You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.09.06 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | পরলোকে কণ্ঠশিল্পী আব্দুল আলীম | নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যাঘাত | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৬ই সেপ্টেম্বর, শুক্রবার, ২০শে ভাদ্র, ১৩৮১

পরলোকে কণ্ঠশিল্পী আব্দুল আলীম

কন্ঠ শিল্পী আব্দুল আলীম আর নেই। শিল্পী গতকাল (বৃহস্পতিবার) সকাল ৬-৩৩ মিনিটে স্থানীয় পি জি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন (ইন্নালিল্লাহে-রাজিউন) ।
মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে তিনি পরপারের দিকে যাত্রা করলেন। একটি মানুষের জীবনে তেতাল্লিশ বছর কিছুই নয়। জীবনের মধ্যাহ্ন কাল বলা চলে এ সময়কে। শিল্পী আব্দুল আলীম অসময়ে এবং অপরিণত বয়সে বিদায় নিলেন।
মৃত্যু এসে শিল্পীকে ছিনিয়ে নিয়েছে। মৃত্যুর উপর কারও হাত নেই। জন্ম মৃত্যু মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। পল্লী কোকিল আব্বাস উদ্দিন আহমদ মৃত্যুর পূর্বে লিখেছিলেন, “দুদিন পরে আমি যখন এ ধরার আনন্দ কোলাহল থেকে চিরদিনের মত চলে যাব তখন তুমি আমাকে ভুলে যাবে। চিরকাল জেগে আছে এবং থাকবে শুধু আকাশের ওই চন্দ্র সূর্য, অগণিত তারকা সজাগ প্রহরীর মত। চলমান হয়ে থাকবে আলো বাতাস, দখনে-হাওয়া-পাখির কলতান, কুলুকুলু নাদিনী স্রোতস্বিনী আমার এবং তার বাগানের হাসনাহেনা, জুঁই চামেলী। এরা ফুটবে ঝরবে আবার ফুটবে। আমি ফুটেছিলাম-দিন কয়েক হেসেছিলাম-এবার-ঝরার পথে ঝরবো কিন্তু আর ফিরবো না।”
কন্ঠ শিল্পী আব্দুল আলীম “হাসনাহেনা”র মতোই পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে জন্মেছিলেন ১৯৩১ সালে। গান পাগলা আব্দুল আলিম গায়ক জীবনে সাতাশটি বছর হাসনাহেনার মতোই সৌরভ ছড়িয়ে গেছেন। তাঁর গানে মুগ্ধ হয়েছে এ দেশের অগণিত মানুষ। বয়স অল্প। নিত্যান্ত বালক। তখনই বেরিয়ে পড়েছিলেন মুর্শিদাবাদের গ্রামে গ্রামে যাত্রা আর তরজা দলের সঙ্গে। অভিজ্ঞতার জারক রসে হয়েছেন সঞ্জীবিত। দীর্ঘদিনের সাধনায় অর্জন করেছেন নিজস্ব গায়কী ঢং।
“প্রেমের মরা জলে ডোবে না,” “আমারে সাজাইয়া দিও নওশারই সাজন,” “দুয়ারে আইসাছে পাল্কী নাইওরি গাও তোলরে তোল,” এমনই আরো কত মন মাতানো গান গেয়েছেন শিল্পী। জারি সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদী, মারফতি কত বিচিত্র ধরনের গান শিল্পী এদেশের মানুষকে শুনিয়েছেন। লোকসঙ্গীতের একজন একনিষ্ঠ সেবক বলতে যা বোঝায় শিল্পী ছিলেন তাই। আব্বাস উদ্দীনের পর দ্বিতীয় নাম উচ্চারিত হলেই সর্বাগ্রে আসবে আব্দুল আলীমের নাম।
আব্দুল আলিম এর মত আরেকটি কন্ঠ বাংলাদেশ আর পাবে কিনা তা ভবিষ্যতই বলতে পারে। যে সম্পদ আমরা হারালাম তার বর্ণনা দেবার মতো ভাষা আমাদের নেই। আব্দুল আলীম বাংলাদেশের গৌরব। একটি নাম। একটি ইতিহাস।
শিল্পী আব্দুল আলীমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এবং তার শোকসমস্ত পরিবারবর্গকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে সমবেদনা জানিয়ে আমরা দুটি কথা বলতে চাই। কার দোষে, কারো অবহেলায় বা কার অপরিণামদর্শিতায় শিল্পীকে আমরা হারালাম এ বিতর্ক উত্থাপন করে আজ আর কোন লাভ নেই। বাঙালির জীবনে এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে। অনেক শিল্পী, সাহিত্যিক দারিদ্রতার অভিশাপ ও অবহেলার মর্মযাতনা ভোগ করতে না পেরে অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন। সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না করেই বলব আমরা পল্লী কোকিল আব্বাস উদ্দিনকে পেয়েছিলাম। তিনি আজ আর নেই। মধুকন্ঠ আব্দুল আলীমকে পেয়েও অকালে হারালাম। আব্বাস উদ্দিনের নামে আজও কোন লোকসংগীত সংরক্ষণাগার স্থাপিত হয়নি। তার গানগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। শিল্পী আব্দুল আলীমের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। শিল্পীর গাওয়া গানগুলো যদি যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় এবং বাংলার মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকসংগীত চর্চার জন্য যদি সুপরিকল্পিত সুচিন্তিত উদ্যোগ নেয়া হয় তাহলে শিল্পীর আত্মা যেমন শান্তি পাবে তেমনি তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে। আশা করি সরকার এ বিষয়ে বিশেষ ভাবে ভেবে দেখবেন।

নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যাঘাত

কেরোসিন তেল, সরিষার তেল, কাঁচা ও শুকনো মরিচের দাম দিন দিন ক্রেতাসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে এবং ঊর্ধ্বগতিতে লাগামহীন রশি টেনে ধরার মত সামর্থ্য মনে হয় এই মুহূর্তে কারোরই যেন নেই। গত মঙ্গলবার সরিষার তেল, শুকনো ও কাঁচামরিচের দাম বেঁধে দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত খোলা বাজারে এ ৩টি অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের প্রতিটা যথাক্রমে বত্রিশ, চল্লিশ এবং দশ টাকা সের দরে বিক্রি হচ্ছিল। কিন্তু দাম বেঁধে দেয়ার পর পরই দেখা গেল ৩টি জিনিসই বাজার থেকে প্রায় উধাও হয়ে গেছে এবং গোপনে দাম বেশি দিতে চাইলে প্রতিটি জিনিসই আবার পাওয়া যাচ্ছে।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে জিনিসপত্রের মূল্য নির্ধারণ গল্পে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই রাতারাতি তা বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়, গত আড়াই বছর ধরে জনসাধারণ তা দেখে আসছে। ঢাকার মাত্র দু একটি অভিজাত এলাকার সুখী নাগরিকরা ছাড়া আর বাদবাকি সবাই রান্নায় জ্বালানির জন্য কেরোসিনের ওপর নির্ভরশীল। সেই কেরোসিন এখন ঢাকাতে প্রতি গ্যালন বিক্রি হচ্ছে বারো টাকায়। ইস্টার্ন রিফাইনারি বন্ধ থাকার সময় প্রতি গ্যালন বিক্রি হচ্ছিল আট টাকা করে। কিন্তু গত পঁচিশে আগস্ট রিফাইনারিতে উৎপাদন শুরু হওয়ার পর বিস্ময়কর ভাবে লক্ষ্য করা গেল কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। বোঝা দুষ্কর, কেন কেরোসিনের দাম বাড়ছে রিফাইনারিতে উৎপাদন শুরু হওয়া সত্ত্বেও। ঢাকাতে তেল সরবরাহ করে এমন কোম্পানির সংখ্যা ৪টি। পল্লা পেট্রোলিয়াম ট্যাংকের অভাবে তার ডি-৩ এবং ডি-৪ এলাকায় গত তিন সপ্তাহ ধরে তেল সরবরাহ করতে পারছে না।
বার্মা ইস্টার্ন, এস এবং যমুনা অয়েল নিয়মিতভাবে তাদের এজেন্ট ও ডিলারদের কাছে তেল সরবরাহ করছে বলে তিনটি কোম্পানির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু ঢাকার একটি এলাকাতেও কেরোসিন দেয়া হচ্ছে না এবং হকাররা অভিযোগ করছে এজেন্টরা তাদের কাছ থেকে বেশি দাম নিচ্ছে বলে বাইরে ও তাদের চড়া দাম হাঁকতে হচ্ছে। পদ্মা পেট্রোলিয়ামের এলাকায় তেল সংকট স্বাভাবিক। কিন্তু বাদবাকি এলাকাগুলোর এ অবস্থা কেন?
সুতরাং সামগ্রিকভাবে আমাদের প্রশ্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের দাম হঠাৎ করে আজ বৃদ্ধি পায়নি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু মজুমদার ও তাদের দ্বারা সৃষ্ট এ কৃত্রিম সংকট মোকাবেলা করা হচ্ছে না কেন? দু একজন লোক গ্রেফতার কিংবা জরিমানা করে এ সর্বগ্রাসী সমস্যার সমাধান মোটেই সম্ভবপর নয়। এর জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা করা একান্ত দরকার। তা না হলে বিষফোঁড়ার মতো বরাবর এ সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এবং জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে।
এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই দেখা দেয়। সেটা হলোঃ আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী এসব দ্রব্য সরবরাহ আছে কি? এ সম্পর্কিত যাবতীয় হিসাব জনসাধারণের কাছে না থাকলেও এ কথা বলা যায়, কোন কোন ক্ষেত্রে চাহিদা মাফিক সরবরাহ নিশ্চিত করার আশ্বাস সরকার বহুবার দেশবাসীকে দিয়েছেন। যেমন কেরোসিন বা অন্যান্য আরো কয়েকটি অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আবার আমাদের দেশে উৎপাদিত কোন কোন দ্রব্যে যেমন মরিচ পিঁয়াজ ইত্যাদির ফলন ভালো না হওয়ায় হয়তো চাহিদামাফিক বাজারে মাল তেমন আমদানি হচ্ছে না কিন্তু তাই বলে কি সকালে একদম বিকালে আরেক দাম অর্থাৎ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চলতেই থাকবে? এটা কি করে সম্ভব এক্ষেত্রে একথা বলা নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য হোক না কেন- তা দেশীয় কৃষিজাত কিংবা আমদানিকৃত বন্টন ব্যবস্থায় ভয়ানক গলদ রয়েছে বলে মনে হয়। যা কিছু আমরা বিদেশ থেকে আনি না কেন কিংবা দেশে উৎপাদন করিনা কেন বন্টন ব্যবস্থা সুষ্ঠু না হলে ক্রেতা সাধারণ কোনদিনই এ যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাবেন না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন