যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ভূমিকা
১৯৮৭ সালের প্রথমদিকে এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আতাউর রহমান খান বলেন, ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ কভেন্ট্রি সম্মেলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুটা সন্দিহান ছিলেন। কারণ, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে তারা অবহিত ছিলেন না। এর ফলে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গাউস খান অস্বস্তি বােধ করেন। কভেন্ট্রি সম্মেলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির পরিবর্তে আঞ্চলিক অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিদের নিয়ে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি না থাকায় আন্দোলনের কর্মপন্থা নির্ধারণের ব্যাপারে এবং কমিটির দৈনন্দিন কার্যকলাপের সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল না। গাউস খানের এলাহাবাদ রেস্তোরার ওপরতলায় স্টিয়ারিং কমিটির জন্য বিনা ভাড়ায় অফিস দেয়ার প্রস্তাব গৃহীত না হওয়ায় তিনি নিরুৎসাহিত বােধ করেন। বিচারপতি চৌধুরী তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন : ‘লন্ডনের বিভেদকে এড়িয়ে ২৫ এপ্রিল এই শহরে সকল দলকে নিয়ে স্টিয়ারিং কমিটির সঙ্গে সহযােগিতার উদ্দেশ্যে একটি কমিটি। গঠন করা সম্ভব হয়। এই সভাতেও আপসের জন্য শেখ আবদুল মান্নানসহ কয়েকজন কর্মী যথেষ্ট পরিশ্রম করেন। সভায় আওয়ামী লীগ নেতা গাউস খান সভাপতি, মিনহাজউদ্দিন। সহ-সভাপতি এবং ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হােসেন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। প্রথমে মিনহাজউদ্দিনের নাম সভাপতিরূপে প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু শেখ আবদুল মান্নান এবং আরাে কয়েকজন বাঙালি নেতার অনুরােধে মিনহাজউদ্দিন সহ-সভাপতি হতে সম্মত হন।১৫৫ শেখ মান্নান লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ২৪ এপ্রিল কভেন্ট্রি সম্মেলন থেকে কোচযােগে লন্ডন থেকে ফিরে আসার পথে তিনি কাউন্সিল ফর দি রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন দি ইউ কে ভেঙে দিয়ে লন্ডন এলাকার জন্য নবগঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির এক শাখা কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাব অনুযায়ী ২৬ এপ্রিল পূর্ব লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক সভায় আপসের মনােভাব নিয়ে গাউস খান অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে লন্ডন অ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ গঠিত হয়।
গাউস খান খুশি হন নি। তিনি আশা করেছিলেন, কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটিতে তার স্থান হবে। শেষ পর্যন্ত তিনি লন্ডন কমিটির প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করতে রাজি হন। ৪ জুন বাংলাদেশ সমর্থক ভারতীয় জননেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের সম্মানার্থে লন্ডন কমিটি একটি চা-চক্রের আয়ােজন করে। এই সমাবেশে লন্ডন কমিটির পক্ষ থেকে গাউস খান এবং স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে শেখ আবদুল মান্নান তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বক্তৃতা করেন। ৬ জুন লন্ডন কমিটির উদ্যোগে পূর্ব লন্ডনে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি চৌধুরী তার স্মৃতিকথায় বলেন : “এই সভায় আমি পুনরায় লক্ষ্য করলাম যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে সম্পূর্ণ নিবেদিত বাঙালিদের মধ্যে তখনও লন্ডন কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে চাপা কোন্দল রয়েছে।