You dont have javascript enabled! Please enable it!

মে, ১৯৭১

১ মে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউমের কাছে লিখিত এক পত্রে বিরােধীদলীয় নেতা হ্যারল্ড উইলসনের অন্যতম পার্লামেন্টারি প্রাইভেট সেক্রেটারি ফ্র্যাঙ্ক জাড পাকিস্তানকে সাহায্যদান অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানান। পশ্চিম বঙ্গ সফর শেষে লন্ডনে ফিরে এসে ব্রুস ডগলাসম্যান ১ মে দি সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকার সংবাদদাতাকে বলেন, শরণার্থীদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার পর মুক্তাঞ্চলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন সে সম্পর্কে তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি মি. রয়ালের সঙ্গে আলােচনা করেছেন। লন্ডনের কোনাে কোনাে পত্রিকায় প্রকাশিত বিভ্রান্তিমূলক সংবাদের প্রতিবাদ করে তিনি বলেন, যশাের জেলায় মুক্তিযােদ্ধারা তাদের আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। পূর্ব বঙ্গের সঙ্কট পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার নয় বলে তিনি স্পষ্ট অভিমত প্রকাশ করেন। মি. রয়ালের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে জন। স্টোনহাউসও উপস্থিত ছিলেন। ব্রিটেন সফরকারী পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের বিরুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের বিক্ষোভের ফলে ক্রীড়ামােদীরা বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি হারাতে পারে বলে ১ মে দি গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পদদলিত করার বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ব্রিটেনসহ গণতন্ত্রের আন্তর্জাতিক সমর্থকরা প্রতিবাদ করবে বলে আশা করা স্বাভাবিক। কিন্তু তারা প্রকাশ্যে উচ্চবাচ্য করেনি। কাজেই বাঙালিদের পক্ষে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা ছাড়া আর কোনাে উপায় নেই বলে উক্ত নিবন্ধে মন্তব্য করা হয়। ১ মে উরস্টার শহরে পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের প্রথম ম্যাচের বিরুদ্ধে প্রায় ছ’শ বাঙালি পুরুষ ও মহিলা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির বার্মিংহাম শাখার প্রেসিডেন্ট জগলুল পাশার নেতৃত্বে এই বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। লন্ডন থেকে কোচযােগে আগত প্রায় একশ’ বাঙালি ছাত্র ও যুবক এই বিক্ষোভে যােগদান করে। নিরাপদ পরিবেশে স্টিয়ারিং কমিটির অফিস স্থাপনের জন্য শেখ আবদুল মান্নান ও তার সহকর্মীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মে মাসের গােড়ার দিকে। ড, মােশাররফ হােসেন জোয়ারদার ও হারুন-অর-রশীদ শেখ মান্নানের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। ড. জোয়ারদার বলেন, বহির্বিশ্বের সঙ্গে পূর্ব বঙ্গের রফতানি বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে হেন্ডন অ্যাকশন কমিটির প্রেসিডেন্ট হারুন-অররশীদের পাট-রফতানি ব্যবসাও বন্ধ হয়ে গেছে। পূর্ব লন্ডনের ১১ নম্বর গােরিং স্ট্রিটে অবস্থিত দোতলা দালানে তার অফিস তিনি আর চালাতে পারছেন না।

তার অফিসে তিনটি টেলিফোন, টেবিল, টাইপ-রাইটার এবং অফিসের জন্য প্রয়ােজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্র রয়েছে। স্টিয়ারিং কমিটির জন্য নেয়া হলে তিনি অফিসটির জন্য যে ভাড়া দিচ্ছেন, তাই দিতে হবে। ভাড়া নেয়া সম্পর্কে বিচারপতি চৌধুরীর সম্মতি পাওয়ার পর ৩ মে গােরিং স্ট্রিটে স্টিয়ারিং কমিটির অফিস খােলা হয়।৫৬ নতুন অফিসে বিচারপতি চৌধুরীর উপস্থিতিতে স্টিয়ারিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। শামসুল আলম চৌধুরী অফিস সেক্রেটারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।  