আবারও ভুল হলাে, জনাব নেওয়াজ শরীফ
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফকে একজন আধুনিক মুসলিম লীগার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্তত এ রকমই একটা ধারণা তৈরি হয়েছে দেশবিদেশের অনেক মহলে তিনি তাঁর দেশের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এ-যুগের একজন বড় যােদ্ধাও, বিশেষত চিফ জাস্টিস এবং প্রেসিডেন্টের সাথে একই সাথে যুদ্ধ করে বিজয়ী হওয়া কম।যােগ্যতার কথা নয়। পাকিস্তানি রাজনীতির আগের লড়াইগুলিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট জিততেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিফ জাস্টিসও জিতেছেন, কিন্তু সম্প্রতিকালে পাকিস্তানের বেচারা প্রধানমন্ত্রীরা কখনােই জিততে পারেন নি বলতে গেলে এবারেই। প্রথম জনাব নেওয়াজ শরীফের নেতৃত্বে প্রেসিডেন্ট এবং চিফ জাস্টিসকে এক সাথে কুপােকাত করে একজন প্রধানমন্ত্রী জিতলেন পাকিস্তানের মতাে একটি দেশে এটি অবশ্যই কম যােগ্যতা আর স্বল্প সৌভাগ্যের কথা নয় ঢাকায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ত্রি-দেশীয় বাণিজ্য শীর্ষ সম্মেলনে এসেছিলেন জনাব নেওয়াজ শরীফ। বাংলাদেশে তার এবারের আসাটা অবশ্য দুই প্রয়ােজনেই ছিল। প্রথমত, তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী ইন্দর কুমার গুজরাল আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বাণিজ্য শীর্ষ সম্মেলনে যােগ দেবেন, এবং দ্বিতীয়ত, সম্মেলনউত্তরকালে বাংলাদেশে দু’দিনের এক সরকারি সফর করবেন। জনাব শরীফের সাথে তাঁর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গওহর আইয়ুব খান এবং অর্থমন্ত্রী সারতাজ আজিজও ছিলেন সে কারণে এটা ধরেই নিতে হবে যে, জনাব নেওয়াজ শরীফের এবারকার ঢাকা সফরটি ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ আমার এই লেখাটি অবশ্য জনাব শরীফের বাণিজ্য শীর্ষ সম্মেলনে যােগদান কিম্বা সেই সম্মেলনের ফলাফল কী হলাে, তা নিয়ে নয় আজকের প্রধান বিষয় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কিছু মন্তব্য যা বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সাথে জড়িত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দেয়া এক রাষ্ট্রীয় ভােজে জনাব নেওয়াজ শরীফ এমন কিছু মন্তব্য করেছেন– যা ইতিহাস সততার প্রয়ােজনেই আলােচনার দাবি রাখে তিনি বলেছেন, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল না মেনে নেয়াটা একটি ‘ভুল’ ছিল, এবং যদি তা মেনে নেয়া হতাে তাহলে এই অঞ্চলের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতাে সেই সাথে আরও বলেছেন, আমরা যেন অতীতের ভুলগুলি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি। এখানেই থামেন নি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, তিনি আরও বলেছেন, কারণ ‘৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেয়াতে যে ভুল’ হয়েছিল সেই ধরনের ‘ল’কে পুঁজি করতে আমাদের বহিঃশত্রুরা সদাসর্বদা তৎপর।