You dont have javascript enabled! Please enable it! জনযুদ্ধের উপেক্ষিত মানুষেরা - সংগ্রামের নোটবুক

জনযুদ্ধের উপেক্ষিত মানুষেরা

জাতীয় স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম বা যে কোনও মুক্তিযুদ্ধই জনযুদ্ধ, চিরাচরিত প্রথায় যুদ্ধবিগ্রহ নয়, এটি স্বতঃসিদ্ধ। ১৯৭১ সালের আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সে কারণে সার্বিক অর্থেই এক জনযুদ্ধ। এই জনযুদ্ধে প্রথমত অংশগ্রহণ করেছিল ছাত্রজনতা, গ্রাম-গঞ্জশহরের সাধারণ শিক্ষিত-অশিক্ষিত তরুণেরা, সেই সঙ্গে বাঙালি দেশপ্রেমীক সেনাবাহিনী ও আধা-সামরিক সীমান্ত প্রহরী ইপিআর, পুলিশ ও আনসার। অন্যদিকে এই যুদ্ধের সবচে’ বড় শক্তি ছিল গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষ, যারা তাদের জীবনের বিনিময়ে মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, নিরাপত্তা দিয়েছে, পাকিস্তানিদের পরাস্ত করতে গেরিলাদের সর্বাত্মক সহযােগিতা করেছে এবং খাদ্য যুগিয়েছে। ১৯৯৩ সালে জনযুদ্ধের উপাখ্যান’ নামে আমার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটিতে আমি মুক্তিযুদ্ধে আমার নিজের অংশগ্রহণের কিছু অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করি। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে নিজের তােলা কিছু ছবি এবং সংগৃহীত কিছু ডকুমেন্ট ছাপাই। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, মুক্তিযুদ্ধকে ‘জনযুদ্ধ’ বলায় আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন যথেষ্ট। উন্মা প্রকাশ করেন। তাদের ধারণা, মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধ বলে পরিচিত করলে মুক্তিযুদ্ধবিরােধীরা সুযােগ নিতে পারে; এবং এতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-বিকৃতির ষড়যন্ত্র আরও জোরদার হয়ে উঠতে পারে। আমি অবশ্য এ ধরনের যুক্তির সঙ্গে একমত হই নি। হইনি, কারণ, আমাদের এই সমাজে মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধ বলে পরিচিত না করার জন্যে এক শ্রেণীর মানুষ আছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধকে কেবলমাত্র একটি ‘লড়াই’ বা সামরিক কর্মকাণ্ড’ বলে চালিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চেয়েছে। এই শ্রেণীটির হাতে আমাদের একাত্তরের জনযুদ্ধের ইতিহাস, যা একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার ফসল এবং যা একটি ধারাবাহিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের ফলাফল, যথেষ্টই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই শ্রেণীর হাতে মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘকাল যাবত পরিচিত হয়েছে কেবলমাত্রই এক যুদ্ধ বলে, যা পেশাদার সৈন্যদের কাজ বৈ কিছু নয়। আমার বিশ্বাস জাতীয় স্বাধীনতার সর্বাত্মক মহান জনযুদ্ধকে সামরিকায়ন করার এটি ছিল একটি কৌশল, যা করে দেশের রাজনীতিকে সামরিকায়ন করার সুযােগ সৃষ্টি করা হয়েছিল।

১৯৭১ সালের তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বেরিয়ে আসা বাঙালি সেনা এবং ইপিআর ও পুলিশের একটি বড় অংশ যােগ দিয়েছিল। জাতীয় স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম যেহেতু একটি সামরিক কর্মকাণ্ডও, সেহেতু দেশপ্রেমী বাঙালি সেনাবাহিনী বা অন্যান্য পেশাদার যােদ্ধাদের অংশগ্রহণে মুক্তিযুদ্ধে গতি এসেছিল এবং সামরিক কর্মকাণ্ড বেগবান নিঃসন্দেহে হয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সে কারণে। এটি একদল উল্লেখযােগ্য অগ্রগতির অধ্যায়। কিন্তু বড় কথা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে এদের  অংশগ্রহণের পরও সে যুদ্ধ কোনাে কনভেনশনাল ওয়ার’ বা গতানুগতিকে যুদ্ধে পরিণত হয় নি। এ যুদ্ধের নীতি নির্ধারণ করেছে রাজনীতিবিদরা, এর নিয়ন্ত্রক ছিল রাজনীতি আর মূল শক্তি ছিল সাধারণ মানুষ। এ যুদ্ধের পেছনে দীর্ঘ রাজনৈতিক, সামাজিক আর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ঐতিহ্য থাকার কারণে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছিল ছাত্র, কৃষক, মজুর আর গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষের হাতে পরিচালিত এক জনযুদ্ধ, সাধারণ অর্থে কোনাে যুদ্ধ বা লড়াই নয়। এ বছর মহান মুক্তিযুদ্ধের বা আমাদের গর্বের ঐতিহাসিক জাতীয় জনযুদ্ধের ছাব্বিশতম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ আজ অনেককালের পুরনাে ঘটনা, যদিও এর প্রাসঙ্গিকতা আমাদের রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রেক্ষাপটে কমেছে বলে ভাববার কারণ নেই। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের বা বাঙালির স্বাধীনতা আর প্রগতির শত্রুরা এখনও, এত বছর পরও যখন হাল ছেড়ে দেয় নি, তখন পুরনাে হলেও মুক্তিযুদ্ধের প্রাসঙ্গিকতা আছে বৈকি! আজ আবার মনে পড়ছে, সেই উপেক্ষিত গণমানুষদের কথা, যাদের সক্রিয় সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া সুশিক্ষিত পাকিস্তান বাহিনীকে পরাস্ত করতে পারতাম না আমরা কখনই। অথচ গ্রামগঞ্জের সেইসব মানুষেরা, যারা মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য সহযােগিতা করার অপরাধে নির্যাতিত হয়েছে, নিপীড়িত হয়েছে, যাদের ঘরবাড়ি জ্বলেছে মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে, যাদের মেয়ে বা গৃহবধূরা নিগৃহীত হয়েছে মুক্তিযােদ্ধাদের খাবার যােগাতে গিয়ে, তারা কিন্তু একটিবারের জন্যেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্থান করে নিতে পারে নি। এ আমাদের এক জাতীয় ট্যাজেডি নিঃসন্দেহে। এদের আমরা মুক্তিযোদ্ধা বলেও যেমন মর্যাদা দিই নি, তেমনি একটিবারের জন্যেও এদের কথা ভাববার অবকাশ পাই নি কেউই। মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই আমরা পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। প্রতিষ্ঠিত হয়েছি কেউ আমরা আমাদের পারিবারিক কারণে, কিংবা কেউ কেউ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক সুযােগ সুবিধেয়।