নতুন অফিসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন উপলক্ষে সমবেত বাঙালিদের উদ্দেশে বিচারপতি চৌধুরী বলেন : “মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর পাকিস্তান মৃত্যুবরণ করেছে। বাংলাদেশ আজ একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সংগ্রাম করছে। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীকে খতম না করা পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পূর্ব বাংলায় সংঘটিত গণহত্যা কিছুতেই পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার হতে পারে না। জাতিসংঘ ও ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস এই গণহত্যা সম্পর্কে তদন্ত করে অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তিদানের ব্যবস্থা করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।  স্টিয়ারিং কমিটির অফিস ভাড়া নেয়ার কিছুকাল পর হারুন-অর-রশীদ একখানি চিঠি নিয়ে দেখা করতে আসেন। চিঠিখানি খুলনা থেকে তার স্ত্রীর নামে লেখা। হয়েছে। শেখ মান্নান ও তাঁর সহকর্মীদের সামনে এসে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। চিঠিতে বলা হয়েছে, তাঁর ১৪ বছর-বয়সী ভাইকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে গিয়ে প্রথমে নির্মমভাবে মারধর করেছে, তারপর কান দুটো কেটে ফেলেছে এবং সব শেষে গাছে ঝুলিয়ে তার চোখ দুটো উপড়ে ফেলেছে। অবিলম্বে এই চিঠির ইংরেজি অনুবাদ করে শেখ মান্নান জাকারিয়া খান চৌধুরীসহ কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে পার্লামেন্ট ভবনে যান। শ্রমিকদলীয় সদস্য জন স্টোনহাউসের সঙ্গে দেখা করে তাঁরা চিঠিখানি অবিলম্বে স্পিকারের হাতে পৌঁছে দেয়ার জন্য অনুরােধ করেন। বাংলাদেশের নিরপরাধ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করার এই জঘন্য চিত্র পার্লামেন্ট সদস্যদের কাছে পৌছে দেয়ার ফলে প্রবাসী বাঙালিরা তাদের অকুণ্ঠ। সাহায্য ও সহানুভূতি পেয়েছিলেন।৮

৬ মে ‘দি মর্নিং স্টার’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বার্মিংহামের নিকটবর্তী এজবাস্টন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের বাইরে প্রায় দু’হাজার বাঙালি পুরুষ ও মহিলা যুক্তরাজ্য সফররত পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। জগলুল পাশা বিক্ষোভকারীদের নেতৃত্ব দেন। উল্লিখিত তারিখে ‘দি ইভিনিং স্টার’-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, ১৯৪৭ সালে জোড়াতালি দিয়ে যে দুটি দেশকে এক দেশ বলে ঘােষণা করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বলা চলে না। এই দুটি দেশের মধ্যে একটি। যে অপরটির সম্পূরক নয়, তা এখন দিনের আলাের মতাে স্পষ্ট।  ইতােমধ্যে ‘মুজিবনগর সরকার বিচারপতি চৌধুরীকে আমেরিকায় গিয়ে জাতিসংঘে নিয়ােজিত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদল ও মার্কিন জনসাধারণকে বাংলাদেশের আন্দোলন সম্পর্কে অবহিত করার জন্য অনুরােধ করেন। তিনি অবিলম্বে মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে তিন মাসের ভিসার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু কন্সাল-জেনারেল তাকে ১৯৭১ সালের ৬ মে থেকে ১৯৭৫ সালের ৬ মে পর্যন্ত চার বছরের ভিসা মঞ্জুর করেন। চার বছরের মধ্যে যতবার খুশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার অনুমতি ভুলক্রমে দেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে কন্সাল-জেনারেল বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন : ‘না, ভুল নয়, ইচ্ছা করেই দিয়েছি। একবার গেলেই আপনার দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে সেটা ভাবি নি।