You dont have javascript enabled! Please enable it!

১ এপ্রিল, ১৯৭১

১ এপ্রিল ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর কূটনৈতিক সংবাদদাতা প্রদত্ত এক সংবাদে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা থেকে বিমানযােগে করাচিতে নিয়ে আসা হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। তিনি কোথায় ও কিভাবে রয়েছেন সে সম্পর্কে পাকিস্তান সরকার নীরব থাকার নীতি গ্রহণ করেছে।  একই তারিখে ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ৩১ মার্চ ভারতীয় পার্লামেন্টে গৃহীত এক প্রস্তাবে পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনগণের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান সফল হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়। মিসেস গান্ধী নিজে এই প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি ভারতীয় জনগণের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এবং তারা সর্বপ্রকার সাহায্যদানের জন্য প্রস্তুত।  ১৯৮৯ সালে লন্ডনে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ উইমেনস্ এ্যাসােসিয়েশন ইন্ গ্রেট ব্রিটেন’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মিসেস জেবুন্নেসা বখস্ বলেন : ‘পঁচিশে মার্চ আর্মি ক্র্যাডাউনের আগে থেকেই আমরা বুঝতে পারছিলাম, দেশে ভয়ঙ্কর একটা কিছু হতে যাচ্ছে। এ দেশের খবরের কাগজে কিছু কিছু সংবাদ আসছে। আমরা তাই মহিলাদের পক্ষ থেকে কিছু করার কথা ভাবছিলাম। এরপর এলাে পচিশে মার্চের ভয়াল রাত। আমরা বুঝলাম, আর নয়, অপেক্ষা করার দিন শেষ হয়ে গেছে। এবার রাস্তায় নামতে হবে। এর জন্য চাই একটা সংগঠন। আমরা কয়েকজন আলাপ-আলােচনা করতে থাকলাম। অবশেষে ২ এপ্রিল লোরি রােডে আমার বাড়িতে মিসেস ফেরদৌস রহমান, উর্মি রহমান, লুলু বিলকিস বানু এবং আরাে দু’একজন একত্র হলাম এবং সেদিনই আমাকে কনভেনার করে বাংলাদেশ উইমেনস্ অ্যাসােসিয়েশন ইন্ গ্রেট ব্রিটেন’ (বাংলাদেশ মহিলা সমিতি) প্রতিষ্ঠিত হয়।২৯ ৩ এপ্রিল (শনিবার) বাংলাদেশ মহিলা সমিতির উদ্যোগে একটি বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করা হয়। এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে মিসেস আনােয়ারা জাহান বলেন, সকালবেলা প্রায় তিনশ’ শাড়ি-পরিহিতা বাঙালি মহিলা টেমস্ নদীর উত্তর তীরবর্তী ভিক্টোরিয়া এ্যামব্যাঙ্কমেন্ট এলাকায় সারিবদ্ধ হয়ে বিক্ষোভমিছিলের জন্য তৈরি হন। অনেকের হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড। তার একদিকে বড় বড় অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা ছিল ‘স্টপ জেনােসাইড’, ‘রেকগনাইজ বাংলাদেশ’, “ইয়াহিয়া’স আর্মি-আউট আউট’ এবং অন্যদিকে বাংলায় লেখা ছিল ‘গণহত্যা বন্ধ কর,’ ‘বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দাও,’ ‘আমার নেতা তােমার নেতা-শেখ মুজিব। শেখ মুজিব, ‘ইয়াহিয়ার আর্মি-ভাগাে ভাগাে।’

কেউ কেউ শিশুদেরও সঙ্গে নিয়ে। এসেছিলেন। প্ল্যাকার্ডে লেখা শ্লোগানগুলাের সঙ্গে তােমার দেশ আমার দেশ-বাংলাদেশ’ শ্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে মহিলারা সুশৃঙ্খলভাবে হােয়াইটহল হয়ে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে অবস্থিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির দিকে। এগিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে একটি স্মারকলিপি হস্তান্তর করে মিছিল বাকিংহাম প্রাসাদে গিয়ে হাজির হয়। প্রাসাদে কর্মরত অফিসারদের হাতে স্মারকলিপি প্রদান করে মিছিল হাইড পার্কের দিকে এগিয়ে যায়। মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের চোখেমুখে ছিল দৃঢ় প্রত্যয়ের ছাপ। তারা শপথ নিয়েছেনদেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে এবং প্রয়ােজন হলে ব্যক্তিগত সুখ ও আরাম বিসর্জন দিতে হবে। হাইড পার্কে স্পিকার্স কর্নারের কাছে সমবেত হওয়ার পর নেত্রীস্থানীয় মহিলারা দেশের দুর্দিনে বাঙালি মহিলাদের নিজ নিজ কর্তব্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। মহিলাদের এই মিছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর লন্ডনে এটাই ছিল বাঙালি মহিলাদের প্রথম মিছিল। উল্লিখিত তারিখে সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রসঙ্গে ‘দি টাইমস’ ও ‘দি গার্ডিয়ান নিরপরাধ বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যার জন্য দায়ী পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। দি গার্ডিয়ান পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়, পাকিস্তানের তথাকথিত জাতীয় সংহতির মৃত্যু হয়েছে; নির্বিচারে হত্যার মাধ্যমে দুই অংশকে এক করা সম্ভব নয়।  ৪ এপ্রিল লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘দি অবজারভার’-এর মস্কো সংবাদদাতা দেব । মুরারকা প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগরনি। পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা অবিলম্বে প্রত্যাহার ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য ইয়াহিয়া খানের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। ৩ এপ্রিল প্রেরিত এক কূটনৈতিক বার্তায় তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে অধিকাংশ ভােটদাতার সমর্থন লাভের পর বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুর  রহমান এবং তার সহকর্মীদের গ্রেফতার ও নির্যাতন সােভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে উদ্বেগজনক। শক্তি প্রয়ােগের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা জটিলতর হবে বলে ।

তিনি বিশ্বাস করেন। এই সমস্যার শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য তিনি অনুরােধ জানান। সােভিয়েত প্রেসিডেন্টের আবেদন সম্পর্কিত খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বিচারপতি চৌধুরী এনামুল হকসহ (পরবর্তীকালে ডক্টর) লন্ডনস্থ সােভিয়েত দূতাবাসে গিয়ে জনৈক উর্ধ্বতন কূটনীতিবিদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।৩২ ৪ এপ্রিল (রােববার) দুপুরবেলা বাংলাদেশ স্টুডেন্টস্ অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে হাইড পার্কে বাংলাদেশের সমর্থনে একটি জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিল ফর দি পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শেখ আবদুল মান্নান এই জনসমাবেশে বক্তৃতা করেন। হাইড পার্ক থেকে একটি বিক্ষোভ-মিছিল ট্র্যাফালগার স্কোয়ারে গিয়ে কাউন্সিল ফর দি পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ এবং স্ট্রাথাম এলাকার অ্যাকশন কমিটির যৌথ ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত একটি বিরাট জনসভায় যােগ দেয়। এই সভায়। সভাপতিত্ব করেন গাউস খান। সভার কার্য পরিচালনা করেন বি এইচ তালুকদার। কাউন্সিলের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে শেখ আবদুল মান্নান এবং ঐথাম অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে আহমদ হােসেন জোয়ারদার সভায় বক্তৃতা করেন। অপর বক্তাদের মধ্যে ছিলেন সুলতান মাহমুদ শরীফ, হাজী আবদুল মতিন (ম্যাঞ্চেস্টার) ও সাখাওয়াত হােসেন। সভার পর একটি বিক্ষোভ মিছিল ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবি সংবলিত স্মারকলিপি পেশ করে। উল্লিখিত তারিখে সন্ধ্যায় লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড টাউন হলে শ্রমিক দলের প্রভাবশালী সদস্য জন এ্যানালসের সভাপতিত্বে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানাের জন্য আহুত এই সভায় বক্তৃতাদানকারীদের মধ্যে ছিলেন লর্ড (ফেনার) ব্রকওয়ে, শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শাের, পাকিস্তানি ছাত্রনেতা তারিক আলী, শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য মাইকেল বার্নস্, শেখ আবদুল মান্নান, লুলু বিলকিস বানু, লন্ডন আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি সুলতান মাহমুদ শরীফ ও বাংলাদেশ নিউজলেটার’-এর সম্পাদক ফরিদ এস, জাফরী।  লর্ড ব্রকওয়ে পূর্ব বঙ্গের ব্যাপারে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ দাবি করেন এবং পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে কোনাে প্রকার সাহায্য না দেয়ার জন্য শ্রীলঙ্কার । প্রতি আবেদন জানান। পিটার শাের পূর্ব বঙ্গের হত্যাকাণ্ডকে পাকিস্তানের। অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং বিধ্বস্ত এলাকায়। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল পাঠাবার ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ব্রিটিশ  সরকারের কাছে দাবি জানান।

