You dont have javascript enabled! Please enable it!

১১ নম্বর সেক্টর এবং তার অধিনায়ক বিতর্ক

এ লেখাটি একটি প্রতিক্রিয়া মাত্র। ভেবেছিলাম লিখব না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লিখতে বাধ্য হচ্ছি, মূলত দুটি কারণে। এক, মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপঞ্জির ওপর যে-কোনাে সুস্থ বিতর্ককে একটি মন্দ কাজ বলে আমি মনে করিনে। দুই, আমার নিজের যা অভিজ্ঞতা বা যা স্মৃতি তাকে পুনরাবৃত্তি করে আমার নিজের কাছে আমি সৎ থাকতে পছন্দ করি। এ আমার নিজস্ব চিন্তাচেতনার বিষয়। জনকণ্ঠ-এর পাতায় আমার আগের লেখা, অর্থাৎ “জিয়া, তাহের এবং তারামন প্রসঙ্গ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে আমার প্রিয় ব্যক্তিত্বদের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শাফাআত জামিলের প্রতিবাদধর্মী লেখাটিকে সে-কারণেই আমি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছি। তার লেখাটি পড়ে একদিক থেকে আমার ভালাে লেগেছে। কারণ তিনি আমাকে ২৪ বছর পরেও মনে করতে পেরেছেন। তবে কর্নেল জামিলের লেখাটি পড়ে একই সাথে আমি বিস্মিত হয়েছি। এ-ক্ষেত্রে আমি আমার একটি ভুল শুধরে দেয়ার জন্যে তার কাছে সত্যি কৃতজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধকালীন জেড ফোর্স-এ তিনি ছিলেন তৃতীয় বেঙ্গলের অধিনায়ক, আমার আগের লেখাতে যাকে আমি ভুলবশত কোম্পানি কমান্ডার’ বলে উল্লেখ করেছি। এ ব্যাপারটি সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত, যা আমি স্বীকার করছি। একই সাথে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে বলে কর্নেল জামিলের অভিযােগটিকে কোনােভাবেই আমি মানতে পাচ্ছিনে। কর্নেল জামিল, একটি নয়, একাধিক অভিযােগও এনেছেন আমার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বেশ গুরুতর এবং একই সাথে কৌতূহল উদ্দীপকও। আবু তাহেরকে ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কিম্বা জিয়াউর রহমানকে জেড ফোর্স-এর কমান্ডার বলার মধ্যে কোথেকে আঞ্চলিকতার ক্ষুদ্র মানসিকতা অথবা রাজনৈতিক বৈরিতা খুঁজে পাওয়া যায়— এ আমি একেবারেই বুঝতে অক্ষম। একটা সু-বৃহৎ দেশ বা ভূখণ্ড হলে না হয় তার অভিযােগ মতাে আঞ্চলিকতার প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক হলেও হতে পারত। কিন্তু আমাদের এই বাংলাদেশ একটি ছােট্ট গ্রাম বৈ-তাে নয়। এখানে আবার অঞ্চলিকতার প্রসঙ্গ কোথেকে আসে। আর জিয়াউর রহমানের সাথে আমার মতাে একজন সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক বৈরিতার অভিযােগটি রীতিমতাে একটি ভিত্তিহীন অভিযোেগ বৈকি। রাজনীতি-চর্চা আমার বিষয় নয়, কখনাে ছিলও না, বিষয় লেখালেখি  দুঃখের সাথে, এবং বাধ্য হয়ে তাই আমি এই অপ্রয়ােজনীয় মন্তব্যগুলাের প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হচ্ছি।

