You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.01 | বাংলাদেশ গেরিলা বাহিনীর কর্মতৎপরতার বিশদ বিবরণ-১ অক্টোবর ১৯৭১ দি ডেইলি টেলিগ্রাফ - সংগ্রামের নোটবুক

অক্টোবর, ১৯৭১

১ অক্টোবর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বাংলাদেশ গেরিলা বাহিনীর কর্মতৎপরতার বিশদ বিবরণ দেয়া হয়। পত্রিকাটির সংবাদদাতা ডেভিড লােশাক প্রেরিত এই বিবরণে বলা হয়, বাঙালি গেরিলারা আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে তৈরি রাইফেল, মেশিনগান ও মর্টার ব্যবহার করছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের অতর্কিতে আক্রমণ করে তারা কিছুসংখ্যক চীনদেশে-তৈরি অস্ত্র যােগাড় করতে সক্ষম হয়। এই সংবাদ স্বভাবতই প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে উৎসাহের সঞ্চার করে। ৬ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে পশ্চিম বঙ্গের শরণার্থী শিবিরগুলােকে পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষ বলে উল্লেখ করে ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনীকে তার জন্য দায়ী করা হয়। এই নিবন্ধে আমেরিকা থেকে পাকিস্তানকে সামরিক অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখারও নিন্দা করা হয়। ৭ অক্টোবর ব্রাইটনে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ শ্রমিক দলের বার্ষিক সম্মেলনে গৃহীত এক প্রস্তাবে বাংলাদেশের শােকাবহ পরিস্থিতির জন্য পাকিস্তান সরকারকে দায়ী করা। হয়। কার্যনির্বাহী পরিষদের পক্ষ থেকে পার্লামেন্ট সদস্য ও শ্রমিক দলের চেয়ারম্যান ইয়ান মিকার্ডো এই প্রস্তাব পেশ করেন। ৮ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান ও ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবিলম্বে আলােচনা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়ার জন্য শ্রমিক দল ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। প্রস্তাবের সমর্থনে জুডিথ হার্ট, ক্ৰস্ ডগলাসম্যান, জন্ স্টোনহাউস এবং আরও কয়েকজন সদস্য বক্তৃতা করেন।  মি, ডগলাসম্যান বলেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের ওপর শ্রমিক দলের নিরবচ্ছিন্নভাবে চাপ দেয়া অবশ্য কর্তব্য। মি, স্টোনহাউস বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ হিটলারের জার্মানিতে যাট লক্ষ ইহুদি নিধনের পরবর্তীকালের সবচেয়ে বড় শােকাবহ ঘটনা বলে অভিহিত করেন। মিসেস হার্ট বলেন, বাংলাদেশে দুস্থদের জন্য খাদ্য বিতরণের দায়িত্ব পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর পরিবর্তে জাতিসংঘের ওপর ন্যস্ত করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য রাজনৈতিক সমাধান অপরিহার্য। তিনি আরও বলেন, শেখ মুজিব ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাদের মুক্তি দিয়ে তাদের সঙ্গে আলােচনার মাধ্যমেই বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব।

