You dont have javascript enabled! Please enable it!

১০ ডিসেম্বর সকাল আনুমানিক ১১টায় মেজর ভূঁইয়ার সাথে পুনরায় সংযােগ স্থাপিত হলাে। “বি’ কোম্পানী মেঘনার তীর ধরে দুর্গাপুর ও আশুগঞ্জের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান নিয়েছে। একটি হালকা ভারতীয় বাহিনীও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ রেললাইন বরাবর অগ্রসর হয়ে তালশহর রেলস্টেশনসংলগ্ন এলাকায় জড়াে হয়েছে। দুপুর ১টার দিকে আমার কোম্পানী আরও একটু এগিয়ে গিয়ে ভারতীয় বাহিনী ও ‘বি’ কোম্পানীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। এরই মধ্যে ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন আমাদের অবস্থানে এসে আশুগঞ্জ প্রবেশের প্রারম্ভে ভারতীয় কামানের সমর্থন দেয়ার কথা জানালাে। সে ইতিমধ্যেই নিজের উদ্যোগে ভৈরবের পাকিস্তানী অবস্থানের ওপর ৫.৫ ইঞ্চি মাঝারী কামানের গােলাবর্ষর্ণের নির্দেশনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও সে ভারতীয় বিমান বাহিনীকে রেডিও মারফত বােমাবর্ষণের প্রয়ােজনে দু’বার তলব করে। প্রতিবারই ভারতীয় এস ইউ ৭ বােমারু বিমানগুলাে উপযুপরী নাপাম বােমা নিক্ষেপ করে ভৈরবের লক্ষ্যবস্তুতে। আশুগঞ্জের বেশ কয়েকটি এলাকাতেও রকেট হামলা সংঘটিত হলাে একই সময়।  সেদিন আশুগঞ্জ-ভৈরব অঞ্চলে পাকবাহিনীর উল্লেখযােগ্য কোনাে তৎপরতা না থাকলেও সন্ধ্যার পর পরই তারা আমাদের বিভিন্ন অবস্থানে তাদের ভারী মর্টার ও কামানের সাহায্যে গােলাবর্ষণ শুরু করে এবং মধ্যরাত্রি পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখে। এই গােলাবর্ষণের আড়ালে পাকিস্তানীদের শেষ সেনাদল আশুগঞ্জ ত্যাগ করে ওপার ভৈরবে চলে যায়। যুদ্ধজনিত ক্লান্তিতে রণাঙ্গনব্যাপী সকলেই বিশেষ করে মুক্তিবাহিনীর সৈনিকরা হীনবল। হয়ে পড়েছে। অন্ততঃ আটটি রাত কিছুক্ষণের জন্যেও কেউ ঘুমাতে পারেনি। তার ওপর অনাহার। গত সাত দিনে একমুঠো ভাত জোটেনি মুক্তিবাহিনীর কোনাে সৈনিকের। শুধুমাত্র সরাইলে স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা কিছু মুড়ি আর চাল দিয়েছিলাে আমাদেরকে। সেখান থেকে এক ছটাকের মতাে চাল আমাকেও বরাদ্দ দেয়া হয়েছিলাে। আর তা দিয়ে আমার প্রাতঃরাশ হয়েছে গত দুই দিন। প্রতিদিন সকালে আমিন মগে করে এক মগ পানি আর মুঠিতে সামান্য চাল দিতাে আমাকে প্রাতঃরাশের জন্যে। খুব চেষ্টা করলে হয়তাে মুক্ত এলাকাগুলাে থেকে খাবার সংগ্রহ করা যেতাে। কিন্তু একটি। ব্যাটালিয়নের এক থেকে দেড় হাজার সৈনিককে খাওয়াবার মতাে সামর্থ তখনকার অবস্থায় কোনাে একক লােকের পক্ষে তাে নয়ই একটি গ্রামের একত্রিত মানুষের পক্ষেও সম্ভব ছিলাে

 গত দুইদিন কলা গাছ কেটে তার ভেতরের শাস খাওয়ানাে হয়েছে সৈনিকদেরকে। এই প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও কারাে কোনাে অভিযােগ ছিলাে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্দেশ পালিত। হয়েছে নির্দ্বিধায়। ১১ ডিসেম্বরের কুয়াশাচ্ছন্ন ভােরে মিত্রবাহিনীর গােলাবর্ষণের ছত্রচ্ছায়ায় ১১ ইস্ট বেংগল রেজিমেন্ট ও ভারতীয় বাহিনী ক্ষিপ্রতার সাথে আশুগঞ্জে প্রবেশ করলাে। মেজর ভূঁইয়া আশুগঞ্জ-ভৈরব রেললাইনের দক্ষিণ দিক দিয়ে অগ্রসর হয়ে আশুগঞ্জ সাইলাে থেকে শুরু করে নদীর পার ঘেঁষে অবস্থান নেয়। আমার নেতৃত্বে ‘ডি’ কোম্পানী আশুগঞ্জ রেলস্টেশন সংলগ্ন মসজিদ থেকে শুরু করে উত্তরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা দেয়াল পর্যন্ত মেঘনার পাড় ঘেঁষে অবস্থান গ্রহণ করে। ভারতীয় বাহিনীর কোনাে নির্দিষ্ট সীমানা ছিলাে না। তারা আমাদের সাথে অগ্রসর হয়ে আশুগঞ্জের মধ্যাঞ্চলে অবস্থান নেয়। কোনাে প্রতিরােধ ছাড়াই আশুগঞ্জ দখলে চলে এলাে। শত্রুবাহিনীর শেষ যােদ্ধাদল আমাদের প্রবেশের কয়েক ঘণ্টা আগেই ভৈরবের পথে আশুগঞ্জ ত্যাগ করেছে। পাকিস্তানীরা যখন মেঘনা পাড় হয়ে ভৈরবে পশ্চাদপসরণে ব্যস্ত ঠিক তখনই কিছুটা দক্ষিণে মাত্র দু’ মাইলেরও কম দূরত্বে মেঘনার পশ্চিম পারে ভারতীয় ৩১১ ব্রিগেড গ্রুপ বিনা প্রতিরােধে একটি সেতুবন্ধন প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয় এবং রাতের মধ্যেই ৪টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন, মাঝারি কামানসহ তিনটি গােলন্দাজ ব্যাটারী এবং কিছু হালকা পিটি ৭৬ ট্যাংক মেঘনার অপর পারে পৌছে দেয়। ভারতীয়দেরকে এই পারাপারে সাহায্য করে স্থানীয় মুক্তিবাহিনী। তারা দুই থেকে তিনশ দেশী নৌকো যােগাড় করে সারারাত ধরে ভারতীয়দের নদীর অপর পারে পৌছানাের অভূতপূর্ব দায়িত্ব পালন করে। বড় আকারের নৌকোগুলােতে তাদের মাঝারী কামানগুলােকে মেঘনার অপর পারে পৌঁছে দেয় অনায়াসে। এ ছাড়া বেশ কিছু পিটি ৭৬ উভচর ট্যাকে নৌকোর সাহায্যে টেনে নদী পার করা হয়। নদী পার হয়েই ভারতীয়রা অগ্রসর হয় রায়পুরা ও নরসিংদীর দিকে। আশুগঞ্জ প্রবেশের পর পরই শহরে ব্যাপক তল্লাশি চালানাে হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় হয়তাে এ ধরনের তল্লাশির তেমন দরকার হতাে না। কিন্তু ৯ তারিখের একই স্থানে ঘটে যাওয়া দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রােধেই এই তল্লাশির প্রয়ােজন অনুভূত হয়। কিন্তু তল্লাশিতে পাকিস্তানীদের পরিত্যক্ত অগণিত মৃতদেহ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেলাে না। প্রতিটি স্থানেই মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলাে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকৌশলীদের বাসস্থানসংলগ্ন ছােট্ট পার্কের মতাে স্থানটিতে সম্ভবতঃ নিহত পাকিস্তানী অফিসারদের কবরস্থ করা হয়। তাড়াহুড়াের মধ্যে দায়িত্ব সারার ফলে মাটি চাপা দেয়ার কাজটিও ঠিক মতাে করতে পারেনি তারা।

অনেকেরই হাত অথবা পা, আবার কারাে মাথারও কিয়দংশ বের হয়ে ছিলাে ভূপৃষ্ঠে এবং সেই দৃশ্যগুলাে ছিলাে কিছুটা ভৌতিক।  অদৃষ্ট কী নিষ্ঠুর। প্রায়শ্চিত্ত কতাে ভয়ংকর আর মর্মান্তিক। মাত্র দিন কতক আগেও এই মৃত মানুষগুলো ছিলাে দোর্দণ্ড প্রতাবশালী। বাঙালীদের এই পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখা কিংবা পৃথিবী থেকে তাদের চিরতরে হটিয়ে দেয়ার নিরংকুশ ক্ষমতা ছিলাে তাদের। আর আজ সেই প্রতাবী মানুষগুলাে মৃত্যুর পরে সৎকার তাে নয়ই, এমনকি ঠিকমতাে কবরস্থ হবার মর্যাদাটুকু পর্যন্ত পেলাে না। অদৃষ্ট বােধ করি এভাবেই চিরকাল তার সীমা লংঘনকারীর বিরুদ্ধে মর্মদ। প্রতিশােধ নিয়ে থাকে। দুর্ভাগ্যবশতঃ ছােট্ট পার্কটির পাশেই আমাকে আমার কোম্পানী দফতর স্থাপন করতে হলাে। সেখান থেকে একদিকে ভৈরবের অবস্থান এবং সেই সাথে উত্তরের সমগ্র এলাকার নিয়ন্ত্রণ সহজতর ছিলাে বলেই স্থানটিকে বেছে নেওয়া হয়। উত্তর দিকের নিরাপত্তা দেয়াল বরাবর ট্রেঞ্চ এবং বাংকারগুলােতে চাদর বিছিয়ে তার ওপর। রাখা ছিলাে পাকিস্তানী সৈনিকদের অনেকগুলাে মৃতদেহ। এই লাশগুলাের অধিকাংশই ছিলাে হালকা অন্ত্রের গুলিতে বিদ্ধ এবং খুব একটা পচন তখনাে ধরেনি। তাই অনুমান করা গেলাে যে এই সৈনিকরা সম্ববতঃ ৯ তারিখে তাদের পাল্টা আক্রমণ চালাবার সময় আমাদের হাতে নিহত হয়। নিরাপত্তা দেয়ালের উত্তরে খােলা মাঠে তখনাে কিছু ভারতীয় সৈনিকের লাশ বিক্ষিপ্তভাবে পড়েছিলাে। অধিকাংশ লাশেরই অঙ্গহানী করা ছিলাে। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য। পাকিস্তানী বভিষিকার অপর এক নিদর্শন। ভারতীয়রা তাদের সৈনিকদের লাশ তুলে নিয়ে গেলাে নিজেদের অবস্থানে। সেখান থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই হেলিকপ্টারে করে লাশগুলাে ভারতের অভ্যন্তরে পাঠিয়ে দেয়া হলাে। আশুগঞ্জ সাইলাের উত্তর দিকের একটি ডোবাতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কিছু হতভাগ্য বাঙালীর গলিত মৃতদেহও পাওয়া গেলাে। পাকিস্তানী অথবা তাদের দোসরদের বর্বরতার সম্ভবতঃ শেষ স্বাক্ষর এগুলাে। | ভাের ৮টার দিকে পাকিস্তানীরা ভৈরব অবস্থান থেকে কামানের সাহায্যে আশুগঞ্জের সমগ্র ফ্রন্ট বরাবর গােলাবর্ষণ শুরু করলাে। যুদ্ধের শুরু থেকে সেই দিন অবধি পাকিস্তানীদের গােলাবর্ষণের তীব্রতা কখনােই এতাে প্রচণ্ড মনে হয়নি আমার। ভারী মর্টারসহ আনুমানিক দুটি গােলন্দাজ ব্যাটারী সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখে। এই দুই ঘন্টায় পাকিস্তানীরা কমপক্ষে এক হাজার গােলা নিক্ষেপ করে আমাদের অবস্থানে। মিত্রবাহিনীর কামানগুলােও বসে ছিলাে না। তারাও পাল্টা আঘাত হানে ভৈরবে।

ভুলবশতঃ এ সময় ভারতীয়দের একটি গােলন্দাজ ব্যাটারীর গােলা আমাদের অবস্থানে এসে পড়ে। মড়ার উপর খাড়ার ঘা। এই ভুলের জন্যে ভারতীয় সৈনিকেরা চিৎকার করে মুণ্ডপাত করছিলাে তাদের কামন্দাজদের। পাকিস্তানীদের গােলাবর্ষণের তীব্রতায় সমগ্র আশুগঞ্জ এলাকা ধূয়াচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। এই গােলার আঘাতে আমাদের পক্ষে তিন জন এবং ভারতীয়দের পক্ষে আহত হয় দুজন। গােলাবর্ষণ কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসার পর দুজন সৈনিক সাথে নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর এক গােলা নির্দেশক এলেন আমার অবস্থানে। তার সাথে আসা সৈনিক দুজনের পেছনে ঝুলানাে রয়েছে দুটি দূরপাল্লার ওয়্যারলেস সেট। এই দুটি সেটের একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে বিমান বাহিনীর সাথে যােগাযােগের জন্যে এবং অপরটির সংযােগ রয়েছে পেছনে অবস্থানরত গােলন্দাজ বহরের সাথে। অর্থাৎ এই দুটি ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে নির্ধারিত শত্রু অবস্থানে হামলা চালানাের প্রশ্নে বিমান ও গােলন্দাজ বহরকে পরিচালনা করা যাবে। 

দীর্ঘ সময়ের গােলা আতংকের মধ্যে ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনীর ওই কর্মকর্তাকে কাছে পেয়ে খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। ভাবলাম অব্যর্থভাবে কিছু পালটা গােলা এখন নিক্ষেপ করা যাবে ভৈরবে শত্রু অবস্থানের ওপর। এ ব্যাপারে সহায়তা চাওয়ার জবাবে তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে প্রয়ােজনে চাওয়া মাত্রই মাঝারী কামানসহ অস্তুতঃ ৩০টি কামানের সহায়তা দেয়া যাবে। তবে তার আগে আক্রমণের লক্ষ্যস্থলগুলাে চিহ্নিত করে নিতে হবে। ভৈরবে পাকিস্তানীদের অবস্থান স্থলটি বসতিপূর্ণ লােকালয়ের মধ্যে অবস্থিত থাকার কারণে সেখানে সুনির্দিষ্ট করে কোনাে গােলা হামলার স্থান চিহ্নিত করা কষ্টসাধ্য বলেই আমার মনে হলাে। উপরন্তু মানুষের বসতবাড়ী থাকার কারণে সেখানে গােলা নিক্ষেপ করার ব্যাপারে ভারতীয়দের মধ্যেও ইতস্তুতঃ ভাব লক্ষ্য করা গেলাে। যুদ্ধ কৌশল বিবেচনার সময় ভারতীয় সৈনিকদের মধ্যে মানবিক এই দিকটি আমরা বরাবরই লক্ষ্য করেছি। প্রায়ই দেখেছি আক্রমণ চালানাের সময় তারা বেসামরিক এলাকাগুলাে এড়িয়ে চলতে চায়। ভৈরবে পাকিস্তানীদের অবস্থানে গােলা নিক্ষেপের প্রশ্নেও তাদের এই মানবিক মনােবৃত্তির প্রকাশ দেখতে পেলাম। অথচ যুদ্ধে সক্ষম একটি পূর্ণাঙ্গ ব্রিগেড আয়তনের সেনাদল এখনাে সেখানে শক্ত অবস্থান নিয়ে বসে আছে এবং এই শত্রু সেনারাই মাত্র দু’দিন আগে অগ্রসরমান ভারতীয় বাহিনীকে আশুগঞ্জ রণাঙ্গণে কি নাস্তানাবুদই না করলাে। | ভৈরবে পাকিস্তানীদের সমাবেশ পর্যবেক্ষণের জন্য এরপর আমরা চারজন রেলস্টেশন সংলগ্ন উচু খাদ্যগুদাম সাইলাের একেবারে ছাদে উঠে যাই। কয়েক দশকে আগে নির্মিত এই সাইলাের উচ্চতা প্রায় দশতলা ভবনের উচ্চতার সমান। সাইলাের ছাদে দাড়িয়ে ভৈরব বন্দরের প্রায় পুরােটাই চোখে পড়ে। সেখানে পাকিস্তানী সৈনিকদের কিছু চালাচলও আমরা দেখতে পেলাম। আরও কিছু দেখা যায় কিনা নিবিষ্ট দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করার সময় সহসাই আমরা ওপারে অবস্থানরত পাকিস্তানীদের নজরে পড়ে যাই। সাথে সাথে ১০৬ মিলিমিটার ট্যাংক বিধ্বংসী কামানের গােলা মুহূমূহ এসে পড়তে লাগলাে সাইলাের ছাদ লক্ষ্য করে। আশুগঞ্জ সাইলাের ওপর দিকটায় তার কিছু গােলার আঘাতের গভীর ক্ষতচিহ্ন দীর্ঘকাল ধরে জেগে থাকার কথা।

গােলার আঘাতে বিধ্বস্ত রেলিংয়ের বড় ইটের টুকরােগুলাে একসময় আমাদের নিরাপত্তা বিপন্ন করে তুললাে। তা সত্ত্বেও ভারতীয় বাহিনীর সেই গােলা নির্দেশক কিছু যন্ত্রপাতি বের করে নিমিষেই পাকিস্তানী কামানের অবস্থান নির্ণয় করে ফেললাে। এই ঘটনা একটি বাড়তি পাওনা হিসেবে যােগ হলাে আশুগঞ্জে আমাদের পরবর্তী যুদ্ধ পরিচালনায়। তারপরও রেলস্টেশন এলাকা ছাড়া ভৈরবের বিস্তৃত ফ্রন্টে ভারতীয়দের গােলাবর্ষণ তেমন একটা কার্যকরী না হওয়াতে ভারতীয় গােলন্দাজ অফিসার দু’দফায় তাদের বিমান বাহিনী তলব করলাে। ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মাথায় দুটি সােভিয়েট নির্মিত বােমারু বিমান ভৈরবের ওপর দুবার আক্রমণ চালালাে। যদিও প্রতিটি বিমান আক্রমণ ছিলাে ক্ষণস্থায়ী, তথাপি সেই আক্রমণের ভয়াবহতা ছিলাে প্রচণ্ড। প্রতিবারই এই আক্রমণে ভারতীয়রা নাপাম বােমা ব্যবহার করে। বিমান আক্রমণের পর পরই আগুনের লেলিহান শিখা এবং ধুম্রকুণ্ডলী ভৈরব আচ্ছন্ন করে ফেলে। সেদিনই ১২টার দিকে ভারতীয় বাহিনীর একটি হালকা বিমান আশুগঞ্জে আমাদের রক্ষাব্যুহের বিভিন্ন স্থানে এই প্রথমবারের মতাে বস্তাভর্তি তেরী খাবার নিক্ষেপ করে যায়। আমাদের ও মিত্রবাহিনীর সৈনিকরা অনেক দিন পর খাবার পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে।  আমিন কখনােই পিছিয়ে থাকেনি কোনাে কাজে। যে কারণে তাকে অকর্মন্য ভাবার সুযােগ। আমার হয়নি। এরই মধ্যে সে আমার জন্যে একটি টিনের থালা, কাচের গ্লাস আর একটি চামচ যােগাড় করে ফেলেছে। দেখেই মনে হলাে সেগুলাে সবই পরিত্যাক্ত। তাহােক, এই দুঃসময়ে পরিত্যাক্ত থালা বাটিই বা কোথায় পাই। আমিন সেই থালায় আমার জন্যে খুব যত্ন। করে কিছু রুটি আর সুজির হালুয়া নিয়ে এলাে।  আশুগঞ্জ এলাকা সম্পূর্ণভাবে জনশূন্য। নরসিংদী-রায়পুরা অঞ্চল থেকে গােলাগুলির শব্দ ছাড়া যুদ্ধের তেমন কোনাে আলামত নেই কোথাও। পাকিস্তানীদের মৃতদেহগুলাের কাছে এই দিনের বেলাতেও বিরাট আকারের শেয়ালের ঘােরাঘুরি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনাে প্রাণীর চিহ্নটি পর্যন্ত নেই। এমনকি চিল-শকুনও না। চারদিকে দুমড়ানাে মােচড়ানাে একটা ছত্রাখান অবস্থা। যেনাে প্রলয়ংকরী কিছু একটা ঘটে গেছে।

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কামানের গােলা ফাটার বিদির্ণ করা শব্দ আর আমিনের ঝাকুনিতে ঘুম ভাংলাে। আমিন আমাকে এক রকম টেনেই আমার নির্দিষ্ট ট্রেঞ্চে নিয়ে এলাে। পাকিস্তানী কামানের গােলা সরাসরি আমাদের অবস্থানে এসে পড়ছিলাে। বিশেষ করে সম্মুখভাগের ৩ নম্বর প্লটুনের ওপর। ১০৫ মিলিমিটার কামানের তিনটি গােলা একসাথে আমার ট্রেঞ্চের কয়েক গজের মধ্যে বিকট শব্দ করে ফাটলাে। এই বিস্ফোরণে ধুলােবালি আর কাঁদামাটির ঝাপটা ট্রেঞ্চের মধ্যেও আমাকে ছেয়ে ফেললাে। বিস্ফোরণ কাছাকাছি ঘটার কারণে মাটির চাপে আমার ট্রেঞ্চের আয়তন সংকুচিত হয়ে পড়ে। ট্রেঞ্চের মধ্যে বসে থাকাটাও তখন কষ্টসাধ্য হয়ে উঠলাে। আমার ঘুমের ঘাের ততােক্ষণে কেটে গেছে। আনুমানিক এক ঘন্টার মতাে ঘুমিয়েছি। অবশ্য এটা কোনাে পরিপূর্ণ ঘুম নয়। আধাে জাগা আধাে ঘুমের একটা অবস্থা। আর সে ঘুমের পুরােটাই ছিলাে স্বপ্নের। মাকে দেখলাম। এইতাে সেদিন চেষ্টা করেও মায়ের মুখখানা মনে আনতে পারিনি। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়েছিলাে। জানি না কোথায় আছে সবাই বড়দা, পুতুল, মৃদুল, জিপসী, বাবু, ওরা। পাকিস্তানীদের গােলাবর্ষণ তখনাে চলছে। ভারতীয় কামানগুলােও পাল্টা গােলার আঘাত শুরু করেছে। এভাবেই দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে গেলাে। সূর্যাস্তের পর কামান যুদ্ধ ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়লাে। এর খানিক পরই রণাঙ্গনে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। সন্ধ্যার পর হুদা এলাে। আজ তাকে বড় বেশি ক্লান্ত দেখাচ্ছে। স্যালুট করেই ধুপ করে বসে। পড়লাে মাটিতে। এরপর সংক্ষেপে তার প্লাটুন সম্পর্কিত যাবতীয় কথাবার্তা শেষ করলাে।।

আশুগঞ্জ থেকে মেঘনার জলধারা বেয়ে একটু এগিয়ে গেলেই নদীবন্দর নরসিংদী। হুদার বাড়ি এই নরসিংদিতে। তার পরিবারের সবাই নরসিংদীতেই থাকতাে। এটা যুদ্ধের আগের কথা। এখন তারা কোথায় আছে বা কেমন আছে, তা হুদার জানা নেই। এপ্রিলে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পর তাদের আর কোনাে খবর পায়নি সে। | একদিন কথা প্রসঙ্গে হুদা আমাকে বলেছিলাে যে তার পিতাই তাকে একরকম ঠেলে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছে। পাকিস্তানী সেনারা তখনও নরসিংদিতে পৌছেনি। কিন্তু ইতিমধ্যেই হুদার সচেতন পিতা পাকিস্তানী সেনাদের বরবতা সম্পর্কে জেনে ফেলেছিলেন। তিনি সম্ভবতঃ অনুমান করেছিলেন যে তার এই তরুন বিদ্রোহী সন্তানটি হয়তাে বেঘােরে এমনিতেই মারা যাবে। এর চেয়ে ভালাে সে স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করুক। সেখানে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কিছুটা হলেও থাকবে। আর এই যুদ্ধের প্রক্রিয়ার মধ্যে যদি তার মৃত্যুও ঘটে, তাহলে। তাে এক শহীদি মৃত্যু হবে তার সন্তানের। এতে পিতা হিসেবে নিজেকে প্রবােধ দেয়ার একটি। উপলক্ষ্য অন্ততঃ থাকবে। স্বল্পভাষী হুদা কাজে অনেকটা ধীরস্থির। তবে স্বভাবে তার দৃঢ় প্রত্যয় সহজেই দৃষ্টি কেড়ে নেয়। তার স্বভাবের এই দৃঢ়তাই সম্ভবতঃ তাকে একজন সফল অধিনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইসলামপুর ও দুর্গাপুরের যুদ্ধে হুদা ইতিমধ্যে তার সফলতা ও দক্ষ নেতৃত্বের স্বাক্ষর। ‘ রেখেছে। এদিকে আশুগঞ্জ-ভৈরব রণাঙ্গনে তেমন কিছু না ঘটলেও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল তখন উত্তপ্ত। অনেকগুলাে আক্রমণ শলাকা সীমান্তের চারদিক থেকে সাপের মতাে কিলবিল করে। বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করেছে। সেগুলাে এখন রাজধানী ঢাকায় শেষ ছােবল মারার অপেক্ষায় আছে। বাংলাদেশের পূর্ব রণাঙ্গনে ৪ কোরের পরিচালিত সবগুলাে আক্রমণ শলাকাই নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে মেঘনার পূর্ব তীর বরাবর পেীছে গেছে। চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয়া হয়েছে পূর্বাঞ্চলের প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত পাকিস্তানের ১৪ এবং ৩৯ পদাতিক ডিভিশন দুটোকে। ১৪ পদাতিক অনেক আগেই দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়েছে। ডিভিশনটির সদর দপ্তর এবং অধীনস্ত ২৭ পদাতিক ব্রিগেড় বিস্তৃত অঞ্চল ছেড়ে দিয়ে মেঘনার পশ্চিম পার ভৈরবে অবস্থান নিয়েছে। এই ফুন্টে ভারতীয় ৫৭ ডিভিশনের ৭৩ ও ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেডের মূল বাহিনীর অধিকাংশই মেঘনা অতিক্রম করে এখন ঢাকার পথে এগিয়ে চলেছে। ১১ ডিসেম্বর নরসিংদীর পতনের মধ্যদিয়ে ঢাকায় সরাসরি আঘাত হানার এই সুযােগ সৃষ্টি হয়েছে। নরসিংদীর পর ৩১১ মাউন্টেন ডেমরা দখলের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যায় এবং ১১ ডিসেম্বর শেষ বিকেলের দিকে ডেমরায় পাকিস্তানী সমাবেশের বিপরীতে অবস্থান নেয়। এদিকে ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেডের মুখ একটু ঘুরিয়ে দেয়া হয়। নরসিংদী থেকে ব্রিগেডটিকে পূবাইল হয়ে টঙ্গির দিকে অগ্রসর হতে বলা হয়ে। | অপর দিকে ২ ইস্ট বেঙ্গল এবং ৩ নম্বর সেক্টরের অন্যান্য বাহিনী নিয়ে সফিউল্লাহ ১২ ডিসেম্বর রায়পুরা হয়ে নরসিংদী পৌছান এবং সেখান থেকে বুলত-মুরাপাড়া অক্ষ ধরে ঢাকার দিকে এগিয়ে যান।

