You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকেট

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ ও বিভিন্ন বন্ধুভাবাপন্ন দেশের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশ ডাকটিকেট প্রচলন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ব্রিটিশ ডাকযােগাযােগ দপ্তরের প্রাক্তন মন্ত্রী ও তৎকালীন শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউসের (John Stonehouse) পরামর্শ অনুযায়ী এপ্রিল মাসের শেষদিকে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ উল্লিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।  ১৯৭১ সালে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাঙালিরা ‘মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে আন্দোলন পরিচালনা করেন। আন্দোলনের সমর্থনে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় গঠিত অ্যাকশন। কমিটিগুলােকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ২৪ এপ্রিল ইংল্যান্ডের কভেন্ট্রি শহরে অনুষ্ঠিত এক প্রতিনিধি সম্মেলনে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হয়। বিচারপতি চৌধুরী ছিলেন এই কমিটির প্রধান উপদেষ্টা।  স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার আগেই কয়েকজন শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য তৎকালীন পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতার প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থনদানের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন জন স্টোনহাউস ও ক্রস ডগলাসম্যান (Bruce Douglasman)।  ২৪ এপ্রিল (১৯৭১) ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে আগত শরণার্থীদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য মি. ডগলাসম্যান ও মি. স্টোনহাউস সম্প্রতি কলকাতায় পৌঁছান। ২৩ এপ্রিল এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে মি, ডগলাসম্যান বলেন, দক্ষিণ ভিয়েতনামের মাইলাই গ্রামে মার্কিন সৈন্যবাহিনী সংঘটিত অমানুষিক হত্যাকাণ্ডের মতাে বহু ঘটনা পূর্ব বাংলায় প্রতিনিয়ত ঘটছে। উল্লিখিত সফরকালে মি, স্টোনহাউস মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকালে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, বাংলাদেশ ডাকটিকেট প্রচলন করা হলে মুক্তাঞ্চল থেকে পাঠানাে চিঠিপত্রের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব বাস্তব সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আললাচনাকালে অর্থমন্ত্রী মনসুর আলীও উপস্থিত ছিলেন। সহকর্মীদের সঙ্গে,

আলাপ-আলােচনার পর প্রধানমন্ত্রী মি, স্টোনহাউসকে জানান, মন্ত্রিসভা তার প্রস্তাব অনুমােদন করেছে। ডাকটিকেট প্রকাশের দায়িত্ব তাঁকে দেয়া হয়। যথারীতি ‘মুজিবনগর সরকারের সিলমােহর সংবলিত অনুমতিপত্রও তাকে দেয়া হয়।  লন্ডনে ফিরে আসার পর মি. স্টোনহাউস পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি গ্রাফিক শিল্পী বিমান মল্লিকের সঙ্গে যােগাযােগ করে বাংলাদেশের জন্য এক সেট’ ডাকটিকেটের নকশা তৈরি করার জন্য তাকে অনুরােধ করেন। মি. স্টোনহাউস যখন পােস্টমাস্টার জেনারেল (ডাক ও টেলিযােগাযােগ মন্ত্রী) ছিলেন তখন মি. মল্লিক ব্রিটিশ পােস্ট অফিসের জন্য গান্ধী। স্মারক ডাকটিকেটের নকশা তৈরি করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।