কিন্তু গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মুক্তিযােদ্ধাদের বেশির ভাগই আজও সার্বিকভাবে উপেক্ষিত, অচিহ্নিত। মুক্তিযােদ্ধাদের জন্যে কেবলমাত্র একটি রাষ্ট্রীয় পদকই বেশি কিছু নয়, কিন্তু এদের কেউই সেই পদকটি পর্যন্ত পায় নি। এদের কাউকে রাষ্ট্রীয় কোনও অনুষ্ঠানে কোনও দিন ডাকা হয় নি। অথচ এই অগণিত দেশপ্রেমীর নিঃস্বার্থ বলিদান না হলে মুক্তিযুদ্ধ সফল হতে পারত না, এ জাতির স্বাধীনতা আসত না। লেখাটা লিখতে গিয়ে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। জুলাই কী অগাস্ট মাসে মেঘালয়ের ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে উত্তর-জামালপুরের চর অঞ্চল দিয়ে সামনে এগুচ্ছি। পাকিস্তানি সৈন্যদের রসদ বহন করা ট্রেনে হামলা চালানােই আমাদের গেরিলা দলটির উদ্দেশ্য আমাদের কাছে খবর আছে, রাতের বেলা জামালপুর থেকে সৈন্য আর রসদ বােঝাই হয়ে ট্রেন চলাচল করে বাহাদুরাবাদের পাকিস্তানি ক্যাম্পে। বাহাদুরাবাদের পাকিস্তানি ক্যাম্পে এর আগেও হামলা হয়েছে মুক্তিফৌজের। ক্ষয়ক্ষতি যথেষ্টই হয়েছে। কিন্তু আবারও গুছিয়ে নিয়েছে ওরা। অতএব ওদের রসদ সরবরাহের লাইন কেটে দিতে হবে। হামলাটা গুছিয়ে নিতে সুবিধেজনক একটি গ্রামে থাকতে হবে আমাদের কয়েক ঘন্টা।  গ্রামটার নাম আজ আর মনে পড়ে না। পশ্চিম পাশে বিশাল পুরনাে ব্রহ্মপুত্র। সারি সারি শন আর ঝাউগাছের বন। নদী পারে নৌকোর জন্যে অপেক্ষা করছি আমরা একদল মুক্তিযােদ্ধা। কীভাবে নদীটা পাড়ি দেয়া যায় তার চিন্তা করছি। সূর্য তখনও ডােবে নি। আমাদের দেখে গ্রামের বেশ কিছু লােক এসে ভিড় করল। আমাদের কাউকেই ওরা চেনে না। আমরাও চিনিনে ওদের কাউকে। কিন্তু ওদের সঙ্গে আমরা মন খুলে কথা বলতে লাগলাম। ওরা আমাদের দুঃখকষ্টের কথা, ভারতে আমাদের ট্রেনিং-এর কথা, খাবার দাবারের কথা জানতে চাইল। কী নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যে, পাকিস্তানি আর স্থানীয় দালালদের অত্যাচারের মধ্যে তারা জীবনযাপন করছে, তা জানাল। আগ্রহ ভরে জানতে চাইল, কবে নাগাদ পাঞ্জাবিদের আমরা তাড়াতে পারব। বারবার করে অনুরােধ করল, আমরা যেন একবেলা ওদের ওখানে খেয়ে যাই, গ্রাম ছাড়ার আগে। পাকিস্তানি সৈন্য আর স্থানীয় রাজাকারেরা ক’দিন আগেই ওদের নৌকোগুলি জোর করে নিয়ে গেছে। হাট বাজার করতে ওরা এখন নদী পাড়ি দিতে পারছে না। কিন্তু আমাদের প্রয়ােজন নদী পার হওয়া। এক্ষুণি না হােক, অন্তত রাতের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে রেললাইন ধরে নির্দিষ্ট জায়গায় আমাদের পৌছতে হবে। প্রথমে প্রয়ােজন একটি রেকি টিম’ পাঠিয়ে ওপারের পরিস্থিতি জেনে নেয়া। কিন্তু নদী সঁতরে কে যাবে।

প্রস্তাবটা পাড়তেই তিন-চারজন গ্রাম্য যুবক স্বতঃস্ফূর্তভাবে নদী সাঁতরে ওপারে যেতে তৈরি হল। আমরা ওদের বুঝিয়ে দিলাম কী কী ওদের করতে হবে, কী কী খবর আনতে হবে। ওরা একবারও ভাবল না, ওপারে গেলে ওরা। মুক্তিযােদ্ধাদের চর হিসেবে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়তে পারে এবং সে অপরাধে ওদের জীবনও যেতে পারে। সে-রাতে আমাদের চল্লিশ জনের দলটির জন্যে খাবারের ব্যবস্থা করেছিল সেই গ্রামবাসীরা অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে। নদী পেরিয়ে পাকিস্তানিরা হঠাৎ আমাদের আক্রমণ করতে আসে কিনা, তার খোঁজ রেখেছে ওরা গভীর রাত পর্যন্ত দূরদূরান্তে দাড়িয়ে থেকে। বাড়ির যুবতীরা, বৃদ্ধারা সবাই মিলে বাড়ির আঙ্গিনায় কুপি আর হারিকেন জ্বালিয়ে আমাদের খাবার পরিবেশন করেছে। আমরা তাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছি। বলেছি, এই যে আপনারা মুক্তিযােদ্ধাদের প্রাণ খুলে ভালবাসছেন, এতেই আমাদের জাতির স্বাধীনতা আসবে। আপনারা আমাদের জন্যে দোয়া করবেন। আমি লক্ষ করে দেখেছিলাম, আমাদের মুখে স্বাধীনতার কথা শুনে ওরা ওদের চোখগুলিকে বড় বড় করে তাকিয়েছিল। হয়ত বুঝতে চেষ্টা করেছিল, স্বাধীনতা আসলেই কী? আজও আমার ঘটনাটি মনে পড়ে। আমাদের জন্যে নদীর ওপারে ‘রেকি’ করতে গিয়ে দুজন গ্রাম্য যুবক ধরা পড়েছিল সেদিন। ওরা কোনওদিন তাদের বাড়িতে ফিরতে পেরেছিল কিনা তার আর খোঁজ নেয়া হয় নি। শেষ পর্যন্ত নৌকো জোগাড় করতে পারে নি বলে অনেক মাইল হেঁটে অন্য পথে গন্তব্যে পৌছতে হয়েছিল আমাদের। এতকিছুর পরও সেবার আমাদের ‘অপারেশন’ সফল হয় নি। কিন্তু আমাদের আশ্রয় আর সহযােগিতা দেয়ার অপরাধে সেই গ্রামটিকে পরদিনই জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। নির্বিচারে গুলি করে অনেককে ওরা হত্যা করেছিল। যারা বেঁচে ছিল তাদের সান্ত্বনা দিতেও আর একবার সে গ্রামে আমরা যেতে পারি নি।

