পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে। অমৃতসরে পাকিস্তানি বিমান হামলা হয়েছে। পাকিস্তানিদের অভিযােগ একটিই— শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর ভারত বাঙালি মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য সহযােগিতা দিচ্ছে। এক কোটি শরণার্থীকে জায়গা দিয়েছে। পূর্ব খণ্ডে পাকিস্তানিদের কলােনি হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে আছে, ইন্দিরা গান্ধী সেদিন এক বেতার ভাষণ দিয়েছিলেন। অনেক কিছুর মধ্যে বলেছিলেন, শরণার্থীদের জন্যে যখন ঘাম দিতে পেরেছি, তখন রক্তও দিতে পারব।
দেখলাম, শেষ রাতে ক্যাপ্টেন আজিজ ২০০ মুক্তিযােদ্ধার এক বাহিনী নিয়ে জামালপুরের দিকে চলে গেলেন। ঘাের অন্ধকার তখন। মেঘালয়ের পাহাড়ে ডিসেম্বরের শীত। লােকটাকে আমি ভীষণ ভালবাসতাম। খুব সহজ সরল মানুষ। হ্যান্ডশ্যাক করার পর আমাকেও তাঁর সাথে যেতে বললেন। আমি অন্য গ্রুপের সাথে যাবাে আগেই ঠিক করেছি। মেজর তাহেরের বড় ভাই আবু ইউসুফ খান বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের সাথে আছেন। আরও আছেন আমাদের গােয়েন্দা বিভাগের সুপরিচিত জহুরুল হক মুন্সি। পরিকল্পনা হচ্ছে একযােগে আক্রমণের। মহেন্দ্রগ, ডালু, পােড়খাসিয়া—সব শিবিরগুলিতেই সাজ সাজ রব। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এখন থেকে মুক্তিবাহিনী আর মিত্র বাহিনীর যৌথ আক্রমণ চলবে। পাহাড়-ঘেরা ভারতীয় সীমান্তের ক্যাম্পগুলি আমাদের ছাড়তে হবে, চিরদিনের জন্যে। কী মনে করে ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে যত্রতত্র ছবি তুলে যাচ্ছিলাম। টেপ রেকর্ডারটা ‘অন করে বন্ধু সহযােদ্ধাদের কথাবার্তা আর রাতের অন্ধকারে পাহাড়ি কীটপতঙ্গের শব্দ সঞ্চিত করে রাখছিলাম। সম্ভবত অনাগত ভবিষ্যতের জন্যে। এ ছিল আমার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের যৎসামান্য চেষ্টা। ডিসেম্বর ৪। কোলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ইন্দিরা গান্ধী ভাষণ দিলেন। পুরােদস্তুর যুদ্ধ। কারণ পাকিস্তানিরা ইতােমধ্যেই ভারত আক্রমণ করেছে। ভারত কেন বসে থাকবে। ভাের থেকেই মিত্র বাহিনীর যুদ্ধ বিমানগুলাে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে বিভিন্ন পাকিস্তানি লক্ষবস্তুতে আঘাত করছে। আমাদের কামালপুরের পাকিস্তানি শিবিরটির ওপর দিয়েও বেশ কয়েকবার উড়ে গেল। এর মধ্যেই কামালপুর-মহেন্দ্রগঞ্জ সীমান্তের ব্রাহ্মণপাড়ায় কয়েক শত মুক্তিযােদ্ধা জড়াে হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর কর্মকর্তাদের সাথে তারতীয় অফিসার আর সেনারাও আছেন। সবাই মিলে সলাপরামর্শ চলছে। কর্তব্য স্থির করার চেষ্টা হচ্ছে। ঠিক হলাে কামালপুরের পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণের চিঠি পাঠানাে হবে। যদি ওরা শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ না করে তাহলে আক্রমণ চলবে যে পর্যন্ত ওরা নিঃশেষ না হয় । কিন্তু ব্যাপক মাইন ফিল্ড পেরিয়ে, পাকিস্তানিদের মেশিনগানের বুলেট অগ্রাহ্য করে, প্রায় নিশ্চিত মৃত্যুর মুখােমুখি হতে কে যাবে সে চিঠি নিয়ে । এ যেন এক অসম্ভব প্রস্তাব! যে কামালপুরে এ যাবত হাজার কয়েক মুক্তিযােদ্ধা, ভারতীয় সৈন্য আর পাকিস্তানি মৃত্যুবরণ করেছে, যে কামালপুরের মাটি যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিদিন রক্তাক্ত হয়েছে, সেই কামালপুরের পাকিস্তানি শিবিরে সারেন্ডারের চিঠি নিয়ে কে যাবে। ভারতীয় জেনারেল গীল বােধ করি বাঙালি মুক্তিযােদ্ধাদের সাহস আর দেশপ্রেম পরখ করতে চেয়েছিলেন। বললেন, কে যাবে তােমাদের মধ্যে। ঝটপট হাত তোেল।’ কয়েক মুহূর্ত নীরবতা।