১৫৮ লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারকালে বিমান মল্লিক বলেন, ২৯ এপ্রিল (১৯৭১) মি. স্টোনহাউস তার সঙ্গে টেলিফোনে যােগাযােগ করে বাংলাদেশ ডাকটিকেটের নকশা তৈরি করার অনুরােধ জানান। ৩ মে তিনি হাউস অব কমন্সে গিয়ে মি. স্টোনহাউসের সঙ্গে এ সম্পর্কে প্রাথমিক আলাপ-আলােচনা করেন। আলােচনাকালে মি. স্টোনহাউস বলেন, বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি বিচারপতি চৌধুরীর নির্দেশমতাে তিনি বাংলাদেশ ডাকটিকেটের সম্পূর্ণ পরিকল্পনা, নকশা তৈরি ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব মি. মল্লিককে দিতে চান।১৫৯  সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে নিরপরাধ বাঙালি জনসাধারণের ওপর।

পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর অমানুষিক অত্যাচারের কাহিনী মি. মল্লিকের জানা ছিল। নিপীড়িত জনসাধারণের দুর্দশার চিত্র তাকে অভিভূত করেছিল। তিনি ভাবলেন, মি. স্টোনহাউসের প্রস্তাব গ্রহণ করলে পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাধ্যমত সাহায্যদানের সুযােগ তিনি পাবেন। মি. স্টোনহাউসের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে তিনি অবিলম্বে তার পরিকল্পনা পেশ করার প্রতিশ্রুতি দেন।  কয়েক দিন পর মি. মল্লিক নিচে উল্লিখিত প্রস্তাবগুলাে পেশ করেন : ক. দৈনন্দিন ডাক-ব্যবস্থার প্রয়ােজনে বিভিন্ন মূল্যের আটটি ডাকটিকেট প্রচলন করা হবে, খ, ডাকটিকেটগুলাের মূল্য এক পাউন্ড রাখা হলে উৎসাহী ডাকটিকেট সংগ্রহকারীদের পক্ষে তা সংগ্রহ করা সহজসাধ্য হবে, গ, প্রথম দিনের খামের (First Day Cover) ওপর। ৮টি ডাকটিকেটের একটি ‘সেট’ মানানসই হবে, ঘ, বলিষ্ঠ গ্রাফিক-চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের কাহিনী ও বিদ্যমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে হবে, ও, ডাকটিকেটের ওপর অঙ্কিত প্রতিকৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাপূর্ণ প্রগতিশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, চ, ডাকটিকেটগুলােকে আকর্ষণীয় এবং বাংলাদেশের সংগ্রামের মর্মবাণী প্রচারের বাহক হিসেবে তুলনামূলকভাবে বড় আকারের ও রঙিন হতে হবে। মি. স্টোনহাউসের সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে মি, মল্লিককে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। তারা উভয়ে মি, মল্লিকের প্রস্তাবগুলাে গ্রহণ করে তাকে ডাকটিকেটের নকশা তৈরি করার দায়িত্ব দেন। বিমান মল্লিক তখন কেন্টের ফোকস্টোন স্কুল অব আর্ট-এ প্রতি সপ্তাহে দু’দিন এবং এসেক্সের হারলাে টেকনিক্যাল কলেজে প্রতি সপ্তাহে তিন দিন হিসেবে অধ্যাপনায় নিয়ােজিত ছিলেন। এই উপলক্ষে তাকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় চারশ’ মাইল যাতায়াত করতে। হতাে। কাজেই তিনি সন্ধ্যার পর এবং সপ্তাহের শেষ দিকে নকশা তৈরির কাজ করতেন।

