You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক- জিয়াউর রহমান -কর্নেল তাহের-তারামন বেগম - সংগ্রামের নোটবুক

জিয়া, তাহের এবং বীর প্রতীক তারামন

বীর প্রতীক তারামন বেগম বা তারামন বিবিকে নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে যেভাবে আলােড়ন হচ্ছে, তাতে সন্দেহাতীতভাবে ধারণা করা যায়, আমাদের জাতি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা চৈতন্য থেকে সরে যায় নি, কিংবা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভুলিয়ে দেয়ার যড়যন্ত্র সফল হয় নি। বেশ কয়েক মাস আগে ময়মনসিংহ আনন্দমােহন কলেজের শিক্ষক শ্রী বিমল কান্তি দের কাছ থেকে আকস্মিক একটি চিঠি পাই আমি। যেহেতু ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমার যৎকিঞ্চিৎ লেখালেখিও আছে, সেহেতু দ্রলােক, যার সাথে আমার পূর্বপরিচয় নেই, বােধ করি ধরে নিয়েছিলেন আমাদের সেক্টরের একমাত্র মহিলা বীর প্রতীক তারামন বেগমকে আমি চিনলেও চিনতে পারি। দুর্ভাগ্যবশত মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় পদক তালিকায় তারামন বেগমের নাম থাকলেও এবং আমি নিজে ১১ নম্বর সেক্টরের একজন সক্রিয় যােদ্ধা হলেও বিমল কান্তি দে’কে আমি তারামন বেগমের খোজ দিতে পারি নি। তবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষেরা, এবং তাদের সবাই না হলেও, আমাদের চেয়েও যে অনেক অনেক বেশি যােগ্য তার স্বাক্ষর রেখেছেন শ্রী বিমল কান্তি দে। তিনি তার নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত কুড়িগ্রামের কোদালকাঠি গ্রাম থেকে তারামন বেগমকে আবিষ্কার করে জাতিকে, উপহার দিয়েছেন। আমি মনে করি, একজন ব্যক্তির পক্ষে তার জাতিকে, উপহার দেয়ার এ এক বড় দৃষ্টান্ত। মুক্তিযুদ্ধের ২৪ বছর পেরিয়ে রজতজয়ন্তীর উৎসব হচ্ছে এখন, অথচ আমাদের ব্যর্থতাটা এমনিই, আমরা আমাদের দু’জন মহিলা বীর প্রতীক’এর একজনকে এ যাবত খােজ করে বের করবারও প্রয়ােজনবোেধ করি নি! অন্যজন ডাক্তার সেতারা বেগম, যিনি দুই নম্বর সেক্টরে ছিলেন, দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। বীর মুক্তিযােদ্ধা লে. কর্নেল হায়দারের এই বােন যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসায় কীভাবে সেদিন নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন, তার বৃত্তান্ত এখনও পর্যন্ত প্রায় অজানাই রয়েছে। আমি মনে করি, ডাঃ সেতারাকে সরকারি উদ্যোগে কিংবা অন্য কোনাে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে দেশে ফিরিয়ে আনা উচিত এবং নতুন প্রজন্মের মানুষদের কাছ তার বীরগাথা উপস্থাপনের সুযােগ সৃষ্টি করা উচিত। বীর প্রতীক তারামন বেগমকে ইতােমধ্যেই বিভিন্ন গণসংগঠন এবং সরকারের পক্ষ থেকে সম্মানিত করা হয়েছে। অনেক দেরিতে হলেও জাতি তার কৃতজ্ঞতার পরিচয় দিতে পেরেছে।

