You dont have javascript enabled! Please enable it!

নভেম্বর, ১৯৭১

১ নভেম্বর (সােমবার) লন্ডনের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে মিসেস গান্ধীর আনুষ্ঠানিক আলােচনা গতকাল (রােববার) দুপুরবেলা সমাপ্ত হয়। সােমবার লন্ডনের ‘ফরেন প্রেস অ্যাসােসিয়েশন আয়ােজিত মধ্যাহ্নভােজসভায় বক্তৃতাদানকালে মিসেস গান্ধী বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ভারত সম্পূর্ণভাবে তৈরি না থাকলে দেশের জনগণ তার সরকারকে ক্ষমা করবে।  তিনি আরও বলেন, ভারত পাকিস্তানকে কখনও আক্রমণ করে নি এবং বর্তমানেও সেই ইচ্ছা নেই। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, স্বীকৃতিদানের ফলে কি লাভ হবে? তিনি বলেন, স্বীকৃতিদানের উপযুক্ত মুহূর্ত সম্পর্কিত প্রশ্ন তাঁর সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে। | ভারতীয় মুখপাত্ররা বলেন, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙে গিয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে মিসেস গান্ধী পাশ্চাত্যের দেশগুলাের বিরুদ্ধে অনুযােগের সুরে। বলেন, পাকিস্তানের কার্যকলাপ উপেক্ষা করে ভারত ও পাকিস্তানকে সমপর্যায়ের রাষ্ট্র বলে উল্লেখ করা বিরক্তিকর ২ নভেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, ভারত ও পাকিস্তান সমপর্যায়ভুক্ত নয় এবং তা মেনে নিতে তিনি রাজি নন। একই তারিখে ‘দি টাইমস-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, সভাগৃহের দরজায় জনৈক প্ল্যাকার্ডধারী বিক্ষোভকারী মিসেস গান্ধীর কাছে বাস্তুত্যাগীদের দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে ভারতের বাধা সৃষ্টির কারণ জানতে চায়। তিনি  বলেন, এ প্রশ্নটি এ বছরের সবচেয়ে বড় রসিকতা বলে গণ্য হওয়া উচিত। বাস্তুত্যাগীদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য ভারত অত্যন্ত সচেষ্ট রয়েছে। তা সত্ত্বেও দৈনিক প্রায় ৩০ হাজার বান্ধুত্যাগী ভারতে  আশ্রয়গ্রহণ করছে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে চীন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করবে বলে ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক বিবৃতি সম্পর্কে তার অভিমত জানতে চাইলে মিসেস গান্ধী বলেন, অন্যান্য প্ররােচনামূলক বিবৃতির সঙ্গে এর মিল রয়েছে। পাকিস্তানকে আক্রমণ করার ইচ্ছা ভারতের নেই। ইতঃপূর্বে পাকিস্তান দু’বার আক্রমণ করেছে বলে ভারতকে সম্পূর্ণভাবে তৈরি থাকতে হবে। ১ নভেম্বর স্থানীয় কলােসিয়াম থিয়েটারে ইন্ডিয়া লীগ আয়ােজিত এক সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে মিসেস গান্ধী উপমহাদেশের সমগ্র পরিস্থিতির ভয়াবহতা বর্ণনা করে বলেন, তিনি একটি আগ্নেয়গিরির চূড়ায় অবস্থান করছেন বলে মনে করেন। কখন বিস্ফোরণ ঘটবে তা তিনি জানেন না।

