বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২১শে অক্টোবর, রোববার ৪ঠা কার্তিক ১৩৮০
বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে ও বাংলাদেশ
আগামী ২৫শে অক্টোবর মস্কোতে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য বাংলাদেশ থেকে পঁচিশজন সদস্যের প্রথম প্রতিনিধি দলটি আজ মস্কোর উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করবেন। পাঁচজন সদস্যের দ্বিতীয় দলটি আগামী ২৪শে অক্টোবর দলের নেতা কৃষি মন্ত্রী জনাব আব্দুস সামাদ আজাদ সহ মস্কো যাত্রা করবেন।
মস্কোতে শান্তিবাদী শক্তিগুলোর যে সম্মেলন শুরু হচ্ছে শান্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে তা এক নজিরবিহীন ঘটনা আসন্ন সম্মেলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে বর্তমান যুগের সমাজের সমগ্র শ্রেণীর প্রতিনিধিদের ব্যাপক অংশগ্রহণ এ কারণে জাতিসংঘ সমিতিসমূহের বিশ্ব ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মিঃ হোরেস পেরোরা সম্মেলনকে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে বর্ণনা করেছেন।
এটা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে শাস্তির বিরুদ্ধবাদীরা হাতে গুটিয়ে বসে নেই।
বর্তমান চিলি ও ইসরায়েল তার প্রমাণ। বিশ্ব শান্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, বিশ্ব শান্তি পরিষদ এর নীতি ও আহ্বান অত্যন্ত স্পষ্ট ইসরাইল পূর্ব পরিকল্পিত উপায়ে মিসর ও সিরিয়ার উপর হামলা করেছে আরব। এলাকাসমূহ দখল করে রাখার ব্যাপারে ইসরাইলি শাসকচক্রের অব্যাহত নীতি এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সুবিদিত সিদ্ধান্ত মেনে চলার ব্যাপারে তাদের অস্বীকৃতিরই এ পরিণতির আগ্রাসন। বিশ্বব্যাপী তথা এশিয়ার বুকে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর শাস্তি বিরোধী কার্যকলাপের ভিত্তিতে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ নীরব থাকতে পারেনা। একাত্তর সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে অনেক রক্তের বিনিময়ে উপলব্ধি করেছে যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারলে শান্তি স্বাধীনতা ও প্রগতির পথ প্রশস্ত হবে না। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়নের মনি শান্তির সোনানী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানি শাসন কায়েমের পর থেকে এই সত্যকে অনুধাবন করেছিলেন। আর তা করেছিলেন বলেই তিনি শান্তি ও বিশ্ব মানবতার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন এবং এখনো আছেন। ছপান্ন সালে চীনে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে শান্তির একনিষ্ঠ থেকেও সোনানীরুপে বঙ্গবন্ধু যোগদান করেন। ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন সাতষট্টি সালে মিশরের মাটিতে ইসরাইলি হামলার তীব্র নিন্দা করেন বঙ্গবন্ধু। একনিষ্ঠ শান্তির সেনাননীরূপে এ কথা তিনি স্পষ্ট উপলব্ধি করেছিলেন যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি শান্তির সৈনিক কে যদি বিশ্ব মানবতা ও শান্তির স্বপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে হয় তাহলে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শৃংখল মুক্ত হতে হবে। তাই তিনি একাত্তর সালের সাত ই মার্চ সমগ্র জাতিকে আহ্বান জানান এই বলে যে, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেদিন বাংলাদেশের মানুষ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছিল। বাংলাদেশের শান্তিকামী মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রাম যাতে সফল হয় সেজন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসেন বিশ্বশান্তি পরিষদ।