… দেখুন, মি, জাস্টিস চৌধুরী, ব্যাপারটা হচ্ছে এই—আপনি আমাদের দেশে যাচ্ছেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে [ প্রচারকার্য চালাতে। পাকিস্তান আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। তাদের আমরা অসন্তুষ্ট করতে পারি না। সে রকম চিঠি পেলে আমরা পাকিস্তানিদের জানিয়ে দেব যে আর আপনাকে ভিসা দেয়া হবে না। অল্প দিনের ভিসা দিলে আপনি ভিসার জন্য আবার  আসতেন; তাই আমরা ঠিক করলাম যে আপনাকে আমরা চার বছরের ভিসা দেব।  তা হলে পাকিস্তান ও আপনারা দু’পক্ষই আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবেন।”  ৮ মে গােরিং স্ট্রিটের অফিসে সমগ্র যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির প্রায় একশ’জন প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারির এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার পর এই সভা সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য বলে বিবেচিত হয়।

সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আন্দোলনের সাহায্যার্থে বাংলাদেশ ফান্ড’ নামের একটি তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তহবিল পরিচালনার জন্য বাের্ড। অব ট্রাস্টি’র বাঙালি সদস্য নির্বাচনের ব্যাপারে জটিলতা দেখা দেয়। বিচারপতি। চৌধুরী প্রথমে ‘বাের্ড অব ট্রাস্টি’-র সদস্য হতে রাজি হন নি। বহু আলাপআলােচনার পর বিচারপতি চৌধুরী, বিশিষ্ট সমাজকর্মী ডােনাল্ড চেসওয়ার্থ ও শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউসকে সদস্য মনােনীত করে ‘বাের্ড অব ট্রাস্টি’ গঠন করা হয়। বাংলাদেশ তখনাে পর্যন্ত স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ার ফলে কোনাে ব্যাঙ্কই ‘বাংলাদেশ ফান্ড’ নামে একাউন্ট খুলতে রাজি হচ্ছিল।  অনেক চেষ্টার পর হ্যামরােজ ব্যাঙ্ক নামের একটি মার্চেন্ট ব্যাঙ্ক একাউন্ট। খুলতে রাজি হয়। কিছুকাল পর হ্যামরােজ ব্যাঙ্ক হঠাৎ একাউন্টটি বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বহু চেষ্টার পর ‘বাের্ড অব ট্রাস্টি’-র সদস্যগণ ন্যাশনাল ওয়েস্টমিস্টার ব্যাঙ্কে নতুন একাউন্ট খুলতে সক্ষম হন। বিচারপতি চৌধুরী তার স্মৃতিকথায় বলেন, পাকিস্তান দূতাবাসের প্রতিবাদের ফলেই হ্যামরােজ ব্যাঙ্ক উল্লিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল বলে তিনি পরবর্তীকালে জানতে পেরেছিলেন। ‘বাংলাদেশ ফান্ড থেকে স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও ট্রাস্টিবৃন্দ এবং বিচারপতি চৌধুরী নিজে কোনাে অর্থ গ্রহণ করেন নি।৬০

৮ মে লন্ডনের উত্তরে অবস্থিত নর্থহ্যাম্পটন শহরের ক্রিকেট গ্রাউন্ডের বাইরে প্রায় দু’শ বাঙালি পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান এবং পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমকে দেশে ফিরে যাওয়ার দাবি সংবলিত ‘স্লোগান দেয়। | স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থনে জনসভায় বক্তৃতাদানের জন্য যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিচারপতি চৌধুরীকে অনুরােধ জানানাে হয়। এই অনুরােধের পরিপ্রেক্ষিতে ৯ মে সকালবেলা ব্র্যাডফোর্ড এবং বিকেলবেলা বার্মিংহামে জনসভার আয়ােজন করা হয়। ব্র্যাডফোর্ডে অনুষ্ঠিত জনসভা স্টিয়ারিং কমিটির পরিকল্পনা অনুযায়ী জনসংযােগের প্রথম প্রচেষ্টা। একটি আহ্বায়ক কমিটি এই জনসভার আয়ােজন করে। কমিটির সদস্যদের মধ্যে মুসাব্বির তরফদার এবং এ কে এম এনায়েতউল্লাহর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। মি. খান এই কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ব্র্যাডফোর্ডে একটি জনাকীর্ণ হলে জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালবাসি’ দিয়ে সভার কাজ শুরু হয়। তার বক্তৃতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে বিচারপতি চৌধুরী বলেন : ‘বন্দি হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে বাংলার নেতা (শেখ মুজিবুর রহমান) স্বাধীনতা