You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.01 | বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি

১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের নবনির্বাচিত গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রস্তাবিত অধিবেশন স্থগিত রাখার ঘােষণা জারি করেন। যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাঙালিরা ইয়াহিয়া খানের অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ১৪ মার্চ লন্ডনে এক গণসমাবেশের আয়ােজন করে। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগে হাইড পার্কে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে ১০ হাজারেরও বেশি বাঙালি যােগদান করে। হাইড পার্ক থেকে বিক্ষোভকারীরা যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি গাউস খানের নেতৃত্বে লাউডস স্কোয়ারে অবস্থিত পাকিস্তান হাই কমিশনে গিয়ে পূর্ব বাংলার দাবি সংবলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করে। এই সমাবেশের পর প্রবাসী বাঙালিদের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি পায়। কয়েক দিনের মধ্যে তারা প্রায় ১৫টি শহরে ‘অ্যাকশন কমিটি গঠন করে। এই শহরগুলাের মধ্যে ছিল লন্ডন, বার্মিংহাম, ম্যাঞ্চেস্টার, লিডস ও ব্র্যাডফোর্ড। ইতঃপূর্বে বার্মিংহামে সংগঠিত পূর্ব পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি নাম গ্রহণ করে। এই কমিটি বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের বীভৎস হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই কমিটির উদ্যোগে ২১ মার্চ বার্মিংহামে একটি গণসমাবেশের আয়ােজন করা হয়। এই  সমাবেশে ৭ হাজারেরও বেশি বাঙালি ও তাদের দাবির সমর্থকরা যােগদান করেন। ২৬ মার্চের পর বিভিন্ন পেশাজীবী এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে উৎসাহী ব্যক্তিরাও নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলেন। এদের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ স্টুডেন্টস্ অ্যাকশন কমিটি (ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ), বাংলাদেশ উইমেন্স অ্যাসােসিয়েশন (মহিলা সমিতি), বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসােসিয়েশন, অ্যাকশন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ এবং ওমেগা।১২৮

২৬ মার্চ সন্ধ্যার পর পাকিস্তান স্টুডেন্টস্ হােস্টেলে অনুষ্ঠিত এক জরুরি সভার পর আহমদ হােসেন জোয়ারদার (এ এইচ জোয়ারদার) কয়েকজন সঙ্গীসহ দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের ২৪ নম্বর থােম হাই স্ট্রিটে বি এইচ তালুকদারের কুলাউড়া’ তন্দুরি রেস্তোরার উপরতলায় অনুষ্ঠিত এক সভায় যােগ দেন। পূর্ব বঙ্গ পরিস্থিতি সম্পর্কে সভায় আলাপআলােচনার পর মি, তালুকদারের নেতৃত্বে স্ট্রেথম অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয়। কমিটির উৎসাহী সদস্যদের মধ্যে ছিলেন নুরুল হক চৌধুরী, এ এইচ জোয়ারদার, সােহেল ইবনে আজিজ, নৃপেন্দ্রনাথ ঘােষ, মােহাম্মদ রফিক এবং এ ইসলাম। মি, তালুকদার রেস্তোরার ওপরতলা বিনা ভাড়ায় অ্যাকশন কমিটির অফিস হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি স্রেথাম কমিটির নেতৃবৃন্দ বার্মিংহাম, ম্যাঞ্চেস্টার ইত্যাদি অঞ্চলে গিয়েও অন্য বাঙালিদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করেন। এই কমিটির একটি নিজস্ব ফান্ড ছিল। ফান্ডের। ট্রাস্টিদের মধ্যে ছিলেন রিচার্ড ক্রসম্যান (পরবর্তীকালে শ্রমিকদলীয় মন্ত্রী), লর্ড গিফোর্ড ও বিশপ ট্রেভর হাড়লস্টোনের মতাে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এই ফান্ড থেকে তারা ৫০০ পাউন্ড মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে বাঙালি শরণার্থীদের জন্য পাঠিয়েছেন বলে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে জানিয়েছেন। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে কুলাউড়া’ তন্দুরি রেস্তোরায় অনুষ্ঠিত বাঙালিদের বৈঠকে বিচারপতি চৌধুরী যােগদান করেন।