মাইকেল বার্নস শরণার্থীদের সাহায্যদানের ব্যাপারে আলােচনা উপলক্ষে সময় অপচয় না করে পূর্ব বঙ্গ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করা বাঞ্ছনীয় বলে মন্তব্য। করেন। সুলতান শরীফ স্বাধীনতা সগ্রামে আওয়ামী লীগের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে বলেন, বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত বাঙালিরা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার’ সম্পাদক ফরিদ এস, জাফরী এবং পাকিস্তানি ছাত্রনেতা তারিক আলী পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করেন।৩৪ এই সভায় কোনাে কোনাে বক্তা বাংলাদেশ সংগ্রামকে ভিয়েতনামের সগ্রামের সঙ্গে তুলনা করেন। তাদের বক্তৃতা থেকে বােঝা যায়, বাংলাদেশের জীবনমরণ সংগ্রামে প্রতিবেশী ভারত ও অন্যান্য বন্ধু দেশের সাহায্য তারা প্রত্যাশা করেন। অধিকাংশ শ্রোতা তাঁদের সঙ্গে একমত হন। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বিচারপতি চৌধুরী ব্রিটিশ মিনিস্টার ফর ওভারসিজ ডেভেলাপমেন্ট রিচার্ড উডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ইয়ান সাদারল্যান্ড এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। তিনিও এই সাক্ষাৎকালে উপস্থিত ছিলেন। বিচারপতি চৌধুরী মি. উড়কে পূর্ব বঙ্গে রক্তক্ষয় বন্ধ এবং শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য যথাযােগ্য চেষ্টা করার অনুরােধ জানান। মি. উড বলেন, ব্রিটিশ সরকার ইতােমধ্যে পাকিস্তানে নিয়ােজিত ব্রিটিশ হাই কমিশনারের সঙ্গে এই ব্যাপারে যােগাযােগ করেছেন এবং একটি বন্ধু রাষ্ট্রের ওপর যতটা চাপ দেয়া সম্ভব তা তারা নিশ্চয় দেবেন।  ৬ এপ্রিল স্যার আলেক পাকিস্তান হাই কমিশনার সালমান আলীর সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী আলােচনাকালে পূর্ব বাংলা সম্পর্কে ব্রিটিশ মনােভাব জ্ঞাপন করেন। শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য ফ্রাঙ্ক জাডের এক চিঠির উত্তরে পাকিস্তান হাই কমিশনার জানান : পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবকে কয়েক দিন আগে গ্রেফতার করেছেন এবং বর্তমানে তিনি আটক রয়েছেন।’ ৬ এপ্রিল ‘দি গার্ডিয়ান ও ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এই সংবাদ প্রকাশিত হয়।  ৬ এপ্রিল (সােমবার) সকালবেলা জানা যায়, পূর্বদিন রাতে বেশ কিছুসংখ্যক পার্লামেন্ট সদস্য পূর্ব বঙ্গে ‘গৃহযুদ্ধ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকারকে। প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরােধ জানিয়ে পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব পেশ করেছেন। এদের মধ্যে ক্রস ডগলাসম্যান, ফ্রাঙ্ক জাড়, নাইজেল ফিসার, এরিক হেফার এবং জন পার্ডোর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।

সেদিন বিকেলবেলা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেক ডগলাস-হিউম পার্লামেন্টে পূর্ব বঙ্গ সমস্যা সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করেন। ৬ এপ্রিলের মধ্যে ১৬০ জনেরও বেশি পার্লামেন্ট সদস্য এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। স্যার আলেকের বক্তব্য বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থনকারীদের কিছুটা নিরাশ করে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক মতবিরােধ আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে দূর করা বাঞ্চনীয় বলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ইতঃপূর্বে ইয়াহিয়া খানকে জানিয়েছেন। আলােচনা ভেঙে যাওয়ার পর সামরিক বল প্রয়ােগ করার জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সংঘাত বন্ধ করে পুনরায় আলােচনা শুরু করার জন্য পাকিস্তানের কাছে আবেদন জানান। পার্লামেন্টে স্যার আলেক প্রদত্ত বক্তৃতার সমালােচনা প্রসঙ্গে ৬ এপ্রিল ‘দি গার্ডিয়ান-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, গতকাল স্যার আলেক ডগলাস-হিউম। পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবির প্রতি সমর্থন ঘােষণার সুযােগ পেয়েছিলেন। তিনি সে সুযােগের অপচয় করেছেন। তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিভিন্ন দলীয় সদস্যরা যে প্রশ্ন তুলেছেন সে সম্পর্কে অবাক হওয়া তার পক্ষে উচিত হবে না। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ভােটের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে ক্ষমতা গ্রহণের অধিকার। দিয়েছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্যই সামরিক অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক নির্যাতন অসঙ্গত—একথা খােলাখুলিভাবে বলতে না পারলে স্যার আলেকের পক্ষে বিবৃতিদান স্থগিত রাখা উচিত ছিল।৩৫ ইতঃপূর্বে টেলিফোন করে বিচারপতি চৌধুরী ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ও সম্মানিত শিক্ষাবিদ লর্ড জেমসের সঙ্গে ৬ এপ্রিল সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে মধ্যাহ্নভােজে আমন্ত্রণ জানান। অতিথি হিসেবে প্রায় পনেরােজন অধ্যাপক তাদের সঙ্গে যােগ দেন। লর্ড জেমস্ ও অন্যান্য অধ্যাপকদের সঙ্গে আলােচনাকালে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত গণহত্যা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেশ করেন। তিনি বলেন : ‘আমাদের সম-অধিকারের দাবি আজ স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আজ আমরা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দৃঢ়সঙ্কল্প। জীবনে কখনাে। রাজনীতির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু একজন আত্মসম্মানবােধসম্পন্ন বাঙালি হিসেবে আমিও সেই সংগ্রামে যােগদান করেছি। লর্ড জেমস্ বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা শিগগিরই বুঝতে পারবে তারা কি ভুল করেছে।

ছ’ মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন।৬ আওয়ামী লীগ পরিচালিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে প্রবাসী বাঙালিদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের সংযােগ স্থাপন এবং তার ব্যাপকতা সম্পর্কে তাজউদ্দিন আহমদ ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে ৭ এপ্রিল সুলতান মাহমুদ শরীফ, মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু ও মাহমুদ হােসেন লন্ডন থেকে কলকাতা রওনা হন। ব্রিটেনে দূতাবাস স্থাপনের ব্যাপারে সহায়তা করার জন্য তারা প্রায় তিন মাস পর লন্ডনে ফিরে আসেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি নির্যাতন ও মুক্তিযােদ্ধাদের অসীম সাহস সম্পর্কে তিনটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তারা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। এই চলচ্চিত্রগুলাে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে স্থানীয় অ্যাকশন কমিটিগুলাের উদ্যোগে প্রদর্শিত হয়। ১০ এপ্রিল বিচারপতি চৌধুরী পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউমের সঙ্গে দেখা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি এবং পূর্ব বাংলায় হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরােধ জানান। এ ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার যতদূর সম্ভব কূটনৈতিক চাপ দেবেন বলে স্যার আলেক আশ্বাস দেন। তার সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টাকাল আলাপের সময় মি, সাদারল্যান্ড ও মি. ব্যারিংটন উপস্থিত ছিলেন। আলােচনাকালে স্যার আলেক জানতে চান, বিচারপতি চৌধুরী কোথায় থাকবেন। বলে স্থির করেছেন। উত্তরে তিনি বলেন : ‘আমি ঠিক করেছি আমার দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত ব্রিটেনে অবস্থান করবাে, আর স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাবাে।’ এর উত্তরে স্যার আলেক অনেক কিছু না বলে একটি প্রীতিপূর্ণ হাসি উপহার দিলেন বলে বিচারপতি চৌধুরী তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেন। এই সাক্ষাৎকালে তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারেন, স্যার আলেক বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল।৩৭ হােয়াইটহলে অবস্থিত পররাষ্ট্র দফতর থেকে বেরিয়ে এসে বিচারপতি চৌধুরী একটি ট্যাক্সি নিয়ে অন্ডউই এলাকায় অবস্থিত বুশ হাউসে বি বি সি’র ওভারসিজ সার্ভিসের বাংলা বিভাগে যান। সিরাজুর রহমান ও শ্যামল লােধ তৈরি হয়েই ছিলেন। তারা বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এই সাক্ষাৎকারকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী হত্যার কাহিনী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বর্ণনা করে বলেন, বিশ্ববাসীকে এই নৃশংস হত্যার কথা তিনি জানাবেন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি দেশে ফিরবেন না। বি বি সি সেদিনই এই সাক্ষাৎকার প্রচার করে। কলকাতার সংবাদপত্রে এই সাক্ষাৎকারের রিপাের্ট প্রকাশিত হয়।  বি বি সির সঙ্গে সাক্ষাঙ্কারের পর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর পক্ষ থেকে পিটার গিল বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। 

উল্লিখিত সাক্ষাৎকারের পর বুশ হাউস ত্যাগ করার সময় স্থানীয় পাকিস্তান দূতাবাসে নিয়ােজিত সেকেন্ড সেক্রেটারি মহিউদ্দিন আহমদকে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। মহিউদ্দিন বলেন : ‘স্যার, আমি আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। আপনি ডাকলেই আমাকে পাবেন। তখনাে পর্যন্ত প্রবাসী সরকার গঠিত হয় নি। কাজেই বিচারপতি চৌধুরী তাকে তখনই চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনে যােগ দেয়ার কথা বলেন নি।  ১১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এক সভায় বেঙ্গল স্টুডেন্টস্ অ্যাকশন কমিটি বাংলাদেশ আন্দোলনে জড়িত অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও দলের সঙ্গে সহযােগিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ  করে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটির সদস্য-সংখ্যা ৩১-এ দাঁড়ায়। কমিটির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান এবং পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ দেয়ার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের কাছে আবেদন জানানাে হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করে নিয়ে ইয়াহিয়া সরকারের প্রতি চীনের সমর্থন প্রত্যাহার করার জন্য চেয়ারম্যান মাও সে-তুং-এর কাছে একটি তারবার্তা পাঠানাে হয়। ১২ এপ্রিল অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধি হিসেবে বহুসংখ্যক বাঙালি ছাত্র নিজেদের পতাকা ও স্বাধীনতার দাবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে কমিটি ফর নিউক্লিয়ার ডিআরমামেন্ট আয়ােজিত প্রতিবাদ মিছিলে অংশগ্রহণ করে ট্রাফালগার স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসমাবেশে যােগ দেয়। উল্লিখিত তারিখে লন্ডনের জেরার্ড স্ট্রিটে অবস্থিত ‘দি গ্যাঞ্জেস’ রেস্তোরার মালিক তাসাদুক আহমদ বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে ‘মুজিবনগর’-এ অবস্থান গ্রহণকারী ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামের সঙ্গে টেলিফোনযােগে আলাপ করেন। আলাপকালে আমীরুল ইসলাম বলেন, ভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত বিচারপতি চৌধুরীর বেতার সাক্ষাৎকারের বিবরণ পড়ে তাজউদ্দিন আহমদ ও তাঁর সহকর্মীরা অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে যারা ভারতে এসেছেন, তাঁরা শিগগির প্রবাসী সরকার গঠন করবেন এবং তাজউদ্দিন আহমদ হবেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে বিদেশে প্রবাসী সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি নিয়ােগ করতে চান। তার সম্মতি নেয়ার জন্য আমীরুল ইসলামকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে যােগাযােগ করিয়ে দেয়ার জন্য আমীরুল ইসলাম তাসাদুক আহমদকে অনুরােধ করেন।  ১২ এপ্রিল আমীরুল ইসলামের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সময় বিচারপতি চৌধুরী বলেন : ‘আপনাদের সঙ্গে কোনরূপ যােগাযােগ না হলেও আমি স্বাধীনতা। আন্দোলনে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমি ধন্যবাদের সঙ্গে বিশেষ প্রতিনিধিরূপে কাজ করার সম্মতি জানাচ্ছি। আপনি নেতৃবৃন্দকে আমার সালাম  জানাবেন এবং বলবেন যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে আমার সাধ্যমতাে সাহায্য করবাে।’  আমীরুল ইসলাম বললেন : “শিগগিরই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে এবং তার পরেই। আপনার নিয়ােগপত্র পাঠিয়ে দেয়া হবে।  আমিরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলার পর বিচারপতি চৌধুরী ব্যালহাম এলাকার বাড়ি থেকে উত্তর লন্ডনের ফিঞ্চলি এলাকার একটি বাড়িতে উঠে যান। পাকিস্তান হাই কমিশনার সালমান আলী ব্যালহামের বাড়ির টেলিফোন নম্বর যােগাড় করে। বিচারপতি চৌধুরীকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করা সত্ত্বেও বারবার তাকে টেলিফোন করা হয়। নিরাপত্তার খাতিরে তিনি বাড়ি বদলাতে বাধ্য হন। ফিঞ্চলির ফ্ল্যাটে এক সপ্তাহ থাকার পর তিনি পশ্চিম লন্ডনের এ্যাকটন এলাকায় একটি ছােট বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে যান। ফিঞ্চলির ফ্ল্যাটে থাকার সময় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড নামে পরিচিত লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের হেডকোয়ার্টার্স থেকে পুলিশ অফিসার মি, ল্যাঙ্গলি ও তার সহকর্মী মি, ওয়াকার বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। তারা পাকিস্তান সরকারের এক গােপন পরিকল্পনার কথা ফাস করে বলেন, সুযােগ পেলেই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সাদা পােশাকধারী গুপ্তচররা তাকে অপহরণ করে পাকিস্তানে নিয়ে যাবে। কাজেই তিনি যেন সাবধানে চলাফেরা করেন। অফিসাররা তাকে ভরসা দিয়ে বলেন, যুক্তরাজ্য সরকার তার নিরাপত্তা সম্পর্কে সাধ্যানুযায়ী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা। বিচারপতি চৌধুরীর গতিবিধির ওপর নজর রাখবেন। তার টেলিফোন নম্বরের গােপনীয়তা রক্ষা, অপরিচিত লােকের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং বেসরকারি যানবাহনযােগে চলাফেরা সম্পর্কে নানা ধরনের সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ। দিয়ে বিদায় নেয়ার আগে প্রয়ােজনমতাে ব্যবহার করার জন্য একটি টেলিফোন নম্বর দিয়ে যান। এই নম্বরে টেলিফোন করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি প্রয়ােজনীয় সাহায্য পাবেন।  ১৩ এপ্রিল লন্ডনের ‘দি ওয়াকার্স প্রেস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, গাউস খানের নেতৃত্বে কাউন্সিল ফর দি পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশের কয়েকশ’ বাঙালি সমর্থক ১২ এপ্রিল লন্ডনস্থ চীনা দূতাবাসে গিয়ে ইয়াহিয়া খানের প্রতি চীনের সমর্থন প্রত্যাহার করার আবেদন জানায়। কাউন্সিলের পক্ষ থেকে দূতাবাসের কর্মচারীদের হাতে প্রদত্ত এক স্মারকলিপিতে বলা হয়, বাঙালিরা অতীতে তাদের সংগ্রামে চীনকে সমর্থক বলে বিবেচনা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি তাদের বর্তমান নীতির ফলে বাঙালি জনসাধারণ চীনের প্রতি শ্রদ্ধা হারাতে শুরু করেছে। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিচারপতি চৌধুরী কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েটের সেক্রেটারি জেনারেল আর্নল্ড স্মিথ এবং অধ্যাপক জিনকিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। 

বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর মি. স্মিথ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি ব্যক্তিগত চিঠি লিখে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও পূর্ব বঙ্গে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য অনুরােধ জানাবেন বলে কথা দেন। | অধ্যাপক জিনকি ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি রক্ষণশীল দলের কমনওয়েলথ গ্রুপের সেক্রেটারি ছিলেন। তার আমন্ত্রণক্রমে বিচারপতি চৌধুরী রক্ষণশীল দলভুক্ত পার্লামেন্ট সদস্যদের এক সভায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে বক্তৃতা দেন। লর্ড সেলকার্ক এই সভায়। সভাপতিত্ব করেন। মূল বক্তৃতার পর লর্ড সেলকার্ক একটি সহানুভূতিমূলক বক্তৃতা দেন। পার্লামেন্ট সদস্যদের প্রশ্নের ধারা থেকে পরিষ্কার বােঝা যায়, তারা বাংলাদেশ আন্দোলনকে সমর্থন করেন। ১৩ এপ্রিল ‘দি টাইমস পত্রিকায় যুক্তরাজ্য প্রবাসী ভারতীয় লেখক নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর একটি চিঠি প্রকাশিত হয়। চিঠির শুরুতে তিনি বলেন, ব্রিটিশ সংবাদপত্র এবং বেতার ও টিভিতে পূর্ব বঙ্গের ঘটনাবলিকে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে বাঙালি হিসেবে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হয়েছেন। | ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর কলকাতার হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় (বর্তমানে অবলুপ্ত) প্রকাশিত তার এক নিবন্ধের উল্লেখ করে মি. চৌধুরী বলেন, তিনি যা আশঙ্কা করেছিলেন তা ঘটেছে। সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের অচিন্তনীয় শ্রেষ্ঠতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে এই শক্তি সাফল্যের সঙ্গে প্রয়ােগ করা হবে। তিনি পূর্ব বাংলার মুসলমানদের এ ব্যাপারে সংযত হওয়ার পরামর্শ দেন। পাকিস্তানের সামরিক আক্রমণ শুরু হওয়ার আগে ঢাকায় সমবেত ব্রিটিশ সাংবাদিকরা যে ধরনের সংবাদ পাঠিয়েছেন, তার ফলে বাঙালি মুসলমানরা চরম পন্থা গ্রহণে উৎসাহিত হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।  মি. চৌধুরী মনে করেন, পূর্ব বাংলায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা। ফিরিয়ে আনা পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর উদ্দেশ্য নয়। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা দূর করে তারা পূর্ব বাংলায় শত্রু-দেশ দখলকারী সৈন্যবাহিনী হিসেবে থাকার চেষ্টা করছে। তাদের এই চেষ্টা সফল হবে এবং অনির্দিষ্টকাল তারা পূর্ব বাংলা দখলে রাখতে সক্ষম হবে। দি টাইমস্’কে উপদেশ দিয়ে তিনি বলেন, আপনাদের উদ্দেশ্য সৎ বলে স্বীকার করে বলতে হচ্ছে, উভয় পক্ষের মধ্যে আলােচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের জন্য আপনারা যে পরামর্শ দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন অসম্ভব। উপসংহারে তিনি বলেন, বাঙালিদের প্রতিরােধ বৃদ্ধির সহায়ক কোনাে কিছু না করাই হবে দয়ালু মনােভাবের পরিচায়ক। উল্লিখিত তারিখে ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত অপর এক চিঠিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এন সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে যে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয় তার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। 

১৪ এপ্রিল ‘দি ওয়ার্কার্স প্রেস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পাকিস্তানের সংহতি বজায় রাখার জন্য ইয়াহিয়া খানের প্রচেষ্টাকে অভিনন্দন জানিয়ে চৌ এন-লাই এক বাণী পাঠিয়েছেন। বাণীতে বলা হয়, পাকিস্তানে এখন যা ঘটছে তা  মূলত তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে চীন সরকার মনে করে। ভারতের সম্প্রসারণবাদীরা যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অভিযান শুরু করে তা হলে চীনের জনসাধারণ ও সরকার পাকিস্তান সরকারের পক্ষ সমর্থন করবে। ইতােমধ্যে পাকিস্তান থেকে লন্ডনে প্রাপ্ত এক সংবাদে জানা যায়, জুলফিকার আলী ভুট্টো ও মওলানা মওদুদী বাংলাদেশ আন্দোলনকে সমর্থনদানের জন্য। অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমােডর এম কে জানজুয়া, তারিক আলী, ফরিদ জাফরী, হামজা আলভী ও অন্য পাকিস্তানিদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলে প্রকাশ্যে নিন্দা করেন। উগ্রপন্থী পাকিস্তানি মােল্লারা তারিক আলী ও ফরিদ জাফরীকে কাফের বলে বর্ণনা করে। এপ্রিল মাসের প্রথমদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে পৃথকভাবে দেখা করে তাদের দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করার জন্য অনুরােধ জানান। তার স্মৃতিকথায় তিনি বলেন, ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পর তিনি দৃঢ়ভাবে অনুভব করেন, তাঁর পক্ষে কোনাে দল বা সমিতির কর্মকাণ্ডে যােগ দেয়া উচিত হবে না। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বিভিন্ন দলের সংগ্রামী স্পৃহা ও প্রচেষ্টাকে সমন্বিত করার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। অতএব, তিনি নির্দলীয় ব্যক্তি হিসেবে স্বাধীনতার জন্য কাজ করবেন। গাউস খানের অনুরােধক্রমে শেখ আবদুল মান্নান বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে তাকে কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করার অনুরােধ জানান। কাউন্সিলের সাফল্য কামনা করে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, তিনি কোনাে বিশেষ দল বা প্রতিষ্ঠানে যােগ দেবেন না। নির্দলীয় ব্যক্তি হিসেবে স্বাধীনতার জন্য তিনি কাজ করবেন বলে স্থির করেছেন। স্মৃতিচারণ উপলক্ষে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস্ হাউসের প্রেসিডেন্ট আনিস রহমান বলেন, এপ্রিল মাসের গােড়ার দিকের এক সন্ধ্যায় তিনি এবং তার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব ফজলে রাব্বি মাহমুদ হাসানের আর্লস্ কোর্টের বাড়িতে বসে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলােচনা করছিলেন। কিছুদিন যাবৎ তারা বিভিন্ন দল-উপদলগুলাের কার্যকলাপের সমন্বয় সাধনের জন্য নির্দলীয় কোনাে ব্যক্তিত্বের শরণাপন্ন হওয়ার কথা ভাবছিলেন। স্বভাবতই তারা বিচারপতি চৌধুরীর  কথা চিন্তা করেন। ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের নির্বিচারে হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে বিচারপতি চৌধুরীকে তারা উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