ঘােষণা করে সমগ্র বাঙালি জাতির আশা ও আকাক্ষারই প্রতিধ্বনি করেছেন। শেখ মুজিবকে বন্দি করে পাকিস্তান বাঙালি জাতির অনুভূতির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করেছে বলে তিনি দৃঢ় কণ্ঠে ঘােষণা করেন। দীর্ঘ বক্তৃতায় মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ ব্যাখ্যা করেন। সমবেত জনসাধারণ ‘জয় বাংলা’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, ‘বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হােক’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ঘােষণা করে। ব্র্যাডফোর্ড থেকে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসােসিয়েশনের সদস্য ড. মােশাররফ হােসেন জোয়ারদার ও স্টিয়ারিং কমিটির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক শেখ আবদুল মান্নানসহ বার্মিংহাম যান। বার্মিংহাম অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে জগলুল পাশা এবং স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে শেখ মান্নানের বক্তৃতার পর বিচারপতি চৌধুরী প্রধান বক্তা হিসেবে তার বক্তব্য পেশ করেন। বিচারপতি চৌধুরী বলেন : ‘পচিশে মার্চের স্তব্ধ অন্ধকারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এক নবজাগ্রত জাতির জয়যাত্রা শুরু হয়েছে। সেই ন্যায়যুদ্ধে আপনারা সকলেই যােগদান করেছেন।

আপনাদের সঙ্গে একজন নগণ্য বাঙালি হিসেবে আমিও এসে দাড়িয়েছি। আমরা চেয়েছিলাম সমান অধিকার, এগিয়ে চলেছিলাম নিয়মতান্ত্রিক পথে। সেই সময় প্রতারণার দ্বারা সময় হরণ করে পাকিস্তান থেকে সৈন্য এনে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে শ্যামল বাংলার বুকে মা-বােনের ইজ্জত হরণ, লুণ্ঠন আর গণহত্যার জন্য। এই সভার কথা উল্লেখ করে বিচারপতি চৌধুরী তাঁর স্মৃতিকথায় বলেন : ‘বাঙালির সংগ্রাম ছিল আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। সে আদর্শ এমন এক অনুপ্রেরণা, উদ্দীপনা ও উৎসাহের সৃষ্টি করেছিল, যা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব।”৬১  ১০ মে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করার জন্য ব্রিটেনের শ্রমিক ও বিভিন্ন প্রগতিশীল শক্তির প্রতি আহ্বান জানায়।  ১২ মে ল্যাঙ্কাশায়ার ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে পাচ-সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল ৬৩০-সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রত্যেক সদস্যের হাতে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে ৬৩০ খানি চিঠি নিয়ে পার্লামেন্ট ভবনে এসে হাজির হন। প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন এম রহমান, জাহির চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, এ কে কামালউদ্দিন এবং লতিফ আহমদ। প্রতিনিধিদলের ছবি পরদিন ‘ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। | ১৩ মে দি টাইমস্ -এর প্রায় এক পৃষ্ঠাব্যাপী বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সৈন্যবাহিনী অপসারণ না করা পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোনাে প্রকার সাহায্যদানে বিরত থাকার জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। ব্রিটেনের ২০৬জন বুদ্ধিজীবী, পার্লামেন্ট সদস্য ও প্রখ্যাত নাগরিকদের দস্তখত সংবলিত বিজ্ঞাপনে হাজার হাজার নিরপরাধ ব্যক্তি-হত্যার ঘটনাকে পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার বলে উল্লেখ করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের সমালােচনা করা হয়। ২৫ মার্চ রাত্রিবেলা ঢাকায় সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের আভাস দেয়ার উদ্দেশ্যে বন্ধ-করা দোকানপাটের সামনে পড়ে থাকা একটি বিকৃত মৃতদেহের ভীতিপ্রদ ছবি বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়। বিজ্ঞাপনটির শিরােনাম ছিল এই মুহূর্ত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, মানুষ অভ্যন্তরীণ সমস্যার চেয়ে অনেক বড়।’ অ্যাসােসিয়েটেড প্রেস গৃহীত এই ছবিতে পাকিস্তানের প্রকৃত উদ্দেশ্য পরিষ্কার বােঝা যায়।

বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক ‘অ্যাকশান বাংলাদেশ’ বিজ্ঞাপনের ব্যয়ভার বহন করে। বিজ্ঞাপনটি কেটে নিজের নাম ও ঠিকানা যােগ করে নিজ নিজ এলাকার পার্লামেন্ট সদস্যদের কাছে ডাকযােগে পাঠাবার জন্য পাঠক-পাঠিকাদের অনুরােধ জানানাে হয়। ১৩ মে ‘দি গার্ডিয়ান-এ নীরব বিবেক’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়। আগামী কাল (১৪ মে) পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনাকালে ইয়াহিয়া খান ও অখণ্ড পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে বলে ভান করা সরকার কিংবা বিরােধীদলের সদস্যদের পক্ষে উচিত হবে না। পাকিস্তান ভেঙে যাবে; কবে। পর্যন্ত ভাঙবে সেটাই এখন লক্ষণীয়। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার পন্থা তদারক করার জন্য শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া সম্ভব হলে ব্যাপারটা সহজতর এবং রক্তপাতের পরিমাণ স্বল্পতর হবে। কারণ, মুজিব নিজেকে শান্তিপ্রিয় বলে প্রমাণ করেছেন।’  কার্ডিফে সংগঠিত দক্ষিণ ওয়েলসের বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির পাঁচজন সদস্য বাংলাদেশ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে ১৩ মে দুপুরবেলা থেকে পরদিন বিকেলবেলা পর্যন্ত মােট ২৬ ঘণ্টা অনশন পালন করেন। অনশনকারীদের মধ্যে ছিলেন আবদুল হান্নান, এম জেড মিয়া, মােহাম্মদ ফিরােজ, আবদুল হালিম ও আবদুস শহীদ। অ্যাকশন কমিটির এক বিবৃতিতে বলা হয়, দক্ষিণ ওয়েলস্ থেকে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যরা বাংলাদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণ দাবির সমর্থক।  মে মাসের প্রথম দিকে শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য ব্রুস ডগলাসম্যান বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে হাউস অব কমন্সে যে ব্যক্তিগত প্রস্তাব পেশ করেন, সে সম্পর্কে ১৪ মে সরকার ও বিরােধীদলের সম্মতিক্রমে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। এর আগেই বিচারপতি চৌধুরী ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকালে স্যার আলেক বলেন, শেখ মুজিবের স্বাস্থ্য। সম্পর্কে উদ্বেগের কারণ নেই বলে পাকিস্তান সরকার ব্রিটিশ সরকারকে জানিয়েছে। পাকিস্তান সরকারের এই উক্তি বিশ্বাস না করে ইসলামাবাদে অবস্থিত ব্রিটিশ হাই। কমিশনের মাধ্যমে প্রকৃত খবর সংগ্রহ করার জন্য বিচারপতি চৌধুরী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরােধ করেন। স্যার আলেক বলেন, শেখ মুজিবের মুক্তি ও বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলােচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকারকে রাজি করানাের জন্য ব্রিটিশ সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। প্রায় তিনশ’ পার্লামেন্ট সদস্য মি, ডগলাসম্যানের প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। সমর্থনকারীদের মধ্যে পিটার শাের, মাইকেল বার্নস্, ফ্র্যাঙ্ক এলান, হিট ফ্রেজার, ফ্রেড এভান্স, এন্ড্রু ফাউন্ড, রেজ ফ্রিসন, হিউ জেনকিন্স, জন সিলকিন, রবার্ট প্যারি, জন স্টোনহাউস, ইয়ান মিকার্ডো, স্যার জেরাল্ড নেবারাে প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

