You dont have javascript enabled! Please enable it!

১ সেপ্টেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গের গভর্নর ও সামরিক প্রশাসক লে. জে. টিক্কা খানকে সরিয়ে দিয়ে ড. আবদুল মােত্তালিব মালিককে গভর্নর এবং লে. জে. আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজীকে সামরিক প্রশাসক পদে নিয়ােগ করা হয়েছে। ৩১ আগস্ট করাচি থেকে প্রেরিত এই সংবাদে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গের প্রশাসনিক দায়িত্ব ড. মালিক ও তার মন্ত্রীদের হাতে দেয়া হবে। ইয়াহিয়ার এই অসাধু চাল ব্যর্থ হবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর বিশেষ সংবাদদাতা মিস ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ প্রেরিত এক সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হয়, টিক্কা খানের অপসারণের ফলে জনসাধারণ উহূল্প বােধ করবে। ৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এই বিশ্লেষণে আরও বলা হয়, ড. মালিক বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও বহু বাঙালি তাকে ‘কুইসলিং’ বলে মনে করে।  ১ সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী লন্ডন থেকে নরওয়ের রাজধানী অসলাে।  পৌঁছান। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন রাজিউল হাসান রঞ্জু। বিমানবন্দরে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হামিদুল ইসলাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রফিকুজ্জামানসহ ৬/৭জন বাঙালি তাদের অভ্যর্থনা জানান। মাত্র ৬/৭জন অসলােবাসী বাঙালির কর্মতৎপরতার ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন নরওয়ের বিভিন্ন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাদের প্রচেষ্টার ফলে স্থানীয় টিভি বিচারপতি চৌধুরীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি নরওয়ের অধিবাসীদের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনের সারমর্ম ব্যাখ্যা করার সুযােগ লাভ করেন। সেদিন বিকেলবেলা এই সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। পরদিন (২৭ সেপ্টেম্বর) বিচারপতি চৌধুরী বেলা ১১টার সময় নরওয়ের প্রধান বিচারপতি পিয়ের অল্ডের সঙ্গে কফি পানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তিনি সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারপতিকে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর কক্ষে আসার জন্য অনুরােধ জানিয়েছিলেন। তারা জানতে চাইলেন, বাংলাদেশ কেন পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে চায়  বিচারপতি চৌধুরী সংক্ষেপে বাঙালির স্বাধীনতা কামনার মূল কারণগুলাে বিশ্লেষণ করেন। তারা বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে আন্দোলনের সাফল্য কামনা করেন।  সেদিন দুপুরবেলা বিচারপতি চৌধুরী অসূলাে রােটারি ক্লাবের সভায় অতিথি হিসেবে যােগদান করেন। সভা শুরু হওয়ার আগে তিনি এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে সংগ্রামী বাংলার দৃঢ় প্রত্যয়ের বাণী’ সদস্যদের কাছে পৌঁছে দেন। রােটারি ক্লাবের সভার পর বিচারপতি চৌধুরী নরওয়ের পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনাকালে বাঙালিদের দাবির যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। 

এরপর বিচারপতি চৌধুরী অসলাে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিন’-এর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক।  কিছুকাল আগে মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশে গণহত্যা সংঘটনের অপরাধে পাকিস্তানের বিচার অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল গঠন সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিচারপতি চৌধুরীকে অনুরােধ জানায়। এই ট্রাইবুনালের প্রধান কাজ হবে গণহত্যা সম্পর্কে একটি প্রামাণ্য রিপাের্ট প্রণয়ন করা। এ সম্পর্কে। আলােচনার পর আইন বিভাগের ডিন প্রস্তাবিত ট্রাইবুনালের সদস্যপদগ্রহণ করতে রাজি হন। (এই ট্রাইবুনাল গঠিত হওয়ার আগেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা  অর্জন করে।) ৩ সেপ্টেম্বর সকালবেলা বিচারপতি চৌধুরী অসলাের মেয়রের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন জানান। বিচারপতি চৌধুরীকে তিনি অসলাে শহরের বিভিন্ন আলােকচিত্র সংবলিত একটি বই উপহার দেন। বইটির প্রথম পৃষ্ঠায় তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি বলে উল্লেখ করেন। নরওয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার আগেই অসলাের মেয়র বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। সেদিন বিকেলবেলা নরওয়ের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী স্টলটেনবার্গ বিচারপতি চৌধুরীকে আনুষ্ঠানিকভাবে সাদর অভ্যর্থনা জানান। প্রায় দেড় ঘণ্টা যাবৎ আলােচনার পর মি, স্টলটেনবার্গ বলেন, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশসমূহের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আসন্ন সম্মেলনে নরওয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি পেশ করবে। সম্মেলনের সরকারি বিবরণীতে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের কথা প্রকাশ করা হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন। 

৬ সেপ্টেম্বর (সােমবার) সকালবেলা এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশ সংগ্রামের উদ্দেশ্য, বিদ্যমান পরিস্থিতি এবং সংগ্রামের অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেশ করেন। পরদিন নরওয়ের সবগুলাে সংবাদপত্রে তার বক্তব্য গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়। উল্লিখিত তারিখে সন্ধ্যা সাতটার সময় অসলাে বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে এক বিরাট ছাত্র সমাবেশের আয়ােজন করা হয়। ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মি. বুল বাংলাদেশ আন্দোলনের উৎসাহী সমর্থক। তার উদ্যোগে ছাত্র-সমাবেশে বক্তৃতা দেয়ার জন্য বিচারপতি চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়।  নির্দিষ্ট সময়ের কয়েক মিনিট আগে হামিদুল ইসলাম, আলী ইউসুফ, রফিকুজ্জামান এবং আরাে কয়েকজন বাঙালি ছাত্রের সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরী মিলনায়তনে উপস্থিত হয়ে নরওয়ের ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা ও চাঞ্চল্য লক্ষ্য করেন।  নরওয়ের একজন বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা একটি ব্যঙ্গচিত্র ছাত্র ইউনিয়ন পােস্টার হিসেবে ব্যবহার করে। এই ব্যঙ্গচিত্রে ইয়াহিয়া খানকে নরহত্যাকারী দৈত্যরূপে দেখানাে হয়। পােস্টারের পাশে ছিল সভার বিজ্ঞপ্তি। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকর্তারা বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, কয়েকজন পাকিস্তানি ছাত্র মিলনায়তনের প্রবেশদ্বারের কাছে কয়েকটি পােস্টার ছিড়ে ফেলেছে। এর ফলে উত্তেজিত ছাত্ররা দলে দলে মিলনায়তনে এসে সমাবেশে যােগ দেন। বিচারপতি চৌধুরীর বক্তৃতার আগেই দু’তিনজন ছাত্রনেতা বাংলাদেশে ছাত্র নিপীড়নের জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর তীব্র নিন্দা করেন। তারা বলেন, নরওয়ে বাক-স্বাধীনতার দেশ। এ দেশে এসে পাকিস্তানি ছাত্ররা যদি পােস্টার ছিড়ে ফেলতে সাহস করে তা হলে নিজেদের দেশে তাদের এবং তাদের সরকারের ব্যবহার সহজেই অনুমেয়।  পাকিস্তানি ছাত্রদের অগণতান্ত্রিক ও উস্কানিমূলক কাজের ফলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত সৃষ্টি হয়। এই সুযােগ গ্রহণ করে বিচারপতি চৌধুরী রাজনৈতিক বক্তৃতার ধরন ত্যাগ করে মর্যাদাব্যঞ্জক ভাষায় নিপীড়িত জনগণের মুক্তির কামনা ব্যক্ত করেন। সমবেত ছাত্ররা তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন।১০৮  ৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী অসলাে থেকে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোেম। রওনা হন। ইতােমধ্যে পাকিস্তান সরকার তাদের দূতাবাসে নিয়ােজিত কূটনৈতিক অফিসার ও অন্যান্য কর্মচারী এবং তাদের পরিবারবর্গের পাসপাের্ট ৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়ার নির্দেশ জারি করে। বাঙালি কূটনৈতিক অফিসার এবং কর্মচারীদের বাংলাদেশের পক্ষে যােগদান বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এই নজিরবিহীন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