১৯৭১ সালের শেষদিকে স্ট্রেথাম কমিটির উদ্যোগে লন্ডনের কনওয়ে হলে একটি বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি চৌধুরী এই সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যােগ দেন। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন পিটার শাের (এম পি), ক্রস ডগলাসম্যান (এম পি), লর্ড গিফোর্ড, লর্ড ব্রকওয়ে এবং অধ্যাপক রেহমান সােবহান। | স্ট্রেথাম কমিটির প্রচার সম্পাদক নুরুল হক চৌধুরী রচিত “বাংলাদেশ ফাইটস ফর ফ্রিডম’ (Bangladesh Fights for Freedom) শীর্ষক একটি ইংরেজি পুস্তিকা কমিটির উদ্যোগে প্রকাশিত হয়। বিচারপতি চৌধুরী তার ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। | লন্ডনে স্মৃতিচারণ উপলক্ষে এ এইচ জোয়ারদার বলেন, মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে প্রচারিত হােয়াই বাংলাদেশ (Why Bangladesh?) শীর্ষক একটি পুস্তিকার হাজার হাজার কপি ছাপিয়ে স্ট্রেথম অ্যাকশন কমিটি যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় বিতরণের ব্যবস্থা করে। তিনি আরও বলেন, বিলেতে কর্মরত সাধারণ বাঙালিরা ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের জন্য মুক্তহস্তে দান করেন। রেস্তোরাঁর কর্মীরা অনেকেই তাঁদের সাপ্তাহিক বেতনের প্যাকেট দান করেন। কমিটির উদ্যোগে হাইড পার্ক, ট্রাফালগার স্কোয়ার এবং আরাে কয়েকটি জায়গায় জনসভার আয়ােজন করা হয়। আসন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালিদের কর্মপন্থা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে লন্ডনের বিভিন্ন এলাকায় অনেকগুলাে সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধি এবং উৎসাহী ব্যক্তিরা এসব সভায় যােগ দেন। হাইবারি হিলে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান হাউস, গাউস খানের ‘এলাহাবাদ’ রেস্তোরাঁ, মতিউর রহমান চৌধুরীর ‘দিলশাদ’ রেস্তোরাঁ, ফোর্ডহাম স্ট্রিটে পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার অ্যাসােসিয়েশনের অফিস এবং ছাত্রদের বিভিন্ন আস্তানায় সভাগুলাে অনুষ্ঠিত হয়। 

২৬ মার্চ হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন এ করে যৌথ নেতৃত্বদানের প্রয়ােজন তীব্রভাবে অনুভূত হয়। এই উদ্দেশ্যে একটি বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান গঠনের জন্য ২৯ মার্চ (সােমবার) লন্ডনের পােল্যান্ড স্ট্রিটে অবস্থিত মহাঋষি রেস্তোরায় একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ আলাপ-আলােচনার পর বিভিন্ন এলাকার প্রতিনিধিদের নিয়ে কাউন্সিল ফল দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন দি ইউ কে’ শীর্ষক একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। গাউস খান এই কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। উইন্ডমিল স্ট্রিটে অবস্থিত ‘লাক্ষী রেস্তোরার মালিক শওকত আলী তার রেস্তোরার দুটি রুম বিনা ভাড়ায় কমিটির অফিস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য দেন। তাছাড়া অফিসের কাজে বিনা খরচে একটি টেলিফোন ব্যবহার করার অনুমতি দেন। | কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা লন্ডনের বাইরের কমিটিগুলাের সঙ্গে যােগাযােগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হােসেন কভেন্ট্রি ও বার্মিংহামসহ মিডল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে যান শেখ আবদুল মান্নান ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকা এবং লন্ডনের চারপাশের শহরে যেসব কমিটি ছিল তাদের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। গাউস খান নিজে ল্যাঙ্কাশায়ার ও ইয়র্কশায়ারসহ উত্তরাঞ্চলের কমিটিগুলাের সঙ্গে যােগাযােগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।১৩৩  যুক্তরাজ্যের প্রায় প্রত্যেকটি অ্যাকশন কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্ব মেনে নিয়ে অনুমােদন গ্রহণ করে। কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনে বি এইচ তালুকদারের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি অনুমােদন গ্রহণের বিরােধিতা করে। মি. তালুকদার গাউস খানের নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি হন নি। আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে তার মত পরিবর্তন করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির পাঁচজন সদস্যসহ শেখ আবদুল মান্নান মি. তালুকদারের বাড়িতে গিয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। আলােচনাকালে তাঁর সহকর্মী নুরুল হক চৌধুরী, সােহেল ইবনে আজিজ এবং আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। তিনি তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। কিছুতেই তিনি গাউস খানের নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি হন নি।  বার্মিংহামের দুটি কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্ব মেনে নেয়া সত্ত্বেও গাউস খানের নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি হয় নি এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। এই দুটি কমিটির মধ্যে জগলুল পাশা ও আজিজুল হক ভূঁইয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত কমিটি সদস্য-সংখ্যার বিচারে লন্ডনের পর দ্বিতীয় স্থান দখল করে। মি. পাশা ও মি. ভূঁইয়া যথাক্রমে এই কমিটির প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি ছিলেন। তােজাম্মেল হক অপর কমিটির নেতা ছিলেন।