প্রস্তাবের পক্ষে বক্তৃতাদানকালে মি. ডগলাসম্যান বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপকতা এবং তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে যে প্রচণ্ড ঘৃণার উদ্রেক হয়েছে তার ফলে পাকিস্তান আজ এক রাষ্ট্র হিসেবে মৃত। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী সর্বপ্রথম বাঙালিদের হত্যা করতে শুরু করে বলে বিভিন্ন মহল থেকে। তাঁকে বলা হয়েছে। সংঘর্ষ চলাকালে পাকিস্তানকে কোনাে প্রকার সাহায্য না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকৃতির ভিত্তিতে পূর্ব বঙ্গ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। তিনি আরও বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীকে বের করে না দেয়া পর্যন্ত সংঘর্ষ অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগের পক্ষে ক্রমাগত গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য রয়েছে। অবিলম্বে শান্তি স্থাপন করার ব্যবস্থা করা হলে বর্তমান পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে পর্যবসিত হবে। এর ফলে লক্ষ লক্ষ লােক খাদ্যাভাবে, মহামারী ও বুলেটের আঘাতে মৃত্যুবরণ করবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্রিটেনের যে প্রভাব রয়েছে তা প্রয়ােগ করে পাকিস্তানকে সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা ব্রিটিশ সরকারের কর্তব্য। | তিনি আশা করেন, পাকিস্তানকে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল থেকে সাহায্যদান বন্ধ রাখার জন্য ব্রিটিশ সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ইতােমধ্যে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গুরুতর সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যুদ্ধ বাবদ পাকিস্তানকে দৈনিক দশ লক্ষ পাউন্ড খরচ করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধের অবসান ঘােষণা না করা পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোনাে প্রকার সাহায্য না দেয়ার জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে দাবি জানান। | বৈদেশিক উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী রিচার্ড উড় বলেন, পূর্ব বঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু বৈদেশিক সাহায্যদান বন্ধ রেখে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবকে পূর্ব বঙ্গে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তা যাচাই করা সম্ভব হয় নি। সর্বশেষ সংবাদে প্রকাশ, তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি করে রাখা হয়েছে এবং সম্ভবত তার বিচারের ব্যবস্থা করা হবে।  প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এডওয়ার্ড হিথ ব্যক্তিগত ভিত্তিতে গােপন আলােচনা করেছেন বলে মি. উত্ প্রকাশ করেন। আলােচনাকালে মি. হিথ পূর্ববাংলা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরামর্শ দেন। 

শ্রমিক দলের নেতৃস্থানীয় সদস্য ডেনিস হিলি বলেন, পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবের বিচারের ব্যবস্থা করবে না বলে তিনি আশা করেন। যদি তা করা হয় তা হলে বর্তমান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। জনগণের আশা-আকাক্ষা অনুযায়ী শিগগিরই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ যদি গ্রহণ না করা হয়, তা হলে ভারত ও পাকিস্তান প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতােমধ্যে রাশিয়া ও চীন যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। এই পরিস্থিতিতে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি ব্যাহত হওয়ার বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে।  উদারনৈতিক দলের সদস্য জন পার্ডো বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার ব্যাপারে ব্রিটেন, কমনওয়েলথ এবং জাতিসংঘ নিজেদের হীনবল বলে প্রমাণ করেছে। মনােবলের অভাবে তারা নৈতিক চাপ প্রয়ােগ করতে ব্যর্থ হয়। শ্রমিকদলীয় সদস্য জন স্টোনহাউস বলেন, পূর্ব বঙ্গের জনগণ পূর্ণ স্বাধীনতা চায় কিনা তা যাচাই করার জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি গণভােট গ্রহণ করা উচিত। এক হাজার মাইল দূরে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ইচ্ছার বিরুদ্ধে পূর্ব বঙ্গে তাদের শাসন চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।  