৩ সেপ্টেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, এ যাবৎ বিশজন বাঙালি কূটনৈতিক অফিসার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। এঁদের মধ্যে দু’জন লন্ডন এবং চৌদ্দজন ওয়াশিংটন দূতাবাসে নিয়ােজিত ছিলেন। পাকিস্তানের কূটনৈতিক পাসপাের্ট ব্যবহার করে তারা নির্বিঘ্নে দেশ-দেশান্তরে সফর করেছেন। ৪ সেপ্টেম্বর ‘মর্নিং স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশ আন্দোলনকে সাহায্য ও সমর্থনদানের উদ্দেশ্যে ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফ শহরে। একটি ‘সলিডারিটি’ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যদের মধ্যে কমিউনিস্ট পাটি, শ্রমিক দল, ওয়েলস্ জাতীয়তাবাদী দল, ক্রিশ্চিয়ান এইড (আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা) এবং ইয়াং কনজারভেটিভদের প্রতিনিধি রয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার (২ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী সভায় কমিটির সদস্যগণ বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ, অবিলম্বে শেখ মুজিবের মুক্তিদান এবং পাকিস্তানে অস্ত্র চালান নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। ‘অপারেশন ওমেগা’ প্রেরিত পিস টিমের চারজন সদস্য দুর্গতদের জন্য সাহায্যসামগ্রী সঙ্গে নিয়ে ৫ সেপ্টেম্বর পায়ে হেঁটে পেত্রাপােল পার হয়ে দ্বিতীয়বার পূর্ব বঙ্গে প্রবেশ করেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা অবিলম্বে তাদের গ্রেফতার করে। আরও তিনজন সদস্য অন্য এক পথ দিয়ে পূর্ব বঙ্গে প্রবেশ করেন। তারাও গ্রেফতার হন বলে অনুমান করা হয়। পিস টিমের সদস্যরা ১৭ আগস্ট প্রথমবার সাহায্যসামগ্রী সঙ্গে নিয়ে পূর্ব বঙ্গে প্রবেশ করেন। ২৬ ঘণ্টা আটক রাখার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের পশ্চিম বঙ্গে ফেরত পাঠায়।  ১০ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, ৫ সেপ্টেম্বর পূর্ব বঙ্গে প্রবেশকারী পিস টিমের প্রথম দলের চারজন সদস্যকে কারাদণ্ড দিয়ে যশাের জেলে পাঠানাে হয়েছে। ঢাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনারের অফিস থেকে এই সংবাদ পাঠানাে হয়। | ১৮ সেপ্টেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ১৭ সেপ্টেম্বর পিস টিমের সাজাপ্রাপ্ত সদস্যদের জেল থেকে মুক্তি দিয়ে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।

শিগগিরই তারা লন্ডনে ফিরে আসবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী নরওয়ে থেকে সুইডেনে পৌঁছা সুইডেনে। নিয়ােজিত পাকিস্তানের প্রাক্তন কূটনৈতিক অফিসার আবদুর রাজ্জাক বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।  স্টকহােমে পৌঁছার দু’ঘণ্টা পর বিচারপতি চৌধুরী নােবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক গুনার মীয়ারডালের সঙ্গে দেখা করেন। আবদুর রাজ্জাক। এই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। বাংলাদেশ আন্দোলনের আদর্শ ও  উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার পর বিচারপতি চৌধুরী অধ্যাপক মীয়ারডালকে স্থানীয় বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যান পদ গ্রহণ করার জন্য অনুরােধ করেন। তিনি সানন্দে রাজি হন। | সেদিন বিকেলবেলা আবদুর রাজ্জাক ও রাজিউল হক রঞ্জুকে সঙ্গে নিয়ে বিচারপতি চৌধুরী সুইডিস সােস্যালিস্ট ডেমােক্রেটিক পার্টির সেক্রেটারি-জেনারেল স্টেন এ্যান্ডারসনের সঙ্গে দেখা করেন। তার পার্টি তখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার পর মি. এ্যান্ডারসন বলেন, তার পার্টির সমর্থন জানিয়ে শুধু একটা প্রস্তাব পাশ করিয়ে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন  বাংলাদেশকে সত্যিকারের সাহায্য করতে হলে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র সরবরাহ করতে হবে। তাদের পার্টির মাধ্যমে অস্ত্র সরবরাহ করার চেষ্টা করবেন বলে তিনি আশ্বাস দেন। এরপর বিচারপতি চৌধুরী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যালবার্গ এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পিয়ের শশারির সঙ্গে দেখা করেন। প্রধানমন্ত্রী তখন সুইডেনে ছিলেন না। ৮ সেপ্টেম্বর সকালবেলা বিচারপতি চৌধুরী সুপ্রিম কোর্টের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি মিসেস ইনগ্রিড গার্ডেওয়াইডেমারের সঙ্গে দেখা করেন। বিকেলবেলা তিনি সুইডিস পার্লামেন্ট হাউসে গিয়ে লিবারেল পার্টির চিফ হুইপ ইয়ান স্টিফেনসনের সঙ্গে বাংলাদেশ সংগ্রাম সম্পর্কে আলােচনা করেন। তার পার্টি বাংলাদেশকে সমর্থন করবে বলে তিনি আশ্বাস দেন। এরপর বিচারপতি চৌধুরী সুইডেনের খ্যাতনামা সাংবাদিক এবং এক্সপ্রেসেন ইভনিং ডেইলি পত্রিকার সম্পাদক টমাস হ্যামেনবার্গের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করেন। তিনি বাংলাদেশ আন্দোলন সমর্থন করবেন বলে আশ্বাস দেন।  ৯ সেপ্টেম্বর সকালবেলা সাভেনস্কা ডাগ ব্লাডেট পত্রিকার পক্ষ থেকে সাংবাদিক বাে কার্লসন বিচারপতি চৌধুরীর একান্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। বিকেলবেলা একটি জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। সুইডেনের প্রত্যেকটি উল্লেখযােগ্য পত্রিকার প্রতিনিধি এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। প্রশ্নের ধারা থেকে বােঝা যায়, সাংবাদিকরা বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল। ১০ সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী এফটেন ব্লাডেট পত্রিকার খ্যাতনামা। সাংবাদিক ফ্রেডারিকসেনের সঙ্গে বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কে আলােচনা করেন। তিনি স্থানীয় বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির সঙ্গে একযােগে কাজ করবেন বলে আশ্বাস দেন। 

