You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.04 | আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলাে ১৫০ হানাদার পাকিস্তানি সৈন্য - সংগ্রামের নোটবুক

১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১

শেষ পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধাদের ঐতিহাসিক বিজয় সূচিত হলাে রক্তস্নাত কামালপুরের মাটিতে যে কামালপুর মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে প্রায় প্রতিদিন রক্তরঞ্জিত হচ্ছিল, সেই কামালপুরে প্রবেশ করে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি পতাকাকে টেনে নামিয়ে ফেলল ডিসেম্বরের ৪ তারিখ। আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলাে ১৫০ হানাদার পাকিস্তানি সৈন্য। ভারতীয় জেনারেল গিল নিজেই প্রস্তাব দিলেন আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে যাবার। কে যাবে এখন? দ্রুত রাজি হয়ে গেল স আর বশীর কী রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা আমাদের। কিন্তু না, পাকিস্তানিরা ওদের হত্যা না করে আত্মসমর্পণ করতেই সিদ্ধান্ত নিল। আমি সনু আর বশীরের ছবি তুলে রাখলাম মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী তারপর যৌথভাবে সামনে এগুতে থাকল আমরা এগুতে থাকলাম বকসিগঞ্জ আর শেরপুরের পথে সেখান থেকে পুরনাে ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে ঢুকে যাব আমরা জামালপুর। তারপর ঢাকার পথে বিজয়ের মহানন্দের মাঝেও আমাদের দুঃখ যে, সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহের আজ সাথে নেই। নভেম্বরের ১৪ তারিখ কামালপুরের এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে তাঁর একটি পা খােয়া গেছে। লেঃ মান্নান, আবু সাঈদ, আমি এবং অন্যরা ধানুয়া কামালপুরের পশ্চিম দিকে একটি আখ ক্ষেতে পজিশন নিয়ে আছি গভীর রাতে, হঠাৎ এক সময়, একযােগে গােলাবর্ষণ শুরু হলাে পাকিস্তানি শিবির কামালপুরের ওপর একই সাথে চলল তিন দিক থেকে আমাদের আক্রমণ পাকিস্তানিরা অবরুদ্ধ। বুঝতে পাচ্ছি, বিজয় আমাদের হাতের মুঠোয় কিন্তু আকশ্বিকভাবে তাহের আহত হলেন মর্টারের আঘাতে। ওয়াকি-টকিতে আমি বেলালের কান্নার আওয়াজ পেলাম। তাহেরকে উদ্ধার করে ভারতীয় সীমান্তের দিকে নিয়ে গেল বেলাল, সুজাসহ অন্য সহযােদ্ধারা। একটি পা তার কেটে ফেলতে হয়েছে। সেক্টরের ডাক্তার প্রেমাঙ্কুর রায় সাথে গেছে তাহেরের ভারতীয় হাসপাতালে। কিন্তু এই যন্ত্রণার পরও মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রায় বিরতি নেই। খাবারের কথা মনে নেই। ঘুমানাের সময় নেই।মেঠো পথ, ফসলের মাঠ সব পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি এবং সেই চলার কিছু কিছু ছবি ধারণ করছি আমি আমার ক্যামেরায়। ‘ডসেম্বরের তিন কি চার তারিখ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী আমাদের সাথে যােগ দিয়েছে। ওরাও চলছে আমাদের সাথে। পাকিস্তানি সৈন্যরা কামালপুরে পরাজিত হয়ে দি হটতে শুরু করেছে। দ্রুত আমরা বকসিগঞ্জে প্রবেশ করলাম। বকসিগঞ্জে ঢুকেই দেখলাম লােকে-লােকারণ্য। পাকিস্তানি শেরপুরের দিকে আসয়েছে ওদের কেউ কেউ ধরা পড়েছে। ক্যাপ্টেন মান্নান এবং সদরুজ্জামান।

