You dont have javascript enabled! Please enable it! সাতচল্লিশের চেতনা দিয়ে বাংলাদেশ চলবে কি - সংগ্রামের নোটবুক

সাতচল্লিশের চেতনা দিয়ে বাংলাদেশ চলবে কি ?

১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্তির চেতনা সমুন্নত করতে জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গােলাম আযম শীর্ষ বিরােধী রাজনীতিবিদদের এক ইফতারি। মােনাজাত পরিচালনা করেছেন সম্প্রতি রাজধানীর এক কমিউনিটি সেন্টারে। সে মােনাজাতে অংশগ্রহণ করেছেন আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সংসদে বিরােধীদলীয় নেত্রী এবং মুক্তিযােদ্ধা প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, এককালের স্বৈরশাসক এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্তর্গত বাঙালি সেনা অফিসারদের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান জে.এইচ.এম, এরশাদ এবং আরও কয়েকজন ধর্মপন্থী রাজনীতিবিদ। অধ্যাপক গােলাম আযমের বক্তব্যটি যদি তার নিজের বক্তব্য হতাে তাহলে আমার বিশেষ কিছু বলার থাকত না। কারণ যে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ উপমহাদেশ দু’ভাগ হয়ে (সেদিনের পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে কার্যত তিন ভাগ) ভারত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র দুটির সৃষ্টি হয়েছিল, সেই দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতেই গােলাম আযম এবং তার অনুসারীরা রাজনীতি করে থাকেন। অবশ্য গােলাম আযমের মােনাজাতে জে, এরশাদের অংশগ্রহণকে আমি তেমন গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে রাজি নই। কারণ তিনি মাত্র ক’দিন আগে শেখ হাসিনার সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছেন, জেল থেকে বের হয়েছেন, বেগম খালেদা জিয়াকে প্রতিনিয়ত গালমন্দ করেছেন এবং আজ সেসব বিসর্জন দিয়ে গােলাম আযম এবং বেগম জিয়ার চাটুকারিতা করছেন। দ্বিমত করি না আমাদের দেশীয় রাজনীতিতে এসব চরিত্র হরহামেশাই পাওয়া যায়। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, জে, এরশাদ না হয় তার মত এবং পথ হরহামেশাই বদলাতে পারেন, কিন্তু আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং শীর্ষ বিরােধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও কি তা পারেন। এর উত্তর হচ্ছে, দুর্ভাগ্যক্রমে, হ্যা, তিনিও পারছেন। গেল দু’সপ্তাহ ধরে হরহামেশাই ইফতারের রাজনীতি হচ্ছে, যেখানে গােলাম আযম, এরশাদ এবং খালেদা জিয়াকে এক সাথে দেখা যাচ্ছে শলাপরামর্শ করতে, কানে কানে কথা বলতে, এবং সেই অনুষ্ঠানগুলাের রঙিন ছবিও প্রতিটি দৈনিকে প্রকাশ পাচ্ছে। যারা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারার সুই রাজনীতি চান, তাদের প্রত্যেকেই সরকারের বাইরে একটি কি দুটি শক্তিশালী বিরােধী দল আশা করেন।