সম্মানীত করা হয়েছে সেই মানুষদেরই একজনকে, যাদের আত্মত্যাগ পরবর্তী প্রজন্মের মানুষদের স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশের নাগরিক হিসেবে সম্মানিত হবার গৌরব দিয়েছে। কেবলমাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে কোনাে এক শংকর মাধবপুর গ্রামের কোনাে এক কোদালকাঠি ইউনিয়নের এবং সুদূর কুড়িগ্রাম জেলার  রুগ্ন, অভুক্ত, নিরক্ষর এবং অজ্ঞাত তারামন এখন বারাে কোটি মানুষের একজন হয়েও অনন্যসাধারণ। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা আত্মত্যাগ করেছেন, তাঁদের মধ্যে এখনও যারা বেঁচে আছেন, এবং এখনও যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি হয়ে লড়ছেন, তাদের জন্যে এক সুখবর বৈকি! কিন্তু তারামন বেগমের আবিষ্কার, প্রচার এবং তাকে সম্মানিত করা ইত্যাদি ব্যাপারগুলাের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠিত ঘটনাপঞ্জিকে আরেকবার সংশয় সঙ্কুলে ফেলার একটি অপচেষ্টা দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকছে না তাদের বিশেষ করে যারা ১১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। রৌমারী, চিলমারী, রাজিবপুর, ভুরুঙ্গামারী, কোদালকাঠি ইত্যাদি চরাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সময় একাধিকবার আমাকে যেতে হয়েছে। ‘জেড ফোর্স’ এবং ১১ নম্বর সেক্টর থেকে রণাঙ্গনের দৈনন্দিন খবরাখবর স্বাধীন বাংলা বেতার’ আর ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায় পাঠাতে যুদ্ধ-সাংবাদিকতার বাড়তি দায়িত্ব ছিল আমার। সে কারণে ‘জেড ফোর্স’ কমান্ডার জিয়াউর রহমান এবং ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার আবু তাহেরের সাথে প্রচুর ঘুরতে হয়েছে সেদিনকার অবিভক্ত রংপুর আর উত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে। আর সে অঞ্চল আমার নিজের এলাকার মধ্যে কিংবা আশপাশে বলে ওগুলাে নিয়ে পরিষ্কার ধারণাও আছে আমার। আমাদের টেলিভিশন যেহেতু সরকার নিয়ন্ত্রিত সেহেতু প্রশ্নটি এসেই যায়— মরহুম জিয়াউর রহমান, যিনি বাস্তবে এবং এখনও পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের অবিকৃত দলিলেদস্তাবেজে ‘জেড ফোর্স’ কমান্ডার হিসেবে পরিচিত, হঠাৎ করেই তাকে ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার বানাতে গেল কেন? বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে বেশ বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছে। ১১ নম্বর সেক্টরের একজন সৈনিক হিসেবে আমার নিজের যৎসামান্য কথা বলা তাই এখানে অসঙ্গত মনে করিনে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীরযোদ্ধা শাফায়াত জামিল, যিনি সেদিন বেশ ক’টি মাস সেই তিস্তা-ধরলা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ‘জেড ফোর্সের একজন কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং হামিদুল্লাহ খান, যিনি আবু তাহের গুরুতর আহত হবার পর সেক্টরের আনুষ্ঠানিক দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের বক্তব্যের পর এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা বা মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ নেবার পর থেকেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব যুদ্ধ পরিকল্পনা গুছিয়ে নিতে থাকে। মূলত এপ্রিল থেকেই বাংলাদেশকে ভাগ করে নেয়া হয় ১১টি যুদ্ধ সেক্টরে। এই সেক্টরগুলাের বাইরে যুদ্ধকালীন সরকার তিন সিনিয়র বাঙালি সেনা— অফিসারের নামানুসারে তিনটি পৃথক বাহিনী গঠন করে। জেড ফোর্স’, ‘এস ফোর্স এবং কে ফোর্স’ নামের ব্রিগেড আকারের এ বাহিনীগুলাে মূলত গড়ে তােলা হয়েছিল।

বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং প্রাক্তন ইপিআর-এর দেশপ্রেমিক বাঙালি সৈন্যদের নিয়ে, যদিও বেশ কিছুসংখ্যক ছাত্র-যুবকও এ বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়েছিলাে । “জেড ফোর্স’-এর সদর দপ্তর ছিল আসাম-মেঘালয় সীমান্তে তেলঢালার পাহাড়ে। আর ১১ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জে। অক্টোবর মাসে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ‘জেড ফোর্স’-কে সিলেট অঞ্চলে বদলি করা হয়। এর আগ পর্যন্ত আসাম সংলগ্ন রংপুরের সীমান্ত অঞ্চল এবং উত্তর ময়মনসিংহের সীমান্ত এলাকায় এ বাহিনীর সদস্যরা যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। অন্যদিকে এলাকাগতভাবে এ অঞ্চলগুলাের বেশির ভাগ ছিল ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে। জুলাই মাসে পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে যােগদানের পর থেকে আবু তাহের ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। তিনিই মূলত এ সেক্টরকে গড়ে তােলেন। তাহের আসার আগে ১১ নম্বর সেক্টরের কোনাে কমান্ডারকে যুদ্ধকালীন সরকার নিয়ােগ দিয়েছিল বলে আমাদের জানা নেই। এ কথা আমি বলছি এ কারণে যে, মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক সরকারের স্বীকৃতি বা নিয়ােগ ছাড়া সঙ্গত কারণেই কোনাে সেক্টর বা ফোর্সের নেতৃত্ব দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না কারও পক্ষে। তাই তারামন বেগম ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বলে বাংলাদেশ টেলিভিশনের খবরে বলা হলে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপঞ্জি নিয়ে। আরেক দফা সঙ্কট সৃষ্টি করা হয় বৈকি। তবে যদি বলা হতাে- ‘জেড ফোর্স’-এর কমান্ডার জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে তারামন যুদ্ধ করেছেন তাহলে বিতর্কের কোনােই অবকাশ থাকত না। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপঞ্জিকে বহুবারই চলতি রাজনীতির স্বার্থে পরিবর্তনের চেষ্টা হয়েছে। রাজনীতির সাময়িক স্বার্থসিদ্ধির ললাডে এ কাজটি যারা করেছেন, আমার বিশ্বাস, তারা সজ্ঞানে জাতির ইতিহাসের অনেক বড় অবমাননা করেছেন, অনেক বেশি ক্ষতি করেছেন। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে একটি পরিপূর্ণ ব্রিগেডকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যার যােদ্ধারা দেশের বিভিন্ন অংশে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত বীরত্বের সাথে লড়েছেন। এ আমি জানি, মানি এবং স্মরণ করি। ঠিক একইভাবে লড়েছেন কে এম সফিউল্লাহর নেতৃত্বে এস ফোর্স’ এবং অনন্যসাধারণ যােদ্ধা খালেদ মােশাররফের ‘কে ফোর্স’।