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাবাে তার এই উপলব্ধির জন্যে অন্তত অনেক দেরিতে হলেও পাকিস্তানের একজন মুখ্য রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি বুঝতে পেরেছেন, গণতান্ত্রিক মনমানসিকতা না ধারণ করলে কিম্বা নির্বাচনী ম্যান্ডেট মেনে নেয়ার মানসিকতা না থাকলে সমস্যা বা সংকট বাড়ে বৈকি তবে দুঃখ বা ক্ষোভটা আমার অন্য জায়গায় বাংলাদেশের জন্ম কিম্বা এই অঞ্চলের ইতিহাস বদলাবার পেছনে কেবলমাত্র সত্তরের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেয়ার পাকিস্তানের ‘ভুলটাই যে সব নয়, সেটিও জনাব নেওয়াজ শরীফ এই ছাব্বিশ বছরে অনুধাবন করতে পারেন নি। তাছাড়া ব্যাপারটি পাকিস্তানি জেনারেলদের বা সে সময়কার পাকিস্তানি পলিটিশিয়ানদের ‘ভুল ছিল, না বাঙালি নিধনের সুচিন্তিত একটি কৌশল ছিল, সেটিও আলােচনার দাবি রাখে বৈকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে আমরা সযতনে এবং অবিকৃতভাবে সংরক্ষণ করতে চাই, একই সাথে চাই পাকিস্তানের জনগণ সুখে থাকুক, এ অঞ্চলে শান্তি আর স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হােক, আমরা সবাই মিলে আমাদের অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া ব্যাপক জনগােষ্ঠির কল্যাণের জন্যে অতীতের সব সন্দেহ আর অবিশ্বাসের প্রাচীর ভেঙে এখন থেকে নতুন এক যুগের সূচনা করি- এ আমাদের জাতীয় প্রত্যাশা। আপনি না জানলেও জানতে পারেন, জনাব নেওয়াজ শরীফ, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৭০-এর নির্বাচন বা তার ফলাফল থেকে শুরু হয় নি, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ইতিহাস শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকে, যখন আপনাদের জাতির পিতা’ মিঃ মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মুখের ভাষাকে অপমানিত করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন এরপর গেল দুই যুগের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আধিপত্য যা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগােষ্ঠীর জন্যে কোনােদিনই সুখকর ছিলাে না একজন আধুনিক মানুষ হিসেবে এই ইতিহাস আপনি জানবেন না, এটা ভাবতেই আমার দুঃখ হয়, জনাব শরীফ। আমাদের ইতিহাস আমাদের রক্তের কাছে, আমাদের মাটি আর সততার কাছে আমাদের জাতির অস্তিত্বের দায়বদ্ধতা, এ আমাদের রক্তের ঋণ কাজেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের একটি মন্তব্যের পর আমাকে বলতেই হচ্ছে, জনাব শরীফ, আপনার মন্তব্যটি অর্ধ-সত্যও যেমন নয়, অন্যদিকে ইতিহাসভিত্তিকও নয়।
প্রথমত, ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ফলাফলকে পাকিস্তানের সেদিনের সেনাপতি শাসক জে, ইয়াহিয়া খান আর পাকিস্তান পিপলস পাটিঅর্থাৎ পিপিপির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো মেনে না নিয়ে শুধু যে সাধারণ ভুল করেছিলেন, তা বলা কি ঠিক হবে, সেটা তাদের সাধারণ কোনাে ভুল ছিলাে না। সে ভুল ছিল তাদের সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত, যাকে ‘ডেলিবারেট মিসটেক’ বললেই সঙ্গত বলা হবে কারণ এই ভুলটির মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মনে যে স্বাধীনতার দুর্বার আকাঙক্ষাটি গড়ে উঠেছিল, মূলত তাকেই তারা ধ্বংস করতে চেয়েছিল এবং সে চেষ্টাতেই তারা অতর্কিতে সেনাবাহিনী নামিয়ে কামান-বন্দুকের শক্তিতে আমাদের স্বাধীনতার আকাকাকে দমাতে চেয়েছিল। হ্যা, জনাব শরীফ, আপনি যথার্থই বলেছেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ আর ব্যালট বাক্সের আত সম্মান দেখানাে না হলে সংকটের সৃষ্টি হয়। সেদিক থেকে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের সেদিনের সামরিক আর অসামরিক প্রভুরা কতবার যে সে ভুলের সেঞ্চুরি করেছে তার কি ইয়ত্তা আছে সেঞ্চুরি’ শব্দটির ব্যবহার করছি আরও একটি প্রাসঙ্গিক কারণে জনাব নেওয়াজ শরীফ, আপনি ঢাকা স্টেডিয়ামে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে বাংলাদেশের ইন্ডিপেন্ডেস কাপ’ খেলাটি দেখতে গিয়েছিলেন। আপনার সাথে ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আপনি যার অতিথি এবং যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা একজন ক্রীড়ামােদী হিসেবে এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার দেশের দলকে আপনি অনুপ্রাণিত করবেন, উৎসাহ দেবেন, এটা অবশ্যই স্বাভাবিক এবং কাঙিক্ষত কিন্তু ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান-ভারত ক্রিকেট খেলা দেখে আপনার আনন্দের বা উপলব্ধির সীমাটা সেদিন ঠিক আপনি বুঝে উঠতে পেরেছিলেন বলে আমার কিন্তু মনে হয় না। কারণ সে রাতেই আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ভােজসভায় আপনি আপনার লিখিত বক্তব্যের বাইরে গিয়ে এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যাকে কূটনীতির শিষ্টাচারবিবর্জিত বলেই শুধু মনে হয় নি, আরও মনে হয়েছে। আপনি আমাদের ইতিহাস আর বাঙালিদের মনমানসিকতা উপলব্ধি করতে এখননা, ঠিক আপনার দেশের আগেকার রাজনীতিবিদদের মতােই, এবং ছাব্বিশ বছর পরও, আবারাে কেন যেন ব্যর্থ হচ্ছেন। এ আমাদের আপনাদের জন্যে যৌথ আরেক দুর্ভাগ্য বৈকি।
কারণ আপনি বা আপনার দেশের রাজনীতিবিদগণ এত বছর পরও যদি বাঙালিকে বুঝতে না পারেন, ইতিহাসকে শ্রদ্ধা করতে না শেখেন, তাহলে কী করে আমরা সবাই মিলে একত্রে যৌথ নতুন যাত্রা করবাে পাকিস্তান বিশ্ব ক্রিকেটের একটি সশ্রদ্ধ নাম, অত্যন্ত শক্তিশালী একটি দল, এটিকে পৃথিবীর যে কোনাে ক্রিকেট অনুরাগীই অস্বীকার করবে বলে আমার অন্তত মনে হয় । ঠিক একইভাবে ভারতও বিশ্ব ক্রিকেটের আরেক পুরােধা, যার খেলার কৌশল আর আত্মপ্রত্যয় বিশ্বজুড়েই তার সমর্থক সৃষ্টি করেছে বিশেষ করে ঢাকার মাঠে অবিস্মরণীয় খেলায় পাকিস্তানকে পরাজিত করে নতুন বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করে বাংলাদেশের রজতজয়ন্তী ইন্ডিপেন্ডেস কাপ জিতে ভারত তার ক্রিকেট শ্রেষ্ঠত্বের সম্মানকে আরও বেশি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে সাম্প্রতিকালে ক্রিকেটের দুনিয়াতে অবশ্য আরেক শক্তিমান তারকা আবির্ভূত হয়েছে, যার নাম শ্রীলঙ্কা আমি ক্রিকেট তেমন বুঝি নে, কিন্তু ইদানীং যথেষ্ট