হেলালকে দেখলাম বন্দি দু’জন পাকিস্তানি সৈন্যের সাথে কথা বলছে ওরা আহত সেই ছবিটিও বন্দি করলাম আমি আমার ক্যামেরায় এরই মধ্যে এক ঝলক দেখা হলাে তাহেরের অবর্তমানে নতুন সেক্টর কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ খানের সাথে। হামিদুল্লাহ খানের হাতে অনেক দায়িত্ব তখন। দ্রুত ছুটে যেতে দেখলাম হেলালুজ্জামান পান্নাকে ফারুককে পথে কোথায় যেন দেখা হলাে বীর সহযােদ্ধা কাজী জয়নুল আবেদীনের সাথে আমার নিজের থানা দেওয়ানগঞ্জের আরও অনেকের সাথে কিন্তু কারও হাতে তখন সময় নেই। যত দ্রুত শেরপুর পর্যন্ত পৌছা যায় ততই মঙ্গল। ক্যাপ্টেন আজিজ এরই মধ্যে চলে গেছেন আরেক পথে মহেন্দ্রপর থেকেই তিনি চাচ্ছিলেন আমি তার সাথে যাই কিন্তু আমার যাওয়া হয় নি আমি আমার ক্যাম্প থেকে একেবারে শেষের দিকে বেরিয়েছি সাথে আমাদের সেকটরের গােয়েন্দা অফিসার মনিরুজ্জামান এই সেই মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প যেখানে আমরা অনেকগুলাে মাস অবস্থান করেছি আমাদের যৌবনের একটি শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছি। ক্যাপ্টেন আজিজ নান্দিনা এলাকা হয়ে ঢুকবেন। ফয়েজুর রহমান তার কোম্পানি নিয়ে ইতােমধ্যেই জামালপুরের পথে পাকিস্তানিদেরকে পরাস্ত করতে পূর্ণ প্রস্তুতি সম্পন্ন। যুদ্ধের শেষদিকে একটি হােন্ডা ফিফটি মােটর সাইকেল হাতে এসেছিল আমার কামালপুর থেকে সেই বাহন নিয়ে আমি আর আবু সাঈদ খান শেরপুরের দিকে দুটলাম। সড়কের দুই পাশে আগুনে পােড়া অসংখ্য বাড়িঘর  কিন্তু শেরপুরে এসেই থমকে দাঁড়ালাম ডিসেম্বরের ৬ খুব সম্ভবত সেদিনই পাকিস্তানিদের হাত থেকে শেরপুরের পতন ঘটল। পুরনাে ব্রহ্মপুত্রের ওপারে পাকিস্তানিরা প্রতিরােধ তৈরি। করেছে, যাতে আমরা জামালপুরে প্রবেশ করতে না পারি। এপার থেকে আমাদের গােলা নিক্ষিপ্ত হচ্ছে অবিরল ধারায় ওপার থেকে পাকিস্তানিরাও গােলা ছুঁড়ে যাচ্ছে।

ইতােমধ্যে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের সাথে হেলিকপ্টারে করে ইউসুফ ভাই (আবু তাহেরের বড় ভাই আবু ইউসুফ খান) এসে পৌঁছলেন ঝগড়ার চরে। আসলে জামালপুর থেকে পাকিস্তানিদের সেই প্রতিরােধ ছিল পালাবার কৌশলমাত্র। তারা ঢাকার দিকে পালাবার সময় খুঁজে নিতে চেয়েছিল। একদিকে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে আমাদের অপেক্ষা, অন্যদিকে অসমসাহসী মুক্তিযােদ্ধা জহুরুল হক মুন্সিকে পাঠানাে হলাে পাকিস্তানি হেড কোয়ার্টার্সে আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে। আরেক শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষা কে জানে জহরুল হক মুন্সি আর কখনও ফিরবে কিনা মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে শক্ত ভাষায় বলা হলাে, হয় আত্মসমর্পণ কর, নয় মৃত্যুবরণ কর অবশ্য যুদ্ধ তখনও চলছে জামালপুরের বিভিন্ন অংশে প্রায় গােটা মহকুমা শহর অবরুদ্ধ। কোম্পানি কমান্ডার রুহুল আমীনের নেতৃত্বাধীন যােদ্ধারা পিটিআই থেকে আরও কিছু দূরে বেলটিয়া গ্রামে সেখানেও চলছিল তখন সামনাসামনি যুদ্ধ। এই যুদ্ধে অসম সাহসে লড়ে যাচ্ছিল তরুণ মুক্তিযােদ্ধা মু’তাসিম বিল্লাহ খুররম তার প্লাটুন নিয়ে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হলাে খুররম এক সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে রক্তাক্ত যুদ্ধ চলতে থাকল অনেকক্ষণ অগ্রবর্তী এই প্লাটুনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বেলটিয়ায় হঠাৎ শহীদ হলাে খুররম। অবিভক্ত ময়মনসিংহ অঞ্চলে একমাত্র শহীদ— যাকে বীরবিক্রম উপাধিতে অভিষিক্ত করা হয়েছে হাজারাে সালাম এই বীর বাঙালিকে যার রক্ত মিশে আছে আমাদের প্রিয় স্বদেশের মাটিতে শহীদ খুররমের সাথে ব্যক্তিগতভাবে কখনই আমার পরিচয় হয় নি। মুক্তিবাহিনীর হাজার হাজার বন্ধুর অনেকেই অনেককে চিনতাম, ঘনিষ্ঠও ছিলাম কিন্তু সকলেই সকলকে নয়। ১৯৭১ ছিল এক গণযুদ্ধ। সাতাশ বছরের পুরনাে। আজ এত বছর পর সবাইকে মনেও নেই। আমার নিজের থানার অসংখ্য বীর মুক্তিযােদ্ধা যারা আজও বেঁচে আছেন। তাদের ক’জনকেইবা আমি আজ মনে করতে পারি? নাছির কোম্পানির সেই নাছির, সেই এনায়েত, পান্না, খুররম, খােরশেদ, বাদু ভাই, নুরু, আদিল, রুনু, কামাল, মতিউর— এঁদের কাউকে কাউকে মনে পড়লেও সবাইকে মনে করতে পারি কই।। কিন্তু খুররমের অসীম সাহসের কথা আমি অনেকবারই শুনেছিলাম। সাহসী আর প্রবল বুদ্ধিদৃপ্ত গেরিলাদের খুব পছন্দ করতেন যুদ্ধের কমাণ্ডার আবু তাহের। মু’তাসিম বিল্লাহ খুররম ছিল তাঁদেরই একজন।

কিন্তু আজ শুনলাম ওর মৃত্যু সংবাদ। খুররম শহীদ হলাে ১০ ডিসেম্বর, যেদিন পাকিস্তানিদের ৬০০ হানাদার সৈন্যের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে জামালপুর শত্রুমুক্ত হলাে বিজয়ের হাসি নিয়ে মুন্সি জহুরুল হক ফিরে এলাে। জামালপুর-শেরপুরের সর্বশেষ শহীদ মু’তাসিম বিল্লাহ খুররম যে তরুণ কলেজ ছাত্রটি শেষ পর্যন্ত তার দেশের পূর্ণ স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেন নি। ডিসেম্বর ১০ আমার নিজের জেলা জামালপুরের জন্য স্বাধীনতার অমর ইতিহাসের একটি অনন্য দিন। পুরনাে ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে, চারদিক থেকে দলে দলে মুক্তিবাহিনী ঢুকছে জামালপুরে। পাকিস্তানি পতাকাকে টেনে নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা টাঙিয়ে দিল বীর মুক্তিযােদ্ধা ফয়েজুর রহমান চোখে তখন সবার পানি। জয় বাংলার স্লোগানে মুখরিত জামালপুর। আমরা এক সময় দয়াময়ী বাড়িতে গিয়ে পৌছলাম। আপাতত সামান্য বিশ্রাম। তারপর মধুপুর এবং ময়মনসিংহের পথে শুনলাম, ময়মনসিংহ থেকেও পাকিস্তানিরা পালাতে শুরু করেছে আমি আমার হােন্ডা ফিফটি নিয়ে শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরছি আমার। প্রথম তারুণ্যের সঙ্গী প্রিয় জামালপুর। হঠাৎ দেখা হয়ে গেল বন্ধু শহীদুল্লাহর সাথে  পরে সিদ্দিক চাচার সাথে (আসলে পাথালিয়ার সিদ্দিক জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজে আমার সহপাঠী, কিন্তু আমরা ওকে কেন যেন চাচা বলতাম)। সিদ্দিক চাচা। আমাকে নিয়ে গেলেন কলেজ ক্যাম্পাসে সেখান থেকে ডিগ্রি হােস্টেলে, তারপর কত গােরস্থান। স্টেনগানটা সিদ্দিক চাচার হাতে দিয়ে রক্ত আর লাশের ছবি তুললাম আমি একের পর এক। হানাদার পাকিস্তান বাহিনী, আল-বদর আর রাজাকারদের হাতে শহীদ অগণিত স্বাধীনতাকামীর রক্ত আর সেই কঙ্কাল। সাংবাদিক আহসানের লাশটাকে তাে আর খুঁজেই পাওয়া গেল না। শুনলাম, ওকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে খুন করা হয়েছে।

ডিসেম্বর, ১৯৯৮

 

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ হারুন হাবীব