এখানে সফিউল্লাহ ভারতীয় বাহিনীর নির্দেশ অগ্রাহ্য করে নিজের সিদ্ধান্তেই ঢাকার পথে অগ্রসর হন। ভারতীয়রা সফিউল্লাহকে তার বাহিনী নিয়ে নরসিংদী। থেকে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলো। সমান্তরাল রেখার দক্ষিণে চাদপুরে পৌছে ভারতীয় ৩০১ মাউন্টেন ব্রিগেডও ঢাকায় আঘাত। হানার লক্ষ্যে দাউদকান্দির দিকে ধাবিত হয়। ব্রিগেডটি ১১ ডিসেম্বর ভােরে স্থলপথে বৈদ্যেরবাজার হয়ে নারায়ণগঞ্জের দিকে এগিয়ে যায়। পাকিস্তানী বাহিনীর ১৪ পদাতিক ডিভিশনের অপর অংশ ৩১৩ ব্রিগেড মৌলভীবাজার অঞ্চলের যুদ্ধে প্রচণ্ড মার খাওয়ার পর পিছু হটে যায়। সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতির মুখে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে এর অধীনস্ত সকল সেনা ইউনিট। ব্রিগেডের ৩০ ফুটিয়ার ফোর্স এবং ২২ বালুচ রেজিমেন্ট অর্ধেকেরও কম শক্তি নিয়ে কোনাে রকমে সিলেটের ২০২ ব্রিগেডের সাথে সংযুক্তি ঘটাতে সক্ষম হয়। ২০২ ব্রিগেডকেও ইতিমধ্যে প্রচণ্ড চাপের মুখে পূর্ব সীমান্তের সকল অবস্থান ছেড়ে দিয়ে সিলেট শহরের দিকে সংকুচিত হতে হয়েছে। ৯ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার এবং পরের দিন ১০ ডিসেম্বর সাদিপুর ও শেরপুর ফেরীঘাটের দখল নিয়ে নেয় ভারতীয় ৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড। এই সীমিত লক্ষ্য অর্জনের পর পরই ব্রিগেডকে আগরতলায় ফিরিয়ে আনা হলাে পরবর্তীতে রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে ব্যবহারের জন্যে। প্রয়ােজনে এরপর এটিকে আকাশ পথে ঢাকায় পাঠানাের পরিকল্পনা করা হয়। অন্যদিকে ৫৯ মাটন ব্রিগেডের একাংশ ১১ ডিসেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জ দখলে এনে সিলেটের পথে 

এগিয়ে যায় এবং ১৩ ডিসেম্বর ৪/৫ গােখা রাইফেলসের সাথে সংযুক্তি ঘটায়। এই ব্যাটালিয়নটিকে এর আগে ৭ ডিসেম্বর সিলেট শহরের ২ মাইল পূর্বে চরকাই ও সিলেটের মধ্যবর্তী স্থানে হেলিকপ্টারের সাহায্যে নামিয়ে দেয়া হয়েছিলাে। ময়নামতি ছাড়া কুমিল্লা ও নােয়াখালীর বিস্তৃত অঞ্চল ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে যৌথবাহিনীর। দখলে এসে যায়। ৩৯ ডিভিশনের অধিনায়ক জেনারেল রহিম ১০ ডিসেম্বর ভােরে চাঁদপুরের। অবস্থান ছেড়ে ঢাকার পথে পাড়ি দেন। এই ফুন্টের সর্বশেষ পাকিস্তানী প্রতিরক্ষাব্যুহ ছিলাে। লাকসামে। তখনাে আংশিক অক্ষত সেখানকার ৫৩ ব্রিগেডের সেনাদল সেদিন মধ্যরাতেই। লাকসাম ছেড়ে ময়নামতি দুর্গের দিকে পা বাড়ালাে। পথে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ব্রিগেডের অর্ধেকেরও বেশি সদস্য ভারতীয়দের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ব্রিগেড অধিনায়ক আসলামসহ এই। ব্রিগেডের অপর অংশ অবশ্য পরের দিন ১১ ডিসেম্বর ময়নামতি পৌছাতে সক্ষম হয়। ময়নামতি দুর্গ ছাড়া কুমিল্লা-নােয়াখালীর বিস্তৃত রণাঙ্গন ১২ ডিসেম্বর থেকে বিজয় উল্লাসে। মেতে ওঠে। | দক্ষিণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে জেনারেল রহিম পরিচালিত ৩৯ পদাতিক ডিভিশনের অবশিষ্টাংশ। ৯১ ও ৯৭ ব্রিগেড যৌথবাহিনীর ক্রমাগত চাপের মুখে পশ্চাদপসরণ করে চট্টগ্রাম শহর ও তার । উপকণ্ঠে এসে আশ্রয় নেয়। এই রণাঙ্গনে চূড়ান্ত যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের। মধ্যদিয়ে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি ব্যাটালিয়ন, একটি গােলন্দাজ ব্যাটারী (মুজিব। ব্যাটারী) এবং ভারতীয় বিএসএফ’র একটি ব্যাটালিয়ন ও অপর একটি পূর্ণাঙ্গ ভারতীয়। গােলন্দাজ রেজিমেন্ট একযােগে এই সেক্টরে আক্রমণের সূচনা করে। মুক্তিবাহিনী এই অক্ষের। অগ্রবর্তী এলাকার প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত পাকিস্তানী ১৭ পদাতিক ব্রিগেডকে তাদের অবস্থান। থেকে উচ্ছেদ করার পর ১২ ডিসেম্বর নাগাদ সীতাকুণ্ডের উপকণ্ঠে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। এই পর্যায়ে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা একটি অতিরিক্ত সেনা ফরমেশন ৮৩ মাউন্টেন ব্রিগেড়কে। চট্টগ্রাম দখলের জন্যে দ্রুত সেদিকে ধাবিত করেন এবং ১৩ ডিসেম্বর ব্রিগেডটি সেখানে। পাকিস্তানীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। মিলিত বাহিনীর এই শক্তিশালী শলাকা সেদিনই । কুমিরা দখল করে ফৌজদারহাটের উপকণ্ঠ পর্যন্ত পেীছে যায়।  অপর দিকে ভারতীয় সেনা প্রধানের নির্দেশে পাকিস্তানীদের বার্মায় পশ্চাদপসরণ রােধে। কক্সবাজার এলাকায় একটি উভচর অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়। এই লক্ষ্যে একটি গােখা ব্যাটালিয়ন এবং ১১ বিহার রেজিমেন্টের দু’টো কোম্পানী নিয়ে একটি বাহিনী তৈরী করা হয়। গােলন্দাজ সহায়তার জন্যে এদেরকে দেয়া হলাে কিছু মর্টার। এই বাহিনী ১২ ডিসেম্বর কক্সবাজার উপকূলে অবতরণের উদ্দেশ্যে কলকাতা পােতাশ্রয় ত্যাগ করে। আর এভাবেই। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সকল ফুন্টে পাকিস্তানী প্রতিরােধ চুর্ণ করে দিয়ে বিজয়ের সম্ভাবনা নিশ্চিত করে তুললেন ভারতীয় অধিনায়ক সাগত সিং। 

উত্তরবঙ্গে ১২ ডিসেম্বর সকাল থেকে বগুড়া মুক্ত করার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তবে এই যুদ্ধ। তখনাে পর্যন্ত বগুড়ার শহরতলীতেই সীমাবদ্ধ থাকে। সেদিনই অধিনায়ক লছমন সিং তার ৩৪০ ব্রিগেডকে সংঘর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ পেলেন। নির্দেশ মতাে ব্রিগেডটিকে ঢাকা দখলের যুদ্ধে ধাবিত করা হবে। ঢাকায় স্থানান্তরের নির্দেশ পাওয়ার পরেও ব্রিগেডটির একাংশ পাকিস্তানীদের সঙ্গে সংঘর্ষ অব্যাহত রাখে।  এদিকে ব্রিগেডিয়ার ভাটির ২০২ ব্রিগেড ক্ষেতলাল হয়ে বগুড়ার কাছাকাছি পৌছে গেছে তখন। অপর একটি ভিন্ন অক্ষে ধাবিত হয়ে ১৬৫ ব্রিগেডও জোরালাে চাপ সৃষ্টি করেছে নওগা প্রতিরক্ষাব্যুহ ও বগুড়ার দ্বারপ্রান্তের পাকিস্তানী সমাবেশের ওপর। এ অবস্থায় ১৪ ডিসেম্বর। সূদয়ের আগেই চারদিক থেকে বগুড়ার ওপর চূড়ান্ত আক্রমণ চালাবার সিদ্ধান্ত নেন লছমন সিং। এই আক্রমণ শুরুর আগে তিনি বগুড়ার সঙ্গে নওগাঁ, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের সড়ক যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে ট্যাংকসহ শক্তিশালী সেনাদলের বিচলন ঘটালেন সেদিকে। মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় এই সড়ক বিচ্ছিন্নকরণের কাজ নির্বিঘ্নেই সমাধা হলাে। এখন অপেক্ষা চূড়ান্ত যুদ্ধের। | উত্তরে রংপুর দখলের প্রস্তুতিও সম্পন্ন প্রায়। ব্রিগেডিয়ার শর্মার ৬৬ ব্রিগেড দু’টি ট্যাংক স্কোয়াড্রনের সহায়তা নিয়ে এগিয়ে যাবে প্রথমে মিঠাপুকুর এবং তারপর ২৩ পদাতিক ব্রিগেডের ঘাঁটি রংপুরে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টরে ভারতীয় ৯ পদাতিক ডিভিশন তার পুরাে শক্তি নিয়েই। খুলনায় গেড়ে বসা ১০৭ ব্রিগেডের ওপর একের পর এক আঘাত হেনে চলেছে। ইতিমধ্যে সাতক্ষীরা এবং কালিগঞ্জ হয়ে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি দল খুলনার দক্ষিণ ও দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান নিয়েছে। শুধুমাত্র খুলনা এবং এর শহরতলী ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের সব এলাকাই এখন মুক্ত। | সেক্টরের উত্তরে যশােরের বিস্তৃত এলাকা থেকে পাকিস্তানীরা সরে গেলেও জেনারেল আনসারী ৩৮ ফুষ্টিয়ার ফোর্স ও ৫০ পাঞ্জাবের দুই ব্যাটালিয়ন পরিমাণ সৈন্য নিয়ে মাগুরায় মধুমতির পূর্ব পারে অবস্থান নিয়েছে। এ পর্যায়ে পশ্চাদ্ধাবনরত ভারতীয় ৪ মাউন্টেন  ডিভিশনের অধিনায়ক বারার তার ৬২ এবং ৭ মাউন্টেন, এই দুটো ব্রিগেড দিয়ে মধুমতি অতিক্রম করে অবরােধের মাধ্যমে আনসারীকে আটকাতে চাইলেন। সম্ভবতঃ এটাই হবে এই অঞ্চলের সর্বশেষ বােঝাপড়ার যুদ্ধ।  মধুমতির সংযােগ এলাকায় উভয় পক্ষের সমাবেশ ছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টর এখন প্রায় প্রতিরােধইনি হয়ে পড়েছে। এই সেক্টরের কোথাও শত্রুবাহিনীর কোনাে জোরালাে অবস্থান আর অবশিষ্ট নেই। খুলনার ক্ষুদ্র পকেট এবং মধুমতির পূর্ব পারের অবস্থান ব্যতীত রণাঙ্গনের সর্বত্র শত্রুবাহিনী নিশ্চিহয়।

থচ আঘাত করার মতাে শক্তির কোনাে অভাব নেই কোর অধিনায়ক জেনারেল রায়নার হাতে। ৭টি পূর্ণাঙ্গ ব্রিগেড নিয়ে তিনি স্তীমিত বিশাল এই রণাঙ্গন জুড়ে শক্রব্যুহ খুঁজে হয়রান হয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের সমগ্র রণাঙ্গনব্যাপী যুদ্ধ বিস্তৃতির এই পর্যায়ে ১১ এবং ১২ ডিসেম্বর যুদ্ধ জয়ের মূল কেন্দ্রবিন্দু খােদ ঢাকাকে লক্ষ্য করে এর চারপাশে যৌথ বাহিনীর যে অবস্থান তৈরী হলাে তার চিত্রটি দাড়ালাে মােটামুটি এই রকমঃ ক, উত্তর থেকে ভারতীয় ৯৫ ও ১৬৭ ব্রিগেড এবং ব্রিগেডিয়ার সন্ত সিংয়ের এফ জে ব্রিগেড গ্রুপ ঢাকার কালিয়াকৈরে তুরাগ নদী বরাবর পাকিস্তানীদের ঢাকা প্রতিরক্ষাব্যুহের মুখােমুখি এসে উপস্থিত হয়েছে। | খ, পূর্বে ৬১, ৭৩, ৩০১ ও ৩১১ ব্রিগেড এবং মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্স ব্রিগেড শীতলক্ষ্মা অতিক্রম করে ঢাকায় আঘাত হানার জন্যে প্রস্তুত।  গ. ব্রিগেডিয়ার বকসির ৩৪০ ব্রিগেডের একাংশ ফুলছড়ি হয়ে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে তখন ঢাকার পথে ধাবমান। তবে সামগ্রিক অবস্থার এই পর্যায়ে এক ব্রিগেড পরিমাণ সেনাদল পাকিস্তানী নৌ বাহিনীর অনুপস্থিতিতে খুব অনায়াশে এবং সবার অলক্ষে নদীপথে এবেশ করে যুদ্ধের একেবারে শুরুতে নারায়নগঞ্জ ও ঢাকার মধ্যাঞ্চলে অবতরণে সক্ষম হতাে। এর ফলে ঢাকার হালকা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সহজেই ভেঙে পড়তাে এবং পাকিস্তানী সেনা নেতৃত্বে প্রচণ্ড ভিভ্রান্তির সৃষ্টি হতাে। বলার অপেক্ষা রাখে না এতে করে পাকিস্তানীদের পতন অনেকটাই ত্বরান্বিত হতাে। এই দিকটি ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ সম্ভবত তাদের বিবেচনায় আনেননি। | যাইহােক ঢাকার প্রতিরক্ষা বৃত্তকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানী বাহিনী দীর্ঘ মেয়াদে যে চূড়ান্ত যুদ্ধের পরিকল্পনা এঁটেছিলাে তার প্রস্তুতি বহুলাংশেই ব্যর্থ হয়ে যায় প্রয়ােজনীয় সংখ্যক সেনাদলের অভাবে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত সেনাদলকে পাশ্চাদপসরণের মাধ্যমে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা একেবারেই অসম্ভব হয়ে ওঠে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কোথাও পাকিস্তানীরা যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে সংঘবদ্ধ পশ্চাদপসরণে সমর্থ হলাে না। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন এই বাহিনী আক্রমণের প্রচণ্ডতায় কার্যতঃ সর্বত্রই প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।