এ কারণেই আশা করেন যে, তাতে এক দলের আধিপত্য থাকে না এবং চেক এ্যান্ড ব্যালেন্সের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ স্বৈরতন্ত্রের উত্থান ঠেকাতে পারে। কিন্তু যে বিরােধী দল বা দলগুলাের মাের্চ রাষ্ট্রের অস্তিত্ববিনাশী তত্ত্বের সাথে নিজেদের যুক্ত করে, বাংলাদেশে বাস করে সাতচল্লিশের চেতনার পুনরুথান কামনা করে তারা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে কি না সে নিয়ে তাে প্রশ্ন আসতেই পারে। এবার অধ্যাপক গােলাম আযমের, অর্থাৎ মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম যুদ্ধাপরাধী। | হিসেবে বিবেচিত এই ব্যক্তিটির ‘৪৭-এর চেতনাসংক্রান্ত বক্তব্যে আসা যাক। কী ছিল ১৯৪৭-এর চেতনা। অর্থাৎ মুসলমানদের জন্য এক দেশ এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য আরেকটি । ব্যাপারটি যে একটি উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভাজন তাতে সন্দেহ নেই। অবশ্য কারও কারও কাছে এর প্রয়ােজন হয়তাে ছিল, কারও কারও কাছে নয়। সে যাই হােক, জাতি বা দেশের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক এই বিভাজনকেই ইতিহাসগতভাবে দ্বিজাতিতত্ত্ব বলা হয়ে থাকে। এখানে আরেকটি কথা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলা যেতে পারে, তা হচ্ছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাঝ দিয়ে স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা উপমহাদেশের এই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভাজনের তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করেছিল, যার ফলশ্রুতিই আজকের এই বাংলাদেশ। কাজেই ‘৪৭-এর চেতনাকে ১৯৭১-এর চেতনার সাথে মিলিয়ে তালগােল পাকাবার চেষ্টা একমাত্র গােলাম আযমরাই করতে পারেন আর কেউ নয়। আরও বলি। এ ইতিহাসও সকলের জানা যে, ১৯৪৭ সালের ব্রিটিশ-ভারতের বিভক্তিতে দুটি দলই কেবল মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। এর একটি পণ্ডিত নেহেরুর নেতৃত্বে ভারতীয় কংগ্রেস, অন্যটি মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মওদুদী, ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, এ দুই ধারার কোনােটিতেই যুক্ত ছিলেন না। বরং সেদিনের জামায়াতে ইসলামী একদিকে যেমন পণ্ডিত নেহেরুর কংগ্রেসকে গালাগাল করেছে অন্যদিকে সমালােচনা করেছে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর, যিনি পাকিস্তানের জাতির পিতা। মুণ্ডপাত করেছে তারা একই ধারায় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের। অন্যদিকে ভারত বিভাজনের বিরােধিতা করেছিল সেদিনের কমিউনিস্টগণও, যাদের সেদিনকার স্লোগান ছিল— ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখাে ইনসান ভুখা হ্যায়।’ আর এসব ভূমিকা নিয়ে এ দলগুলাে আসলে কার উদ্দেশ্য সফল করতে চেয়েছিল তা তারাই ভালাে বলতে পারবেন। কাজেই ‘৪৭-এর চেতনা কখনই অধ্যাপক গােলাম আযমের দলের চেতনা ছিল না আর ১৯৭১-এর চেতনার বিরােধিতা তাদের বিরুদ্ধে বাঙালির জাতীয় ইতিহাসের দলিলে রক্তাক্ষরে লেখা আছে— যা কোনাে দিনই মােছবার নয়।

বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখেছি অধ্যাপক গােলাম আযম ‘৪৭-এর চেতনার সাথে ‘৭১-এর চেতনাকে মিলিয়ে সম্প্রতি গঠিত চার দলীয় ঐক্যজোটের আগামী রাজনীতি ধারা প্রতিষ্ঠা করতে চান, বাংলাদেশকে তাঁদের মতাে করে চালাতে চান। তা যদি করা সম্ভব হয় কখনও, এবং তা যদি দেশবাসীর সমর্থন লাভ করে তাহলে একজন গণতান্ত্রিক মানুষ হিসাবে আমার হয়তাে তেমন কিছু বলার থাকে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রচেষ্টাকে সফল করা সম্ভব হলে একদিকে যেমন বাংলাদেশের নাম পাল্টে দিতে হবে, অন্যদিকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতে হবে ১৯৭১-এর রক্তপাত, দুঃখ-বেদনা এবং লাখাে শহীদের আত্মত্যাগ। সেই সাথে ভুলে যেতে হবে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি যা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মুছে দিতে হবে সেই সব ইতিহাস সেই বাষট্টি, ছেষটি আর উনসত্তরের গণ-আন্দোলন আর পাকিস্তানিদের হাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের সেই নির্যাতন আর নিপীড়নের ইতিহাসগুলােও। সে-কারণেই বলি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে যত অঘটনই ঘটুক না কেন, অন্তত এমন কোনাে অঘটন ঘটতে পারে না— যা ১৯৭১-এর চেতনাকে ভুলিয়ে দিতে পারে। কোন দল কখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাবে তা জনগণই নির্ধারণ করে দেবে ভােটের মাধ্যমে। কিন্তু, আমার সর্বান্তঃকরণ বিশ্বাস, এমন কোনাে দল এই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নেতৃত্ব করবে না, করতে পারে না— যার সাতচল্লিশের চেতনায় দেশ চালাতে চায়। বিএনপি’র সভানেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সম্প্রতি সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তিনি কি অধ্যাপক গােলাম আযমের মতাে ১৯৪৭-এর চেতনা পুনপ্রতিষ্ঠা করতে চার-দশীয় ঐক্যজোটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। উত্তরে তিনি সরাসরি কিছু না বললেও এটিই বুঝিয়েছেন যে, না, ও বক্তব্যটি জামায়াতে ইসলামীর আমীরেরই নিজস্ব, তাঁর দলের নয়, কারণ তাঁর দলের নিজস্ব একটি স্বতন্ত্র মেনিফেন্টো আছে। আমি জানি না, ঘটনা যা দেখতে পাচ্ছি তাতে বেগম জিয়ার এই স্বতন্ত্রতার দাবি কতদিন টিকবে। যদি টেকে ভালাে, তা না হলে বলতেই হবে বিএনপি ক্রমান্বয়েই একটি ধর্মীয় উগ্রবাদী দলে পরিণত হবে যা হবে আরেক দুর্ভাগ্য।

ডিসেম্বর, ১৯৯৯

 

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ হারুন হাবীব