ছ’ সপ্তাহের মধ্যে তিনি নকশা তৈরির কাজ শেষ করেন। সাধারণত তিনি একাধিক বিকল্প-নকশা তৈরি করেন। ১৯৬৯ সালে গান্ধী স্মারক ডাকটিকেটের জন্য তিনি ১৭টি বিকল্প-নকশা তৈরি করেছিলেন। সময়াভাবের ফলে বাংলাদেশ ডাকটিকেটের জন্য তিনি একাধিক বিকল্প-নকশা তৈরি করতে পারেন নি। শুধু ‘সাপাের্ট বাংলা দেশ’ (Support Bangla Desh) লেখা ডাকটিকেটখানির একটি মাত্র বিকল্প-নকশা তৈরি করেছিলেন। বিচারপতি চৌধুরী ও মি. স্টোনহাউস নকশাগুলাের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন (পরবর্তীকালে বাংলা দেশ’ শব্দ দুটি এক শব্দ হিসেবে গৃহীত হয়)। | লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারে শিল্পী বিমান মল্লিক বলেন, ডাকটিকেটগুলাের নকশা তৈরি করার সময় তিনি বিচারপতি চৌধুরী ও মি, স্টোনহাউসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করেন। ডাকটিকেটে ব্যবহৃত বিভিন্ন তথ্য ও প্রতীক সম্পর্কে কোনাে লিখিত নির্দেশ না থাকায় তিনি নিজেই গবেষণার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য কোনাে পারিশ্রমিক তিনি গ্রহণ করেন নি। শিল্পীর প্রাপ্য ‘রয়ালটি’ সম্পর্কে কোনাে চুক্তিপত্রেও তিনি স্বাক্ষর করেন নি। ব্রিটিশ দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’-এর (War on Want) চেয়ারম্যান ডােনাল্ড চেসওয়ার্থ (Donald Chesworth) প্রথম থেকেই বাংলাদেশ আন্দোলনের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। তিনি ডাকটিকেটগুলাের নকশা সঙ্গে নিয়ে মুজিবনগর সরকারের অনুমােদনের জন্য কলকাতায় যান। কয়েক দিনের মধ্যেই মন্ত্রিসভার অনুমােদন নিয়ে তিনি ফিরে আসেন। বাংলাদেশের ডাকটিকেটগুলাে ছাপানাের জন্য জন স্টোনহাউস দক্ষিণ লন্ডনের ফরম্যাট ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রিন্টার্স লিমিটেড-এর (Format International Security Printers Ltd.) সঙ্গে যােগাযােগ করেন। তারা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ছাপার কাজ সম্পন্ন করে। ২৬ জুলাই (১৯৭১) হাউস অব কমন্সের হারকোর্ট রুমে (Harcourt Room) অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সংবাদ সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী ঐতিহাসিক ডাকটিকেটগুলাে এবং ফাস্ট ডে কভার প্রদর্শন করেন।

পরদিন (২৭ জুলাই) লন্ডনের ‘দি টাইমস’, ‘দি গার্ডিয়ান’, ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’, “ডেইলি মিরর ও ‘দি মর্নিং স্টার’সহ বিভিন্ন পত্রিকায় ডাকটিকেটগুলাের ফ্যাক্সিমিলি’সহ সংবাদ প্রকাশিত হয়।১৬০ পরবর্তীকালে বিচারপতি চৌধুরী তার স্মৃতিচারণমূলক বইতে বলেন, এই ডাকটিকেট। প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল। এর ফলে ‘মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্র। পরিচালনা করছে, এই ধারণা বিদেশে সমর্থন লাভ করে। বাংলাদেশের ডাকটিকেটের একটিতে বাংলাদেশের মানচিত্র ছিল, অন্যটিতে ছিল ব্যালটক্স। ব্যালটবয় গণতন্ত্রের প্রতীক। আরেকটিতে শিকল ভাঙার ছবি। এর দ্বারা বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পাকিস্তানের পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়েছে। একটি টিকেটে ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। আরেকটি ডাকটিকেটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তপাত দেখানাে হয়েছে। ডাকটিকেট প্রকাশনা অনুষ্ঠানে পার্লামেন্টের সকল দলের সদস্য উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে পিটার শাের (পরবর্তীকালে লর্ড শাের), জন স্টোনহাউস এবং আরাে কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে বক্তৃতা করেন। বিচারপতি। চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সমবেত পার্লামেন্ট