এ অবস্থায় পরস্পর বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে তারা কেবলমাত্র এলাকাভিত্তিক যুদ্ধের মধ্যেই নিজেদের নিয়ােজিত রাখতে বাধ্য হয়। সামগ্রিক এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ রণাঙ্গনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামরিক পরাজয়ের বিষয়টি তখন অনেকটাই সুস্পষ্ট ওঠে। | বাংলাদেশে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপতি নিয়াজী ৭ ডিসেম্বরের মধ্যেই তার বাহিনীর সম্ভাব্য পরিণতির ব্যপারে মােটামুটি নিশ্চিত হয়ে যান। তিনি যথার্থই বুঝে নেন যে অলৌকিক কিছু না ঘটলে যুদ্ধে তার বাহিনীর পরাজয় ঠেকানাে একেবারেই অসম্ভব। অধিকন্তু পশ্চিমের রণাঙ্গনে বিজয়ের সম্ভাবনাও নিস্প্রভপ্রায়। | সেদিন সন্ধ্যায় গভর্নর ডাঃ মালেকের সাথে পরিস্থিতির ওপর কথােপকথনের এক পর্যায়ে নিয়াজী অকস্মাৎ শিশুর মতােই একটি কাণ্ড করে বসলেন। রণাঙ্গনের সর্বত্র পাকিস্তান বাহিনীর বিপর্যয় এবং একটি অত্যাসন্ন পরাজয়ের গ্লানির কথা ভেবে গভর্নর মালেকের সামনে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। আর তার এই কান্নার মধ্যদিয়েই গভর্নর মালেকও সেদিন প্রথমবারের মতাে যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আসন্ন পরাজয়ের বিষয়টি অবহিত হলেন। এর আগে অবশ্য তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকিস্তানী বাহিনীর বীরত্ব এবং শৌর্যবীর্যের কথাই কেবল শুনে আসছিলেন। নিয়াজীর সংগে শলাপরামর্শ শেষে গভর্নর মালেক ইয়াহিয়া খানকে উদ্দেশ্য করে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আবেদন জানিয়ে একটি তার পাঠালেন। কিন্তু ইয়াহিয়া এই তারবার্তার জবাবে সম্পূর্ণ নীরব থাকলেন। ৮ ডিসেম্বর গভর্নর মালেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে আগেরবারের অনুরূপ আরও একটি তার পাঠান। তারের বিষয়বস্তু একই কালবিলম্ব না করে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার আবেদন। ইয়াহিয়া পূর্ববৎ দ্বিতীয় তারেরও কোনাে জবাব দিলেন

এই দুই দিন অর্থাৎ ৭ থেকে ১ ডিসেম্বর নিয়াজী সম্পূর্ণ একাকিত্বেই কাটালেন। তার এই একাকিত্বের ৪৮ ঘন্টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা বেষ্টনী ভেদ করে মুক্তিবাহিনীর সাথে তাদের মিত্ররা আরও অনেকখানি ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। রণাঙ্গনের সর্বত্র পাকিস্তানীদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। তাছাড়া তাদের সরবরাহ ব্যবস্থাও সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ সামগ্রিক বিচারে নিয়াজীর বাহিনী পরাজয়ের সর্বশেষ সিড়িতে এসে উপনীত হয়েছে। ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিস্তৃত রণাঙ্গনে উদ্ভুত সর্বশেষ সামরিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে নিয়াজী পাঞ্জা এড়াবার শেষ আশাটিও ত্যাগ করলেন। সেদিনই জেনারেল নিয়াজী প্রথমবারের মতাে বাংলাদেশ রণাঙ্গনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে পিণ্ডির সেনাসদর দফতরে একটি তাব পাঠালেন। খুব সম্ভব রাওয়ালপিণ্ডিও এই প্রথমবার বাংলাদেশ রণাঙ্গনে বিরাজমান বাস্তব অবস্থাটি উপলব্ধি করলাে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবার তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। তিনি গভনব মালেকের নামে একটি ছােট্ট তার ছাড়লেন এবং তার অনুলিপি জেনারেল নিয়াজীর ইস্টার্ন কমাণ্ড হেডকোয়ার্টারেও পাঠালেন। সেই তারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গভর্নর মালেককে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি দিলেন এবং সেই সাথে আরও বললেন যে, ইস্টার্ন কমাণ্ডার জেনারেল নিয়াজী তার অর্থাৎ গভর্নর মালেকের নেয়া যে কোনাে সিদ্ধান্ত মেনে চলবেন। | পরের দিন ১০ ডিসেম্বর সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হামিদ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উপরােক্ত তারের সূত্র ধরে জেনারেল নিয়াজীকে অপর একটি তার পাঠালেন এবং সেই তারে গভর্নর মালেক এবং জেনারেল নিয়াজীকে উদ্দেশ্য করে ইতিপূর্বে দেয়া ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তেরই পুনরুক্তি করলেন। জেনারেল হামিদ এর সাথে আরও একটি লাইনের সংযােজন ঘটালেন, যেখানে ইস্টার্ন কমাণ্ডকে প্রয়ােজনে আত্মসমর্পণের পথটি বেছে নেয়ার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দেয়া হলাে। বার্তায় জেনারেল নিয়াজীকে সর্বাধিক সংখ্যক সমরাস্ত্র এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংস করার পরামর্শ দেয়া হলাে যাতে সেগুলাে তাদের ভাষায় শত্রু বাহিনীর হস্তগত না হয়।

গভর্ণর মালেকের সামনে তখন আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনাে বিকল্পই ছিলাে না। তবুও তিনি অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্ন সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করলেন না। গভর্নর মালেক এবং তার উপদেষ্টা জেনারেল রাও ফরমান বিরাজমান পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাবার লক্ষ্যে আতুসমর্পণ ব্যতিরেকে আপাততঃ যে কোনাে প্রকারে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার স্বপ্ন। দেখলেন। পরাজয়ের প্রান্তে দাঁড়িয়ে এ ধরনের স্বপ্ন প্রকৃত প্রস্তাবে তখন আর কোনাে অর্থই। বন করে না। যাহােক মালেক গংরা তাদের চিন্তাধারার আলােকে যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব তৈরী করে জাতিসংঘের এসিস্টেন্ট সেক্রেটারী জেনারেল পল মার্ক হেনরীকে হস্তান্তর করলেন। হেনরী এ সময় ঢাকাতেই ছিলেন। গভর্নর মালেকের প্রস্তাবটি ছিলাে অত্যন্ত। হাস্যকর ও বাস্তবতা বর্জিত। তিনি তার প্রস্তাবে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎপরতা সমর্থন করে এর পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করলেন। শুধু তাই নয়, তিনি পাকবাহিনীর। বীরত্ব ও শৌর্যবীর্যেরও ভূয়সী প্রশংসা করে সমস্যা সমাধানে তাদের অর্থাৎ পাকবাহিনীর সদিচ্ছার গভীরতার কথা ব্যক্ত করলেন। শুধু এটুকু বলেই গভর্নর মালেক থেমে থাকেননি। এরপরে তিনি এই প্রস্তাবের সাথে জুড়ে দেন পাচটি শর্তঃ এক, কালবিলম্ব না করে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা। দুই, সম্মানের সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা ) তিন, স্বদেশে ফিরে যেতে ইচ্ছুক সকল পশ্চিম পাকিস্তানী নাগরিকের প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম করা। চার, পূর্ব বাংলায় বসবাসরত মােহাজেরদের নিরাপত্তা বিধান করা এবং পচ, কারাে প্রতি কোনাে প্রকার যে প্রদত্ত প্রস্তাবের বাইরে আর কোনাে ছাড় দেয়া সম্ভব হবে না বা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর।

আত্মসমপর্ণের প্রশ্নও বিবেচনাযােগ্য নয় এবং সে ক্ষেত্রে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের আর কোনাে বিকল্পই থাকবে না। ৭১’র মর্মান্তিক দিনগুলােতে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর অদৃষ্টপূর্ব বর্বরতার মুখে অসহায় কোটি কোটি বাঙালীর আর্তনাদে গােটা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ আতংকে আতকে উঠলেও এই চিৎকার মার্কিন হােয়াইট হাউজের শক্ত দেয়াল কখনাে ভেদ করতে পারেনি। এই মর্মভেদী আর্ত চিৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাপ্রিয় সাধারণ জনগণ উৎকণ্ঠিত হলেও তা নিক্সন-কিসিঞ্জার চক্রের মধ্যে কোনােই অনুরণন তুলতে সক্ষম হয়নি। | বাংলাদেশে ২৫ মার্চের পাকিস্তানী সশস্ত্র আগ্রাসন এবং বেশুমার গণহত্যার পরেও মার্কিন নীতি নির্ধারণী এজেণ্ডাতে বাংলাদেশ সংক্রান্ত বিষয়ের স্থান সংকুলান হয়েছিলাে সবার নিচে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের পরদেশ বিষয়ক করণীয় কার্যাবলীর মধ্যে বাংলাদেশের তখনাে কোনাে গুরুত্ব নেই। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র এবং মানবতাবাদের সােচ্চার প্রবক্তা যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে পরিচালিত এমন একটি জঘন্য গণহত্যার বিপক্ষে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে টু শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি। এই সময় বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে হােয়াইট হাউজ প্রশাসন যে মনােভাব গ্রহণ করে তার নেতিবাচক আভাস পাওয়া যায় সে সময়কার মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের দুটি উক্তির মধ্যে। এই দুটি স্বীকারােক্তির প্রথমটি হচ্ছে ‘পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গৃহীত সামরিক পদক্ষেপের সবিস্তার কারণ সম্পর্কে মার্কিন প্রশাসন জ্ঞাত নয়। তবে সে অঞ্চলে উস্কানীমূলক উত্তেজনা সৃষ্টিতে বাঙালীরা যে সেনাবাহিনীকে প্ররােচিত করেছে তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। দ্বিতীয় স্বীকারােক্তিটি হচ্ছে ‘পূর্ব পাকিস্তানে সে দেশের সেনাবাহিনী নির্বোধের মতােই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। কিন্তু তারপরেও সেখানে যা কিছুই ঘটেছে তা একান্তই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিসিঞ্জারের এই স্বীকারােক্তির মধ্যে বাংলাদেশ ইস্যুতে মার্কিন নীতি নির্ধারকদের ভাওতাবাজির একটি স্পষ্ট আভাস আপনিই প্রতিভাত হয়ে ওঠে। বলা হলাে, বাঙালীদের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার নৃশংস হয়ে ওঠার কারণ তাদের জানা নেই। অথচ বাঙালীরা যে পাকিস্তানী বাহিনীকে বর্বর হতে প্ররােচিত করেছে সে খৱ তারা পেয়েছে যথাসময়েই। উপরন্তু তারা এটাও বুঝতে পেরেছে যে বাংলাদেশে পাকিস্তানীরা যে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে তা একটি নির্বোধের মতাে কাজ। অথচ তারপরও একই সাথে বলা হলাে, বাংলাদেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে তারা ওয়াকেবহাল নয়। আসলে ৭১’র বাংলাদেশ সম্পর্কে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তারা যে নীতিমালা গ্রহণ করে তার পুরােটাই ছিলাে উদ্দেশ্যপ্রণােদিত।

মুক্ত বিশ্বের গণতন্ত্রের ইতিহাসে সর্বত্র মানুষের মধ্যে অধিকার সচেতনতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রেরও একটি নিজস্ব ইতিহাস আছে। অন্যান্য দেশের মতাে সেখানেও আন্দোলন, সংগ্রাম এবং রক্তপাতের ঘটনা আছে। আমেরিকার এই রক্তাক্ত ইতিহাসই বিশ্ববাসীর মধ্যে প্রথম আধুনিক গণতান্ত্রিক চিন্তা চেন্নার উন্মেষ ঘটায়। বলা যায়, মুক্ত চিন্তাধারায় অভিষিক্ত সেই সংগ্রামের ইতিহাসই বিশ্বে স্বাধীনতার জোরালাে অভিব্যক্তির প্রাথমিক উদ্বোধন। প্রায় সােয়া দু’শ বছর আগে সূচিত আমেরিকাবাসীর আন্দোলন যে ফলাফল বয়ে আনে তারই পরিণতিতে প্রতিষ্ঠিত হয় আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসের প্রথম গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র। | ১৭৭৪ সালে সাম্রাজ্যবাদী ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে আকস্মিক বিদ্রোহের সূচনা করে ইউরােপীয় বণিকদের স্থাপিত আমেরিকার উপনিবেশগুলাে। তারা ইংল্যাণ্ডের চাপিয়ে দেয়া অতিরিক্ত কর এবং স্বাধীনভাবে অবাধ বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টির কারণে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বৃটিশ পার্লামেন্টের এই আচরণ ছিলাে কার্যতঃ উপনিবেশগুলাের ওপর তাদের অর্থনৈতিক শােষণেরই একটি ঐতিহাসিক ধারা। কিন্তু আমেরিকার উপনিবেশগুলােতে ইংল্যাণ্ড তার সংসদীয় খবরদারির এই ধারা আর অক্ষুন্ন রাখতে পারেনি। ফলে আমেরিকাবাসী ইংরেজ বণিকদের মধ্যে তাদের মূল শেকড়ের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠে। ১৭৭৫ সালে এই অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করে এবং আমেরিকায় ইংল্যাণ্ডের শাসন-শােষণের অবসান ঘটানাের জন্যে শুরু হয়। | বিচ্ছেদের যুদ্ধ। প্রায় এক দশকের এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরিণতিতে অবশেষে অর্জিত হয় আমেরিকার স্বাধীনতা। ১৭৮৩ সালের এই ঐতিহাসিক ঘটনা থেকেই আমেরিকাবাসীর গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার শুরু। | বঙ্গদেশে ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধে বাংলার নবাবকে পরাজিত করে এবং ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে দিল্লীর মােঘল সম্রাটকে অনুগত করে ভারতে বৃটিশ উপনিবেশিক শক্তির সাম্রাজ্য বিস্তারের ঘটনার প্রায় সমসাময়িক পর্যায়ের ইতিহাসই আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। সেই ইতিহাসেরই কি অদ্ভুত বৈপরীত্য যে, ভারতে বৃটিশ বণিকরা ইংল্যাণ্ডের পার্লামেন্টের প্রতি অনুগত থাকলেও আমেরিকায় তারা সূচিত করে সম্পূর্ণ একটি বিপরীত অধ্যায়।