৮ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান-এর কূটনৈতিক সংবাদদাতা প্রদত্ত এক সংবাদে বলা হয়, লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনের ‘পলিটিক্যাল কাউন্সিলার’ রেজাউল করিম পদত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে যােগদান করেছেন। এ পর্যন্ত যেসব বাঙালি অফিসার হাই কমিশন থেকে পদত্যাগ করেছেন, তাঁদের মধ্যে মি, করিম সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। পত্রিকাটির সংবাদদাতার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মি, করিম বলেন, পাকিস্তান সরকারের ভয়ানক নির্বুদ্ধিতা ও অপকর্মের প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগ করেছেন। ৫ মার্চ দিবাগত রাতে পূর্ব বঙ্গে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের পর বিদেশে নিয়ােজিত অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের মতাে তিনিও নিদারুণ মানসিক যাতনা ভােগ করেন। পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞকে তিনি বিংশ শতাব্দীর নিষ্ঠুরতম ঘটনা বলে উল্লেখ করেন।১১৬ ৮ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত অপর এক সংবাদে বলা হয়, পাকিস্তান সরকারের বিনা অনুমতিতে বাংলাদেশে ঢুকে দুস্থদের মধ্যে কাপড়-চোপড় বিতরণ করার জন্য ‘অপারেশন ওমেগা’র আরও দুজন কর্মীকে গ্রেফতার করে যশাের জেলে পাঠানাে হয়। গত আগস্ট মাস থেকে এ যাবৎ ‘ওমেগা’র কর্মীরা মােট ছ’বার বাংলাদেশে গিয়ে সাহায্যসামগ্রী বিতরণের চেষ্টা করেন। ইতঃপূর্বে ১২জন কর্মীকে গ্রেফতার করে কিছু দিন জেলে আটক রাখার পর বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১০ অক্টোবর “দি সানডে টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক সংবাদে লন্ডনস্থ পাকিস্তান। হাইকমিশনের একটি গােপন দলিলের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ৩ আগস্ট ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত বাংলাদেশ-বিরােধী একটি বিজ্ঞাপনের ব্যয়ভার পাকিস্তান। সরকার বহন করে। দি টাইমস’-এ প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের উদ্যোক্তা হিসেবে তথাকথিত ‘পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্ট’-এর নাম উল্লেখ করা হয়। পাকিস্তানপন্থী। ‘বাঙালি’ আবুল হায়াত ফ্রন্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা। পাকিস্তান হাই কমিশনে নিয়ােজিত প্রেস কাউন্সিলর আবদুল কাইয়ুম সরকারি তহবিল থেকে ২,৬৪০ পাউন্ড ব্যক্তিগত নামে গ্রহণ করে সলিডারিটি ফ্রন্ট’-এর প্রতিনিধির হাতে দেন। ‘দি সানডে টাইমস-এ গােপন দলিলটির ফ্যাক্সিমিলি’ প্রকাশিত হয়।

আর্জেন্টিনায় পাকিস্তান দূতাবাসে নিয়ােজিত বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবদুল মােমিন। ১১ অক্টোবর পদত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে যােগদানের কথা ঘােষণা করেন। ১৩ অক্টোবর তিনি লন্ডনে পৌছেই বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১৪ অক্টোবর ‘দি মর্নিং স্টার’-এ এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। | সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে মি. মােমিন বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক চক্র বেআইনিভাবে ক্ষমতাসীন হয়েছে। তারা পূর্ব বঙ্গে হত্যা, অত্যাচার ও নিপীড়নের জন্য দায়ী। যাদের আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করা হয়েছে তারা জনসাধারণের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত আশ্বস্ত বােধ করবে না।  ১২ অক্টোবর ব্রিটিশ উদারনৈতিক দলের যুব প্রতিষ্ঠান ইয়াং লিবারেলস্ বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের দাবি জানায়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত এক পত্রে তারা বলেন, ইয়াহিয়া খান হাজার হাজার নিরপরাধ বাঙালিকে হত্যা করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে তার সৈন্যবাহিনী নিয়ােগ করেন। ১৩ অক্টোবর ‘দি। মর্নিং স্টার’-এ এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। জেনেভা থেকে প্রাপ্ত এক সংবাদে প্রকাশ, বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক চক্রের মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব । জুরিস্ট’-এর একটি প্রতিনিধিদল আগামী ডিসেম্বর মাসে ভারত সফর করবে। কমিশনের সদস্যরা পাকিস্তান সফরেও যাবেন বলে আশা করেন। ১৪ অক্টোবর। লন্ডনের ‘ইন্ডিয়া উইকলি পত্রিকায় প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, আগামী জানুয়ারি মাসের শেষে তদন্তকারী কমিশন তাদের রিপাের্ট পেশ করবে। ১৯ অক্টোবর ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত অর্ধ-পৃষ্ঠাব্যাপী এক বিজ্ঞাপনে ভারতে। আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের দুর্গতির প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান নির্ধারণ করে অবিলম্বে তা কার্যকর করতে হবে।  বিশ্বের দুর্গত জনগণকে সাহায্যদানের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’। ও অক্সফ্যাম’ নামে পরিচিত দুটি বিখ্যাত দাতব্য প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে উপরােক্ত । বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞাপনটির শেষে একটি কুপন সংযােজিত হয়। এই কুপনটি পূরণ করে নিজ নিজ এলাকার পার্লামেন্ট সদস্যের কাছে পাঠানাের জন্য। পাঠকদের অনুরােধ জানানাে হয়। এই কুপনে বলা হয়, জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী। প্রাপ্ত অধিকারবলে পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং দুর্গতদের সাহায্যদানের পরিকল্পনা অবিলম্বে কার্যকর করার জন্য দস্তখতকারী জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানাচ্ছে।৯৮। ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের দুর্দশা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অবহিত করার। জন্য ২১ অক্টোবর ‘অক্সফ্যাম ৬০জন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ সংবলিত একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এই পুস্তিকায় যাদের বিবৃতি, লিখিত বিবরণ ও সাক্ষাৎকারের  রিপাের্ট প্রকাশ করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন সিনেটার এওয়ার্ড কেনেডি, মাদার তেরেসা, ড, ট্রেভর হাডলস্টোন, জেরাল্ড স্কার্ফ (কার্টুনিস্ট) এবং কিছুসংখ্যক সাংবাদিক ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য। ২১ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান’-এ এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘অক্সফ্যাম’-এর ডাইরেক্টর লেজলি কার্কলি বলেন, এই পুস্তিকাটি প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও জাতিসংঘের সেক্রেটারি-জেনারেল উ থান্টের হাতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, আমেরিকান কংগ্রেস ও জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যােগদানকারী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মধ্যে পুস্তিকাটি বিতরণ করা হবে।

