আগস্ট, ১৯৭১
১ আগস্ট ‘দি সানডে টাইমস্ -এ প্রকাশিত একটি বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধে পত্রিকাটির বিশেষ সংবাদদাতা মারে সেইল বলেন, পূর্ব বাংলা পরিস্থিতি সম্পর্কে পাকিস্তানের মস্তিষ্ক-বিকৃতির লক্ষণসূচক প্রচারণার ফলে তাদের সৈন্যবাহিনী ভিয়েতনামের যুদ্ধের মতাে এক ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এই মিথ্যা প্রচার অভিযানে সামরিক সরকার নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানি সংবাদপত্রগুলােকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সবাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রে যােগ দিয়েছে বলে দাবি করে বলা হচ্ছে, ভারত ব্রিটেনের সঙ্গে, বি বি সি জায়নিস্ট’ নামে পরিচিত চরমপন্থী ইহুদিদের সঙ্গে এবং রাশিয়া ইজরায়েলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাকিস্তান-বিরােধী। ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। শুধু চীন ইসলামকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে অনুগত বন্ধু হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে রয়েছে। ‘মারে সেইল তার নিবন্ধে আরাে বলেন, পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের দাবি হলাে, বিদেশী জালিমদের খতম করাে। এই মনােভাবের মধ্যে ভারত-বিরােধিতার কোনাে স্থান নেই; পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর উদ্যোগে পরিচালিত ‘ভারতকে ধ্বংস করার অভিযান’ সম্পর্কে তাদের (বাঙালিদের) কোনাে উৎসাহ নেই। তাদের চোখে পশ্চিম পাকিস্তানিরাই বিদেশী জালিম। উভয়পক্ষের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে মারে সেইল বলেন, বাংলাদেশের সমর্থক ও পাকিস্তানিদের মধ্যে কোনাে প্রকার আপস হওয়া সম্ভব নয়। পাকিস্তানের অত্যাচারী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য বিশ্ব-জনমতকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে ১ আগস্ট (রােববার) লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে একটি বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
পল কনেটের নেতৃত্বে গঠিত অ্যাকশন বাংলাদেশের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই জনসমাবেশে ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে ২০ হাজারেরও বেশি বাঙালি যােগ দেন। শতাধিক বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির সদস্যদের লন্ডনে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন কমিটি বহু কোচ ভাড়া করে। একমাত্র বার্মিংহাম থেকে ৭০টি কোচ বাঙালিদের নিয়ে লন্ডনে আসে। [ সভায় বক্তৃতাদানকারীদের মধ্যে ছিলেন বিচারপতি চৌধুরী, লর্ড ব্রকওয়ে, লর্ড গিফোড, অশােক সেন (পরবর্তীকালে ভারতের আইন দপ্তরের মন্ত্রী), পিটার শাের, [ রেজু প্রেন্টিস, ক্রস ডগলাসম্যান, জন স্টোনহাউস, পল কনেট, বেগম লুলু বিলকিস | বানু ও গাউস খান। বক্তৃতাদানকালে বিচারপতি চৌধুরী ঘােষণা করেন, বাংলাদেশ কখনও তার স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ থেকে বিচ্যুত হবে না। বাংলাদেশের পূত-পবিত্র ভূমি। থেকে হানাদার বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত আমাদের আপসহীন, বিরামহীন সংগ্রাম চলবে। এই সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সংগ্রাম।’| হাজার হাজার কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মাধ্যমে বিচারপতি চৌধুরীর উদ্দীপনাময় ঘােষণাকে সমর্থন জানানাে হয়। বাঙালিদের আত্মবিশ্বাসের প্রমাণ। পেয়ে তিনি অভিভূত হন বলে তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন। বিচারপতি চৌধুরী আরও বলেন, ‘মুজিবনগর সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে আপােসরফা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে মিথ্যা প্রচারণা চালানাে হচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে বানচাল করার জন্য শত্রুপক্ষ এই গুজব ছড়াচ্ছে। তিনি এই ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে আলাপ করেছেন। উপরােক্ত গুজব ভিত্তিহীন বলে প্রধানমন্ত্রী তাকে জানিয়েছেন। শত্রুপক্ষের মিথ্যা প্রচারণা দ্বারা বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য বিচারপতি চৌধুরী আহ্বান জানান। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী সন্ ম্যাব্রাইড বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থন করার উদ্দেশ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে পাকিস্তান থেকে ব্যর্থ মনােরথ হয়ে ফিরে এসেছেন বলে বিচারপতি চৌধুরী প্রকাশ করেন। সমবেত জনতা ‘শেম ‘শেম’ বলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা প্রকাশ করে। বিচারপতি চৌধুরী অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করেন এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশসমূহের প্রতি আহ্বান জানান। তাছাড়া পূর্ব বঙ্গে নির্বিচারে ব্যাপক হত্যার মাধ্যমে গণহত্যা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক কনভেনশন ভঙ্গের জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জাতিসংঘের অধীনস্থ সিকিউরিটি কাউন্সিলের কর্তব্য বলে তিনি দাবি করেন। _ বক্তৃতা প্রসঙ্গে বিচারপতি চৌধুরী মুজিবনগর সরকারের তিনটি নির্দেশের কথা উল্লেখ করেন। প্রথম নির্দেশ অনুযায়ী শিগগিরই লন্ডনে একটি দূতাবাস স্থাপন করা হবে বলে তিনি ঘােষণা করেন।
দ্বিতীয় নির্দেশ অনুযায়ী পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বিমানযােগে ভ্রমণ না করার জন্য বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। তৃতীয় নির্দেশ অনুযায়ী পাকিস্তানি সরকারি কর্মচারী হিসেবে। পাকিস্তান ও বিদেশে নিয়ােজিত বাঙালিদের অবিলম্বে পদত্যাগ করে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের আহ্বান জানান। বিচারপতি চৌধুরীর বক্তৃতার পর অপ্রত্যাশিতভাবে লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনে নিয়ােজিত দ্বিতীয় সেক্রেটারি মহিউদ্দিন আহমদ বক্তৃতা দেয়ার জন্য । এগিয়ে আসেন। জনতার বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে মি. আহমদ ঘােষণা করেন, পাকিস্তানের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিকে তিনি অস্বীকার করতে পারেননি। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তিনি বেঁচে থাকতে চান। তাঁর। বক্তৃতা সমবেত জনতার মধ্যে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। ইউরােপে কর্মরত পাকিস্তানি কূটনীতিবিদদের মধ্যে মহিউদ্দিন আহমদই সর্বপ্রথম পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। ১০ এপ্রিল বি বি সি’র বুশ হাউসে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি বাংলাদেশের প্রতি তার সমর্থনের কথা। প্রকাশ করেন। ট্রাফালগার স্কোয়ারের জনসভায় যােগদানের জন্য রওনা হওয়ার কিছুক্ষণ আগে মি, আহমদ টেলিফোনযােগে বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে প্রস্তুত। বিচারপতি চৌধুরী তাকে সপরিবারে তাঁর বাড়িতে আসার জন্য বলেন। সেখান থেকে তাঁরা দুজন। সরাসরি ট্রাফালগার স্কোয়ারে যান। জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে জন স্টোনহাউস এম পি বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তান সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও অরাজকতা হিটলারের আমলে সংঘটিত ঘটনাবলির মতােই ভয়াবহ। কিছুদিন আগে তিনি কলকাতা ও পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে দুর্গতদের অবস্থা নিজ চোখে দেখে এসেছেন।
মি. স্টোনহাউস আরও বলেন, সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থন করার জন্য পাকিস্তান সরকার বিচারপতি চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলে তিনি জানতে পেরেছেন। এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করার জন্য তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে অনুরােধ জানিয়েছেন। পাকিস্তানে তার শারীরিক নিরাপত্তা বিপন্ন হবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। পঞ্চাশ বছর যাবৎ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকারী লর্ড ব্রকওয়ে বলেন, বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে সিকিউরিটি কাউন্সিলের জরুরি সভা অনুষ্ঠানের জন্য ব্রিটিশ সরকারের আহ্বান জানানাে উচিত। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা করে তিনি বলেন, অবিলম্বে আলােচনার মাধ্যমে এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান বাঞ্ছনীয়। এ ব্যাপারে তিনি বৃহৎ শক্তিবর্গের নিষ্ক্রিয়তার সমালােচনা করেন। রেজ প্রেন্টিস্ এম পি বলেন, বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত । জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করবে বলে আশা প্রকাশ করেন। অপর বক্তাদের সঙ্গে একমত হয়ে তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত ৭ কোটি ৫০ লক্ষ লােকের নেতা শেখ মুজিবকে অবিলম্বে মুক্তিদানের দাবি জানান। পল কনেট তার বক্তৃতায় বলেন : ‘বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের পাশে রয়েছে। বিশ্বের সকল দেশের, সকল ধর্মের, সকল বর্ণের মুক্তিকামী মানুষ। এই যুদ্ধ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির যুদ্ধ নয়, এই যুদ্ধ স্বাধীনতা হরণকারীদের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের যুদ্ধ। আপনাদের এই আদর্শবাদী সংগ্রামের সঙ্গে আমরা একাত্মতা প্রকাশ করছি। জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে অশােক সেন (পরবর্তীকালে ভারতের আইন দপ্তরের মন্ত্রী) বাঙালির সগ্রাম ও একনিষ্ঠ দেশপ্রেমের কথা গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন। প্রবাসী বাঙালি মহিলাদের পক্ষ থেকে বক্তৃতাদানকালে বেগম লুলু বিলকিস বানু মুক্তিযুদ্ধের সূচনা থেকে লন্ডনস্থ বাঙালি মহিলা সমিতির কার্যকলাপের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করেন। সভার শেষে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ একটি শােভাযাত্রা সহকারে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। এই লিপিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান, শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি এবং পাকিস্তানে অস্ত্র চালান বন্ধ করার উদ্দেশ্যে মার্কিন সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আবেদন জানানাে হয়।
