You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ ইয়াহিয়া খানের সাথে বাক্যবিনিময় কিংবা করমর্দন করতে রাজি নন - সংগ্রামের নোটবুক

জুন, ১৯৭১

১ জুন লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনের মুখপত্র পাকিস্তান নিউজ-এ পূর্ব বঙ্গের ৫৫জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীর নামে প্রচারিত একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। মে মাসে নিউইয়র্কের ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব ইউনিভার্সিটি এমেরিটাস্ পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক বিবৃতি প্রচার করে। মার্কিন শিক্ষাবিদদের বিবৃতির অসারতা প্রমাণ করার জন্য পাকিস্তানের সামরিকচক্র মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে। পূর্ব বঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের নামে ১৬ মে ঢাকা থেকে প্রচারিত এই বিবৃতিতে বলা হয়, সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে তথাকথিত চরমপন্থীরা স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে একতরফাভাবে স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করছে এবং যারা এর বিরােধিতা করে তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। এই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, মেশিনগান ও মর্টার সংগ্রহ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ছাত্রাবাস জগন্নাথ হলকে গােপন অস্ত্রাগারে পরিণত করে হলের প্রাঙ্গণ মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এই সশস্ত্র প্রচেষ্টা বানচাল করে দিয়ে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে বলে বিবৃতিতে স্বাক্ষরদানকারীরা সন্তোষ প্রকাশ করেন। স্বাক্ষরদানকারীদের মধ্যে ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন, কাজী দীন মােহাম্মদ, শামসুল হুদা চৌধুরী এবং আরাে কয়েকজন পাকিস্তানপন্থীর নাম দেখে প্রবাসী বাঙালিরা এই বিবৃতি পাকিস্তানি অপপ্রচারের উদাহরণ বলে নিশ্চিত হন। ভারতীয় সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে কায়রাে, রােম, হেলসিংকি, পারী ও মস্কো সফরের পর ২ জুন লন্ডনে পৌঁছান। পল কনেট ও মারিয়েটা প্রকোপের উদ্যোগে অ্যাকশন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠিত এক সভায় মি, নারায়ণ বলেন : বাংলাদেশ চিরস্থায়ী হবে এবং বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ ইয়াহিয়া খান কিংবা বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে ব্যক্তির সঙ্গে বাক্যবিনিময় কিংবা করমর্দন করতে রাজি নন।… আমি শান্তিবাদী; কিন্তু ইয়াহিয়া খানের নিষ্ঠুর সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালিদের সশস্ত্র প্রতিরােধের নিন্দা করতে আমি রাজি নই। যুদ্ধের জন্য ভারতের তৈরি হওয়া উচিত।’ এই সভায় তিনজন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যজন স্টোনহাউস, পিটার শাের ও মাইকেল বার্ন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বক্তৃতা করেন। তাদের বক্তৃতার পর বিচারপতি চৌধুরী সবাইকে ধন্যবাদ জানান এবং মি, নারায়ণের বিদেশ সফরের সাফল্য কামনা করেন। ৪ জুন জয়প্রকাশ নারায়ণের সম্মানার্থে লন্ডন অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে একটি চা-চক্রের আয়ােজন করা হয়। এই সমাবেশে লন্ডন কমিটির পক্ষ থেকে গাউস খান এবং স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে শেখ আবদুল মান্নান তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বক্তৃতা করেন। বিচারপতি চৌধুরী মি. নারায়ণের জীবন-দর্শনের ওপর আলােকপাত করেন।

৪ জুন (শুক্রবার) বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে একটি মিছিলের আয়ােজন করে। সমিতির সভানেত্রী মিসেস জেবুন্নেসা বসের নেতৃত্বে প্রায় দু’শ মহিলা ও শিশু সেন্ট জেমস পার্ক থেকে মিছিল করে। ডাউনিং স্ট্রিটে যান। অবিলম্বে গণহত্যার অবসান ও স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবি সংবলিত পােস্টার ও প্ল্যাকার্ড-ধারিণী শাড়ি পরিহিতা মহিলারা সহজেই পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। দু’বােন সমিতির ব্যানার বহন করেন। এঁদের মধ্যে একজন তার স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে দু’সপ্তাহ আগে লন্ডনে পৌছাতে সক্ষম হন। মিসেস জাহানারা রহমান ও মিসেস আনােয়ার জাহান মিছিল পরিচালনার ব্যাপারে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন। | মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদলের নেত্রী হিসেবে মিসেস বস্ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। এই স্মারকলিপিতে ইয়াহিয়া সরকারকে সাহায্যদান অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত। পুনর্বিবেচনা করার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে অনুরােধ জানানাে হয়। বর্তমান। পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকারকে সাহায্যদান অব্যাহত রাখা হলে বাংলাদেশে বহু পরিবারের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাবে এবং বহু লােকের মৃত্যু ঘটবে বলে স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়।  ৫ জুন ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক রিপাের্টে বলা হয়, মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে ‘সেইভ দি চিলড্রেন ফান্ড’, দি ব্রিটিশ রেডক্রস সােসাইটি’ এবং ক্রিস্টিয়ান এইড’ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের কাছে অবিলম্বে ত্রাণকার্য শুরু করার জন্য একটি আবেদন। পেশ করা হয়। ৫ জুন শেফিল্ড অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে স্থানীয় টাউন হলে একটি জনসভার আয়ােজন করা হয়। শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রীতিশ মজুমদার এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাঙালি, ভারতীয় ও ইংরেজ শ্রোতারা সভায় উপস্থিত ছিলেন। শেখ আবদুল মান্নান, ড, জোয়ারদার এবং অপর কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে বিচারপতি চৌধুরী এই সভায় যােগদানের জন্য লন্ডন থেকে শেফিল্ড যান। হলে ঢােকার আগে প্রীতিশ মজুমদার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, স্যার, আপনাকে একটা দুঃসংবাদ দিতে হচ্ছে। আমরা তাে সভা করতে পারছি না। পাকিস্তানিরা হলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

হলঘরটিও তারা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। বিচারপতি চৌধুরীর সহকর্মীরা বললেন, হলে আমরা ঢুকবাে এবং সভা হবেই। যে-কোনাে পরিস্থিতির মােকাবিলা করার জন্য আমরা তৈরি রয়েছি। হলে ঢােকার সময় বিরােধী পক্ষ গােলমাল সৃষ্টির চেষ্টা করে। তারা দু’তিন টুকরাে পাথর ছুঁড়ে মারে এবং ব্যারিকেড তৈরি করে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করে। বিচারপতি চৌধুরী ও তার সহকর্মীরা ‘ব্যারিকেড ভেঙে হলে ঢুকে পড়েন। পুলিশ দক্ষতার সঙ্গে শৃঙ্খলা বজায় রাখে। সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বিচারপতি চৌধুরী বলেন : ‘আমরা একটি পবিত্র সাধনায় লিপ্ত। বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে সেখানে সংসদীয় গণতন্ত্র স্থাপনে আমরা দৃঢ়সঙ্কল্প। ব্রিটেনের মতাে নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী দেশ শাসন করবেন। মানুষের মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হবে; সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে মানুষের মনে নিরাপত্তাবােধ স্থায়ী করতে হবে। সেই মহৎ জীবনের লক্ষ্যে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে দৃপ্ত পদক্ষেপে।” সভায় বক্তৃতাদানকারীদের মধ্যে ছিলেন শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফ্র্যাঙ্ক গার্লিং, আফরােজ চৌধুরী, কবীর চৌধুরী ও শেখ আবদুল মান্নান। হলের বাইরে একদল পাকিস্তানি জমায়েত হয়। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা থাকায় দু’শ ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ তাদের প্রতি নজর রাখে।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের রিডার ও শেখ মুজিবের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সােবহান মে মাসে কলকাতা থেকে লন্ডন হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে তিনি এইড কন্সর্শিয়াম’-এর সদস্য দেশগুলাের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্যদান বন্ধ করার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন।  জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনে ফিরে এসে অধ্যাপক সােবহান কয়েকটি প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদপত্রের সম্পাদক ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর ফলে ৪ ও ৫ জুন ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় তার দুটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রথম নিবন্ধে তিনি পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্যদান বন্ধ রাখার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন  করেন।

