You dont have javascript enabled! Please enable it!

অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিজয়ী হলাে

যে-কোনাে সমাজের প্রতিটি সভ্য গণতান্ত্রিক মানুষই চাইবেন অপরাধীর বিচার হােক। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার হােক, কারণ আইনের সমান শাসন প্রতিষ্ঠা করা না গেলে, কারাে কারাে অপরাধের বিচার হলে আর কারােটা না হলে গণতান্ত্রিক চর্চার গলা বুলির কোনােই মানে হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই বাংলাদেশে বিগত একুশ বছরের চর্চা ছিল স্লো। এখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযােগীদের নির্মমভাবে হত্যা করার পরও দীর্ঘ একুশ বছর ধরে সেই হত্যাকারে বিচার হয় নি। যে মানুষটির কাছে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস ঋণী, তারই নাম শেখ মুজিবুর রহমান। আর তারই হত্যাকারে বিচার করতে হলাে তেইশ বছর পর। অস্বীকার করিনে, এ এক রূঢ় বাস্তবতা আমাদের সমাজের এবং এক জাতীয় ট্রাজেডিও। কারণ আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের বর্বরতম একটি হত্যাকাণ্ডের আইনসিদ্ধ বিচার সমাধা করতে ২৩ বছর সময় লাগল। সে যা হােক, অনেক দেরিতে হলেও একথা মানতেই হবে যে, জাতির বিবেকের ওপর থেকে ব্যর্থতার প্রকাণ্ড পাথরটি আজ সরে গেল। যে বিচারের প্রশ্নটি জাতির বিবেকের ওপর প্রায় দুই যুগ অচলায়তন হয়ে বসে ছিল, শেষ। পর্যন্ত তাকে সরানাে সম্ভব হলাে। জানি, হয়তাে-বা কারাে কারাে কাছে আমার এই মন্তব্যটি গ্রহণযোগ্য হবে না। হবে না, কারণ জাতি হিসেবে নিজেদের বিভক্ত করার কৌশল আমাদের অনেকেরই জানা আছে। এও জানা আছে যে, আমরা বাঙালিরা কখনাে কখনাে আত্মঘাতী হতেও পিছপা হই নে। আমাদের এ সমাজে প্রতিনিয়ত বর্বরতা ঘটছে, প্রতিনিয়ত মানবাধিকার ধূলিম্বা হচ্ছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে সমূলে নস্যাৎ করার চেষ্টা নিচ্ছে। কিন্তু এরপরও আমরা। গণতন্ত্রের কথা উচ্চস্বরে বলে থাকি। বলি, একটি গণতান্ত্রিক সমাজ হচ্ছে আমাদের স্বপ্ন, আমাদের প্রত্যাশা একটি সভ্য সমাজের কাঠামাে হচ্ছে আমাদের আরাধনা।  কিন্তু এটিও সত্য যে, সেই গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত সহনশীলতার কথাটি আমরা ক’জনেই-বা আসলে মানি। আমরা, প্রায় অধিকাংশই, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শত্র বলে বিবেচনা করি। শুধু বিবেচনা করি নে, তাদের সমূলে উৎখাত করতেও আমরা পিছপা হই নে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাে আসলে হচ্ছে আদর্শিক প্রতিপক্ষ যাদের সাথে আমাদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব হতেও বাধা নেই। একটি সভ্য সমাজের এই তাে হচ্ছে মানদণ্ড, এই তাে হওয়া উচিত। আমি কোনাে বিশেষ রাজনৈতিক দলে যুক্ত হওয়ার সাফল্য অর্জন করতে পারি নি।