প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থানের সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রদত্ত এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বিচারপতি চৌধুরী ব্রিটিশ জনগণ, রাজনীতিবিদ ও। সংবাদপত্রগুলােকে তাদের সহযােগিতার জন্য ধন্যবাদ জানান। হাইড পার্কের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত স্পিকার্স কর্নারের কাছে গিয়ে শােভাযাত্রার অবসান হয়। ট্রাফালগার স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত জনসমাবেশের একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল ‘অপারেশন ওমেগা’র উদ্যোগে গঠিত ইন্টারন্যাশনাল পিস্ টিম’ ও তার কর্মসূচির বাস্তবায়ন। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর আক্রমণের ফলে আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ওষুধপত্র ও অন্যান্য সাহায্যসামগ্রী নিয়ে পল কনেটের স্ত্রী এলেন কনেট এবং আরও একজন মহিলা একটি মােটরযানযােগে ট্র্যাফালগার স্কোয়ার থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হন। উপস্থিত বাঙালিরা তাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানান। বাংলাদেশে প্রবেশের পর পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ তাদের বন্দি করে যশাের কারাগারে আটক রাখে । ২ আগস্ট শ্রমিক ও রক্ষণশীল দলভুক্ত বেশ কয়েকজন প্রাক্তন মন্ত্রী ও বহু। পার্লামেন্ট সদস্য শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি সংবলিত একটি প্রস্তাব পার্লামেন্টে পেশ করেন। এই প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গে সংঘটিত ভয়াবহ বিপর্যয়ের ফলে উদ্ভূত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অবশ্য প্রয়ােজনীয় পূর্বশর্ত হিসেবে শেখ মুজিবকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। এই প্রস্তাবটি বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গত ১৫ জুলাই যে প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে, তার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রস্তাবের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন, জন স্টোনহাউস, আর্নেস্ট মারপল্স, মাইকেল স্টুয়ার্ট, পিটার শাের ও এডওয়ার্ড দুক্যান। এ সম্পর্কে ৩ আগস্ট ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, কমপক্ষে ৩৫০জন পার্লামেন্ট সদস্য প্রস্তাবটি সমর্থন করবেন বলে উদ্যোক্তারা আশা করেন। ২ আগস্ট লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনারের ‘চ্যান্সেরি বিভাগের অফিসার বখতিয়ার আলী স্বাক্ষরিত এক দলিলে প্রকাশ, ইয়াহিয়া খানের পক্ষে প্রচারণা চালাবার জন্য যুক্তরাজ্য সফরকারী বেগম আখতার সােলায়মান (হােসেন শহীদ। সােহরাওয়ার্দীর কন্যা) ও তার স্বামী এস এ সােলায়মানকে ভাতা বাবদ নগদ অর্থ। দেয়া হয়। ২০ জুলাই থেকে ৪ সপ্তাহের জন্য দৈনিক সাড়ে সাত পাউন্ড হিসেবে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মােট ৪২০ পাউন্ড গ্রহণ করেন। সফরে রওনা হওয়ার আগে বেগম সােলায়মান পেশােয়ারে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, বিদেশ সফরকালে তিনি পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে কোনাে টাকা নেবেন না। বি বি সি’র উর্দু সার্ভিস প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারকালেও তিনি জোর গলায় বলেন, পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে তিনি কোনাে টাকা গ্রহণ করেন নি।
লন্ডনের সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকায় ভাতাদান সম্পর্কিত সরকারি দলিলটির। ফ্যাক্সিমিলি ১৯৭১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ছাপানাে হয়। উক্ত দলিল সম্পর্কিত সংবাদ বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের নগ্নরূপ’ শিরােনাম দিয়ে । প্রকাশিত হয়। ৫ আগস্ট পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে। একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বাঙালিরা সবকিছুর জন্য দায়ী। বলে এই তথাকথিত দলিলে অভিযােগ করা হয়। ৬ আগস্ট ‘দি টাইমস্ ও ‘দি গার্ডিয়ান’-এ দলিলটির সারমর্ম প্রকাশিত হয়। | উল্লিখিত দলিলে বলা হয়, সংবিধান প্রণয়ন সম্পর্কে আলােচনাকালে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার জন্য প্রকারান্তরে স্বাধীনতা আদায়ের চেষ্টা করেন। তাদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তারা সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পরিকল্পনা করেন। রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রকাশিত এই দলিলে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে নিম্নে বর্ণিত তিনটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয় : ১. ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে পূর্ব বঙ্গের। জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগ এক লক্ষ পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের হত্যা করে; ২. ২৬ মার্চ সকালবেলা সশস্ত্র অভূত্থানের জন্য আওয়ামী লীগ একটি পরিকল্পনা তৈরি করে; ৩, ভারতের সঙ্গে গােপন পরামর্শ করে আওয়ামী লীগ তাদের। পরিকল্পনা তৈরি করে এবং ভারত অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে বিদ্রোহীদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। দলিলটির পরিশিষ্টে বলা হয়, চট্টগ্রাম এলাকা পাঁচ দিন যাবৎ বিদ্রোহীদের দখলে থাকাকালে ১০ থেকে ১২ হাজার লােককে হত্যা করা হয়। তাছাড়া বগুড়া। ও খুলনায় যথাক্রমে ২০ হাজার ও ৮ হাজার বিহারিকে হত্যা করা হয়। | এই মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত ‘শ্বেতপত্র প্রকাশ করে পাকিস্তান সরকার পূর্ব বঙ্গে তাদের সামরিক বাহিনী সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের জন্য আওয়ামী লীগ ও ভারতের ঘাড়ে দোষ চাপানাের ব্যর্থ চেষ্টা করে। ইউরােপ ও আমেরিকার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংবাদপত্রগুলাে শ্বেতপত্রে’র বিশ্বাসযােগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ। প্রকাশ করে। | ৫ আগস্ট লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনে ডাইরেক্টর অব অডিট এ্যান্ড একাউন্টস পদে নিয়ােজিত লুৎফুল মতিন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। বিচারপতি চৌধুরীকে লিখিত এক পত্রে তিনি তার সিদ্ধান্তের কথা জানান। মি. মতিনের পদত্যাগকালে চারজন বাঙালি কূটনৈতিক অফিসার লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনে কর্মরত ছিলেন।
জুলাই মাসের শেষদিকে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগারে দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে খবর পাওয়ার পর বিচারপতি চৌধুরী এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি-জেনারেল মাটিন এ্যানালসের সঙ্গে দেখা করে এই ব্যাপারে তাকে সাহায্য করার অনুরােধ জানান। মি, এ্যানালসের সঙ্গে আলােচনার পর বিচারপতি চৌধুরী এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও আন্তর্জাতিক রেডক্রস সােসাইটির (আই সি আর সি) কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দরখাস্ত পেশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মি. এ্যানালসের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রধান ও “ডিন এবং রেডক্রস সংক্রান্ত জেনেভা কনভেনশন ও আনুষঙ্গিক আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড্রেপারকে ‘মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির কাছে দরখাস্ত পেশ করার জন্য ব্যারিস্টার হিসেবে নিয়ােগ করেন। ৫ আগস্ট বিচারপতি চৌধুরী অধ্যাপক ড্রেপারসহ জেনেভায় পৌঁছান। অধ্যাপক ড্রেপার আনুষ্ঠানিকভাবে রেডক্রসের উচ্চপদস্থ অফিসারদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর শারীরিক নিরাপত্তার ব্যাপারে আলােচনা করেন এবং তার সম্পর্কে সঠিক সংবাদ সংগ্রহের জন্য অনুরােধ জানান। রেডক্রসের কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা। করার