দ্বিতীয় নিবন্ধে তিনি মুজিব-ইয়াহিয়া আলােচনার পটভূমি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, পূর্ব বঙ্গে গণহত্যা সংঘটনের পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্ভবত ১ ও ৬ মার্চের মধ্যে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ৪ জুন সাপ্তাহিক ‘নিউ স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধ ছিল মূলত তারই বক্তব্য। নিবন্ধের উপসংহারে বলা হয়, অতঃপর ইয়াহিয়া ও তার অনুচরদের বৈদেশিক সাহায্যদানকারী দেশগুলাে পূর্ব বঙ্গে গণহত্যার দায় এড়াতে পারবে না। “দি কপূসেজ ইন দি সান” (সূর্যালােকে মৃতদেহ) শীর্ষক এই নিবন্ধ পাঠকদের অভিভূত করে। ৫ জুন মি. সােবহান স্থানীয় ‘দি গ্যাঞ্জেস’ রেস্তোরায় বাংলাদেশ নিউজলেটার ও বাংলাদেশ ফ্রিডম মুভমেন্ট ওভারসিজ’-এর কর্মী ও সমর্থকদের এক ঘরােয়া সভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। ৬ জুন লন্ডন অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে পূর্ব লন্ডনে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় পূর্ব লন্ডনে বসবাসকারী বাঙালিরা এবং বেশ কিছুসংখ্যক ইংরেজ যােগদান করেন। বিচারপতি চৌধুরী তার বক্তৃতায় প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে একতার প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। সংগ্রামের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি অপপ্রচারের তীব্র সমালােচনা করে তিনি বলেন : ‘জয় আমাদের সুনিশ্চিত। পাকিস্তানের আর্থিক সাহায্যপুষ্ট কয়েকজন বাঙালি মুক্তি’ নামের একটি বাংলা সাপ্তাহিকের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে হীন প্রচারণা চালায়। এদের মধ্যে মুক্তি পত্রিকার সম্পাদক আবুল হায়াতের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সে ভারতীয় হিন্দুদের মুসলমানবিরােধী ষড়যন্ত্র বলে দাবি করে। বিচারপতি চৌধুরীর বিরুদ্ধে সে মিথ্যা ও মানহানিকর প্রচারণা অব্যাহত রাখে। উক্ত পত্রিকাটির কয়েকটি কপি সংগ্রহ করে দেশপ্রেমিক বাঙালিরা সভামঞ্চের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে অগ্নিসংযােগ করেন। ৬ জুন ব্রিটিশ সরকার ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের সাহায্যার্থে দশ লক্ষ পাউন্ড মঞ্জুর করে। বি বি সি প্রচারিত ‘দি ওয়ার্ল্ড দিস উইকয়েন্ড’ এই সাহায্য প্রয়ােজনের তুলনায় নগণ্য বলে উল্লেখ করে। এ সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে বৈদেশিক উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী রিচার্ড উড় কিছুটা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে বলেন, অযথা বিলম্ব না করে তারা এই মজুরির কথা ঘােষণা করেছেন। তাছাড়া খাদ্য-দ্রব্য সরবরাহের সিদ্ধান্তও তারা নিয়েছেন। এই উভয় প্রকার সাহায্যের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ২০ লক্ষ পাউন্ড।

অপর এক প্রশ্নের উত্তরে মি. উড় বলেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে রাজনৈতিক মীমাংসার মাধ্যমে শান্তি স্থাপনের জন্য ব্যক্তিগত চিঠি লিখেছেন। | ৭ জুন ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক সংবাদে প্রকাশ, বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কে শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্টারি মুখপাত্র জুডিথ হার্ট ব্রিটিশ সরকার ঘােষিত সাহায্যের পরিমাণ ‘হাস্যকর’ বলে উল্লেখ করেন। পূর্ব বঙ্গে সামরিক অভিযান সম্পূর্ণ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোনাে প্রকার সাহায্যদান অনুচিত হবে। বলে তিনি মন্তব্য করেন। মে মাসের গােড়ার দিকে করাচির ইংরেজি দৈনিক দি ডন পত্রিকার লন্ডন সংবাদদাতা নাসিম আহমদ “দি রয়াল কমনওয়েলথ সােসাইটির এক সভায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীদের তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সগ্রাম শুরু হওয়ার আগে তাকে বক্তৃতাদানের আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছিল। সভায় উপস্থিত বাঙালি শ্রোতারা নাসিম আহমদের অশালীন উক্তির বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদ জানায়। রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা প্রমাণ করার জন্য সােসাইটির কর্তৃপক্ষ বিচারপতি চৌধুরীকে হাইকোর্টের জজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আওয়ামী লীগের ছয়-দফা সম্পর্কে বক্তৃতাদানের আমন্ত্রণ জানান। পাকিস্তান হাই কমিশনার সালমান আলী এই আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করার জন্য দাবি জানান। সােসাইটির কর্তৃপক্ষ এই দাবি উপেক্ষা করেন। এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার জন্য সালমান আলী পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউমের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। ৮ জুন ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপে সরকারি হস্তক্ষেপ অনুচিত বলে স্যার আলেক মন্তব্য করেন। পাকিস্তানপন্থী বাঙালি ডেপুটি হাই কমিশনার সেলিমুজ্জামান ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে সােসাইটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। ১২ জুন ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে পাকিস্তানের হাই কমিশনারের মনােভাব উদ্ধত বলে উল্লেখ করা হয়। ৮ জুন ‘দি রয়াল কমনওয়েলথ সােসাইটির হলরুমে অনুষ্ঠিত বক্তৃতায় বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ সংঘটনের জন্য পাকিস্তানের তীব্র সমালােচনা করেন। তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বিচারে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক হত্যা সম্পর্কে হৃদয়বিদারক বর্ণনা দেন, তখন শ্রোতাদের মধ্যে অনেকেই শােকে অভিভূত হন। সভার কাজ শেষ হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. ডবলিউ এ জেঙ্কিন্সের স্ত্রী লেডি জেঙ্কিন্স সভামঞ্চে গিয়ে বিচারপতি চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে নিহতদের জন্য শােক প্রকাশ করেন।

তিনি বাংলাদেশ সংগ্রামের প্রতিও সমর্থন জ্ঞাপন করেন। বিচারপতি চৌধুরী প্রত্যেকবার পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে স্যার আলেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর পাকিস্তান হাই কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানায়। এর ফলে স্যার আলেক বিচারপতি চৌধুরীকে তাঁর সরকারি বাসভবনে গিয়ে দেখা করার পরামর্শ দেন। বাসভবনে সামাজিক সাক্ষাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানাে কূটনৈতিক রীতি-বিরুদ্ধ বলে তিনি উক্ত পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, সামাজিক সাক্ষাতের সময় রাজনৈতিক আলােচনা নিষিদ্ধ নয়। ৮ জুন ‘দি টাইমস-এ প্রকাশিত এক পত্রে শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জন সম্পূর্ণ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোনাে প্রকার সাহায্যদান অনুচিত হবে। বলে তিনি মন্তব্য করেন। মে মাসের গােড়ার দিকে করাচির ইংরেজি দৈনিক দি ডন পত্রিকার লন্ডন সংবাদদাতা নাসিম আহমদ “দি রয়াল কমনওয়েলথ সােসাইটির এক সভায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীদের তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সগ্রাম শুরু হওয়ার আগে তাকে বক্তৃতাদানের আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছিল। সভায় উপস্থিত বাঙালি শ্রোতারা নাসিম আহমদের অশালীন উক্তির বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদ জানায়। রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা প্রমাণ করার জন্য সােসাইটির কর্তৃপক্ষ বিচারপতি চৌধুরীকে হাইকোর্টের জজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আওয়ামী লীগের ছয়-দফা সম্পর্কে বক্তৃতাদানের আমন্ত্রণ জানান। পাকিস্তান হাই কমিশনার সালমান আলী এই আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করার জন্য দাবি জানান। সােসাইটির কর্তৃপক্ষ এই দাবি উপেক্ষা করেন। এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার জন্য সালমান আলী পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউমের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। ৮ জুন ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপে সরকারি হস্তক্ষেপ অনুচিত বলে স্যার আলেক মন্তব্য করেন। পাকিস্তানপন্থী বাঙালি ডেপুটি হাই কমিশনার সেলিমুজ্জামান ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে সােসাইটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। ১২ জুন ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে পাকিস্তানের হাই কমিশনারের মনােভাব উদ্ধত বলে উল্লেখ করা হয়। ৮ জুন ‘দি রয়াল কমনওয়েলথ সােসাইটির হলরুমে অনুষ্ঠিত বক্তৃতায় বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ সংঘটনের জন্য পাকিস্তানের তীব্র সমালােচনা করেন। তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বিচারে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক হত্যা সম্পর্কে হৃদয়বিদারক বর্ণনা দেন, তখন শ্রোতাদের মধ্যে অনেকেই শােকে অভিভূত হন। সভার কাজ শেষ হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. ডবলিউ এ জেঙ্কিন্সের স্ত্রী লেডি জেঙ্কিন্স সভামঞ্চে গিয়ে বিচারপতি চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে নিহতদের জন্য শােক প্রকাশ করেন। তিনি বাংলাদেশ সংগ্রামের প্রতিও সমর্থন জ্ঞাপন করেন। 