সদস্য, সম্মানিত অতিথি ও সাংবাদিকবৃন্দকে ধন্যবাদ জানান। শিল্পী বিমান মল্লিক এই ডাকটিকেটগুলােতে যে চিন্তাশীলতার পরিচয় দিয়েছেন সেজন্য তাকে তিনি অভিনন্দন জানান। ২৯ জুলাই (১৯৭১) বাংলাদেশ ডাকটিকেট ও ‘ফার্স্ট ডে কভার বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল, ভারত, যুক্তরাজ্য, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইজরায়েল, ইউরােপ, অস্ট্রেলিয়া ও দূরপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। এই উপলক্ষে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একটি কক্ষে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। অনুষ্ঠানকালে নতুন ডাকটিকেট ও ফার্স্ট ডে কভার নিলামে বিক্রয় করা হয়। আটটি ডাকটিকেট সংবলিত প্রথম ‘সেটও ‘ফার্স্ট ডে কভার’ বাংলাদেশের একজন ব্যবসায়ী দু’শ ত্রিশ পাউন্ড দিয়ে ক্রয় করেন। দু’শ বিশ পাউন্ড দিয়ে দ্বিতীয় সেট ও ফাস্ট ডে কভার ক্রয় করেন। মুক্তিযুদ্ধের আরেকজন বাঙালি সমর্থক। ফাস্ট ডে কভার’-এর ওপর ছিল বিচারপতি চৌধুরী, জন স্টোনহাউস ও বিমান মল্লিকের ‘অটোগ্রাফ’।

নিলাম পরিচালনায় বিচারপতি চৌধুরী অংশগ্রহণ করেন। প্রায় এক ঘণ্টা স্থায়ী অনুষ্ঠানের শেষে মি. স্টোনহাউস জানান, ডাকটিকেট ও ফাস্ট ডে কভার বিক্রয় করে কমপক্ষে এক হাজার পাউন্ড সংগৃহীত হয়েছে।১৬২ যুক্তরাজ্য-প্রবাসী বাঙালি নেতৃবৃন্দ এই অনুষ্ঠানে যােগদান করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন গাউস খান, মিনহাজউদ্দিন, শেখ আবদুল মান্নান ও আজিজুল হক ভূঁইয়া। মি. স্টোনহাউসের অনুরােধ অনুযায়ী শিল্পী বিমান মল্লিক ডাকটিকেটগুলাের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন। আটটি ডাকটিকেট সংবলিত প্রতি ‘সেট’-এর মূল্য ছিল ২১ টাকা ৮০ পয়সা। তৎকালীন পাউন্ডের মূল্য ২০ টাকা হিসেবে ব্রিটিশ মুদ্রায় ডাকটিকেটগুলাের মূল্য ছিল ১ পাউন্ড ৯ পেনি। আলাদাভাবে ডাকটিকেটগুলাের মূল্য এবং নকশা ও রঙের বিবরণ নিচে উল্লেখ করা হলাে : | ক, বাংলাদেশের মানচিত্র সংবলিত দশ পয়সা মূল্যের টিকেটে নীল, টকটকে লাল ও বেগুনি-লাল রঙ, খ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ড শীর্ষক ২০ পয়সা মূল্যের টিকেটে হলুদ, টকটকে লাল ও গাঢ় সবুজ রঙ, গ, সাড়ে সাত কোটি বাঙালি জাতি শীর্ষক ৫০ পয়সার টিকেটে কমলা, হালকা বাদামি ও ধূসর রঙ, ঘ, বাংলাদেশের মানচিত্রসহ জাতীয় পতাকা সংবলিত এক টাকার টিকেটে হলদে, টকটকে লাল ও সবুজ রঙ, ও, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের পক্ষে শতকরা ৯৮ ভাগ ভােট প্রদান শীর্ষক দু টাকার টিকেটে নীল, গাঢ় নীল ও ম্যাজেন্টা রঙ, চ, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘােষণাসহ শিকল। ভাঙার চিত্র সংবলিত তিন টাকার টিকেটে সবুজ, গাঢ় সবুজ ও নীল রঙ, ছ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফটো সংবলিত পাঁচ টাকার টিকেটে সােনালিসদৃশ, কমলা, গাঢ় বাদামি ও হাফ-টো কালাে রঙ এবং জ, বাংলাদেশকে সমর্থন করুন শীর্ষক ১০ টাকার টিকেটে। সােনালিসদৃশ, ম্যাজেন্টা ও গাঢ় নীল রঙ ব্যবহার করা হয়। ডাকটিকেটগুলােতে। বাংলাদেশ’ শব্দটি ইংরেজি ও বাংলায় দুটি পৃথক শব্দ হিসেবে লেখা হয়েছিল। বাংলাদেশ ডাকটিকেট বিক্রয়ের জন্য বাংলাদেশ ফিলাটেলিক এজেন্সি (Bangladesh Philatelic Agency) নামের একটি ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি  বাংলাদেশ ডাকটিকেট ও ফাস্ট ডে কভার’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফিলাটেলিস্টদের কাছে পৌঁছে দেয়। 

