You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.01 | বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য ব্রিটেনের তৈরি থাকা উচিত - সংগ্রামের নোটবুক

ডিসেম্বর, ১৯৭১

১ ডিসেম্বর লন্ডনের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা অবশ্যপ্রয়ােজন বলে ভারত সরকার মনে করে। ৩০ নভেম্বর রাজ্য পরিষদে বক্তৃতাদানকালে মিসেস গান্ধী ভারত সরকারের উপরােক্ত মনােভাব দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করেন। দি টাইমস্ ও ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত উক্ত সংবাদে আরও বলা হয়, উচ্চ পরিষদে অনুষ্ঠিত এক বিতর্কে অংশগ্রহণ করে মিসেস গান্ধী বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর উপস্থিতি ভারতের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি বলে তিনি মনে করেন। প্রতিবেশী দেশে গণহত্যা ভারতের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। নিরস্ত্র জনগণকে নিশ্চিহ্ন করার ব্যাপারে তারা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারেন না।  তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান যদি ভারতের প্রতি শান্তির হস্ত প্রসারিত করতে চায়, তাহলে সদিচ্ছার প্রমাণ হিসেবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বাংলাদেশ থেকে তার সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করতে হবে।  ১ ডিসেম্বর ‘দি টাইমস্’-এ প্রকাশিত অন্য একটি সংবাদে বলা হয়, ৩০ নভেম্বর রাত্রিবেলা এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ভারতের দেশরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, আত্মরক্ষার জন্য প্রয়ােজন হলে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে সীমান্ত অতিক্রম করে পূর্ব বঙ্গে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়া হবে।  ২ ডিসেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান’-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুত্র শেখ জামালের একটি আলােকচিত্র প্রকাশিত হয়। চিত্র-পরিচিতি উপলক্ষে বলা হয়, শেখ জামাল বাংলাদেশ গেরিলা বাহিনীতে যােগ দিয়েছেন। তার ইউনিট পূর্ব বঙ্গ সীমান্ত পার হয়ে দশ মাইল ভেতরে গিয়ে যুদ্ধে নিয়ােজিত রয়েছে। ৩ ডিসেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ভারতকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকার ভারতের পাঞ্জাব এলাকায় একটি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে চরমপন্থী শিখদের সমর্থনদান করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।  গতকাল (২ ডিসেম্বর) লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে চরমপন্থী শিখদের নেতা ড, জগজিত সিং চৌহান উপরােক্ত তথ্য প্রকাশ করে বলেন, পাকিস্তানের অন্তর্গত নানকানা সাহেব থেকে একটি বেতার কেন্দ্র এবং লাহাের ও রাওয়ালপিন্ডি থেকে নতুন একটি যাত্রীবাহী বিমান প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ইয়াহিয়া খান অনুমতি দেবেন। এর ফলে পাক-ভারত সীমান্ত বিরােধে মিসেস গান্ধী অনুসৃত নীতি ব্যাহত হবে বলে ড. চৌহান মনে করেন।

৩ ডিসেম্বর করাচি থেকে প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, জুলফিকার আলী ভুট্টো। নুরুল আমিনের নেতৃত্বে গঠিত ‘কোয়ালিশন মন্ত্রিসভায় যােগদানের প্রস্তাব সংবলিত একটি পত্র ইয়াহিয়া খানের কাছে পাঠিয়েছেন। রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসমাবেশে মি. ভুট্টো তার সিদ্ধান্তের কথা ঘােষণা করেন।  ৪ ডিসেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, সঙ্কটের ক্রমবর্ধমান অবনতি এবং ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যাপারে ব্যর্থতার কথা বিবেচনা করে তিনি উল্লিখিত পত্র পাঠিয়েছেন। কিন্তু তার কাছে। ‘পূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে বলে তিনি দাবি করেন।  মি. ভুট্টো আরও বলেন, তিনি নিজে এবং তার পার্টি যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর মুখােমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত। ইয়াহিয়া খান যদি তার প্রস্তাব মেনে নেন, তাহলে আগামীকাল তিনি ‘কোয়ালিশন মন্ত্রিসভায় যােগদান করে ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।  ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাত্রির অব্যবহিত পর এক বেতার ভাষণে মিসেস গান্ধী বলেন, পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে পূর্ণোদ্যমে যুদ্ধ করছে এবং দেশে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করার পর জাতির উদ্দেশে এই বেতার ভাষণ প্রচার করা হয়।  ৪ ডিসেম্বর ‘দি টাইমস্ ও ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী মিসেস গান্ধী আরও বলেন, পাকিস্তানি স্যার জেট বিমান উত্তর-পশ্চিম ভারত ও কাশ্মিরের আটটি বিমান ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। পরবর্তী খবরে প্রকাশ, পাকিস্তানি বিমান আগরতলার বিমান ঘাঁটিও আক্রমণ করে। প্রথম সপ্তাহের শেষে লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বাংলাদেশ ও ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণ পরিচালনার জন্য পাকিস্তানের সামরিক চক্রের তীব্র নিন্দা করা হয়। ওয়ালি খান ও মুজাফফর আহমদ পরিচালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি ও পিপলস্ ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট অব বাংলাদেশের উদ্যোগে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৬ ডিসেম্বর মর্নিং স্টার পত্রিকায় এই সভার বিস্তারিত রিপাের্ট প্রকাশিত হয়।