আনিস রহমান তখনই তাকে টেলিফোন করে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য অনুরােধ জানান। বিচারপতি চৌধুরী একটু ইতস্তত করে বললেন : ‘আমার কি কোনাে রাজনৈতিক দলে যােগ দেয়া উচিত হবে?” আনিস রহমান বললেন : স্যার, এটা এখন আর রাজনীতি পর্যায়ে নেই; এটা। বাংলাদেশের জনগণের অস্তিত্বের প্রশ্ন। বিচারপতি চৌধুরী কথাটা মেনে নিয়ে আধঘণ্টার মধ্যেই আর্লস্ কোর্টে এসে হাজির হন। সেদিন যে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়, তার ভিত্তিতে কিছুকাল পর অ্যাকশন কমিটিগুলােকে নেতৃত্বদানের উদ্দেশ্যে – একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। ১৬ এপ্রিল লন্ডনের হলওয়ে এলাকায় ব্যারিস্টার রুহুল আমিনের বাড়িতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটি ও রাজনৈতিক দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা স্বাধীনতা আন্দোলনের সপক্ষে তাদের কার্যকলাপের বিবরণ দেন।৫ এই বৈঠকে কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট গাউস খান বলেন, আন্দোলনের স্বার্থে প্রয়ােজন হলে তিনি পদত্যাগ করবেন। বিচারপতি চৌধুরী প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করতে রাজি হলে তিনি বিনা দ্বিধায় তার সঙ্গে কাজ করবেন। বিচারপতি চৌধুরীর পক্ষে কোনাে প্রতিষ্ঠানে যােগদান করা কেন সম্ভব নয় তা তিনি ব্যাখ্যা করেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কিত কার্যাবলির সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের আবেদন জানান। রাত দুটো পর্যন্ত আলােচনার পরও কমিটির কাঠামাে তৈরি করা সম্ভব হয় নি। পরদিন আবার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের ব্যাপারে একমত না হলে তিনি আর ঘরােয়া বৈঠকে। যযাগদান করবেন না। তা সত্ত্বেও সেদিন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয় নি। ১৬ এপ্রিল (শুক্রবার) ব্রিটেনের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নিউ স্টেটসম্যান’-এর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ‘দি ব্লাড অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, রক্তের বিনিময়ে যদি স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়, তা হলে বাংলাদেশ অত্যধিক রক্ত দিয়েছে। জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সরকারের পতন এবং দেশের সীমান্ত পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে যেসব সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে, তাদের মধ্যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষয়ী ও স্বল্পকাল স্থায়ী বলে প্রমাণিত হতে পারে। পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম সাময়িকভাবে পরাজিত হতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সংগ্রাম ন্যায়সঙ্গত বলে স্বীকৃতি পাবে।৪৬ উল্লিখিত তারিখে ব্রিটেনের বামপন্থী রাজনৈতিক দল ‘দি সােস্যালিস্ট লেবার লীগ”-এর উদ্যোগে পূর্ব লন্ডনের টয়েনবি হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে একটি বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। আশাতীত জনসমাগমের ফলে বহু বাঙালি শ্রোতা হলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হন।

সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করা হয়। তাছাড়া বাংলাদেশে গণহত্যা সংগঠনের জন্য রক্তপিপাসু ইয়াহিয়া চক্র ও তার সমর্থক চীনের তীব্র নিন্দা করা হয়। ১৮ এপ্রিল ‘দি অবজারভার পত্রিকায় ‘মুজিবনগর সরকার গঠনের সংবাদ প্রকাশিত হয়। ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার বৈদ্যনাথতলায় আয়ােজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন আহমদ শপথ গ্রহণ করেন। প্রায় পাঁচ হাজার বাঙালি এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে সমবেত হন। মুক্তিবাহিনীর রাইফেলধারী তরুণরা বাংলাদেশ সরকারের সদস্য, বিদেশী সাংবাদিক ও অতিথিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে।  ১৮ এপ্রিল ‘দি সানডে টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে এক সাক্ষাঙ্কারের বিবরণ প্রকাশিত হয়। পূর্ববর্তী সপ্তাহে ‘ম্যানড্রেক গৃহীত এক। সাক্ষাঙ্কারকালে বিচারপতি চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের হৃদয়বিদারক বিবরণ দিয়ে বলেন, এরপর অখণ্ড পাকিস্তানের আদর্শ মরীচিকা মাত্র। তিনি আরও বলেন, দু’সপ্তাহ যাবৎ ক্রমাগত বােমা ও গােলাগুলির সাহায্যে জনসাধারণকে নির্বিচারে হত্যার পর পূর্ব বাংলার ভয়াবহ পরিস্থিতিকে পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার বলে গণ্য করা চলবে না।। উল্লিখিত তারিখে ঔপনিবেশিক স্বাধীনতা আন্দোলনের (মুভমেন্ট ফর। কলােনিয়াল ফ্রিডম) উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান লর্ড ব্রকওয়ে বলেন, পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর আক্রমণ হিটলার আমলের পর দুনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে অনুভূতিহীন ও বর্বরতম আক্রমণ বলে পরিগণিত হবে। সম্মেলনে গৃহীত এক প্রস্তাবে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতিদানের দাবি জানানাে হয়। পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রামকারী এই প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তীকালে “লিবারেশন নামে পরিচিত হয়।  ১৮ এপ্রিল (রােববার) পূর্ব লন্ডনে বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থনে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় পাঁচশ’ বাঙালি শ্রমিক এই সভায় যােগদান করেন। সেদিন বিকেলবেলা লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত এক জনসমাবেশেও প্রায় পাঁচ হাজার লােক যােগদান করেন। বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট তােজাম্মেল হক (টনি) তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে “জনযুদ্ধ’ বলে ঘােষণা করেন। বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই। জনসমাবেশের পর একটি বিক্ষোভ মিছিল ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবি সংবলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করে। উল্লিখিত তারিখে শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য ব্রুস ডগলাসম্যানের নেতৃত্বে “জাস্টিস ফর ইস্ট বেঙ্গল’ শীর্ষক একটি কমিটি গঠন করা হয়।