আলােচনার উপসংহারে মি. উড় বলেন, পূর্ব বঙ্গে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য করবে। কিন্তু উন্নয়ন বন্ধ করে পূর্ব বঙ্গ সমস্যা সমাধানের জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়ােগ করার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার রাজি নয়। তা সত্ত্বেও তিনি মি. ডগলাসম্যানের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভােট দেয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন না। কারণ, তা অন্যায় হবে বলে তিনি মনে করেন। শেষ পর্যন্ত সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিতর্কের রিপাের্ট পরদিন ফলাও করে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এর ফলে প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতীয় সােশ্যালিস্ট পার্টির নেত্রী মিসেস অরুণা আসফ আলী মস্কো থেকে ফেরার পথে লন্ডনে আসেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আন্দোলনের উৎসাহী সমর্থক হিসেবে তিনি সুপরিচিত। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে ভারতে ও বিদেশে জনমত গড়ে তােলার জন্য তিনি সর্বশক্তি নিয়ােগ করেন। লন্ডনে অবস্থানকালে তিনি কয়েকটি ব্রিটিশ ও বাঙালি গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করেন।

লন্ডনের রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে লিঙ্ক ফোরাম’ গ্রুপের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে মিসেস আসফ আলী বলেন, ভারতের জনগণ বাংলাদেশের সংগ্রামকে জাতীয় বিপ্লব বলে মনে করে। কারণ, বাংলাদেশের জনগণ একযােগে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছে। দল ও মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন কি করে স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত হয়, তা ব্যাখ্যা করেন। সন্ধ্যায় বিমানযােগে তারা লন্ডনে ফিরে আসেন। | মে মাসের শেষদিকে আফগানিস্তানে অবস্থানরত প্রবীণ জননেতা খান আবদুল গাফফার খান বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে এক দীর্ঘ বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির খবর তিনি বেতারযােগে পেয়েছেন। এর ফলে বাঙালিদের ওপর ভীতির রাজত্ব কায়েম হয়েছে। তাদের দুর্দশার জন্য তিনি অত্যন্ত বেদনাবােধ করেন।  প্রকৃত পরিস্থিতির সংবাদ ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও সীমান্ত প্রদেশের কাইয়ুম খানের মিথ্যা প্রচারণার সমালােচনা করে গাফফার খান বলেন, পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করা বর্তমান যুদ্ধের উদ্দেশ্য নয়; ক্ষমতা দখল করাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। পাঞ্জাবের ধনিক শ্রেণী এবং উর্ধ্বতন সামরিক নেতৃবৃন্দ নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতা দখল করেছে। হতভাগ্য বাংলার আর কোনাে অপরাধ নেই; তারা নির্বাচনে জয়লাভ করেছে, এটাই তাদের অপরাধ। বাঙালিদের সঙ্গে আজ যে খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেই একই খেলা পসতুনদের সঙ্গে পাকিস্তান গঠনের সময় অনুষ্ঠিত হয়।  