উল্লিখিত সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে লর্ড ব্রকওয়ে বলেন, এই যুদ্ধের জন্য সােভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া অন্যান্য বৃহৎ শক্তিবর্গ বিশেষভাবে দায়ী। পূর্ব বঙ্গে সামরিক আক্রমণ চালিয়ে গণহত্যা শুরু করার পর তারা নিষ্ক্রিয় থাকার নীতি গ্রহণ করে। বৃহৎ শক্তিবর্গ ও জাতিসংঘ কর্তৃক পূর্ব বঙ্গ সমস্যার গণতন্ত্রসম্মত রাজনৈতিক সমাধানের দাবি উত্থাপন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের অধিকার স্বীকারের মাধ্যমে সর্বাত্মক যুদ্ধজনিত বিপর্যয় এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির যুক্তরাজ্য শাখার ভাইস-প্রেসিডেন্ট ড. নূরুল আলম বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণকে সমর্থনদানের জন্য সােভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ ও ভারতকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। যারা পাকিস্তান টিকে থাকবে বলে বিশ্বাস করে তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।  সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে সুদান কমিউনিস্ট পার্টির পলিটিক্যাল ব্যুরাের সদস্য এসেলেইন এল-আমীর বলেন, তার পার্টির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থনসূচক একটি বাণী নিয়ে তিনি এসেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এলাকা থেকে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করার দাবি সংবলিত একটি প্রস্তাব সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। পিপলস্ ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টের সেক্রেটারি হাবিবুর রহমান প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন।  ৫ ডিসেম্বর ‘দি সানডে টাইমস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তান বিরােধে চীন পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থন করবে বলে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাই ঘােষণা করেছেন। ব্রিটিশ সাংবাদিক নেভিল ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গে এক সাক্ষাঙ্কারকালে চীনের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হলে উভয় দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ধ্বংসাত্মক ও আক্রমণমূলক কার্যকলাপের ব্যাপারে চীন দৃঢ়ভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করে। শেষ পর্যন্ত ভারত তার ফলাফল ভােগ করবে। এরপর উপমহাদেশে অশান্তি বিরাজ করবে। 

৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ৭ ডিসেম্বর ‘দি টাইমস ও ‘মনিং স্টার’-এ এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। ভারতীয় পার্লামেন্টে তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে উপরােক্ত সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পাকিস্তানের বর্তমান সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে ক্ষতিকর হওয়ার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। ঘটনাবলির স্বাভাবিক পরিণতির সম্ভাবনা থাকলে এই পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্বে তিনি ইতস্তত করতেন। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহের মােড় পরিবর্তিত হয়েছে। জীবন-মরণ সংগ্রামে নিয়ােজিত বাংলাদেশের জনগণ এবং আক্রমণকারীদের  বিরুদ্ধে প্রতিরােধ সংগ্রামে নিয়ােজিত ভারতীয় জনগণ বর্তমানে একই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য পরস্পরের সহযােগীতে পরিণত হয়েছে বলে মিসেস গান্ধী। বলেন।১২৩ মিসেস গান্ধী বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত কয়েকটি পত্রের কপি পার্লামেন্ট সদস্যদের অবগতির জন্য পেশ করেন। ২৪ এপ্রিল (১৯৭১) লিখিত পত্রে সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের অনুরােধ জানানাে হয়। ৪ ডিসেম্বর লিখিত সর্বশেষ পত্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন আহমদ দস্তখত করেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, গণতান্ত্রিক নীতিতে বিশ্বাসী বাংলাদেশ সরকার ভবিষ্যতে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করবে বলে ঘােষণা করেছে। ৬ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে মিস ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী কৌশলগত কারণে পশ্চাদপসারণ করছে বলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে জেনারেল রাও ফরমান আলী স্বীকার করেন। ৭ ডিসেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত উক্ত সংবাদে আরও বলা হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে পশ্চাদপসারণ আত্মরক্ষার সর্বোত্তম উপায় বলে ফরমান আলী দাবি করেন। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর ৭টি ডিভিশন আক্রমণ শুরু করেছে বলে তিনি প্রকাশ করেন। ৬ ডিসেম্বর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধিবেশনে টোরিদলীয় সদস্য ডাকান স্যান্ডস সিকিউরিটি কাউন্সিলে সােভিয়েত ইউনিয়নের ‘ভিটো প্রয়ােগের সমালােচনা করেন। ৭ ডিসেম্বর মর্নিং স্টার’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, শ্রমিকলীয় সদস্যগণ তার সােভিয়েত-বিরােধী মন্তব্যের তীব্র সমালােচনা করেন। এদের মধ্যে জন স্টোনহাউসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।

