You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৯ই অক্টোবর, বুধবার, ১৯৭৪, ২২শে আশ্বিন, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

ইরাক-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব

ইরাকের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব নতুন নয়, বঙ্গবন্ধুর সফরের পরে দু’দেশের সেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই দৃঢ়তর হয়েছে। ইরাকী জনগণ এবং সরকার হৃদয়ের যে উষ্ণতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সম্বর্ধনা জানিয়েছে তাঁর সঙ্গে আলোচনার সময় বাংলাদেশের জনগণের প্রতি যে সহানুভূতি এবং সহযোগিতা প্রদানের মনোভাব ব্যক্ত করেছে তা নিঃসন্দেহে সেই নিবিড় বন্ধুত্বেরই প্রকাশ। আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইরাকই প্রথম দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তব পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল আর সেই উপলব্ধির আলোকেই বাংলাদেশ পেয়েছিল স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইরাকের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
সেই গোড়া থেকেই ইরাকী জনগণ এবং তাদের বিপ্লবী সরকার বাংলাদেশের প্রতি তাদের সাহায্য এবং সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত রেখেছিল। তেল সংকট যখন আমাদের অর্থনীতিকে একটা মারাত্মক হুমকির মুখোমুখি এনে দাঁড় করেছিল তখনও ইরাক বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। আগামীতেও আমাদের প্রয়োজনীয় তেলের একটা বড় অংশ ইরাক সরবরাহ করবে।
ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ বন্যায় যখন হাজার হাজার দুর্গত মানুষ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিল তখনো ইরাকী জনগণ তাদের বাংলাদেশী ভাইদের জন্য পাঠিয়েছিল সাহায্য। এবার ইরাকী নেতাদের সাথে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা শেষে অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। ইরাক বাংলাদেশকে পাঁচ কোটি দশ লাখ ডলার সাহায্য দিতে রাজী হয়েছে। এর মধ্যে ষাট লাখ ডলার দান হিসেবে এবং বাকীটা ঋণ হিসেবে পাওয়া যাবে। ঋণের অধিকাংশই ব্যয়িত হবে বিভিন্ন প্রকল্পে।
বন্ধুত্বের পরীক্ষায় ইরাক উত্তীর্ণ একটি দেশ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যা সম্পর্কেও ইরাক এবং বাংলাদেশ ঐক্যমত পোষণ করে এসেছে। যেমন উপমহাদেশের প্রশ্নে তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারেও দু’টি দেশ শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সমস্যাবলীর ন্যায়সঙ্গত সমাধানের আহ্বান জানিয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধুর ইরাক সফর শেষে প্রকাশিত যুক্ত ইশতেহারেও বাংলাদেশ এবং ইরাকের অভিন্ন মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে। এছাড়া ঐ যুক্ত ইশতেহারে উভয় দেশ অর্থনৈতিক এবং কারিগরি সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি স্থায়ী যুক্ত কমিটি গঠনে সম্মত হয়েছে।
আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশ এবং ইরাকের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো বৃদ্ধি পাবে। এ সম্পর্ক সম্প্রসারিত হবে আরো নানা ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের মতো ইরাকও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ইরাক বাংলাদেশের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতর বন্ধু। জনগণের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধি আনয়নের জন্য উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো তাদের সহযোগিতার মাধ্যমে অগ্রসর হবার যে নীতি জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে ঘোষণা করেছে ইরাক-বাংলাদেশ মৈত্রী সে পথেই বলিষ্ঠ এক পদক্ষেপ। দু’দেশের সরকার এবং জনগণের মধ্যে নিবিড়তম সম্পর্ক গড়ে উঠুক, পারস্পরিক সাহায্য এবং সহযোগিতার ভিত্তিতে দু’দেশের জনগণই অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধি লাভ করুন এটাই আমাদের কাম্য।