পারি নি, কারণ আমার মন-মানসিকতা আমাকে অন্ধভাবে বিশেষ দলভুক্ত হতে প্রলুব্ধ করে নি। তবে এটিও অবশ্য সঠিক যে, আমি একটি আদর্শে বিশ্বাসী। আমার সে প্রার্থিত আদর্শ হচ্ছে, আমাদের এই পিছিয়ে পড়া বাঙালি সমাজ সামনে এগােবার সফলতা অর্জন করুক, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত হােক। পৃথিবীর প্রতিটি সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি আধুনিক সমাজ ধর্মীয় এবং দলগত রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে নিজেদের সরবে প্রতিষ্ঠা করছে। কেবল আমরাই পিছিয়ে থাকতে যাব কেন? সে কারণে আইনসিদ্ধ একটি সমাজের নৈতিকভাবে শক্তিশালী একটি মানবগােষ্ঠীর অংশীদার হিসেবে আমার মতাে অরাজনৈতিক মানুষকেও এ কথাটিই বলতে হয়েছে না, হত্যায় কোনাে সমাধান নেই। প্রতিপক্ষকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত মানেই কাপুরুষতার, পশুত্বের চরমতম বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারের প্রায় প্রতিটি সদস্য এবং ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযােগীদের নির্মম হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের এমন এক মৃত্তিকাসিক্ত করুণ পাথা, যা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের বিবেককে রক্তাক্ত করেছিল। ওই মানুষটি তাে এমনিতেই মারা যেতে পারতেন। নিহত হতে পারতেন পাকিস্তানের বন্দিদশায়। মারা যেতে পারতেন সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তানের যে-কোনাে জেলে যেখানে জীবনের বেশিরভাগ সময় তাকে কাটাতে হয়েছে। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধপন্থী প্রতিটি মানুষ, বিশেষত যারা একটি প্রগতিশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেন, তারা প্রত্যেকেই এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছেন। চেয়েছেন, কারণ তাদের অকুণ্ঠ বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধের সাথে, বাংলাদেশের জন্মের সাথে এই হত্যাকাণ্ড জড়িত ছিল। অন্যদিকে, এই বাংলাদেশে আমরা প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচারের কথা বলি, প্রতিটি অপরাধের শাস্তির দাবি তুলি, কিন্তু এও দুর্ভাগ্য যে, এই একটিমাত্র হত্যাকাণ্ডের বিচার। করা যাবে না বলে আইন পর্যন্ত পাস করা হয়েছিল এ দেশে। কিন্তু কেন? কেন এমন আইন পাস করতে হবে যা শুধুমাত্র একটি হত্যাকাণ্ডকে বিচারের বাইরে রাখবে। জাতি হিসেবে আমাদের আরাে দুর্ভাগ্য যে, সে আইনকে জাতির পবিত্র সংবিধানে পর্যন্ত গেঁথে দেয়া হয়েছিল যাতে আর কোনদিনও এই বিচারটিকে না করা সম্ভব হয়।

কিন্তু ইতিহাসের নিজস্ব একটি বিচার আছে, সেই অমােঘ বিচারের রায়ে আজ অনেক দেরিতে হলেও সত্য মাথা তুলে দাড়িয়েছে। যে বাংলাদেশের জন্য লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছিল, লাখ লাখ মানুষ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল, যে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য লাখ লাখ বাঙালি যুবক হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে, সেই বাংলাদেশ আজ বিজয়ী হয়েছে। আমার বিশ্বাস, জাতি হিসেবে বাংলাদেশ আজ সম্মানিত। কারণ, আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি বড় হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে, একটি বড় অপরাধের বিচার। হয়েছে। আজ এই নিবন্ধটি লিখতে গিয়ে সে কারণেই আমরা সাধারণ মানুষেরা এ দাবি করতে পারি যে, এ দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচারপৰ্ব সমাধা হােক, প্রতিটি অন্যায়ের সুবিচার হােক। এবং এই দাবি করতে গিয়ে আমি মােটেই পিছপা হবাে না যে, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে এ যাবৎ প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের। বিচার হােক, প্রতিটি অন্যায়-অবিচারের সুরাহা হােক। আমি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি মােটেই পছন্দ করি নে। কারণ, ধর্ম ব্যক্তির আরাধনার বিষয়, ব্যক্তির স্বাধীন চর্চার বিষয়। আমি এও মানতে বাধ্য যে, আমাদের এই বাংলাদেশের সমাজে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা আর সকলের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। সমাজের এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই আমি প্রশ্ন করতে চাই, আমাদের ধর্মও কি কোনাে হত্যাকারীকে রক্ষা করার অধিকার দিয়েছে সে যে ধরনের, যে পরিস্থিতির হত্যাকারীই হােক না কেন? ইতােমধ্যেই অনেক বিজ্ঞজন বলেছেন, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি প্রধান সংবাদপত্র লিখেছে, এই রায় ঐতিহাসিক। আমি মনে করি, যে বিচার কখনােই করা যাবে না বলে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের দুয়ারে একটি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া হয়েছিল, জাতির স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায়, সেই চ্যালেঞ্জকে শেষ পর্যন্ত পরাজিত করতে পেরেছে এই বাংলাদেশ। ৮ নভেম্বর, ঢাকা জেলা দায়রা জজ আদালতের রায় সে কারণেই বাংলাদেশের দুই যুগের ইতিহাসকে নতুন করে লেখার একটি দিন বিবেকের কাছে জাতির মুক্ত হওয়ার দিন। আদালতের রায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকারীরা কে কোন শাস্তি পেল সেটি মােটেই বড় কথা নয় বড় কথা এই বিচারকার্য রু এবং সমাধা করতে পারা, এবং এটিই প্রমাণিত করা যে আদালতে রায়ের মধ্য দিয়ে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হওয়া গেছে।