সিকিউরিটি কাউন্সিলে উত্থাপিত মার্কিন প্রস্তাব সমর্থন করতে অস্বীকার করার জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারের প্রশংসা করেন। বৃহত্তর লন্ডন এলাকার ১৪টি বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে ১০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল ৬ ডিসেম্বর লন্ডনস্থ ভারতীয় হাই কমিশনে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে। ৭ ডিসেম্বর ‘মর্নিং স্টার -এ প্রকাশিত উপরােক্ত সংবাদে আরও বলা হয়, প্রতিনিধিরা জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে ইন্ডিয়া হাউসে প্রবেশ করেন। ভারতীয় হাই কমিশনার আপা পন্থের সঙ্গে সাক্ষাঙ্কালে তিনি বলেন, ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের মাধ্যমে ঐতিহাসিক সত্যকে মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশ গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের পথ অনুসরণ করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ  করেন। ৭ ডিসেম্বর ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করে। নয়া দিল্লিতে ভারত সরকারের জনৈক মুখপাত্র এই সংবাদ প্রকাশ করেন। ভারতের পর ভুটানই সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করে। ৮ ডিসেম্বর জেনারেল ইয়াহিয়া খান নুরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোকে উপ-প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়ােগ করে একটি কোয়ালিশন’ সরকার গঠন করা হয়েছে বলে ঘােষণা করেন। ৯ ডিসেম্বর ‘ফাইনান্সিয়াল টাইমস্ -এ প্রকাশিত উক্ত সংবাদে বলা হয়, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থন করার জন্য ভুট্টো অবিলম্বে রাওয়ালপিন্ডি থেকে নিউইয়র্ক রওনা হন। ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মহিলা সমিতির উদ্যোগে হাইড পার্ক এলাকার স্পিকার্স কর্নারের কাছে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।