২৯ জুলাই মুজিবনগর সরকারও কলকাতায় ডাকটিকেট ও ‘ফাস্ট ডে কভার প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে। ১ আগস্ট কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয় : প্রথম প্রকাশিত বাংলাদেশের ডাকটিকেট ও ফার্স্ট ডে কভার কেনার জন্য আবার (অর্থাৎ ৩০ জুলাই) শত শত ক্রেতা বাংলাদেশ মিশনের ফটকে গিয়ে ভীড় করে।’ ১ আগস্ট দৈনিক ‘অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশের ডাকটিকেটগুলাের বিপুল চাহিদা মেটানাের জন্য সেদিন সাপ্তাহিক ছুটির দিন (রােববার) হওয়া সত্ত্বেও স্থানীয় বাংলাদেশ মিশনের ডাকটিকেট কাউন্টার’ সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত খােলা রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে মুজিবনগর সরকার পরিচালিত ‘ফিল্ড পােস্টঅফিস থেকেও বাংলাদেশ ডাকটিকেট এবং ‘ফাস্ট ডে কভার বিক্রয় করা হয়। একটি ফিল্ড পােস্টঅফিস’ পাহারারত তিনজন মুক্তিযােদ্ধার ছবি পরবর্তীকালে লন্ডনের ‘মর্নিংস্টার’ পত্রিকায় ছাপা হয়। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে আবুল হাসান মাহমুদ আলী বাংলাদেশ ডাকটিকেট এবং ‘ফার্স্ট ডে কভার যুক্তরাষ্ট্রে উপস্থাপন ও প্রচারের ব্যবস্থা করার জন্য মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে এক জরুরি নির্দেশ পান। ১৯৭১ সালে মি. মাহমুদ আলী। নিউইয়র্কে পাকিস্তান কনসুলেট-জেনারেলের অফিসে ভাইস-কন্সল পদে নিয়ােজিত ছিলেন। ২৬ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি। পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। মে মাসে মুজিবনগর সরকার তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের প্রতিনিধি পদে নিয়ােগ করে।  সদ্য প্রকাশিত ডাকটিকেটগুলাের একটি ‘সেট’ সঙ্গে নিয়ে মি. মাহমুদ আলী। জাতিসংঘের সদর দপ্তরে নিয়ােজিত ‘নিউইয়র্ক টাইমস্ -এর সংবাদদাতা ক্যাথলিন টেন্টসের (Ms. Kathleen Teltsch) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তার ডাকনাম ছিল কিটি। মি. মাহমুদ আলী জানতেন, তাঁর দশ বছর বয়সী একটি পুত্র-সন্তান ছিল। ডাকটিকেটের ‘সেটটি তার হাতে দিয়ে মি. মাহমুদ আলী বললেন, ‘কিটি, স্বাধীন বাংলাদেশের এই নতুন ডাকটিকেটগুলাে তােমার ছেলের জন্য এনেছি।’ কিটি ডাকটিকেটগুলাে দেখে খুশি হয়ে বললেন, এ সম্পর্কে প্রচারণার ব্যাপারে তিনি সাহায্য করবেন রবিবাসরীয় নিউইয়র্ক

টাইমসের ডাকটিকেট বিভাগের সম্পাদককে তিনি মি, মাহমুদ আলীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে  দেন। অতঃপর তিনজনে মিলে আলােচনা করে নিম্নে উল্লিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন : ১. মি. মাহমুদ আলী নিউইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশিয়ায় নিয়ােজিত সংবাদদাতা সিডনি শানবার্গের (Sydney Schanberg) সঙ্গে যােগাযােগ করে মুজিবনগর’ এবং বাংলাদেশের – মুক্তাঞ্চলে নতুন ডাকটিকেট প্রকাশ সম্পর্কিত সংবাদ সংগ্রহ করে পাঠাবার জন্য অনুরােধ করবেন, ২. ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ ডাকটিকেটের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের সংবাদ পাঠাবেন নিউইয়র্ক টাইমসের লন্ডন সংবাদদাতা এবং ৩, সর্বশেষে ডাকটিকেট বিভাগের – সম্পাদক রবিবাসরীয় সংখ্যায় বাংলাদেশ ডাকটিকেট সম্পর্কে আলােচনা ও মতামত প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। উল্লিখিত পরিকল্পনা অনুযায়ী সংগৃহীত বিভিন্ন সংবাদ এবং ডেভিড লিড়ম্যানের (David Lidman) প্রতিবেদন ১৯৭১ সালের ৮ আগস্ট নিউইয়র্ক টাইমসের রবিবাসরীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য সংবাদপত্রেও বাংলাদেশ ডাকটিকেট সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওয়াশিংটনের ‘ইভিনিং স্টার পত্রিকার সংবাদদাতা হেনরি ব্র্যাড়শ (Henry Bradshaw) প্রদত্ত সংবাদ ২৭ জুলাই প্রকাশিত হয়। এই সঙ্গে ৮টি ডাকটিকেটের ফ্যাক্সিমিলিও ছাপানাে হয়। তাছাড়া বহুল প্রচারিত মার্কিন সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নিউজউইক’-এর ৯ আগস্ট সংখ্যায় ‘রিবেল স্ট্যাম্প’ (Rebel Stamp) শিরােনাম দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। মি. স্টোনহাউস তার স্মৃতিচারণমূলক বইতে বলেন, বাংলাদেশ ডাকটিকেট এবং ‘ফার্স্ট ডে কভারগুলাে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফিলাটেলিস্ট, সরকার ও সংবাদপত্রের দপ্তরে পৌঁছানাের ফলে এক বিপুল আলােড়ন সৃষ্টি হয়। ইন্টারন্যাশনাল পােস্টাল ইউনিয়নের সদর দপ্তরে পেশ করা এক অভিযােগে পাকিস্তান দাবি করে, ডাকটিকেটগুলাে বেআইনি বলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার যােগ্য নয়। কিন্তু মুক্তাঞ্চল থেকে বাংলাদেশ ডাকটিকেট সংবলিত চিঠি বিদেশের বিভিন্ন ঠিকানায় পাঠানাের প্রমাণ হাজির করে মুজিবনগর সরকার পাকিস্তানের অভিযােগ উপেক্ষা করে। বাংলাদেশের ডাকটিকেট ব্যবহার করে মুক্তাঞ্চল থেকে পাঠানাে বহু চিঠিপত্র বিদেশে বিলি করা হয়। আন্তর্জাতিক বিমান ডাকযােগে মি. স্টোনহাউসের নামে পাঠানাে চিঠি হাউস অব কমন্সের নিজস্ব পােস্ট অফিসের সিলমােহরাঙ্কিত হয়ে তার হাতে পৌঁছায়।

বিজয় দিবসের ৪ দিন পর (২০ ডিসেম্বর, ১৯৭১) দশ পয়সা, পাঁচ টাকা ও দশ টাকা মূল্যের ডাকটিকেটগুলাের ওপর ‘Bangla Desh Liberated’ ও বাংলা দেশের মুক্তি শব্দগুলাে ছাপিয়ে বাজারে ছাড়া হয়।৬৫  উল্লিখিত পত্রিকার একই সংখ্যায় বলা হয়, ১ ফেব্রুয়ারি (১৯৭২) বাংলাদেশ ডাকটিকেটের দ্বিতীয় সিরিজে মােট ১৫টি টিকেট বাজারে ছাড়া হয়। এই টিকেটগুলাের মূল্য ছিল যথাক্রমে ১ পয়সা, ২ পয়সা, ৩ পয়সা, ৫ পয়সা, ৭ পয়সা, ১০ পয়সা, ১৫ পয়সা, ২০ পয়সা, ২৫ পয়সা, ৪০ পয়সা, ৫০ পয়সা, ৭৫ পয়সা, ১ টাকা, ২ টাকা ও ৫ টাকা। বিমান মল্লিকের আঁকা প্রথম সিরিজের ৮টি ডিজাইনের তিনটি (১০ পয়সা, ২০। পয়সা ও ৫০ পয়সা) দ্বিতীয় সিরিজের ১৫টি টিকেট ব্যবহার করা হয়। তাঁর মূল। ডিজাইনগুলােতে বাংলা দেশ’ কথাটি দুটি শব্দে বিভক্ত ছিল। দ্বিতীয় সিরিজের টিকেটে বাংলাদেশ এক শব্দ হিসেবে দেখানাে হয়। অতএব, ভিন্ন অক্ষর বিন্যাসের প্রয়ােজন হয়। অক্ষর বিন্যাস এবং এই অংশে রঙের ব্যবহার ছিল ত্রুটিপূর্ণ। বিমান মল্লিক বলেন, এ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। কেউ তার অনুমতিও গ্রহণ করেন নি। তার শিল্পকর্মকে এভাবে বিকৃত করার জন্য তিনি অত্যন্ত মনােক্ষুন্ন হন।  ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ বাংলাদেশ অবজারভার’-এ প্রকাশিত এক পত্রে কলকাতা থেকে এস কে চৌধুরী ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত প্রথম সিরিজের ডাকটিকেটগুলাের প্রশংসা করে বলেন, দ্বিতীয় সিরিজের ডাকটিকেটগুলাের ডিজাইন ত্রুটিপূর্ণ এবং রঙ নির্বাচনে সৌন্দর্যবােধের অভাব পীড়াদায়ক। তাছাড়া ইংরেজি ও বাংলা অক্ষরগুলাে অবিন্যস্ত বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। পত্রলেখক আরও বলেন, পরবর্তীকালে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ২০ পয়সা মূল্যের শহীদ স্মরণে’ শীর্ষক ডাকটিকেটটির নকশা দেখে তিনি সবচেয়ে বেশি হতাশ হয়েছেন।৬৬

লন্ডনের স্ট্যাম্প কালেক্টিং’ (Stamp Collecting) পত্রিকার ২৭ জুলাই (১৯৭২) সংখ্যায় ডাকটিকেট সম্পর্কিত ভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ উল্লেখ করে বলা হয়, বাংলাদেশ পােস্ট অফিসের ডাইরেক্টর-জেনারেল এ এম আহসানউল্লাহ এবং পােস্টমাস্টার জেনারেল ফরিদউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ ডাকটিকেটের দ্বিতীয় সিরিজের দায়দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন। তাঁরা বলেন, ডাকটিকেটের নকশা সম্পর্কে ঢাকায় অধিষ্ঠিত সরকারের অনুমােদন গ্রহণ না করেই ডাকটিকেটগুলাে ছাপিয়ে বিশ্বের বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হয়। যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম ডাকটিকেট সংগ্রহকারী ও বিক্রেতা স্টানলি গিবন্-এর (Stanely Gibbone) পক্ষ থেকে বলা হয়, ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত ডাকটিকেটের দ্বিতীয় সিরিজ বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্রহণযােগ্য নয় বলে ডাকটিকেট হিসেবে তা মূল্যহীন।  বিতর্কিত ডাকটিকেটগুলাের প্রকাশক বাংলাদেশ ফিলাটেলিক এজেন্সির পক্ষ থেকে প্রচারিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর প্রথম সিরিজের তিনটি টিকেটের ওপর ‘Bangla Desh Liberated’ এবং বাংলা দেশের মুক্তি’ ছাপানাের পর বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ১৫টি টিকেট সংবলিত দ্বিতীয় সিরিজ ছাপানাের লিখিত অনুমতি দেন। ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে তৎকালীন পােস্ট মাস্টার জেনারেল এ, আকন (A. Akon) নির্দিষ্টসংখ্যক টিকেট ছাপানাের লিখিত নির্দেশ দেন। পরবর্তী ফেব্রুয়ারি মাসে টিকেটগুলাে ঢাকায় সরবরাহ করা হয়। ইতােমধ্যে ঢাকায় বিবিধ রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে মি. আকনকে সরিয়ে দিয়ে নতুন ডাইরেক্টর-জেনারেল নিয়ােগ করা হয়। স্বাধীনতা অর্জনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কোনাে কোনাে ডাকটিকেটের নকশা সম্পর্কে দ্বিমত দেখা দেয়। বাংলাদেশের মানচিত্র সংবলিত ডাকটিকেটটি ছিল এর মধ্যে অন্যতম। ইতােমধ্যে বাংলাদেশের পতাকার জন্য নতুন নকশা গৃহীত হয়। তাছাড়া নতুন রাষ্ট্রের ডাকটিকেটে স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তীকালে আঁকা বিভিন্ন নকশা এবং জাতীয় জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মারক অথবা প্রতীক ব্যবহারের যৌক্তিকতা সম্পর্কেও আলাপ-আলােচনা অব্যাহত ছিল। এসব কারণে দ্বিতীয় সিরিজের টিকেটগুলাে ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

 লন্ডন, ২০ ডিসেম্বর, ১৯৯৯

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি – যুক্তরাজ্য আবদুল মতিন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!