পাকিস্তানি ভাইবােনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গাফফার খান বলেন : ‘পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ সব সময়ে ধর্মের নামে আমাদের প্রতারিত করেছে। তারা পাকিস্তান ও ধর্মের নামে কথা বলার অধিকার দাবি করে। বাংলায় যা ঘটেছে তা কি ইসলামের জন্য ঘটেছে? আমরা একটানা সামরিক শাসনের আওতায় রয়েছি, একথা দয়া করে আপনারা মনে রাখবেন। গাফফার খান আরাে বলেন, জালালাবাদে নিয়ােজিত পাকিস্তানি কন্সাল তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারকালে বাঙালিরা পাকিস্তান ধ্বংস করেছে বলে উল্লেখ করেন। এর উত্তরে তিনি বলেন, ট্যাঙ্ক, মেশিনগান ও বােমা দিয়ে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করা যাবে না। পাকিস্তান সরকার বাস্তবিকই যদি পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করতে চায়, তা হলে তিনি শেখ মুজিব ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার জন্য মধ্যস্থতা করতে রাজি হবেন। পাকিস্তান সরকার যদি শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় তাহলে তিনি বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবেন।

কিছুকাল পর পাকিস্তানি কন্সল গাফফার খানের সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাৎ করে। বলেন, তিনি এ সম্পর্কে তার একটি বিবৃতি প্রচার করবেন বলে পাকিস্তান সরকার আশা করে। গাফফার খান বলেন, বিবৃতি দেয়ার কোনাে প্রয়ােজন নেই; তবে তিনি বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য তৈরি রয়েছেন।  ২৪ মে বিচারপতি চৌধুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে রওনা হন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন এনামুল হক। তিনি তখন ফোর্ড ফাউন্ডেশনের বৃত্তি নিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় নিয়ােজিত ছিলেন। ২৭ মে ‘দি গার্ডিয়ান বাংলাদেশে পাকিস্তানি নৃশংসতা সম্পর্কে দু’জন খ্রিষ্টান ধর্মীয় নেতা রেভারেন্ড জন হ্যাস্টিংস ও রেভারেন্ড জন ক্ল্যাপহাম প্রদত্ত প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ প্রকাশ করে। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর এই নৃশংস অত্যাচারের কাহিনী অ্যাকশন বাংলাদেশ পুস্তিকাকারে পুনর্মুদ্রণ করে। পুস্তিকার শেষে বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য অ্যাকশন বাংলাদেশ বিশ্বসমাজকে আহবান জানায়। ২৯ মে বিচারপতি চৌধুরী লন্ডনে ফিরে আসেন। পরদিন তিনি ম্যাঞ্চেস্টারে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করেন। ম্যাঞ্চেস্টার রওনা হওয়ার আগে তিনি গােরিং স্ট্রিটের অফিসে গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কাছে বিদেশ থেকে অস্ত্র সরবরাহ সম্পর্কে একখানি চিঠি লিখে স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক আজিজুল হক ভূঁইয়ার মারফত পাঠাবার। ব্যবস্থা করেন। মি. ভুইয়া তিন মাস পর লন্ডনে ফিরে আসেন। তার অনুপস্থিতিতে শেখ আবদুল মান্নান স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক ও অফিস পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ম্যাঞ্চেস্টারের অধিবাসী প্রবীণ বাঙালি হাজী আবদুল মতিন উল্লিখিত সভার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য কবির চৌধুরী এবং স্থানীয় বাঙালি ছাত্রদের নেতা মহিউদ্দিন আহমদ তাকে সাহায্য করেন। বিরাট হলটিতে তিল ধারণেরও স্থান ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ তারিখের বক্তৃতার ক্যাসেট বাজিয়ে সভার কাজ শুরু হয়। বিচারপতি চৌধুরী তার বক্তৃতায় ২৫ মার্চের রাত থেকে শুরু করে ৩০ মে পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাবলির বিবরণ দেন। তিনি আমেরিকায় বাঙালিদের সংগঠন এবং কর্মতৎপরতার কথাও উল্লেখ করেন। শ্রোতারা জয় বাংলা’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’ ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করেন। হাজী আবদুল মতিন, শেখ আবদুল মান্নান, এনামুল হক এবং আরাে কয়েকজন এই সভায় বক্তৃতা করেন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি – যুক্তরাজ্য আবদুল মতিন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!