দলে দলে মহিলারা এই সভায় যােগ দেন। সভার পর মহিলারা মিছিল সহকারে বিভিন্ন দূতাবাসে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবি সংবলিত স্মারকলিপি পেশ করেন।  ১১ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে মিস ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গের গভর্নর ড. আবদুল মােত্তালেব মালিক আত্মসমর্পণের শর্তাবলি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে আলােচনার জন্য যে প্রস্তাব পেশ করেন, তার বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া খান ভিটো’ প্রয়ােগ করেন। ১২ ডিসেম্বর ‘দি সানডে টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, গত শুক্রবার (১০ ডিসেম্বর) মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর মারফত ড. মালিকের প্রস্তাব ঢাকায় নিয়ােজিত জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে পেশ করা হয়। উল্লিখিত সংবাদে আরও বলা হয়, ১১ ডিসেম্বর জেনারেল এ এ কে নিয়াজি হঠাৎ ঢাকা বিমানবন্দরে হাজির হয়ে দম্ভভরে ঘােষণা করেন, তিনি পালিয়ে যাননি। তার মৃত্যুর পূর্বে ঢাকার পতন হবে না। উল্লিখিত তারিখে “দি সানডে টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত আর একটি সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সহকর্মীদের নিয়ে সদ্যমুক্ত যশাের পরিদর্শন করেন। বিপুল জনসমুদ্র ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি সহকারে তাদের অভ্যর্থনা জানায়। | ১২ ডিসেম্বর বিকেলবেলা লন্ডনের হাইড পার্ক এলাকার স্পিকার্স কর্নারের কাছে প্রায় ১৫ হাজার প্রবাসী বাঙালির এক গণসমাবেশে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করা হয়।  ১৯ ডিসেম্বর সাপ্তাহিক জনমত’-এ প্রকাশিত উপরােক্ত সংবাদে আরও বলা হয়, ব্রিটেনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দলে দলে প্রবাসী বাঙালিরা কোচযােগে লন্ডনে এসে এই সমাবেশে যােগদান করেন। সমবেত জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তৃতাদানকারীদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ মিশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান কর্মকর্তা রেজাউল করিম, শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শাের ও জন স্টোনহাউস এবং বাংলাদেশ থেকে আগত আওয়ামী লীগের নেতা ড, আসাবুল হক। ১৩ ডিসেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক রিপাের্টে বলা হয়, হাইড পার্ক থেকে বাঙালিরা বিরাট মিছিল সহকারে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে অবস্থিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পৌছায়। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট গাউস খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের অনুবােধ সংবলিত স্মারকলিপি পেশ করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে অনুরােধ জানানাে হয়। ডাউনিং স্ট্রিট থেকে প্রবাসী-বাঙালিরা অন্ডউইচে অবস্থিত ভারতীয় হাই। কমিশনে গিয়ে একটি ধন্যবাদজ্ঞাপক পত্র পেশ করেন। ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লন্ডনের মহাত্মা গান্ধী হলে ইন্ডিয়া লীগ আয়ােজিত এক সভায় শ্রমিক দলীয় প্রাক্তন মন্ত্রী পিটার শাের বলেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য ব্রিটেনের তৈরি থাকা উচিত। ১৩ ডিসেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, নবগঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবহারিক সাহায্যদানের জন্যও ব্রিটেনের তৈরি থাকা কর্তব্য। | ১৪ ডিসেম্বর বিকেলবেলা পূর্ববঙ্গের গভর্নর ড. এ এম মালিক ও তার মন্ত্রিপরিষদ একযােগে পদত্যাগ করেন। একটি ব-পয়েন্ট কলম দিয়ে এক টুকরাে ছেড়া কাগজে নিজ হাতে পদত্যাগপত্র লিখে ড. মালিক তা জাতিসংঘের অফিসার জন কেলি ও ‘দি অবজারভার’-এর সংবাদদাতা গেভিন ইয়াংকে দেখান। ইয়াহিয়া খানের কাছে লেখা পদত্যাগপত্রখানি ঢাকায় নিয়ােজিত আন্তর্জাতিক রেডক্রস সােসাইটির প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করা হয়। [ সকালবেলা থেকে ড. মালিক ও তার মন্ত্রীর পদত্যাগের কথা বিবেচনা করছিলেন। ভারতীয় বিমান আক্রমণের ফলে গভর্নরের বাসভবন ধ্বংস হওয়ার পর তারা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পূর্ববঙ্গের উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসারগণ ড, মালিকের নির্দেশ অনুযায়ী নিরপেক্ষ-এলাকা হিসেবে ঘােষিত হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (পরবর্তীকালে শেরাটন) আশ্রয়গ্রহণ করেন। | ১৬ ডিসেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এক পত্রে বাংলাদেশ আন্দোলনের উৎসাহী সমর্থক লর্ড ব্রকওয়ে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব নেই; এই সত্য ইয়াহিয়া খানকে মেনে নিতে হবে।

গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া তার পক্ষে অবশ্যকর্তব্য বলে তিনি মনে করেন। ১৬ ডিসেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে ভারতের বিরুদ্ধে ভুট্টোর এক হাজার বছর যাবৎ যুদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা সম্পর্কে বলা হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের হাস্যকর কথা বলার কোনাে মানে হয় না। ১৫ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর সংবাদদাতা মিস্ ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, জেনারেল নিয়াজি নীতিগতভাবে যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করতে রাজি হয়েছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইয়াহিয়ার নির্দেশ অনুযায়ী নিয়াজি আত্মসমর্পণের শর্ত সম্পর্কে আলােচনা করতে রাজি হন বলে মিস হােলিংওয়ার্থ বলেন। ১৬ ডিসেম্বর লন্ডনের সান্ধ্য-দৈনিক দি ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী আজ পূর্ববঙ্গে আত্মসমর্পণ করেছে। জেনারেল নিয়াজির পক্ষে এ ছাড়া অন্য কোনাে পথ খােলা ছিল না। তার আত্মসমর্পণের ফলে বহু নিরীহ লােকের প্রাণহানির আশঙ্কা দূর হয়েছে। | পত্রিকাটির সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা এবং লক্ষ লক্ষ বাস্তুত্যাগীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করার জন্য ভারতের যুদ্ধ-প্রচেষ্টা অনেকেই সমর্থন করবে। সবকিছু বিবেচনা করে বলা চলে, দুনিয়ার ইতিহাসে অযােগ্য নেতাদের মধ্যে অন্যতম বলে বিবেচিত ইয়াহিয়া খান মিসেস গান্ধীকে অস্ত্র ব্যবহার করতে বাধ্য করেন। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর আত্মসমর্পণ সম্পর্কে ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে প্রদত্ত ভাষণে মিসেস গান্ধী বলেন, পাকিস্তান বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের রাজধানী। ১৭ ডিসেম্বর ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত উল্লিখিত সংবাদে আরও বলা হয়, নতুন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান তার দেশের জনগণের মধ্যে ন্যায্য আসন গ্রহণ করে বাংলাদেশকে উত্তরােত্তর সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবেন বলে মিসেস গান্ধী আশা। প্রকাশ করেন। সােনার বাংলার স্বপ্ন সফল করার সুযোেগ উপস্থিত হয়েছে। এ । ব্যাপারে ভারতের শুভেচ্ছা থাকবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।

মিসেস গান্ধী আরও বলেন, এ বিজয় শুধুমাত্র বাংলাদেশের বিজয় নয়। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি যেসব জাতি শ্রদ্ধাশীল তারা এই বিজয়কে মানব স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি উল্লেখযােগ্য পথ-নির্দেশক বলে গণ্য করবে।১২৪ ১৬ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে অবস্থানরত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও তাঁর সহকর্মীরা ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর যুক্ত কমান্ডের কাছে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদ পান। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি। সমর্থনদানকারী বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করার জন্য আরও কয়েক দিন অবস্থানের পর তিনি এবং বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অপর সদস্যগণ ২২ ডিসেম্বর লন্ডনে ফিরে আসেন। | লন্ডনে ফিরে আসার পর বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছ থেকে একটি তারবার্তা পান। এই তারবার্তায় তাকে। অবিলম্বে দেশে ফেরার জন্য অনুরােধ জানানাে হয়। বিচারপতি চৌধুরী টেলিফোনযােগে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে আলােচনাকালে বলেন, ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী বাঙালিরা বাংলাদেশের জন্য আপ্রাণ পরিশ্রম করেছেন; তাদের ধন্যবাদ না জানিয়ে তিনি দেশে ফিরতে পারবেন না। তাছাড়া সাংগঠনিক কয়েকটা কাজ সমাধা না করে ব্রিটেন থেকে তিনি ফিরে যেতে পারেন না। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেন, বিদেশের বিভিন্ন সরকারের স্বীকৃতি লাভের ব্যাপারে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে আলােচনা করা দরকার। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারেও তার সঙ্গে আলােচনা করা প্রয়ােজন। তিনি ইচ্ছা করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সলর থাকতে পারেন। তা যদি না চান, তাহলে নতুন ভাইস-চ্যান্সলর নিয়ােগ সম্পর্কে তাঁর পরামর্শ প্রয়ােজন। তিনি যদি ভাইস-চ্যান্সলর পদে নিয়ােজিত থেকে লন্ডনে ফিরে যেতে চান, তাহলে একজন অস্থায়ী ভাইস-চ্যান্সলর নিয়ােগ করতে হবে।