মুক্তিযুদ্ধে আমার কর্মস্থল ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং সে দিনের রংপুরের কিছু অংশ। সে সুবাদে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ডের অনেকের সঙ্গেই আমার সম্পর্কে গড়ে উঠেছিল। আমি ঢাকায় থাকি এবং পেশাগতভাবে সাংবাদিকতা করি বলে আমার সেদিনের রণাঙ্গন সাথীদের অনেকেই এখনও আসেন আমার কাছে মাঝে মধ্যে। তাদের দুঃখদৈন্যের, ক্ষোভ-আক্ষেপ আর ব্যর্থতার কথা বলেন। সেগুলির সাধ্যমতাে প্রতিকার চান। কিন্তু আমার মতাে একজন ব্যক্তির জন্য ওদের সংকটগুলির সমাধান দেয়া সম্ভব নয়। কারণ আমি কেবলই একজন ব্যক্তি, যার কোনও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নেই। সত্যি বলতে কী, সে কারণে নিজের প্রতি ক্ষোভ আমার প্রতিনিয়তই জমছে। এ ক্ষোভ হচ্ছে আমার একাত্তরের সাথীদের জন্যে কিছু না করতে পারার ব্যর্থতার । মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি দিয়েছে, যা ছিল সময়ের দাবি। প্রার্থিত এই স্বাধীনতা না এলে আমাদের এ অঞ্জলের বাঙালি সমাজের সার্বিক বিকাশ হতে পারত । আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, আমাদের শিক্ষা-সাংবাদিকতা আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের এতটা প্রসার নিশ্চয়ই ঘটত না। কিন্তু আমার ধারণা, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জাতীয় মুক্তিযােদ্ধাদের কপালে যে দুর্ভাগ্য জোটে নি, তা জুটেছে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ভাগ্যে। এত অবহেলায়, এত অযতনে মুক্তিযােদ্ধারা মৃত্যুবরণ করবে তা। ভাববার কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই, একাত্তরের মুক্তিযােদ্ধাদের অতি সামান্যই কেবল সম্মানিত হয়েছে, অতি সামান্যই কেবল তাদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি পেয়েছে, বিশাল-বিপুল সেই আত্মত্যাগীরা লােকচক্ষুর আড়ালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আমার ধারণা, জাতীয় স্বাধীনতার কল্যাণে সবচে’ বেশি উপকৃত হয়েছে আমাদের সমাজের দুটি কি তিনটি শ্রেণী। এদের একটি সিভিল ব্যুরােক্রেসি অন্যটি মিলিটারি ব্যুরােক্রেসি। সেই সঙ্গে নতুন এক ব্যবসায়ীগােষ্ঠী। যুক্ত পাকিস্তান থাকলে এদের যারা কোনওদিনই ‘সেকশন অফিসার’ বা ‘ডেপুটি সেক্রেটারি’র ওপরে উঠতে পারতেন না, কিম্বা মেজর বা লেঃ কর্নেলের ওপরে যেতে পারতেন না, সেই তারাই আজ জয়েন্ট সেক্রেটারি’ আর ‘সেক্রেটারি হচ্ছেন অবলীলায়, হচ্ছেন ব্রিগেডিয়ার’ ও ‘জেনারেল’।