ভালােবাসি, বেশ বুঝতে পাচ্ছি, ইদানীং আমি নিজেও শ্রীলঙ্কার সমর্থক হয়ে যাচ্ছি। কথাগুলি বলছি, এ-কারণে যে, আপনি ঢাকার মাঠে কয়েক দণ্ড থেকে পাকিস্তানি দলের পক্ষে গ্যালারির সমর্থন দেখে কেনই বা এমন ধারণা করতে গেলেন যে, বাংলাদেশ আর পাকিস্তান আবার এক হয়ে যাচ্ছে। অন্য দেশের মাটিতে নিজ দেশের খেলােয়াড়দের পক্ষে গ্যালারির সমর্থন নিঃসন্দেহে একটি আনন্দের খবর, কিন্তু জনাব নেওয়াজ শরীফ, আমরা বলতে বাধ্য যে, আপনার আনন্দের মাত্রাটা যথেষ্টই বাড়তি হয়েছে আপনি এটিও বােধহয় ধরে নিয়েছেন যে, বাংলাদেশ নামে ১৯৭১ সালে যে দেশটা যৎসামান্য ভুলের জন্য কিম্বা বহিঃশত্রুর প্ররােচনার জন্য সৃষ্টি হয়েছিল বা আপনাদের হাতছাড়া হয়েছিল, তা আবার পাকিস্তান হতে তৈরি হচ্ছে। বিশ্বাস করুন। জনাব শরীফ, আপনার মতাে লােকের কাছ থেকে এমন একটি বাজে উপলব্ধি আমি অন্তত আশা করি নি।
হতে পারে আমাদের দেশে এখনাে পাকিস্তানপন্থীরা আছে, হতে পারে এ-দেশের মাটিতে পাকিস্তানের প্রেতাত্মাকে সজীব করে রাখা হচ্ছে, কিন্তু আপনার মতাে একজন আধুনিক মুসলিম লীগার কেন একটা ভুল করতে যাবেন যদিও আপনি নাম ধরে বলেন নি, কিন্তু আপনার ভাষায় আপনি যাকে বহিঃশত্র’ বলে তুলে ধরেছেন তা হচ্ছে ভারত এবং আকারে-ইঙ্গিতে এও বােঝাতে চেয়েছেন, এই দেশটি থেকে আমাদের অর্থাৎ পাকিস্তান আর বাংলাদেশকে সচেতন থাকতে হবে, যাতে সে আর নতুন করে কোনাে ভুলের সুযােগ না দিতে পারে কথাটা হয়তাে পাড়তাম না, কিন্তু না উপায় নেই, এবং এ-কারণে যে, এই ভারতই ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম বন্ধু এই ভারতের মাটিতেই আপনার পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে সেদিন এক কোটি মানুষকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল, এই ভারতের জনগণ এবং সরকারই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র, গোলাবারুদ আর। সাহায্য সহযােগিতা জুগিয়েছিল, এই ভারতের সরকারই সেদিন বিশ্বজুড়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করেছিল। অতএব ভারত যদি শত্রু হয়, হতে পারে তা আপনার, আমাদের বা বাংলাদেশের কেন? আপনার দেশের রাজনীতি বা আপনার দেশের পররাষ্ট্রনীতি আমাদের সমান্তরাল ভাবতে যাচ্ছেন কেন আপনি, জনাব নেওয়াজ শরীফ আসলে ঠিক বুঝতে পাচ্ছিনে, এবার বাংলাদেশ এসে আপনি আসলে কী বুঝেছেন বা কী আপনাকে বােঝানাে হয়েছে। দেশে এক ধরনের ভারতবিরােধী আর পাকিস্তানপন্থী তৎপরতা দেখে বা শুনে কি এটাই আপনার মনে হয়েছে, ১৯৭১ সালের ‘ভুল’-টাকে এবার হয়তাে শুধরে নেয়া যাবে বিশ্বাস করুন জনাব নেওয়াজ শরীফ, মুক্তিযুদ্ধের একজন সৈনিক হয়েও, যার শরীরে এখনাে পাকিস্তানি সৈন্যদের বুলেটের চিহ্ন আছে, আমি আমাদের সকলের, এই অঞ্চলের প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্যে কল্যাণ চাই ইতিহাসের সেই নৃশংসতাকে আমরা কখনােই ভুলতে চাইনে, কিন্তু এরপরও আমরা সবাই মিলে আমাদের নতুনদের কল্যাণে সৌহার্দ্য চাই, একে অপরের সহযােগিতা চাই, যৌথ উদ্যোগে বাঁচতে চাই । এ আমাদের সভ্যতার, আমাদের যুগের দাবি কিন্তু সেদিনের পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ আর সৈন্যদের নৃশংসতা আর বর্বরতা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এমন এক অধ্যায় মিঃ নেওয়াজ শরীফ, যা আমাদেরকে কেই ভুলিয়ে দিতে পারে না।