১৫৬ স্টিয়ারিং কমিটিকে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ সাংগঠনিক রূপ দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রচেষ্টা চালানাে হয়। এই প্রচেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হয়নি। আওয়ামী লীগের প্রচেষ্টা সফল না হওয়া সত্ত্বেও নীতিগতভাবে কমিটির বিরােধিতা না করে গাউস খান ও তার সহকর্মীরা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী নিজস্ব পন্থায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাঁরা টেলিফোন ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সদস্যদের স্থানীয় পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ করে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ দেয়ার নির্দেশ দেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগে লন্ডনের হাইড পার্ক, ট্রাফালগার স্কোয়ার ও কনওয়ে হল এবং বার্মিংহাম, কার্ডিফ, লুটন, ম্যাঞ্চেস্টার ও অন্যান্য শহরে প্রতিবাদ-সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়া আওয়ামী লীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ-মিছিল হাইড পার্ক থেকে চীন ও মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে স্মারকলিপি পেশ করে। গাউস খান মিছিলের নেতৃত্ব দেন। ১ আগস্ট ট্র্যাফালগার স্কোয়ারে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ”-এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বিরাট জনসভায় গাউস খান উদ্দীপনাময় বক্তৃতা দেন।
আওয়ামী লীগের কর্মতৎপরতার ফলে পাকিস্তান-সমর্থক বাঙালিরা গাউস খান ও আতাউর রহমান খানকে নানা রকম ভীতি প্রদর্শন করে। বাংলাদেশ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ না করলে তাদের রেস্তোরার ক্ষতিসাধন করা হবে, তারা দেশে ফিরতে পারবেন না এবং তাদের দেশের আত্মীয়-স্বজনকে খতম করা হবে ইত্যাদি নানা ধরনের ভীতি প্রদর্শন করা সত্ত্বেও তারা আন্দোলন পরিত্যাগ করেন নি। ভীতি প্রদর্শনকারীদের মধ্যে পাকিস্তানপন্থী বাঙালিদের চিনতে পেরেছলেন বলে আতাউর রহমান খান বলেন। আতাউর রহমান খানের সঙ্গে ব্যক্তিগত যােগাযােগের ফলে সেন্ট্রাল লন্ডন পলিটেকনিকের ডাইরেক্টর কলিন এ্যাডামস বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগের প্রায় সকল বৈঠক ও সভায় তিনি যােগদান করেন। তাছাড়া আওয়ামী লীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত প্রকাশ্য সভার জন্য বিনা ভাড়ায় পলিটেকনিকের মিলনায়তন ব্যবহার করার অনুমতিও তিনি দেন। আন্দোলনের প্রথম দিকে আতাউর রহমান খান শ্রমিকদলীয় সদস্য ব্রুস ডগলাসম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সাহায্য করার অনুরােধ জানান। কিছুকাল পর পূর্ব লন্ডনে বসবাসকারী আবদুল মালেকের সহায়তায় যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ প্রভাবশালী শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শােরের (পরবর্তীকালে লর্ড শাের) সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ স্থাপন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অকপট সমর্থক মি, শাের লন্ডনের যে এলাকা থেকে নির্বাচিত হন, সে এলাকায় বহুসংখ্যক বাঙালি বসবাস করেন। মি. মালেকও সেই এলাকার পুরনাে অধিবাসী। ১৯৮৪ সালে গৃহীত এক সাক্ষাৎকারে মি, মালেক বলেন, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে পিটার শােরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তিনি উদ্যোগী হন। এ সম্পর্কে আলােচনা করার জন্য ব্যারিস্টার রুহুল আমিনের সহায়তায় এক বৈঠকের আয়ােজন করা হয়। তাঁর বাড়িতে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে যােগদানকারীদের মধ্যে ছিলেন গাউস খান, তৈয়েবুর রহমান, মিম্বর আলী, আতাউর রহমান খান ও আবদুল মালেক। এই বৈঠকে পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সরাসরি যােগাযােগ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