বিচারপতি চৌধুরী প্রত্যেকবার পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে স্যার আলেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর পাকিস্তান হাই কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানায়। এর ফলে স্যার আলেক বিচারপতি চৌধুরীকে তাঁর সরকারি বাসভবনে গিয়ে দেখা করার পরামর্শ দেন। বাসভবনে সামাজিক সাক্ষাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানাে কূটনৈতিক রীতি-বিরুদ্ধ বলে তিনি উক্ত পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, সামাজিক সাক্ষাতের সময় রাজনৈতিক আলােচনা নিষিদ্ধ নয়। ৮ জুন ‘দি টাইমস-এ প্রকাশিত এক পত্রে শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউস পূর্ব বঙ্গে সংঘটিত গণহত্যার উল্লেখ করে নিম্নে বর্ণিত দুটি প্রস্তাব পেশ করেন : ১. পূর্ব বঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা এবং পাকিস্তান সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে অবিলম্বে সিকিউরিটি কাউন্সিলের বৈঠক ডাকা উচিত; ২. পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ পূর্ব বঙ্গে শাসন চালিয়ে যাওয়ার অধিকারী কিনা সে সম্পর্কে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলাের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। বাংলাদেশ সরকারকে পূর্ব বঙ্গের জনগণের প্রতিনিধিমূলক সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার যৌক্তিকতাও তাদের বিচার করে দেখা উচিত। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশকে যতাে তাড়াতাড়ি স্বীকৃতি দেয়া হবে, ততাে তাড়াতাড়ি পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করা সম্ভব হবে। অবরুদ্ধ ঢাকা নগরী থেকে লন্ডনে ফিরে এসে শফিক রেহমান (চার্টার্ড এ্যাকাউন্টেন্ট) দি গার্ডিয়ান ও দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সংবাদদাতাদের। সঙ্গে ৯ জুন এক সাক্ষাৎকারকালে বলেন, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের কর্মতৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। তারা মাইনের সাহায্যে রাস্তাঘাট ও রেলওয়ে লাইনের বিপুল ক্ষতিসাধন করেছে এবং খুলনাগামী স্টিমার সার্ভিস বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। মুক্তিযােদ্ধারা ওঁৎ পেতে থেকে সামরিক যানবাহনের ক্ষতিসাধন এবং পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সহযােগিতাকারী দেশদ্রোহীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে।  মি. রেহমান আরও বলেন, ঢাকায় যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের খোজখবর পাওয়া যাচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে তিনি কয়েকজন ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করেন। এদের জেরা করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। তারা ফিরে আসেন নি। যারা দেশ ত্যাগ করতে পারবেন না বলে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাদের নাম ৩৬। পৃষ্ঠাব্যাপী একটি তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তিনি নিজে সৌভাগ্যবান বলেই বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তিনি বলেন : আমরা যুদ্ধ করার মতাে মনােবলের অধিকারী। কিনা এ প্রশ্ন অবান্তর; প্রাণের দায়ে এখন আমাদের যুদ্ধ করতে হবে।’ মুক্তিবাহিনীর উদ্যোগে রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতিসাধনের ফলে ঢাকার বাইরে যাওয়া এক রকম অসম্ভব বলে তিনি প্রকাশ করেন।

টেলিফোন যােগাযােগ ব্যবস্থার গুরুতর অবনতি ঘটেছে। কেবল বিমানযােগে চট্টগ্রাম যাওয়া সম্ভব টিকেট কেনার জন্য কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার নামের একটি। শক্তিশালী বেতার কেন্দ্র থেকে সকাল ও সন্ধ্যায় ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত প্রােগ্রাম প্রচার করা হচ্ছে। ১৭ মে ঢাকায় স্টেট ব্যাঙ্ক, দুটি সিনেমা হল এবং একটি আধুনিক শপিং এলাকায় একযােগে ৮টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। মে মাসে মুক্তিবাহিনীর একটি দল সরাসরি আক্রমণ চালিয়ে নরসিংদী এলাকার একটি তথাকথিত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মিয়া আবদুল হামিদ ও তার দু’জন। সহযােগীকে হত্যার কাহিনীও তিনি সবিস্তারে বর্ণনা করেন। ৯ জুন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধিবেশনকালে মিসেস জুডিথ হার্ট বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ ২০ লক্ষ পাউন্ড অপ্রতুল বলে মন্তব্য করেন। শ্রমিক দলের পক্ষ থেকে তিনি আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করার জন্য দাবি জানান। বিরােধী দলের নেতা হ্যারল্ড উইলসন বাংলাদেশ পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে অবিলম্বে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। তিনি বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে গত মহাযুদ্ধের পর সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা বলে উল্লেখ করেন। বিরােধীদলের দাবি মেনে নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউম ১০ জুন পার্লামেন্টে পাকিস্তান সম্পর্কে বিশেষ বিতর্ক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। চার ঘণ্টাব্যাপী বিতর্ককালে স্যার আলেক বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়ােজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি শরণার্থীদের সাহায্য বাবদ ব্রিটিশ সরকারের দান সীমাবদ্ধ থাকবে না বলে আশ্বাস দেন।  ১১ জুন লন্ডনের উইকয়েন্ড টেলিভিশন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে একটি অনুষ্ঠান প্রচার করে। এই অনুষ্ঠানে বিচারপতি চৌধুরী স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনে তার বক্তব্য পেশ করেন। অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে তাকে সাড়ে সাত কোটি সংগ্রামী বাঙালির প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে বিরােধী মত প্রকাশ করার জন্য অনুষ্ঠান কর্তৃপক্ষ টোরি দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জন বিগস্-ডেভিডসনকে আমন্ত্রণ জানান। তিনি পাকিস্তানের গোঁড়া সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই অনুষ্ঠানে মি. বিগস-ডেভিডসন এবং আরাে কয়েকজন বিচারপতি চৌধুরীকে বহু প্রশ্ন করেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে সবগুলাে প্রশ্নের উত্তর দেন।  ১২ জুন ‘দি টাইমস্’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী হিন্দুদের নির্বিচারে হত্যা করছে। পূর্ব বাংলা থেকে জনৈক ব্রিটিশ নাগরিক হাতে হাতে পাঠানাে এক চিঠিতে হত্যাকাণ্ডের চাক্ষুষ বিবরণ দিয়ে বলেন, পুরুষদের নির্মমভাবে হত্যা করে মহিলা ও শিশুদের ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। হিন্দুদের শুধু হিন্দু বলেই হত্যা করা হচ্ছে।

৩০ থেকে ৪০ জন বাস্তুচ্যুত হিন্দুকে ছােট ছােট দলে ভাগ করে গণকবরের সামনে দাঁড় করিয়ে সরাসরি গুলি করা হচ্ছে। উল্লিখিত তারিখে লন্ডনের উত্তরে অবস্থিত সেন্ট আলবান্স শহরে বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থনে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি চৌধুরী এই সভায় বক্তৃতা করেন। পরদিন (১৩ জুন) বিচারপতি চৌধুরী তার সহকর্মীদের নিয়ে লিড়সে পৌঁছান। স্থানীয় একটি বিরাট হলে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশকে। শত্রুমুক্ত করে এবং স্বাধীনতার পতাকা উচ্চে তুলে ধরে বাংলাদেশের বীর শহীদদের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হবে। সভায় শেখ মান্নান, অধ্যাপক কবীরউদ্দিন আহমদ এবং আরাে কয়েকজন বক্তৃতা করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে লিড়সের বাংলাদেশ অ্যাসােসিয়েশন ও লিস্ লিবারেশন ফ্রন্ট উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে। মিয়া মােহাম্মদ মােস্তাফিজুর রহমান। (পরবর্তীকালে ড. রহমান) ও মির্জা মােজাম্মেল হক যথাক্রমে প্রতিষ্ঠান দুটির। প্রেসিডেন্ট ছিলেন। লিড়সের বাঙালি কর্মীরা ‘জয় বাংলা নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। মােহাম্মদ নুরুল দোহা এই পত্রিকাটি সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। লিড়সের মহিলারাও আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৩ জুন বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকরা পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্যদানের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে একটি প্রতিবাদ মিছিলের আয়ােজন করেন। মিছিলটি লন্ডনের হাইড পার্ক থেকে পার্ক লেন, পিকাডিলি ও ডাউনিং স্ট্রিট হয়ে ট্রাফালগার স্কোয়ারে পৌঁছায়। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা ব্রিটিশ ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট দপ্তর, কানাডার হাই কমিশন এবং ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, হল্যান্ড ও ইতালির দূতাবাসগুলাের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।  ১৩ জুন (রােববার) লন্ডনের বহুল প্রচারিত ও প্রভাবশালী দি সানডে টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে এক বিস্তারিত রিপাের্ট প্রকাশিত হয়। করাচির ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক ও “দি সানডে টাইমস্ -এর পাকিস্তান সংবাদদাতা এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের চাক্ষুষ বিবরণ ‘গণহত্যা’ (জেনােসাইড) শিরােনাম দিয়ে ফলাও করে ছাপানাে হয়। পত্রিকাটির প্রথম পৃষ্ঠায় সংবাদদাতার পরিচয় এবং রিপাের্টের সারমর্ম প্রকাশিত হয়। প্রায় দশ হাজার শব্দ সংবলিত মূল রিপাের্টটি পাঁচ কলামব্যাপী শিরােনাম দিয়ে ১২ থেকে ১৪ পৃষ্ঠায় ছাপানাে হয়। 