আমি বুঝতে পারিনে, মুক্তিযুদ্ধের ২৪ বছর পর জিয়াউর রহমানকে ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার বানিয়ে দেয়ার মধ্যে মরহুম জিয়ার প্রতি কদুর বাড়তি সম্মান দেয়ার সুযোেগ থাকে। মুক্তিযুদ্ধের জীবীত মানুষ এবং লিখিত দলিলগুলাে ষড়যন্ত্রের আগুনে পুড়ে এখনও ধ্বংস হয় নি। অতএব এমন একটি কাজ। অতি উৎসাহীদের হাতে না করতে দেয়াটাই হয়ত মঙ্গল ছিল। মুক্তিযােদ্ধা তারামন বেগম ‘জেড ফোর্স’-এর অধীনে লড়েছেন আমাদের টেলিভিশন এমন একটি খবর প্রচার করলে ব্যাপারটির বিশ্বাসযােগ্যতা নিয়ে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক বিরােধীরা পর্যন্ত বিতর্ক সৃষ্টির অবকাশ পেত না। আমার নিজেরও এ লেখাটি লিখবার প্রয়ােজন হত না। কিন্তু বলা হলাে- বীর প্রতীক তারামন ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছেন। আমাদের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন, বলতে দ্বিধা নেই, জ্ঞানে বা অজ্ঞানে এমন আরেকটি সঙ্কট সৃষ্টি করেছেযা নতুন প্রজন্মের মানুষদের আরেক দফা মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের নিয়ে ঝামেলায় ফেলবে। ইতােমধ্যেই এ নিয়ে হামিদুল্লাহ খানসহ কারও কারও মতামত খবরের কাগজে বেরিয়েছে। কেউ কেউ এও বলতে চেয়েছেন, জিয়াউর রহমান বেশ কয়েক মাস ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়কত্ব করেছেন। বিশেষ করে ‘জেড ফোর্স-এর অন্যতম বীর সেনানী কর্নেল শাফায়াত জামিলের বিবৃতি দেখে আমি নিজেও সন্দেহের মধ্যে পড়ি। সন্দেহটা হয় এ কারণে, আমরা না হয় অতি তরুণ এবং অসামরিক লােকজন ছিলাম, কিন্তু শাফায়াত সাহেব ছিলেন তখন একজন তরুণ মেজর, যিনি একটি কোম্পানিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সেদিন অভাবিত যােগ্যতায়। মনে পড়ে, আমি নিজেও রাজিবপুর, কোদালকাঠি, রৌমারী, বাহাদুরাবাদ, দেওয়ানগঞ্জের এলাকাগুলােতে হাতে একটি ক্যামেরা আর স্টেনগান নিয়ে বার কয়েক সঙ্গী হয়েছি জিয়া, আবু তাহের এবং শাফায়াতের সাথে। কিন্তু মুখ্যত তাহের এবং যুদ্ধের একেবারে শেষ দিকে অর্থাৎ নভেম্বরের ১৪ তারিখে তাহের একটি পা হারাবার পর স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ খানের দায়িত্ব পাওয়া ছাড়া আর কারও নাম ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের নথিপত্রে কিংবা মুক্তিযােদ্ধাদের স্মৃতিতে আছে বলে আমরা জানি নি বা শুনি। নি এ যাবত। কাগজে-কলমে ১১ নম্বর সেক্টরের অবস্থান ছিল কিশােরগঞ্জ ছাড়া সমগ্র ময়মনসিংহের অঞ্চল এবং টাঙ্গাইল নিয়ে। তবে টাঙ্গাইল-পাবনা-ময়মনসিংহ আর ঢাকার কিছু অংশ নিয়ে সে সময় অতিরিক্ত একটি সেক্টর গড়ে উঠেছিল— যার নেতৃত্বে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কিংবদন্তি কাদের সিদ্দিকী। আগেই বলেছি, জুন-জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ‘জেড ফোর্স’-এর বেশির ভাগ কর্মকাণ্ড ছিল ১১ নম্বর সেক্টরের এলাকায়।