মি. মালেক এ ব্যাপারে মি, শশারের সঙ্গে প্রাথমিক আলােচনার Tদায়িত্ব গ্রহণ করেন। সপ্তাহখানেক পর প্যাডিংটন স্ট্রিটে আতাউর রহমান খানের ‘রাজদূত’ রেস্তোরায় মি. শােরের সঙ্গে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে আওয়ামী লীগের ১৫/১৬ জন নেতাকর্মী যােগদান করেন। বাংলাদেশ থেকে সদ্য আগত আওয়ামী লীগ দলীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আবদুল মান্নানও (ছানু মিয়া) এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বিস্তারিত আলাপ-আলােচনার পর আওয়ামী লীগের অনুরােধ অনুযায়ী মি. শাের বাংলাদেশের স্বাধানতা আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সপ্তাহ দুয়েক পর মি. শাের বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করার জন্য হাউস অব কমন্সে একটি সভার আয়ােজন করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলভুক্ত পার্লামেন্ট সদস্য এই সভায় যােগ দেন। গাউস খান, পিটার শাের এবং আরাে কয়েকজন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে বক্তৃতা করেন। ভারতের প্রাক্তন দেশরক্ষা মন্ত্রী মি. কৃষ্ণমেনন আগস্ট মাসের মাঝামাঝি লন্ডনে আসেন। তিনি আতাউর রহমান খানের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। রাজদূত’ রেস্তোরায় তার সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয় এই বৈঠকের পর গাউস খান তার সম্মানার্থে এক ঘরােয়া ভােজসভার আয়ােজন করেন। | লন্ডনে নিয়ােজিত ভারতীয় হাই কমিশনার আপা পন্থ গাউস খানের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ স্থাপন করেন। তাঁর সঙ্গে মি. খানের সাক্ষাৎকালে তৈয়েবুর রহমান, ম্যাঞ্চেস্টারের আবদুল মতিন ও বার্মিংহামের এ কে এম হক উপস্থিত ছিলেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার যােগাযােগ ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল বলে আওয়ামী লীগ মহল প্রকাশ করে।
লন্ডনে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা সংস্থার প্রতিনিধি এবং লন্ডন থেকে প্রকাশিত ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘ইন্ডিয়া উইকলি’র প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ড. তারাপদ বসু যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি আওয়ামী লীগকে নানাভাবে সাহায্য করেন। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম (পরবর্তীকালে লর্ড হিউম) পার্লামেন্টে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, ব্রিটিশ সরকার। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। প্রবাসী বাঙালিরা তার এই মন্তব্যে মর্মাহত হন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মােহাম্মদ ইসহাক ও কয়েকজন নেতৃস্থানীয় বাঙালি ছাত্র তকালীন রক্ষণশীল দলীয় (টোরি) পার্লামেন্ট সদস্য কুইনটিন হগের (পরবর্তীকালে লর্ড হেইলশ্যাম) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে স্যার আলেক ডগলাস হিউমকে এই উক্তি প্রত্যাহারে রাজি করানাের জন্য অনুরােধ করেন। অন্যান্য মহল থেকেও তাকে এ ধরনের অনুরােধ জানানাে হয়। কিছুকাল পর স্যার আলেক বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয় বলে ঘােষণা করেন। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা আবদুস সামাদ আজাদ জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে নিউইয়র্কের পথে রওনা হয়ে লন্ডনে পৌঁছান। স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রবাসী বাঙালি ও তাদের সমর্থকদের অবহিত করার উদ্দেশ্যে লন্ডনের রুমসবারি হােটেলে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ আয়ােজিত এক সভায় মি, আজাদ বক্তৃতা করেন। গাউস খান এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। এরপর মি. আজাদ ইংল্যান্ডের কয়েকটি শহরে আওয়ামী লীগ আয়ােজিত জনসভায় বক্তৃতা করেন। বাংলাদেশ পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্পর্কে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের সরকারি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার জন্য ব্যাপক সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ২৯ অক্টোবর লন্ডনে পৌঁছান। লন্ডনে অবস্থানকালে তাঁর সঙ্গে গাউস খানের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। এই সাক্ষাৎকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে আওয়ামী লীগ মহল মনে করে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি – যুক্তরাজ্য – আবদুল মতিন