প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত রিপাের্টে বলা হয়, মার্চ মাসের শেষদিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের হাজার হাজার বেসামরিক অধিবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের পক্ষে এই ভয়ঙ্কর সংবাদ চাপা দেয়া সম্ভব হয় নি। কলেরা ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা উপেক্ষা করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৫০ লক্ষেরও বেশি বাঙালি ভারতে গিয়ে আশ্রয়প্রার্থী হওয়ার কারণ এই হত্যাযজ্ঞ। দি সানডে টাইমস্ -এর সংবাদদাতা এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের চাক্ষুষ বিবরণ বহির্বিশ্বকে অবহিত করার জন্য পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছেন। সৈন্যবাহিনী শুধু বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকদের হত্যা করে নি, হিন্দু ও মুসলমানদের তারা নির্বিচারে হত্যা করেছে। ১৮ মে (মঙ্গলবার) ম্যাসকারেনহাস লন্ডনে ‘দি সানডে টাইমস্ -এর অফিসে এসে হাজির হন। পত্রিকার কর্তৃপক্ষকে তিনি বলেন, পূর্ব বাংলা থেকে ৫০ লক্ষেরও বেশি অধিবাসী কেন ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে, তার প্রকৃত কারণ সংবলিত কাহিনী তিনি লিখবেন। এই কাহিনী ছাপানাে হলে তিনি করাচিতে ফিরতে পারবেন না। তাই করাচি ফিরে গিয়ে সপরিবারে লন্ডনে ফিরে আসার আগে তাঁর রিপাের্ট ছাপানাে হবে না বলে পত্রিকার কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতি দেন। ম্যাসকারেনহাস করাচিতে ফিরে গিয়ে দশ দিন পর পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে দেশত্যাগ করতে সমর্থ হন। | ‘দি সানডে টাইমস’-এ প্রকাশিত মূল রিপাের্টে ঢাকা, কুমিল্লা, চাঁদপুর, হাজিগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর নবম ও ঘােড়শ ডিভিশনের অফিসারদের অমানুষিক কার্যকলাপ সম্পর্কে হৃদয়বিদারক বিবরণ দেয়া হয়। বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে জড়িত অফিসারদের মধ্যে নবম ডিভিশনের মেজর রাঠোর, মেজর বশীর, কর্নেল নঈম, লে. কর্নেল আসলাম, বালুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আজমত, লে. জাওয়াদ, কুমিল্লার সামরিক শাসক মেজর আগা এবং জেনারেল রেজা, মেজর ইফতিখার ও ক্যাপ্টেন দুররানীর নাম উল্লেখ করা হয়। কুমিল্লা সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণে ১৯ এপ্রিল মেজর আগার নির্দেশে সন্ধ্যা ছয়টার পর লাঠি দিয়ে পিটিয়ে দু’জন হিন্দু, একজন ছাত্র, একজন আওয়ামী লীগ সংগঠক এবং একজন খ্রিষ্টান বন্দিকে হত্যার বিবরণ পড়ে কারাে পক্ষে বিচলিত না হওয়া অসম্ভব।

ঢাকায় অবস্থিত ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তরে আলােচনাকালে ম্যাসকারেনহাসের কাছে পূর্ব বঙ্গে প্রযােজ্য সরকারি নীতি ব্যাখ্যা করা হয়। এই নীতির সপক্ষে বলা হয় : ১. বাঙালিরা বিশ্বাসযােগ্য নয়; ২. বাঙালিদের মধ্যে পৃথক হওয়ার মনােভাব দূর করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববােধ দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে জনসাধারণকে নতুন করে ইসলামিক দীক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে; ৩. মৃত্যু ও দেশত্যাগের ফলে হিন্দুদের নাম-নিশানা মুছে যাওয়ার পর তাদের বিষয়-সম্পত্তির লােভ দেখিয়ে সুবিধাভােগ থেকে বঞ্চিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মুসলমানদের সমর্থন আদায় করতে হবে। ভবিষ্যতে এদের ওপর। ভিত্তি করে শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক কাঠামাে গড়ে তুলতে হবে। বাঙালিদের সমর্থন লাভের জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও লে. জেনারেল টিক্কা। খানের চেষ্টা মােটামুটিভাবে ব্যর্থ হয়। কিছুসংখ্যক পাকিস্তানপন্থী বাঙালি স্বেচ্ছায় রক্তপিপাসু পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সহযােগিতা করে। এদের মধ্যে নেজামে ইসলামের মৌলবী ফরিদ আহমদ, মুসলিম লীগের ফজলুল কাদের চৌধুরী ও জামাতে ইসলামীর গােলাম আযমের নাম ম্যাসকারেনহাসের রিপাের্টে উল্লেখ করা হয়। উল্লিখিত রিপাের্ট সম্পর্কে ‘দি সানডে টাইমস্ -এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয় : ‘১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে মতের অমিল ও অনৈক্যের বীজ বপন করা হয়। তখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ন্যায়সঙ্গতভাবে নিজেদের অসম-অংশীদার বলে অনুভব করে। দেশের আর্থিক সম্পদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে অর্ধেকেরও বেশি অবদান থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রতি দরিদ্র আত্মীয়ের মতাে ব্যবহার করা হয়।  দি সানডে টাইমস’-এর এই চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী রিপাের্ট বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপত্র, টিভি ও রেডিওর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এর ফলে পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তানি গণহত্যা সম্পর্কিত সংবাদ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

সারা বিশ্বের অসংখ্য গণতন্ত্রকামী কর্মী ও জনসাধারণ এবং বহু গণতান্ত্রিক দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জ্ঞাপন করে। ১৩ জুন সন্ধ্যায় আই টি.ভি. ‘র ‘ম্যান ইন দি নিউজ প্রােগ্রামে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারের বিবরণ প্রচারিত হয়। এই সাক্ষাঙ্কারে তিনি বলেন, পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের খবর চেপে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি আরও বলেন : সৈন্যবাহিনী পাকিস্তানকে খতম করেছে। বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া হলেই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হবে। বাংলাদেশের বড় বড় শহর ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তান সরকারের অস্তিত্ব নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। ১৪ জুন ‘দি টেলিগ্রাফ’-এ উল্লিখিত সাক্ষাৎকারের বিবরণ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য লাভের উদ্দেশ্যে বিচারপতি চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৪ জুন একটি শােভাযাত্রার আয়ােজন করা হয়। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণক্রমে আল্‌স্টারের ইউনিয়নপন্থী পার্লামেন্ট সদস্য জেমস্ কিফেডার, শ্রমিকদলীয় সদস্য জেমস্ টিন এবং টোরি দলীয় সদস্য মিসেস জিল নাইট (পরবর্তীকালে ডেইম্ নাইট) পাকিস্তান সফরে যান। দি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রেরিত একাধিক তারবার্তায় মিসেস নাইট নিজেকে পাকিস্তান ও ইয়াহিয়া খানের অন্ধভক্ত বলে প্রমাণ করেন।  ১৪ জুন ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এক তারবার্তায় মিসেস নাইট | ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক সাক্ষাঙ্কারের কথা উল্লেখ করেন। এই সাক্ষাৎকারকালে শেখ মুজিবকে পূর্ব বঙ্গ পরিস্থিতির জন্য দায়ী করে ইয়াহিয়া খান বলেন, নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ মুজিব পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেন। তিনি ও তার সহকর্মীরা বহু লােককে হত্যা করেন। এই তারবার্তায় আরও বলা হয়, শেখ মুজিবের সৈন্যবাহিনী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং পূর্ব বঙ্গে নিয়ােজিত প্রত্যেক পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল বলে পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করেন। এই পরিকল্পনা বানচাল করার জন্য পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী তড়িৎগতিতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। ১৫ জুন ১২০ জন শ্রমিকদলীয় সদস্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে। একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এই প্রস্তাবে পূর্ব বঙ্গে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক নেতৃবৃন্দকে দায়ী করা হয়। ডাক ও তার-যােগাযােগ দপ্তরের প্রাক্তন মন্ত্রী জন স্টোনহাউস উত্থাপিত এই প্রস্তাব সমর্থন করে যারা দস্তখত দেন তাঁদের মধ্যে ছয়জন প্রিভি কাউন্সেলর, শ্রমিক দলের চেয়ারম্যান ইয়ান মিকাডো এবং কার্যনির্বাহী পরিষদের তিনজন সদস্য ছিলেন। কয়েকদিনের মধ্যে প্রস্তাবটি তিনশ’র বেশি পার্লামেন্ট সদস্যের সমর্থন লাভ করে। পার্লামেন্টে উত্থাপিত অপর একটি প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গে উপযুক্ত রাজনৈতিক কাঠামাে গঠিত না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্যদান স্থগিত রাখা বাঞ্ছনীয়। দু’শ পঞ্চাশজনের বেশি পার্লামেন্ট সদস্য প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। 