কামালপুর, যা আমার নিজের থানা দেওয়ানগঞ্জে অবস্থিত, এবং যা ছিল ১১ নম্বর সেক্টরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক সমরক্ষেত্র, সেখানেও জুন-জুলাইয়ের দিকে বেঙ্গল রেজিমেন্ট অর্থাৎ ‘জেড ফোর্স’-এর সেনানিরা যুদ্ধ করেছেন। এই কামালপুরে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন শহীদ হয়েছেন, ক্যাপ্টেন আমিন আহমদ চৌধুরী ক্যাপ্টেন হাফিজ-সহ অনেকে গুরুতর আহত হয়েছেন যাদের নাম আমি এখন মনে করতে পারছিনে। তবে তখনকার এই যুদ্ধ ঘটেছে বেশির ভাগই ‘জেড ফোর্স’, অর্থাৎ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের দ্বারা, কিন্তু ঘটেছে আবার ১১ নম্বর সেক্টরের আওতাধীনে। মেজর আবু তাহের আসার পর, অর্থাৎ জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে ১১ নম্বর সেক্টরের মূল কর্তৃত্ব বর্তায় তারই হাতে। তিনি হাজার হাজার ছাত্র-যুবককে ট্রেনিং দিয়ে যুদ্ধের উপযােগী করে গড়ে তুলেছিলেন এবং পাকিস্তানিদের সাথে গেরিলা সমরে এক নতুন যুদ্ধ ধারার সৃষ্টি করেছিলেন। মুহিব হাবিলদার নামে তারামন বেগমের যে ধর্মপিতা’ বা গুরু বলে যাকে প্রচার করা হয়েছে, অর্থাৎ সেদিনের বালিকা তারামন সেদিন প্রথমত যাঁর কাজের মেয়ে’ হিসেবে নিয়ােগ পেয়েছিলেন, তিনি ‘জেড ফোর্স’-এর আওতাধীনে ছিলেন, না সরাসরি ১১ নম্বর। সেক্টরের অধীনে ছিলেন তা বলা আমার পক্ষে অবশ্য সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলােতে, অর্থাৎ মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে, জাতির স্বাধীনতা লাভ করতে, সেদিন আমাদের মধ্যে এমন বিভাজন একেবারেই ছিল না, যদিও আজ শুধু দলীয় রাজনীতির স্বার্থে আমরা বিভাজনের প্রয়ােজনবােধ করে থাকি। আমাদের সৌভাগ্য। সেদিন আমাদের সকলের শত্রু ছিল এক, আর দুর্ভাগ্য, আজ আমরা প্রত্যেকেই যেন প্রত্যেকের শত্র। সে কারণে ইতিহাসে ঘটে যাওয়া পুণ্যগুলােকে বৈধ বা অবৈধভাবে হাতড়ে নিয়ে আজ আমরা আমাদের চলতি রাজনীতির ফুলছেরাত’ পাড়ি দিতেও পিছপা হইনে। আমার বিশ্বাস, ১১ নম্বর সেক্টরের যাঁরা যােদ্ধা তারা সকলেই জানেন কে তাদের কমান্ডার ছিলেন। তেমনি জানেন ‘জেড ফোর্স-এর যােদ্ধাগণও।

এ সবের প্রত্যেকটি সত্য লিপিবদ্ধ আছে এ যাবত সংগৃহীত মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি দলিলে। জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম থেকে বিদ্রোহ করেছিলেন, যা পরবর্তীতে ১ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন ছিল। হলেও হতে পারে, জ্যেষ্ঠ সেনা অফিসার হিসেবে তিনি সেই সেক্টরের প্রথম কমান্ডার হয়েছিলেন, তবুও মাত্র কিছুদিনের জন্যে। তবে ‘জেড ফোর্স’ আসাম-মেঘালয় অঞ্চলে এসে সংগঠিত হবার পর এবং মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন বীরযােদ্ধা মেজর রফিকুল ইসলাম। সে কারণে জিয়াউর রহমানকে কেবল ‘জেড ফোর্স কমান্ডার হিসেবে পরিচিত করার মধ্যে কোনাে ভুল নেই। তাছাড়া এতে জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের গর্ব খর্ব হয় বলে ভাবনারও কারণ নেই। দুই নম্বর সেক্টরে অধিনায়কত্ব করেছেন মেজর খালেদ মােশাররফ এবং পরবর্তীতে মেজর হায়দার। তিন নম্বর সেক্টরে মেজর কে এম শফিউল্লাহ এবং পরবর্তীতে নুরুজ্জামান। চার নম্বর সেক্টরে মেজর সি আর দত্ত। পাঁচ নম্বর সেক্টরে মেজর মীর শওকত আলী। ছয় নম্বর সেক্টরে উইং কমান্ডার বাশার, সাত নম্বর সেক্টরে মেজর কাজী নূরুজ্জামান, আট নম্বর সেক্টরে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী এবং পরবর্তীতে মেজর মজুর। নয় নম্বর সেক্টরে মেজর জলিল (পরে কিছুদিনের জন্য মেজর মর)। ১০ নম্বর সেক্টরে, যা ছিল অভ্যন্তরীণ নৌপথ আর সম্পদ উপকূল এলাকা নিয়ে, বিশেষ কেউ কমান্ডার ছিলেন না। আমাদের সেক্টর কমান্ডার আর ফোর্স কমান্ডারদের মধ্যে একমাত্র জিয়াউর রহমানই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছিলেন তাও এক বিশেষ পরিস্থিতিতে। দেশের প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা আর রাজনীতির পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ এক নয়। এক করে দেখাও সঙ্গত নয়।