উল্লিখিত তারিখে ফাইনান্সিয়াল টাইমস’-এর সংবাদদাতা কেভিন র্যাফাটি এক সংবাদ-বিশ্লেষণে বলেন, শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের আবেদন জানাবার উদ্দেশ্যে মিসেস গান্ধী ব্রিটেন ও পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশ সফর করছেন বলে মনে করা হয়। কিন্তু অগ্নিগর্ভ ভাষায় প্রদত্ত তার বক্তব্য থেকে মনে হয়, শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের প্রশ্ন জরুরি নয়। পাকিস্তান প্রেসিডেন্টের উদ্যোগে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানই তাঁর কাম্য।  পত্রিকাটির সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, মিসেস গান্ধীর যুক্তি বােধগম্য এবং যুক্তিসঙ্গত। তিনি মনে করেন, আলােচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পূর্বশর্ত হিসেবে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে। পত্রিকাটি মনে করে, মিসেস গান্ধীর যুক্তি মেনে নেয়া ছাড়া অন্য কোনাে উপায় নেই।  ১ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউম ক্ল্যারিজেস হােটেলে গিয়ে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ৪০ মিনিট যাবৎ বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করেন। উল্লিখিত তারিখে ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর বিশেষ সংবাদদাতা ডেভিড লােশাক এক সংবাদ-বিশ্লেষণে বলেন, পাকিস্তান বর্তমান একটি চরম সঙ্কটের মুখােমুখি হয়েছে। গত দশ মাসে একের পর এক হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তা সত্ত্বেও হঠকারিতার জন্য অনুতাপ না করে সাধুতার ভান করা হয়। সরকারি প্রচারণামূলক চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পূর্ব বঙ্গের গণহত্যার জন্য বাঙালিদের দায়ী করা হয় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে পাকিস্তান-সৃষ্ট পরিস্থিতির জন্য  ভারতকে দায়ী করে। শেখ মুজিবকে কারারুদ্ধ করে পাকিস্তানের সামরিক চক্র বিপদমুক্ত হয়েছে বলে মনে করা ভুল হবে। শেখ মুজিবই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি পাকিস্তানকে ভরাডুবি থেকে রক্ষা করতে পারেন। তাকে কারাগারে আটক রাখা হলে তিনি একটি প্রতীক এবং ইয়াহিয়ার বিকল্প হিসেবে পরিগণিত হবেন ৩ নভেম্বর ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্ন-এ অবস্থিত পাকিস্তানি দূতাবাসে সেকেন্ড সেক্রেটারি হিসেবে নিয়ােজিত ওয়ালিউর রহমান পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের পক্ষে যােগ দিয়েছেন। তিনি সুইজারল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। ৭ নভেম্বর বৃহত্তর লন্ডন এলাকার বাঙালিদের উদ্যোগে গঠিত ১৪টি এ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিবৃন্দ এক সভায় মিলিত হয়ে গ্রেটার লন্ডন কো-অর্ডিনেটিং কমিটি গঠন করেন।

এস এম আইউব এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। ত্রিশজন প্রতিনিধি ও দর্শক এই সভায় যােগদান করেন। ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার’-এর নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা। হয়, বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির কর্মসূচির সমন্বয় সাধন এবং প্রস্তাবিত জাতীয় সম্মেলন সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে উল্লিখিত কো-অর্ডিনেটিং কমিটি গঠন করা হয়। মি. আইউব কমিটির আহ্বায়ক মনােনীত ৪ নভেম্বর মিসেস গান্ধী লন্ডন থেকে ওয়াশিংটন পৌঁছান। সেখান থেকে ৭ নভেম্বর তিনি পারীতে যান। পারীতে দু’দিন কাটিয়ে ৯ নভেম্বর তিনি পশ্চিম জার্মানি পৌঁছান। ৯ নভেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন প্রচেষ্টা গ্রহণ না করা পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান বহির্বিশ্বে ক্রমেই অধিকতর সমর্থনহীন হয়ে পড়বেন। এর ফলে মরিয়া হয়ে তিনি কাশ্মির কিংবা পাঞ্জাবে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টা করতে পারেন। সৌভাগ্যক্রমে, ভুট্টোর চীন। সফরের উদ্দেশ্য সফল হয় নি বলে মনে হয়।  উল্লিখিত তারিখে ‘দি গার্ডিয়ান’-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, ঘটনাস্রোত ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল (৮ নভেম্বর) আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেছে। পাকিস্তানের বিশ্বস্ত বন্ধু বলে প্রচারিত চীন থেকে ভুট্টো ‘আন্তরিক বন্ধুত্ব’ ও ‘সমর্থনের দৃঢ় সঙ্কল্প’ সম্পর্কিত মৌখিক আশ্বাস নিয়ে ফিরে এসেছেন। এর ফলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অপার স্বস্তি বােধ করবেন।  সম্পাদকীয় মন্তব্যে আরও বলা হয়, পাকিস্তানের জেনারেলগণ নিজেদের দুর্বুদ্ধির ফলে সৃষ্ট নিপীড়নমূলক পথের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছেন। তারা যুদ্ধ করে পরাজয় স্বীকার করতে পারেন, কিংবা আলােচনার মাধ্যমে বিদায় গ্রহণ করতে পারেন। এরপর তাদের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়; প্রতারণামূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব নয়। ১০ নভেম্বর ঢাকা থেকে প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর গেরিলা 