১৬ জুন ‘ডেইলি মিরর পত্রিকায় খ্যাতনামা সাংবাদিক জন পিলজার প্রদত্ত রিপাের্টে পূর্ব বঙ্গে নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা ও নির্যাতনের ভীতিজনক এক বিবরণ দেয়া হয়। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে মি. পিজার বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা সফর করেন। একটি জাতির মৃত্যু’ শীর্ষক রিপাের্টে জনৈক বৃদ্ধের পেটে বেয়নেট দিয়ে এলােপাতাড়ি কাটার চিহ্ন, সরাসরি গুলির আঘাতে একটি শিশুর ক্ষতবিক্ষত কানে জমাট রক্ত এবং জীবন্ত কবর দেয়া স্বামীর কবরের পাশে জনৈক মহিলার শােক প্রকাশের করুণ কাহিনী দিয়ে তিনি তার রিপাের্ট শুরু করেন। উপসংহারে তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি অধিবাসীর বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক অভিযান পরিচালনা করছে। গ্রামের পর গ্রাম আক্রমণ করে শেখ মুজিবের সমর্থক এবং আওয়ামী লীগের সদস্যদের হত্যা করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। হাজার হাজার, সম্ভবত লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ পুরুষ, মহিলা ও শিশুকে পাঞ্জাবি ও পাঠান সৈন্যরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে।  এই রিপাের্ট প্রকাশিত হওয়ার পর বিচারপতি চৌধুরী জন পিলজারকে টেলিফোন করে ধন্যবাদ জানান। এর দু’একদিন পর মি. পিলজার বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে মৌখিক বিবরণ দেন। মি. পিজার বলেন, বাংলাদেশ নিজস্ব শক্তিতে জয়ী হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।  ১৬ জুন ‘দি টাইমস্ পত্রিকায় একটি সন্দেহজনক সংবাদ প্রকাশিত হয়। রাতারাতি গজিয়ে ওঠা এশিয়ান নিউজ সার্ভিস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সংবাদদাতা বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে বলে নিশ্চিত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেসামরিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছেন। ঢাকার অধিবাসীদের মধ্যে যারা পালিয়ে গিয়েছিলেন তারা ফিরে আসতে শুরু করেছেন। ঢাকার ধ্বংসপ্রাপ্ত বাজারগুলােতে আবার বেচাকেনা শুরু হয়েছে।

বেসামরিক কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও ছােট শহরগুলাের শাসনভার গ্রহণ করেছেন।… পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলভুক্ত ১৬৭ জন সদস্যের মধ্যে ২৫ জন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সহযােগিতা করবেন বলে বিশ্বাসযােগ্য সূত্রে জানা গেছে। ব্যাপক ক্ষমা প্রদর্শন সম্পর্কে সামরিক সরকারের ঘােষণা প্রচারিত হওয়ার পর আরও বহু সদস্য এদের সঙ্গে যােগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।… প্রাক্তন চিফ জাস্টিস ও আইনমন্ত্রী কর্নেলিয়াস এবং প্রাক্তন এটর্নি জেনারেল মঞ্জুর কাদির একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নে ব্যস্ত রয়েছেন।… ঢাকার জনৈক মধ্যবিত্ত বাঙালি কেরানির মন্তব্য থেকে পরিস্থিতি আঁচ করা যায়। এই কল্পলােকনিবাসী কেরানি বলেন : ‘আমরা চাই শান্তি; বাংলাদেশ না পাকিস্তান তা আমরা জানতে চাই না।৭২ বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, অ্যাকশন বাংলাদেশ এবং আরাে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যােগ দিয়ে পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধের দাবি জানিয়ে সপ্তাহব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি পালন উপলক্ষে ১৬ জুন পশ্চিম জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।। পাকিস্তানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন উপলক্ষে মহিলা সমিতির কর্মীরা অন্যদের সঙ্গে যােগ দিয়ে লন্ডনস্থ মার্কিন দূতাবাসের সামনে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সভায় অংশগ্রহণ করেন। এই উপলক্ষে স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির কর্মী আবদুল হাই খান ও মিসেস রাজিয়া চৌধুরী দূতাবাসের সামনে অনশন পালন করেন। বিচারপতি চৌধুরী তার স্মৃতিকথায় বলেন, এ দুজনের অনশন শুরু হওয়ার পর তিনি প্রতিদিনই তাদের দেখতে যান। কয়েকদিন পর তাদের অবস্থা দেখে তিনি। তার অফিসে বসে ভাবছিলেন, এ ব্যাপারে কী করা যায়। এমন সময় মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক সচিব মি. কিং তাকে টেলিফোন করেন। তিনিই বিচারপতি চৌধুরীর জন্য মার্কিন ভিসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। মি. কিং বলেন, রাষ্ট্রদূত থেকে সবাই অনশনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। বিচারপতি চৌধুরী ও অনশনকারীদের মনােভাব রাষ্ট্রদূত ও মার্কিন সরকারকে যথাযথভাবে জানাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মি. কিং অনশন প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করার জন্য বিচারপতি চৌধুরীকে সনির্বন্ধ অনুরােধ জানান। মি. কিং-এর অনুরােধ সম্পর্কে স্টিয়ারিং কমিটি এবং স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করে বিচারপতি চৌধুরী মার্কিন দূতাবাসের সামনে গিয়ে ছাত্রদের অনশন ভাঙার অনুরােধ জানান। অনশনকারীরা তার অনুরােধ রক্ষা করেন।

১৭ জুন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিচারপতি চৌধুরীর কূটনৈতিক পরিচয়পত্র স্বাক্ষর করেন। এই পরিচয়পত্রে বিচারপতি চৌধুরীকে যুক্তরাজ্যে হাই কমিশনার হিসেবে নিয়ােগের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘােষণা করা হয়। এই পরিচয়পত্র রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সরকারি বাসভবন বাকিংহাম প্যালেসে পেশ করা হয়। যথাসময়ে পরিচয়পত্র প্রাপ্তিস্বীকার করে বাকিংহাম প্যালেস থেকে বিচারপতি চৌধুরীর কাছে একটি পত্র পাঠানাে হয়। এই পত্রের মাধ্যমে প্রকারান্তরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হয় বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন। | ১৯ জুন ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত এক তারবার্তায় মিসেস জিল নাইট বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক সফরকালে তিনি পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী সংঘটিত গণহত্যার কোনাে প্রমাণ পান নি। বরং আওয়ামী লীগের ‘চরমপন্থী সদস্যদের নৃশংসতার প্রমাণ পেয়ে তিনি বিচলিত হয়েছেন। ঢাকার নতুন শহর থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য জহিরুদ্দিন তাকে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন তিনি সমর্থন করেন না। পাকিস্তান সরকার শান্তি ফিরিয়ে আনবে বলে তিনি (জহিরুদ্দিন) বিশ্বাস করেন। করাচি থেকে প্রেরিত মিসেস নাইটের এই তারবার্তায় পাকিস্তান সামরিক চক্রের প্রতি তাঁর প্রচ্ছন্ন সহানুভূতি পাঠকদের দৃষ্টি এড়ায় নি। ( ১৯ জুন হাইড পার্কে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সভায় শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শাের বলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের অগ্রণী হওয়া উচিত। বেসামরিক ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়া হবে না বলে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়ার জন্য তিনি আন্তর্জাতিক সাহায্যদানকারী সংস্থার প্রতি আবেদন জানান। জুন মাসের মাঝামাঝি জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি মােহাম্মদ শাজাহান ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান লন্ডন সফরে আসেন। স্টিয়ারিং কমিটি। আয়ােজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে তারা বক্তৃতা করেন। মার্চ মাসের গৌরবজনক। সগ্রাম সম্পর্কে তারা আবেগপূর্ণ ভাষায় তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে ব্রিটিশ শ্রমিক আন্দোলনের সমর্থন লাভের জন্য জাতীয় শ্রমিক লীগের নেতৃদ্বয় ব্রিটেন আসেন।

