You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ লন্ডনে অনুষ্ঠিত বাঙালি ছাত্রদের সর্বদলীয় এক বিরাট সভায় বিস্তারিত আলােচনার পর ১১-সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি (বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ) গঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠান গঠিত হওয়ার এক সপ্তাহ আগে (২৮ ফেব্রুয়ারি) সংগ্রামী ছাত্ররা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে লন্ডন আওয়ামী লীগ আয়ােজিত বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে যােগদান করে। ১ থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত বাঙালি ছাত্ররা লাউন্ডস্ স্কোয়ারে অবস্থিত পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে ২৪-ঘণ্টা অবস্থান-ধর্মঘট করে সামরিক কর্তৃপক্ষের দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ৭ মার্চ যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ আহূত এক প্রতিবাদ-মিছিলে হাজার হাজার বাঙালি জনসাধারণের সঙ্গে ছাত্ররাও যােগ দেয়। আন্দোলনের প্রথমদিকে ছাত্ররা দলে দলে বিভক্ত হয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে (১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বার্মার (মায়ানমার) দূতাবাসে গিয়ে স্মারকলিপি পেশ করে। তাছাড়া বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও জাতিসংঘের কাছে প্রেরিত তারবার্তায় বাংলাদেশে পাকিস্তান সংঘটিত গণহত্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ করে সংবাদপত্রের কাটিং ও বিভিন্ন তথ্য সংবলিত প্রচারপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। শ্রমিকদলীয় সদস্য পিটার শশারের (পরবর্তীকালে লর্ড শাের) সঙ্গে ছাত্র প্রতিনিধিদের দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের পর তিনি শেখ মুজিবের শারীরিক নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এরপর থেকে জন স্টোনহাউস, ক্ৰস্ ডগলাসম্যান, ফ্রেড ইভান্স, টোবি জ্যাসেল এবং আরাে অনেক পার্লামেন্ট সদস্য বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করে সর্বপ্রকার সাহায্যের আশ্বাস দেন। পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগকালে ছাত্র প্রতিনিধিরা জোর দিয়ে বলেন, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনাে ব্যবস্থা বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য হবে না। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটরদের সঙ্গেও যােগাযােগ স্থাপন করে। পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্যদান স্থগিত রাখার জন্য ১৯৬১ সালের বৈদেশিক সাহায্যদান আইনের সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপনকারী সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি ও ফ্রাঙ্ক চার্চের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করা হয়।

জুলাই মাসের শেষদিকে লন্ডনে আমেরিকান বার অ্যাসােসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনে যােগদানকারী আইনজীবীদের বাংলাদেশ সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করা হয় এবং সেই সঙ্গে মানবতার খাতিরে বাংলাদেশকে সাহায্যের আবেদন জানানাে হয়। আমেরিকায় ফিরে গিয়ে বহু আইনজীবী তাদের এলাকার সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে যােগাযােগ করে বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য চাপ দেন। সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে স্বাধীনতা সগ্রামের ছ’মাস পূর্তি উপলক্ষে হাইড পার্কে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের কনভেনার মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তৃতাদানকারীদের মধ্যে ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ, সৈয়দ আবদুস সুলতান, ড. আসাবুল হক এবং ফনিভূষণ মজুমদার। ১৯৭১ সালের ৩০ অক্টোবর লন্ডনের হেনরি থর্নটন স্কুলে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয় ছাত্র সম্মেলনে সংগ্রাম পরিষদের প্রথম আট মাসের কার্যবিবরণী পেশ করা হয়। কার্যবিবরণীতে বলা হয়, পরিষদের উদ্যোগে বিভিন্ন উপলক্ষে প্রকাশিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি ছাড়াও মােট ২০টি তথ্য-বিজ্ঞপ্তি ও পাঁচটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে মুক্তি সংগ্রামের প্রথম ছ’মাস’ শীর্ষক পুস্তিকাটি অন্যতম। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের “পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ” শীর্ষক ঘােষণা পুস্তিকা হিসেবে প্রকাশ করা হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে লন্ডনের দৈনিক সংবাদপত্রগুলােতে মােট চারটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। ২৩ মার্চ ‘দি টাইমস’-এ, ২৭ মার্চ ও ২০ জুলাই “দি গার্ডিয়ান’-এ এবং ১৬ আগস্ট ‘দি টাইমস’-এ বিজ্ঞাপনগুলাে প্রকাশিত হয়। ২০ আগস্টের বিজ্ঞাপনটি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে আমেরিকার বার অ্যাসােসিয়েশনের সদস্যদের প্রতি খােলা চিঠি’ হিসেবে প্রকাশিত হয়। ১৬ আগস্টের বিজ্ঞাপনে পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের গােপন-বিচারের প্রহসন সম্পর্কে বিশ্ব জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এছাড়া আরও একটি বিজ্ঞাপন সাপ্তাহিক জনমত’-এ প্রকাশিত হয়। এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পাকিস্তান হাই কমিশনে নিয়ােজিত বাঙালি অফিসারদের বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের আহ্বান জানানাে হয়। 