আমি ‘জেড ফোর্স’ এবং ‘১১ নম্বর সেক্টর’- দু’টোর সাথেই পর্যায়ক্রমে যুক্ত ছিলাম বলে আমাদের টেলিভিশনে প্রচারিত ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে নিজের স্মৃতির কথা দু’কলম লিখেছি মাত্র। কর্নেল জামিল বলেছেন, আমি নতুন করে এই বিতর্কের সূত্রপাত্র করেছি। কিন্তু একবারও তিনি ভেবে দেখেন নি, আমার লেখাটি বেরিয়েছে তার এবং অন্যান্যদের এ প্রসঙ্গে মতামত প্রকাশেরও অনেকদিন পর। কর্নেল জামিল জেড ফোর্স-এর এবং তার অধিনায়ক জিয়াউর রহমানের যে শ্রমসাধ্য কর্মতৎপরতার কথা উল্লেখ করেছেন তার প্রায় প্রতিটি মন্তব্যের সাথে আমি ঐকমত্য পােষণ করি। জেড ফোর্স-এর লেঃ এস আই এম নূরুন্নবী খান (যিনি পরবর্তীকালের বীর বিক্রম এবং লেঃ কর্নেল, এবং তার নামের শেষে এখন বরখাস্ত লেখেন) রৌমারী মুঞ্চলের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। এখানেই গড়ে উঠেছিল সুবৃহৎ একটি মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবির। জিয়াউর রহমানের অধিনায়কত্বে জেড ফোর্স-এর সাহসী অফিসার এবং সৈনিকবৃন্দ যে-ভূমিকা রেখেছেন সে-ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়। নাম উল্লেখ না করেও এইসব দুঃসাহসী দেশপ্রেমিকের প্রতি সে-কারণেই আমার শ্রদ্ধা। কারণ আমি নিজে জেড ফোর্স-এর সেই ঐতিহাসিক ভূমিকার একজন যৎসামান্য প্রত্যক্ষদর্শী। কিন্তু এর পরেও আমি বলতে বাধ্য, জিয়াউর রহমান ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন না, কখনােই ছিলেন, ছিলেন জেড ফোর্স-এর অধিনায়ক। ১১ নম্বর সেক্টর গঠিত হয়েছে অগাস্ট মাসে, এবং এই সেক্টরের প্রথম অধিনায়ক তৎকালীন মেজর আবু তাহের। তিনি আহত হওয়ার পর স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ খান এই সেক্টরের কমান্ডার হয়েছিলেন। তাহেরের প্রতি এই স্বীকৃতি মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকার এবং সেই সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে দেয়া হয়েছিল। গেল লেখাতেও বলছি, আবারও বলছি, সেক্টর কমান্ডার যে-কেউ ইচ্ছে করলেই হতে পারেন নি, কারণ সে-সময় একটি সরকার ছিল এবং সেনা সদর দপ্তর ছিল, যারা এই সব কমান্ডাদের সরকারিভাবে নিয়ােগ করেছে। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন জেড ফোর্স, আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, সংগঠিত হয়েছিল এমন একটি এলাকায় যে-এলাকাটি সীমানাগতভাবে ছিল ১১ নম্বর সেক্টরের মধ্যে। জুন থেকে অক্টোবরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত, অর্থাৎ সিলেট অঞ্চলে বদলি হওয়ার আগে পর্যন্ত এই এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরােধ করে গেছে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন জেড ফোর্স।

এই যুদ্ধাঞ্চলে মুক্তিযােদ্ধাদের সফলতা বয়ে আনতে জিয়া এবং তার বাহিনীর সকল অফিসার এবং সৈনিকদের অবদান নিঃসন্দেহে স্মরণযােগ্য। যা হােক, এ বিষয়টি নিয়ে নিজের স্মৃতির কথা আর না বাড়ানােই ভালাে। স্মৃতি অনেক সময় প্রতারিতও করতে পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সে-কারণে “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র” যে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছিল প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলেই, সেই দলিল থেকেই এখানে যৎসামান্য উদ্ধৃতি দিতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের জিয়াউর রহমানকে অনেক সঙ্গত কারণেই কৃতিত্বের দাবিদার বলা প্রয়ােজন এবং তা ইতিহাসের কারণেই সমীচীন। কিন্তু ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হবার কৃতিত্ব অবশ্যই তাকে দেওয়ার চেষ্টা করা কখনােই একটি উচিত কাজ নয়। এতে ইতিহাস বিকৃত হবে। “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র”, ১০ম খণ্ড। কর্নেল আবু তাহেরের বিবৃতি। “অগাস্টের ১২ তারিখে মেঘালয় এসে পৌছাই। এই এলাকার মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডে ইতিপূর্বেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলাে। …. ১৫ই অগাষ্ট আমি নিজে ১৫০ জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে সন্ধ্যার দিকে কামালপুর পাকর্ঘাটি আক্রমণ করি। আমার আক্রমণের পূর্বে এই এলাকা কোনাে সেক্টরের আওতায় ছিলাে না। আমি সেনাবাহিনীর সদর দফতরে এই এলাকাকে একটি সেক্টরে পরিণত করার আবেদন করলে আবেদন মঞ্জুর হয়। আমার সেক্টরের নাম হলাে ১১ নং সেক্টর। কমান্ড আমাকেই দেওয়া হলাে।” (পৃষ্ঠা ৬৪০)। তাহেরের নিজের বক্তব্য, যা মুক্তিযুদ্ধের নথিপত্রে আছে, তা দেখলেই বােঝা যায়, কর্নেল শাফাআত জামিলের বক্তব্য, জিয়ার কাছ থেকে তাহের ১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, ১০ই অক্টোবর ১৯৭১-এ, এটা সঠিক নয়। এবং এটা ঠিক নয় যে জিয়া যুগপৎভাবে জেড ফোর্স এবং ১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন। তাহের জুলাই মাসের ২৫ তারিখে পাকিস্তানের এবােটাবাদ থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিতে ভারতের মাটিতে প্রবেশ করেন। অগাস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি এই সেক্টরের দায়িত্ব পান।