স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কিত কার্যকলাপে উভয় কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে পূর্ণ সহযােগিতা করে।  লন্ডনের অন্যান্য কমিটি কোনাে কোনাে ব্যাপারে কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে দ্বিমত পােষণ করে। গাউস খান ও শেখ মান্নান পূর্ব লন্ডনে গিয়ে মতিউর রহমান চৌধুরী, মিম্বর আলী, শামসুর রহমান ও অন্য স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে এক সঙ্গে কাজ করার আবেদন জানান। তারা বলেন, আপনারা কাজ চালিয়ে যান। যখনই ডাক আসবে তখনই তারা বৃহত্তর কমিটির সঙ্গে কাজ করবেন। তারা আশা করেন, কেন্দ্রীয় কমিটিতে যাদের প্রতিনিধিত্ব নেই, তাদের প্রতিনিধি নেয়া হবে। আপাতত বৃহত্তর কমিটির ডাকে যতাে শশাভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল ও জনসভা হবে তাতে তাঁরা যােগ দেবেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচারপত্র, দেয়ালপত্র ও পুস্তিকা বিলি করার ব্যাপারেও তারা সাহায্য করবেন। ইতােমধ্যে বৃহত্তর কমিটির পক্ষ থেকে একটি নির্দেশনামার মাধ্যমে স্থানীয় অ্যাকশন কমিটিগুলােকে জানিয়ে দেয়া হয়, তারা যেন অবিলম্বে স্থানীয় অধিবাসী এবং এমপিদের সঙ্গে যােগাযােগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবির প্রতি তাদের সমর্থন আদায় ও প্রয়ােজনবােধে শােভাযাত্রা ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করে।৩৪। ২৩ এপ্রিল পূর্ব লন্ডনের আর্টিলারি প্যাসেজে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিরা একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্দেশ্যে পরদিন (২৪ এপ্রিল) কভেন্ট্রি শহরে একটি প্রতিনিধি সম্মেলনের আয়ােজন করেন। এই সম্মেলনে গঠিত অ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন দি ইউ কে নামের প্রতিষ্ঠানের কার্য পরিচালনা জন্য ৫-সদস্যবিশিষ্ট একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। স্টিয়ারিং কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকে আজিজুল হক ভূঁইয়া কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। তাঁর পক্ষে যথেষ্ট সময় দেয়া সম্ভব না হওয়ায় কিছুকাল পর শেখ আবদুল মান্নান কমিটির আহবায়ক এবং অফিস পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কভেন্ট্রি সম্মেলন থেকে কোচযােগে লন্ডনে ফিরে আসার পথে শেখ আবদুল মান্নান কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন দি ইউ কে ভেঙে দিয়ে বৃহত্তর লন্ডন এলাকার জন্য কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটির একটি শাখা গঠনের প্রস্তাব করেন।