এটিও নিঃসেন্দেহে একটি ভালাে দিক যাকে আমি জাতীয় স্বাধীনতার একটি শুভপ্রাপ্তি বলেও মনে করি। কিন্তু একই সঙ্গে মনে পড়ে, কী করেছি আমরা আমাদের সেই সাধারণ মুক্তিযােদ্ধাদের জন্যে, নীরবে-নিভৃতে কালযাপন করা মুক্তিযােদ্ধাদের জন্যে, যাদের সীমাহীন আত্মত্যাগ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ কোনওদিন সফল পরিণতি পেতে পারত না। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট বলে যে প্রতিষ্ঠানটি আছে, যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গড়ে গিয়েছিলেন, কী হচ্ছে সেখানে বছরের পর বছর। সবার কথা আমি জানি , কিন্তু কারও কারও কথা তাে জানিই। আবদুল আজিজ বলে একজন মুক্তিযােদ্ধাকে আমি জানি আর দুটো পা গেছে যুদ্ধে। মাত্র কয়েক বছর তার ভাতা চালু ছিল, কিন্তু আজ বেশ কয়েক বছর ধরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সে নিরন্ন। আমার কাছে এলে ওকে আমি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হই। হাজার আকুতিমিনতি করেও আবদুল আজিজ তার বন্ধ হয়ে যাওয়া ভাতা চালু করতে পারে নি। কল্যাণ ট্রাষ্টের হারানাে চাকরি ফিরে পায় নি। আজও বীর মুক্তিযােদ্ধা আলী আজগর জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের পঙ্গু মুক্তিযােদ্ধা সুরুজ মিয়ার স্ত্রী আজ ঢাকার বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। নয়াপাড়া গ্রামের সুরুজ মিয়া আজ পঙ্গু। আমার বাল্যবন্ধু সুজা, যাকে বীর প্রতীক দেয়া হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে দুঃসাহসী ভূমিকা রাখার জন্যে, আজ সে জীবনযুদ্ধে পরাস্ত কিন্তু কাউকেই কিছু জানাতে রাজি নয়, সে এমনই তার আত্মসম্মান। কত বলব এদের কথা। ক’দিন আগে ঢাকায় আমার বাসা খুঁজে বের করে গ্রাম থেকে এলেন আমার মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পের এককালীন প্রশিক্ষক, সেদিনের ইপিআর-এর জোয়ান বাজু মিয়া। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের সঙ্গে এই বাচ্চু মিয়া অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছেন মুক্তি যােদ্ধাদের উত্তর-ময়মনসিংহ ঘেঁসা মেঘালয়ের সীমান্তে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক দিনগুলিতে। কিন্তু আজ সে নিঃস্ব। কোথাও যাবার জায়গা নেই । কিন্তু যে মুক্তিযােদ্ধাদের কিছুই নেই তাদের মানসিক জোর বা তেজ কিন্তু কমে নি। না খেয়ে মরে যেতে রাজি কিন্তু মাথা নােয়াতে নয়। জাতির মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত হতে পারার মধ্যে যে গর্ব, সে গর্ব আজও এরা বহন করে চলেছে, না হয় অর্থবিত্ত কিছুই নেই। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলের সরকার ক্ষমতাসীন বলেই হয়তাে কথাটা বলা। আমরা কি আজ পারিনে এই সব উপেক্ষিত মুক্তিযােদ্ধাদের খুঁজে বের করতে, সেইসব আত্মত্যাগী গ্রামবাসীদের খুঁজে বের করতে, যাদের আত্মত্যাগ জাতির স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিল ?

ডিসেম্বর, ১৯৯৬

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ হারুন হাবীব