১৩ সেপ্টেম্বর বিমানযােগে সুইডেন ত্যাগ করার আগে বিচারপতি চৌধুরী আবদুর রাজ্জাককে সুইডেনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব অর্পণের জন্য মুজিবনগর সরকারকে পত্রযােগে অনুরােধ জানান।১০৯। বিচারপতি চৌধুরীর স্ক্যান্ডিনেভিয়া সফরকালে বাংলাদেশ আন্দোলনের শত্রুরা গভীর রাতে লন্ডনের গােরিং স্ট্রিটে অবস্থিত স্টিয়ারিং কমিটির অফিসের নিচের তলার প্রবেশদ্বারে একটি বােমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এর ফলে দরজা-জানালার ক্ষতি হয়, কিন্তু কেউ আহত হননি। পাকিস্তানপন্থীরাই এর জন্য দায়ী বলে সবাই মনে করেন। ১০ সেপ্টেম্বর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের (মেট্রোপলিটন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স) অফিসার পিটার ল্যাঙ্গলি অফিসে এসে স্টিয়ারিং কমিটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সম্পর্কে আলােচনা করেন। তাছাড়া তিনি অফিসের সামনে পুলিশের ঘনঘন টহলের ব্যবস্থা করেন। ১ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পারীতে আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রায় ৭শ’ প্রতিনিধি যােগদান করেন। সংশ্লিষ্ট দেশের স্পিকার তার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। সম্মেলনে যােগদানকারী পার্লামেন্ট সদস্যদের বাংলাদেশে সংঘটিত পাকিস্তানি বর্বরতা সম্পর্কে অবহিত করার জন্য ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে।  ১ সেপ্টেম্বর পারী পৌঁছে ছাত্র প্রতিনিধিরা সম্মেলনের সভাপতি আঁদ্রে সেনারনাগারের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করেন। পরদিন অনুষ্ঠিত সাক্ষাৎকারকালে ছাত্র-প্রতিনিধিরা বিচারপতি চৌধুরীর চিঠি তার হাতে দেন। এই চিঠিতে তিনি মুজিবনগর সরকারের পার্লামেন্টকে স্বীকৃতিদানের অনুরােধ জানান।  ছাত্র-প্রতিনিধিরা সুযােগমতাে প্রত্যেক প্রতিনিধিদলের নেতার কাছে বিচারপতি চৌধুরীর চিঠি পৌঁছে দেন। এই চিঠির সঙ্গে ছিল বাংলাদেশ সম্পর্কে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদদের লেখা একটি নিবন্ধ, বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটি রিপাের্ট, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ এবং বিদেশী সংবাদপত্রে প্রকাশিত বাংলাদেশ সম্পর্কিত সংবাদ।  নরওয়ে, ইতালি, আয়ারল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার প্রতিনিধিবৃন্দ বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান। লাইবেরিয়ার প্রতিনিধিদলের নেতা বাংলাদেশ সরকারকে আফ্রিকায় একটি কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল পাঠাবার পরামর্শ দেন। প্রতিনিধিদল পাঠানাে হলে তাদের সর্বপ্রকার সাহায্যদানের আশ্বাসও তিনি দেন।

জর্ডানের প্রতিনিধিদলের নেতা আল হােসেইনি পাকিস্তানি অত্যাচার ও নিপীড়নের কাহিনী শুনে অভিভূত হন এবং দেশে ফিরে গিয়ে জর্ডানের বাদশাকে এ সম্পর্কে অবহিত করবেন বলে আশ্বাস দেন। মার্কিন প্রতিনিধিদলের জনৈক সদস্য পাক হানাদার বাহিনী সংঘটিত অমানুষিক  অত্যাচারের বিবরণ শুনে বলেন, দেশে ফিরে গিয়ে এসব কথা তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে জানাবেন। মিশরীয় প্রতিনিধিদলের নেতা প্রথমে ছাত্র প্রতিনিধিদের বলেন, মিশর থেকে রওনা হওয়ার আগে তিনি পাকিস্তানি দূতাবাস থেকে জানতে পেরেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন একটি মুসলিম রাষ্ট্রকে দ্বিখণ্ডিত করার অপচেষ্টা মাত্র। কিন্তু পারীতে আলােচনার পর তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই বলে মন্তব্য করেন। বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সম্মেলনে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ছাত্র-প্রতিনিধিগণ ফ্রান্সের জাতীয় ছাত্র সমিতির সঙ্গেও বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করেন। বাংলাদেশের নির্যাতিত ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের জন্য। তারা একটি বিরাট শশাভাযাত্রার আয়ােজন করেন। ছাত্র-প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন নজরুল ইসলাম, এ এইচ প্রামাণিক, ওয়ালী আশরাফ, খােন্দকার মােশাররফ হােসেন এবং মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু।১০ কমিটি ফর ক্রিশ্চিয়ান অ্যাকশন’-এর চেয়ারম্যান ক্যানন কলিলের উদ্যোগে লন্ডনে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি প্রদর্শনী এবং চারটি আলােচনা-সভার আয়ােজন করা হয় ট্র্যাফালগার স্কোয়ারের কাছে সেন্ট মার্টিনস্-ইন-দি-ফিল্ড নামের বিখ্যাত গির্জার বেসমেন্টে ১৩ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই প্রদর্শনী স্থায়ী হয় আলােচনা-সভার মূল বক্তাদের মধ্যে ছিলেন ক্যানন কলিন্স (১০ সেপ্টেম্বর), জন গ্রিগ (১৪ সেপ্টেম্বর), মর্টিন এ্যাডেনি (১৫ সেপ্টেম্বর) এবং ফরিদ জাফরী (১৬ সেপ্টেম্বর)।১১১  ১৩ সেপ্টেম্বর (সােমবার) সকালে বিমানযােগে বিচারপতি চৌধুরী সুইডেন থেকে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি পৌঁছান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রাজিউল হাসান রঞ্জু। হেলসিংকিতে নিয়ােজিত ব্রিটিশ কাল-জেনারেল রয় ফক্স। বিমানবন্দরে বিচারপতি চৌধুরীকে অভ্যর্থনা জানান। ঢাকায় ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনার পদে নিয়ােজিত থাকাকালে তাঁর সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। মি. ফক্স তাদের দু’জনকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। 

বিকেলবেলা মি. ফক্স বিচারপতি চৌধুরীকে রেলওয়ে স্টেশনের কাছে তার হােটেলে পৌঁছে দেন। হােটেলে জিনিসপত্র রেখে তিনি সরাসরি বিশ্ব শান্তি পরিষদের সেক্রেটারি-জেনারেল রমেশচন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রমেশচন্দ্র বলেন, হেলসিংকিতে অবস্থানকালে বিচারপতি চৌধুরী তার অফিস এবং টেলিফোন ও টেলেক্স ব্যবহার করলে তিনি খুশি হবেন। বিচারপতি চৌধুরী সানন্দে এই উদার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। রমেশচন্দ্র তার সহকর্মীদের সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীর পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর সেখানে বসেই তার হেলসিংকির কর্মসূচি তৈরি করেন। পরদিন বিচারপতি চৌধুরী অত্যন্ত কর্মব্যস্ত থাকেন। সকালবেলা হােটলে এসে ফিনিশ টেলিভিশন তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরদানকালে তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও বিদ্যমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। বিকেলবেলা ছাত্রদের এক সভায় তিনি বক্তৃতা করেন। তারপর পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করেন। এঁদের মধ্যে একজন কয়েক দিনের মধ্যে ফিনল্যান্ডের প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যােগ দেবেন। তিনি ফিনিশ সরকারকে বাংলাদেশ সংগ্রাম সম্পর্কে অবহিত করা এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশকে সমর্থন করার আশ্বাস দেন। এরপর পররাষ্ট্র দপ্তরের জনৈক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বিচারপতি চৌধুরীকে অভ্যর্থনা জানান। তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, বাংলাদেশ আন্দোলনের ব্যাপকতা এবং গুরুত্ব সম্পর্কে ফিনিশ সরকার সজাগ রয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে ফিনল্যান্ডের সহায়তা আশা করতে পারে। সন্ধ্যাবেলা হেলসিংকি ত্যাগ করার আগে বিচারপতি চৌধুরী ফিনল্যান্ডের বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘সুয়ােম্যান সােসিয়লি ডেমােক্রাত’-এর সম্পাদক এবং সুপ্রিম কোর্টের জজ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ভ্যাটিওসারিওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা বাংলাদেশ আন্দোলনকে যথাসম্ভব সাহায্যদানের আশ্বাস দেন।  ১৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যাবেলা বিচারপতি চৌধুরী ডেনমার্কের কোপেনহাগেন পৌঁছান। বিমানবন্দরে মতিউর রহমান এবং লিয়াকত হুসেনসহ কয়েকজন বাঙালি কর্মী তাকে অভ্যর্থনা জানান। বাংলাদেশ আন্দোলনের উৎসাহী সমর্থক মিমি ক্রিশ্চিয়ানসেন নামের একজন বয়ােবৃদ্ধা ডেনিশ মহিলার বাড়িতে বিচারপতি চৌধুরী ও রাজিউল হাসান রঞ্জুর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। 