অবশ্য এ কথা সত্য যে আমেরিকায় বৃটিশ বণিকরা তাদের ওপর চরম আঘাতটি না আসা পর্যন্ত আন্তরিকভাবে আমেরিকার স্বাধীনতা চায়নি। যুদ্ধ শুরুর আগে আপােস রফার শেষ চেষ্টা তারা করেছিলাে। এমনকি যুদ্ধ শুরুর পরেও একটা পর্যায় পর্যন্ত তারা তাদের দাবি শুধুমাত্র স্বায়ত্তশাসনের মধ্যে সীমিত রাখে। তখনাে পর্যন্ত তারা ইংল্যাণ্ডের পার্লামেন্টের প্রতি অনুগত থেকেছে এবং আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের স্থপতি স্বয়ং জর্জ ওয়াশিংটন পর্যন্ত নিজেকে ইংল্যাণ্ডের চিরবশ্য প্রজা বলে স্বীকার করেছেন। বিস্ময়কর যে এই অনুগত উপলব্ধির পাশাপাশি ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরােধ যুদ্ধও অব্যাহত থাকে। শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধপ্রক্রিয়ার মধ্যদিয়েই একদিন আমেরিকার বৃটিশ উপনিবেশসমূহের চূড়ান্ত স্বাধীনতা। নিশ্চিত হয়ে যায়। ‘জন্মকালে সব মানুষই সমান’—এটাই হচ্ছে ১৭৭৬ সালের আমেরিকার স্বাধীনতা ঘােষণাপত্রের মহান উক্তি। এই স্বীকারােক্তির মধ্যেই প্রতিফলিত রয়েছে আধুনিক বিশ্ব দশন-গণতান্ত্রিক আদর্শ ও তার মানবিক মূল্যবােধ। দু’ শতক আগের সেই বিশ্ব ব্যবস্থায় মানবিক মূল্যবােধের এই বৈপ্লবিক আহবান বিশ্বের শংখলিত সকল জনগােষ্ঠীকে তাদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে আলােড়িত করেছিলাে প্রচণ্ডভাবে। একদিকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে মুক্তিকামী মানুষের বিজয় এবং একই সাথে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবােধের জাগরণ বিশ্বকে এক মহান উত্তরণের দ্বারপ্রান্তে এনে পােছে দেয়। আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থার উদ্বোধন কিন্তু সেখান থেকেই। উত্তর আমেরিকায় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার এ সাফল্য বিশ্বে বিভিন্ন জাতিসত্তার মুক্তির আন্দোলনে এবং ইউরােপের বৈপ্লবিক পরিবর্তনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিলাে।

স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রে চিরায়ত মানবতার যে. আমােঘ বাণী খােদাই করে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র তার যাত্রা শুরু করে, একই দেশে বসবাসকারী অবহেলিত কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বেলায় কিন্তু সেই মহান শ্লোক অসার হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানে গৃহীত গণতন্ত্রের আস্বাদ প্রাপ্তি থেকে অমানবিকভাবে বঞ্চিত রাখা হলাে কৃষ্ণাঙ্গদের। অর্থাৎ খােদ আমেরিকার অভ্যন্তরেই পূর্ববত বহাল থাকলো বিশ্ববিবেক ধিকৃত সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য। স্বাধীনতা লাভের পর দীর্ঘ প্রায় এক শ বছর লেগেছে আমেরিকায় ক্রীতদাস প্রথার বিলুপ্তি ঘটাতে। মধ্যযুগীয় এই বর্বর প্রথার বিলােপের মধ্যদিয়ে এবং আরও একটি প্রলম্বিত রক্তের চড়াই উৎরাই পথ মাড়িয়ে অবশেষে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যে উন্মুক্ত হলাে গণতন্ত্রের উদার দিগন্ত। ১৮৬২ সালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন দাসমুক্তির ঘােষণাপত্রে স্বাক্ষর করলেন। কিন্তু আমেরিকার গৃহযুদ্ধ শেষ হতে সময় লাগলাে আরও তিন বছর। ১৮৬৫ সালে এই রক্তপাতের অবসান ঘটে সেখানে।  যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে কৃষ্ণাঙ্গদের রাজনৈতিক অধিকার বাণীবদ্ধ হবার পরও কিন্তু শ্বেতাঙ্গ অধুষিত মার্কিন সমাজ ব্যবস্থায় তাদের অর্থনীতিক জীবনযাপনে স্বাধীনতা আসেনি। অথচ কোনাে সভ্য সমাজে কোনাে সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক অধিকার স্বীকৃত হবার পর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্ন স্বভাবতঃই অমীমাংসিত থাকে না। কিন্তু সাংবিধানিক আইন দিয়ে স্বীকৃত স্বাধীনতার সামগ্রিক স্বদি অর্থহীন করে রাখা হলাে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যে। সেখানে সংবিধান আছে, সাংবিধানিক আইনের প্রয়ােগ আছে এবং সেই প্রয়ােগের গণতান্ত্রিক ধারা যথার্থ নিরূপণের জন্যে আছে কংগ্রেস। অথচ তারপরও বহু বছর সর্বস্তরে সামাজিক বৈষম্যের অবসান হলাে না আমেরিকায়।

এই গেলাে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। বহির্বিশ্বের ঘটনা প্রবাহে প্রয়ােগের জন্যে তাদের পররাষ্ট্র বিষয়ক আইনের অবস্থাও তথৈবচ। সেখানে দেখা যাবে মার্কিন নেতৃবর্গ গণতন্ত্র আর মানবতার নামাবলি গায়ে জড়িয়ে তাদের ভাষায় প্রশান্ত বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ ছড়াবার দায়ে অভিযুক্ত করছে জন্ম-উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনীদের। আবার একই সাথে যুদ্ধেমান ইসরাইলকে মদদ দিচ্ছে গােটা পশ্চিম এশিয়াকে অশান্ত করে তুলবার কাজে। ঢালাও সমরাত্র তারা সেখানে সরবরাহ করছে মানুষ হত্যার জন্যে। একইভাবে সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরােপের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বিস্তারের দোহাই দিয়ে তারা ভিয়েতনাম এবং বিশ্বব্যাপী জন্ম দিয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ। বিস্ময়কর যে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের স্বীকৃত দলিল নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তখনাে কংগ্রেস সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু কি অভ্যন্তরীণ, কি বহির্বিশ্ব, মার্কিন নেতৃত্ব তাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সংরক্ষণের অজুহাতে প্রয়ােজনে ঢালাওভাবে অবজ্ঞা করে গেছে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা এবং তার প্রণেতা কংগ্রেসকে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় এই রকম বৈপরিত্যের দৃষ্টান্ত অন্তহীন। তার ঘােষিত নীতি এবং এই নীতির ব্যবহারিক পদ্ধতির মধ্যে যে ব্যবধান, কার্যতঃ সেখানেই সক্রিয় রয়েছে মার্কিন নেতাদের বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। এই আগ্রাসী একতরফা আচরণের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে তারা এ সত্যই প্রকারান্তরে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে যে, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত হলেও তারা বৃটিশেরই ঔরসজাত। ফলে যে যুক্তরাষ্ট্র মুখে গণতন্ত্র আর মানবতাবাদের কথা বলে তাকেই দেখা যায় দেশে বিদেশে নির্দ্বিধায় পদদলিত করে যাচ্ছে মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের মহান আদর্শকে। বিষয়টি এই রকম যেনাে গণতন্ত্র আর মানবতাবাদের সংজ্ঞা বিশ্বে তারাই নিরূপ করবে এবং এই সংজ্ঞা নিরূপণের নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় এমনকি মার্কিন জনগণের ইচ্ছা অনিচ্ছাও হবে উপেক্ষিত।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও হােয়াইট হাউজ প্রশাসন সেই একই নীতি অনুসরণ করেছে। মার্কিন জনগণের চোখের সামনে মিথ্যের কালাে পর্দা সেঁটে দিয়ে তারা বাঙালী নিধনের জন্যে ঢালাওভাবে সমর্থন ও সমরাস্ত্র উভয়ই সরবরাহ করেছে পাকিস্তানে। গণতন্ত্র আর মানবতাবাদের প্রতিষ্ঠার চেয়েও এখানে মুখ্য হয়ে উঠেছে চিরায়ত মার্কিন স্বার্থ। উৎসুক মার্কিন জনগণকে স্বার্থের কথাই বলা হয়েছে বিভিন্ন কৌশলে। এই স্বার্থ সংরক্ষণের কথা বলে তারা বহিবিশ্বের দেশে দেশে যেমন একই দেশ ও জাতির মধ্যে বিভক্তি এনেছে, আবার প্রয়ােজনে দুটি ভিন্ন জাতিকে অযৌক্তিকভাবে ঐক্যবদ্ধ রাখার প্রয়াস চালিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তারা এই দ্বিতীয় অযৌক্তিক কাজটিই সমাধা করতে চেয়েছিলাে পাকিস্তানকে সমর্থন করার মধ্যদিয়ে। বিশ শতকের গােড়ার দিকে বিশ্ব মানবতা এবং বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত মানুষের স্বার্থে মহান আন্তর্জাতিকতাবাদের বাণী নিয়ে এশিয়া ইউরােপ জুড়ে সােভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যুদয়ের পর থেকেই মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি একটি অযাচিত নতুন সংকটের মুখে পড়ে। তার পররাষ্ট্র নীতিতে তখন সর্বাধিক গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে বিশ্বের দেশে দেশে সােভিয়েত প্রভাব ঠেকানাের মতাে একটি জটিল বিষয়। জার্মানী, কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও ইয়েমেনের মধ্যে আদর্শগত বিভক্তি রেখা টেনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর পরিস্থিতিতে এই জটিলতার একটি তাৎক্ষণিক সরলীকরণের প্রয়াস নেয়া হলেও যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে এই সংকট একটি জোরালাে সমস্যা হিসেবেই থেকে যায়। ঠিক এই রকম একটি অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ায় সূচিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্র তার পুরনাে সমস্যায় একটি নতুন জটিলতার আলামত হিসেবে আবিষ্কার করে। ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীদের মানবিক চিৎকারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে তাদের সাহায্য-সমর্থন দেয়ার পেছনে কয়েকটি কারণের মধ্যে এটি ছিলাে অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্র ঠিকই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এক পর্যায়ে প্রতিবেশী ভারত নিজেকে জড়িয়ে ফেলবে এর সাথে এবং সেই যুদ্ধটি এক সময় পাক-ভারত যুদ্ধে রূপান্তরিক হবে।

সম্ভাব্য সেই যুদ্ধে প্রতিবেশী সােভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সখ্যতা থাকার কারণে ভারত তার সমর্থন ও সাহায্য উভয়ই পাবে—যা যুক্তরাষ্ট্র কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ততােদিন যতােদিন পাকিস্তান নিজে বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে সামরিক শক্তির বলে সামাল দিতে পেরেছে। কিন্তু বালাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন পাক-ভারত যুদ্ধের সূচনা হয় এবং সেই যুদ্ধে খােদ পশ্চিম পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে, ঠিক সেই সময় যুক্তরাষ্ট্র ব্যস্ত হয়ে ওঠে আপােস মীমাংসার জন্যে। এ অবস্থায় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কেও তারা মেনে নিতে রাজি। কেননা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিনিময়ে হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় সােভিয়েত বিরােধ পাকিস্তানের মতাে তাবেদার একটি দেশের অস্তিত্ব হারাতে তারা রাজি নয়। সংকট নিরসনে প্রথমতঃ তারা বাংলাদেশের নেতৃবর্গের সাথে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করার জন্যে চাপ প্রয়ােগ করে পাকিস্তানের ওপর। উপরন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উত্তেজনা সৃষ্টিতে একতরফাভাবে ভারতকে দায়ী করলেও পাক-ভারত যুদ্ধের ভয়ংকর পরিণতি ঠেকাবার উপায় উদ্ভাবনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে হােয়াইট হাউজ প্রশাসন। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের দৌড়ে পিছিয়ে পড়া যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় পাক-ভারত যুদ্ধের পরিণতির মধ্যদিয়ে এ অঞ্চলে জোরালাে সােভিয়েত উপস্থিতির সম্ভাবনাতে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে আবার ৯ আগষ্ট ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের মতাে একটি সামরিক আদালতে বাংলাদেশের নেতা বন্দী শেখ মুজিবের বিচার অনুষ্ঠানের ঘােষণা দেয়। এই ঘােষণা যুক্তরাষ্ট্রকে আরও বিচলিত করে তােলে। এই দুটি ঘটনার মধ্যদিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে একটি ভয়ংকর যুদ্ধের অনিবার্যতা সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিত হয়ে চাপ অব্যাহত রাখে। পাক-ভারত যুদ্ধের মাধ্যমে নয়, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটুক এতােদিন পরে যুক্তরাষ্ট্রের এমন একটি মীমাংসা কাম্য হয়ে ওঠে। কেননা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিষয়টি তখন প্রায় অবশ্যম্ভাবী।