যােদ্ধারা বিগত দু’ সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশের ৭টি এলাকা দখল করে মুজিবনগর সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। ১১ নভেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, ঢাকার নিকটবর্তী মধুপুর জঙ্গল এবং সুন্দরবন এলাকা মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে রয়েছে। ১১ নভেম্বর বন্ থেকে ‘দি গার্ডিয়ান’-এর সংবাদদাতা নরম্যান ক্রসল্যান্ড প্রেরিত সংবাদে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তান সমস্যা সম্পর্কে মিসেস গান্ধীর অনমনীয় মনােভাব থেকে বােঝা যায়, উভয় দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার স্পষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, সীমান্ত এলাকায় এবং ওপারের ঘটনার ওপর যুদ্ধ শুরু হবে কিনা তা নির্ভর করছে। পূর্ব বঙ্গের অধিবাসীরাই পাকিস্তানের অখণ্ডতার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। কিন্তু পূর্ব বঙ্গে যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়েছে তার ফলে জনসাধারণ পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখার পক্ষপাতী কিনা সে সম্বন্ধে সন্দেহ রয়েছে। সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং লক্ষ লক্ষ শরণার্থী দেশে ফিরে যেতে সক্ষম না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি বিপজ্জনক বলে বিবেচিত হবে।  ইয়াহিয়া খানের এক পত্রের জবাবে পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সলর উইলি ব্রান্ড উপমহাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি মধ্যস্থতা করতে রাজি নন বলে জার্মানির সরকারি মুখপাত্র প্রকাশ করেন। মিসেস গান্ধী মধ্যস্থতার প্রস্তাব সম্পর্কে উৎসাহী নন। বিশ্ব-জনমত ইয়াহিয়া খানকে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়ােজনীয়তা স্বীকার করতে বাধ্য করবে বলে তিনি আশা করেন।  পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করলে ভারত পাল্টা আক্রমণ করবে এবং দখলিকৃত এলাকা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য কেউ ভারতকে বাধ্য করতে পারবে না বলে সম্প্রতি ভারতের দেশরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম যে মন্তব্য করেন, সে সম্পর্কে মিসেস গান্ধী একমত বলে উল্লেখ করেন।  তিন দিনব্যাপী পশ্চিম জার্মানি সফরের পর মিসেস গান্ধী ১১ নভেম্বর বন্ থেকে দিল্লি রওনা হন। বন্ অবস্থানকালে তিনি ফেডারেল চ্যান্সলর উইলি ব্রান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করেন।  ভারত-বিরােধী প্রচারে চীনপন্থীরা মওলানা ভাসানীর নাম ব্যবহার করতে দ্বিধাবােধ করে নি।

ভারত ও বিদেশে প্রচারিত বিবৃতিতে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি ব্যাহত করার জন্য ভারত সরকার মওলানা ভাসানীকে কার্যত গৃহবন্দি। অবস্থায় দিনযাপন করতে বাধ্য করেছে। শেষ পর্যন্ত তিনি তার ভক্তদের এই মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ১১ নভেম্বর। বিচারপতি চৌধুরীর কাছে লিখিত এক পত্রে তিনি গৃহবন্দি থাকার সংবাদ  ১৮ নভেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, শেখ মুজিবকে মুক্তিদানের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। পাকিস্তানের মঙ্গলকামী বিদেশী নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনেকেই ইয়াহিয়া খানকে জানিয়েছেন, শেখ মুজিবের মুক্তির মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এড়ানাে সম্ভব বলে তারা মনে করেন। অথচ ইয়াহিয়া খান এই পরামর্শ গ্রহণ করতে রাজি নন। শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হলে পূর্ব বঙ্গ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে বলে তিনি আশঙ্কা করেন। ১৮ নভেম্বর ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা দর্শনা শহর দখল করতে সক্ষম হয়েছে। এখান থেকে পূর্ব দিকে আক্রমণ চালিয়ে এই সেক্টরের প্রধান রাস্তাগুলাে দখল করাই মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য বলে মনে হয়। পূর্ব বঙ্গের দেবহাটা থেকে ২৩ নভেম্বর অ্যাসােসিয়েটেড প্রেসের সংবাদদাতা সন্তোষ বসাক প্রেরিত এক সংবাদে মুক্তিযােদ্ধাদের বিবৃতি উল্লেখ করে বলা হয়, পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীকে উচ্ছেদ করার সংগ্রাম গতকাল (২২ নভেম্বর) শুরু। হয়েছে। ২৪ নভেম্বর ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, মুক্তিযােদ্ধারা এই যুদ্ধকে ‘জীবন-মরণ সংগ্রাম’ বলে উল্লেখ করেন। | ২৪ নভেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, জাতিসংঘের মতামতকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সংগ্রামরত মুক্তিযােদ্ধারা এগিয়ে যাবে। যুদ্ধের অবসান ঘটাতে হলে শেখ মুজিবের মুক্তি এবং বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসন লাভের অধিকার সংবলিত প্রস্তাব পেশ করতে হবে। এ ধরনের উদ্যোগ ছাড়া রক্তপাত বন্ধ হওয়ার কোনাে সম্ভাবনা নেই। উল্লিখিত তারিখে ‘দি টাইমস্ -এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, পাকিস্তানের দু’অংশকে একত্র করে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। বর্তমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মন্থর গতিতে স্বাভাবিক রাজনৈতিক অবস্থা ফিরিয়ে আনবেন কিংবা শেষ পর্যন্ত শুভেচ্ছার প্রতীক হিসেবে শেখ মুজিবকে মুক্তিদান করবেন, এই আশায় ভারত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে বলে আশা করা যায় না। অপরপক্ষে ভারত বিভাগের নীতির প্রতি আস্থাশীল প্রবীণ পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা অচিন্ত্যনীয়।