ভারত উপমহাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ২৪ অক্টোবর নয়া দিল্লি ত্যাগ করেন। তিন সপ্তাহ বিদেশে অবস্থানকালে তিনি ব্রাসেলস্, ভিয়েনা, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, পারী ও বন (তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির রাজধানী) সফর করবেন। | ২৫ অক্টোবর বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে রয়াল ইনস্টিটিউট অব ইন্টান্যাশনাল রিলেশন্স ভবনে বক্তৃতা প্রসঙ্গে মিসেস গান্ধী বলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকগণ পূর্ব বঙ্গের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এই অভিযানকে গৃহযুদ্ধ বলা যায় না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুযায়ী ভােটদানের ফলে নিরপরাধ জনগণকে তারা নির্বিচারে হত্যা করছে। বিপুলসংখ্যক বাস্তুত্যাগীকে তারা ভারতে আশ্রয়গ্রহণ করতে বাধ্য করে। এর ফলে ভারতীয় জনসাধারণের জীবনযাত্রা এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যাহত হচ্ছে। ভারত এ যাবৎ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। বর্তমানে ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।  ২৬ অক্টোবর ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত উপরােক্ত সংবাদে আরও বলা হয়, মিসেস গান্ধী বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উপমহাদেশের সঙ্কটজনক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করেন। | ২৬ অক্টোবর মিসেস গান্ধী বেলজিয়াম থেকে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা পৌঁছান। ২৮ অক্টোবর ‘দি টাইমস-এ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, ২৭ অক্টোবর মিসেস গান্ধী অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর ব্রুনাে ক্রাইস্কির সঙ্গে উপমহাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে দেড় ঘণ্টাকাল আলাপ করেন। এরপর এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ভারতপাকিস্তান সীমান্তে আসন্ন সঙ্কট এড়াতে হলে পূর্ব বঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযােগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।  মিসেস গান্ধীর সঙ্গে ভিয়েনা সফররত ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে। আলােচনাকালে মি, ক্রাইস্কি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে রাজনৈতিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সুযােগ দেয়া উচিত বলে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। ৬ নভেম্বর লন্ডনের ইন্ডিয়া উইকলি’-তে এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। ২৯ অক্টোবর (শুক্রবার) মিসেস গান্ধী ভিয়েনা থেকে লন্ডনে পৌঁছান। ব্রিটেনে দু’দিনব্যাপী সফরকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাছাড়া ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এ্যাফেয়ার্স-এর সদস্যদের এক সভায় তিনি বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। সােভিয়েত-ভারত মৈত্রী-চুক্তি সম্পর্কেও তিনি বিস্তারিতভাবে আলােচনা করেন।