১৯ এপ্রিল তিনি বাংলাদেশ হতে আগত শরণার্থীদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য কলকাতা রওনা হন।  ইতােমধ্যে বিচারপতি চৌধুরী কয়েকজন সমমনা বাঙালিসহ পার্লামেন্ট হাউসে গিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। এদের মধ্যে ছিলেন পিটার শাের, ব্রুস ডগলাসম্যান, মাইকেল বার্নস্ ও জন স্টোনহাউস। তারা প্রবাসী বাঙালিদের সম্মিলিতভাবে আন্দোলন গড়ে তােলার ওপর জোর দেন। তৃতীয় সপ্তাহের গােড়ার দিকে শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য মাইকেল বার্নস্ পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের যুক্তরাজ্য সফর বাতিল করার দাবি জানিয়ে পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। তার প্রস্তাবের সমর্থনে তিনি বলেন, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর গণহত্যামূলক অভিযানের পর পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের সফর ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’র সঙ্গে তুলনীয়। ১৯ এপ্রিলের মধ্যে বিভিন্ন দলভুক্ত ত্রিশজন পার্লামেন্ট সদস্য এই প্রস্তাবের পক্ষে স্বাক্ষরদান করেন। ২০ এপ্রিল ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সের বিরােধীদলের নেতা হ্যারল্ড উইলসনের এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বলেন, যথাসময়ে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি পূর্ণ বিবৃতি পার্লামেন্টে পেশ করবেন। মি. উইলসন পূর্ব বাংলায় গণহত্যা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ পরিদর্শক টিম পাঠানাের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরােধ করেন। উদারনৈতিক দলের সদস্য ডেভিড স্টিলের এক প্রশ্নের উত্তরে মি. হিথ বলেন, ব্রিটিশ সরকার সংঘর্ষের অবসান এবং সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান অনুসন্ধানের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের স্বাধীনতা থাকা বাঞ্ছনীয়। শ্রমিকদলীয় সদস্য উইলিয়াম হ্যামিলটন বলেন, পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্রিটিশ সরকারের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা উচিত। শ্রমিকদলের নেতৃস্থানীয় সদস্য পিটার শাের পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী অনুসৃত নিষ্ঠুর দমননীতি পরিহারের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের নীতি-নির্ধারণের উদ্দেশ্যে পার্লামেন্টে জরুরি আলােচনা অনুষ্ঠানের দাবি জানান। ২০ এপ্রিল ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ‘বিচ্ছেদপন্থী নেতা শেখ মুজিব ও পাকিস্তান-বিরােধী ষড়যন্ত্রে জড়িত তাঁর সহকর্মীদের বিচারের জন্য ইসলামাবাদে একটি বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠনের উদ্যোগ। নেয়া হয়েছে। করাচি থেকে প্রেরিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশ নামের একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে বেআইনি ঘােষিত আওয়ামী লীগের নেতাদের ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার নিশ্চিত প্রমাণ পাকিস্তান সরকারের হাতে রয়েছে বলে একটি আধাসরকারি সূত্র দাবি করে। 

১৯৬০-এর দশকে ব্রিটেনের বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী পাকিস্তানি ছাত্রনেতা তারিক আলী বামপন্থী পাক্ষিক ‘দি রেড মৌল’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের সামরিক চক্র ও জুলফিকার আলী ভুট্টোকে দায়ী বলে ঘােষণা করেন। এ ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানকে সমর্থনদানের জন্য তিনি মাওপন্থী চীনের কঠোর সমালােচনা করেন। ‘ এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ সাহায্যদানের কর্মসূচি তৈরি করার উদ্দেশ্যে পাক্ষিক ‘পিস নিউজ পত্রিকার অফিসে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন পল কনেট, মিস মারিয়েটা  প্রকোপে ও পত্রিকাটির সম্পাদক। যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক) ও খােন্দকার মােশাররফ এই বৈঠকে যােগ দেন। কর্মসূচি সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনার পর ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ ক্লিয়ারিং হাউস’ শীর্ষক একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০ এপ্রিল আটটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা আনুষ্ঠানিকভাবে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ ক্লিয়ারিং হাউস’ প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্ব বাংলা থেকে অবিলম্বে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহারের দাবির ভিত্তিতে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তােলা এবং বাস্তুহারা বাঙালিদের সাহায্যদানের জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য বলে ঘােষণা করা হয়। পল কনেটের নেতৃত্বে তরুণ শিক্ষয়িত্রী মিস মারিয়েটা প্রকোপে ক্লিয়ারিং হাউস পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। লন্ডনের ক্যামডেন এলাকায় তার বাড়িতে প্রতিষ্ঠানটির অফিস স্থাপন করা হয়। শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য মাইকেল বার্নস এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২৩ এপ্রিল কলকাতায় এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য ব্রক্স ডগলাসম্যান বলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ প্রয়ােগ করা উচিত। তিনি আরও বলেন, দক্ষিণ ভিয়েতনামের মাইলাই গ্রামে সংঘটিত মার্কিন সৈন্যবাহিনীর অমানুষিক অত্যাচারের মতাে বহু ঘটনা পূর্ব বাংলায় প্রতিনিয়ত ঘটছে। কয়েক দিন আগে মি, ডগলাসম্যান তার পার্লামেন্টারি সহকর্মী মি. স্টোনহাউসসহ পূর্ব বাংলা থেকে আগত শরণার্থীদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য কলকাতায় পৌঁছান। স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কিত কার্যকলাপের সমন্বয় সাধনের ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের অ্যাকশন কমিটিগুলাের কর্তব্য নির্ধারণের জন্য এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পূর্ব লন্ডনের আর্টিলারি প্যাসেজে নেতৃস্থানীয় বাঙালিদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা মতিউর রহমান চৌধুরী (‘দিলশাদ’ রেস্তোরাঁর মালিক) হলের ব্যয়ভার বহন করেন। বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিরা এই। বৈঠকে যােগ দেন। পরপর তিন রাত আলােচনার পর ২৩ এপ্রিলের বৈঠকে। কভেন্ট্রি শহরে পরদিন (২৪ এপ্রিল) অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই সম্মেলনে অ্যাকশন কমিটিগুলােকে নেতৃত্বদানের জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হবে বলে ঘােষণা দেয়া হয়। 