চেষ্টা করবেন এবং ফলাফল যথাসময়ে তাকে (অধ্যাপক ড্রেপার) জানাবেন। বলে আশ্বাস দেন। অধ্যাপক ড্রেপারকে বিমানবন্দরে বিদায় দিয়ে বিচারপতি চৌধুরী জেনেভায় ফিরে এসে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস-এর অফিসে গিয়ে সেক্রেটারি জেনারেল নিয়াল ম্যাকডারমেটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ব্রিটিশ সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী মি. ম্যাকডারমেট অত্যন্ত মনােযােগ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিচারপতি চৌধুরীর বক্তব্য – শােনেন। তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে সর্বপ্রকার সাহায্যের আশ্বাস দেন। বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে একটি তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন। মি. ম্যাকডারমেটের অফিস থেকে বিচারপতি চৌধুরী ওয়ার্ল্ড ইউনিভারসিটি সার্ভিসেস-এর অফিসে গিয়ে সেক্রেটারি জেনারেল চিদামবরা নাথানের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করেন। ৬ আগস্ট লন্ডনে ফিরে আসার আগে বিচারপতি চৌধুরী সুইস পার্লামেন্টের প্রভাবশালী সদস্য জা জিগলার এবং কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাছাড়া ১৭ আগস্ট তিনি জেনেভায় একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতাদানের জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। জা জিগলার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
৭ আগস্ট লন্ডনের ‘মর্নিং স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের প্রহসন অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানিয়ে ভারতীয় পার্লামেন্টের ৪৬৭ জন সদস্য ৬ আগস্ট জাতিসংঘের সেক্রেটারি-জেনারেল উ থান্টের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তিদানের দাবিও এই। স্মারকলিপিতে জানানাে হয়। | উল্লিখিত তারিখে ‘দি সানডে টাইমস’-এর প্রতিনিধি রালফ শ’র সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকার উপলক্ষে জেনারেল ইয়াহিয়া খান বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে সর্বোচ্চ শ্রেণীভুক্ত বন্দি হিসেবে শেখ মুজিব সুস্থ শরীরে বেঁচে আছেন। কিন্তু আগামীকাল তিনি বেঁচে থাকবেন কিনা তা বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। | ইয়াহিয়া খান আরও বলেন, দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। তার মানে এই নয় যে আমি তাকে আগামীকাল গুলি করে হত্যা করবাে। তার স্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারে। জেলখানায় তাকে সর্বোচ্চ শ্রেণীর বন্দি হিসেবে রাখা হয়েছে। তাকে শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় না। একটি বিছানা, বৈদ্যুতিক পাখা, গরম পানির ব্যবস্থাসহ ছােট একটি কামরা তাঁকে দেয়া হয়েছে এবং একজন ডাক্তার তাকে দেখাশােনা করছেন।’ ৮ আগস্ট ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়ন একটি ২০-বছর মেয়াদি ‘শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযােগিতার চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর ফলে ভারতের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে সসাভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক সাহায্যের নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠিত হয় বলে দিল্লির কূটনৈতিক মহল মনে করেন। ৯ আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান’-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, বাংলাদেশ সমস্যার ব্যাপারে ওয়াশিংটনের বেয়াড়া নীতি এবং চীনের সঙ্গে পুনরায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ফলে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করা ছাড়া মিসেস গান্ধীর পক্ষে আর কোনাে উপায় ছিল না। ভারত-সােভিয়েত চুক্তিকে পাকিস্তান আক্রমণাত্মক চুক্তি’ বলে অভিহিত করে। ১১ আগস্ট ‘ফাইনান্সিয়াল টাইমস্’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পিপলস্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এই চুক্তিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিটলারের সঙ্গে রাশিয়ার চুক্তি স্বাক্ষরের সঙ্গে তুলনা করেন। আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথমদিকে পাকিস্তান অবজারভার (বর্তমানে ‘বাংলাদেশ অবজারভার) পত্রিকার মালিক হামিদুল হক চৌধুরী পশ্চিম ইউরােপের কয়েকটি দেশ সফর করে লন্ডনে পৌঁছান। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানাের জন্য তাঁকে এবং গণতন্ত্রী দলের নেতা মাহমুদ আলীকে (বর্তমানে পাকিস্তানের নাগরিক) বিদেশে পাঠানাে হয়। লন্ডনে তাঁরা বিখ্যাত রয়াল ল্যাঙ্কাস্টার হােটেলে অবস্থান করেন। পাকিস্তান সরকার তাদের ব্যয়ভার বহন করে। ভাতাদান সম্পর্কিত সরকারি দলিলের ফ্যাক্সিমিলি’ লন্ডনের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘জনমত’-এর ৫ সেপ্টেম্বর (১৯৭১) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।৯৫
ল্যাঙ্কাস্টার হােটেল থেকে টেলিফোন করে হামিদুল হক চৌধুরী লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক আবদুল মতিনের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আলােচনাকালে মি. চৌধুরী বলেন, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায়। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ তা চায় না। বিগত নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগকে ভােট দিয়েছে তারা পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ম্যান্ডেট’ তাকে দেয় নি। মি. মতিন বলেন, ইয়াহিয়ার সৈন্যবাহিনী বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের পথ বেছে নিতে বাধ্য করেছে। | মি. চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ও সাহস আওয়ামী লীগের নেই। বাঙালিদের সাহসের অভাব সম্পর্কে তিনি ফেনিয়ে-ফাপিয়ে গল্প বললেন। পতেঙ্গায় বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ার’ দখলকারী বাঙালি সৈন্যরা নাকি পাঠান সৈন্যদের দেখেই হাতের বন্দুক ছুঁড়ে ফেলে ‘সেলুট’ দিয়ে দাঁড়ায়। ব্যঙ্গ করে তিনি বলেন, এদের নিয়ে শেখ মুজিব যুদ্ধ করবে! মি. মতিন বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া বাঙালিদের আর কোনাে উপায় নেই। মি, চৌধুরী বললেন, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ ভারতের হাতের-পুতুল। মাত্র। ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তান দখল করে তাহলে মুসলমানরা এক হাজার বছর। ধরে হিন্দুদের গােলাম হয়ে থাকবে। আবদুল মতিন তার যুক্তি খণ্ডনের চেষ্টা করেন। মি. চৌধুরী শেষ পর্যন্ত হাল। ছেড়ে দিয়ে বললেন, তুমি এ ব্যাপারে মাহমুদ আলীর সঙ্গে কথা বলাে। সে। তােমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবে। মি, মতিনের অনিচ্ছা সত্ত্বেও মি. চৌধুরী তাঁকে মাহমুদ আলীর রুমে নিয়ে যান। তার মুখেও একই যুক্তি শােনা গেল। হামিদুল হক চৌধুরী ও মাহমুদ আলী কয়েক দিন লন্ডনে ছিলেন। কয়েকটি বাঙালি রেস্তোরায় গিয়ে তারা ঘরােয়া আলােচনাকালে ভারতের তথাকথিত । দুরভিসন্ধির কথা উল্লেখ করেন। তারা বলেন, ভারত ১৯৪৭ সালে দেশ-বিভাগ। মেনে নেয় নি। তাই পাকিস্তানকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগকে তারা সমর্থন করছে। ব্যারিস্টার আব্বাস আলীসহ মাত্র অল্প কয়েকজন পাকিস্তানপন্থী। বাঙালি মাহমুদ আলী ও হামিদুল হক চৌধুরীর সঙ্গে যােগাযােগ করেন। গােলযােগের আশঙ্কায় তারা প্রবাসী বাঙালিদের নিয়ে জনসভা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ত্যাগ করেন।৯৭ আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে পারীতে বসবাসকারী খ্যাতনামা লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে লন্ডনভিত্তিক বাংলাদেশ নিউজলেটার গ্রুপ’-এর সরাসরি। যােগাযােগ স্থাপিত হয়।