এই প্রস্তাব অনুযায়ী ২৬ এপ্রিল পূর্ব লন্ডনের হ্যাসেল স্ট্রিটে অনুষ্ঠিত এক সভায় ‘লন্ডন অ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ” গঠিত হয়। গাউস খান ও ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হােসেন যথাক্রমে এই কমিটির প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। কিছুকাল পর লন্ডন অ্যাকশন কমিটি একটি সংবিধান প্রণয়ন করে গ্রেটার লন্ডন নাম গ্রহণ করে। সংবিধান প্রণয়ন করার পর বিভিন্ন কারণে কমিটির সদস্যদের মধ্যে উৎসাহের অভাব দেখা দেয়। সাখাওয়াত হােসেন সেক্রেটারি পদ থেকে ইস্তফা দেন। আমীর আলীও কমিটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।১৩৫ স্টিয়ারিং কমিটির প্রধান দুটি দায়িত্ব ছিল : ক. প্রবাসে স্বাধীনতা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এবং খ, বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটিকে সংঘবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে একটি প্রতিনিধিমূলক কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা। স্টিয়ারিং কমিটির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক শেখ আবদুল মান্নান বলেন : “আমাদের প্রথম দায়িত্ব সাফল্যজনকভাবে আমরা পালন করেছি। কিন্তু দ্বিতীয় দায়িত্ব পালনে আমরা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছি। এজন্য বিচারপতি চৌধুরী বিরূপ সমালােচনার সম্মুখীন হন। তিনি ছিলেন আমাদের উপদেষ্টা। স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমিও ব্যক্তিগতভাবে সমালােচিত হয়েছি। কেউ কেউ এজন্য আমাকে দায়ীও করেছেন। কেন আমরা ব্যর্থ হয়েছি, সে সম্পর্কে একটি ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়ােজন। বিভিন্ন দল ও মতের সমর্থকরা বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে বারবার দেখা করে অবিলম্বে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করার জন্য দাবি জানাচ্ছিলেন। তাদের চিন্তাধারা এবং উদ্দেশ্যের বিভিন্নতা সম্মিলিত আন্দোলনের পরিপন্থী হবে বলে বিচারপতি চৌধুরী আশঙ্কা করেন। কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে অবশ্যম্ভাবী আত্মকলহের ফলে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি যেন দিব্যদৃষ্টিতে দেখেন, বিভিন্ন মতাবলম্বী নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হলে আমরা যে এক জাতি, আমাদের একটাই দাৰি-স্বাধীনতা, তা থাকবে না।’