২৯ অক্টোবর ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে মিসেস গান্ধীর সফরের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ৯০ লক্ষ বাস্তুত্যাগীকে আশ্রয় দিতে বাধ্য হওয়ার ফলে ভারত এক অসহনীয় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। বহন করছে। | মিসেস গান্ধী মনে করেন, বাস্তুত্যাগীদের জন্য সাহায্য বরাদ্দ করে কেবল সাময়িকভাবে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তাঁর অভিমত সমর্থন করে সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করে বাস্তুত্যাগীদের পূর্ব বঙ্গে ফিরে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সম্পাদকীয় নিবন্ধের উপসংহারে বলা হয়, উপমহাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে মিসেস গান্ধীর যুক্তিগুলাে গ্রহণযােগ্য।  মিসেস গান্ধী লন্ডনে পৌঁছানাের কয়েক ঘণ্টা পর বাংলাদেশ মিশনের প্রধান ও মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ক্ল্যারিজেস হােটেলে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। লন্ডনস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের উদ্যোগে এই সাক্ষাতের আয়ােজন করা হয়। মিসেস গান্ধীর সঙ্গে ইতঃপূর্বে বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎ হয়নি। তিনি বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে পুরনাে বন্ধুর মতাে কথা বলতে শুরু করেন। ফ্রান্স, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডে বিচারপতি চৌধুরীর সফরের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি জানতে চান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এওয়ার্ড হিথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আগে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করার উদ্দেশ্যে যথেষ্ট সময় না দিয়ে তিনি এই সাক্ষাতের অনুরােধ জানিয়েছেন বলে মিসেস গান্ধী উল্লেখ করেন। বিচারপতি চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন দেশের সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের ব্যাপারে তারা বলেন, ভারতের স্বীকৃতিদানের ওপর তাদের সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে। আবেগপূর্ণ স্বরে তিনি আরও বলেন, মিসেস গান্ধীর পিতা বেঁচে থাকলে তিনি  শুধুমাত্র বাস্তুত্যাগীদের আশ্রয় দিয়েই ক্ষান্ত থাকতেন না। অবশ্য এর প্রতিদানে দেয়ার মতাে কিছুই বিচারপতি চৌধুরীর নেই। বাংলাদেশ কখনও ভারতের করদরাজ্যে পরিণত হবে না। তবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারতের বন্ধু-রাষ্ট্রের ভূমিকা গ্রহণ করবে। এই বন্ধুত্ব ভারতের কাম্য কিনা, ভারত তা বিবেচনা করবে। মিসেস গান্ধী ধৈর্য ধরে তাঁর বক্তব্য শােনার পর বিনীতভাবে বলেন, বন্ধুত্বের কথা উল্লেখ করে বিচারপতি চৌধুরী সৌজন্য প্রকাশ করেছেন। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করা বাঞ্ছনীয় বলে তিনি মনে করেন।

বিচারপতি চৌধুরীর উল্লিখিত প্রতিদান সম্পর্কে মিসেস গান্ধী বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে তিনি একটিমাত্র প্রতিদান আশা করেন—তা হলাে গণতন্ত্র । তিনি সামরিক শাসন দেখতে চান না। উল্লিখিত সাক্ষাৎকালে বিচারপতি চৌধুরী মিসেস গান্ধীকে বলেন, লন্ডনের এক সভায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান সম্পর্কে জয়প্রকাশ নারায়ণকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, তাঁকে প্রশ্ন করে লাভ নেই। স্বীকৃতিদানের অধিকারী হলে তিনি বহু পূর্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করতেন।  মিসেস গান্ধী হাসিমুখে বলেন, মি. নারায়ণের মতাে সরকারি-দায়িত্বমুক্ত নাগরিকের অধিকার থেকে তিনি বঞ্চিত। মানবতার খাতিরে তিনি বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দকে সর্বপ্রকার সাহায্য দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতের জনগণের স্বার্থের প্রতি নজর রাখা তাঁর প্রাথমিক কর্তব্য। তিনি ভারতের ওপর একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে পারেন না। ভারতকে বিনা প্ররােচনায় যদি আক্রমণ করা হয়, তা হলে কি করে তার জবাব দিতে হবে, ভারত তা জানে।  উপযুক্ত সময়ে বিনা দ্বিধায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করবেন বলে মিসেস গান্ধী উপরােক্ত সাক্ষাৎকারকালে বিচারপতি চৌধুরীকে আশ্বাস দেন।১৯। ৩০ অক্টোবর (শনিবার) লন্ডনের হেনরি থর্নটন স্কুলে বাংলাদেশ জাতীয় ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটি এই সম্মেলনের আয়ােজন করে। ম্যাঞ্চেস্টার, লিড়, বার্মিংহাম, এক্সেটার, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র প্রতিনিধিদল সম্মেলনে। যােগদান করেন। [ সকালবেলা ঘরােয়া অধিবেশনে কমিটির কার্যবিবরণী পেশ করা হয়। মধ্যাহ্নভােজনের পর বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলন উদ্বোধন করেন। শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য। পিটার শাের এবং ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ছাত্র প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্য অধিবেশনে বক্তৃতা করেন। বিকেলবেলার অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে।