বিচারপতি চৌধুরী শিগগিরই দেশে ফিরবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।১২৫ | ২০ ডিসেম্বর লন্ডনে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসে ইকোনমিক মিনিস্টার’ পদে নিয়ােজিত এ এফ এম এহসানুল কবীর বাংলাদেশের পক্ষে যােগ দিয়েছেন বলে ঘােষণা করেন। ২১ ডিসেম্বর পারী থেকে প্রাপ্ত এক সংবাদে বলা হয়, স্থানীয় পাকিস্তানি দূতাবাসে কমার্শিয়াল কাউন্সেলার’ পদে নিয়ােজিত মােসলেউদ্দিন আহমদ এবং ব্রাসেলসে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসে ‘সেকেন্ড সেক্রেটারি’ পদে নিয়ােজিত খায়রুল আনাম বাংলাদেশের পক্ষে যােগ দিয়েছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে স্বাগত জানানাের জন্য লন্ডনের হাইড পার্কে স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বিচারপতি চৌধুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে টেলিফোনে শেখ আবদুল মান্নানকে বলেন, সভার তারিখ ২ জানুয়ারি (১৯৭২) ঠিক করা হলে তিনি তার আগেই লন্ডনে পৌঁছে যাবেন। তিনি আরও বলেন, স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যদের নামে সব অ্যাকশন কমিটির। পক্ষ থেকে এই সভা আহ্বান করতে হবে। তিনি নির্দেশ দিলেন, জন স্টোনহাউস ও পিটার শােরসহ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের যেসব সদস্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন, তাদের সবাইকে সাদর আমন্ত্রণ জানাতে হবে।

২ জানুয়ারি (১৯৭২) লন্ডনের আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ ছিল। তা সত্ত্বেও ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে কোচযােগে ৭/৮ হাজার উৎসাহী বাঙালি বিজয়ের আনন্দে শরিক হওয়ার উদ্দেশ্যে হাইড পার্কে জমায়েত হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাড়িয়ে থেকে সভার কাজ শুরু হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। জন স্টোনহাউস, পিটার শাের এবং অ্যাকশন বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পল কনেটের প্রতিনিধি হিসেবে মিস মারিয়েটা প্রকোপে এবং আরও কয়েকজন ব্রিটিশ নাগরিক সভায় উপস্থিত ছিলেন। ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার -এর পক্ষ থেকে তাসাঙ্গুক আহমদ, বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদের প্রতিষ্ঠাতা এনামুল হক ও বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারিরাও সভায় উপস্থিত ছিলেন। স্টিয়ারিং কমিটির ভারপ্রাপ্ত কনভেনার শেখ আবদুল মান্নান এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। বিচারপতি চৌধুরী জাতিসংঘে কিভাবে কাজ করেছেন, কিভাবে বাঙালির স্বপ্ন। সফল হলাে, কিভাবে তারা ত্যাগ স্বীকার করেছে, বাঙালির ভবিষ্যৎ কেন উজ্জ্বল হবে ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে আবেগপূর্ণ ভাষায় বক্তৃতা করেন। তিনি আরও বলেন : ‘সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে গঠিত নতুন বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলভুক্ত ব্যক্তিরা শান্তিতে বসবাস করবে। বাংলাদেশের বাঙালিরা সভ্য জাতি হিসেবে গর্ববােধ করে। বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর মতাে বর্বর অত্যাচারের নীতি অনুসরণ করবে না।

গণহত্যা সম্পর্কিত জেনেভা কনভেনশন যারা লঙ্ঘন করেছে, তাদের বিচার করা হবে।’ বিচারপতি চৌধুরী দৃঢ় কণ্ঠে বলেন : স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে না আসা পর্যন্ত বাঙালিরা তার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবে।১২৬ | বিচারপতি চৌধুরী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী প্রবাসী বাঙালি এবং সমর্থনদানকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের অশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। ব্রিটিশ সরকারের প্রতিও তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।  এই উপলক্ষে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশ ফান্ড’-এর জন্য সংগৃহীত অর্থের সংক্ষিপ্ত হিসাব পেশ করেন। ব্যক্তি-বিশেষ ও বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটি সংগৃহীত অর্থের একটি বিরাট অংশ ‘বাংলাদেশ ফান্ড’-এ জমা দেয়া হয় নি বলে তিনি প্রকাশ করেন। শিগগিরই তা জমা দেয়ার জন্য তিনি অনুরােধ জানান।১২৭ অতঃপর স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন শ্রমিকদলীয় প্রাক্তন মন্ত্রী জন স্টোনহাউস, মহিলা সমিতির বেগম আনােয়ারা জাহান, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু, জাকারিয়া খান চৌধুরী, অ্যাকশন বাংলাদেশের মারিয়েটা প্রকোপে, স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য শামসুর রহমান এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসােসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ড, হাকিম। ৬ জানুয়ারি (১৯৭২) সন্ধ্যায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের অনুরােধ অনুযায়ী লন্ডন থেকে বিমানযােগে ঢাকার পথে রওনা হন। কলকাতা হয়ে ৮ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় পৌঁছান। ১২ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

লন্ডন, ১৮ মে, ২০০০

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি – যুক্তরাজ্য আবদুল মতিন