পরদিন সকালবেলা বিচারপতি চৌধুরী ডেনমার্কের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র “ইনফরমেশন অফিসে গিয়ে সম্পাদক নিয়েলসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ইতােমধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে কয়েকটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখেছেন। বিচারপতি চৌধুরীকে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করেছে—একথা ডেনমার্ক উপলব্ধি করে। মুক্তিযােদ্ধারা। ঢাকা দখল না করা পর্যন্ত কোনাে বিদেশী সরকারের পক্ষে বাংলাদেশকে। স্বীকৃতিদান সহজ হবে না বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। বিচারপতি চৌধুরী। বলেন, ঢাকার বুকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত না হওয়া পর্যন্ত। বাঙালি মুক্তিযােদ্ধাদের জয়যাত্রা থামবে না।। এরপর বিচারপতি চৌধুরী পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলভুক্ত সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করেন। তারা বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন এবং সম্ভবত সাহায্য করবেন বলে। আশ্বাস দেন। পার্লামেন্ট ভবন থেকে বিচারপতি চৌধুরী টিভি স্টেশনে যান। সাক্ষাৎকার যিনি পরিচালনা করছিলেন তিনি রেকর্ডিং শুরু হওয়ার আগে বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, পাকিস্তান সরকার ডেনমার্কের একজন অ-ব্যবসায়ীকে অস্ত্র সরবরাহের অনুরােধ জানিয়েছে। সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ডেনিশ সরকারের কাছে আবেদন জানার জন্য তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে পরামর্শ দেন। সাক্ষাৎকারকালে অস্ত্র সরবরাহ সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে বিচারপতি চৌধুরী। বলেন, গণতন্ত্রে অটল বিশ্বাসী ডেনমার্ক কখনও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর স্বৈরশাসন চিরস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে অস্ত্র সরবরাহ করবে না বলে তিনি আশা করেন। পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করা হলে নারী-নির্যাতন, শিশু-হত্যা এবং যেসব নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি হবে, তার জন্য দায়ী থাকবে অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। | স্থানীয় বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি টিভি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেছিলেন। কমিটির আহ্বায়িকা কিস্টেন ওয়েস্টগার্ড একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তিনি ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন। তার কয়েক দিন আগে তিনি কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমীতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে যােগদান করেন। সেদিনের হত্যাকাণ্ড তিনি নিজের চোখে দেখেছিলেন বলে দেশে ফিরে এসেও তা। ভুলতে পারেন নি। কোপেনহাগেনে তার অফিসে বঙ্গবন্ধুর ছবি ঝােলানাে রয়েছে। গণ্যমান্য লােকজনের সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য তিনি সেদিন রাতে তাঁর বাড়িতে একটি সান্ধ্য-অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছিলেন।

টিভি স্টেশন থেকে বিচারপতি চৌধুরী পুনরায় পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে স্পিকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বাংলাদেশ সংগ্রামের সাফল্য কামনা করেন। এরপর বিচারপতি চৌধুরী পার্লামেন্টে বৈদেশিক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংসদে সমবেত হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক নীতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর বৈদেশিক কমিটির সদস্যরা স্বভাবতই ক্ষুব্ধ হন। কমিটির সভাপতি কিয়েল অলসেন বাংলাদেশকে সর্বপ্রকার সাহায্যদানের আশ্বাস দেন। বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎকারের প্রায় দু’মাস পর তিনি ডেনমার্কের দেশরক্ষা মন্ত্রী পদে নিয়ােজিত হন। এঁদের সমবেত প্রচেষ্টার ফলে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য যে কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চুক্তি সম্পাদন করেছিল, তারা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করে। ১৬ সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী জাতিসংঘের আসন্ন অধিবেশনে যােগদানের জন্য মনােনীত ডেনিশ প্রতিনিধিদলের নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি জাতিসংঘে অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করবেন এবং বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে সহায়তা করবেন বলে বিচারপতি চৌধুরীকে আশ্বাস দেন।  বেলা প্রায় ১১টার সময় ডেনমার্কের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘পলিটিকেন’-এর খ্যাতনামা সম্পাদক জন ডানস্ট্র্যাপ বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। তার কথাবার্তা থেকে পরিষ্কার বােঝা যায়, তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনের একজন উৎসাহী সমর্থক। সেদিন বিকেলবেলা স্থানীয় অ্যাকশন কমিটি ও কয়েকজন উৎসাহী বাঙালির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। কোপেনহাগেনের প্রায় প্রত্যেকটি দৈনিক ও সাপ্তাহিক সংবাদপত্র এবং সংবাদ-সংস্থার প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। প্রারম্ভিক ভাষণে বাংলাদেশ সংগ্রামের পশ্চাৎপট ব্যাখ্যা করে বিচারপতি চৌধুরী। বলেন, আদর্শগতভাবে এই সংগ্রাম ভৌগােলিক সীমারেখা অতিক্রম করে সকল দেশের ও সকল মানুষের সংগ্রামে পরিণত হয়েছে।

এই সংগ্রামে ডেনিশ জনগণ সক্রিয় সাহায্যদান করবে বলে তিনি আশা করেন। প্রশ্নোত্তরকালে জনৈক সাংবাদিক বলেন, বাংলাদেশ সরকার ইসরাইলের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এ সম্পর্কে তিনি বিচারপতি চৌধুরীর অভিমত জানতে চান। তিনি বলেন, এই মিথ্যা প্রচারণার জন্য পাকিস্তান দায়ী। বাংলাদেশ সরকারকে মুসলিম দেশগুলাের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করাই তাদের উদ্দেশ্য। তাদের এই হীন কারসাজি ব্যর্থ হবে। সত্য চিরকালই। জয়লাভ করে।  বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে ডেনিশ ভাষায় একটি সংবাদ বুলেটিন নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহ করে কিস্টেন ওয়েস্টগার্ড ও তার সহযােগীরা এই বুলেটিন প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। এদের কর্মচাঞ্চল্য ও একাগ্রতা লক্ষ্য করে বিচারপতি চৌধুরী বিস্মিত হন বলে তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন। ১৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যাবেলা বিচারপতি চৌধুরী কোপেনহাগেন থেকে বিমানযােগে লন্ডনের পথে রওনা হন।১১২  উল্লিখিত তারিখে সন্ধ্যাবেলা দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের লিঙ্কস প্রাইমারি স্কুলে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে বাংলাদেশের সমর্থনে একটি জনসভার আয়ােজন করা হয়। সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে শেখ আবদুল মান্নান বলেন, ভারত বিভাগের পর থেকে পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তানি নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রাম এবং মুক্তিবাহিনার বর্তমান সংগ্রাম একই সংগ্রামের অংশ বলে তিনি মনে করেন।

কমিউনিস্ট পার্টির স্থানীয় শাখার সভাপতি সিড ফেঞ্চ বলেন, স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তিরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ এবং জনসমাবেশের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ প্রয়ােগের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলে তিনি আশা করেন।১৩ ১৬ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের স্কারবারা শহরে অনুষ্ঠিত উদারনৈতিক দলের বার্ষিক সম্মেলনে পার্লামেন্ট সদস্য জন পার্ডো উত্থাপিত এক প্রস্তাবে অবিলম্বে শেখ মুজিবের মুক্তিদান এবং পূর্ব বঙ্গ থেকে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করার দাবি জানানাে হয়। ১৭ আগস্ট ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, আগামী ৬০ দিনের মধ্যে এই দাবি পূরণ না করা হলে একটি কমনওয়েলথ সম্মেলন আহ্বান করে বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতিদানের প্রস্তাব পেশ করা ব্রিটিশ সরকারের কর্তব্য বলে তিনি মনে করেন। ১৭ সেপ্টেম্বর ফরাসি সাহিত্যিক, মুক্তিযােদ্ধা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিবিদ আঁদ্রে মালরাে পারীতে প্রকাশিত এক বিবৃতি প্রসঙ্গে বলেন, পূর্ব বঙ্গে গিয়ে তিনি বাঙালি মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যােগ দেয়ার জন্য তৈরি রয়েছেন। ১৮ সেপ্টেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, তাঁর রওনা হওয়ার তারিখ শিগগিরই ঘােষণা করা হবে। এই চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী বিবৃতি বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করা হয়। এর ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি গণতান্ত্রিক বিশ্বের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়। মসিয়ে মালরাের বিবৃতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর বিচারপতি চৌধুরী তাঁর সঙ্গে যােগাযােগ করে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।১১৪ ১৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনের ওভাল এলাকায় ক্রিকেট খেলার ময়দানে বাস্তুচ্যুত বাঙালিদের সাহায্যার্থে একটি বিরাট ‘পপ সঙ্গীতের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৩৩ হাজার তরুণ-তরুণী এই উৎসবে যােগদান করে। এ সম্পর্কে ২০ সেপ্টেম্বর ‘দি মর্নিং স্টার’-এ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, টিকেট বিক্রির আয় থেকে ১৫ হাজার ২ শ পাউন্ড ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের জন্য পাঠানাে হবে। 

১৮ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ লিবারেল পার্টির বার্ষিক সম্মেলনে বক্তৃতাদানকালে দলের নেতা জেরেমি থর্প বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থনদানের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে জোরালাে আবেদন জানান। বাংলাদেশের জনগণের দুর্ভোগ উপশমের জন্য ব্রিটেনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে তার দল সরকারি কর্তৃপক্ষকে রাজি করাতে সক্ষম হবে বলে তিনি আশা করেন। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ নিউজলেটার’-এর অক্টোবর (১৯৭১) সংখ্যায় প্রকাশিত  সংবাদে বলা হয়, মি, থর্প বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং আন্দোলনকারীদের সর্বপ্রকার সাহায্যদানের জন্য তার দলের সদস্যদের প্রতি আহবান জানান।  ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনের কনওয়ে হলে বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে অস্ত্র হাতে তুলে নাও’ শীর্ষক একটি নৃত্যনাট্য অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে বিচারপতি চৌধুরী উদ্বোধনী ভাষণ প্রদান করেন। সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এনামুল হক (পরবর্তীকালে ড, এনামুল হক) নৃত্যনাট্যটি রচনা করেন। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের এই বিপ্লবী-আলেখ্য দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করে। এই নৃত্যনাট্যটি ব্রিটেনের অন্যান্য শহরেও মঞ্চস্থ করা হয়। গণসংস্কৃতি সংসদের সম্পাদিকা ছিলেন মুন্নি রহমান ফাহমিদা হাফিজও এই সংগঠনে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন।১১৫ ২১ সেপ্টেম্বর মুজিবনগর সরকার প্রেরিত এক তারবার্তায় বলা হয়, জাতিসংঘের আসন্ন অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করার জন্য ১৬-সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল পাঠানাের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বিচারপতি চৌধুরী এই প্রতিনিধিদলের নেতা মনােনীত হয়েছেন। অবিলম্বে তাকে নিউইয়র্ক রওনা হওয়ার জন্য অনুরােধ জানানাে হয়।  বিচারপতি চৌধুরী গােরিং স্ট্রিটের অফিস এবং পেমব্রিজ গার্ডেন্সের দূতাবাসে তার অনুপস্থিতিতে কার্য পরিচালনার জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে ২৩ সেপ্টেম্বর লন্ডন থেকে নিউইয়র্কের পথে রওনা হন। ২৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বক্তৃতা প্রসঙ্গে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউম বলেন, নিজের দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রয়ােজন হয় না, এ ধরনের শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে জনগণের আস্থাপূর্ণ বেসামরিক সরকার গঠনের মাধ্যমে যুদ্ধের আশঙ্কা এড়ানাে সম্ভব। ৩০ সেপ্টেম্বর ‘দি টাইমস্ -এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে উপরােক্ত বক্তৃতার উল্লেখ করে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গের হিন্দু ও মুসলমান অধিবাসীদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এমন একটি সরকার গঠন করা অবশ্য প্রয়ােজন। এই নিবন্ধে আরও বলা হয়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলােচনার মাধ্যমেই লক্ষ লক্ষ বাস্তুত্যাগী দেশে ফিরে গিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শালীনতাপূর্ণ জীবনযাপনের আশা পােষণ করতে পারে। আওয়ামী লীগ জনগণের স্বাভাবিক মুখপাত্র বলে পাকিস্তানের বিগত নির্বাচন প্রমাণ করেছে। গত মার্চ মাসের তুলনায় ভিন্ন পরিবেশে আওয়ামী লীগ নতুনভাবে আলাপ-আলােচনা করতে পারে। এই আলাপ-আলােচনায় শেখ মুজিবকে কারামুক্ত হয়ে অংশগ্রহণ করার সুযােগ দিতে হবে। 

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি – যুক্তরাজ্য আবদুল মতিন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!