সুদূরপ্রসারী আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি চৌধুরী আলােচনা-অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। অধ্যাপক রেহমান সােবহান স্বাধীনতা সংগ্রামের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। আলােচনায় অংশগ্রহণ করে ড. আজিজুর রহমান খান স্বাধীনতা সংগ্রামের অর্থনৈতিক পটভূমি ব্যাখ্যা করেন। সম্মেলনে ছাত্ররা ঘােষণা করেন, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনাে সমাধান তাদের কাছে গ্রহণযােগ্য নয়। কোনাে রকম আপস-আলােচনায় তাদের আস্থা নেই। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের গৌরবজনক পরিণতি তাদের কাম্য। সম্মেলনের পর বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ-এর (পিপল’স কালচারাল সােসাইটি) উদ্যোগে ‘অস্ত্র হাতে তুলে নাও’ শীর্ষক একটি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয়।১২০ ৩১ অক্টোবর ‘দি অবজারভার পত্রিকার কমনওয়েলথ সংবাদদাতা প্রদত্ত এক সংবাদে বলা হয়, আজ (রােববার) প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর অসমাপ্ত আলােচনা পুনরায় শুরু হয়। মিসেস গান্ধী ব্রিটেনকে উপমহাদেশের ব্যাপারে জড়াতে চান না। তিনি আশা করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি এবং এ সম্পর্কে ভারতের নীতির প্রতি ব্রিটেন সমর্থন জানাবে। | বর্তমান সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশ্যে কারারুদ্ধ বাংলাদেশ নেতা শেখ মুজিব কিংবা তার সহকর্মীদের সঙ্গে অবিলম্বে আলােচনা শুরু করার ব্যাপারে পাকিস্তানকে রাজি করানাের জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন বলে মিসেস গান্ধী তার সঙ্গে আলােচনাকালে আশ্বস্ত হতে চান। _ অক্টোবর মাসের শেষদিকে বিচারপতি চৌধুরী পাকিস্তানের প্রাক্তন-রাষ্ট্রদূত আবদুল মােমেনকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডনের একটি হােটেলে মরিশাসের কৃষিমন্ত্রী স্যার আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ করেন। কয়েক মাস আগে লন্ডনে তাঁর সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীর প্রথমবার সাক্ষাৎ হয়। তখন তিনি বলেন, পাকিস্তানের। অঙ্গচ্ছেদের ব্যাপারে তিনি সম্মতি দিতে পারেন না। দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎকালে বিচারপতি চৌধুরী মি, আবদুল মােমেনকে কথা বলার সুযােগ দেন। তিনি বাংলাদেশকে মরিশাসের স্বীকৃতিদানের ব্যাপারে সমর্থনদানের জন্য স্যার আবদুর রাজ্জাককে অনুরােধ করেন। মােমেনের বক্তব্য শােনার পর তিনি বলেন : পাকিস্তান ভেঙে দেয়া ঠিক হবে না। অতীতের অন্যায় ক্ষমা করে নতুন পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য এগিয়ে যেতে হবে। মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী স্যার সিউসাগর রামগােলাম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের পক্ষপাতী ছিলেন। তার দলের মুসলমান সদস্যদের বিরােধিতার ফলে তা সম্ভব হয়নি।১২১ 

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি – যুক্তরাজ্য আবদুল মতিন