উল্লিখিত বৈঠকে কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে’র সভাপতি গাউস খানসহ কেন্দ্রীয় কমিটির ১১জন সদস্য পদত্যাগ করবেন বলে ঘােষণা করেন। যুক্তরাজ্যের প্রত্যেকটি অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিদের কভেন্ট্রি সম্মেলনে যােগদানের আমন্ত্রণ জানানাে হয়। সভার উদ্যোক্তারা বিচারপতি চৌধুরীকে সম্মেলনে উপস্থিত থাকার জন্য সনির্বন্ধ অনুরােধ জানান। কভেন্ট্রি সম্মেলন অনুষ্ঠানের আয়ােজন করার দায়িত্ব যারা নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন হাজী আবদুল মতিন (ম্যাঞ্চেস্টার), দবীরউদ্দিন (লুটন), শামসুর রহমান (পূর্ব লন্ডন), আজিজুল হক ভূঁইয়া (বার্মিংহাম), মনােয়ার হােসেন (ইয়র্কশায়ার), এ এম তরফদার (ব্র্যাডফোর্ড) এবং শেখ আবদুল মান্নান (লন্ডন)। ২৪ এপ্রিল ‘দি টাইমস্-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পশ্চিম বঙ্গের নকশালপন্থীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরােধিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নকশালপন্থীদের দেয়ালপত্রে দাবি করা হয়, পূর্ব বাংলায় তথাকথিত বিপ্লব চীনের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। উক্ত সংবাদে আরও বলা হয়, উগ্র মাওপন্থী নেতা মােহাম্মদ তােয়াহা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বিরােধিতার পথ পরিত্যাগ করেছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত নিয়ােগপত্রে বিচারপতি চৌধুরীকে বহির্বিশ্বে স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ২৩ এপ্রিল লন্ডনে বসবাসরত বাঙালি ব্যবসায়ী রকিবউদ্দিন তাকে টেলিফোনে জানান, কলকাতা থেকে তার নিয়ােগপত্র তিনি সঙ্গে নিয়ে ফিরে এসেছেন। সেদিন দুপুরবেলা বিচারপতি চৌধুরী এনামুল হকসহ রকিবউদ্দিনের রেস্তোরায় যান। মধ্যাহ্নভােজনের সময় নিয়ােগপত্রখানি তার হাতে দেয়া হয়। বিচারপতি চৌধুরী তাকে নিয়ােগপত্রখানি কভেন্ট্রি সম্মেলনে পড়ে শােনানাের জন্য অনুরােধ করেন। কারণ, এই নিয়ােগপত্র থেকে পরিষ্কার বােঝা যাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর পক্ষে কোনাে বিশেষ দল বা প্রতিষ্ঠানে যােগদান করার প্রশ্ন অবান্তর।৫০ বৃহত্তর লন্ডনের ১৪টি কমিটির ১৪ জন প্রতিনিধি এবং নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে গাউস খান, মিনহাজউদ্দিন, তৈয়েবুর রহমান, আজিজুর রহমান, ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হােসেন, জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, জাকারিয়া খান চৌধুরী, মতিউর রহমান চৌধুরী এবং শেখ আবদুল মান্নান একটি কোচযােগে ২৪ এপ্রিল (শনিবার) কভেন্ট্রি শহরে পৌঁছান। স্থানীয় একটি মিলনায়তনে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। এই সম্মেলনে বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে ১২৫ জন প্রতিনিধি ও ২৫ জন পর্যবেক্ষক যােগদান করেন। সকল দলের পক্ষ থেকে বিচারপতি চৌধুরীকে  সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার অনুরােধ জানানাে হয়। তিনি তাতে রাজি না হয়ে সভানেত্রী হিসেবে লুলু বিলকিস বানুর নাম প্রস্তাব করেন। মিসেস বানু বাংলাদেশ। মহিলা সমিতির প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে বিচারপতি চৌধুরী বলেন : ‘সভার শুরুতেই সকল দলের পক্ষ থেকে আমাকে সভাপতিত্ব করতে বলা হয়। আমি চিন্তা করে দেখলাম, যদি এই সভা কোনাে কারণে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনে ব্যর্থ হয়, অথবা গঠিত হলেও যদি ভেঙে যায় তবে ইউরােপীয় বা অন্যদের কাছে বাঙালিদের হয়ে কথা বলার অধিকার কিছুটা বাধা পাবে। আমি অসম্মতি জ্ঞাপন করে বেগম লুলু বিলকিস বানুর নাম সভানেত্রী হিসেবে উল্লেখ করি ।… আমার কথায় তিনি রাজি হয়ে গেলেন। সভার কাজ শুরু হওয়ার পর বিচারপতি চৌধুরীর জন্য ‘মুজিবনগর সরকার প্রদত্ত নিয়ােগপত্র পড়ে শােনানাে হয়। মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রকিব উদ্দিন পত্রখানি আনুষ্ঠানিকভাবে তার হাতে তুলে দেন। বিচারপতি চৌধুরী তার উদ্বোধনী বক্তৃতায় সকল দলের সমর্থনপুষ্ট ও সকলের বিশ্বাসভাজন একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের জন্য আবেদন জানান। প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা তৈরি করার ব্যাপারে অচলাবস্থা দেখা দেয়। বহু আলাপ-আলােচনা পর ‘অ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে’ নামের একটি সংগঠন। প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়। সংগঠনের কার্য পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য হিসেবে ১. আজিজুল হক ভুইয়া, ২. কবীর চৌধুরী, ৩. মনােয়ার হােসেন, ৪. শেখ আবদুল মান্নান, ৫. শামসুর রহমানের নাম ঘােষণা করা হয়। এই পাঁচজনের ওপর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এবং বৃহত্তর কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয় । তাছাড়া স্টিয়ারিং কমিটির প্রথম বৈঠকে একজন আহ্বায়ক নিয়ােগ করা হবে। বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অপর এক প্রস্তাবে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন এলাকায়। সংগঠিত অ্যাকশন কমিটিগুলােকে কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটির শাখার মর্যাদা দেয়া হয়। | কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য বিচারপতি চৌধুরীকে অনুরােধ জানানাে হয়। মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়ােজিত থাকাকালে অন্য কোনাে পদ গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে অনুচিত হবে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। তার ফলে সম্মেলনে স্থির করা হয়, কেন্দ্রীয় কমিটি তার সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করবে।  কভেন্ট্রি সম্মেলনে রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে শুধু আওয়ামী লীগ ও ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টের নেতা ও কর্মীরা যােগ দিয়েছিলেন তা নয়। সাধারণত বামপন্থী হিসেবে পরিচিত রাজনৈতিক কর্মীরাও সম্মেলনে যােগ দেন। এদের মধ্যে ছিলেন জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, জগলুল হােসেন, ব্যারিস্টার লুৎফুর রহমান শাজাহান, আবু মুসা, মেসবাহউদ্দিন ও ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হােসেন। বামপন্থীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন মাওপন্থী। এদের মধ্যে জিয়াউদ্দিন মাহমুদ। ছিলেন স্পষ্টভাষী।৫২