মি. মান্নান ইঞ্জিনিয়ারিং শ্রমিকদের নেতা হিউ স্ক্যানলন, রাসায়নিক শ্রমিকদের নেতা বল্ এডওয়ার্ডস, সিনেমা শিল্পে নিয়ােজিত কারিগরদের নেতা এ্যালান স্যাপার, খনি শ্রমিকদের নেতা লরেন্স ড্যালি এবং ছাপাখানার শ্রমিকদের নেতা রিচার্ড ব্রিগিনশ’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থনের আবেদন জানান। ব্রিটিশ শ্রমিক। আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ তার আবেদনে সাড়া দিয়ে পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। _ ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘দি মনিং স্টার’-এর কূটনৈতিক সংবাদদাতা ক্রিস্ মায়ান্টের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মি. মান্নান বলেন, বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণী শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়-দফা দাবির মধ্যে অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার ফলে তাঁর নেতৃত্বে গণসংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করার পর নিপীড়িত শ্রমিকশ্রেণী সর্বাগ্রে স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিক ও স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যােগদান করে। এই সাক্ষাৎকারের বিবরণ ২৮ জুলাই ‘দি মর্নিং স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ২০ জুন এক জনসভায় বক্তৃতা করার জন্য বিচারপতি চৌধুরী ওয়েলসের প্রধান শহর কার্ডিফে যান। মি, মান্নানও তার সঙ্গে যান। সভায় বক্তৃতাদানকালে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং বাঙালি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্যাতনমূলক কার্যকলাপের ভয়াবহতা বর্ণনা করেন। কার্ডিফের জনসভায় বিচারপতি চৌধুরী আরও বলেন, এবারের স্বাধীনতা হবে গণমানুষের স্বাধীনতা এবং তাদের প্রতিনিধিরা দেশ শাসন করবেন। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের আপােসের সম্ভাবনা রয়েছে বলে যে গুজব ছড়ানাে হয়েছে, তা ভিত্তিহীন বলে তিনি ঘােষণা করেন। অন্য বক্তাদের মধ্যে ছিলেন শেখ আবদুল মান্নান ও সুলতান মাহমুদ শরীফ।

২১ জুন বিচারপতি চৌধুরী শ্রমিক নেতা মি. মান্নানসহ হল্যান্ড সফরে যান। সফরে যাওয়ার দু’দিন আগে হল্যান্ড থেকে একটি টেলিভিশন টিম লন্ডনে এসে বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। ২০ জুন সন্ধ্যায় এই সাক্ষাঙ্কার। প্রচারিত হয়। পরদিন বিকেলবেলা বিমানযােগে তিনি আমস্টারডামে পৌঁছান। বিমানবন্দরের ভি আই পি রুমে সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের সাংবাদিকরা তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। বিমানবন্দর থেকে হােটেলে পৌঁছানাের পর দু’জন পার্লামেন্ট সদস্য তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁদের সঙ্গে তিনি বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করেন। পরদিন (২২ জুন) বিচারপতি চৌধুরী তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে পার্লামেন্ট ভবনে যান। কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্যের সহায়তায় তিনি স্পিকারের সঙ্গে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। বিকেলবেলা পার্লামেন্টের একটি কমিটি রুমে তিনি বৈদেশিক ব্যাপার সম্পর্কিত সাব-কমিটির সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হন। তারা দু’ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিচারপতি চৌধুরীকে নানা প্রশ্ন করেন। প্রশ্নোত্তরের পর সাব-কমিটির চেয়ারম্যান বলেন, বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে। আলােচনার পর তারা বুঝতে পেরেছেন, পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের পর বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে পারে না। তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের সংগ্রামকে তারা আদর্শগতভাবে সমর্থন জানাবেন। সাব-কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলােচনাকালে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে ছিলেন। সুনীল কুমার লাহিড়ী, জহীরুদ্দিন এবং রাজিউল হাসান রঞ্জু।  পরদিন লন্ডনে ফিরে আসার আগে বিচারপতি চৌধুরী একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। এই সম্মেলনের রিপাের্ট এবং অন্যান্য কার্যকলাপের সংবাদ হল্যান্ডের বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় দু’তিন কলামব্যাপী শিরােনাম দিয়ে প্রকাশিত হয়। স্বল্পসংখ্যক প্রবাসী বাঙালির সাহায্য ও সহায়তা এবং আদর্শের প্রতি বিচারপতি চৌধুরীর দৃঢ়প্রত্যয়ের ফলে ডাচ সরকারি ও বেসরকারি মহল তাকে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম এবং সর্বজন স্বীকৃতরাষ্ট্রের বিশেষ প্রতিনিধির মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করেন।৭৫

২১ জুন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ও ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউম বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রায় এক ঘণ্টাকাল আলাপ-আলােচনা করেন। পররাষ্ট্র দপ্তরে অনুষ্ঠিত এই ঘরােয়া বৈঠকের পর প্রচারিত এক যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করবেন। এই বিবৃতির মাধ্যমে গ্রহণযােগ্য। সমাধানের শর্ত সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের মনােভাব পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করা হয়। বাঙালিদের স্বাধীনতা দাবির এই পরােক্ষ স্বীকৃতি প্রবাসী বাঙালিদের উৎসাহিত করে।৬ পররাষ্ট্র দপ্তরে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর এক সাংবাদিক সম্মেলনে মি. শরণ সিং বলেন, ভারতের জন্য বৈদেশিক সাহায্য চাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি লন্ডনে আসেন নি। পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্যদান স্থগিত রাখার অনুরােধ জানানাে তার সফরের মূল উদ্দেশ্য। সােভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিম ইউরােপের কয়েকটি দেশের সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে আলােচনার পর মি. শরণ সিং লন্ডনে আসেন। তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এওয়ার্ড হিথের সঙ্গেও এক সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের নির্দেশ অনুযায়ী বিচারপতি চৌধুরী শরণ সিং-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকালে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আপা পন্থ উপস্থিত ছিলেন। মি. শরণ সিং বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, বিভিন্ন দেশ সফরকালে যদি বিপদের সম্মুখীন হন, তা হলে তিনি (বিচারপতি চৌধুরী) ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যােগাযােগ করতে যেন দ্বিধাবােধ না করেন। কথা প্রসঙ্গে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র পাঠাবার ব্যাপারে ভারত সরকারের অনুমতি চেয়েছেন। অনুমতি না । পাওয়ার জন্য অস্ত্র পাঠানাে সম্ভব হচ্ছে না বলে প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে হতাশা। দেখা দিয়েছে। মি, শরণ সিং বলেন, বিদেশ থেকে অস্ত্র না পাঠালেও মুক্তিযােদ্ধারা প্রয়ােজনীয় অস্ত্র পাচ্ছে। তবে লন্ডন থেকে অস্ত্র পাঠাবার অনুমতি ।

দেয়ার আগে কয়েকটি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সেজন্য অনুমতিদানে বিলম্ব হচ্ছে। বিচারপতি চৌধুরী তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, শেখ মান্নান ও আজিজুল হক ভুইয়া ভারতীয় দূতাবাসের বাঙালি কূটনীতিবিদ শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করেন। মুজিবনগর সরকারের কোনাে জরুরি বার্তা ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে পাঠানাে হলে মি. ব্যানার্জি তা শেখ মান্নান অথবা মি. ভুইয়ার কাছে পৌছানাের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৭৭ পারী থেকে ২১ জুন প্রাপ্ত এক সংবাদে প্রকাশ, পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্যদানের উদ্দেশ্যে গঠিত ১১ সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান (এই পাকিস্তান কন্সরসিয়াম) পূর্ব বাংলা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নতুন সাহায্যদানের প্রস্তাব সম্পর্কিত আলােচনা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সাহায্যদানকারী দেশগুলাের প্রতিনিধিদের সভায় ‘বি’ করার জন্য লন্ডন থেকে অ্যাকশন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও বাংলাদেশ মহিলা সমিতির প্রতিনিধিরা পারী সফর করেন। ২৪ জুন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউম পার্লামেন্টে বলেন, পূর্ব বাংলা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের নিশ্চিত প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানকে নতুন কোনাে বৈদেশিক সাহায্য মঞ্জুর করবে না। এই ঘােষণার মাধ্যমে কয়েকদিন আগে পারীতে অনুষ্ঠিত এই পাকিস্তান কন্সরসিয়াম’-এর সিদ্ধান্তের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের সমর্থন সূচিত হয়। | ২৬ জুন লন্ডনের বেওয়াটার এলাকায় সংগঠিত বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে একটি প্রকাণ্ড হলে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বহু ইংরেজ এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। শ্রমিক দলের পক্ষ থেকে পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শাের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে বক্তৃতা করেন। শেখ মান্নান স্টিয়ারিং কমিটির কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন। বিচারপতি চৌধুরী বলেন : বাঙালির জয়যাত্রা সফল হবেই। এই তিন মাসে যে একতা গড়ে উঠেছে তা সকল বাধা অতিক্রম করে সাফল্য বয়ে আনবে।