আমার হাতে স্টেনগান আর ক্যামেরা। ভাবছিলাম, বলি, আমিই যাবাে। দেখতে পাচ্ছিলাম, আমার মতাে অনেকেরই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছিল। কিন্তু মুহূর্ত বিলম্ব না করে হঠাৎ হাত তুলে সােজা হয়ে দাঁড়াল আমাদেরই দু’জন। দু’জনেই আমার বয়োকনিষ্ঠ। একজন বসির অন্যজন সন্তু। আমি ওদের চিনতাম। আমার স্নেহাস্পদ ওরা। খুবই সাধারণ গােবেচারা গােছের। জীবনের বিনিময়ে এতটা সাহস আর দেশপ্রেম ওরা যে দেখাতে পারবে তা আগে কখনােই মনে হয় নি। কিন্তু ওরাই পরিল। আনন্দে, উত্তেজনায় আমি ওদের ছবি তুললাম। বারবার করে আমার ক্যামেরার সাটার টিপলাম। শুধু আমি কেন, উপস্থিত সকলেই ওদের বুকে জাপটে ধরল। সবাই ধরে নিল— এ যাত্রাই ওদের শেষ যাত্রা। কারণ একে তাে পাকিস্তানিরা কখনােই আত্মসমর্পণ করবে না, অন্যদিকে হয় ওরা মাইন বিস্ফোরণে মরবে, নয় তাে পাকিস্তানিরাই ওদের গুলি করে মারবে। কাজেই ওদের শেষ বিদায় জানানােই ভাল। প্রথমে গেল বসির। হাতে চিঠি আর একটি সাদা পতাকা। বীর দর্পে হেঁটে চলল সে। কয়েক হাজার চোখের রক্তাক্ত মণি ভেদ করে সীমান্ত ঘেঁসা গ্রামের ছেলে বসির দর্পে। হেঁটে চলল কামালপুরের পাকিস্তানি ঘাটির দিকে। না, কোনাে বিস্ফোরণ ঘটল না। কোনাে গুলির শব্দ হলাে না। আমাদের চোখের সামনে মুক্তিযােদ্ধা বসির লুটিয়ে পড়ল। না। সে এক ভয়ঙ্কর উৎকণ্ঠা। আমরা সবাই সে দৃশ্য দেখছি। কিন্তু নির্ধারিত সময়েও বসির ফিরে এল না। পরিকল্পনা মাফিক এবার যাবার পালা সঙ্কুর। কোনাে কথা না বলে হাঁটতে থাকল সেও। ঠিক যে পথ দিয়ে বসির গিয়েছিল সে পথেই চলল দ্বিতীয় জন। এবারেও সেই একই উৎকণ্ঠা। আমরা প্রায় সকলেই ধরে নিয়েছি। আমাদের এ দুই বন্ধুর মৃত্যু অবধারিত, শহীদের খাতায় আরও দুটি নতুন নাম উঠবে। বসির যেমন আর ফিরবে না তেমনি ফিরবে না সস্তু। কামালপুরের মাটিতে মিশে যাবে ওদের দেহ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ঘটে নি। এক ঘণ্টারও বেশি সময় চলে গেছে এরই মধ্যে। পাকিস্তানিদের আক্রমণ সর্বাত্ত্বক করে পরাস্ত করা ছাড়া পথ নেই, ধরেই নিতে হলাে আমাদের। কিন্তু না, এক সময় আমাদের সকলের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার অবসান ঘটল। দেখলাম, আমাদের প্রিয় বসির আর সঞ্জুর পিছে এক লাইনে বেশ কিছু পাকিস্তানি সৈন্য। হাত তুলে এগিয়ে আসছে। গুণে দেখা গেল সংখ্যায় ওরা ১৬০। আনন্দে আমাদের অনেকের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকল।
জয় বাংলা’ বলে অনেকে জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠল। শেষ পর্যন্ত তাহলে বর্বর পাকিস্তানিরা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলাে! যে পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের হাজার হাজার স্বাধীনতাকামীর জীবন নিয়েছে ধর্মের নামে, লাখাে বাঙালির ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে পাকিস্তানের অলীক অখণ্ডতার নামে, সেই পাকিস্তানিরা শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছেই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই বন্দি পাকিস্তানিদের দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। প্রতিশােধের আগুন জ্বলে উঠল মনে। অস্বাভাবিকও কিছু ছিল না তা। কিন্তু ভারতীয় সেনাদের প্রখর নিরাপত্তায় ওরা বহাল তবিয়তে রইল। জেনেভা কনভেনশনের নিয়ম অনুযায়ী ওদের হেফাজত করা হলাে, মর্যাদা দেয়া হলাে যুদ্ধবন্দির। আমরা চাইলাম বন্দিরা আমাদের হেফাজতে থাকুক, কিন্তু ওরা রইল ভারতীয়দের তত্ত্বাবধানে। আজ এত বছর পর পাকিস্তানিদের প্রথম আত্মসমর্পণের ঘটনাটি আমাকে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ঘােলই ডিসেম্বরে ঢাকার ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ দেখি নি বলে মনের কষ্টটা কমিয়ে দেয়। আমি জানি, যদ্দিন বাঁচব, এই স্মৃতিকে মনে রাখবে। মনে রাখবে আমার মতাে কয়েক হাজার মুক্তিযােদ্ধা আর। ভারতীয় সৈনিক যারা সেদিন কামালপুরে উপস্থিত ছিলেন। আমার কাছে ৪ঠা ডিসেম্বরের প্রথম আত্মসমর্পণের এ ঘটনাটি দুর্লভ এক সম্পদ। অত্যাচারীর পরাজয়। ন্যায্য প্রতিরােধের কাছে বর্বরতার আত্মসমর্পণ। আমাদের স্বাধীনতার বিজয়। না, পাকিস্তানের জনগণ নয়, আমরা এবং আমি সকলে মিলে চেয়েছিলাম সেদিনের সেনাপতি-শাসিত তথাকথিত ধর্মান্ত্রিক পাকিস্তানের পতন। চেয়েছিলাম, সভ্যতার স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, প্রগতি আর সামাজিক ন্যায় বিচারের স্বার্থে ধর্মাশ্রয়ি শােষক পাকিস্তানের পতন। সে একই কারণে আজও চাই আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশ ধর্মান্ধতায় আর কুসংস্কারে আত্ন না হােক। মানুষ হিসেবে আমরা সামনে এগােই, পিছনে নয়।
ডিসেম্বর, ১৯৯৯
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ – হারুন হাবীব