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের। বার্ষিক সম্মেলনে ‘লবি’ করার ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে এ্যাবারডিনে অনুষ্ঠিত খনি। শ্রমিকদের সম্মেলনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জ্ঞাপন করে প্রস্তাব পাশ করা হয়। স্কারবারায় অনুষ্ঠিত ট্রান্সপাের্ট ও জেনারেল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলনে যােগদানকারী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার পর ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি জ্যাক জোন্স তাদের জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় বাংলাদেশের সমস্যা সম্পর্কে। আলােচনার প্রতিশ্রুতি দেন। এই ইউনিয়নটি ব্রিটেনের সর্ববৃহৎ (সদস্য-সংখ্যা প্রায় ১৪ লক্ষ) শ্রমিক প্রতিষ্ঠান। শ্রমিক ও উদারনৈতিক দলের বার্ষিক সম্মেলনেও বাংলাদেশের সপক্ষে প্রস্তাব পাশ করা হয়। রক্ষণশীল (টোরি) দলের বহু সদস্য ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও তাদের বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশের সপক্ষে প্রস্তাব গ্রহণের প্রচেষ্টা সফল হয় নি। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সদস্য ইউরােপের অন্যান্য দেশ সফর করে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণা চালান। পরিষদের সদস্য ওয়ালী আশরাফ বাংলাদেশ সরকারের অনুরােধ অনুযায়ী বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যােগদান করেন। হল্যান্ডে সংগঠিত ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’-এর আমন্ত্রণে খােন্দকার মােশাররফ হােসেন ও নজরুল ইসলাম এক সাংবাদিক সম্মেলনে যােগদান করেন। সম্মেলনের পর তারা বেলজিয়াম সফর করেন। পারীতে অনুষ্ঠিত “ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন’-এর সম্মেলনে ‘লবি” করার জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে। ড. এ এইচ প্রামাণিক, নজরুল ইসলাম এবং এ জেড মােহাম্মদ হােসেনকে পাঠানাে হয়। মােট ৭০টি দেশের প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে যােগদান করেন।

সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার পর সম্মেলনে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি প্রস্তাব পাশ করা হয়। রুমানিয়ায় বিজ্ঞান ও বিশ্ব শান্তি’ সম্পর্কে অনুষ্ঠিত ‘পাগওয়াস’ সম্মেলনে ‘বি’ করার জন্য স্টিয়ারিং কমিটির অনুরােধে এ জেড মােহাম্মদ হােসেনকে পাঠানাে হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের সহায়তায় স্ক্যান্ডিনেভিয়া, পশ্চিম জার্মানি, বেলজিয়াম ও ফ্রান্সে বাংলাদেশ আন্দোলনে সমর্থনকারী প্রতিষ্ঠান গঠন করা সম্ভব হয়। সংগ্রাম পরিষদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও গাল্ফ স্টেটে বসবাসরত বাঙালিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করে। ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে সংগঠিত বাংলাদেশে অ্যাকশন কমিটিগুলাের সময়ে একটি কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটি গঠনের জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রাথমিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই উদ্দেশ্যে ১৯ মার্চ এক সভার আয়ােজন করা হয়; কিন্তু গুরুতর মতানৈক্যের ফলে। কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা সম্ভব হয় নি। ছাত্রদের উদ্যোগে বেশ কয়েকটি বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের। উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভেও তারা যােগদান করেন। লন্ডনে সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত যে সভায়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও পার্লামেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউস বক্তৃতা করেন, সেই সভা ছাত্রদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের বিরুদ্ধেও ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবিতে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সদস্য শামসুদ্দীন চৌধুরী (মানিক) ও আফরােজ আফগান ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের নিকটবর্তী। ফুটপাতে অনশন পালন করেন। পাকিস্তানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র প্রেরণের প্রতিবাদে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য আবদুল হাই খান ও মিসেস রাজিয়া চৌধুরী লন্ডনে। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে অনশন পালন করেন। বিচারপতি চৌধুরীর অনুরােধক্রমে তারা অনশন প্রত্যাহার করেন। ২৫ মার্চ ছাত্রদের একটি বিরাট দল লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে বিক্ষোভরত বহুসংখ্যক বাঙালির সঙ্গে যােগদান করেন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি – যুক্তরাজ্য আবদুল মতিন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!