১৯৬৭ সালের ৮ আগস্ট তিনি ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক দপ্তরে প্রােগ্রাম স্পেশালিস্ট হিসেবে যােগ দেন। পরবর্তীকালে তিনি ডেপুটি ডাইরেক্টর পদে উন্নীত হন। ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার’-এর প্রতিটি সংখ্যা এবং ব্রিটিশ ও আমেরিকান। সংবাদপত্রের বহু ক্লিপিং ডাকযােগে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে পাঠানাে হয়েছিল। আগস্ট মাসে পারী সফরকালে আবদুল মতিনের সঙ্গে তার যােগাযােগ হওয়ার পর তিনি জানান, বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন ফরাসি সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত খবর সরবরাহ করার ব্যাপারে ইতােপূর্বে লন্ডন থেকে পাঠানাে বুলেটিন ও ক্লিপিংগুলাে তার খুব কাজে লেগেছে। তখন থেকে তার। স্ত্রী এ্যানমেরী ওয়ালীউল্লাহ ফরাসি সংবাদপত্রসমূহে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রকাশিত সংবাদ-বিশ্লেষণ ও সম্পাদকীয় মন্তব্য ইংরেজিতে অনুবাদ করে বাংলাদেশ। নিউজলেটার’-এ প্রকাশের জন্য নিয়মিতভাবে পাঠান। সেপ্টেম্বর মাসের (১৯৭১) শেষের দিকে তিনি লন্ডনে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক কয়েকটি গ্রুপের সঙ্গে তিনি দেখা করেন। মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করা তার সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। বিচারপতি চৌধুরী তখন লন্ডনের বাইরে ছিলেন বলে তার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হয় নি। বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব-জনমত গড়ে তােলার জন্য সর্বোদয় আন্দোলনের নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের উদ্যোগে দিল্লিতে যে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়ােজন করা হয়েছিল, তাতে যােগ দেয়ার জন্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিতান্ত ব্যক্তিগত কারণে তিনি এই সম্মেলনে যােগ দিতে পারেন নি। ১০ অক্টোবর (১৯৭১) তিনি পারীতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ১০ আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান’ ও ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পরদিন (বুধবার) একটি সামরিক আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও অন্যান্য গুরুতর অভিযােগে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন দপ্তর থেকে ৯ আগস্ট প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়। এই বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, শেখ মুজিবের পক্ষ সমর্থন করার জন্য কৌসুলি নিয়ােগের সুযােগ দেয়া হবে। তবে পাকিস্তানের নাগরিক ছাড়া অন্য কাউকে কৌসুলি নিয়ােগ করা যাবে না। সামরিক আদালতের সদস্যদের নাম এবং কোথায় এই গােপন-বিচার প্রহসন অনুষ্ঠিত হবে তা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ হয়নি। সামরিক আদালতে বিচারের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে শেখ মুজিবকে মুক্তিদানের দাবি সংবলিত স্মারকলিপি ও ব্যক্তিগত পত্র লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনে পাঠানাে হয়। বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় মন্তব্যে শেখ মুজিবের বিচার অপরিণামদর্শীর সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করে তা পরিহার করার পরামর্শ দেয়া হয়।
১০ আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, শেখ মুজিবের গােপন-বিচার সম্পর্কে ইয়াহিয়া খানের অকল্পনীয় সিদ্ধান্ত ভারত উপমহাদেশের জন্য অধিকতর তিক্ততা, যুদ্ধ ও ধ্বংস ডেকে আনবে। ভারত ও পাকিস্তানের পক্ষে প্রকাশ্য সংঘর্ষ ছাড়া আর কোনাে পথ খােলা আছে বলে মনে হয় না। | ১০ আগস্ট জেনেভা থেকে “দি ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস’ শেখ মুজিবের গােপন বিচার অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে এক জরুরি তারবার্তা প্রেরণ করে। কমিশনের ব্রিটিশ সেক্রেটারি-জেনারেল নিয়াল ম্যাকডারমেটের উদ্যোগে এই তারবার্তা প্রেরণ করা হয়। সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গােপন-বিচার সম্পর্কে ১০ আগস্ট ‘দি মর্নিং স্টার’-এর প্রতিনিধির সঙ্গে আলােচনাকালে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, এর ফলে বাংলাদেশের জনগণ অধিকতর ঐক্যবদ্ধ হবে। শেখ মুজিব বাঙালিদের হৃদয়ে এক বিশিষ্ট স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছেন। কোনাে নেতাই তাঁর মতাে নির্ভীক নন। ২৫ মার্চ ঢাকা থেকে চলে যাওয়ার জন্য তার বন্ধুরা তাকে অনুরােধ করেন। তাঁকে খুঁজে বের করার অজুহাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী সমগ্র শহরকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করবে আশঙ্কা করে তিনি ঢাকা থেকে চলে যেতে অস্বীকার করেন। তিনি অবশ্য জানতেন না, সৈন্যবাহিনী ইতােমধ্যে গণহত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। জনগণকে বাঁচার জন্য তিনি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিচারপতি চৌধুরী আরও বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি অধিবাসী স্বাধীনতা অর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এটি একটি বাস্তব সত্য। এ সত্যকে মেনে নেয়ার জন্য পার্লামেন্ট সদস্যরা ব্রিটিশ সরকারকে রাজি করানাের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। | শেখ মুজিবকে মুক্তিদানের দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সম্প্রতি উত্থাপিত প্রস্তাবটি ইতােমধ্যে দু’শজনেরও বেশি পার্লামেন্ট সদস্য সমর্থন করেছেন জেনে বিচারপতি চৌধুরী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি ব্রিটিশ সরকার ও জনগণের কাছে শেখ মুজিবের মুক্তি অর্জনের ব্যাপারে কার্যকর সমর্থনদানের জন্য আবেদন জানান। উপসংহারে তিনি বলেন : ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই। আমরা বিজয় অর্জন করবাে, এ সম্বন্ধে আমার মনে কোনাে সন্দেহ নেই। সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের পক্ষ সমর্থন করার জন্য বাংলাদেশ মিশন লন্ডনের বিখ্যাত সলিসিটারদের প্রতিষ্ঠান বার্নার্ড শেরিডান এ্যান্ড কোম্পানিকে নিয়ােগ করে। ১১ আগস্ট ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক পত্রে তারা বলেন, শেখ মুজিবকে আইনগত পরামর্শ গ্রহণের সুযােগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। পাকিস্তানের সরকারি মহলের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করে তারা ব্যর্থ হয়েছেন।
এ সম্পর্কে তারা পাকিস্তান হাই কমিশনারের মারফত যে পত্র প্রেরণ করেন, তার কোনাে উত্তর পাওয়া যায় নি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী সন্ ম্যাকব্রাইডের সঙ্গে বার্নার্ড শেরিডান এ্যান্ড কোম্পানির জনৈক সলিসিটার রাওয়ালপিন্ডি যান। শেখ মুজিবকে তার পছন্দ। অনুযায়ী আইনজীবীর সঙ্গে আলােচনার সুযােগদান, বেসামরিক আদালতে তাঁর প্রকাশ্য বিচার অনুষ্ঠান এবং তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগগুলাে অবিলম্বে তাকে অবহিত করার দাবি সরাসরি পাকিস্তান সরকারের কাছে পেশ করার জন্য তাঁরা পাকিস্তান সফর করেন। এই সফর ফলপ্রসূ হয় নি। | পাকিস্তানের বেসামরিক কর্তৃপক্ষ ২৬ জুলাই মি. ম্যাকব্রাইডকে বলেন, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে যেসব অভিযােগ আনা হবে তা লিপিবদ্ধ করা হয় নি এবং দেশি কিংবা বিদেশি আইনজীবীর সঙ্গে আলােচনার সুযােগ তাকে দেয়া হয় নি। এমনকি তাকে কোন জেলে বন্দি রাখা হয়েছে তাও তিনি জানতে পারেন নি। পত্রের উপসংহারে বলা হয়, স্বাভাবিক ন্যায়নীতির সর্বনিম্ন মান অনুযায়ী শে। মুজিবের ন্যায্য বিচার লাভের কোনাে সম্ভাবনা নেই। ইয়াহিয়া খান সন ম্যাকব্রাইড় ও বার্নার্ড শেরিডান এ্যান্ড কোম্পানির। সলিসিটারের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেন। তারা অগত্যা ইয়াহিয়া খানের আইন বিষয়ক উপদেষ্টা বিচারপতি কর্নেলিয়াসের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বলেন, কোনাে বিদেশী আইনজীবীকে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ অথবা তার পক্ষ সমর্থন করতে দেয়া হবে না । বঙ্গবন্ধুর বিচারের প্রতিবাদে ১১ আগস্ট লন্ডনের হাইড পার্কে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে কোচযােগে বাঙালিরা দলে দলে হাইড পার্কে এসে জমায়েত হন। সভায় বক্তৃতাদানকালে বিচারপতি চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করে ঘােষণা করেন : বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তাহানি কিংবা কোনাে প্রকার ক্ষতি হলে বাঙালি জাতি কোনাে দিন পাকিস্তানকে ক্ষমা করতে পারবে না। ক্ষমা শব্দটি বাঙালি চিরদিনের মতাে ভুলে যাবে।’ আঞ্চলিক কমিটিগুলাের কয়েকজন নেতা এবং স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে শেখ আবদুল মান্নানও বক্তৃতা করেন। তারা পাকিস্তান সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধুর কোনাে ক্ষতি হলে সমগ্র বাঙালি জাতি অপরাধীর সমুচিত শাস্তির ব্যবস্থা করবে। এই সভায় পাকিস্তান হাই কমিশনে ডাইরেক্টর অব অডিট এ্যান্ড একাউন্টস পদে নিয়ােজিত লুফুল মতিন, ফজলুল হক চৌধুরী এবং আরাে কয়েকজন পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন।
সভার শেষে এক বিরাট শশাভাযাত্রা পিকাডিলি সার্কাসসহ বিভিন্ন রাস্তা। পরিক্রমণের পর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে অবস্থিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পৌঁছায়। শশাভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, ‘বিচার প্রহসন বন্ধ কর’, ‘গণহত্যা বন্ধ করা ইত্যাদি শ্লোগান দেয়। দি মর্নিং স্টার’-এ প্রকাশিত এক রিপাের্টে বলা হয়, পাঁচ হাজারেরও বেশি লােক এই শােভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। পিটার শাের, মাইকেল বার্নর্স, ক্রস ডগলাসম্যান, জন স্টোনহাউস এবং আরাে কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য শােভাযাত্রার প্রথম সারিতে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে ছিলেন। | প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সরকারি দপ্তরে নিয়ােজিত জনৈক অফিসারের হাতে একটি স্মারকলিপি দিয়ে বিচারপতি চৌধুরী বলেন : “শেখ মুজিব একটি। স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের রাষ্ট্রপতি। তার বিচার করার অধিকার কারাে নেই। গােপন-বিচার একেবারেই সভ্যতা-বহির্ভূত। এই প্রহসনের অবসান এবং শেখ মুজিবের অবিলম্বে মুক্তির জন্য ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে, এটাই আমাদের আশা।১০০
১২ আগস্ট ‘দি টাইমস্ -এর প্রধান সম্পাদকীয় নিবন্ধে সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গােপন-বিচারের তীব্র নিন্দা করা হয়। পাকিস্তানের এই সিদ্ধান্তকে শােকাবহ বলে উল্লেখ করা হয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবের যুদ্ধ ঘােষণা করার অভিযােগ উদ্ভট বলে বর্ণনা করা হয়। তাছাড়া গােপন-বিচারকে লজ্জাকর বলে অভিহিত করে বলা হয়, এর ফলাফল অন্যায্য হওয়ার গুরুতর আশঙ্কা থাকে। উপসংহারে বলা হয়, শেখ মুজিবের জীবন রক্ষার জন্য সবাইকে জোরালাে আবেদন জানাতে হবে। সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গােপন-বিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের দু’জন শ্রমিক দলীয় সদস্যের পৃথক চিঠি ১৩ আগস্ট ‘দি টাইমস্’-এ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থনকারী কৌসুলি টমাস উইলিয়ামস তার পত্রে বলেন, সামরিক আদালতে। গােপন-বিচারের ভয়াবহ ফলাফল এড়ানাের জন্য ব্রিটিশ সরকার ও জাতিসংঘ যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে তিনি আশা করেন। অপর পত্রে পিটার শাের বলেন, গােপনে শেখ মুজিবের বিচার অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত থেকে মনে হয়, পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট পূর্ব বঙ্গ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন এবং সশস্ত্র সংঘর্ষের আশঙ্কা সম্পর্কে নিরুদ্বেগ। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। নিজেদের মঙ্গলের কথা বিবেচনা করে পাকিস্তানের শাসকচক্র এই। পরিস্থিতিতে তাদের মত পরিবর্তন করবে বলে তিনি কি আশা করতে পারেন? আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারতের প্রাক্তন দেশরক্ষামন্ত্রী এবং যুক্তরাজ্যে তাদের প্রাক্তন হাই কমিশনার মি. কৃষ্ণমেনন ৪/৫ দিনের জন্য লন্ডনে আসেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয় মনােভাব দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যাখ্যা করাই তার। সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। তার বয়স তখন প্রায় ৭৫ বছর। তিনি তখন ভারতীয় লােকসভার স্বতন্ত্র সদস্য বিচারপতি চৌধুরী স্যাভয় হােটেলে গিয়ে মি, কৃষ্ণমেননের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রবাসী ভারতীয় সাংবাদিক ড. তারাপদ বসু তাঁকে দেখাশােনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন লন্ডন অবস্থানের প্রথম দিন পুরাে বিকেলবেলা তিনি বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন সম্পর্কে আলােচনা। করে কাটান।
১৩ আগস্ট মি. কৃষ্ণমেনন কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউটের প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বক্তৃতা করেন। সভার শেষে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাঙালি বাস্তুত্যাগীদের অবস্থা সম্পর্কে গৃহীত চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, নিজের চোখে যা দেখেছেন তা আরও করুণ ও হৃদয়বিদারক। ১৪ আগস্ট তিনি ভারতীয় ছাত্রাবাস মহাত্মা গান্ধী হল এবং রেড লায়ন। স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে অনুষ্ঠিত দুটি পৃথক সভায় বাংলাদেশ সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। বিচারপতি চৌধুরী উভয় সভায় উপস্থিত ছিলেন। কনওয়ে হলের সভায় তিনি মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে মি, কৃষ্ণমেননকে ধন্যবাদ জানান। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট গাউস খান মি, কৃষ্ণমেননের সম্মানার্থে একটি ঘরােয়া ভােজসভার আয়ােজন করেন। বিচারপতি চৌধুরী, স্টিয়ারিং কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং কয়েকজন বিশিষ্ট কর্মীকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছিল। তিনি ধৈর্য সহকারে সবার বক্তব্য শােনেন এবং যথাসম্ভব সাহায্যের আশ্বাস দেন। লন্ডনের কর্মসূচি পালনের পর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পথে রওনা হয়ে যান। | ১৪ আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ব্রিটিশ শ্রমিক দলের জাতীয় কার্যনির্বাহক সংস্থার পক্ষ থেকে পাকিস্তান হাই কমিশনারের কাছে সম্প্রতি লিখিত এক পত্রে শেখ মুজিব ও তার সহকর্মীদের অবিলম্বে মুক্তিদানের আবেদন জানানাে হয়। শ্রমিক দলের সহকারী সেক্রেটারি গুইন মর্গান লিখিত চিঠিতে বলা হয়, সামরিক আদালতে গােপন বিচারের সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলােচনার মাধ্যমে বিদ্যমান সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব বলে শ্রমিক দল মনে করে। |৫ আগস্ট (রােববার) ‘দি অবজারভার পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তানি নির্যাতন ও তাদের নীতির যৌক্তিকতা প্রমাণ করা ছাড়া | শেখ মুজিবের গােপন বিচারের আর কোনাে উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। পত্রিকাটি ইয়াহিয়া সরকারকে সাবধান করে দিয়ে বলে, শেখ মুজিবকে যদি শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকভাবেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, তাহলে এর ফলাফল সুদূরপ্রসারী হবে। এর ফলে, পূর্ব বঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে রাজনৈতিক ও সামাজিক দমনকার্য পরিচালনাই জেনারেল ইয়াহিয়ার একমাত্র নীতি বলে যে সন্দেহ রয়েছে, তা সত্য বলে প্রমাণিত হবে।
এই নীতি সফল হতে পারে না এবং এর ফলে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। উল্লিখিত তারিখে ‘দি সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, গত বুধবার (১১ আগস্ট) লাহাের থেকে ৮০ মাইল দূরবর্তী শহর লায়ালপুরের একটি সার্কিট হাউসে পূর্ব বঙ্গের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হয়। জনৈক ব্রিগেডিয়ার তিন-সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষ সামরিক আদালতের প্রধান কার্যনির্বাহক পদে নিয়ােজিত হয়েছেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ১৫ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে বাংলাদেশ-বিরােধী একটি জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ নিউজলেটার এই জনসমাবেশকে ‘অদ্ভুত সার্কাস’ বলে। অভিহিত করে। লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে কয়েকজন বাঙালি কুইসলিং’ যােগদান করে। এদের নেতা মােহাম্মদ আবুল হায়াত পাকিস্ত নি অর্থ সাহায্য গ্রহণ করে বাংলাদেশ-বিরােধী প্রচারণার জন্য মুক্তি নামের একটি। সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে। টোরিদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য এবং লন্ডনস্থ পাকিস্তান সােসাইটির প্রতিষ্ঠাতা জন। বিগ ডেভিডসন এমপি তার বক্তৃতায় পাকিস্তানি গণতন্ত্রের প্রশংসা করেন। অন্যান্য বক্তা মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, বি বি সি এবং ব্রিটিশ শ্রমিক দলের বিরুদ্ধে বিষােদ্গার করেন। ১৬ আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত এক রিপাের্টে বলা হয়, দু’সপ্তাহ আগে। ট্রাফালগার স্কোয়ারে বাংলাদেশের সমর্থক বাঙালিদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত গণসমাবেশের পাল্টা জবাব হিসেবে পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্ট’ ১৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত জনসমাবেশের আয়ােজন করে। এপ্রিল মাসে আবুল হায়াতের নেতৃত্বে। বার্মিংহামে এই প্রতিষ্ঠানটি জন্মলাভ করে। পূর্ব বঙ্গে গণহত্যা সংঘটনের অভিযােগ অস্বীকার করে পাকিস্তান হাই কমিশন প্রকাশিত একটি প্রচারপত্র ট্রাফালগার স্কোয়ারের জনসমাবেশে বিলি ।করা হয়। কয়েকটি প্ল্যাকার্ডে ইয়াহিয়া খানের ছবি দেখা যায়। এই ছবিগুলাে। পাকিস্তান হাই কমিশন থেকে সরবরাহ করা হয় বলে দি গার্ডিয়ান’-এর রিপাের্টে। উল্লেখ করা হয়।
১৬ আগস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম, হােসেন এবং বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এম. ইসলাম লিখিত একখানি চিঠি ‘দি। টাইমস’-এ প্রকাশিত হয়। এই চিঠিতে তারা গত ৭ জুলাই প্রকাশিত ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হুসাইন ও ড. মােহর আলীর চিঠির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। ড. সাজ্জাদ হুসাইন ও ড. মােহর আলী তাদের চিঠিতে বলেন, চট্টগ্রাম কিংবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনাে বাঙালি অধ্যাপককে হত্যা করা হয় নি। এর। উত্তরে অধ্যাপক এম, হােসেন ও অধ্যাপক এম. ইসলাম বলেন, ১৩ এপ্রিল। রাজশাহী দখল করার পর পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী গণিতশাস্ত্র বিভাগের হাবিবুর রহমান ও ভাষাতত্ত্ব বিভাগের এস আর সমাদ্দারকে তাদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে। গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। ড. সাজ্জাদ হুসাইন তখনও পর্যন্ত রাজশাহী। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত উপাচার্যের বাসভবনে বসবাস করছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের খবর তার অজানা থাকার কথা নয়। ১৬ আগস্ট ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত অর্ধ-পৃষ্ঠাব্যাপী এক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করার জন্য । বিশ্ব জনমতের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। তার একটি প্রতিকৃতির নিচে পাকিস্তান। জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণ ও গণহত্যা এবং সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর গােপন-বিচার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তথ্য দেয়া হয়। এই বিজ্ঞাপনের উদ্যোক্তাদের তালিকায় ৬৮টি প্রতিষ্ঠানের নামােল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি এ সম্পর্কে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি লন্ডনের ওয়ালডর্ফ হােটেলে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রীতিঅনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসােসিয়েশন’ এই অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে পুলিন বিহারী শীল ও ড. গিয়াস উদ্দিন বিচারপতি চৌধুরীকে প্রধান অতিথি হওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তারা উভয়েই বাঙালি। মি, শীল ত্রিশের দশকে চট্টগ্রাম থেকে লেখাপড়ার জন্য ব্রিটেনে আসেন এবং তখন থেকেই এ দেশে বসবাস করছেন। ইউরােপে ভারতের স্বাধানতা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য মি, শীল ও ড. গিয়াসউদ্দিন এই অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেন। এই প্রীতি-অনুষ্ঠানে মুসলিম দেশগুলাে ছাড়া অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতগণ যােগদান করেন। পূর্ব ইউরােপের প্রায় প্রত্যেকটি দেশ এবং সাইপ্রাস, কিউবা, মরিশাস প্রভৃতি দেশের রাষ্ট্রদূত, ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনার, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনেক সদস্য এবং বহু সাংবাদিক এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থনদানের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য। স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করে বক্তৃতা দেন। | এই অনুষ্ঠানে মি. শীল গভর্নমেন্ট বাই মার্ডার’ (হত্যার মাধ্যমে শাসন) শীর্ষক একটি প্রচারপত্র বিলি করেন।১০১ | বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে বিচারপতি চৌধুরী ১৭ আগস্ট সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় একটি আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ৫ আগস্ট জেনেভায় অবস্থানকালে এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে তিনি লন্ডনে ফিরে এসেছিলেন। তার পরামর্শ অনুযায়ী স্থানীয় বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি সম্মেলন অনুষ্ঠানের কথা ঘােষণা করে। সুইজারল্যান্ডের সমাজতান্ত্রিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জা জিগলার এ সম্পর্কে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফেডারেল পার্লামেন্টের স্থানীয় সদস্যদের ব্যবহারের জন্য জেনেভা শহরে একটি ভবন রয়েছে। এই ভবনের প্রেস রুমে মি.। জিগলার সম্মেলনের ব্যবস্থা করেন। ১৭ আগস্ট সকাল সাড়ে দশটায় বিচারপতি চৌধুরী জেনেভা বিমানবন্দরে পোঁছান। সুইজারল্যান্ডের বিশিষ্ট নাগরিক মাদাম ক্যাথলিন লা প্য তাকে অভ্যর্থনা জানান। তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, তাঁকে ভিসা মধুর করা হয়নি বিধায় তার সাংবাদিক সম্মেলন বাতিল করা হয়েছে বলে পাকিস্তানি দূতাবাসের উদ্যোগে। জেনেভায় অবস্থিত জাতিসংঘের প্রেস রুমে একটি বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছিল। এই খবর পেয়ে মাদাম লা প্য ও তাঁর সহকর্মীরা পাল্টা বিজ্ঞাপনে ঘােষণা করেন, পাকিস্তানি দূতাবাসের মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক বিজ্ঞপ্তি উপেক্ষা করে সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করার জন্য তারা বাংলাদেশের প্রতিনিধি বিচারপতি চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং সম্মেলন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে। প্রবেশ-ভিসা থাকা সত্ত্বেও বিমানবন্দরে বিচারপতি চৌধুরীর পাসপাের্টে এন্ট্রি সিল’ সঙ্গে সঙ্গে দেয়া হয় নি। এ ব্যাপারে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের হাত রয়েছে বলে। মাদাম লা প মনে করেন। বিকেলবেলা সাংবাদিক সম্মেলনের আগে দু’জন সুইস ফেডারেল পুলিশ। অফিসার বিচারপতি চৌধুরীর হােটেলে গিয়ে তাকে বলেন, তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য রাজধানী বার্ন থেকে তারা এসেছেন। পাকিস্তানিদের দুরভিসন্ধি রয়েছে বলে তারা খবর পেয়েছেন।
ফেডারেল পার্লামেন্টের জেনেভা অফিসে পৌঁছে বিচারপতি চৌধুরী মি.। জিগলারের রুমে যান। মাদাম লা প্য প্রেস রুম থেকে ঘুরে এসে বললেন, পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞপ্তির ফলে সাংবাদিকদের আগ্রহ বেড়ে গেছে। তার ফলে বহু সাংবাদিক প্রেস রুমে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। | সাংবাদিকদের ভিড়ের মধ্যে পাকিস্তানি দূতাবাসের একজন সেকেন্ড সেক্রেটারি। ছিলেন। বিচারপতি প্রেস রুম থেকে মি, জিগলারের রুমে ফিরে এসে মাদাম লা । প্য, সম্মেলনের কয়েকজন আয়ােজনকারী এবং বার্ন থেকে আগত পুলিশ। অফিসারদের বলেন : “এই সম্মেলন সাংবাদিকদের জন্য, পাকিস্তানি কূটনীতিবিদ এখানে আসতে পারেন না।’ তারা বলেন, এ প্রশ্ন তাঁকে করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেছেন, দূতাবাসের জনসংযােগ অফিসার পদে তিনি নিয়ােজিত। অতএব, তাকেও সাংবাদিক হিসেবে। গণ্য করতে হবে। বিচারপতি চৌধুরী বলেন : “তিনি দূতাবাসের অফিসার, কিন্তু পেশাগতভাবে সাংবাদিক নন অথবা কোনাে সংবাদপত্র বা সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধি নন। অতএব, তার প্রবেশাধিকার নেই, একথা তাকে বুঝিয়ে বলুন।’ শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি দূতাবাসের অফিসার প্রেস রুম থেকে চলে যান। সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন সম্পর্কেও সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরদিন ‘লা সুইস’, ‘ট্রিবিউন দ্য জেনিডসহ সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন পত্রিকায় পুরাে পৃষ্ঠাব্যাপী সম্মেলনের খবর ও বাংলাদেশ আন্দোলনের ইতিহাস প্রকাশিত। হয়। পত্রিকাগুলাে বড় বড় হরফে পাকিস্তানিদের বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞপ্তির কথা উল্লেখ করে। কয়েকটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির ছবিও প্রকাশিত হয়।১০২ ১৭ আগস্ট আন্তর্জাতিক ওমেগা পিস টিমের আটজন ব্রিটিশ ও তিনজন আমেরিকান কর্মী পাকিস্তানি আক্রমণের ফলে আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ওষুধপত্র এবং অন্যান্য সাহায্য-সামগ্রী নিয়ে পেত্রাপােল পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ইয়াহিয়ার সৈন্যরা তাদের গ্রেফতার করে জেলখানায় আটক রাখে। ১৮ আগস্ট ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত উক্ত সংবাদে বলা হয়, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন ওমেগার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতার স্ত্রী এলেন কনেট এবং আরাে কয়েকজন মহিলা। তারা পিস টিমের অগ্রগামী দল হিসেবে একটি ভ্যানযােগে ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ার থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ওমেগার কর্মীরা যশাের জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন। ১৮ আগস্ট বিচারপতি চৌধুরী জেনেভায় লীগ অব রেডক্রস এবং ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেডক্রসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার জন্য তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার অনুরােধ জানান। সেদিন বিকেলবেলা তিনি লন্ডনে ফিরে আসেন।
২১ আগস্ট লন্ডনে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, পাকিস্তানি আইনজীবী এ কে ব্রোহি সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের পক্ষ সমর্থন করবেন। সামরিক শাসনকর্তার প্রধান কার্যালয় থেকে জারি করা এক বিবৃতিতে এই সংবাদ প্রকাশ করা হয়। ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, মি. ব্রোহি এই দায়িত্ব। গ্রহণে রাজি ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত আইন দপ্তরের অনুরােধে তিনি রাজি হন। ২১ আগস্ট (শনিবার) সকালবেলা ইরাকে নিয়ােজিত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ টেলিফোনযােগে বিচারপতি চৌধুরীর প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করবেন বলে বিচারপতি চৌধুরীকে জানান। | সেদিন বিকেলবেলা গােরিং স্ট্রিটের অফিসে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে মি, ফতেহ তার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। তার এই সিদ্ধান্তের কথা বিচারপতি চৌধুরী তারবার্তা পাঠিয়ে মুজিবনগর সরকারকে জানিয়ে দেন। সাংবাদিক সম্মেলনে মি, ফতেহ বলেন, সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হওয়ার পর তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইরাকের রাজধানী বাগদাদ ত্যাগ করার দিন তিনি দূতাবাস থেকে বেরিয়ে সরাসরি ব্যাঙ্কে গিয়ে দূতাবাসের একাউন্ট থেকে ২৫ হাজার পাউন্ড তুলে নেন। ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সহায়তায় উক্ত অর্থ ‘মুজিবনগর’ | সরকারের কাছে পাঠানাের ব্যবস্থা করে তিনি সপরিবারে ইরাক থেকে ট্যাক্সিযােগে দশ মাইল পার হয়ে কুয়েত বিমানবন্দর থেকে লন্ডনের পথে রওনা হন। আগস্ট
মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় বিশজন বাঙালি কূটনৈতিক অফিসার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে যােগ দেন। তাদের মধ্যে মি, ফতেহ ছিলেন সবচেয়ে উচ্চপদস্থ অফিসার। তার লন্ডনে আগমন সংবাদ বিভিন্ন পত্রিকায় বিশেষ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়। কিছুকাল পর ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বিচারপতি চৌধুরীকে বলা হয়, আবুল। ফতেহুর বিরুদ্ধে পাকিস্তান হাই কমিশন এক অভিযােগ পেশ করেছে। ইরাকের ব্যাঙ্ক থেকে পাকিস্তান সরকারের অর্থ তুলে নিয়ে আসার অভিযােগে মি. ফতেহকে পাকিস্তান সরকারের হস্তে অর্পণ করার সরাসরি অনুরােধ আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তাকে জানানাে হয়। মি, ফতেহ বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্য ‘মুজিবনগর’-এ যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। পাকিস্তান সরকারের মতলব টের পাওয়ার পর অবিলম্বে তার ‘মুজিবনগর’-এ চলে যাওয়া বাঞ্ছনীয় বলে বিবেচিত হয়। যাওয়ার আগে তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।১০৩ ২৩ আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বার্মিংহামের বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির প্রেসিডেন্ট জগলুল পাশা ছ’ হাজার পাঁচশ’ পাউন্ডের একখানি চেক পশ্চিম বঙ্গে আশ্রয়গ্রহণকারী দুস্থ বাঙালিদের সাহায্যার্থে লন্ডনস্থ ভারতীয় হাই কমিশনার আপা পন্থের হস্তে অর্পণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম-বিরােধী পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্টের কনভেনার মােহাম্মদ আবুল হায়াতের দস্তখতে প্রেরিত একখানি চিঠি ২৩ আগস্ট “দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত হয়। এই চিঠিতে ১৯ আগস্ট প্রকাশিত এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভিক্টর কিয়েরনানের চিঠির বালকসুলভ প্রতিবাদ করা। হয়। অধ্যাপক কিয়েরনান ১৫ আগস্ট ট্রাফালগার স্কোয়ারে ইয়াহিয়ার সমর্থনে অনুষ্ঠিত জনসমাবেশের উল্লেখ করে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা এই সমাবেশে অংশগ্রহণ করে। আবুল হায়াত নিজেকে পূর্ব পাকিস্তানি হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলে, জনসমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই পূর্ব বঙ্গের নাগরিক। অধ্যাপক কিয়েরনান তাঁর চিঠিতে বলেন, পাকিস্তানে জনজীবন সভ্যতার মাপকাঠি দিয়ে বিচার করা চলে না এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের মান অত্যন্ত নিচু। আবুল হায়াত তার প্রতিবাদ করে বলেন, “ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার আগে আমরা। (অর্থাৎ মুসলমানরা) ৮শ’ বছর যাবৎ শাসন করেছি। তিনশ’ বছরব্যাপী মােগল শাসনের পূর্বে এবং পরবর্তীকালে দেশে অধিকতর শান্তি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সামাজিক ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা বজায় ছিল। ব্রিটিশ রাজের অ্যুদয়ের ফলে আমাদের (অর্থাৎ মুসলমানদের) দুর্দশা শুরু হয়।’ চিঠির উপসংহারে আবুল হায়াত বলেন, পাকিস্তানের ‘নিচু মানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব’ সমাজের সবচেয়ে বেশি পাশ্চাত্যমুখী অংশ থেকে এসেছে।
২৪ আগস্ট ‘দি মনিং স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি এবং জাতিসংঘের মানবিক অধিকার কমিশনের সদস্য বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশে ইয়াহিয়া সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে আলােচনা করার উদ্দেশ্যে কমিশনের জরুরি সভা আহ্বান করার জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্টকে অনুরােধ জানিয়ে এক তারবার্তা প্রেরণ করেন। এই তারবার্তায় তিনি আরও বলেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নেতা শেখ মুজিবকে বিচার করার আইনগত অধিকার পাকিস্তানের নেই। ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনের বেজওয়াটার এলাকার নটিংহিল গেইট টিউব স্টেশনের কাছে ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেন্সে প্রায় ৩শ’ বাঙালি, কয়েকজন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য এবং বহু বিদেশী সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ মিশনের দ্বারােদঘাটন করেন। ভারতের বাইরে লন্ডনেই বাংলাদেশের প্রথম কূটনৈতিক মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। দূতাবাসের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করার পর বিচারপতি চৌধুরী বলেন, লন্ডন থেকেই বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সংযােগ রক্ষা করা হবে এবং লন্ডনই হবে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র। পরবর্তীকালে লন্ডনে এক সাক্ষাৎকার উপলক্ষে স্টিয়ারিং কমিটির ভারপ্রাপ্ত কনভেনার শেখ আবদুল মান্নান বলেন, জাকারিয়া খান চৌধুরী খবর নিয়ে এলেন, বেজওয়াটার এলাকায় ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেনের বাড়িটি কূটনৈতিক মিশনের জন্য পাওয়া যেতে পারে। এই বাড়িতে তখন টক-এই নামের প্রতিষ্ঠান পরিচালিত একটি আন্তর্জাতিক হােস্টেল ছিল। ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’-এর চেয়ারম্যান ডােনাল্ড চেস্ওয়ার্থ এই হােস্টেলের ওয়ার্ডেন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মি. চেসওয়ার্থ প্রথম থেকেই বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। “ওয়ার অন ওয়ান্ট’-এর পক্ষ থেকে তিনি ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারীদের সাহায্যের ব্যবস্থা করার জন্য কয়েকবার কলকাতা যান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে তখন তার পরিচয় হয়। মে মাসে মি, চেস্ওয়ার্থ বাংলাদেশ ফান্ডের অন্যতম ট্রাস্টি পদে নিয়ােজিত হন।
বিচারপতি চৌধুরী, শেখ আবদুল মান্নান ও জাকারিয়া খান চৌধুরী ডােনাল্ড চেস্ওয়ার্থের সঙ্গে দেখা করেন। মি, চেসওয়ার্থ হােস্টেলের গ্রাউন্ড ফ্লোরের রুমগুলাে নামমাত্র ভাড়ায় বাংলাদেশ মিশনকে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। উদ্বােধনী বক্তৃতায় বিচারপতি চৌধুরী বলেন, ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী পূর্ব বঙ্গে গণহত্যা শুরু করার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করা হয়। ১৭ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়। উপরােক্ত ঘােষণা অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনের জন্য বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হয়, জলে। গ্রেট ব্রিটেন-প্রবাসী বাঙালিরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। এই স্বাধীন দেশের সরকারি প্রতীক হিসেবে একটি মিশন স্থাপনের জন্য তাদের আগ্রহ ও বাসনা বিচার করে গত ১ আগস্ট বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের কথা ঘােষণা করা হয়। ১১ নম্বর গােরিং স্ট্রিটে মিশনের কাজ অবিলম্বে শুরু করা হয়। এখন থেকে ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেন্সে মিশনের কাজ যথারীতি পরিচালিত হবে। গত ২৩ বছর যাবৎ পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব বঙ্গকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উপনিবেশ এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শােষণের শিকার হিসেবে ব্যবহার করেছে। আইনসঙ্গতভাবে আমাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সত্য ও ন্যায়পরায়ণতা বিসর্জন দিয়ে ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী ধ্বংসযজ্ঞে আত্মনিয়ােগ। করেছে। তারা এখনও গণহত্যায় নিয়ােজিত রয়েছে। ইতােমধ্যে তারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে, যে জাতি মৃত্যুকে জয় করেছে তাকে সামরিক বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে পরাজিত করা সম্ভব নয়। * আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের নির্ভীক ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ নেতাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁকে বেআইনিভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তাঁর বিচার-অনুষ্ঠান বর্বরােচিত কাজ। তার যদি কোনাে ক্ষতি হয়, তাহলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি কখনও তা ক্ষমা করবে না। শেখ মুজিব একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট। তার বিচার করার অধিকার অন্য কোনাে দেশের নেই। আমরা অবিলম্বে তাঁর মুক্তি দাবি করি।