উপমহাদেশে উত্তেজনা প্রশমনে মার্কিন চাপ অব্যাহত রাখার প্রেক্ষাপটে এ ব্যাপারে ভারতীয় মনােভাবের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ঘটে ৩০ নবেম্বর। এই দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ভারতীয় পার্লামেন্টে ঘােষণা করলেন যে, বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রশ্নটি অবশ্যই গ্রহণযােগ্য, তবে এই সেনা প্রত্যাহার আগে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে প্রযাে’T হতে হবে। তিনি আরও বললেন, বাংলাদেশ সম্পর্কিত সমস্যার নিষ্পত্তি শুধুমাত্র বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই করতে পারে এবং তাদের কাছে পূর্ণ স্বাধীনতার কম অন্য কোনাে প্রস্তাবই গ্রহণযােগ্য নয়। এদিকে ৭ ডিসেম্বর মার্কিন প্রশাসন নির্ভরযােগ্য সূত্রের মারফত এই মর্মে অবহিত হলাে যে বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত ভারত কোনাে যুদ্ধবিরতির আহবানই মেনে নেবে না। ১০ ডিসেম্বর মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে সম্পূর্ণভাবে একটি ঘটমান বাস্তবতা হিসেবে মেনে নেয়। কিন্তু একই সাথে পশ্চিম পাকিস্তান রণাঙ্গনে ভারতের সুনিশ্চিত বিজয়ের সম্ভাবনাতে তারা দারুণভাবে বিচলিত হয়ে ওঠে। তাদের ধারণা হলাে বাংলাদেশ রণাঙ্গনে লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার সাথে সাথে ভারত তার বিমান বাহিনীর গােটা শক্তিকেই পশ্চিম পাকিস্তানের লক্ষ্যসমূহ ধ্বংস করার কাজে নিয়ােজিত করবে এবং সেই সাথে স্থল বাহিনীর এক বিরাট অংশকেও দ্রুত পশ্চিমে সঞ্চালনের মাধ্যমে বিজয় অর্জনে সমর্থ হবে। ফলে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর নিশ্চিতভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, যা সম্ভবতঃ পশ্চিমে ভারতের একমাত্র সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য। আর সে ক্ষেত্রে মার্কিন প্রশাসনের ধারণায় পূর্ব বাংলা ও আজাদ কাশ্মীর থেকে বিচ্ছিন্ন পাকিস্তান কার্যতঃ একটি মৃত পাকিস্তানে পরিণত হবে। ভারতের ওপর যুদ্ধ পরিহারের চাপ প্রয়ােগে ব্যর্থ হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন পশ্চিম পাকিস্তানে ভারতের সামরিক চাপ হ্রাসের লক্ষ্যে এবং বাংলাদেশ রণাঙ্গন থেকে ভারত যাতে পশ্চিমে তার অতিরিক্ত বিমান ও স্থল বাহিনীর সঞ্চালন ঘটাতে না পারে তার জন্যে ১০ ডিসেম্বর প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থানরত সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে ধাবিত করেন। যদিও বলা হলাে এই নৌবহর প্রয়ােজনে ঢাকায় অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধাবে নিয়ােজিত হবে।

কিন্তু এই ঘটনায় মার্কিন চাপের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতের বিষয়টি সহজেই অনুমেয় হয়ে ওঠে এবং এটা প্রকারান্তরে উপমহাদেশীয় সংঘাতে মার্কিনীদের জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাকেই প্রকট করে তােলে। | বাংলাদেশ উপকূলে নৌবহর প্রেরণ সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণী আলােচনার এক পর্যায়ে কিসিঞ্জার মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লেয়ার্ডকে বললেন, মার্কিন টাস্কফোর্স বঙ্গোপসাগরে পাঠানাের দৃশ্যমান উদ্দেশ্য আমাদের আটকে পড়া নাগরিকদের উদ্ধার হলেও কার্যতঃ এই নৌবহর পাকিস্তানের পশ্চিম ফ্রন্টে হামলার অভিলাষ থেকে ভারতকে নিবৃত্ত করার প্রশ্নে একটি সতর্কীকরণ মিশন হিসেবে কাজ করবে। মার্কিন নীতিতে গৃহীত বৈপরীত্যের এই জটিল বিষয়টির ব্যাপারে সে দেশের সাধারণ জনগণও বােধ করি তেমন কিছুই জানতে পারলাে না। মার্কিন নীতি নির্ধারকদের জালিয়াতির এটা সেই পুরনাে কৌশল যার ব্যবহারে তারা বরাবরই অভ্যস্ত এবং পরিপক্ক। অকথিত হলেও সত্য যে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশে সৃষ্ট সংকটের শুরুতে এই ইস্যর ওপর সােভিয়েত সমর্থন তেমন জোরালাে বলে প্রতীয়মান হয়নি। যদিও সােভিয়েত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে একাধিকবারই বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং সেই সাথে অব্যাহতভাবে বাংলাদেশ প্রশ্নে একটি গ্রহণযােগ্য রাজনৈতিক সমাধানের ওপর গুরুত্বারােপ করেছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে বাংলাদেশ প্রলে গৃহীত ভারতের পদক্ষেপের প্রতি সােভিয়েত সমর্থনের বিষয়টি ক্রমেই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

শুরুতে বাংলাদেশ প্রশ্নে সােভিয়েত সমর্থন অনুপস্থিতির কারণ সম্ভবতঃ ক্রেমলিন। নীতিনির্ধারকরা এই সময় স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী আওয়ামী লীগের শ্রেণী চরিত্র নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। সমাজতান্ত্রিক সােভিয়েত কর্ণধারদের মতে আওয়ামী লীগ হচ্ছে পশ্চিমা ধ্যান ধারণাসিক্ত একটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল এবং একই কারণে এই দলটির সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পুঁজিবাদী রাষ্ট্রীয় নীতির দ্বারাই প্রভাবিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে রয়েছে সেহেতু স্বাধীনতা। উত্তর বাংলাদেশ এই দলটির প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণেই পরিচালিত হবে। এ অবস্থায় চরিত্রগত আদর্শের কারণে এই স্বাধীন দেশটি পাশ্চাত্য বলয়ে আশ্রিত থেকেই তার যাত্রা শুরু করবে। অর্থাৎ এর ফলাফল যা দাড়াবে তা হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শক্তি ও সংখ্যার ভারসাম্যের প্রশ্নে বাংলাদেশ সােভিয়েত বিরােধী পুঁজিবাদী বলয়ের পাল্লাই ভারি করবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি পর্যায় অবধি পৌঁছার পর এটা তাদের কাছে স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হলাে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের ব্যাপকতর জনগােষ্ঠীর স্বতঃস্থত অংশ গ্রহণ রয়েছে এবং সে দেশের বাম রাজনৈতিক দলগুলােও এই প্রক্রিয়ার সাথে জোরালােভাবে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রতিরােধ যুদ্ধ তখন ব্যাপক অর্থেই একা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে রূপ নিয়েছে এবং এর আদর্শিক ধারাও প্রগতিশীল। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ভারত সােভিয়েত ঐতিহ্যবাহী সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের হাত পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন উপেক্ষা করা সােভিয়েতের পক্ষে সম্বব হয়ে ওঠেনি। | এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পাকিস্তানের গৃহীত ভূমিকার প্রশ্নে সােভিয়েত ইউনিয়নের মূল্যায়নের বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযােগ্য। দক্ষিণ এশিয়ার জােট নিরপেক্ষ এই অঞ্চলে পাকিস্তান তার জন্মলগ্ন থেকেই একটি মার্কিন তাবেদারী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। শুরু থেকেই এই দেশটির সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় মার্কিন অনুপ্রেরণায় কমিউনিস্ট বিরােধী ভূমিকায়। সেই ধারায় স্বাধীনতার পর থেকে পাশ্চাত্য অনুপ্রেরণায় আসক্ত পাকিস্তান ১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করার মধ্যদিয়ে প্রকাশ্যেই পাশ্চাত্য বলয়ের প্রভাবাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। একই বছর পাকিস্তান কমিউনিস্ট বিরােধী সিয়াটো প্রতিরক্ষা জোটে যােগ দেয়।

ঠিক তার পর বছর মার্কিন পৃষ্ঠপােষকতায় পাকিস্তান বাগদাদ চুক্তির আওতায় আরও একটি প্রতিরক্ষা জোটের অন্তর্ভূক্ত হয়। এই জোট থেকে ইরাক তার সদস্যপদ প্রত্যাহারের পর সংস্থাটি ৫৯ সালে সেন্টো নামে আত্মপ্রকাশ করে এবং পাকিস্তান পূর্বাপর এই জোটের সদস্য থেকে যায়। সে বছরই পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযােগিতার আরও অপর একটি দ্বিপাক্ষিক সামরিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এভাবে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চার চারটি প্রতিরক্ষা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, যার প্রতিটিই ছিলাে প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে কমিউনিস্ট বিরােধী। এশিয়ার মধ্যে পাকিস্তানই একমাত্র দেশ যে একাধারে চারটি প্রতিরক্ষা চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি শক্ত গাটছাড়া বাধে। এরপর কোনাে রাখঢাক ছাড়াই পাকিস্তান এশিয়ায় বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় প্রথম শ্রেণীর তাবেদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ১৯৬০ সালের মে মাসে। সােভিয়েত আকাশ সীমায় মার্কিন ইউ-২ গােয়েন্দা বিমান ভূপাতিত করার ঘটনা এ সময় পাকিস্তানের সােভিয়েত বিরােধী ভূমিকাকে আরও প্রকাশ্য করে তােলে। উল্লেখ্য গােয়েন্দা বিমানটি পাকিস্তানের ভূখণ্ড থেকেই পরিচালিত হয়েছিলাে এবং এর বৈমানিক ফ্রান্সিস গ্যারিকে অক্ষতই সােভিয়েত ভূখণ্ডে আটক করা হয়। ফলে প্রবহমান সােভিয়েত-পাকিস্তান শীতল সম্পর্ক এরপর আরও তিক্ত হয়ে ওঠে এবং পরবর্তী বছরগুলােতে উভয় দেশের মধ্যকার এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে আর কোনাে পরিবর্তন ঘটেনি। উপরন্তু রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে বৈরী দেশ চীনের সাথে পাকিস্তানের অতিরিক্ত মাখামাখির বিষয়টিও সােভিয়েত-পাকিস্তান সম্পর্ককে অধিকতর তিক্ত করে তােলে। একটানা ১৮ বছর যােগসূত্রহীন থাকার পর ৬৫’র প্রথমার্ধে আইয়ুবের সােভিয়েত সফর দু দেশের সম্পর্কে খানিকটা পরিবর্তন এনে দেয়। কিন্তু ততােদিনে বিশ্বব্যাপী প্রবহমান মেরুকরণ প্রক্রিয়ায় সােভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের অনেক কাছাকাছি পৌঁছে গেছে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তখন দু’ দেশের স্বার্থ প্রায় অভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। | বাংলাদেশ ইস্যুকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে নবতর চিন্তাধারায় এই মেরুকরণে সর্বশেষ যে সমীকরণ পাওয়া গেলাে তা হচ্ছে সিনাে-মার্কিন-পাকিস্তান বলয়ের বিপরীতে ভারতের স্বাথের প্রতি অনিবার্য সােভিয়েত সমর্থন। ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার ঐতিহ্যগত সম্পর্কের প্রেক্ষাপটেই সােভিয়েত সমর্থনের এই অনিবার্যতা সম্পর্কে নয়াদিল্লীর নীতিনির্ধারকদেরও সন্দেহের কোনাে অবকাশ থাকার কথা নয়।

ভারত এটা ভালােভাবেই অবগত ছিলাে যে পরস্পর বিরােধী দুটি শিবিরে বিভক্ত বিশ্বে সােভিয়েত ইউনিয়নের জন্যে নির্জোট ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় যে একটি অবিকল্প উপস্থিতি, ক্রেমলিন প্রশাসন তা গুরুত্বের সাথেই উপলব্ধি করে। যে কারণে আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে মস্কো ভারতের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে, এটাই স্বাভাবিক। এদিকে বাংলাদেশ রণাঙ্গনে পাকিস্তানী বাহিনীর দ্রুত পরাজয়ের প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৭ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনকে তার বিপর্যয়ের কথা জানান। ওয়াশিংটন অবশ্য এ ধরনের একটি অনুমান আগেভাগেই করে রেখেছিলাে। ঠিক এ সময় ওয়াশিংটন নির্ভয়যােগ্য সূত্র। মারফত এই মর্মে আরও অবহিত হলাে যে শুধুমাত্র বাংলাদেশ মুক্ত করার মধ্যেই ভারতের অভিপ্রায় সীমাবদ্ধ নয়-পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের দখল নিশ্চিত করাও ভারতীয় অভিপ্রায়ের অতিরিক্ত লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে পাকিস্তানের স্থল ও বিমান বাহিনীর পুরােপুরি ধ্বংস সাধনেও ভারতীয় অভিযান পরিচালিত হবে। অর্থাৎ এ সমস্ত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পত্তি ভারত জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত কোনাে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবই মেনে নেবে না। পাক-ভারত সংকটের তীব্রতার পাশাপাশি ভারতে মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র তৎপরতাও জােরদার হতে থাকে। বাংলাদেশ রণাঙ্গনে পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয়ের প্রাক্কালে এ সময় ভারতের অভ্যন্তরে সিআইএ’র গােয়েন্দা তৎপরতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে। পেীছে। নয়াদিল্লীর কেন্দ্রীয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি স্তরেই তখন সিআইএ তার অপচ্ছায়ার সুনিপুণ বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ সংকটকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান সম্পর্কিত ভারতীয় নীতিনির্ধারণীর একান্ত গােপনীয় সিদ্ধান্তগুলােও হােয়াইট হাউজ প্রশাসন সিআইএ মারফত হস্তগত করতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ এ ব্যাপারে দিল্লী সরকারের কোনাে সিদ্ধান্তই তাদের আজানা থাকে না। এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী গান্ধী কখন কোথায় কোন গােপন বৈঠকে যােগ দিচ্ছেন এবং সে সব বৈঠকগুলােতে কি কথাবার্তা হচ্ছে তার পুরােটাই সিআইএ’র মাধ্যমে ওয়াশিংটন পেীছে যাচ্ছে নিয়মিতভাবেই। আর এভাবেই উপমহাদেশীয় সংকটকে কেন্দ্র করে ভারতীয় উদ্যোগের প্রতিটি পদক্ষেপ আগেভাগেই জেনে নিয়ে মার্কিন প্রশাসন একের পর এক তার কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করে চলে।