কেউ কেউ বলেছেন, আবু তাহের মাঝে মধ্যে জিয়াউর রহমানের কাছে, অর্থাৎ ‘জেড ফোস’-এর সদর দপ্তরে এসে ব্রিফিং নিতেন। তেলঢালার ‘জেড ফোর্স’-এর সদর দপ্তরে আমি নিজেই থাকতাম। অক্টোবরে ‘জেড ফোর্স’ সিলেট সীমান্তে চলে যাবার আগে পর্যন্ত জিয়া এবং তাহেরের মধ্যে অসংখ্য দেখা-সাক্ষাতে আমি নিজেও উপস্থিত ছিলাম। হতেই পারে একই এলাকায় যুদ্ধরত বলে তারা সলাপরামর্শ করতেন, জজনে মিলে যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করতেন। এটাই স্বাভাবিক। এসব সলাপরামর্শ বা কৌশল নির্ধারণী বৈঠক স্বাভাবিক কারণেই জরুরি ছিল। কিন্তু এতে ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়কত্ব ছিল জিয়াউর রহমানের এটা ভেবে নেয়া ঠিক হবে না বরং ১১ নম্বর সেক্টরের এলাকাতে ‘জেড ফোর্স’ যুদ্ধ পরিচালনা করেছে- কখনও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে সেক্টরের স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শত ছাত্র-যুবকরা একযােগে যুদ্ধ করেছে- এগুলাে ছিল তখনকার স্বাভাবিক ঘটনা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সকল আর্থেই এক জনযুদ্ধ। আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী সেখানে তাদের গৌরবােল ভূমিকা রেখেছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু এ যুদ্ধের শ্রেষ্ঠ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ছিল—এতে অত্র তুলে নিয়েছিল সমাজের সব শ্রেণীর তারুণ্য। বিচ্ছিন্নভাবে, কেউ এতে অধিনায়কত্ব নেয় নি বা নেয়ার সুযােগ ছিল না, কারণ সেক্টরের বা ব্রিগেড আকারের বাহিনীগুলাের নিয়ােগ হয়েছিল অস্থায়ী মুজিবনগর রাজনৈতিক সরকারের নথিপত্রে। ইতিহাসের স্বার্থেই, চলতি রাজনীতির অথৈ টানাপােড়েনের পরেও এই সত্যটিকে না মানলে ইতিহাসের বিকৃতি অবশ্যম্ভাবী। আমাদের সম্মান দেখাতে হবে প্রতিটি মুক্তিযােদ্ধাকে, সেক্টর বা ব্রিগেড আকারের ফোর্সগুলাের প্রতিটি অধিনায়ককেও সমানভাবে। এদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে চরম সাহসিকতা দেখিয়েছেন, কেউ বা তা পারেন নি। কেউ ছিলেন রণাঙ্গনের লড়াকু চরিত্র, কেউ বা পাকিস্তানিদের পরাজিত করার কৌশলী অধিনায়ক। এদের কারও অবদান কারও চেয়ে কম হতে পারে না। বাংলাদেশে আজ যারা রাজনীতি করছেন বা ভবিষ্যতেও যারা করবেন, দয়া করে দলীয় রাজনীতির স্বার্থে এদের কাউকে বড় বা কাউকে ছােট করার চেষ্টা নেবেন না। ইতিহাসের ক্ষতিকে অনুগ্রহ করে আর বাড়াবেন না। অনেক তাে হয়েছে।

মার্চ, ১৯১৫

 

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ হারুন হাবীব