শেখ আবদুল মান্নান প্রদত্ত তথ্য থেকে জানা যায়, স্টিয়ারিং কমিটির পাঁচজন সদস্য কাজের সুবিধার জন্য আঞ্চলিক নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন। এই অঞ্চলগুলাে ছিল : ক, ইয়র্কশায়ার ও ব্রিটেনের উত্তরাঞ্চল, খ, ল্যাঙ্কাশায়ার, গ, মিডল্যান্ডস এবং ঘ, লন্ডন ও দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ড। এই চার অঞ্চলের চারজন নেতা এবং তাদের প্রত্যেকের একজন সহকর্মী স্টিয়ারিং কমিটির অফিসে অনুষ্ঠিত একাধিক বৈঠকে যােগ দিয়েছেন। আঞ্চলিক নেতাদের মধ্যে ছিলেন এ এম তরফদার, হাজী আবদুল মতিন, জগলুল পাশা ও গাউস খান। কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন সম্পর্কে তাঁরা একমত হতে পারেননি। লন্ডন এলাকার নেতৃবৃন্দ আরও দু’জন আঞ্চলিক প্রতিনিধি নিয়ে স্টিয়ারিং কমিটি পুনর্গঠনের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিদের সম্মেলন। আহ্বান করে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পক্ষপাতী ছিলেন।  স্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা পদে অধিষ্ঠিত বিচারপতি চৌধুরীর কাছে শেখ মান্নান কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন সম্পর্কে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। এই স্মারকলিপিতে তিনি দুটি প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করেন। প্রথম প্রস্তাবে বলা হলাে : গােরিং স্ট্রিটে আঞ্চলিক কমিটির পরবর্তী বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হােক। দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হলাে, স্টিয়ারিং কমিটির পাঁচজন সদস্য এবং আরাে ছয়জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে বর্ধিত স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হােক ছয়জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির নামও তিনি উল্লেখ করেছিলেন। বিচারপতি চৌধুরী শেখ মান্নানের কোনাে প্রস্তাব গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। তিনি বলেন : ‘আমি দিব্য-দৃষ্টিতে দেখছি, আপনি যাদের নামের তালিকা দিয়েছেন, তাদের “কো-অপ্ট’ করার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে অসুবিধার সৃষ্টি হবে এবং কিছুইতে আপনাদের একতা আর থাকবে না। আর আমি কোনাে কাজেই লাগবে না।… ‘প্যাভােরার বাক্স একবার খুলে দেয়া হলে আর বন্ধ করা যাবে না। আপনারা প্যান্ডােরার বাক্স খুলে দেবেন, এটা হবে না।১৩৬ বিচারপতি চৌধুরী আরও বলেন, ইউরােপ ও আমেরিকার যেসব দেশে তিনি গিয়েছেন, সেখানে দেখেছেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি একতাবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ এবং বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলরদের সঙ্গে দেখা করেছেন। আন্দোলনের একটা ইমেজ’ (ভাবমূর্তি) তিনি গড়ে তুলেছেন এবং এই । আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি গঠন করে যারা স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন হাজী আবদুল মতিন (ম্যাঞ্চেস্টার), ড. মােজাম্মেল হক (গ্লাসগাে), বােরহান উদ্দিন (লুটন), দবীর উদ্দিন (সেন্ট অলবান্স), নূর। মােহাম্মদ খান (লেস্টার), আজিজুল হক ভুইয়া, জগলুল পাশা, আফরােজ মিয়া, ইজরাইল। মিয়া ও তােজাম্মেল (টনি) হক (বার্মিংহাম), ড. মাের্শেদ তালুকদার, কাজী মুজিবুর রহমান, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হােসেন ও আতাউর রহমান খান (পশ্চিম লন্ডনের বেজওয়াটার কমিটি), এস এম আইউব (উত্তর লন্ডন), সৈয়দ আবু আহসান ও কায়সারুল ইসলাম (দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের ব্যালহাম কমিটি), বি এইচ তালুকদার, সােহেল ইবনে আজিজ, এ এইচ জোয়ারদার ও নূরুল হক চৌধুরী (দক্ষিণ পশ্চিম লন্ডনের স্রেথম কমিটি), তাসাদুক আহমদ (ওয়েস্টমিনস্টার কমিটি) এবং মিম্বর আলী, শামসুর রহমান, মতিউর রহমান চৌধুরী, ফখরুদ্দিন আহমদ, সিরাজুল হক, জিলুল হক ও তৈয়বুর রহমান (পূর্ব লন্ডনের বিভিন্ন কমিটি)।১৩৭ স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার কিছুকাল পর যুক্তরাজ্যের বাঙালিরা স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনসূচক ব্যাজ, নেকটাই ও টি-শার্ট, বাংলাদেশের পতাকা এবং বিভিন্ন বকম প্রতীক সংবলিত জিনিসপত্র বিক্রি করতে শুরু করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যক্তিগত স্বার্থে কিংবা পকেট ভারি করার জন্য স্বাধীনতা আন্দোলনের সুযােগ গ্রহণ করে। তাছাড়া কোনো কোনাে জিনিসের ডিজাইন ছিল নিম্নমানের এবং দাম রাখা হয়েছিল অত্যধিক। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি স্টিয়ারিং কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দীর্ঘ আলােচনার পর প্রবাসী বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে। সচেতন করার জন্য রুচিসম্মত ব্যাজ, নেকটাইপতাকা ও টি-শার্ট ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ।

স্টিয়ারিং কমিটির অনুমােদন ছাড়া কোনাে জিনিস বাজারে ছাড়া হলে তা না কেনার জন্য কমিটির পক্ষ থেকে জনসাধারণকে অনুরােধ জানানাে হয়। ইতােমধ্যে বাজারে যেসব জিনিস পাওয়া যাচ্ছিল, তার মধ্যে কয়েকটি ব্যাজ ও নেকটাই বিক্রি করার অনুমােদন দেয়া হয়। অন্য কয়েকটি ব্যাজ এবং রিকগনাইজ বাংলাদেশ লেখা টি-শার্ট বিক্রি বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়। ২৫ মার্চের দিবাগত রাত্রের (অর্থাৎ ২৬ মার্চের) হত্যাযজ্ঞের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসী বাঙালি ডাক্তাররা মুক্তিযােদ্ধাদের সরাসরি সাহায্যদানের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসােসিয়েশন’ গঠন করেন এ ব্যাপারে যারা উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ড. আবদুল হাকিম (সভাপতি), ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ড. মােশাররফ হােসেন জোয়ারদার, ড. আহমদ, ড. কাজী ও ড. সাইদুর রহমান। জাফরুল্লাহ চৌধুরী মেডিক্যাল অ্যাসােসিয়েশনের অত্যন্ত উৎসাহী সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুকাল পর তিনি মুজিবনগর’-এ চলে যান। নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। আলাপ-আলােচনার পর তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করে তিনি আহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। অধিকাংশ সময় বিভিন্ন রণাঙ্গনে সেবারত চিকিৎসক হিসেবে কাজ করলেও তিনি দু’একবার খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও লন্ডনে আসেন। স্মৃতিচারণ উপলক্ষে শেখ আবদুল মান্নান বলেন : ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ড. মােশাররফ হােসেন জোয়ারদার এবং তাদের আরাে কয়েকজন সহকর্মী গােরিং স্ট্রিটে। স্টিয়ারিং কমিটির অফিসে এসে জানতে চান, আমাদের কোনাে আর্থিক সঙ্কট আছে কিনা। আমরা বললাম, আর্থিক সঙ্কটের জন্য আমরা বিচারপতি চৌধুরীকে আমেরিকা পাঠাতে পারছি না। তারা বললেন, বিচারপতির বিমান-ভাড়া তারাই দেবেন। মেডিক্যাল অ্যাসােসিয়েশনের সৌজন্যে বিচারপতি চৌধুরীর প্রথম আমেরিকা সফরের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনকালে বিচারপতি চৌধুরীর বিদেশ সফরের খরচ স্টিয়ারিং কমিটির তহবিল থেকে নেয়ার প্রয়ােজন হয় নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাঙালিরা প্রয়ােজনীয় অর্থের ব্যবস্থা করেছেন।৩৯