আমি এ দেশের একজন সাধারণ নাগরিক মাত্র, যার কোনাে প্রতিরক্ষা নেই, একমাত্র সত্যের বর্ম ছাড়া। আমি মুক্তিযুদ্ধের একজন সৈনিক হওয়ার গর্বও ধারণ করি নিঃসন্দেহে। সে কারণেই শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা করি আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে, জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের মূল কাণ্ডারি হিসেবে, একজন ত্যাগী রাজনৈতিক পুরুষ হিসেবে যিনি পাকিস্তানের ধর্মকেন্দ্রিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গােটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রগতিশীল এক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের মূল ব্যক্তি হিসেবে শেখ মুজিব যা যা করেছিলেন বা যা যা করতে পারেন নি বা ব্যর্থ হয়েছিলেন, সে হচ্ছে আরেক প্রেক্ষাপট । আমি কখনােই এটা মানতে রাজি নই যে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রশাসন যা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তার সবগুলােই ছিল বিতর্কের উর্ধ্বে বা তার রাজনৈতিক বিরােধীদের তাকে সমালােচনা করার অধিকার ছিল না। কিন্তু এতকিছুর পরও শেখ মুজিব বা তার পরিবারের হত্যাকাণ্ডকে যথার্থতা দেয়ার কোনাে যুক্তি আছে একজন বিবেকসম্পন্ন গণতান্ত্রিক মানুষের। কিংবা কোন যুক্তি আছে এই বলবার যে, এই হত্যাকাণ্ড যথার্থ হয়েছিল? কোনাে হত্যাকাণ্ডই যথার্থ বলে বিবেচিত হতে পারে না, যদি না তার সমর্থকরা উন্মাদ হন। হত্যায় কোনাে সংকটের সমাধান নেই। কখনােই নেই। এটা অনস্বীকার্য যে, যেকোনাে সমাজেই মানুষের সততই প্রতিপক্ষ গজিয়ে ওঠে। সেই প্রতিপক্ষকে আদর্শের বর্মে প্রতিরােধ করাই সর্বোত্তম এবং মহত্তম পথ, প্রতিপক্ষকে হত্যা করে নয়।

আমরা জাতিগতভাবে যত তাড়াতাড়ি এই চিরাচরিত সত্যের উপলব্ধি করতে পারব, আমার বিশ্বাস, তত তাড়াতাড়ি আমরা আধুনিক এবং সভ্য বলে বিবেচিত হব। ৮ নভেম্বর রায়ে বিচারক কাজী গােলাম রসুল বেশ কতগুলাে মন্তব্য করেছেন, যা প্রণিধানযােগ্য বলে আমি মনে করি। তিনি ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আদালতের মন্তব্যটি এ রকম, প্রাসঙ্গিকভাবে ইহা উল্লেখ করিয়া পারা যায় না যে, এই মামলায় প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ইহা প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ বিশেষ করিয়া যাহারা ঢাকায় অবস্থান করিতেছিলেন, তাহারা তাহাদের দায়িত্ব পালন করেন নাই, এমনকি পালনের কোনাে পদক্ষেপও গ্রহণ করেন নাই। যথেষ্ট সময় পাওয়া সত্ত্বেও। সাক্ষ্য-প্রমাণে ইহা পরিষ্কার যে, মাত্র দুইটি রেজিমেন্টের খুবই অল্পসংখ্যক জুনিয়র সেনা অফিসার/সদস্য। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেন এই কতিপয় সেনা সদস্যকে নির/নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে নাই তাহা বােধগম্য নয়। ইহা আমাদের জাতীয় সেনাবাহিনীর জন্য একটি চিরস্থায়ী কলঙ্ক হিসাবে চিহ্নিত হইয়া থাকিবে।’ একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিধানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য, বিশেষত আমাদের সেনাবাহিনী যেখানে জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে তাদের যাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু যে চিরস্থায়ী কলঙ্কের’ কথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড মামলার মান্যবর বিচারক বলে গেলেন, সেই কলঙ্কের কথাটা কি ফেলে দেয়ার মতাে।

ডিসেম্বর, ১৯৯৮

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ হারুন হাবীব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!