কিন্তু লক্ষ্যণীয় যে এতাে কিছুর পরও এই উপমহাদেশে ৭১’র ঘটনা প্রবাহকে তারা তাদের নিয়ন্ত্রণে ধরে রাখতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। * অবস্থাদৃষ্টে যে বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জোরালােভাবে প্রতীয়মান হলাে তা হচ্ছে বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের প্রতি সােভিয়েত ইউনিয়নের নিরবচ্ছিন্ন রাজনৈতিক ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক সমর্থন অব্যাহত থাকবে। সন্দেহাতীতভাবেই যুক্তরাষ্ট্র এটা উপলব্ধি করলাে যে নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রদান করে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভারতকে নিবৃত্ত করার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ উপেক্ষা করার মাধ্যমে সােভিয়েত ইউনিয়ন নয়াদিল্লীকে প্রকারান্তরে যুদ্ধ জয়ের জন্যে প্রয়ােজনীয় সময়ের যােগান দিয়ে যাচেছ। এ সময় সােভিয়েত সংবাদ সংস্থা তাস ৫ ডিসেম্বরের প্রতিবেদনে ভারতের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বাংলাদেশের জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যে কোনাে ধরনের যুদ্ধবিরতির বিপক্ষে মত প্রকাশ করে। আর ঠিক ওই দিনই প্রেসিডেন্ট নিক্সন সােভিয়েত ইউনিয়নের ওপর অধিকতর চাপ প্রয়ােগের সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ওই তারিখেই অর্থাৎ ৫ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে নিযুক্ত অস্থায়ী সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত ভরসভকে ডেকে কিসিঞ্জার ভারতের প্রাত সােভিয়েতের সমর্থন মস্কো-ওয়াশিংটন সম্পর্কের ক্ষেত্রে অশুভ বলে উল্লেখ করেন। এ ভরন্টসভ জানান যে দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে সৃষ্ট দুর্যোগ সপ্তাহখানেকের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে এবং বিষয়টি সােভিয়েত-মার্কিন সম্পর্ককে আদৌ বিঘ্নিত করবে না। এর উত্তরে কিসিঞ্জার এই বলে হুঁশিয়ারি করলেন যে, এক সপ্তাহর মধ্যে দুর্যোগ কেটে গেলেও এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে সােভিয়েত-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্র দীর্ঘায়িত হবে। বস্তুতঃ বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে সংকটের ঘনীভূত পর্যায়ে এটাই ছিলাে প্রথম সােভিয়েত-মার্কিন কূটনৈতিক বাদানুবাদ।  পরদিন ৬ ডিসেম্বর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলো। আর সেই সাথে পাকিস্তানের ভৌগলিক আওতার মধ্যে বাংলাদেশ সংকটের রাজনৈতিক সমাধান দেয়ার যে প্রত্যাশা যুক্তরাষ্ট্র করেছিলাে তার সম্ভাবনাও পুরােপুরি অদৃশ্য হয়ে গেলাে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র তাৎক্ষণিকভাবে ভারতে তার অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত ঘােষণা করলাে। এই পর্যায়ে হােয়াইট হাউজ প্রশাসনের মধ্যে পাকিস্তানের পূর্বাংশকে কেন্দ্র করে যতােটুকু না উৎকণ্ঠা তার চেয়েও বেশি উৎকণ্ঠা দেখা গেলাে পশ্চিম পাকিস্তান ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের নিরাপত্তার ব্যাপারে। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে পশ্চিমে নিবৃত্ত করার লক্ষ্যে সম্পর্কের দোহাই দিয়ে সােভিয়েত ইউনিয়নের ওপর তার চাপ আরও তীব্রতর করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে সেদিনই প্রেসিডেন্ট নিক্সন পাক-ভারত উপমহাদেশে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার প্রয়ােজনীয়তার বিষয় উল্লেখ করে ব্রেজনেভকে দেয়া একটি চিঠি ভরন্টসভকে হস্তান্তর করেন। এই চিঠিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পাক-ভারত যুদ্ধের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়াসহ মার্কিন-সােভিয়েত সম্পর্কের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।

চিঠিতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন করে তােলার জন্যে ভারতীয় কর্মকাণ্ডকেই মূলতঃ দায়ী করলেন। এক কথায় মস্কোয় প্রেরিত প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চিঠিটি ছিলাে পাক-ভারত যুদ্ধের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক মার্কিন প্রতিক্রিয়া এবং সেই সাথে এই সংকটে সম্ভাব্য মার্কিন হস্তক্ষেপেরই পরােক্ষ সিয়ারি। | সেদিনই রাত ১১টায় ভরন্টসভ কিসিঞ্জারের সাথে তার ৫ ডিসেম্বরের সংলাপের ভিত্তিতে মস্কোয় পাঠানাে বার্তার জবাব কিসিঞ্জারকে হস্তান্তর করলেন। বার্তায় সােভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গীর বিপরীতে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতির বাস্তব ব্যাখ্যা তুলে ধরার চেষ্টা করে। সেই সাথে বাংলাদেশে একটি গ্রহণযােগ্য রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়টিও গুরুত্বের। সাথে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ সােভিয়েত জবাব এক অর্থে ছিলাে ৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত তাসের প্রতিবেদনেরই হুবহু পুনরুক্তি। | ৯ ডিসেম্বর ব্রেজনেভের পাঠানাে সােভিয়েত জবাব ওয়াশিংটনের হস্তগত হলাে। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চিঠির উত্তরে প্রেরিত মস্কোর এই বার্তাটি ছিলাে অনেকটাই অস্পষ্ট। অর্থাৎ এখানে ব্যাখ্যা চাওয়ার অবকাশ থেকে গেলাে, কিনা প্রকারান্তরে সিদ্ধান্তমূলক যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্যে ভারতকে আরও কিছু বাড়তি সময় এনে দিলাে। একইদিন আবার সােভিয়েত কৃষিমন্ত্রী ম্যাটসকিভিচ নির্ধারিত যুক্তরাষ্ট্র সফরে ওয়াশিংটন পেীছলেন। তাকে হঠাৎ করেই প্রেসিডেন্টের ওভাল অফিসে ডাকা হলো। বালাই বাহুল্য ম্যাটসকিভিচের সফরসূচীর বাইরে এই সাক্ষাতকার অনুষ্ঠিত হলাে অনেকটা জরুরী ভিত্তিতে। কুশল বিনিময়ের পর পরই নিকন তার অনির্ধারিত বৈঠকের উদ্দেশ্য অবহিত করলেন ম্যাটসকিভিচকে। তিনি এখানে আবারাে বললেন, পাক-ভারত যুদ্ধে ভারতের প্রতি সােভিয়েত ভূমিকা সােভিয়েত-মাকিন সম্পর্ক বিঘ্নিত করে তুলছে। এরপর যে বক্তব্যটি নিক্সন ম্যাটসকিভিচকে অবহিত করলেন তা ছিলাে অনেকটা ধমকেরই সামিল। অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিপন্ন হলে যুক্তরাষ্ট্র নীরব থাকবে না, নিক্সনের বক্তব্যে এমন একটি আভাসই সুস্পষ্ট হলে।

ম্যাটসকিভিচকে তিনি পরােক্ষভাবে এটাও স্মরণ করিয়ে দিলেন যে সােভিয়েত-ভারত চুক্তির মতাে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যেও অনুরূপ প্রতিরক্ষা চুক্তি বিদ্যমান। সুতরাং পাক-ভারত সংকট নিরসন প্রশ্নে একটি যুদ্ধবিরতির মধ্যেই মস্কো ওয়াশিংটন পারস্পরিক মঙ্গল নিহিত। উল্লেখ্য এর আগে ২ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট নিকনের কাছে ৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পাদিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তির বিষয় উল্লেখ করে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সাহায্য দাবি করেছিলেন। ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ব্রেজনেভের চিঠির আলােকে একটি নতুন প্রস্তাব নিয়ে জাতিসংঘের দারস্থ হলাে। এতে অবশ্য পাকিস্তানেরও সম্মতি ছিলাে। এই প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান উভয়ই তাদের পূর্ববতী অবস্থান থেকে অনেকটা সরে দাড়ালাে। এই নতুন প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহারের কথা আর বলা হলাে না। অর্থাৎ এতে বাংলাদেশ সংকটের নিস্পত্তি ধরে নেয়া হলাে। সামগ্রিক অর্থে অবস্থা যা দাড়ালাে তা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রশ্নে যে কোনাে ধরনের ছাড় দিতে পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই তখন প্রস্তুত। ১০ ডিসেম্বর ভােরে জাতিসংঘে নেয়া মার্কিন উদ্যোগের পূর্ব মুহুর্তে কিসিঞ্জার সােভিয়েত দূত ভরন্টসভকে ডেকে তাদের নতুন প্রস্তাবের খুটিনাটি সম্পর্কে অবহিত করলেন। সেই সাথে সােভিয়েত নেতা ব্রেজনেভের জন্যে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের একটি চিঠিও হস্তান্তর করলেন। চিঠিতে ব্রেজনেভকে এই মর্মে জানানাে হলাে যে তার প্রত্যাশা অনুযায়ী বাংলাদেশ সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌছার ব্যাপারে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় কালক্ষেপণ না করে পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য ওই চিঠিতে জোরালাে দাবি জানানাে হলাে। এই বেঠকের এক পর্যায়ে কিসিঞ্জার ভরসভকে ১৯৬২ সালের ৫ নবেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তির কথা উল্লেখ করেন। তিনি জানালেন যে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তাদের ভাষায় ভারতীয় আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের সাহায্যে এগিয়ে আসতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিসিঞ্জার এরপর ভরন্টসভকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রয়ােজনে এই প্রতিশ্রুতি পালনে কুণ্ঠাবােধ করবে না। যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ব্যাপক কুটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করছে ঠিক সেই সময় একই সাথে বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়ে সে তার প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরকে ১০ ডিসেম্বর বঙ্গোপসাগর অভিমুখে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেয়।

এ ব্যাপারে সপ্তম নৌবহরকে আগেই প্রস্তুত রাখা হয়েছিলাে। যে কারণে বঙ্গোপসাগরের পথে তাদের পারি জমাতে খুব একটা বিলম্ব ঘটেনি। উদ্ভূত পরিস্থিতির এই বিপজ্জনক পর্যায়ে সংকটের আরও এক নতুন মাত্রা এর সাথে যােগ করলাে যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানকে উদ্ধারের জন্যে এবার সে আদর্শগত বৈরী দেশ চীনকে এই প্রথমবারের মতো কাছে টানলাে। বিরাজমান পরিস্থিতির আলােকে চীনের সাথে আলাপের অজুহাতে সপ্তম নৌবহরকে মালাক্কা প্রণালীতে ২৪ ঘণ্টার জন্যে থামিয়েও দেয়া হলাে। ততােক্ষণে অবশ্য বিশ্ববাসী এবং যুদ্ধরত বাংলাদেশের জনগণ জেনে গেছে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে মার্কিন নৌবহরের আগমনের কথা। উৎকণ্ঠার আর এক পর্বের সূচনা হলাে সবেত্র। তথাপি বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত তখনাে তার ভূমিকায় অবিচল। অন্যদিকে এতাে কিছুর পরও যেনো সবকিছুই এলােমেলাে থেকে গেলাে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। ঘটনা প্রবাহের ওপর কোনাে নিয়ন্ত্রণই তাদের থাকলাে না। সময়ও গড়িয়ে চলেছে। বাংলাদেশও পূর্ণ স্বাধীনতার একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। ১০ ডিসেম্বর দিনের শেষে নিউইয়র্কে কিসিঞ্জার চীনের দূত হুয়াং হুয়ার সাথে এক গােপন বৈঠকে মিলিত হলেন। হুয়াং হুয়াকে মার্কিন দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনার সবিস্তার বর্ণনা করলেন তিনি। তারপর বললেন, পাকিস্তানকে বাঁচাতে হলে এখন এই মূহুর্তে ভারত ও সােভিয়েতের ওপর সম্মিলিতভাবে চাপ প্রয়ােগ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। | হুয়াং হুয়া চীনের নীতি ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের জড়িত হয়ে পরার বিষয়টিকে অগ্রহণযােগ্য বলে উল্লেখ করলেন। উপরন্তু এই সংকটের সাথে সােভিয়েত সম্পৃক্ততাকে তাদের মূল্যায়নে নেতিবাচক হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। হুয়াং হুয়া এরপর মার্কিন যুদ্ধবিরতি উদ্যোগেরও সমালােচনা করে বললেন যে এর মাধ্যমে তার মতে আগ্রাসনকেই পুরস্কৃত করা হচ্ছে। বৈঠকের শেষ পর্বে হুয়াং হুয়া কিসিঞ্জারকে জানালেন যে তাদের মধ্যেকার আলােচনার বিষয়বস্তু এবং মার্কিন মনােভাবের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে যথারীতি জানানাে হবে এবং একই সাথে আশ্বাসও ধ্বনিত করলেন এই বলে যে, চীন প্রয়ােজনে পাকিস্তানকে অধিকতর সাহায্যের জন্যে এগিয়ে যাবে। যুদ্ধের এই চূড়ান্ত পর্যায়ে কিসিঞ্জার পাকিস্তানকে সাহায্যে করার প্রশ্নে হুয়াং হুয়ার প্রদত্ত আশ্বাসকে ভারতের বিরুদ্ধে। চীনের সামরিক কার্যক্রম গ্রহণের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বলেই ধরে নিলেন।