তবে ১১ নম্বর সেক্টর গঠনের আগে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বেই এই বিস্তীর্ণ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। আমার বিশ্বাস কর্নেল শাফাআত জামিল সে-কারণেই মেজর জিয়াকে এই সেক্টরের কমান্ডার বলতে চেয়েছেন। জামিল সাহেবের বরাতে জিয়া ৪ মাসেরও বেশি এই সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন— এ কথাটাও ঠিক নয়। আর ঠিক নয় তাহের ১ মাস ৪ দিন মাত্র অধিনায়কত্ব করেছেন। এবার, তাহের ছাড়া ১১ নম্বর সেক্টরের অন্যান্য বীরযােদ্ধারা বিষয়টিকে কিভাবে দেখেছেন তা দেখা যেতে পারে। এবারেও আমার সূত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। : দলিলপত্র”, ১০ম খণ্ড। মেজর আবুল আজিজ, পৃষ্ঠা ৬৫৮, বলেছেন : “অগাস্ট মাসের আগে পর্যন্ত এই সেক্টর (১১ নং সেক্টরের এলাকা) একজন ভারতীয় অফিসার ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিংহের পরিচালনায় ছিল। এবং কোনাে বাঙালি অফিসারকে কমান্ডার নিযুক্ত করা হয় নি। …….. জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে মেজর (বর্তমানে কর্নেল) জিয়াউর রহমান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিনটি ব্যাটেলিয়ন নিয়ে ১১ নং সেক্টরে। আসেন এবং তাকে প্রথম নিয়মিত ব্রিগেড (অর্থাৎ ‘জেড ফোর্স’) গঠন করার দায়িত্ব দেয়া হয়।…… অগাস্ট মাসের শুরুতে মেজর আবু তাহের মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়কয়ে সফরে বের হয়ে এই সেক্টরে আগমন করেন। এলাকার অভিযানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি এই সেক্টরে থাকার সিদ্ধান্ত নেন, এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতর থেকে তাকে সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়।” লেঃ মান্নান, পৃষ্ঠা ৬৬৯, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র”, ১০ম খণ্ড। ….এরপর (অর্থাৎ জুলাই মাসে কামালপুর যুদ্ধে আহত হয়ে এবং ১ মাস পর সুস্থ হয়ে ওঠার পর) আমি ১নং বেঙ্গলের রেজিমেন্টের ইউনিটে ফিরে আসি। তারপর শুনতে পাই যে ১১ নং সেক্টর নামে একটি নতুন সেক্টর গঠিত হয়েছে যার হেড কোয়াটার্স মহেন্দ্রগঞ্জে।

কর্নেল তাহের সেক্টরের দায়িত্ব নেন।” ১১ নম্বর সেক্টরের সুপরিচিত এই মুক্তিযােদ্ধা ৬৭৫ পৃষ্ঠায় আরও বলেছেন, “মেজর তাহের অগাস্ট মাসে ১১ নং সেক্টরে আসেন।” জেড ফোর্স-এর অন্যতম সু-পরিচিত ব্যক্তিত্ব, জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযােগী, এবং ফোর্সের ব্রিগেড মেজর’, কর্নেল অলি আহমদ, (যুদ্ধকালীন সময়ে যিনি ক্যাপ্টেন ছিলেন) বলেছেন, “মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম ব্রিগেড জেড ফোর্স গঠিত হয় ৭ই জুলাই।” পৃষ্ঠা ৬৮১। তিনি তার বক্তব্যে কোথাও বলেন নি জিয়াউর রহমান ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন। এরপর আসি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানীর বক্তব্যে। সূত্র, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র” । পৃষ্ঠা ৮০৫। … ১ নং সেক্টরে প্রথমে জিয়াউর রহমান (বর্তমানে কর্নেল) পরে মেজর রফিক। দুই নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মােশাররফ……১১ নং সেক্টরের ছিলেন মেজর (পরে লেঃ কর্নেল) আবু তাহের। ইনি জখমের জন্যে বডি আউট’ হয়েছেন। আমার আগের লেখায় সে কারণেই আমি বলেছিলাম জিয়া প্রথমদিকে ছিলেন ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার, পরে সেই সেক্টরের দায়িত্ব নেন মেজর রফিক। সত্যি বলতে কি, ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের নাম নিয়ে এই বিতর্ক, মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর পূর্তির এই দিনে, আমাদের জন্যে একটি দুর্ভাগ্য বৈকি। সরকারি প্রচারযন্ত্র এই বিতর্কটি না তুললে ইতিহাসে নির্ধারিত এইসব সাহসী এবং দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদের নিয়ে নতুন করে এই আলােচনার প্রয়ােজন হতাে না। আমার লেখাটি পড়ে তার মতামত দেয়ার জন্যে আমি বীর মুক্তিযােদ্ধা কর্নেল শাফাআত জামিলের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি আরও কৃতজ্ঞ যে আমার মতাে সেদিনের অতি তরুণ’ একজনকে, মুক্তিযুদ্ধের লাখাে তরুণের ভিড়েও, তিনি মনে রাখতে পেরেছেন, এত বছর পরেও। বলে রাখি, এ বিষয়টি নিয়ে আর লিখতে আমি আগ্রহী নই মােটেই। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ঘাঁটলেই যে-কেউ এ ধরনের বিতর্কের জবাব পেয়ে যাবেন।

এপ্রিল, ১৯৯৬

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ হারুন হাবীব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!