মুক্তিযুদ্ধকালে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে প্রবাসী বাঙালিদের কর্মতৎপরতা অব্যাহত ছিল। যুক্তরাজ্যে তখন দুটি নতুন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। তার মধ্যে একটি ছিল মােহাম্মদ আলীর উদ্যোগে গঠিত ‘বাংলাদেশ কালচারাল অ্যাসােসিয়েশন’। এরা রাজনৈতিকভাবে স্টিয়ারিং কমিটিকে সাহায্য করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের শিল্প ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তারা চিন্তা-ভাবনা করেছেন। বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ’ নামের অপর প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট ছিলেন এনামুল হক (পরবর্তীকালে ড, এনামুল হক)। তিনি তখন ফোর্ড ফাউন্ডেশনের বৃত্তি নিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য অক্সফোর্ডে গবেষণারত ছিলেন। মুন্নি রহমান ও জেবুন্নেসা খায়ের যথাক্রমে গণসংস্কৃতি সংসদের সম্পাদিকা ও ট্রেজারারের দায়িত্ব পালন করেন। ফাহমিদা হাফিজ এই প্রতিষ্ঠানের উৎসাহী সদস্যা হিসেবে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন।  ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনের রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে ‘গণসংস্কৃতি সংসদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট এনামুল হক রচিত ‘অস্ত্র হাতে তুলে নাও’ শীর্ষক একটি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয়। বিচারপতি চৌধুরী, এই অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী ভাষণ প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের এই বিপ্লবী-আলেখ্য দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করে। ১৬ অক্টোবর ম্যাঞ্চেস্টারের ফ্রি ট্রেড হলে স্থানীয় অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে নৃত্যনাট্যটি মঞ্চস্থ হয়। অক্টোবর মাসের শেষদিকে মিসেস গান্ধীর লন্ডন সফরকালে তাকে সংবর্ধনা জানাবার জন্য আয়ােজিত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপলক্ষেও নৃত্যনাট্যটি। মঞ্চস্থ করা হয়। নৃত্য ও গানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিল শেলী খায়ের, স্বাতী খায়ের, মধু হাফিজ ও সুরাইয়া ইসলাম।১৪০ ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে তরুণ শিক্ষক পল কনেট, তার স্ত্রী এলেন কনেট এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি কোর্সের ছাত্রী মারিয়েটা প্রকোপে বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থনে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামের একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। কিছুকাল পর (সম্ভবত ২০ এপ্রিল) বাংলাদেশ আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ সাহায্যদানের কর্মসূচি তৈরি করার জন্য ক্যালিডােনিয়ান স্ট্রিটে অবস্থিত পিস নিউজ পত্রিকার অফিসে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