শক্তির বলে সত্য বােধ করি এভাবেই পদদলিত হয়। ত্ৰিধায় বিভক্ত মতাদর্শিক বিশ্বে পরস্পর বিরােধী দুই মেরুর দুই রাজনীতিক তাদের দক্ষিণ এশীয় মিত্র পাকিস্তানকে বাঁচানাের জন্যে শেষ পর্যন্ত নিজেদের মধ্যকার মতাদর্শগত পার্থক্য তাে ভুললােই, পরন্তু এই অভিনব জোটবদ্ধতায় এমনকি তারা তাদের অতীত অপকর্মের কথাও বেমালুম বিস্মৃত হলাে। মাত্র আট বছর আগে হুয়াং হুয়ার চীন কোনাে বলাকওয়া ছাড়াই দুর্বল ভারতের বিরুদ্ধে নগ্ন হামলা চালিয়েছিলাে। আর কিসিঞ্জারের চিরকালের আগ্রাসী দেশ যুক্তরাষ্ট্র তখনাে ভিয়েতনামে বেশুমার বােমাবর্ষণ করে অকাতরে নিঃশেষ করে দিচ্ছে ব্যাপক সংখ্যক নিরীহ মানুষের জীবন। কৌতূহলােদ্দীপক যে এই ভিয়েতনাম ইস্যুতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন-যুক্তরাষ্ট্র পরস্পর একে অন্যের প্রতিপক্ষ। এবং একই সাথে ভারত সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম বিরােধী আগ্রাসনের বিপরীতে একটি সােচ্চার প্রতিবাদী কণ্ঠ। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় সিনােমার্কিন এই বৈরীতা নতুন এবং যুগপৎ বিস্ময়কর একাত্মতার জন্ম দিলাে সবাইকে হতবাক। করে দিয়ে। নতুন এই একাট্টার মধ্যেই আজ তারা যৌথ পরামর্শে একত্রিত হয়েছে পাকিস্তানের পক্ষে তথাকথিত ভারতীয় আগ্রাসন ঠেকাবার উপায় উদ্ভাবনে। অথচ মুক্তবিশ্বের কে না জানে বাংলাদেশের মানুষ তাদের দেশের মাটিতে যে মুক্তিযুদ্ধ চালাচ্ছে তা শােষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি জাতির নিছক বেঁচে থাকার অনিবার্য এক যুদ্ধ। | এদিকে একই দিন যুক্তরাষ্ট্র সােভিয়েত পক্ষকও বাংলাদেশ উপকূলে তাদের নৌবহর প্রেরণের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিলাে। অর্থাৎ ১০ ডিসেম্বর নিক্সন প্রশাসন একাধারে বিভিন্ন কূটনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি সামরিক কার্যক্রম গ্রহণ করে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের ওপর তার সর্বোচ্চ চাপ প্রয়ােগ করলাে। ১১ ডিসেম্বর মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভরন্টসভকে জানিয়ে দেয়া হলাে যে যুক্তরাষ্ট্র পরদিন ১২ ডিসেম্বর দ্বিপ্রহর পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে মস্কোর জবাবের প্রত্যাশায় থাকবে এবং এই সময়সীমার পর নিজস্ব সিদ্ধান্তেই তারা সংকট মােকাবেলায় এগিয়ে যাবে। এ সময় ভরন্টসভ জানালেন যে সােভিয়েত উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্যাসিলী কানেতসভ যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে আলাপের জন্যে দিল্লীতে অবস্থান করছেন এবং সেখানে ভারতের কাছ থেকে একটি অনুকুল সাড়া পাওয়া যাবে, এটাই স্বাভাবিক। এই ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রকে তখনকার মতাে কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিলাে।

১২ ডিসেম্বর সকালে ভরন্টসভ কিসিঞ্জারকে এই মর্মে আশ্বাস দিলেন যে পশ্চিম পাকিস্তানে। ভারতের এলাকা দখলের কোনাে অভিলাষ নেই। তবে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ব্যাপারে ভরন্টস কোনাে উচ্চবাচ্য করলেন না। এই পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র সােভিয়েতের ওপর তার চাপ প্রয়ােগ অব্যাহত রাখার ধারায় দুটি কার্যক্রম গ্রহণ করলাে। প্রথমটি যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আবার ফিরে যাওয়া এবং দ্বিতীয়টি ওয়াশিংটন-মস্কো হটলাইন যােগাযােগের মাধ্যমে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার ব্যাপারে সিদ্ধান্তসূচক জবাব চাওয়া। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের হটলাইন ব্যবহার করার উদ্দেশ্য ছিলাে সম্ভবতঃ বিষয়ের গুরুত্বের প্রতি মস্কোর সর্বোচ্চ মনােযােগ আকর্ষণ করা। এদিকে ভারতের বিরুদ্ধে চীনের সম্ভাব্য সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের বিপরীতে সােভিয়েত প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই তার কর্মপন্থা নির্ধারণ করে ফেলেছে। অর্থাৎ চীন ভারতের বিরুদ্ধে সশরীরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে যদি সােভিয়েত রাশিয়া চীনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সােভিয়েতের বিরুদ্ধে যথােপযুক্ত সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এটাই হলাে তখনকার গৃহীত চূড়ান্ত মার্কিন পরিকল্পনা। বিশ্ব তখন এভাবেই বাংলাদেশের মুক্তিপ্রিয় মানুষের স্বাধীনতার দাবিকে কেন্দ্র করে প্রলয়ংকারী এক যুদ্ধের জন্যে মুখােমুখি হয়ে। পড়লাে। | ১২ ডিসেম্বর ভরুন্টসভ এবং কিসিঞ্জারের মধ্যে আরেক দফা বাক্য বিনিময় হলাে। কিসিঞ্জারই উদ্যোগী হয়ে ভরসভাকে ফোন করলেন। তাকে তিনি আবারও মার্কিন উদ্বেগের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, সময় খুব দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ উপর্যুপরি । মার্কিন অস্থিরতার চুড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটলাে তার এই বক্তব্যে। ইতিমধ্যে পিকিং থেকেও চীনের জবাব হস্তগত হয়েছে হুয়াং হুয়ার। কিন্তু এই জবাব। যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে সুখকর তাে নয়ই, পাক-ভারত যুদ্ধের গােটা পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের। জন্যেও এটি একটি হতবাক হবার মতােই খবর। চীনের এই জবাব বিরাজমান পরিস্থিতিতে পিকিংয়ের এতােদিনকার ভূমিকার স্রোতধারাকে আমূল ভিন্নমূখি করে দিলাে—যা যুগপৎ পাক-মার্কিন কূটনৈতিক পর্যায়ে এক মহাবিস্ময়ের সৃষ্টি করলাে। শেষ মুহূর্তে চীনের এই ‘না’ সূচক জবাব একেবারেই অনাকাক্ষিত ছিলাে তাদের জন্যে।

হুয়াং হুয়া যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের। অভিপ্রায় জানিয়ে স্পষ্ট করে বলে দিলেন যে চীন জাতিসংঘের মাধ্যমেই একটি যুদ্ধবিরতি। প্রস্তাব কার্যকরী করার পক্ষপাতি। অর্থাৎ পাক-ভারত যুদ্ধের ব্যাপারে অযথা জঙ্গী হয়ে ওঠার। কোনাে পরিকল্পনা চীনের নেই। অতএব সমাপ্তি ঘটলাে বহু জল্পনা-কল্পনায় প্রতিষ্ঠিত সম্ভাব্য চীনা হস্তক্ষেপের আস্ফালন। | এদিকে বিরাজমান ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে সােভিয়েত ইউনিয়নও ভারতকে আশ্বস্ত করলাে। এই বলে যে, যে কোনাে চীনা আক্রমণের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সােভিয়েত ইউনিয়ন সরাসরি চীন আক্রমণ করবে এবং সপ্তম নৌবহর সােভিয়েত নৌবহর দিয়ে প্রতিহত করা হবে। বলাই বাল্য সােভিয়েত আহ্বাসের বিস্তারিত বিবরণের পুরােটাই গােয়েন্দা মারফত ওয়াশিংটনে যথারীতি পৌছে যায়।। এ সময় ভারতের প্রতি মস্কোর আবাস শুধুমাত্র কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলাে না, যেমনটি হয়েছে পাকিস্তানের প্রতি পিকিংয়ের প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে। সবার অলক্ষ্যেই দেখা গেলাে বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি ভারত মহাসাগর এলাকায় ১৬টি রণতরীর সমন্বয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী সােভিয়েত নৌবহর ইতিমধ্যেই তার অবস্থান সুসংহত করেছে। এর পাশাপাশি একটি মাইনসুইপার এবং অপর একটি সরবরাহ জাহাজও তখন বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর ধাবিত হচ্ছে। প্রধানতঃ নৌশক্তি দিয়ে ভারতকে প্রদত্ত সাহায্যের আবাস বাস্তবায়নে ক্রেমলিন প্রশাসন এরপরও সাবমেরিনসহ তিনটি জাহাজের সমন্বয়ে গঠিত আরও একটি নৌবহর মালাক্কা প্রণালী দিয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে ধাবিত করে। এই বহরের তিনটি জাহাজের একটি ছিলাে ক্ষেপণাস্ত্রবাহী এবং অপর একটি সরবরাহ জাহাজ। বহরের তৃতীয়টি ছিলাে সাবমেরিন। এই নৌবহরকে অনুসরণ করে অপর একটি ক্ষেপণাস্ত্রবাহী সাবমেরিনও ভারত মহাসাগরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে সােভিয়েত ইউনিয়নের এই বিশাল নৌশক্তির সমাবেশের আগে চীন-সােভিয়েত কূটনৈতিক পর্যায়ে একটি বােঝাপড়া সম্পন্ন হয় নেপালের। কাঠমণ্ডুতে।

বলাই বাহুল্য পরাশক্তি সােভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে এই বােঝাপড়াটি ছিলাে। বহুলাংশেই একতরফা এবং চীনের প্রতি এর মূল সুরটি ছিলাে অনেকটা ধমকের মতােই। বাংলাদেশ ইস্যুকে কেন্দ্র করে এ সময় কাঠমণ্ডুর কূটনীতিক পাড়াও অস্বাভাবিক কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠে। অবস্থানগত দিক থেকে চীন ও নেপালের ভৌগলিক নৈকট্য এবং এর পাশাপাশি ভারতের সাথে তার সুসম্পর্কের কারণে পাক-ভারত সংকটে নেপালের অবস্থান। অনিবার্যভাবেই গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। এর ফলে এই সংকটকেন্দ্রিক কূটনৈতিক তৎপরতা অনায়াশেই কাঠমণ্ডুতে বিস্তৃত হয়। ৮ কিংবা ৯ ডিসেম্বরের কথা। কাঠমণ্ডুতে নিযুক্ত সােভিয়েত দূত লুজিনভ সেখানকার চীনা দূতাবাসের সামরিক এটাচে চাও কুয়াং চিকে ডেকে পাক-ভারত সংকটে মস্কোর। কঠোর অবস্থানের কথা সরাসরি জানিয়ে দেন। এ সময় লুজিনভ তাকে সতর্ক করে দিয়ে। বললেন যে চীন যেনাে দক্ষিণ এশিয়ার কোনাে সংঘাতে অহেতুক হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত। থাকে। এর বিপরীতে চীন যদি তার দোসর পাকিস্তানের হয়ে এই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে তাহলে। সােভিয়েত ইউনিয়ন অবশ্যই তার জবাব দেবে সরাসরি চীন আক্রমণ করে। | সােভিয়েত ইউনিয়ন এরই মধ্যে চীনা হাকডাকের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীনের সিং কিয়াং প্রদেশের স্পর্শকাতর লপনরে আঘাত হানার লক্ষ্য নিয়ে সামরিক প্রস্তুতি শুরু করেছে। তার বিমান বাহিনীও ততােক্ষণে আক্রমণের জন্যে পুরােপুরি তৈরী হয়ে গেছে। একই। সাথে চীনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুকে তাক করে সােভিয়েত মাঝারি ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলাে কেবল বােতাম টেপার অপেক্ষায় রয়েছে তখন। অন্যদিকে চীনের অভ্যন্তরেও সােভিয়েত যুদ্ধ প্রস্তুতির বিরুদ্ধে প্রতিরােধ ব্যবস্থা গ্রহণে। বস্ততা লক্ষ্য করা গেলাে। এ সময় মহাকাশে ভাসমান সােভিয়েত পর্যবেক্ষণ উপগ্রহ থেকে এমন আলামতও ক্রেমলিন প্রশাসনের হস্তগত হলাে যে চীনারা তাদের পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্রগুলােও যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করে তুলছে। একই সাথে তিব্বতে তাদের সীমিত। সামরিক তৎপরতাও লক্ষণীয় হয়ে উঠলাে। ওদিকে সপ্তম নৌবহর ইতিমধ্যেই মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করেছে। উৎকণ্ঠিত বিশ্ববাসী বিপুল আতংক চোখে নিয়ে তাকিয়ে আছে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে।  

সূত্র : যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা – মেজর নাসির উদ্দিন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!