না আপনি, না এদেশের ক্ষুদে পাকিস্তানপন্থীরা, যারা শুনছি, আজও নাকি ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখে। কই, একজন আধুনিক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে একবারও তাে আপনি সেই নির্বিচার গণহত্যা আর পৈশাচিকতার জন্যে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন নি। এবার যখন আপনি সাভারে আমাদের জাতীয় শহীদ স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলেন, আমাদের অনেকেরই কিন্তু ধারণা ছিল, আপনি আমাদের লাখাে শহীদের উদ্দেশে, যাঁরা সকলেই আপনার পাকিস্তানের সৈন্যদের হাতে নিহত হয়েছে, এই দেশের স্বাধীনতার জন্যে আত্মাহুতি দিয়েছে, কমবেশি কিছু একটা বলবেন। স্মৃতিসৌধের দর্শনার্থী বই-এ অন্তত কিছু একটা লিখবেন কিন্তু কিছুই লিখেন নি আপনি। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্দেশে একটি সশ্রদ্ধ বাক্যও আপনি উচ্চারণ করেন নি। কেন, জনাব নেওয়াজ শরীফ, বাস্তবতাকে মেনে নিতে এতােটা কার্পণ্য করলে আমাদের সকলের জন্য নতুন সৌহার্দের জগৎ কীভাবে তৈরি হবে। বলতে বাধ্য হচ্ছি, একজন আধুনিক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে এ আপনার সুম এক ব্যর্থতা। শুনেছি, একটি বিদেশী বেতারের সাথে এক সাক্ষাৎকারে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আপনাদের মিলিটারি অপারেশন করা উচিত কাজ হয় নি-এমন একটি মন্তব্যও আপনি করেছেন। এই মন্তব্যটি অবশ্য বাংলাদেশে বসে এবারেই আপনি প্রথম করলেন এতােটাই যদি আপনার উপলব্ধি হলাে, তাহলে সেই ‘মিলিটারি অপারেশন”এ যে লক্ষ মানুষ মারা গেল, মানবতা ভূলুষ্ঠিত হলাে, লক্ষ নারী নির্যাতিত হলাে, ধ্বংসপ্রাপ্ত হলাে একটি জনপদ, তার জন্যে পাকিস্তানের সরকারপ্রধান হিসেবে কেন আপনি ক্ষমা প্রার্থনা করলেন না বাংলাদেশের মানুষের কাছে আজ আপনাকে সুস্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই জনাব নেওয়াজ শরীফ, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের যে প্রভেদ তা কেবলমাত্রই ভাষাগত বা দূরত্বগত নয়, একই সাথে ঐতিহ্যগত এবং সংস্কৃতিগত। ভারতকে দোষারােপ করে অযথা সময়ক্ষেপণ করে লাভ নেই। একটি সময়ের পর ভারতেরও আজ নতুন উপলব্ধি হয়েছে। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ আজ সৌহার্দ্যের অঞ্চল কামনা করছে। আপনারদের মধ্যেও আজ নতুন উপলব্ধি হওয়া উচিত। কারণ যে ধর্ম মানুষের ব্যক্তিক চর্চার বিষয়, সেই ধর্মকে এখনাে আপনারা পুঁজি করছেন রাজনীতিতে। যদ্দিন এই আত্মসংহারকারি উপলব্ধি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারবেন, তদ্দিন ধরে সবাই মিলে আমরা কেবলমাত্র বিভাজিতই হতে থাকবে। তাই কামনা করি, আসুন আমরা সবাই মিলে নতুন এক যুগের সূচনা করি, যেখানে কেবলই মানবতার জয়গান হবে।
ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ – হারুন হাবীব