কভেন্ট্রি সম্মেলন থেকে কোচযােগে লন্ডনে ফিরে আসার পথে শেখ আবদুল মান্নান ‘কাউন্সিল ফর দি পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে ভেঙে দিয়ে লন্ডন এলাকার জন্য কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটির একটি শাখা গঠনের প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাব অনুযায়ী ২৬ এপ্রিল পূর্ব লন্ডনের হ্যাসেল স্ট্রিটে হাফেজ মনির হােসেনের দোকানে একটি সভার আয়ােজন করা হয়। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন শামসুর রহমান (সভাপতি), জিল্লুর রহমান, আমীর আলী, ড. নুরুল হােসেন, মিনহাজউদ্দিন এবং আরাে অনেকে। নেতৃস্থানীয় একজন প্রস্তাবিত লন্ডন কমিটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে মিনহাজউদ্দিনকে নির্বাচনের অনুরােধ জানান। শেখ মান্নান। প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারি হিসেবে যথাক্রমে গাউস খান ও ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হােসেনের নাম প্রস্তাব করেন। তারা দুজনেই অনুপস্থিত ছিলেন। বিস্তারিত আলােচনার পরও শেখ মান্নানের প্রস্তাব সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয় নি। তখন মিনহাজউদ্দিন আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়ে গাউস খান সম্পর্কিত প্রস্তাব মেনে নেন। সাখাওয়াত হােসেন সম্পর্কিত প্রস্তাব সবাই মেনে নেন। গাউস খান খুশি হন নি। তিনি আশা করেছিলেন কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটিতে তার স্থান হবে। শেষ পর্যন্ত তিনি লন্ডন কমিটির প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করতে রাজি হন। কমিটির অফিস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য তিনি ৫৮ নম্বর বেরিক স্ট্রিটে তার রেস্তোরার উপরতলায় একটি রুমও দিয়েছিলেন। এই শাখা কমিটি ‘লন্ডন অ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ নাম গ্রহণ করে। আমীর আলীর সম্পাদনায় কমিটির মুখপত্র হিসেবে ‘জয় বাংলা শীর্ষক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার ৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। কিছুকাল পর লন্ডন কমিটি একটি সংবিধান প্রণয়ন করে ‘গ্রেটার লন্ডন কমিটি’ নাম গ্রহণ করে। সংবিধান প্রণয়নের পর বিভিন্ন কারণে কমিটির সদস্যদের মধ্যে উৎসাহের অভাব দেখা দেয়। সাখাওয়াত হােসেন সেক্রেটারি পদ থেকে ইস্তফা দেন। আমীর আলীও কমিটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। অনতিবিলম্বে স্টিয়ারিং কমিটির প্রথম সভা ২১ নম্বর রােমিলি স্ট্রিটে অবস্থিত একটি রেস্তোরার বেসমেন্টে অনুষ্ঠিত হয়। লুলু বিলকিস বানু সভাপতিত্ব করেন। ম্যাঞ্চেস্টার থেকে কবীর চৌধুরী (পরবর্তীকালে ড. কবীর চৌধুরী), ব্র্যাডফোর্ড থেকে মনােয়ার হােসেন, বার্মিংহাম থেকে আজিজুল হক ভুইয়া এবং লন্ডন থেকে। শামসুর রহমান ও শেখ আবদুল মান্নান সভায় যােগদান করেন। বিচারপতি। চৌধুরীর উপস্থিতিতে সভার কাজ শুরু হয়। আলাপ-আলােচনার বিষয়বস্তু ও সিদ্ধান্ত গােপন রাখা সম্ভব হবে না আশঙ্কা করে বিচারপতি চৌধুরী অবিলম্বে একটি অফিস স্থাপনের প্রস্তাব করেন। 

২৬ এপ্রিল মার্কিন সাপ্তাহিক ‘নিউজউইক পত্রিকায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি। হত্যাযজ্ঞের পুরাে পৃষ্ঠাব্যাপী বিবরণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাম্প্রতিক ফটোগ্রাফ। প্রকাশিত হয়। করাচি বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বন্দি অবস্থায় তার ফটোগ্রাফ গ্রহণ করা হয়। গম্ভীরভাবে তিনি একটি সােফায় বসে রয়েছেন; দু’পাশে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর দু’জন জোয়ান তাঁকে পাহারা দিচ্ছে। ২৭ এপ্রিল স্থানীয় পাকিস্তান হাই কমিশনে নিয়ােজিত প্রবীণ অফিসার হাবিবুর রহমানকে বিনা নােটিশে পদচ্যুত করা হয়। তিনি সাত বছর যাবৎ উক্ত পদে নিয়ােজিত ছিলেন। ২৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় এক হাজারেরও বেশি প্রবাসী বাঙালি লন্ডনের মে ফেয়ারে অবস্থিত ইংলিশ স্পিকিং ইউনিয়নের হেডকোয়ার্টার্সে আয়ােজিত এক সংবর্ধনায় যুক্তরাজ্য সফররত পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের সদস্যদের যােগদানে বাধা সৃষ্টি করেন। স্টিয়ারিং কমিটি এবং কয়েকটি স্থানীয় অ্যাকশন কমিটি এই বিক্ষোভের আয়ােজন করে। প্রায় ৫০জন পুলিশের সহায়তায় ক্রিকেটারদের হলের ভেতরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। চব্বিশজন বাঙালি বিক্ষোভকারীকে এই উপলক্ষে গ্রেফতার করা হয়। ৩০ এপ্রিল শেখ আবদুল মান্নানের বাড়িতে স্টিয়ারিং কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি চৌধুরীর উপস্থিতিতে কমিটির কর্তব্য, কর্মপদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কবীর চৌধুরী কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে শেখ মান্নানের নাম প্রস্তাব করেন। বাকি সদস্যরা তাকে সমর্থন করেন। শেখ মান্নান পরবর্তীকালে বলেন, নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলে তিনি তার চেয়ে কম বয়স্ক কাউকে আহ্বায়ক নিয়ােগ করার অনুরােধ জানান। বিচারপতি চৌধুরী তাকে বলেন : আপনি অভিজ্ঞ, আপনি রাজনীতি করেছেন, বাকি চারজন রাজনীতি করেন নি। অতএব, আপনার এই দায়িত্ব নেয়া উচিত।’ শেখ মান্নান তাকে বুঝিয়ে বলেন : কাজটা যদি আমি করি, নামটা আমি নিতে চাই না। আমি অঙ্গীকার করছি, কাজ আমি করবাে।’ তখন আজিজুল হক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক নিয়ােগ করা হয়। | তিন সপ্তাহের মধ্যে আজিজুল হক ভূঁইয়া মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ আলােচনার জন্য কলকাতা চলে যান। তিন মাস পর তিনি লন্ডনে ফিরে আসেন। তার অনুপস্থিতিতে শেখ মান্নান কমিটির আহ্বায়ক ও অফিস পরিচালকের দায়িত্ব। | পালন করেন।

 কিছুকাল পর ইয়র্কশায়ার অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ব্র্যাডফোর্ডের মনােয়ার হােসেন সম্পর্কে জটিলতা দেখা দেয়। শেফিল্ড, ব্র্যাডফোর্ড ও লিডস থেকে দলে দলে লােকজন এসে বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, মনােয়ার হােসেন নাকি জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে এক তারবার্তায় পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তাকে অবিলম্বে সরিয়ে দিতে হবে। বিচারপতি চৌধুরী প্রথমে এই দাবি উপেক্ষা করেন। পরপর। বিভিন্ন প্রতিনিধিদল লন্ডনে এসে একই দাবি পেশ করার ফলে বিচারপতি চৌধুরী বিভ্রান্ত হন। মনােয়ার হােসেন ছিলেন ইয়র্কশায়ারের প্রথম নির্বাচিত বাঙালি কাউন্টি কাউন্সিলার। পাকিস্তানিদের ভােট নিয়ে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন বলেই তাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তিনি উল্লিখিত তারবার্তা পাঠান নি বলে। শেখ মান্নান মনে করেন। তার (শেখ মান্নান) আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বিচারপতি চৌধুরী সঙ্কট এড়ানাের জন্য স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে নিম্নে বর্ণিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরামর্শ দেন। এরপর থেকে মনোেয়ার হােসেন কমিটির বৈঠকে যােগদান করবেন। , শুধু টেলিফোনে শেখ মান্নানের সঙ্গে যােগাযােগ করবেন, লন্ডনে এসে কমিটির কাগজপত্র নিয়ে যাবেন এবং কোচভর্তি লােকজন নিয়ে এসে বিক্ষোভ-মিছিল ও জনসভায় যােগ দেবেন। যেভাবে তিনি স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য হয়েছেন সেভাবেই থাকবেন। মনােয়ার হােসেন ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্টিয়ারিং কমিটির সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করেন।৫৫

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি – যুক্তরাজ্য আবদুল মতিন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!