স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার পর ২৭ জুন বার্মিংহামে দ্বিতীয় জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ডিগবেথ হলে অনুষ্ঠিত এই সভায় বক্তৃতাদান উপলক্ষে বিচারপতি চৌধুরী। স্বাধীনতা সংগ্রামের যৌক্তিকতা এবং ২৫ মার্চের পর সংঘটিত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাগুলাে বর্ণনা করেন। তাছাড়া বাংলাদেশ সংগ্রামের ঐতিহাসিক ও আদর্শগত দিক সম্পর্কেও তিনি বিশদ ব্যাখ্যা দেন। শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জুলিয়াস সিলভারম্যান এবং ক্রস ডগলাসম্যানও সভায় বক্তৃতা করেন। | বিরাট জনসমাবেশের সুযোেগ নিয়ে চীনপন্থী বাঙালি মেসবাহউদ্দিন হলের বাইরে দাঁড়িয়ে তার দলের মুখপত্র ‘গণযুদ্ধ বিক্রির চেষ্টা করেন। এই খবর পাওয়ার পর স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য আজিজুল হক ভূঁইয়া মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন : ভাই সব, এই হলের বাইরে চীনের এক চর আমাদের সভা ‘স্যাৰােটাজ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। সে পত্রিকা বিক্রি করছে। তার ঘােষণা শােনার পর জনতা মেসবাহউদ্দিনকে ঘিরে ফেলে উত্তম-মধ্যম দেয়ার উপক্রম করে। শেখ মান্নান ছুটে গিয়ে তাকে জনতার হাত থেকে মুক্ত করে হলের মধ্যে নিয়ে এসে বিচারপতি চৌধুরীর পাশে চুপচাপ বসে থাকার জন্য বলেন। সভা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। হলের একদিকে স্থানীয় অ্যাকশন কমিটি কয়েকটি ছােট ছােট দোকান খােলে। এই দোকানগুলােতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের মনােগ্রাম সংবলিত নেক-টাই, কাফ-লিঙ্ক ইত্যাদি বিক্রি করা হয়। সভার উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন জগলুল পাশা, মােহাম্মদ আবদুল গনি ও তােজাম্মেল হক (টনি)। ২৭ জুন ‘দি সানডে টাইমস্ -এর রাজনৈতিক ভাষ্যকার হুগাে ইয়াং এক নিবন্ধে বলেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি নেতৃবৃন্দের হাস্যকর নির্বুদ্ধিতার জন্য রক্ষণশীল দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য মিসেস জি নাইটের নেতৃত্বে প্রেরিত পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদলের সফরকে সামরিক সরকার অন্তত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তাদের অপপ্রচারের স্বপক্ষে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী পূর্ব বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানদের ব্যাপক হারে হত্যা করেছে বলে মিসেস নাইট এখন স্বীকার করছেন। এর জন্য পাকিস্তানকে ভুল বােঝা উচিত হবে না বলে তিনি (মিসেস নাইট) মনে করেন।

এ প্রসঙ্গে মি, ইয়াং ১৪ জুন থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর তারবার্তার উল্লেখ করেন। উক্ত তারবার্তায় মিসেস নাইট বলেন, সামরিক বাহিনী সংঘটিত ব্যাপক হারে হত্যার কোনাে প্রমাণ তিনি পান নি। হত্যা সম্পর্কিত খবরগুলাে পাকিস্তান-বিরােধী প্রচারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল বিদেশী সংবাদপত্রগুলাে পূর্ব বাংলার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসার জন্য দায়ী বলে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন মিসেস নাইট ইঙ্গিত করেন। বিগত সপ্তাহে মিসেস নাইট ‘দি সানডে টাইমস’-এর সংবাদদাতাকে বলেন : জরুরি অবস্থার চরম পর্যায়ে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে আমি নিশ্চিত কিন্তু এখনও তা ঘটছে বলে আমি মানতে রাজি নই।’ মি, ইয়াং প্রকাশ করেন, ব্রিটেন ও পাকিস্তান প্রায় একই সঙ্গে পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদলের পাকিস্তান সফরের প্রস্তাব করে। ১৪ মে পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনাকালে পররাষ্ট্র ব্যাপারে শ্রমিকদলীয় মুখপাত্র ডেনিস্ হিলি এ সম্পর্কে প্রথম উল্লেখ করেন। সরকার ও বিরােধীদল একমত হওয়ার পর আশা করা হয়েছিল, পররাষ্ট্র দপ্তর, পার্লামেন্টের কর্মসূচি নির্ধারণের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী উইলিয়াম হােয়াইটুল’ এবং রক্ষণশীল ও শ্রমিকদলের চিফ হুইপ যথাক্রমে ফ্রান্সিস পিম ও ব মেলিস্ এ সম্পর্কে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন। ১৪ মে পাকিস্তান হাই কমিশন একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের প্রতিনিধিদল পাকিস্তানে পাঠাবার উদ্যোগে গ্রহণ করে। ব্রিটিশ পরিকল্পনা অনুযায়ী উভয় সরকারের সম্মতি নিয়ে পার্লামেন্টের প্রবীণ সদস্যদের পাঠানাে হবে এবং ব্রিটিশ সরকার তাদের ব্যয়ভার বহন করবে বলে আশা করা হয়েছিল। পাকিস্তানিরা প্রবীণ সদস্যদের পরিবর্তে তাদের মনােনীত সদস্যের আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী পার্লামেন্টের হুইটসান’ ছুটি শেষ হওয়ার আগেই পাকিস্তান মিসেস নাইট ও তার সঙ্গীদের আমন্ত্রণ জানায়। পার্লামেন্টের ৬৩০জন সদস্যের মধ্যে এই তিনজনকে কেন আমন্ত্রণ জানানাে হয়, সে সম্পর্কে পাকিস্তান হাই কমিশনে নিয়ােজিত কাউন্সেলার সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেন নি বলে মি. ইয়াং উল্লেখ করেন।  উল্লিখিত প্রতিনিধিদলের সদস্য মনােনয়নের ব্যাপারে রক্ষণশীল দলীয় সদস্য স্যার ফ্রেডারিক বেনেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি পার্লামেন্ট সদস্যদের সমবায়ে গঠিত এ্যাংলাে-পাকিস্তান গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি ‘স্টার অব পাকিস্তান’ পদক ধারণ করে গর্ব বােধ করেন। তার পিতা মি. জিন্নাহর বন্ধু ছিলেন বলে তিনি পার্লামেন্টে বক্তৃতাদানকালে প্রকাশ করেন। সর্বদলীয় পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল পাঠানাের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি ও  বিরােধীদলের সদস্যরা ছুটির শেষে ৮ জুন পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হওয়ার পর | মিসেস নাইটের নেতৃত্বে গঠিত প্রতিনিধিদল ১১ জুন পাকিস্তান রওনা হবেন বলে জানতে পারেন।

এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর প্রতিনিধি পাঠানাের দায়িত্বপ্রাপ্ত।  সদস্যরা মিসেস নাইট ও তাঁর সঙ্গীদের সফর বাতিল করার চেষ্টা করেন। প্রাক্তন যুদ্ধমন্ত্রী জেমস্ র্যামডেন ও মি. হিলির যুক্ত নেতৃত্বে গঠিত প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে তাদের তিনজনকে গ্রহণ করা হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়। ১০ জুন এই নবগঠিত প্রতিনিধিদলের সদস্যদের নাম যখন ঘােষণা করা হয়, তখন পর্যন্ত কয়েকটি জরুরি কাজ সমাধা করা হয় নি। প্রতিনিধিদল ভারত অথবা পাকিস্তানে | যাবে, নাকি উভয় দেশে যাবে, তা স্থির করা হয় নি। ঘােষণা প্রকাশিত হওয়ার আগে বিদেশ সফররত মি. হিলির সঙ্গে আলােচনা করা হয় নি। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযােগ গ্রহণ করে মিসেস নাইট ও তার সঙ্গীরা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তানের পথে রওনা হন। | পাকিস্তানি সংবাদপত্রগুলাে মিসেস নাইটের পাকিস্তান-প্রীতি সম্বল করে অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ ও ভারতবিদ্বেষী প্রচারণায় মনােনিবেশ করে। রেডিও পাকিস্তানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মিসেস নাইট বলেন, ব্রিটিশ সংবাদপত্রে অত্যধিক পরিমাণে ‘উড়াে-খবর ও একতরফা ভারতীয় প্রচারণা’ ছাপানাে হচ্ছে। বলে তিনি মনে করেন। জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ব্রিটিশ টেলিভিশনের সংবাদ পরিক্রমায় জিল নাইটের পূর্ব বাংলা সফর সম্পর্কিত চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। এই চলচ্চিত্রে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে এক জনসমাবেশে আলােচনারত মিসেস নাইটকে দেখানাে হয়। এই সমাবেশে মুসলিম লীগ নেতা শাহ আজিজুর রহমান দেশে কোনাে গােলযােগ কিংবা অশান্তি আছে কি না জিগ্যেস করার জন্য মিসেস নাইটকে অনুরােধ করেন। তার প্রশ্নের উত্তরে সমাবেশের মধ্য থেকে বলা হয়, দেশের অবস্থা সম্পূর্ণ শান্ত ও স্বাভাবিক। বলা বাহুল্য, পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের সহায়তায় এই সমাবেশের আয়ােজন করা হয়েছিল। পূর্ব লন্ডনের প্রবীণ সমাজকর্মী আবদুল মালেক ১৯৮৪ সালের মে মাসে এক সাক্ষাঙ্কারে বলেন, উল্লিখিত সংবাদ-পরিক্রমা দেখার পর তিনি গভীর রাতে শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শশারের সঙ্গে টেলিফোনযােগে আলাপ করেন। মি, শােরকে তিনি বলেন, অবিলম্বে এই মিথ্যা প্রচারণার জোরালাে প্রতিবাদ না করা হলে বাংলাদেশ সম্পর্কে পার্লামেন্টে উত্থাপিত প্রস্তাবের প্রতি ইতােমধ্যে যাঁরা সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন, তাঁদের কেউ কেউ হয়তাে সমর্থন প্রত্যাহার করবেন। তিনি মি, মালেককে প্রবাসী বাঙালিদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবাদপত্র নিয়ে পরদিন পার্লামেন্টে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পরামর্শ দেন। মি. মালিক তার কন্যার সাহায্যে একটি প্রতিবাদপত্র টাইপ করে পরদিন মি. শশারের হাতে পৌঁছে দেন। মি. শাের এই প্রতিবাদপত্র নিয়ে শ্রমিকদলীয় নেতা মি. হ্যারল্ড উইলসনের সঙ্গে আলাপ করেন। পার্লামেন্ট-বহির্ভূত বাংলাদেশ সমর্থক মহলও পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ করে বাংলাদেশ-বিরােধী প্রচারণা বন্ধের দাবি জানায়।

বিচারপতি চৌধুরীও এ ব্যাপারে কর্মতৎপরতার পরিচয় দেন। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সমর্থনদানকারী পার্লামেন্ট সদস্যদের সহায়তায় আরও চারজন সুপরিচিত সদস্যকে বাংলাদেশ ও ভারত পরিদর্শনের জন্য তিনি রাজি করান। এঁদের মধ্যে ছিলেন রক্ষণশীল দলভুক্ত জেমস্ র্যামডেন ও টোবি জ্যাসেল এবং শ্রমিক দলভুক্ত আর্থার বটলি ও রেজ প্রেন্টিস্। ২১ জুন তারা লন্ডন ত্যাগ করেন। ৭৯ | বাংলাদেশ নিউজলেটার’-এর সম্পাদকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান ফরিদ এস জাফরী জুন মাসে লিখিত এক খােলা-চিঠিতে মিসেস জিল্ নাইটের পাকিস্তান-প্রীতির তীব্র সমালােচনা করেন। এই চিঠিতে বলা হয়, আপনি যদি “দি সানডে টাইমস’-এ প্রকাশিত এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের ‘গণহত্যা’ শীর্ষক বিস্তারিত রিপাের্ট পড়ে থাকেন, তা হলে আপনি নিশ্চয় হত্যাযজ্ঞের স্থান ও কাল এবং নিহতদের নাম-ঠিকানা লক্ষ্য করেছেন। এসব প্রামাণ্য তথ্য আপনি কি অস্বীকার করতে চান? হিন্দু ও মুসলমানদের জ্বালিয়ে দেয়া বাড়িঘর কি আপনি দেখেছেন? পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রে হিন্দুদের সমূলে উৎখাত করে দেশত্যাগে বাধ্য করার দাবি সম্পর্কিত খবর কি আপনি পড়েছেন? পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণে ইসলামাবাদে গিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ-আলােচনার পর বাস্তুত্যাগীদের দেশে ফিরে আসার ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানের আন্তরিকতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া আপনার নিরপেক্ষতার অভাব প্রমাণ করে। আপনি স্বেচ্ছায় নিতান্ত বােকার মতাে পাকিস্তান সরকারের মিথ্যা প্রচারণার শিকার হয়েছেন বলে আমরা অবাক হচ্ছি। মানবাধিকারের সমর্থক না হয়ে আপনি নিজেকে খুনি সরকারের অন্ধ-সমর্থক বলে প্রমাণ করেছেন। ব্যাপারটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও আপাতবিরােধী সত্য, এ সম্বন্ধে কোনাে সন্দেহ নেই। মহান মুক্তিযােদ্ধাদের চরম আত্মত্যাগ ও কষ্টভােগ সম্পর্কে আপনার অযৌক্তিক মন্তব্যের বিরুদ্ধে আমাদের ঘৃণা ও ক্ষোভ ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে। আপনার লজ্জাকর ভূমিকা সম্পর্কে রায় দেয়ার ভার আমরা ব্রিটেনের জনগণের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। ২৮ জুন লন্ডনের রেড় লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে গ্রেটার লন্ডন ও পার্শ্ববর্তী এলাকার অ্যাকশন কমিটিগুলাের প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী কেন্দ্রীয় এ্যাকশন কমিটির নির্বাচন স্থগিত রাখার কারণ বিশ্লেষণ করেন এবং একতা বজায় রাখার জন্য আবেদন জানান। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় এ্যাকশন কমিটির কাজ স্টিয়ারিং কমিটি চালিয়ে যাচ্ছে এবং তা সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মধ্যে সবার দৃষ্টি যদি নির্বাচনের দিকে চলে যায়, তা হলে সাংগঠনিক কাজ পিছিয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন। জাতীয় স্বার্থে আরও কিছুদিন নির্বাচন স্থগিত রাখার জন্য তিনি অনুরােধ করেন। প্রতিনিধিরা তার আবেদনে সাড়া দেয়ার ফলে দলাদলির বিপদ থেকে আন্দোলন রক্ষা পায় বলে তিনি পরবর্তীকালে মন্তব্য করেন।  ২৯ জুন পনেরজন বাঙালি খালাসি ও অফিসার ওয়েলসের কার্ডিফ বন্দরে নােঙর করা পাকিস্তানি জাহাজ এম ভি কর্ণফুলি’ থেকে পালিয়ে ট্রেনযােগে লন্ডনে এসে স্বরাষ্ট্র দফতরে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন।

তারা বলেন, করাচি থেকে রওনা হওয়ার পর নানাভাবে তাদের হয়রান, অপমান, এমনকি শারীরিক নির্যাতন করা হয়। অফিসারদের মুখপাত্র এ কে এম নুরুল হুদা (ইঞ্জিনিয়ার) বলেন, পাকিস্তানে ফিরে গেলে তাদের শারীরিক নির্যাতন কিংবা হত্যা করা হবে বলে তারা আশঙ্কা করেন। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্রবাহী জাহাজ থেকে ডক শ্রমিকরা মাল খালাস করতে অস্বীকার করার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা জাহাজে উঠে বাঙালি খালাসিদের প্রত্যেককে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়। | কার্ডিফ থেকে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য এ্যালফ্রেড এভান্সের সহায়তায় বিচারপতি চৌধুরী বাঙালি খালাসি ও অফিসারদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রার্থনা। মঞ্জুর করাতে সক্ষম হন। এ কে এম নুরুল হুদাকে স্টিয়ারিং কমিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ােগ করা হয়। ৩০ জুন (বুধবার) দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক পূর্ণ-পৃষ্ঠা বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের দাবি জানানাে হয়। ১৫ জুন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সমর্থক সদস্যরা যে প্রস্তাব পেশ করেন, তা বড় বড় অক্ষরে ছাপিয়ে তার নিচে দু’শ’জনেরও বেশি পার্লামেন্ট সদস্যের নাম প্রকাশ করা হয়। এদের মধ্যে ১১ জন প্রিভি কাউন্সিলর এবং ৩০ জনেরও বেশি প্রাক্তন মন্ত্রীর নাম রয়েছে। বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে এই বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। জুন মাসে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি প্রায় ছ’শ পত্রের মাধ্যমে ব্রিটেনের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের কাছে পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন এবং মুক্তিবাহিনীকে সাহায্যদানের জন্য অনুরােধ জানান।

 

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি – যুক্তরাজ্য আবদুল মতিন