সবচেয়ে জরুরি যে-কথাটি মনে রাখা দরকার তা হলাে পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। এর ফলে দুটি নতুন দেশের জন্ম হয়েছে। ইতঃপূর্বে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটি এখন স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। পূর্ববর্তী অবস্থায় আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়— একথা কখনও ভুলে যাওয়া চলবে না। ইয়াহিয়া খানের হানাদার সৈন্যদের তাড়িয়ে দিয়ে আমরা একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ে তুলবাে। এ দেশে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য। ধর্মাবলম্বীরা সাম্য ও মৈত্রীর ভিত্তিতে সমান মানবাধিকার ভােগ করবে। উপসংহারে বিচারপতি চৌধুরী শেখ মুজিবের মুক্তির নিশ্চয়তা বিধান ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনগণ ও সরকারের কাছে আবেদন জানান।১০৪ দূতাবাস উদ্বোধনের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশের সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করে বক্তৃতা করেন। উদ্বোধনের দিন দূতাবাসের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আবুল ফতেহ, মহিউদ্দিন আহমদ, লুৎফুল মতিন, শিল্পী আবদুর রউফ, মহিউদ্দিন আহমদ চৌধুরী, আবদুস সালাম, এ কে এম নূরুল হুদা ও ফজলুল হক চৌধুরী। মুজিবনগর সরকার ইতঃপূর্বে বিচারপতি চৌধুরীকে হাই কমিশনার পদে নিয়ােগ করে ‘লেটার অব ক্রিডেন্স’ (কূটনৈতিক পরিচয়পত্র) প্রেরণ করে। অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামের দস্তখত সংবলিত এই পরিচয়পত্র আবার ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানাে হয়। বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের পর বিচারপতি চৌধুরী হলু-ঘরে উদ্বোধনী ভাষণ দেয়ার সময় একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা সংঘটিত হয়। বিনা আমন্ত্রণে কয়েকটি কোচবােঝাই পুলিশ অফিসার মিশনের সামনে এসে পাহারার দায়িত্ব গ্রহণ করে। অনুষ্ঠানের শেষে তাদের সবাইকে প্রতি অনুষ্ঠানে যােগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানাে হয়।
পরদিন সংবাদপত্র পড়ে বােঝা গেল, পুলিশ কেন পাহারাদানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশ মিশনে অনুষ্ঠান চলার সময় পাকিস্তানি হাই কমিশনার সালমান আলী ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে মিশন স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। প্রতিমন্ত্রী জোসেফ গডবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মি. আলী বলেন, তাঁর দেশের এক অংশের নাম পূর্ব পাকিস্তান। এই অংশের নাম বদল করে বাংলাদেশ নাম নিয়ে লন্ডনে দূতাবাস স্থাপন পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের প্রতি অবমাননাকর। ব্রিটেন পাকিস্তানের বন্ধু-রাষ্ট্র। অতএব, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া ব্রিটিশ সরকারে কর্তব্য। মি, গড়বার মনােযােগ দিয়ে তার বক্তব্য শুনে বলেন, এ ধরনের নাম ব্যবহার ব্রিটেন সমর্থন করে না। পাকিস্তান সরকারকে ব্রিটেন প্রদত্ত স্বীকৃতি অব্যাহত রয়েছে। অতএব, বাংলাদেশ মিশনকে কূটনৈতিক মর্যাদা দেয়ার প্রশ্ন অবান্তর। প্রায় এক ঘণ্টাকাল আলােচনার পর মি, আলী তার কূটনৈতিক চাল সফল হয়েছে বলে অনুমান করে পররাষ্ট্র দপ্তর ত্যাগ করেন। পাকিস্তানের প্রতিবাদ সম্পর্কে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মধ্যে। আলােচনার মর্ম অপ্রকাশিত থাকা সত্ত্বেও পরিষ্কার বােঝা যায়, পাকিস্তানিদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যই বাংলাদেশ মিশনের বাইরে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।১০৫ – দূতাবাস স্থাপিত হওয়ার পর সরকারি অফিসারগণ ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেন্সে। এবং বেসরকারি কর্মকর্তারা ১১ নম্বর গােরিং স্ট্রিটে অফিসের কাজ করবেন বলে বিচারপতি চৌধুরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গােরিং স্ট্রিটের কর্মকর্তারা সাংগঠনিক ও প্রচারকার্য এবং পেমব্রিজ গার্ডেন্সের অফিসাররা কূটনৈতিক কার্য-পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিচারপতি চৌধুরী সকালবেলা গােরিং স্ট্রিটে এবং বিকেলবেলা পেমব্রিজ গার্ডেন্সে উপস্থিত থেকে বাংলাদেশ আন্দোলন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাস পর বিশিষ্ট বাঙালি শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম তার এক পাঞ্জাবি বন্ধুর সহায়তায় চিকিৎসার অজুহাতে লন্ডনে আসার অনুমতি নিয়ে দেশত্যাগ করেন। জুলাই মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসােসিয়েশনের কর্মকর্তা ড. মােশাররফ হােসেন জোয়ারদার বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, মি. ইসলাম তার সঙ্গে দেখা করতে চান। চিকিৎসার অজুহাতে তিনি লন্ডনের লুইসাম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ড. জোয়ারদারের গাড়িতে হাসপাতালে গিয়ে বিচারপতি চৌধুরী তার সঙ্গে দেখা করেন। মি. ইসলাম বলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য অর্থ সাহায্য করার অনুরােধ তিনি তাজউদ্দিন আহমদের কাছ থেকে পেয়েছেন। তিনি নিজেও স্বাধীনতা আন্দোলনে সাহায্য করতে চান। বিচারপতি চৌধুরী বলেন, মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র ক্রয় এবং স্টিয়ারিং কমিটির ব্যয়ভার বহনের জন্য বাংলাদেশ ফান্ড’ নামে একটি তহবিল। খােলা হয়েছে। চাদাদানকারীরা এই তহবিলের অর্থ অন্য কোনাে খাতে খরচ করার পক্ষপাতী নন। প্রস্তাবিত দূতাবাসের জন্য প্রতি মাসে দু’ থেকে আড়াই হাজার পাউন্ড প্রয়ােজন হবে। মি. ইসলাম যদি দূতাবাসের খরচ চালিয়ে নেন, তাহলে বিচারপতি চৌধুরী নিশ্চিন্ত মনে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। মি. ইসলাম এক কথায় রাজি হয়ে বললেন, প্রতি মাসে তিনি ড. জোয়ারদারের মারফত দু’হাজার পাউন্ড পাঠাবেন। ঢাকায় অবস্থানরত মি. ইসলামের পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার খাতিরে উল্লিখিত অর্থ অন্য কারাে নামে জমা করে নিতে হবে। তারা তিনজনে মিলে ঠিক করলেন, প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ড. জোয়ারদার উল্লিখিত পরিমাণ অর্থ মি, ইসলামের কাছ থেকে নিয়ে আসবেন। অর্থ প্রদানকারীর নিরাপত্তার খাতিরে জনৈক সুবিদ আলীর নামে তা জমা দেয়া হবে। দূতাবাসের ফিনান্স ডাইরেক্টর লুৎফুল মতিন এই অর্থ গ্রহণ করে প্রতি মাসে সুবিদ আলীর নামে যথারীতি রসিদ প্রদান করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত মি. ইসলাম বাংলাদেশ মিশনের ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব পালন করেন।১০৬ ৩০ আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত ওয়াশিংটন ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক। সম্পাদকীয় মন্তব্যে ইয়াহিয়া খানকে বাংলাদেশের ভয়াবহ পরিণতির জন্য দায়ী। করা হয়। নির্বাচনে শেখ মুজিবের জয়লাভের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, জেনারেল ইয়াহিয়াকে কয়েকজন সহকর্মী জেনারেল ছাড়া আর কেউ ভােট দেন নি। শেখ মুজিব সম্ভবত জীবিত রয়েছেন এবং সামরিক আদালতে তার গােপন বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তার বহু সমর্থককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং বাকিদের দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। গত বছর যেখানে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন। অনুষ্ঠিত হয় আজ সেখানে ক্রমবর্ধমান গেরিলা-সংঘর্ষ, অনশন ও ভীতি বিরাজমান।
অর্থবহ সত্তা হিসেবে পাকিস্তানের কোনাে অস্তিত্ব নেই। উপসংহারে বলা হয়, ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউম গত কয়েক মাস যাবৎ ঘৃণাসূচক বক্তৃতাদান ছাড়া আর কিছুই করেন নি। তিনি অন্তত একটা প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। ওয়াশিংটন সফর করে তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে কিছু অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিটেনের মনােভাব জ্ঞাপন করতে পারেন। এতে হয় তাে কোনাে ফল হবে না। তা সত্ত্বেও এই প্রচেষ্টা ন্যায্য পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। আগস্ট মাসের শেষ দিকে রুমানিয়ায় বিজ্ঞান ও বিশ্ব-শান্তি’ শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি চৌধুরী ছাত্রনেতা মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জুকে সম্মেলনে যােগদানকারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে তাদের অবহিত করার উদ্দেশ্যে রুমানিয়ায় যাওয়ার জন্য অনুরােধ করেন। বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কিত প্রচার-পুস্তিকা নিয়ে তিনি। ৩০ আগস্ট রুমানিয়ায় পৌঁছান। ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতা সারাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে মােহাম্মদ হােসেন মন্তু তাঁর কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে আলােচনা করেন। ভারতীয় দলে অন্য দু’জন সদস্য শিশির গুপ্ত ও হােসেন জাহির তাকে অন্যান্য দেশের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি মার্কিন প্রতিনিধিদলের সদস্য জেরি স্মিথের সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানে সমরাস্ত্র প্রেরণ বন্ধ করার জন্য অনুরােধ জানান। এরপর তিনি সােভিয়েত প্রতিনিধিদলের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। তারা বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে যথাসাধ্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন।১০৭
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি – যুক্তরাজ্য – আবদুল মতিন