একটি অসময়োচিত অর্ডিন্যান্স

গত সোমবার সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে পাট বিক্রি সম্পর্কিত একটি অর্ডিন্যান্স জারী করা হয়েছে। ১৯৭৪ সালের পাট উৎপাদনকারী (সীমান্ত এলাকা) রেকর্ড অর্ডিন্যান্স মোতাবেক খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া ও রাজশাহী জেলার দশমাইল সীমান্ত এলাকার পাটচাষীদের ১৫ই নভেম্বর এবং অপরাপর সীমান্তবর্তী চাষীদের ১৫ই অক্টোবরের মধ্যে গৃহস্বামীর ব্যবহারের জন্য দুই মণ বাদে চলতি বছরের উৎপাদিত অবশিষ্ট সকল পাট বিক্রির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ১৯৬২ সালের পাট অর্ডিন্যান্স মোতাবেক ১০ মাইল সীমান্ত এলাকার মধ্যে পাট ক্রয়ের লাইসেন্স প্রাপ্ত বেপারী ফড়িয়া, আড়তদার, কাঁচা বেলার, পাট রপ্তানী কর্পোরেশনের রপ্তানীকারী এজেন্ট চটকল এবং সরকারী পাট কর্পোরেশনের এজেন্সীর কাছে এ সব পাট বিক্রি করতে হবে।
স্থিরীকৃত এই নয়া অর্ডিন্যান্সের মূল উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হয়নি। তবে সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে ব্যাপকহারে কাঁচা পাটের চোরাচালান বন্ধ সম্পর্কিত কার্যক্রমের এটা একটা বিশেষ অঙ্গ বলে দেশবাসী মনে করছে। সিদ্ধান্ত এবং কার্যক্রম হিসাবে এটা একটা বলিষ্ঠ পদক্ষেপ তাতে আপাততঃ সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
পত্রিকান্তরে পরিবেশিত বিভিন্ন রিপোর্ট ও তথ্য যতটুকু এ পর্যন্ত আমাদের হাতে এসেছে, তাতে এটুকুই সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, চলতি পাট মওসুমে উৎপাদিত কাঁচা পাটের একটা বিপুল অংশ সীমান্তপথে অপর দেশে পাচার হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। কাঁচা অবশিষ্ট পাটে এ বছর দেশের আভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ হবে কিনা, তা নিয়ে ইতিমধ্যে নানা মহলে বিভিন্নভাবে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সরকারীভাবে অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো প্রতিবাদ জানানো হয়নি এবং আমরা ধরে নিতে পারি, আশংকা যেহেতু মিথ্যা এবং অমূলক বলে বিবেচিত হয়েছে সরকারের কাছে, তাই প্রতিবাদের প্রশ্ন উঠেনি। তবে এ কথা সত্যি যে, আভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ হলেও পাটের রপ্তানী বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটা সংকট আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।
এই অবস্থার মধ্যে সরকারের পাট বিক্রি সম্পর্কিত নয়া অর্ডিন্যান্স দেশবাসীর কাছে আনন্দের খবর। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো : প্রশাসনিক কর্মকর্তারা জানেন যে, যারা পাট উৎপাদন করেন, মোটামুটিভাবে অন্য কোনো দ্বিতীয় বা বিকল্প ফসল তারা উৎপাদন করেন না এবং পাট বিক্রির অর্থে তারা সাংসারিক নিত্যপ্রয়োজনীয় যাবতীয় কাজকর্ম সম্পাদন করেন। এদিকে সরকারের স্থিরীকৃত পাট মূল্যের অধিক অর্থে গ্রামাঞ্চলের চোরাচালানী এবং ফড়িয়ারা পাট কিনছে চাষীদের কাছ থেকে। তদুপরি সীমান্তের ওপারে কোনোমতে ঠেলে দিলে সেখানে দ্বিগুণ অর্থ প্রাপ্তির সম্ভাবনা; সেখানে অর্ডিন্যান্সের জন্য পাটচাষীরা দীর্ঘদিন ধরে পাট বিক্রি না করে অপেক্ষা করবে সেটা সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা বুঝেছেন বলে আমাদেরকেও যে তাই বুঝতে হবে এমনটা ভাববার কোনো অবকাশ আপাততঃ এখানে নেই। আমরা আরো বুঝতে পারছিনা অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র বলে পরিচিত খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়ার সীমান্তবর্তী ১০ মাইল এলাকার পাটচাষীরা কেন একমাস বেশী সময় হাতে পাবে। একই আবহাওয়ায় উৎপাদিত পাট ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের চাষীদের হাতে আসেনা বলেই আমরা জানি। তাই এটুকু বুঝতে পারছি পাট বিক্রির সময়সীমা খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া এবং রাজশাহীর পাটচাষীদের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি করা ঠিক হয়নি। এটা অত্যন্ত খাঁটি কথা যে, প্রকৃত পাটচাষীদের হাতে বর্তমানে কোনো পাট আর অবশিষ্ট নেই। অধিকাংশই চলে গেছে ফড়িয়া এবং চোরাকারবারীদের হাতে। তারা এখন সেই সব উচ্চ মূল্যে কেনা পাট সীমান্ত পথে পাচারের সুযোগে লিপ্ত। তাই পনেরোই অক্টোবর যে সমস্ত অঞ্চলের পাট আইনতঃ বিক্রি শেষ করার কথা, চোরাচালানীরা সে সব সীমান্তে ভীড় না করে উপরোক্ত চারটি জেলার সীমান্তেই ভীড় করবে এবং পাটচাষীর ছদ্মাবরণে তারা পনেরোই নভেম্বর পর্যন্ত নির্বিবাদে ঐ চারটি সীমান্তে তাদের পাট রাখতে সুযোগ পাবে।
দু’মাস আগে জারী করা হলে যে অর্ডিন্যান্স বলে বহুবিধ সুফল পাওয়া যেতো সেই একই অর্ডিন্যান্স জারী সম্পর্কে অসময়োচিত ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে অন্ততঃ এ বছরের জন্য এটাকে একটা কাগুজে অর্ডিন্যান্স ছাড়া অন্য কোনোভাবে বিভূষিত করতে পারছি না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!