এই বৈঠকের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন পল কনেট, মারিয়েটা প্রকোপে ও পত্রিকাটির সম্পাদক। মােট আটটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এই বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে শামসুদ্দীন চৌধুরী (মানিক) ও খােন্দকার মােশাররফ এই বৈঠকে যােগ দেন। কর্মসূচি সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনার পর অ্যাকশন বাংলাদেশ ক্লিয়ারিং হাউস’ নামের একটি সংস্থা গঠন করা হয়। পূর্ব বাংলা থেকে অবিলম্বে পাকিস্তানি সৈন্য প্রত্যাহার এবং বাস্তুহারা বাঙালিদের সাহায্যদানের জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য বলে ঘােষণা করা হয়। মারিয়েটা প্রকোপে এই সংস্থার সচিবের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। আরও কিছুকাল পর পল কনেট ও মারিয়েটার উদ্যোগে অধিকৃত বাংলাদেশে খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধপত্র পৌঁছে দেয়ার জন্য ‘অপারেশন ওমেগা’ নামের একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। লন্ডনের ক্যামডেন এলাকায় মারিয়েটার বাড়িতে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর অফিস স্থাপিত হয়। এখান থেকেই অ্যাকশন বাংলাদেশ ক্লিয়ারিং হাউস’ এবং ‘অপারেশন ওমেগা’র কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি তার উৎসাহের কারণ সম্পর্কে শামসুদ্দীন চৌধুরীর এক প্রশ্নের উত্তরে মারিয়েটা বলেন : “যেখানে একটা পশুশক্তি এভাবে ঝাপিয়ে পড়েছে নিঃসহায় মানুষগুলাের ওপর, সেখানে কি করে অন্য দেশের মানুষ বসে থাকতে পারে। মানুষকে তার দেশ-গােত্রের ভিত্তিতে আলাদা করে দেখাটা মস্ত বড় অন্যায় নয় কি?’

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে আন্দোলনের সমর্থনে অনুষ্ঠিত জনসভা ও মিছিলে পল কনেট ও মারিয়েটা প্রকোপের উপস্থিতি অবধারিত ছিল। পার্লামেন্টে লবি,’ মার্কিন দূতাবাস কিংবা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ মিছিল এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে হাজির থাকার ব্যাপারে তারা কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচয় দেন। অদম্য কর্মপ্রেরণা, মানবিক চেতনাবােধ ও কর্তব্যনিষ্ঠার ফলে তারা প্রবাসী বাঙালিদের শ্রদ্ধা অর্জন করে তাদের আপনজনে পরিণত হন।১৪২ ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে ‘দি টাইমস্ -এ দুটি বড় আকারের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে শেখ আবদুল মান্নান বলেন, স্টিয়ারিং কমিটি এই বিজ্ঞাপনের ব্যয়ভার বহন করে।  ১৩ মে ‘দি টাইমস্ -এর প্রায় এক পৃষ্ঠাব্যাপী বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সৈন্যবাহিনী অপসারণ না করা পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোনাে প্রকার সাহায্যদানে বিরত থাকার জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। এই বিজ্ঞাপনে ব্রিটেনের ১০৬ জন বুদ্ধিজীবী, পার্লামেন্ট সদস্য ও অন্যান্য প্রখ্যাত নাগরিকদের দস্তখত সংযােজিত হয়। উল্লিখিত তারিখে রাত্রিবেলা ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ ও বার্মিংহাম রিলিফ এন্ড অ্যাকশন কমিটি’ একযােগে হাউস অব কমন্সের পার্শ্ববর্তী টেমস নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী আলবার্ট এ্যামব্যাঙ্কমেন্টে ক্যান্ডল-লাইট ভিজিল’-এর (Candle-light Vigil) আয়ােজন করে। ২০ মে থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঔষধ ও খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানাের ব্যাপারে “অ্যাকশন বাংলাদেশ সারা বিশ্বের সহযােগিতা লাভের জন্য কার্যক্রম শুরু করে। ‘অপারেশন ওমেগা ঔষধ ও খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ( ২৭ মে পূর্ববঙ্গে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে দু’জন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দি গাডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ উক্ত বিবরণ পুস্তিকা হিসেবে প্রকাশ করে ব্যাপকভাবে বিতরণের ব্যবস্থা করে। | ১১ জুন ‘দি গার্ডিয়ান’-এ ‘অপারেশন ওমেগার নামে প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপনে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের সাহায্যদানের আবেদন জানিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশের দুর্ভোগ কারাে ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। এ সমস্যা আমাদের সকলের। ১৪ থেকে ১৮ জুনের মধ্যে অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে দশটি বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। লন্ডনে অবস্থিত দশটি দেশের দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের পর পূর্ববঙ্গ পরিস্থিতি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। এই স্মারকলিপিতে বলা হয়, পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্যদান বাংলাদেশের নরহত্যার শামিল।

পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্য না দেয়ার জন্য প্রচারণা চালাবার উদ্দেশ্যে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ১৫ জুন দু’জন এবং ১৯ জুন আরও ৬ জন প্রতিনিধিকে পারীতে লৰি’ করার জন্য পাঠায়।  ২১ জুন পারীতে ‘এইড পাকিস্তান কন্সরশিয়াম”-এর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠক উপলক্ষে অ্যাকশন বাংলাদেশ’ বাঙালিদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একজোট হয়ে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ভবনের সামনে বিক্ষোভের আয়ােজন করে। সেদিন লন্ডন ও বার্মিংহাম থেকে দুটি কোচযােগে প্রায় দেড়শ’ বাঙালি পারীতে গিয়ে হাজির হন। বিকেলবেলা অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে-আসা তিনজন প্রত্যক্ষদর্শী পাকিস্তানি সৈন্যদের নারকীয় অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করেন। ফরাসি সংবাদপত্র কমব্যাট পরের দিন সেসব কাহিনী সবিস্তারে প্রকাশ করে।  ৩০ জুন ‘দি টাইমস-এ প্রকাশিত পুরাে-পৃষ্ঠাব্যাপী এক বিজ্ঞাপনে “অ্যাকশন বাংলাদেশ’ পূর্ববঙ্গে সংঘটিত ‘গণহত্যা’ সম্পর্কে সিকিউরিটি কাউন্সিলের পদক্ষেপ গ্রহণ এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতিদানের দাবি জানায়। [ ৩০ জুলাই ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত পূর্ববঙ্গে গণহত্যা’ শীর্ষক অর্ধ-পৃষ্ঠাব্যাপী এক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১ আগস্ট ট্রাফালগার স্কোয়ারে অ্যাকশন বাংলাদেশ’ আয়ােজিত এক জনসভায় যােগদানের জন্য জনসাধারণকে আহ্বান জানানাে হয়। ট্রাফালগার স্কোয়ারের গণসমাবেশে বক্তৃতাদান প্রসঙ্গে পল কনেট বলেন : ‘বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের পক্ষে রয়েছে বিশ্বের সকল দেশের সকল ধর্মের, সকল বর্ণের মুক্তিকামী মানুষ। এই যুদ্ধ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির যুদ্ধ নয়, এই যুদ্ধ স্বাধীনতা হরণকারীদের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের। আপনাদের এই আদর্শের সংগ্রামের সঙ্গে। আমরা সম্পূর্ণ একাত্মতা ঘােষণা করছি। 

উল্লিখিত গণসমাবেশের একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল ‘অপারেশন ওমেগা’র উদ্যোগে গঠিত “ইন্টারন্যাশনালে পিস্ টিম গৃহীত কর্মসূচির বাস্তবায়ন। পাকিস্তানিদের আক্রমণের ফলে আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ওষুধপত্র ও অন্যান্য সাহায্যসামগ্রী নিয়ে মিসেস এলেন কনেট এবং আরও একজন মহিলা একটি মােটরভ্যানযােগে ট্রাফালগার স্কোয়ার থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হন। ১৫ আগস্ট ট্রাফালগার স্কোয়ারে পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্টের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-বিরােধী সমাবেশের প্রতিবাদে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর সমর্থকরা সেদিন বিকেলবেলা লন্ডনস্থ মার্কিন দূতাবাসের কাছে একটি নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা করেন। ১৬ আগস্টের ‘মর্নিং স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদ-চিত্রে কয়েকজন শাড়ি পরিহিতা বাঙালি মহিলাকে পায়েচলা রাস্তার ওপর শুয়ে থাকতে দেখা যায়। তিনটি গাড়ি বােঝাই সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করে। সৈন্যদের গায়ে ছিল পাকিস্তানি সামরিক পােশাক। বাংলাদেশে পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য এই ‘হত্যা’ অভিনয় অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ আগস্ট ইন্টারন্যাশনাল পিস্ টিম’-এর ৮জন ব্রিটিশ ও ৩জন আমেরিকান কর্মী আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ওষুধপত্র ও অন্যান্য সাহায্যসামগ্রী নিয়ে পেত্রাপােল পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ১৮ আগস্ট ‘দি টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সৈন্যরা তাদের গ্রেফতার করে জেলখানার আটক রাখে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা মুক্তিলাভ করেন।

 

 

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি – যুক্তরাজ্য আবদুল মতিন