এ ব্যাপারে নবীনদের সহানুভূতি থাকা অসম্ভব নয়। ভারতের সঙ্গে অন্তহীন ঝগড়ার অবসান হলে পাকিস্তান অতি সহজেই তার ভৌগােলিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সত্তা খুঁজে পাবে।  ২৯ নভেম্বর করাচি থেকে ফাইনান্সিয়াল টাইমস’-এর সংবাদদাতা প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গের সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর চাপ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও যশাের এলাকায় ভারতীয় আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। উল্লিখিত তারিখে জেনেভা থেকে প্রাপ্ত এক সংবাদে প্রকাশ, শেখ মুজিবের গােপন-বিচার ও তার ফলাফল সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করার জন্য ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস’ পাকিস্তান সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে। ৩০ নভেম্বর “ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন’ পত্রিকায় প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, যদি শেখ মুজিবকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে তাকে দয়া প্রদর্শনের জন্য। কমিশন অনুরােধ জানিয়েছে। ২৯ নভেম্বর রাওয়ালপিন্ডি থেকে “দি টাইমস্’-এর সংবাদদাতা ডেভিড। হাউসগাে প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, ২৭ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হওয়ার পর একটি জাতীয় সরকার গঠন সম্পর্কে আলােচনার জন্য পূর্ব বঙ্গের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগ নেতা নূরুল আমিনকে ইয়াহিয়া খান আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পিপলস্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এ ব্যাপারে ইয়াহিয়া। খানের সঙ্গে দু’বার আলােচনা করেছেন। ভারত ও পূর্ব বঙ্গের ‘দুষ্কৃতকারীদের ব্যাপারে ইয়াহিয়া খান অত্যন্ত আপসপন্থী মনােভাব প্রকাশ করেছেন বলে নূরুল আমিন ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সামরিক বাহিনীর একটি প্রভাবশালী অংশ তার মতামত সমর্থন করে, এ সম্বন্ধে কোননা সন্দেহ নেই। ৩০ নভেম্বর প্রকাশিত উপরােক্ত সংবাদে আরও বলা হয়, পূর্ব বাংলার প্রতি। পাকিস্তানের বর্তমান নীতির মৌলিক পরিবর্তনের কোনাে প্রয়ােজন নেই বলে নূরুল আমিন দাবি করেন। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে বিচারপতি চৌধুরী লন্ডন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তন করেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দেশ্য বর্ণনা করার জন্য হার্ভার্ড, নিউইয়র্ক সিটি, কলম্বিয়া, হােফস্ট্রা ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনােলজি (এম আই টি) ও হার্ভার্ড স্কুল অব ল’ সফর করেন। উপরােক্ত প্রতিষ্ঠানগুলােতে বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনাকীর্ণ সভায় তিনি বক্তৃতা করেন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি – যুক্তরাজ্য আবদুল মতিন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!