শান্তি ও বিশ্ব মানবতার স্বপক্ষে বঙ্গবন্ধুর অশেষ অবদানের জন্যই দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধুকে শান্তি পুরস্কার জুলিও কুরি পদকে ভূষিত করেন বিশ্ব শান্তি পরিষদ। বঙ্গবন্ধুর এ সম্মান শুধু তারই সম্মান নয় এ সম্মান বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সূর্যালোকে উদ্ভাসিত বাংলা সাড়ে সাত কোটি মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করার ফলে আজ ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। আরব ভাইদের পাশে এসে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। নির্যাতিত ও নিপীড়িত বিশ্বমানবতার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বলে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ভিয়েতনামে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও এখন পর্যন্ত সেখানে পূর্ণ শান্তি আসেনি। এখনো সেখানে আবার সাম্রাজ্যবাদী হামলার ন্যক্কারজনক ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মিসর ও সিরিয়ার উপর ইসরায়েলী হামলা শান্তির পক্ষে হুমকি সরূপ। মার্কিনী অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে ইরান অশান্তির আগুন জ্বালাবার পাঁয়তারা কষে চলছে। পাকিস্তান ও মার্কিনী প্রভুদের ইশারা পুতুলের মতো নেচে বেড়াচ্ছে। মুখে শান্তির বুলি আওড়ালেও ভুট্টো সাহেবের আবার একটা যুদ্ধের আগুন লাগানো যায় কিনা প্রতিনিয়ত সে চেষ্টাই করে যাচ্ছে। এশিয়ার বুকে শান্তির বিরুদ্ধবাদী গোষ্ঠীর এহেন শান্তি ও মানবতা বিরোধী কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আমরা আশা করি শান্তি সম্মেলনে যোগদানকারী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল যথাযোগ্য ভূমিকা পালনে সক্ষম হবেন।
উদোর পিন্ডি যাতে বুদোর ঘাড়ে না চাপে
দেশ মুক্ত হবার পর থেকেই সরকার বারবার ঘোষণা করে এসেছেন যে যেকোন মূল্যে দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা হবে এবং দুর্নীতিবাজ, সজনপ্রিয়, কালোবাজারি, চোরাচালানী, মজুতদার ,মুনাফাখোর এবং ভুয়া ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কঠোর হাতে দমন করা হবে।
এ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ দেশের বিভিন্ন অংশে পুলিশ, বিডিআর ও রক্ষী বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং দুষ্কৃতিকারী দমনে স্থানীয় প্রশাসন সমূহের পূর্বাপেক্ষা অধিক ক্ষমতা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
অথচ, দেশের অভ্যন্তরে দৈনিন্দিন নানা ঘটনা ও পরিস্থিতির একটা সার্বিক বিচার করলে কথা বুঝতে মোটেই কষ্ট হয় না যে, সরকারের এতো উদ্যোগ নেয়া সত্বেও দেশের অন্যায় বহুল দিকটির এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি ঘটেনি। বরং দিন দিনই দেশের অন্যায় অনাচার বেড়েই চলেছে এবং এর শেষ কোথায় তাও বলা মুশকিল।
সবাই যেন এ অবস্থার জন্য অন্যকে দায়ী করতে পারলেই বাঁচেন এ ব্যাপারে প্রত্যকের নিজেদের যে কমবেশি একটা দায়িত্ব রয়েছে সে কথা স্বীকার করার মত সৎ সাহসের খুবই অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
দেশের কোন কোন শিল্প কারখানায় ভরপুর বর্তমান নৈরাজ্যের জন্য কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিশ্চিত অভিযোগ এনে তা প্রমাণিত করা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। এতে ফল হচ্ছে যে এই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবে অন্যান্য কর্মকর্তারা সরকার ও জনসাধারণকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অপ্রতিহত গতিতে নিজেদের বেসাতি চালিয়ে যাচ্ছেন এবং দেশের দুর্নীতি সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সব মুখেই প্রায়ই একটি কথা শোনা যাচ্ছে যে, এদেশের দুর্নীতির পুরস্কারই পদোন্নতি। এতে চাটুকারি মাধুর্য কতটুকু আছে বলা মুশকিল, তবে বিষয়টি যে একান্ত দুঃখজনক সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। রাষ্ট্রায়ত্তের পর শিল্প ক্ষেত্রে উন্নতি বিধানের জন্য সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা ববহুক্ষেত্রেই পাটকল সংস্থা ও বিভিন্ন মিলের প্রাশাসনিক কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার ফলে চরমভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। তাদের এ দায়িত্বহীনতা, দুর্নীতি অসাধুতা শিল্প ক্ষেত্রে নৈরাজ্য আশঙ্কাজনকভাবেই বাড়িয়ে তুলেছে। খবরে প্রকাশ যে, সরকারের বিরুদ্ধে কয়েকটি কর্মসূচি নিলেও উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের একটি অংশ স্বীয় স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্য সরকারের সাথে অসহযোগিতা করে সরকারের এ কর্মসূচিকে বানচাল করে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে। এমন কর্মকর্তাদের সম্পর্কে সরকারের আরো সজাগ বা কঠোর হওয়া উচিৎ বলে আমরা মনে করি। গতকাল বাংলার বানীতে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে দেখা যাচ্ছে যে, বাওয়ানী জুট মিলের যে প্রশাসকের বিরুদ্ধে মিলের লক্ষাধিক টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না করে তাকে কওমি জুট মিলের মত অন্য একটি দায়িত্বপূর্ণ মিলে জেনারেল ম্যানেজার করে স্থানান্তরিত করার পেছনে কোন ঔদার্য লুকিয়ে আছে তা আমাদের জানা নেই। এমন কি কোন মুরুব্বির বলে এই বিশেষ কর্মকর্তা বেমালুম শাস্তি এড়িয়ে গেলেন তা আজ জনসাধারণের জিজ্ঞাসা। সোনারবাংলা জুটমিলের জনৈক জেনারেল ম্যানেজারের বিরুদ্ধে অনুরূপ একটি অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাকে একই প্রক্রিয়ায় পাটকল সংস্থার ইনসিওরেন্স ম্যানেজার পদে নিযুক্তি রহস্য আজও তুষারাব্বত।
চট্টগ্রাম পাটকল জনের জমি কমে জেনারেল ম্যানেজারের বিরুদ্ধে ব্যবসায় ব্বত্তিতে নিযুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তিনি সংস্থার এই গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল থাকা সত্ত্বেও একইসঙ্গে শিপিং এজেন্ট ও এক্সপোর্ট ব্রোকার হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি এর আগে খুলনা পাটকল জোনের জেনারেল ম্যানেজার পদে বহাল ছিলেন। পরে তার বিরুদ্ধে স্থানীয় অভিযোগ আনীত হলে তাকে বর্তমান চাকুরীতে স্থানান্তরিত করা হয় অথচ শাস্তির দিকটা বেমালুম বিস্তৃতির সাগরে ডুবিয়ে দেয়া হয়।
ভিক্টোরিয়া জুট প্রোডাক্টেস -এর জনৈক প্রশাসকের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তার অধঃস্তন জনৈক কর্মচারী তার দুর্নীতির কথা উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলে বেচারার চাকরীই চলে যায় এবং কেন তার চাকরি সে খোয়ালো তা আজও তাকে জানবার সুযোগ দেওয়া হয়নি।
শুধুমাত্র শিল্প সংস্থা নয়, অন্যান্য বিভিন্ন সরকারি অফিস ও একই ধরনের বহু ঘটনা অহরহ ঘটছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তবে, মানুষকে বেকায়দায় চাপের মধ্যে ফেলে এসব দুর্নীতি এমন বিচক্ষনতা ও সতর্কতার সাথে করা হচ্ছে যে, যতটুকু ধরা পড়ছে তার চেয়ে শত শত গুণ দুর্নীতি লোকচক্ষুর অন্তরালে বেমালুম পসরা জমিয়ে দেশকে এক অবধারিত ধ্বংসের পথে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে এই যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুবিচারের নিশ্চয়তা নেই, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নেই এবং জানমালের নিরাপত্তা নেই। কিন্তু এই কি আমাদের রক্ত সাগর স্বাধীনতার উদ্দেশ্য ছিল? এই কি আমাদের কারও কাম্য ছিল? না এ কখনোই আমাদের কাম্য ছিল না। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ একান্তভাবে আশা করেছিল যে স্বাধীনতার পর দেশে আগের সমস্ত অন্যায় অনাচার বন্ধ হবে, যে কোনো অভিযুক্তের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে, অভিযোগকারীর নিরাপত্তা বিধান করা হবে। এখনো বাংলার মানুষ আশাতেই দিন কাটাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ এখনো বিশ্বাস করে সরকার উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপাবেন না। ন্যায়নীতি ও সুবিচারের স্বপক্ষে কাজ চালিয়ে যাবেন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক