You dont have javascript enabled! Please enable it!

৬ ডিসেম্বর। পূর্ব সেক্টরের সমস্ত রণাঙ্গনে মুক্তিসেনা ও মিত্রবাহিনী শত্রুর অবস্থান ভেদ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আট থেকে দশ মাইল পর্যন্ত ঢুকে পড়েছে। তেমন কোনাে প্রতিরােধ নেই কোথাও। সিলেটের মৌলভীবাজার অক্ষেই কেবল কিছুটা প্রতিরােধের সম্মুখিন হতে হয়েছে মুক্তিসেনা ও ভারতীয় বাহিনীকে। এ ছাড়া সব জায়গাতেই ছােটখাটো বিক্ষিপ্ত সর্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে যুদ্ধ। প্রায় প্রতিটি স্থানে অগ্রসরমান সম্মিলিত বাহিনীর সামান্য চাপেই পশ্চাপসরণ করেছে পাকিস্তানীরা।  শক্র বাহিনীর পশ্চাদপসরণের এই প্রবণতা শুধুমাত্র পূর্ব সেক্টরেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং | বাংলাদেশ রণাঙ্গনের সর্বত্রই তখন একই অবস্থা বিরাজ করতে দেখা যায়। অনুরূপ অবস্থা। বিরাজমান ছিলাে পশ্চিম পাকিস্তান রণাঙ্গনেও। সেখানে তারা ইসরাইলী স্টাইলে অগ্রণী হয়ে আক্রমণ চালালেও জল, স্থল ও অন্তরীক্ষের সামগ্রিক যুদ্ধে তাদের সর্বাত্মক বিপর্যয় ইতিমধ্যেই সূচিত হয়েছে। উদ্যোগী হয়ে পাকিস্তান ৩ ডিসেম্বর কাশ্মীরসহ পশ্চিমের একাধিক ফ্রন্টে স্থল আক্রমণের সূচনা করে। কাশ্মীরের মধ্যাঞ্চল বরাবর দুটো মুখ্য আক্রমণ পরিচালনা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। পুঞ্জ সেক্টরে পাকিস্তানীদের একটি জোরালাে আক্রমণ ভারতীয়দের ব্যাপক বিমান আক্রমণের ফলে শুরুতেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কাশ্মীরের ছাব অক্ষে পাকিস্তানীদের দ্বিতীয় আক্রমণ রেখা কিছুটা সাফল্য অর্জনে সক্ষম হলেও একই অক্ষের উত্তর ভাগে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ সঞ্চালন ঘটি আখনূরে ভারতীয় পাল্টা আক্রমণ পাকিস্তানের এই সীমিত বিজয়কে অর্থহীন করে দেয়। উপরন্তু পাকিস্তানী আক্রমণের প্রত্যুত্তরে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের কার্গিল সেক্টরে ১৫টি অগ্রবর্তী চৌকি ছিনিয়ে নেয়। টিথওয়াল সেক্টরে লিঙ্গা উপত্যকার অধিকাংশ স্থান থেকেও পাকিস্তানী বাহিনীকে উচ্ছেদ করে দিতে সমর্থ হয় ভারতীয় বাহিনী। উরি সেক্টরেও একই রকম বিপর্যয় ঘটে পাকিস্তানের। এখানে ভারতীয়রা তােশ ময়দানের অনেকগুলাে পাকিস্তানী অবস্থান দখল করে নেয়। মােট কথা ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে পাকিস্তানের আক্রমণাত্মক অভিযান পরিচালন ক্ষমতা পুরােপুরি ধ্বংস করে দেয়া হয় যুদ্ধ শুরুর পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যেই।

এর ফলে পাকিস্তানীদের কাশ্মীর দখলের দীর্ঘকালের লালিত স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হলাে আরেকবার। মূল ভূখণ্ডের যুদ্ধে দক্ষিণে রহিমইয়ারখানের বিপরীতে ভারতীয় রাজস্থানের লাংগেওয়ালাতে পাকিস্তান একটি বড় ধরনের আক্রমণের সূচনা করে। বিমানের ছত্রচ্ছায়া ব্যতিরেকে পরিকল্পনাহীন এই আক্রমণ ভারতীয় বিমান বাহিনীর পাল্টা আক্রমণের ফলে তাদের জন্য ব্যাপক ধ্বংস বয়ে আনে। ৩০টি ট্যাংক হারিয়ে পাকিস্তান বাহিনী এই যুদ্ধে চরম পরাজয়ের সম্মুখিন হয়। এই পরাজয়ের মধ্য দিয়েই পাকিস্তানীদের সকল সামরিক কর্মকাণ্ডের সমাপ্তি ঘটে এই সেক্টরে। পাঞ্জাবের ভারতীয় অংশে ফিরােজপুরের হােসেইনীওয়ালায় এক যুদ্ধে পাকিস্তান একটি সীমিত আকারের বিজয় অর্জনে সমর্থ হয়। এই এলাকা থেকে ভারত অবশ্য আগেভাগেই তার বাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছিলাে। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারতীয় বাহিনী সেহেজরা দখল করে নেয়। এর ফলে কৌশলগত অবস্থান খেমকারান ঝুঁকিমুক্ত হয়ে যায়। খেমকারান এলাকাটি ৬৫’র যুদ্ধে পাকিস্তান দখল করে নিয়েছিলাে। কিন্তু এবার এই এলাকায় ৬৫ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটলাে না। একইভাবে পাঠানকোটে পাকিস্তানীদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরােধে ভারত পাকিস্তানের মূল সেনা সঞ্চালন ঘাঁটি সক্করগড়ে ত্রিমুখি আক্রমণ পরিচালনা করে। এটা ছিলাে পাকিস্তানের পাঞ্জাব অংশে পরিচালিত ভারতের সর্বাধিক জোরালাে আক্রমণ। এখানে যুদ্ধের প্রথম পর্যায়েই ভারতীয় বাহিনী জাফরওয়াল ও সক্করগড়ের শহরতলি পর্যন্ত পৌঁছে যেতে সমর্থ হয়। রাজস্থান সেক্টরে পাকিস্তানীদের লাংগেওয়ালা আক্রমণের পর পরই ভারত এই সেক্টরের দুটি ভিন্ন ফ্রন্টে শক্তিশালী আক্রমণের সূচনা করে। এই আক্রমণ দুটি চালানাে হয় মূলতঃ কৌশলগত কারণে। সম্ভবতঃ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত বাহিনী ১ কোরকে বিশেষ করে এই কোরের অধীন ১ আর্মার্ড ডিভিশনকে ভারত আক্রমণে প্রলুব্ধ করাই ছিলাে এর মূল উদ্দেশ্য। অর্থাৎ ভারত চেয়েছিলাে পাকিস্তানের এই বিপর্যয়ের মুহূর্তে প্রলুব্ধকরণ যুদ্ধে জড়িয়ে তারা ১ আর্মার্ড ডিভিশনকে ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১ আর্মার্ড ডিভিশন যুদ্ধের প্রলােভনে ধাবিত না হলেও পাকিস্তানী সেনা কর্তৃপক্ষ ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের বিচলণ ঘটালাে ভারতীয়দের অগ্রাভিযান প্রতিরােধ করার জন্যে।

এই প্রলুব্ধকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ভারতীয় বাহিনীর একটি আক্রমণ পরিচালিত হলাে রহিম ইয়ার খান অক্ষে অবস্থিত ইসলামগড় দখলের জন্যে। অপর আক্রমণ পরিচালিত হলাে রাজস্থানের দক্ষিণে পাকিস্তানের সিন্ধুসংলগ্ন বােম্বাই-সিন্ধু রেলপথ বরাবর গাদরা নয়াচোর অক্ষাঞ্চলে। গাদরা এবং একই অক্ষে অবস্থিত খােকরােপাড় সহজেই ভারতীয়দের দখলে এসে যায়। আর এভাবেই ভারতীয় বাহিনী পশ্চিমে পাকিস্তানের ঘাটতি পােষাণাের কাঙিক্ষত স্বপ্ন গুড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ রণাঙ্গনে যৌথবাহিনীর চূড়ান্ত যুদ্ধ জয়ের সম্ভাবনাকে দ্রুত উজ্জ্বল করে তােলে।| বিমান যুদ্ধের ক্ষেত্রেও পাকিস্তানের বিপর্যয় ঘটে একইভাবে এবং তা শুরু থেকেই। যুদ্ধের মাত্র দুদিনের মাথায়ই পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর অপসৃতি ঘটে অন্তরীক্ষে। যুদ্ধ শুরুর প্রথম রাতেই তাদের অগ্রবর্তী বিমান ঘাঁটিসমূহে পাকিস্তান কমপক্ষে ৩০টি বিমান হারায়। এ ছাড়া তাদের অধিকাংশ বিমান অবতরণ ক্ষেত্র এবং রাডার স্থাপনাসমূহ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পক্ষান্তরে স্থল বাহিনীকে বিমান বহরের সহায়তা প্রদান প্রশ্নে ভারতীয় বিমান বাহিনীকে অতিমাত্রায় তৎপর দেখা গেলাে। অন্যদিকে শুধুমাত্র কাশ্মীরের ছামবএলাকা ছাড়া পাকিস্তান বিমান বাহিনী আর কোথাও তাদের জোরালাে উপস্থিতি দেখাতে সক্ষম হলাে না। কখনাে সখনাে তারা কোনাে কোনাে ভারতীয় অবস্থানে হামলা চালাতে সমর্থ হলেও ওই সব হামলায় পাকিস্তানী বৈমানিকরা নিদিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানার ব্যাপারে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। পশ্চিম রণাঙ্গনে নেযুদ্ধেও ভারত আশাতীত সাফল্য অর্জন করে।

তেমন কোনাে প্রাধান্য থাকার পরেও ভারতীয় নৌবহর করাচী বন্দরের দিকে এগিয়ে যায় এবং ডিসেম্বরের ৪/৫ তারিখ মধ্যরাতে খােদ করাচী বন্দরে সংঘটিত নৌযুদ্ধে পাকিস্তানের দুটি ডেস্ট্রয়ার খাইবার ও শাহজাহানসহ মােট পাঁচটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। পাকিস্তান নৌ বাহিনীর জন্যে এটি ছিলাে নৌযুদ্ধে সবচেয়ে মারাত্মক বিপর্যয়কর একটি অবস্থা। ভারতীয় নৌবহর তারপরেও নিবৃত্ত থাকেনি। ব্যাপক বােমাবর্ষণে তারা ক্ষতবিক্ষত করে তুললাে করাচী বন্দর। চারদিন পর। ভারতীয় নৌ বাহিনী আবারাে আক্রমণ চালালাে। এবার তাদের আক্রমণ পরিচালিত হলো দুটি লক্ষ্য একসাথে করাচী এবং মাকরান উপকূলের গােয়াদরে। এই আক্রমণে নিমজ্জিত হলাে পাকিস্তানের আরও তিনটি জাহাজ এবং করাচীর জ্বালানি সংরক্ষণাগার এতে পুরােপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।  আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে পূর্ব-পশ্চিমে সামগ্রিক যুদ্ধের এই অবস্থায় পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠী। ও তাদের সমববিদদের সশস্ত্র বাহিনীর গুণগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা ততােক্ষণে নিঃশেষিত হয়েছে প্রায়। শুধু পূর্ব বাংলাই নয়, খােদ পাকিস্তানের নিরাপত্তাও যে চরম সংকটাপন্ন তাও তারা অনুধাবন করতে শুরু করে। আর সে জন্যে তারা যে কোনাে মূল্যে জাতিসংঘের মাধ্যমে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে। এই পর্যায়ে পাকিস্তানের নিরাপত্তার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র যথার্থই অনুভব করে। আর এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর। করার জন্যে প্রবলভাবে উদ্দ্যোগী হতে দেখা যায়। বিরূপ এই পরিস্থিতির কারণে পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এমনকি শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের আশু মুক্তির জন্যে তখন পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যাণ্ডকে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণেরও অনুমতি দেন। একই সাথে ইয়াহীয়া প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে সরাসরি নিঃশর্ত আলােচনাতেও রাজী হন। পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ এবং তাদের অধিকৃত কাশ্মীরের নিরাপত্তার বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ও এ সময় গ্রহণযােগ্য হয়ে পড়ে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর কাছে।

৪ ডিসেম্বর মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন দূত জর্জ বুশের উদ্যোগে যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত হলেও সেভিয়েত ভেটোর মুখে তা বাতিল হয়ে যায়। তাছাড়া মার্কিনীদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ফ্রান্স ও বৃটেনও মার্কিন যুদ্ধবিরতির এই প্রস্তাবের পক্ষে ভােটদানে বিরত থাকে। আর এভাবেই এ সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে শুরু করে। এদিকে মার্কিন প্রশাসন ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই পাকিস্তানের ভাঙ্গনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে তাদের ভাষায় দুঃখজনক বাস্তবতা হিসেবেই মেনে নেয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান ও তাদের অধিকৃত কাশীরের নিরাপত্তার ব্যাপারে তারা সাংঘাতিকভাবে বিচলিত হয় পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত হয় যে, ভারতীয় বাহিনী অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তান রণাঙ্গনেও পাকবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম হবে। পরিণামে। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরসহ পশ্চিম পাকিস্তানের অবধারিত সামরিক পরাজয় ঘটবে। আর তাই পাকিস্তানের অনিবার্য ধ্বংস ঠেকাতে মার্কিন প্রশাসন ত্বরিত কিছু রাজনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যার মধ্যে ছিলাে :  এক, আন্তর্জাতিকভাবে ভারতকে আগ্রাসনের জন্য দায়ী করা। দুই, গণচীনকে উত্তরে হিমালয়সংলগ্ন ভারত সীমান্তে সামগ্রিক যুদ্ধ অথবা সীমিত সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য প্ররােচিত করা এবং তিন, বঙ্গোপসাগরে তাদের সপ্তম নৌবহরকে পাকিস্তানের পক্ষে সামরিক কার্যক্রম গ্রহণের জন্য প্রস্তুত রাখা। শুধু তাই নয়, নিক্সন প্রশাসন এ পর্যায়ে তাদের সর্বোচ্চ চাপ প্রয়ােগ করলো সােভিয়েত ইউনিয়নের ওপর যাতে তারা ভারতকে পশ্চিম পাকিস্তান রণাঙ্গনে যে কোনাে ধরনের সামরিক বিজয় অর্জন থেকে বিরত রাখে। ৬ ডিসেম্বর ভাের নাগাদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট মহাসড়কের নিকটবর্তী পাইকপাড়ায় আমাদের অবস্থান গ্রহণ সম্পন্ন হয়ে যায়। ডানে ‘বি’ কোম্পানী মেজর ভূঁইয়ার নেতৃত্বে মহাসড়ক বিচ্ছিন্ন করার দায়িত্বে নিয়ােজিত। সে ক্যানা ও বুদুস্তি গ্রামের মাঝ বরাবর সড়ক। অবরােধ বসিয়েছে। আমার ‘ডি’ কোম্পানী মহাসড়কের এক হাজার গল্পের মধ্যে কালিসীমায় অবস্থান নিয়েছে। বাঁ দিক জুড়ে ‘এ’ এবং ‘সি’ কোম্পানী। আমরা সবাই শিয়ালের গর্তের মতাে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে অবস্থান নিয়েছি। সমস্ত এলাকাটাই জনশূন্য।

আগের দিন ৫ ডিসেম্বর সূর্যাস্তের পর পরই আমরা আমাদের বিস্তৃত ফুন্ট বরাবর সীমান্ত। বেষ্টনি ভেদ করে এগিয়ে যাই। তেমন কোনাে প্রতিরােধ ছাড়া ভােরে সূর্যোদয়ের আগে। সিলেট ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কে পেীছে যেতেও সক্ষম হলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিক থেকে তখন প্রচণ্ড কামানের গর্জন শােনা যাচ্ছে। আখাউড়ার পতনের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে সম্মিলিত বাহিনী এগিয়ে চলেছে দুটি ভিন্ন অক্ষে। শক্তিশালী দুই শলাকা বিশিষ্ট এই আক্রমণ রেখা সাড়াশির মতােই এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকে। আখাউড়ার পতনের প্রেক্ষাপটে ১১ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের শাহবাজপুর-সরাইল অক্ষ বরাবর পরিচালিত অভিযান শত্রুবাহিনীর ১৪ পদাতিক ডিভিশনকে পুরােপুরি বিচ্ছিন্ন করলাে সিলেট অঞ্চলে যুদ্ধরত তাদের অপর দু’টি। ব্রিগেড থেকে। | বেলা আনুমানিক ২টার দিকে মেজর নাসিমের নির্দেশে আমাদের অভিযান সরাইলের পথে শাহবাজপুরের দিকে মােড় নিলাে। অভিযানে বর্ধিত সুবিধা হিসেবে আছেন ব্রিগেড অধিনায়ক সফিউল্লাহ এর সর্বোপরি নেতৃত্বে। আখাউড়ার ক্রমান্বয়ে নির্জীব হয়ে আসা রণাঙ্গন ছেড়ে তিনি এবার এসেছেন উত্তপ্ত অপর রণাঙ্গনে তার অধীনস্ত দ্বিতীয় শলাকার নেতৃত্বে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাকে ‘এ’ কোম্পানীর পশ্চাতে অগ্রসর হতে হবে। অর্থাৎ অগ্রাভিযানের সম্মুখভাগের অবস্থানে থাকবে ‘সি’ কোম্পানী—তাকে অনতিবিলম্বে। কৌশলগত শাহবাজপুর সেতুর দখল নিশ্চিত করতে হবে! ‘সি’ কোম্পানীকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাবে ‘এ’ এবং সবশেষে আমার ‘ডি’ কোম্পানী। আমার পেছনে ভূঁইয়ার ‘বি’ কোম্পানী হয় সড়ক অবরােধ কার্যকরী করবে নয়তাে পুরাে ব্যাটালিয়নের পশ্চাদ্ভাগের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব পালন করবে।  নাসিমের মৌখিক নির্দেশের বাস্তবায়নে আমি যথাসময়ে মহাসড়কের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। ‘এ’ এবং আমার কোম্পানীর মধ্যে তখন বেশ কিছুটা দূরত্ব বিদ্যমান। মহাসড়কে আমার পৌছানাের আগেই দুটি ট্রাক ও একটি বাসকে মাধবপুরের দিক থেকে দ্রুত শাহবাজপুরের পথে এগিয়ে যেতে দেখলাম। এ সময় সম্মুখভাগে অগ্রসরমান ‘এ’ কোম্পানীর অবস্থান থেকে ধাবমান গাড়ী বহরের ব্যবধান ছিলাে কয়েক গজ মাত্র। তাৎক্ষণিকভাবে আমি ধরে নিলাম যে সেগুলাে হয় ভারতীয় সৈন্য বহনকারী অথবা আমাদের সেক্টর ট্রপস্ পরিবর্তীত অবস্থার প্রেক্ষিতে তেলিয়াপাড়া থেকে শাহবাজপুরে স্থানান্তর হচ্ছে। আমার এই ধারণা আরও নিশ্চিত হলাে যখন দেখলাম মহাসড়কের সংযােগস্থলে আমাদের অগ্রসরমান। সৈনিক এবং ট্রাক ও বাসবাহী অজ্ঞাত সৈনিকদের মধ্যে অপ্রিতিকর কিছু ঘটলাে না।

কিন্তু পূর্বে ব্যপারটি ঘিরে প্রকৃত ঘটনা ছিলাে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ ক্ষেত্রে মেজর ভূঁইয়ার সড়ক থেকে আহত রাখার কথা থাকলেও অধিনায়ক মেজর নাসিমের কথিত নির্দেশ প্রাপ্তির পতিনি সড়ক অবথে প্রেত্যাহার করে তার পরিবর্তে শাহবাজপুরে অগ্রাভিযান শুরুর প্রস্তুতি নে ! আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের কোম্পানী আয়তনের একই মত সেনাদল তিনটি মােটরযানে চোপে নির্বিঘ্নে মহাসড়ক ধরে শাহবাজপুরের দিকে এখন নির্দেশ প্রাপ্তির ব্যাপারে ভুল বােঝাবুঝির অবকাশ থাকলেও সড়ক অবরােধ প্রত্যাহারের কোনাে যুক্তি নেই। আর তা গ্রহণযােগ্যও নয়। রণক্ষেত্রের সর্বত্র বিপুল বিভ্রান্তির অবত ভুলে উপস্থিতি অবশ্যই থাকবে। তবে একজন সফল অধিনায়ক এই ভুল বেকবক ভেতর থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সংকট কাটিয়ে উঠবেন, এটাই স্বাভাবিক। যাই হােক বনে পাকিস্তানীদের পক্ষে বেশীদূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি এরপর। ইসলামপুর সেতুর কাছাকাছি এসে তারা সামনে আমাদের ‘সি’ কোম্পানীসহ আরও অনেক ফের উপস্থিতি লক্ষ্য করে। তখন তাদের এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র পথ ছিলাে আক্রমণের মাধ্যমে ফঁাকের সৃষ্টি করে তা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। পাকিস্তানীদের আক্রমণের পূর্ব মুহূর্তে ব্রিগেড অধিনায়ক সফিউল্লাহ অগ্রসরমান ‘সি’ কোম্পানি থেকে খানিকটা পেছনে ছিলেন। সম্ভবতঃ একটি হালকা যানে চেপে তিনি এগিয়ে ছিলেন মেজর নাসিম ছিলেন ভারতীয় গােলা নির্দেশক অফিসার ক্যাপ্টেন টমাসসহ ‘সি’ কোম্পানির ঠিক পশ্চাত। তাদের সবার জন্যেই পেছন দিক থেকে পাকিস্তানীদের এই আন এবং আক্রমণ উভয়ই ছিলাে অনাকাক্ষিত। আক্তমন্দের প্রচণ্ডতায় ‘সি’ কোম্পানী নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এই কোম্পানীর একটি প্লাটুন নবপদ আশ্রয়ের জন্যে তিতাস নদীর অপর পার শাহবাজপুরে চলে যায়। বাকি দু’ প্লাটুনের মধ্যে একটি আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

অক্ষত একটিমাত্র প্লাটুন নিয়ে কোম্পানী অধিনায়ক নজন প্রতিরােধ ব্যাহত রাখে। মহাসড়কে স্বসৈন্যে আমার পৌছানাের আগেই ইসলামপুরের দিক থেকে গােলাগুলির প্রচণ্ড শব্দ শােনা গেলো। প্রকৃত ঘটনা জানার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তা আমার কাছে স্বাভাবিক বলেই মনে হলো। যুদ্ধক্ষেত্রে এ ধরনের গােলাগুলির শব্দ তাে হবেই। ধরেই নিলাম যে ইসলামপুরের কাছাকাছি এলাকায় ‘সি’ কোম্পানীর সঙ্গে পাকিস্তানী সেনাদের সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। এ অবস্থা প্রমানের করণীয় কি, তা জানার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। আমার অবস্থানের দু থেকে নিল গৰু সামনে ‘এ’ কোম্পানীর যােদ্ধারাও দাড়িয়ে আছে। তারাও সম্ভবতঃ একই কাকলে অপেক্ষা করছে। এই মাল্য গুলিবিদ্ধ এক গ্রামবাসী ছুটে এলাে আমাদের কাছে। রক্ত ঝরছে তার শরীর থেকে। সেই প্রথম জানালাে যে কিছুক্ষণ আগে শাহবাজপুরের দিকে ধাবমান মােৰ্টষনগুলােতে পাক সেনারা যাচ্ছিলাে এবং তারাই পেছন থেকে মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণ করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে আমার মনে হলাে যে, কোনাে কারণবশতঃ মেজর ভূঁইয়ার সড়ক বপ্নে কাকির নেই এব যে কোনাে মুহূর্তে একই ধরনের আরও ঘটনা ঘটে যেতে পারে। প্রথমেই আমি একটি শক্তিশালী সড়ক অবরােধ সৃষ্টির প্রয়ােজন অনুভব করলাম। ভারা মেশিননিসহ ন্যন্য দূরপাল্লার স্বয়ংক্রিয় অন্ত্রের সাহায্যে ত্বড়িত একটি রক্ষাব্যুহ তৈরী করা হলো সড়ক বরাবর। সুবেদার তৈয়বকে দেয়া হলাে এই সেনাদলের নেতৃত্ব। 

এরপর মেজর নাসিমের নির্দেশ উপেক্ষা করে সামান্য কিছু গােলাসহ যে ৩ ইঞ্চি মর্টারটি এনেছিলাম, তার ব্যবহার এই মুহুর্তে খুব প্রয়ােজনীয় হয়ে উঠলাে। এই মর্টার থেকেই শাহবাজপুর লক্ষ্য করে খানিক বিরতি দিয়ে দিয়ে গােলাবর্ষণ শুরু করা হলাে। | এই গােলাবর্ষণের উদ্দেশ্য ছিলাে শত্রুকে এই মর্মে বােঝানাে যে একই অক্ষ বরাবর অতিরিক্ত বাহিনী তাদের মােকাবেলার জন্য এগিয়ে আসছে। তাছাড়া ৩ ইঞ্চি মর্টারের বিধ্বংসী ক্ষমতা একেবারে কম নয়। হতে পারে তা শাহবাজপুরে শত্রুর ওপর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিরও সৃষ্টি করবে। উপস্থিত অধিনায়কদের মধ্যে এখন যেহেতু আমি সবার সিনিয়র, সে কারণে আমাকে তড়িৎ আরও কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হলাে। এ সময় ‘এ’ কোম্পানীর অবস্থান ছিলাে আমার কোম্পানী এবং যুদ্ধে লিপ্ত ‘সি’ কোম্পানীর মাঝ ববাবর। আমি যেহেতু ইতিমধ্যে সড়ক অবরােধ বসিয়েছি এবং চান্দুড়া থেকে তুলনামূলকভাবে অনেকটা বেশি দূরত্বে অবস্থান করছি, সে কারণে এগিয়ে থাকা সুবেদার করিমকে তার ‘এ’ কোম্পানী নিয়ে চাড়ার পাকিস্তানী অবস্থানে আক্রমণ চালাবার জন্যে বললাম। সুবেদার করিম ব্যাটেলিয়ান অধিনায়কের নির্দেশ ব্যতিরেকে আমার দেয়া নির্দেশ অগ্রাহ্য করলাে। তার ব্যতিক্রমী শৃঙ্খলা বিরােধী আচরণের কারণে সে অবস্থায় সময়ক্ষেপণ না করে, বলা যায়, খানিকটা অসৌজন্যমূলকভাবেই কোম্পানীর নেতৃত্ব থেকে তাকে সরিয়ে দিতে হলাে। আমার এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নে প্রকারান্তরে সুবেদার করিম খুশিই হয়েছে বলে মনে হলাে। যুদ্ধ করে প্রাণ দিতেই হবে না। এর চেয়ে ভালাে বিকল্প আর কি হতে পারে। নির্বিকারভাবে সে গ্রামের পথে হেটে চলে গেলাে। বিকল্প হিসেবে আমার অধিনস্ত কোম্পানী অফিসার লেঃ হুদাকে ‘এ’ কোম্পানীর নেতৃত্ব দিয়ে তাকেই চাদুড়ার শত্রুর অবস্থানে আক্রমণ চালাবার জন্যে বললাম। হুদা একান্ত অনুগত অধিনায়কের মতােই আমার দেয়া আদেশ শিরােধার্য করে নিলাে। ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মাথায় হুদা চড়ার শত্রুর অবস্থানে সফল আক্রমণ রচনা করলাে। পাকিস্তানী সেনারা পরাস্ত হলো। তাদের নিহতের সংখ্যা দাঁড়ালাে ২৭ এবং বন্দি হলাে ১৩ জন। আমাদের পক্ষে নিহত হলাে ৪ জন। এর মধ্যে দুজনই ভারতীয় সৈনিক। এই দু’জন ভারতীয় সৈনিক ক্যাপ্টেন টমাসের জন্যে ওয়্যারলেস সেট বহন করছিলাে। অপর মৃত দুজন ‘সি’ কোম্পানীর সৈনিক। আহতের সংখ্যা অনেক। তারমধ্যে গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন অধিনায়ক মেজর নাসিম ও লেঃ মঈন। মুক্ত হলাে আটকে পরা নজরুলের ‘সি’ কোম্পানী। ব্রিগেড অধিনায়ক সফিউল্লাহ অক্ষত বেরিয়ে এলেন।

এরপর সফিউল্লাহ নিজেই আহতদের নিয়ে পশ্চাতে চলে গেলেন পাকিস্তানীদের পরিত্যাক্ত ট্রাকে চেপে। | নাসিম ও ভূঁইয়ার অনুপস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই তৃতীয় সিনিয়র অফিসার হিসেবে ব্যাটালিয়নের দায়দায়িত্ব আমার ওপর বর্তালাে। সূর্যাস্তের তখনাে কিছুটা সময় বাকি থাকার কারণে শাহবাজপুরের দিকে আমাদের যাত্রা অব্যাহত রাখা হলাে। আমার ‘ডি’ কোম্পানী এখন অগ্রাভিযানের নেতৃত্বে। শাহবাজপুর খুব দূরে নয়। জায়গাটির সামরিক গুরুত্ব অপরিসীম। অর্থাৎ শাহবাজপুরের পতন হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পার্শ্বদেশ ও সরাইলের ওপর সরাসরি চাপ সৃষ্টি করা সহজ হবে এবং সেখান থেকে মেঘনার তীর অবধি পৌছানাে তখন সময়ের ব্যাপারে দাড়াবে মাত্র। | আমরা পূর্ণ সতর্কতার সাথে এগিয়ে চলেছি। পাকিস্তানীরা শাহবাজপুর অবস্থান থেকে ১২০ মিলিমিটার ভারী মর্টারের সাহায্যে আমাদের অগ্রসরমান অবস্থানের ওপর সেই অনেকক্ষণ থেকেই গােলাবর্ষণ করে চলেছিলাে। আর ঠিক এ সময়টাতেই তারা বিস্ফোরকের সাহায্যে শাহবাজপুর সেতুটি উড়িয়ে দেয়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পর্যবেক্ষণও কষ্টসাধ্য হয়ে উঠলাে। সেই সাথে পাকিস্তানীদের গােলাবর্ষণের তীব্রতাও বৃদ্ধি পেলাে। ইসলামপুরের সংঘর্যে ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনীর গােলা নির্দেশক দু’জনের মৃত্যুর ফলে এবং বেতারযন্ত্র বিকল হয়ে যাবার কারণে ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনীর সমর্থন লাভও সম্ভব হলাে না। এদিকে ভূঁইয়ার সাথে। তখনাে পর্যন্ত কোনাে যােগাযােগ স্থাপিত হয়নি এবং তার অবস্থান সম্পর্কেও কিছু জানতে পারিনি। তাছাড়া সুবেদার তৈয়বের সড়ক অবরােধের স্থান থেকেও অনেকটা দূরে সরে এসেছি ইতিমধ্যে। দূরত্ব আরও বারলে তার বিচ্ছিন্ন হয়ে পরার সম্ভাবনা রয়েছে। সবকিছু বিবেচনা করে আপাততঃ আর না এগিয়ে রাতের মতাে ইসলামপুরের কিছুটা পেছনে ফিরে গিয়ে অবস্থান গ্রহনের সিদ্ধান্ত নিতে হলাে আমাকে। রাত বাড়ার সাথে সাথে ক্ষুধা ও শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সমগ্র এলাকা জনশূন্য থাকার কারণে চষ্টা করেও রাতে খাবারের কোনাে বন্দোবস্ত করা গেলাে না। ৩৬ ঘণ্টার মতাে আমরা সবাই অভুক্ত। যুদ্ধের প্রথম দিকে এ ধরনের অবস্থায় কখনােই ক্ষুধা অনুভব করতাম । ইচ্ছাও হতাে না। এরপর ধীরে ধীরে সব কিছু সয়ে গেছে। মৃত্যু, রক্ত, লাশ, গলিত মৃতদেহ এর কোনাে কিছুই বাদ সাধতাে না আমাদের করণীয় কোনাে কিছুতে। যেখানে সেখানে খেয়েছি। যা পেয়েছি তাই খেয়েছি। তারপর ঘুম আসলে ঘুমিয়েছি। অনায়াসেই। | সেদিনই মনে হলাে বাস্তবে যুদ্ধ সত্যিই ভয়াবহ আর কষ্টসাধ্য। স্বাভাবিক অবস্থাতে যুদ্ধের নিষ্ঠুর বাস্তবতার ধারে কাছে পৌছানােও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সিনেমাতে বা বইতে যুদ্ধকে যেভাবে দেখানাে হয় বা বর্ণনা করা হয়, প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ তার থেকে বহুগুণে ভয়াবহ।

আমি নিজে অনেক যুদ্ধের ছবি দেখেছি। যুদ্ধের বইও পড়েছি। যুদ্ধকে আমি বরাবর সেই ছবি বা বইয়ের আলােকেই কল্পনা করেছি। কিন্তু বাস্তবে যুদ্ধ আর নরকের বিভীষিকা বােধ করি একই ব্যাপার। প্রেক্ষাপট শুধু ভিন্ন। | ভাবতে অবাক লাগলাে যে, মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেও আমরা ৭ জন অফিসার ব্যাটালিয়নটির নেতৃত্বে ছিলাম। নাসিম ও মঈন আহত হয়ে রণাঙ্গন থেকে বিদায় নিয়েছে। মঈন বেঁচে গেলেও নাসিমের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। হয়তাে মৃত্যুপথযাত্রি এই বীর যােদ্ধাও। মাত্র ক’দিন আগেই বিদায় নিয়ে গেলাে বদি। এভাবে বিদায় নিয়েছে আরও অনেকে কয়েক মাসের ব্যবধানে। এসব ভাবতে ভাবতে এক সময় কি এক বিষন্নতা আমার সৈনিক সত্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেললাে। মৃত্যুর পাশাপাশি বেঁচে থাকারও একটি ছােট্ট বাসনা অনুভব করলাম ভেতরে, অনুভূতির অনেক গভীরে। মৃত্যু আর বেঁচে থাকার কি অদ্ভুত এক দ্বন্দ্ব। অন্তরের এক কোণে লালিত এই বেঁচে থাকার বাসনা সত্ত্বেও অনিবার্য এক যুদ্ধের ভয়ংকর পথ ধরে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। লক্ষ্য কেবল এক টুকরাে মাটির ভালােবাসা। এই ভালােবাসার পবিত্রতা রক্ষার জন্যেই এতাে আত্মত্যাগ। শাহবাজপুরকে সামনে রেখে রাতের মতাে পাইকপাড়ার অগ্রবর্তী এলাকায় অবস্থান নেয়া। হয়েছে। আমার কোম্পানীর সাহায্যে একটি শক্তিশালী সড়ক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়েছে। মহাসড়কে। সুবেদার তৈয়ব ও তার সেনাদলকে ইতিমধ্যে মূল বাহিনীর সঙ্গে একত্রিত করা। হয়েছে এবং মহাসড়কে তৈরী অবরােধ কার্যকর করার দায়িত্ব যৌথভাবে হুদা ও সুবেদার তৈয়বকে দেয়া হয়েছে। আমি আর নজরুল ‘এ’ ও ‘সি’ কোম্পানীর তদারকিতে রয়ে গেলাম সম্মুখভাগে।  শাহবাজপুরের দিক থেকে পাল্টা কোনাে আক্রমণের সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় । আর সে কারণেই ব্যাটালিয়নের অগ্রবর্তী এলাকায় আমাদের উপস্থিতির বিষয়টি খুবই মধ্যরাতের পর প্রচারিত ভারতীয় বেতারের খবরে শুনলাম ভারত সেদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমন একটি খবর শােনার পরও ভাবান্তর হলাে না ভেতরে খুব একটা। মনে হলাে এটা যেনাে প্রত্যাশিতই কোনাে একটি ব্যাপার। ৮ ডিসেম্বর ভােরে শাহবাজপুর আমাদের দখলে এসে যায়। অবশ্য আগের দিন ৭ ডিসেম্বরের মধ্যেই শাহবাজপুরের দখল নিশ্চিত করা সম্ভব ছিলাে। কিন্তু ৭ তারিখ সমস্ত দিন আমাদেরকে আখাউড়ার দিক থেকে অগ্রসরমান ১০ বিহার ও ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছে। আখাউড়া ঘাঁটির পতনের পর ১০ বিহার ও ২ ইস্ট বেঙ্গল আখাউড়ার উত্তর দিক থেকে বিচলন ঘটিয়ে শাহবাজপুর বরাবর এগিয়ে আসে এবং ৮ ডিসেম্বর ভােরে শাহবাজপুর অতিক্রম করার পর এই দুটি রেজিমেন্টের সাথে আমাদের সংযােগ স্থাপিত হয়।

সেদিন ভােরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেও পাকিস্তানীরা পশ্চাদপসরণ করে। বিনা যুদ্ধে আরও একটি তথাকথিত পাকিস্তানী দুর্গের পতন ঘটলে। সমরবিদ সাদুল্লাহ যুদ্ধ ছাড়াই বিস্তৃত রণাঙ্গন ছেড়ে দিলেন। এবার তিনি আশ্রয় নিয়েছেন মেঘনার দুকূল বরাবর—আশুগঞ্জ ও ভৈরবে। | শাহবাজপুরে ১০ বিহার রেজিমেন্টের সাথে যােগাযােগ প্রতিষ্ঠার পর কালবিলম্ব না করে সরাইল অভিমুখে অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখা হলাে। অক্ষ বরাবর শত্রুর ছােটোখাটো প্রতিবন্ধকতাগুলাের সহজেই পতন ঘটে আমাদের যৌথ আক্রমণের মুখে। ভারতীয় অধিনায়ক তখন কোনাে অবস্থাতেই আর সময় অপচয়ের পক্ষপাতী ছিলেন না। হঠাৎ করেই যেনাে আমাদের অগ্রাভিযানে গতির সঞ্চার হলাে। | সেদিন সকাল থেকে দলে দলে রাজাকাররা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আত্মসমর্পণ করছিলাে। এদের। অনেককেই তাদের অস্ত্রশস্ত্র রাস্তার পাশে ফেলে রেখে বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কেউ কেউ অনুশােচনার ভঙ্গিতে কান ধরেও দাড়িয়ে থাকে। অদ্ভুত সব অভিব্যক্তি। অধিকতর নিরাপদ মনে করে এদের কিছু সংখ্যক আবার তাদের স্ত্রী-কন্যা দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েও আত্মসমর্পণ করে। স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর হাতে বেশ কিছু রাজাকার নিহত হলাে এ সময়। নিহত এইসব রাজাকারদের অধিকাংশই বাঙালী হত্যার অভিযােগে অভিযুক্ত ছিলাে। তাদের প্রভুরা বিদায় নিয়েছে। তাই আজ তারা পরাভুত। তবে আমাদের সামনে এই প্রাণহানীর ঘটনা খুব একটা ঘটেনি। এই প্রাণহানি এড়াবার একদিকে যেমন কোনাে উপায় ছিলাে না তেমনি তাতে বাধা দেয়ারও কোনাে যুক্তি কিংবা সুযােগ ছিলো না আমাদের। এক পর্যায়ে আত্মসমর্পণকারী রাজাকারদের সংখ্যা বেড়ে যায়। এ অবস্থা প্রশাসনিক ঝামেলা এড়াবার জন্যে এবং আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থে এই রাজাকারদের দায়-দায়িত্ব আমাদেরকে স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর হাতেই ন্যস্ত করতে হলাে।  রাস্তার দুপাশে দাড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষ আমাদেরকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলাে। সবার চোখেই বিস্ময়। এই প্রথম দিনের আলােতে তারা মুক্তিবাহিনীকে দেখছে। একজন নয়, দুজন নয়—শ’য়ে শ’য়ে অকুতােভয় স্বাধীনতার সৈনিক। জনসাধারণের অনেকে আবেগ আর উচ্ছ্বাসে আমাদেরকে জড়িয়ে ধরে কাদছিলাে।

‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠছিলাে। একের পর এক জনপদ।  যতােই সরাইল আমাদের নিকটবর্তী হচ্ছে কামানের গর্জন ততােই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে লাগলাে। ভারতীয় বাহিনীর হালকা ও মাঝারী কামানগুলাে সক্রিয় হয়ে উঠতে লাগলাে বেলা বাড়ার সাথে সাথে। ভােরের কুয়াশা কেটে যাবার পর স্পষ্ট আলােতে শত্রুর অবস্থান নিরূপণ সহজতর হওয়ায় গােলাবর্ষণ লক্ষভেদী করতে সমর্থ হলাে ভারতীয়রা। তাদের গােলন্দাজ বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সরাইল পর্যন্ত সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তুসমূহে আঘাত হেনে চলে বিরামহীনভাবে। | অক্ষের ডান দিকে ১১ ইস্ট বেঙ্গল সতর্কতার সাথে এগিয়ে চলেছে। বা দিকে ১০ বিহার রেজিমেন্ট। ২ ইস্ট বেঙ্গল সংরক্ষিত বাহিনী হিসেবে এখন পেছনে। এই পর্যায়ে ভারতীয় গােলন্দাজের জোরালাে সহায়তা পাওয়া গেলাে। এই আনুকুল্য সম্ভবতঃ আমাদের সাথে ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতির কারণে ঘটে থাকবে। তারা সুনিপুণভাবে আমাদের অগ্রসরমান অবস্থানের এক হাজার গজ সামনে গােলাবর্ষণ অব্যাহত রাখলাে। সরাইলের তিন রাস্তার মােড়ে আমরা পাকিস্তানীদের প্রতিরােধের মুখােমুখি হলাম। এটা ছিলাে পাকিস্তানীদের একটি বিলম্বিকরণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। তাদের ১২ আজাদ কাশ্মীর ব্যাটালিয়নের একটি কোম্পানী এবং অনিয়মিত সৈন্যের অপর একটি দল সরাইলের উচু অবস্থান থেকে আমাদের সম্মুখ ভাগের ওপর দুরপাল্লার স্বয়ংক্রিয় অন্ত্রের সাহায্যে প্রতিরােধের সূচনা করলাে। ১০ বিহার রেজিমেন্ট তাৎক্ষণিকভাবে বাঁ দিক বরাবর আক্রমণ চালিয়ে অনায়াসেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সরাইল মহাসড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে সমর্থ হলো। মেজর ভূঁইয়ার ‘বি’ কোম্পানী তিন রাস্তার সংযােগস্থল লক্ষ্য করে আক্রমণ চালালাে। আর আমার ‘ডি’ কোম্পানী শত্রুর অবস্থানের ডান দিকে অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে সরাইলের মধ্যভাগে প্রবেশ করলাে। আমাদের এই যৌথ চাপ প্রতিহত করতে সমর্থ হলাে না শত্রুবাহিনী। আক্রমণের মুখে আশুগঞ্জের দিকে সরে পড়ে তারা। বলা যায় বিনা যুদ্ধে সরাইলেরও পতন ঘটলাে।

এখানে পাকিস্তানী ২৭ পদাতিক ব্রিগেডের পক্ষে যুদ্ধরত বাঙালী অফিসার মেজর ফরিদ এবং অপর একজন ক্যাপ্টেন পদের কর্মকর্তা আমাদের সৈনিকদের কাছে আত্মসর্মপণ করে। এই দুজন অফিসারই ৩১ ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্টে পাকিস্তানের পক্ষে স্বজাতির বিরুদ্ধে লড়েছে যুদ্ধের দীর্ঘ নমাস।। আমাদের হস্তক্ষেপের আগেই গুলিতে তারা দু’জনই নিহত হয়। স্বজাতির বিরুদ্ধে এই বিশ্বাসঘাতকতা বাঙালী সৈনিকরা সহ্য করতে পারেনি সম্ভবতঃ।। দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছুঁই ছুঁই করছে। আমরা সরাইলের প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে ব্যস্ত। এ সময় পাকিস্তানীদের একটি পাল্টা আক্রমণের আশংকা করছিলাম। পাক গােলন্দাজ বাহিনীর বিক্ষিপ্ত গােলাবর্ষণ তখনাে অব্যাহত রয়েছে। মিত্রবাহিনীর কামানও বসে নেই। শত্রুর কামান স্ত করার জন্যে তাদের মাঝারি পাল্লার কামানগুলাে সম্মানে গােলাবর্ষণ করে চলেছে। আমরা সরাইলকে ঘিরে ততােক্ষণে বেশ শক্তভাবেই গেড়ে বসেছি। পাল্টা আক্রমণের ধাক্কা। সামলাবার জন্যে আমরা প্রস্তুত।  আমার কোম্পানীর দূরপাল্লার অস্ত্রগুলােকে তাদের সীমানা বন্টন করে নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে সরাইলের লােকজন যার যার ঘরবাড়িতে ফিরে আসতে শুরু করেছে। জয়বাংলা ধ্বনিতে সরাইল মুখরিত হয়ে উঠেছে। | আমরা সবাই ক্লান্ত। অনাহাৱারের চতুর্থ দিন অতিবাহিত হতে চলেছে। এই চার দিনে পানি। ছাড়া পেটে একটি দানাও পড়েনি কারাে। দীর্ঘ পথ হাঁটার ফলে সবারই পা ফুলে উঠেছে। পরবর্তী নির্দেশের জন্যে আমরা অপেক্ষা করছি আমাদের নিজ নিজ অবস্থানে। সরাইলের সাধারণ এলাকা প্রতিরক্ষা অৱস্থান গ্রহণের প্রশ্নে মােটেও উপযুক্ত নয়। মূল লােকালয়টি গাছপালা ঝোপঝাড় পরিবেষ্টিত। চারদিকে বাসাবাড়ী। আর সে কারণেই পর্যবেক্ষণ সীমিত। এ ছাড়াও বড় সমস্যা হচ্ছে ফিরে আসা জনসাধারণের নিরাপত্তার বিষয়। এ সব কারণে শত্রুর পাল্টা আক্রমণে বিপদের সম্ভবনা সেখানে বেশী। মেজর ভূইয়ারও সেই একই সমস্যা।

এরই মধ্যে ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান আমার অবস্থানে এসে খবরাখবর জানতে চাইলেন। তাকে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত অসুবিধার কথা জানালাম এবং এর ওপর কর্নেল সফিউল্লাহর মতামত জরুরি ভিত্তিতে সন্ধ্যার আগেই জানাবার অনুরােধ করলাম। ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামানের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, তখনই পাকিস্তানীদের গােলাবর্ষণ শুরু হলো। বৃষ্টির মতাে অঝোরে ঝরছিলাে পাকিস্তানীদের নিক্ষিপ্ত কামানের গােলা। অলৌকিকভাবে ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামানের জীপটি অক্ষত থেকে গেলাে। কামানযুদ্ধ একটু হালকা হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামানকে পাঠিয়ে দিলাম নিরাপদ দূরত্বে। | চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার প্রয়ােজনে আমি একটি উচু স্থান বেছে নিয়েছিলাম। সেখানে বসেই দূরে উত্তর দিকে ছােটো ছােটো দলে বিভক্ত পাকিস্তানী সেনাদের তখনও আশুগঞ্জের দিকে সরে পড়তে দেখলাম। এরা সবাই তেলিয়াপাড়া বা ইটাখােলার পাকিস্তানী স্থাপনার দলছুট সদস্য। দেশীয় গাইডের সাহায্য ছাড়া এ সময় এমন কৌশলী পলায়ন তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। মর্টারের কিছু গােলা তখনও অবশিষ্ট ছিলাে। তা থেকে বেশ কিছু গােলা সেদিকে ছােড়া। হলাে। নুরুল ইসলামও তার মেশিনগান থেকে মাঝেমধ্যে গুলিবর্ষণ করছিলাে। এতে খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হলাে না। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে অবশ্য তাদেরকে বাধা দেয়া যেতাে। কিন্তু যে কোনাে সময় আশুগঞ্জ বা অন্য কোনাে শত্রু অবস্থানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ এসে গেলে সে ক্ষেত্রে অনিধারিত এই সঞ্চালন সমস্যার সৃষ্টি করতাে। তখনাে কোনাে নির্দেশ আসেনি পরবর্তী কার্যক্রমের। শীতের বিকেল। সূর্য অনেকেটা পশ্চিমে সরে গেছে। এতােক্ষণে অনুভব করলাম যে আমাদের অবস্থান নেয়া এই উচু জায়গাটি একটি কবরস্থান। পার যাতে ভেঙে না যায় সে জন্যে কবরস্থানের কিনারায় কলাগাছ লাগানাে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমার দিকে এগিয়ে আসছে ১৫ কি ১৬ বছরের একটি ছেলে। তার পরনে হাফ প্যান্ট হাফ শার্ট। খালি পা। কাধে ঝােলানাে একটি ৩০৩ রাইফেল। রাইফেলা তার থেকে লম্বায় কিছুটা বড়ােই হবে। কাছে আসার পর বুঝলাম ছেলেটি আমার কোম্পানীর কেউ নয়। বেসামরিক কোনাে মুক্তিযােদ্ধা।

খুব বিনয়ের সাথে সে মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডারের সাথে দেখা করতে চাইলাে। আমি তাকে বাধা দেয়ার আগেই আমি ইঙ্গিতে ছেলেটিকে কাছে আসতে বললাম। তাকে কিছুটা পাথর মনে হলাে। সে জানালাে যে তার এক সহযােদ্ধা মারাত্মকভাবে আহত হয়ে মহাসড়কের পাশে  পড়ে আছে। অবিলম্বে তার চিকিৎসার প্রয়ােজন। সে খুব অনুনয় করে আমাদের ডাক্তারের সাহায্য চাইলাে। আমাদের সাথের ডাক্তার আলী আহমেদ সে সময় বেশ খানিকটা পেছনে অবস্থান করছে। এবং আমার সাথে তার যােগাযােগের তেমন কোনাে ব্যবস্থাও নেই। আহত বা অসুস্থ সৈনিকদের প্রয়ােজনীয় চিকিৎসার জন্যে পেছনেই পাঠিয়ে দিতে হয়েছে এ কদিন।। লেফটেন্যান্ট মঈন আহত হওয়ার পর তার পরিবর্তে এসেছে ডাক্তার আলী আহমেদ। সে সেনাবাহিনীর কোনাে ডাক্তার না। তবে আমাদের সাথে আছে যুদ্ধের শুরু থেকে। ডাক্তার আহমেদ খুবই বন্ধুবৎসল। কিন্তু রণাঙ্গন তার খুব অপছন্দ। তাই তিনি যুদ্ধ এলাকার বাইরে থাকতেই সাচ্ছন্দ বােধ করতেন বরাবর। আর সে জন্যে তাকে যদি দিনরাত ধরে কাজ করতে হতাে তাতেও কোনাে আপত্তি ছিলাে না। মুক্তিযুদ্ধের দু’টো ঘটনা ডাক্তার আলী আহমেদের মনে দারুণভাবে দাগ কাটে। প্রথমটি ছিলাে জুন মাসের শেষের ঘটনা। পাকবাহিনীর কামানগুলাে সেদিন ৩ নম্বর সেক্টরের সদর দফতর এলাকায় গােলাবর্ষণ করছিলাে বিক্ষিপ্তভাবে। সহসা তারই একটি নিক্ষিপ্ত গােলা এসে পড়ে দফতরের কাছে দাড়িয়ে থাকা গাড়িগুলাের ওপর। অকুস্থলেই চার জন মারা যায়। আর এ সময়টাতে ডাঃ আহমেদ মাত্র ৫০ গজ দূরত্বে অবস্থান করছিলেন। এই ঘটনাটি তাকে খুবই বিচলিত করে। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে তারই কিছুদিন পর একই এলাকায়। মুক্তিবাহিনীর সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২৫ থেকে ৩০ জনের একটি দলকে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশের জন্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলাে ট্রাক্টরে চাপিয়ে। পাকিস্তানী চরদের পুতে রাখা একট মাইনের বিস্ফোরণে ট্রাক্টরটি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় এবং তাতে সবাই নিহত হয়। এই শেষের ঘটনাটির পর ডাঃ আহমেদ আরও বিচলিত হয়ে পড়ে এবং এরপর থেকে গাড়িতে চড়াও বন্ধ করে দেয়। প্রায়ই দেখা যেতাে ডাক্তার আলী রাস্তা ছেড়ে জঙ্গল ভেঙে পায়ে হেঁটে চলেছেন গন্তব্যে। কিন্তু তারপরেও এই নরম মনের মানুষটি কেবলি মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্নিহীত সত্যের সাথে একাত্বতাবােধের কারণেই সদা নিয়ােজিত থেকেছেন আহত মুক্তিযােদ্ধাদের সেবায়। ছেলেটি তবুও ঠায় দাড়িয়ে রইলাে। মুখে তার স্পষ্ট অস্থিরতার ছাপ। লক্ষ্য করলাম তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে।

হাত জোর করে সে বললাে, স্যার, একটু সাহায্য করুন। দেরী করলে ও হয়তাে বাচবে না। একজন ডাক্তার আমার সাথে দিন। তার বলায় এমন একটি ভাব। প্রকাশ পেলো যেনাে আমি ইচ্ছে করেই তাকে সাহায্য করছি না। আমি বললাম, আমাদের ডাক্তার এখান থেকে অন্ততঃ মাইল খানেক পেছনে আছে। তােমরা বরং ওকে পেছনে নিয়ে যাও। আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি। কোনাে অসুবিধাই হবে না। যুদ্ধের বাস্তবতা এমন যে তখন অবস্থান ছেড়ে আমার কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। অথচ সামনে দাড়িয়ে সহযােদ্ধার গুলিবিদ্ধ হওয়ার সংবাদ দিচ্ছে একজন মুক্তিযােদ্ধা। দায়িত্ববােধ আর মানবিকতার আহবান—এই দুয়ের দ্বন্দ্বে অবশেষে উঠে দাড়ালাম। বললাম, চলাে। ভাবলাম যদি সম্ভব হয় তবে দুজন সৈনিক দিয়ে আহত মুক্তিযােদ্ধা ছেলেটিকে পেছনে। পাঠিয়ে দেবাে। সরাইলের ত্রিমােহনী সংলগ্ন সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের এক পাশে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে আহত মুক্তিযােদ্ধার রক্তাপুত দেহটি মাটিতে পড়েছিলাে। তার পাশে বসে আছে। আরও দুজন তরুণ মুক্তিযােদ্ধা। আমি আহত মুক্তিযােদ্ধা ছেলেটির কাছে গিয়ে বসলাম। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। রক্তে মাটি ভিজে চপ্ চপ করছে।

এতাে রক্তক্ষরণের পর সাধারণতঃ বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমই থাকে। তার শরীরে পাশাপাশি দুটো গুলি প্রবেশ করেছে। একটি ডান দিকের ফুসফুস ভেদ করেছে এবং অপরটি তারই প্রায় এক ইঞ্চি নিচে। চোখ দুটি হলুদ হয়ে এসেছে। চোখের পাতা বুজে আসছিলাে। বারবার। বােঝা যাচ্ছিলাে জোর করেই চোখ খুলতে চেষ্টা করছে সে। চোখের দৃষ্টিও ছিলাে লক্ষ্যহীন। নিবু নিবু রক্তস্পন্দন কষ্ট করে খুঁজে পেতে হলাে। বুঝতে আমার বাকি রইলাে না যে ছেলেটির শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে।

আহত এই মুক্তিযােদ্ধা ছেলেটিও বয়সে তরুণ। অবয়বে কৈশােরের ছাপ এখনও স্পষ্ট। পরনে হালকা সবুজ রংয়ের প্যান্ট আর গায়ে হাফ হাতার শার্ট। শার্টের রং বােঝার উপায় ছিলাে না। রক্তে ভিজে তা লাল হয়ে গিয়েছিলাে। সে তার বাঁ হাতটি আলতােভাবে উঠানাের চেষ্টা করছিলাে। তার হাতে হাত রাখতেই আমার হাত চেপে ধরলাে। ফিস ফিস করে কি যেনাে বলার চেষ্টা করলাে বার বার। গলার শব্দ ভেঙ্গে এসেছিলাে এরই মধ্যে। নাকমুখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। বুব অস্পষ্টভাবে জানতে চাইলাে, সে কোথায় আছে। আমি তাকে বললাম, বাংলাদেশের ভেতরে সরাইলে আছে সে। তারপর কিছুক্ষণ লক্ষ্যহীনভাবে তাকিয়ে থাকলাে। খুবই অস্পষ্ট করে আবার বললাে, আমি বাঁচবাে তাে? এ কথা শােনার পর তার সাথের সহযােদ্ধা বন্ধুরা ডুকরে কেঁদে উঠলাে এক সাথে। এরপর হঠাৎ করেই ছেলেটি অস্থির হয়ে উঠলাে। মুখে কষ্টের রেখা ফুটে উঠেছে। ক্ষীণকণ্ঠে বললাে, আমার খারাপ লাগছে। এটাই ছিলাে তার শেষ কথা। তারপর অস্থিরতার মাত্রা বেড়ে উঠলাে এবং একটু বাকা হয়ে দুহাত দিয়ে সে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরলাে। এই বাঁধন এরপর ক্রমে শিথিল হয়ে আসতে লাগলাে এবং কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই তার রক্তাক্ত দেহটি আমার কোলে নিথর হয়ে পড়লাে। পরিচয়হীন আরও দুটি লাশের সাথে মুক্তিযােদ্ধা ছেলেটিকে সমাহিত করা হলাে। সৈনিকরা স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হয়ে এই সমাহন পর্ব শেষ করলাে। পত্রবাহক কর্নেল সফিউল্লাহর নির্দেশ নিয়ে ইতিমধ্যেই এসে গেছে। আমাকে অবিলম্বে সরাইল থেকে কোম্পানী তুলে নিয়ে আশুগঞ্জের নিকটবর্তী দুর্গাপুর গ্রামে সন্ধ্যার আগেই অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।  কালবিলম্ব না করে দুজন গাইডের সহায়তায় আমরা দুর্গাপুরের দিকে অগ্রসর হলাম। এখন বা দিকে আমাদের সংগী ভারতের ১৮ রাজপুত ব্যাটালিয়ন। আর ডান দিকে মেজর ভূইয়ার ‘বি’ কোম্পানী। সন্ধ্যা হতে খুব একটা বাকি নেই। পূর্ণ সতর্কাবস্থার মধ্যদিয়ে সরাইল থেকে আশুগঞ্জের পথে দুর্গাপুর গ্রামের কাছাকাছি পেীছলাম সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে। দুর্গাপুর তখনাে মাইল খানেক দূরে। সন্ধ্যা হওয়ার আগ অবধি ডানে মেজর ইয়ার ‘বি’ কোম্পানী এবং বায়ে ১৮ রাজপুতের সাথে যৌথভাবেই অগ্রসর হয়েছি। কিন্তু সন্ধ্যার কিছু পরই মেজর ভূঁইয়ার সাথে সংযােগ। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর কিছু পর ১৮ রাজপুতের সাথেও সংযােগ হারিয়ে ফেলি। এই অবস্থায় দুর্গাপুরের পথে আর অগ্রসর হওয়াটা নিরাপত্তার দিক থেকে সঠিক মনে না হওয়াতে দুর্গাপুরকে সামনে রেখে একটি আপাতঃ অবস্থান নিয়ে ফেললাম। আশুগঞ্জের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হওয়ার আগে এলাকায় শক্র বাহিনী সম্পর্কিত কোনাে তথ্যই আমাদেরকে দেয়া হয়নি। একটি ব্যাপক যুদ্ধে এ ধরনের একটি অভিযান শত্রু সম্পর্কিত তথ্যাদি ছাড়া পরিচালনা করা যুক্তিসঙ্গত বলে আমার মনে হয়নি। সত্যি বলতে কি, রাতের  অন্ধকারে শত্রুর কোম্পানী আকারের একটি অতর্কিত আক্রমণ বা এমবুশ আমাদের এ দুটি পদাতিক ব্যাটালিয়নকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে যথেষ্ট ছিলাে।

অগ্রসরমান ভারতীয় বাহিনীর মেজর টেটা সিংকে শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে প্রশ্ন করেও [কোনাে সদুত্তর পাইনি। তিনি নিজেও সে সম্বন্ধে তেমন অবগত ছিলেন না। অবশ্য মেজর টেটা সিংয়ের মতাে একজন মানুষের এ সব জানারও কথা নয়। তিনি দুটি জিনিসই ভালাে | জানতেন, তার বাইরে কিছু না। এর একটি হচ্ছে নির্দ্বিধায় নির্দেশ মেনে চলা, আর অন্যটি | বেঁচে থাকাটাকে অর্থবহ করে তােলা প্রতি মুহূর্তে। | টেটা সিং নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ১৮ রাজপুতের একটি কোম্পানী। ভারতীয় পাঞ্জাবের অধিবাসী তিরিশাের্ধ্ব এই মেজর টেটা সিং খুবই কৌতুকপ্রিয় মানুষ। তার সাথে আমার পরিচয় ঘটে | ধর্মগড়ে ২ ইস্ট বেঙ্গল ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ অভিযানের মধ্যদিয়ে। | সরাইল থেকে অগ্রসর হয়ে সন্ধ্যা অবধি বেশ কয়েকবার তার সাথে বাক্য বিনিময় হয়। | তবে ভারতীয় চিত্রাভিনেত্রীরাই তার কথােপকথনে বেশী প্রাধান্য পায়। জীবনের এই চরম সন্ধীক্ষণে মৃত্যুর মুখােমুখি দাড়িয়ে এ ধরনের রসিকতা একজন বীর সৈনিকের পক্ষেই সম্ভব | বলে আমার মনে হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর মাত্র ক’দিন আগে আগরতলাতে বােম্বের ছবি ‘রাম অর শ্যাম’ চলছিলাে। সেই ছবিতে কোন্ দৃশ্যে সয়রা বানু এবং ওয়াহিদা রহমানকে কেমন দেখাচ্ছিলাে সৈনিকদের সামনে অভিনয় করে তার বর্ণনা দিতেও পিছ পা হননি মেজর সিং। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তিনি জানালেন যে গত তিন দিন ধরে ১৮ রাজপুতেরও সবাই অভুক্ত। আর সে জন্যে ভারতীয় সরবরাহ ব্যবস্থার প্রতি কটাক্ষ করতেও ছাড়লেন না টেটা সিং। তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে এ জন্যে খুব একটা বিচলিত ছিলেন না। তার কাছে তখনাে বেশ কয়েক বােতল রাম অবশিষ্ট ছিলাে। টেটা সিং একটি রামের ভরা বােতল বের করে আমাকে খেতে পিড়াপিড়ি শুরু করলেন। বৃত্তের আকারে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যেদিক থেকেই আক্রমণ আসুক না কেনাে তা প্রতিহত করা যাবে। অবস্থান গ্রহণের পর চেষ্টা করেও ভূইয়া বা ১৮ রাজপুতের সাথে যােগাযােগ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলাে না। সেইম সাইড হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় যােগাযােগের চেষ্টা থেকেও এরপর বিরত থাকলাম। সেনাবাহিনীতে শান্তিকালীন সময়ে যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল শেখানাে এবং তার অনুশীলন একটি গতানুগতিক রেওয়াজ। উপরন্তু এই অনুশীলনের কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্যে ব্যাপক আকারের যুদ্ধমহড়ারও আয়ােজন হয়ে থাকে। আবার অনুশীলন কর্মসূচীর অধিকাংশই তেরী করা হয় সংঘঠিত বিভিন্ন যুদ্ধ কিংবা রণাঙ্গনের বাস্তব অবস্থার ওপর ভিত্তি করে। এইসব সত্ত্বেও যুদ্ধক্ষেত্রে সামান্যতেই এমন সব বিরূপ ঘটনা ঘটে যায় যার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি আয়ত্বের মধ্যে নিয়ে আসা একেবারে অসম্ভব বলে মনে হয়। আমাদের এই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ঘটনা এ ধরনেরই একটি পরিস্থিতি। যৌথভাবে অগ্রসর হয়েও সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হওয়ার ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে আমরা একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। যার ফলে দুর্গাপুর না পেীছেই তাৎক্ষণিকভাবে অবস্থান গ্রহণ করতে হয়েছে আমাদেরকে। অর্থাৎ পরিকল্পনায় আমূল পরিবর্তন ঘটে যায় আপনা আপনিই। | যােগাযােগ হারিয়ে ১৮ রাজপুতকেও দুর্গাপুর সামনে রেখে অবস্থান নিতে হয় সে রাতে। মেজর ‘ইয়া উত্তরে সরে গিয়ে পানিশ্বর গ্রামে অবস্থান নেয়। ১১ ইস্ট বেঙ্গলের অপর দুটি কোম্পানীর অবস্থান সম্পর্কে আমার কোনাে ধারণাই ছিলাে না বা তাদের সম্পর্কে আমাকে। কিছু জানানােও হয়নি।

আমাদের নেয়া অবস্থানের উত্তরে মেঘনার পার ঘেষে পানিশ্বর গ্রাম। বাঁ দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া খুব একটা দূরে নয়। পুরাে এলাকাটিকেই চরাঞ্চল বলে মনে হলাে। খুব একটা গাছ-গাছালি সম্ভবঃ এ কারণেই সেখানে নেই। তবে সমস্ত এলাকাটাই সমতল। | রাতে আমিন একফালি কাচা কুমড়াে এনে আমার হাতে দিলাে। চারদিনে এই প্রথম খাওয়ার জন্য কিছু পাওয়া গেলাে। রণাঙ্গন মােটামুটি শান্ত। মাঝেমধ্যে ক্ষণস্থায়ী হালকা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিলে৷ তালশহরের দিক থেকে। মধ্যরাতের দিকে আমার কোম্পানী অবস্থানের কিছুটা বায়ে আনুমানিক ৫শ’ গজ দূরে সংঘর্ষের সূত্রপাত হলাে। আমরা শত্রুর পাল্টা আক্রমণের আশংকায় সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রইলাম। এলােপাতাড়ি গুলিবর্ষণ থেকে বিরত থাকা এবং শক্র কমপক্ষে ৫০ গজের মধ্যে না আসা পর্যন্ত গুলি না করার নির্দেশ দেওয়া হলাে প্রত্যেককে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সংঘর্ষের ব্রিতা কমে আসে। পরদিন অবশ্য জেনেছি যে ১০ বিহারের একটি কোম্পানী ভুলবশতঃ ১৮ রাজপুতের পার্শ্বদেশে প্রবেশকালে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। অথাৎ “সেইম সাইড। এরপর থেকেই শুরু হয় পাকিস্তানীদের ভৈরব অবস্থান থেকে কামানের গােলাবর্ষণ। শত্রুবাহিনী ততােক্ষণে নির্ণয় করে ফেলেছে আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থান। মধ্যরাত অতিক্রান্ত হয়েছে কিছুক্ষণ হলাে। পাকিস্তানীদের বিক্ষিপ্ত গােলাবর্ষণ ছাড়া যুদ্ধের তেমন কোনাে উপদ্রব নেই। সাদা কুয়াশা ভেদ করে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের আলাের অনুপ্রবেশ ঘটেছে দুর্গাপুরে। খােলা আকাশের নিচে কনকনে শীতের মধ্যেও কেনাে যেনাে হঠাৎ সবকিছু ভালাে লাগলাে। | কামান যুদ্ধের ফাকে ফাকে রাতের নিসর্গে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। তখন পাতায় শিশির ঝরার শব্দও শুনতে পাওয়া যায়। বাংলার এটুকুই যেনাে এ মুহুর্তে আমার পরিচিত। মধ্যরাতের ভূতুম প্যাচার ডাক নেই এখন এখানে। শেয়ালও ডাকছে না। বহুদূর থেকে কোনাে মন্দিরের ঢােলের শব্দও ভেসে আসে না। বাতাসে শুধুই বারুদের ঘ্রাণ। মাঝেমধ্যে কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে পচা লাশের উৎকট গন্ধও ভেসে আসে।  আমি আর আমিন বের হলাম শেষবারের মতাে অবস্থান পরিদর্শনে। খানিকটা এগােতেই কাছের একটি ট্রেঞ্চে চাঁনমিয়ার উপস্থিতি টের পেলাম। সে চাপা গলায় গান গাইছে। গানগুলাে পরিচিতই। চানমিয়ার গলায় সে গান আগেও বহুবার শুনেছি। তবে আজ খুব দরদ দিয়ে গাইছে সে। ভালাে লাগছে সে কারণেই। আমি তার কাছে গিয়ে দাড়ালাম।

চানমিয়া আমার উপস্থিতি টের পেলাে। গান বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালাে। আমার একটি হাত সস্নেহে তার কাধের ওপর রাখলাম। বল্লাম, চানমিয়া আর একটা গান শােনাও। ট্রেঞ্চের ভেতর থেকে সে কিছু খড়কুটো তুলে বিছিয়ে দিলাে ট্রেঞ্চের বাইরে, মাটিতে। বসেন স্যার, আমার একটা প্রিয় গান আপনাকে শােনাই। সময় ক্ষেপণ না করে চাঁনমিয়া গান ধরলাে। কি হবে সঁই আমার গতি কি হবে সঁই আমার গতি কতাে বেড়াই, কতাে শুনি, ঠিক দাড়ায়না কোন গতি। গানটি শেষ হতেই আবারও একটি গান ধরলাে চাঁনমিয়া। আমি তখনাে তার নিঃশব্দ শ্রোতা।  সুখের আশায় প্রেম করিলাম সুখের লাগি প্রেম করিলাম সুখ হইলাে না এক রতি ভােলা যায় না তাের প্রেমের স্মৃতি, নিঠুর বন্ধু কঠিন তাের হিয়া আমারে করিলি পাগল পিরিতি শিখাইয়া।  গান শেষ হলাে। আমি যেনাে কোথায় অন্ধকারে কি খুঁজে ফিরছি। চাঁনমিয়া হয়তাে খুঁজছে তার জীবনের অর্থ। আর আমি! আমি কি খুঁজছি? কৈশাের-রংপুর-যুদ্ধ কলকলিয়াফটিকছড়া-বিটুলের বুবু, আরও, আরও কি কি সব খুঁজে হয়রান হয়ে যাচ্ছি দুর্গাপুরে মধ্যরাতের সাদা কুয়াশা আপুত জোছনায়। ৯ ডিসেম্বর ভােরে আমার কোম্পানী অবস্থানকে জোরদার করা হলাে। ইতিমধ্যে ১৮ রাজপুতেরও সন্ধান পাওয়া গেলাে। বিচ্ছিন্ন হলেও রাতে তারা আমাদের কাছাকাছিই ছিলাে। ভাের ৭ টার দিকে দুর্গাপুরকে ডান দিকে রেখে তারা সামনে এগিয়ে যায়। ‘বি’ কোম্পানীর সাথে তখনাে পর্যন্ত যােগাযােগ স্থাপন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এদিকে পাকিস্তানী গােলন্দাজ বাহিনীর গােলাবর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। তবে সেই গােলা নিক্ষেপ অনেকটাই বিক্ষিপ্ত, এলােমেলাে। যেহেতু ১৮ রাজপুত দুর্গাপুরকে ডান দিকে রেখে অগ্রসর হয়েছে সেহেতু আমি সরাসরি দুর্গাপুরে প্রবেশের জন্যে অগ্রসর হলাম। ঠিক এ সময় আটটি ভারতীয় পিটি ৭৬ ট্যাংক দেখতে পেলাম। আমাদের অগ্রসরমান অবস্থান থেকে প্রায় ৫শ’ গজ দূরে একটি বড়াে বাঁশঝাড়ের আড়ালে দাড়িয়ে ছিলাে সেগুলাে। হঠাৎ করেই একটি ট্যাংক ঘুরে আমাদেরকে লক্ষ্য করে তার কামান থেকে গােলাবর্ষণ শুরু করলাে। আকস্মিক এই ঘটনায় আমি কিছুটা হকচকিয়ে যাই। আমার সৈনিকরা ততােক্ষণে অবস্থান নিয়ে ফেলেছে এবং চাঁনমিয়া তার এলএমজি থেকে এরই মধ্যে দুবার গুলিবর্ষণও করেছে সেদিকে। তার ধারণা সেগুলাে পাকিস্তানীদের ট্যাংক। বাকি সবাই আমার নির্দেশের অপেক্ষা করছিলাে।

আমি চীৎকার করে চানমিয়াকে গুলিবর্ষণ বন্ধ করতে বললাম। ওদিকে তখন আরও দুটি ভারতীয় ট্যাংক মেশিনগানের সাহায্যে আমাদের দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করেছে। আমার বুঝতে বাকি রইলাে না যে ভারতীয় বাহিনী খাকি পােশাক দেখে আমাদেরকে পাকিস্তানী হিসেবে ধরে নিয়েছে। পােশাকে আমার কোম্পানীতে সেদিন আমিই ছিলাম একমাত্র ব্যতিক্রম। আমার পরনে ছিলাে সবুজ লুঙ্গি আর সবুজ হাফ হাতা শার্ট। এ অবস্থায় আমি দু’হাতে আমার এসএমজি মাথার ওপর তুলে গােলাবর্ষণকারী ভারতীয় ট্যাংকের দিকে অগ্রসর হলাম। আমাকে এগিয়ে আসতে দেখে ভারতীয়রা গােলাগুলি বন্ধ করলাে। তবুও আমি চীৎকার করে তাদেরকে গােলাগুলিবর্ষণ। বন্ধ করতে বললাম। কাছে আসতেই গােলাবর্ষণকারী ট্যাংকের ওপর দণ্ডায়মান এক তরুণ। মেজর আমাদের পরিচয় জানতে চাইলাে। সামান্য চেঁচিয়ে সে বললাে, তােমশা কারা ?  

থাকে, যা তাদের জন্য বয়ে আনে এক দুঃখজনক পরিণতি। পাকিস্তানী বাহিনী পূর্ব রণাঙ্গনে শুধুমাত্র এই আশুগঞ্জের যুদ্ধেই তাদের রণনৈপুণ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হলাে। এটাই ছিলাে সম্ভবতঃ পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তানীদের একমাত্র সামরিক সাফল্য। তাদের দু’টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা দেয়াল বরাবর অবস্থান নিয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলাে। ভারতীয় মূল বাহিনী এই নিরাপত্তা দেয়ালের ৫০ গজের মধ্যে পেীছার সাথে সাথেই পাকিস্তানীরা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে ভারতীয়দের উপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণের পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত এখানে পাকিস্তানীদের অস্ত্র সংবরন ছিলাে প্রশংসাযােগ্য। | অন্যদিকে মিত্রবাহিনীর জন্যে এ আক্রমণ ছিলাে অনভিপ্রেত। তারা এ ধরণের আকস্মিক ঘটনার জন্যে একেবারেই প্রস্তুত ছিলাে না। তাদের অনুমান ছিলাে আশুগঞ্জ শত্রুমুক্ত। আক্রমণের প্রচণ্ডতায় ১৮ রাজপুত ও ১০ বিহার এবং তাদের সাথের ট্যাংক স্কোয়াড্রনটি সম্পূর্ণ বেসামাল হয়ে পড়ে। নিমিষে ট্যাংক বিধ্বংসী গােলার আঘাতে তিনটি ট্যাংক বিধ্বস্ত হয় আমার অগ্রসরমাণ কোম্পানী অবস্থানের ৫শ’ গজের মধ্যে ভারতীয়দের আনুমানিক ৭০ জন নিহত হলাে মাত্র এক থেকে দুই মিনিটের ব্যবধানে। আহত হলাে অসংখ্য। এলাকাটি বিরান সমতলভূমি হওয়ার কারণে ভারতীয়দের হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যায় বহুগুণ। তবুও ১৮ রাজপুত ও ১০ বিহার সাহসিকতার সাথে লড়ে যায়। অক্ষত পাঁচটি ট্যাংক এ পর্যায়ে সুনিপুণভাবে তাদের পদাতিক বাহিনীর পশ্চাদপসরণের জন্য নিজেদের নিরাপত্তা বিপন্ন করেও পাকিস্তানীদের প্রতি পাল্টা আক্রমণ অব্যাহত রাখে। ভারতীয়রা তাদের নিহত বা আহত সদস্যদের ফেলে পশ্চাদপসরণে মােটেও আগ্রহী ছিলাে  আমার অবস্থানের সামনেই একজন আহত সৈনিককে তুলে আনতে গিয়ে অপর দুজন সদস্য নিহত হলাে এবং তৃতীয় জন আহত হয়ে পূর্বের আহত সৈনিকদের পার্শ্বেই লুটিয়ে পড়ে থাকে। 

পাকিস্তানীরা নিজেদের সাময়িক সাফল্যে মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহী হয়ে উঠে এবং কালবিলম্ব করে তাদের অবস্থান থেকে উঠে পাল্টা আক্রমণ চালায়। এ সময় আর সামনে অগ্রসর না হয়ে আমি দুর্গাপুর গ্রামে ফিরে এসে ত্বরিৎ অবস্থান নিয়ে ফেললাম। এই গ্রামের শেষ প্রান্ত এবং আশুগঞ্জের মধ্যে কোনাে লােকালয় নেই। সুতরাং খানিকটা পেছনে গ্রামের দিকে ফিরে এসে অবস্থান নেয়া ছাড়া আমার অন্য কোনাে বিকল্প ছিলাে না। এরই মধ্যে ১০ বিহারের সৈনিকরা পাকিস্তানীদের তাড়া খেয়ে এলােমেলােভাবে আমাদের অবস্থানের চারপাশ ফিরে এসেছে। অনেকে আবার সরে যাচ্ছে পেছনের দিকে। আমি তাড়া খাওয়া কজনকে জোর করে ধরে আমার পাশে বসালাম। এ অবস্থায় হুদাকে কোম্পানীর ডান দিক নিয়ন্ত্রনের জন্যে সেখানে পাঠালাম। আমি থেকে গেলাম কোম্পানী অবস্থানের ঠিক মাঝখানটিতে। সবকিছুই যেনাে এই মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণহীন। কতৃত্ব খসে যেতে চায় বার বার। নিয়ন্ত্রণ অটুট থাকা আর ভেঙ্গে যাওয়ার মধ্যে দূরত্ব সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসে অবস্থান করছে। পরিস্থিতির মােড় নেয়ার বিষয়টি এখন সম্পূর্ণভাবে আমার ওপর নির্ভরশীল। দিব্যি দেখতে পেলাম দীর্ঘ লাইন ধরে সামনে ছুটে আসছে পাকিস্তানী সৈনিকদের হাজার দুয়েকের একটি দল। মুখে ‘ইয়া আলী, ইয়া আলী চিৎকার। দেখতে দেখতে মাত্র দুশ গজের মধ্যে এসে পড়লাে তাদের দলের একাংশ। আর বিলম্ব নয়। নির্দেশ প্রাপ্তির সাথে সাথেই নূরুল ইসলামের ভারী মেশিনগান গর্জে উঠলাে। সেই সাথে পুরাে কোম্পানীর সৈন্যরা তাদের হাতের অস্ত্র সক্রিয় করে তুললাে।

পাকিস্তানীদের ব্যাপক গােলাবর্ষণের মধ্যে জনমানবহীন দুর্গাপুরে বিকেলের আগেই অবস্থান নিতে হলাে আমাকে। পাকিস্তানী গােলন্দাজরা তখনো বিরামহীন গােলাবর্ষণ করে চলেছে। দুর্গাপুরে। সমস্ত রণাঙ্গন জুড়ে লাশ পড়েছিলাে পাকারে। অনেক আহত ভারতীয় সৈনিক তখনাে পড়ে আছে। আমরা বেশ কয়েক জনকে আমাদের অবস্থানে নিয়ে এলাম। অনেক ভারতীয়র হাত এবং মাথা কেটে নিয়ে গেছে পাকিস্তানীরা। বর্বরতার সে এক বিভৎস রূপ! সাময়িক বিপর্যয় ঘটে গেছে মিত্রবাহিনীর।  এতােক্ষণে ভারতীয় বিমান বহরের আগমন ঘটলাে। ঝাকে ঝাকে বিমান আশুগঞ্জ ও ভৈরবের পাকিস্তানী অবস্থানে বােমাবর্ষণ শুরু করেছে। ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনীও সক্রিয়। সন্ধ্যার আগে ভারতীয় বিমানগুলাে দফায় দফায় এসে আক্রমণ চালিয়ে গেলাে আশুগঞ্জ ভৈরবের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে। ভৈরবে তারা বেশ কয়েকবার নাপাম বােমা নিক্ষেপ করলাে। প্রচণ্ড শব্দে সেগুলাে বিস্ফোরিত হলাে। তার লেলিহান অগ্নিশিখা দুর্গাপুর থেকেও দৃষ্টিগােচর হলাে। আশুগঞ্জের সাফল্যের খেসারত পাকিস্তানীদের দিতে হলাে সেদিন সূর্যাস্তের আগেই। | ১০ ডিসেম্বর ভােরে ১০ বিহার ও ১৮ রাজপুত দুর্গাপুরে প্রবেশ করে আমাদের সাথেই অবস্থান নিলাে। গলিত মৃতদেহের গন্ধে সমস্ত এলাকা এক নারকীয় রূপ ধারণ করেছে। আমরা ছাড়া মানুষজনের চিহ্ন নেই কোথাও। গােটা এলাকা লণ্ডভণ্ড। বেলা আনুমানিক ৯টার দিকে ১৮ রাজপুত অধিনায়ক কর্নেল ভর্মার জরুরী তলব পেয়ে তার অবস্থানে যেতে হলাে আমাকে। কিন্তু দেখা পেলাম না। কি কারণে তলব করা হয়েছে তা আর জানা গেলাে না। সেখানে এক জায়গায় অনেকগুলাে লাশ কম্বল দিয়ে ঢাকা অবস্থায় মাটিতে পড়েছিলাে। আহত অনেক সৈনিকও দেখলাম। ভারতীয় হেলিকপ্টার এসে এদের সবাইকে নিয়ে যাবে ভারতের মাটিতে। সেখানে মৃতদের সৎকার হবে আর আহতদের পাঠানাে হবে সামরিক হাসপাতালগুলােতে। 

এমন সময় কে যেনাে আমাকে ডাকলাে মুক্তি সাব’ বলে। ভারতীয় সৈনিকরা মুক্তিবাহিনীর কর্মকর্তাদের এভাবেই সম্বােধন করতাে। আমি ফিরে তাকালাম। ব্যাণ্ডেজ বাধা আহত একজন ভারতীয় সৈনিক আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। হাতে রামের বােতল। সে বললাে সে আমাকে চেনে। ধর্মগড়ের দ্বিতীয় যুদ্ধে সে আমাদের কোম্পানী এলাকায় ছিলাে। তারপর আহত সেই ভারতীয় সৈনিক আমাকে যা বললাে তা শুনে আমার সমস্ত সত্তা ব্যথায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলাে মুহূর্তেই। সে জানালাে যে গতকালের আশুগঞ্জের যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর যে চারজন অফিসার নিহত হয়েছে মেজর টেটা সিং ও মেজর টি এল শর্মা ওই চারজনের দুজন। কথা ক’টি শেষ করে সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাে মাটিতে শােয়ানাে লাশগুলাের দিকে। | এই তাে মাত্র সেদিনই দেখা হলাে টেটা সিংয়ের সাথে। মাত্র দু’দিনের ব্যবধান। সরাইলের পর একত্রে রণাঙ্গন পাড়ি দিয়েছি দুর্গাপুরের পথে। সরাইল থেকে দুর্গাপুর—এই নাতিদীর্ঘ পথের যাত্রাটুকু সে প্রাণবন্ত করে রেখেছিলাে হাসি-তামাসা দিয়ে। বলা কওয়া ছাড়াই এরপর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম মাঝপথে। ভাবিনি তখন আর কখনাে দেখা হবে না। ওড়িষ্যার মেজর টি এল শর্মার সাথে ধর্মগড়ের দ্বিতীয় যুদ্ধে আমার পরিচয় হয়েছিলাে। রণাঙ্গনে যাবার আগে সেদিন পুরােটা সময়ই তিনি আমাদের কলকলিয়া শিবিরের সেই ‘নষ্ফল আম গাছটির নিচে গীতা পড়ে করে কাটান। | ভারতীয়দের লাশগুলাে আজ সকালেই উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল পাকিস্তানীদের আক্রমণের মুখে রণাঙ্গনে পড়ে থাকা অনেক লাশই তুলে আনা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। | আমি জড়াে করা লাশগুলাের কাছে এসে দাড়ালাম। ইতঃস্তত করছিলাম কোন কম্বলটি তুলবাে। ভারতীয় সেই সৈনিকটি নিজেই উঠে এসে দুটি লাশের ওপর থেকে কম্বল সরালাে। স্পন্দনহীন দুটি দেহ। বাংলাদেশের জনগণের দুই অকৃত্রিম বন্ধু ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে। বাংলাদেশ রণাঙ্গনে যুদ্ধের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটার প্রেক্ষাপটে ভারতীয় বাহিনী বাস্তব অবস্থার নিরিখে তাদের রণকৌশলে ইতিমধ্যে কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। অর্থাৎ যুদ্ধ শুরু হবার প্রথম দিকে শক্রর প্রতিটি অবস্থানের ওপর সরাসরি আঘাত হানার যে রণনীতি তারা গ্রহণ করেছিলাে তা এখন রূপান্তরিত হয়েছে শত্রুর অবস্থান পাশ কাটিয়ে মূল লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাবার কৌশলে। এই পরিবর্তীত কৌশলের আওতায় ভারতীয় বাহিনী গুরুত্ববহ নয়, এমন সব পাকিস্তানী ঘাঁটিসমূহ পাশে ফেলে মূল লক্ষ্যস্থলসমূহের দিকে তীব্র গতিতে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। এর পাশাপাশি চলতে থাকে পাকিস্তান বাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানগুলােকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় ইতিমধ্যেই পাকিস্তানীরা তাদের বেশ কয়েকটি সুরক্ষিত অবস্থানের সাথে সংযােগ হারিয়ে একাকী হয়ে পড়েছে। বাদবাকি অবস্থানগুলােও একই পরিণতির মুখে পড়েছে। 

ভারতীয় বাহিনীর ভারসাম্যসূচক শক্তিশালী আক্রমণ শলাকাগুলাের প্রধান লক্ষ্যস্থান এখন রাজধানী ঢাকা এবং অন্যান্য দুর্গশহর। এই লক্ষ্যগুলাের দিকে তারা এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। অন্যদিকে ভারতীয় বাহিনীর বাদবাকি অংশ নিয়ােজিত রয়েছে পাকিস্তানীদের যার যার অবস্থানে বিচ্ছিন্ন করে তাদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখার প্রক্রিয়ায়। এই ধারায় তাদের সামগ্রিক পরিকল্পনার সর্বশেষ লক্ষ্য পাকিস্তানীদের ঢাকার দিকে পশ্চাদপসরণের পথ রুদ্ধ করে দেয়া। ঢাকায় পাকিস্তানীদের পশ্চাদপসরণ ঝুকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে এই কারণে যে, তা রাজধানী ঢাকার পতনকে বিলম্বিত করতে পারে। রণকৌশলে এই উপযােগী পরিবর্তন সূচিত হওয়ায় অগ্রসরমান ভারতীয় বাহিনী দুদিক থেকে লাভবান হলাে। প্রথমতঃ মূল লক্ষে পৌছানাের প্রশ্নে সহায়ক নয়, শত্রুর এ ধরনের শক্ত অবস্থানের ওপর সরাসরি আক্রমণের পূর্ব ধারা পরিহার করার ফলে তাদের পক্ষে হতাহতের সংখ্যা উল্লেখযােগ্য হারে কমে যায়। দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তানীদেরকে বিচ্ছিন্নাবস্থায় অবরুদ্ধ করে ভারতীয় বাহিনীর অপর অংশ অত্যন্ত দ্রুততার সাথে এবং অনেকটা প্রতিরােধইন অবস্থার মধ্যদিয়ে ঢাকাসহ অন্যান্য দূৰ্গশহরগুলাের দিকে সহজেই ধাবিত হতে সক্ষম হয়। এই রণকৌশলের তৃতীয় একটি বাড়তি সুবিধা হলাে, পাকিস্তানীদের দুর্গশহরের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রবণতার কারণে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে আধিপত্ত বিস্তারের একটি অনুকূল প্রেক্ষাপটের সৃষ্টি হয়—যার ফলে এ সকল রণক্ষেত্রে ভারতীয়দের বিজয় সহজতর হয়ে পড়ে। অর্থাৎ প্রতিটি রণাঙ্গনেই ভারতীয়রা তাদের এই পরিবর্তীত যুদ্ধ কৌশলের তাৎক্ষণিক সুফল পেতে থাকে।

অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতার আতংকে সন্ত্রস্ত্র পাকিস্তানী বাহিনী বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সুরক্ষিত অবস্থান পরিত্যাগ করে সামান্য চাপেই পিছু হটে যায়। এভাবেই পরিবর্তীত এই যুদ্ধ কৌশলে পাকিস্তানের সামরিক পরাজয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার যে একটি পরিকল্পনা তাদের ছিলাে, তাও ব্যর্থ হয়ে যায় অচিরেই। সীমান্ত বেষ্টনী বরাবর বিস্তৃত পাকিস্তানীদের প্রতিরক্ষাব্যুহগুলাে ভেঙ্গে পড়ার পর পরই তাদের সৈন্যরা হতােদ্যম হয়ে পড়ে। কার্যতঃ তখন থেকেই শুরু হয় তাদের পশ্চাপসরণের পালা। বিনাযুদ্ধে পাকিস্তানের মতাে একটি শ্রেষ্ঠ (!) সেনাবাহিনীর সৈন্যদের এই লাগাতার পশ্চাদপসরণের খবরে আতংকিত হয়ে ওঠেন স্বয়ং জেনারেল নিয়াজী। শতকরা ৭৫ ভাগ সৈনিক হতাহত না হওয়া পর্যন্ত যে কোনাে ধরনের অননুমােদিত পশ্চাদপসরণের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করলেন তিনি। কিন্তু তারপরও পাকিস্তানী সৈন্যদের রণাঙ্গন ত্যাগ থেমে থাকলাে না।  আর বাংলাদেশের জন্যে প্রণীত ভারতীয় যুদ্ধ পরিকল্পনা এভাবেই নির্ভুল প্রমাণিত হলাে। একইভাবে তাদের পরিকল্পনা নির্ভুল হলাে ভারতীয় পশ্চিমাঞ্চলীয় রণাঙ্গনেও। অর্থাৎ এই যুদ্ধকে ভারত তার পরিকল্পনা অনুযায়ীই একটি নির্দিষ্ট সময় এবং পরিণতি পর্যন্ত পৌছে দিতে সক্ষম হলাে। বাংলাদেশ ইস্যু এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ভারত তার রাজনৈতিক প্রাধান্য শেষ পর্যন্ত অক্ষুন্ন রাখলাে। উপমহাদেশীয় রাজনীতির আকাশেও দেখা গেলাে এই বিতর্কের আন্তর্জাতিক পক্ষপাতের মেঘমালা দ্রুত কেটে যাচ্ছে ভারতীয় দিগন্ত থেকে এবং তা ঘনীভূত হচ্ছে পাকিস্তানের আকাশে। সেখানে ডিসেম্বরের গােড়াতেই চীনের রহসাবৃত মুখচ্ছবি মূর্ত হয়ে উঠলাে। এই মুখ দেখে এবার সুস্পষ্টতঃই বুঝা গেলাে যে চীন এতােদিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে পাকিস্তানের পক্ষে আশ্বাসের যে সাফাই গেয়ে শুনিয়েছে তা একান্তই বন্ধুত্বের নৈতিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কোনাে সামরিক সহায়তা দেয়ার বিষয় সেখানে পুরােপুরি অনুপস্থিত এবং এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও তার প্রত্যক্ষ কোনাে ভূমিকা থাকছে না। একই সাথে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বহুলাংশেই যৌক্তিক হয়ে উঠেছে। বিশ্বজনমত এখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেখতে পুরােপুরি প্রস্তুত।  বাংলাদেশ রণাঙ্গনের পূর্বাংশে পাকিস্তানী সেনা সমাবেশের বিচ্ছিন্নকরণ কাজ সমাপ্ত প্রায়। ভারতীয় ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন ও মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানের ১৪ পদাতিক ডিভিশনকে ইতিমধ্যেই দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেছে। এর একটি অংশ সিলেটে অবরুদ্ধ এবং অপর অংশ তাড়া খেয়ে আশুগঞ্জ-ভৈরববাজারে কেন্দ্রীভূত। সমান্তরালভাবে কিছুটা দক্ষিণে ৪ কোর রিজার্ভ বাহিনীর ৬১ মাউনটেন ব্রিগেড দাউদকান্দির নদীবন্দর দখল নিশ্চিত করা ছাড়াও ময়নামতি অবরােধের লক্ষ্যে এর উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে অবস্থান নিয়েছে। ফলে সেখানকার ১১৭ ব্রিগেড ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

ভারতীয় ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীন ৩০১ মাউন্টেন ব্রিগেড হাজিগঞ্জ হয়ে ৯ ডিসেম্বর ভােরেই চাদপুর পৌছে যায়। কুমিল্লারও পতন ঘটে সেদিন। আর এই বিজয়ের ফলে কার্যতঃ ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকা প্রবেশের তিনটি প্রবেশদ্বারের দুটিই যৌথবাহিনীর হস্তগত হয়ে পড়ে। তৃতীয়টি অর্থাৎ আশুগঞ্জ-ভৈরবের পতন এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। অনাকাঙ্খিত এবং সহজলব্ধ এই সামরিক সাফল্যে ভারতীয়রা বিস্মিত না হয়ে পারেনি। ৪ কোর কমাণ্ডার সাগত সিং এ পর্যায়ে তার পরিকল্পনায় আরও কিছু পরিবর্তন আনলেন। মেঘনার পূর্ব তীর মােটামুটিভাবে দখলে এসে যাওয়ায় আশুগঞ্জ নরসিংদী- ডেমরা অক্ষ বরাবর ঢাকা প্রবেশের প্রস্তুতি শুরু করলেন তিনি। এই লক্ষ্যে সাগত সিং আশুগঞ্জ-ভৈরব এলাকাকে পাশ কাটিয়ে নরসিংদী-রায়পুরা অঞ্চলে একটি সঞ্চালন ঘাটি স্থাপনের পরিকল্পনা নেন। ৯/১০ ডিসেম্বর রাতেই একটি পদাতিক ব্যাটালিয়নকে হেলিকপ্টারে নামানাে হলাে রায়পুরা এলাকায়। এই ব্যাটালিয়নটি ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত। মুক্তিবাহিনীর ২ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকেও ধাবিত করা হলাে একই অক্ষে। সে রাতেই ভৈরবের কাছের মেথিকান্দার পতন ঘটে এবং এই মেথিকান্দার পতনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানীদের ভৈরব দূর্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাে সকল দিক থেকে। ঠিক এ সময় আরও একটি ভারতীয় পদাতিক ব্যাটালিয়ন এগিয়ে যায় নরসিংদীর দিকে। অপরদিকে ১১ ইস্ট বেংগল ও ভারতীয় বাহিনীর ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেডের একাংশ দিয়ে আশুগঞ্জ দখল করে ভৈরব অবস্থানকে পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে ঘিরে রাখার পরিকল্পনা নেয়া হলাে। এই বাহিনীকে সমর্থন যােগাবার জন্যে ভারতীয়রা একটি মাঝারী গােলন্দাজ ব্যাটারীকে তালশহর ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার মাঝ বরাবর রেখে যায়। উত্তরে ময়মনসিংহ সেক্টরে বকশীগঞ্জের পতনের পর শেরপুরেরও পতন ঘটলাে ৫/৬ ডিমেম্বর রাতে। এখানে পাকিস্তানের ৩১ বালুচ কোনাে যুদ্ধ না করেই পশ্চাদপসরন করলাে। এরপর ৩১ বালুচ জামালপুরে এসে অবস্থান নেয় এবং এখানেই তারা অক্ষের মূল যুদ্ধে লড়ার পরিকল্পনা করে। ব্রহ্মপুত্রকে সামনে রেখে জামালপুরে ৩১ বালুচ নির্বিঘ্নেই তাদের সমাবেশ সম্পন্ন করলো। পশ্চাদ্ধাবনে ভারতীয়দের দুর্বল গতি জামালপুরে পাকিস্তানীদের গেড়ে বসার সময় ও সুযােগ দুই-ই করে দিলাে। ইতিমধ্যে জেনারেল গুরবক্স সিং মাইন বিস্ফোরনে আহত হয়ে রনাঙ্গণ থেকে বিদায় | নিয়েছেন। তার জায়গায় এসেছেন মেজর জেনারেল নাগরা। তিনি ৩১ বালুচের পুরাে অংশটাকেই জামালপুরে বিচ্ছিন্ন করে দক্ষিণে নেমে আসতে চাইলেন। এই লক্ষ্যে তিনি তার ব্রিগেডের অধীন চারটির মধ্যে তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়নকেই বিচ্ছিন্নকরণ প্রক্রিয়ার কাজে নিয়ােজিত করলেন।

ব্রিগেডের চতুর্থ ব্যাটালিয়ন ৬ বিহার রেজিমেন্ট তখন মুক্তিবাহিনীর সাথে ময়মনসিংহের দিকে এগিয়ে চলেছে।  এ পর্যায়ে গৃহীত ভারতীয় যুদ্ধ পরকিল্পনা খানিকটা দুর্বোধ্যই মনে হলাে। তারা একটি। অক্ষে একটি মাত্র পাকিস্তানী পদাতিক ব্যাটালিয়নকে (৩১ বালুচ) নিষ্কৃয় করার কাজে উঠে পড়ে লেগে গেলাে। অথচ একই সেক্টরের অপর একটি অক্ষে তখনাে অক্ষত ৩৩ পাঞ্জাবকে মােকাবেলায় সে রকম কোনাে পদক্ষেপই নেয়া হলাে না। | ৮/৯ ডিসেম্বর রাতে ব্রিগেড অধিনায়ক ক্লেয়ার একটি পদাতিক ব্যাটালিয়নের সাহায্যে জামালপুরের খানিকটা পেছনে অবরােধ প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হলেন। কাজটি তিনি করলেন খুবই। নিশব্দে, জামালপুরে অবস্থান নেয়া পাকিস্তানীদের কোনাে জানান না দিয়েই। ৯ ডিসেসবর দুপুরে জামালপুরে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ততােক্ষণে অবশ্য পাকিস্তানীদের  রক্ষাব্যুহের চারদিকে যৌথবাহিনীর অবরােধ প্রতিষ্ঠা পুরােপুরিভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এরপর ব্রিগেডিয়ার ক্লয়ারের হাতে আক্রমন কিংবা প্রয়ােজনে অন্যত্র বিচলন ঘটাবার জন্যে। অতিিরক্ত কোনাে সৈন্য আর থাকলাে না। সেনা প্রধান পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৬৭ পদাতিক ব্রিগেডকে দ্রুত বিচলন ঘটিয়ে জেনারেল নাগরার অধীনে অর্পণ করলেন। রণাঙ্গনের এই সেক্টরের চিত্রপটে এরপর আমূল পরিবর্তন ঘটে গেলাে। ভারসাম্যের আনুকুল্য জোরালােভাবেই ভারতের পক্ষে চলে যায়। এখানে যুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায় একতরফা। এদিকে পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার কাদের জামালপুর এবং ময়মনসিংহ থেকে তার বাহিনী প্রত্যাহারের নির্দেশ পেলেন ১০ ডিসেম্বর। সেদিনই তিনি তার অধীনস্ত ৩১ বালুচ ও ৩৩ পাবকে সরে এসে ঢাকার কাছে কালিয়াকৈরে তুরাগ নদী বরাবর অবস্থান নিতে বললেন। প্রথম পর্যায়ে মধুপুর এবং তারপর সম্মিলিতভাবে টাঙ্গাইল হয়ে কালিয়াকৈরে যাবার পরিকল্পনা করলেন কাদের। ময়মনসিংহ থেকে ৩৩ পাঞ্জাব নিবিঘ্নে বেড়িয়ে আসতে সক্ষম হলেও জামালপুর থেকে ৩১ বালুচের পক্ষে তা সম্ভব হলাে না। ১০/১১ ডিসেম্বর সারারাত ধরে ৩১ বালুচ অবরােধ ভেংগে বেরিয়ে আসার জন্যে একের পর এক মরণপন চেষ্টা চালালাে। ৩১ বালুচের অধিনায়ক কর্নেল সুলতান আনুমানিক দেড় কোম্পানী পরিমান সৈন্য নিয়ে সরে পরতে সক্ষম হলেও ব্যাটালিয়নের অধিকাংশই এখানে হতাহত হলাে এবং বাকিরা ১১ ডিসেম্বর ভােরে ভারতীয়দের কাছে আত্মসমর্পণ করলাে। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী ১১ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতীয় ২ প্যারা ব্যাটালিয়নকে বিমানের সাহায্যে নামিয়ে দেয়া হলাে টাঙ্গাইলের কালিহাতি এলাকায়। কিন্তু তাদের সড়ক অবরােধ প্রতিষ্ঠার আগেই ৩৩ পাঞ্জাব অন্যান্য সহায়ক বাহিনীসহ টাঙ্গাইল অতিক্রম করে গেছে। ফলে ব্যাটালিয়নটির বিচলন তেমন কোনাে সুফল বয়ে আনতে সক্ষম হলাে না। এটা অনুল্লেখ্যযােগ্য নয় যে পাকিস্তানী ১৩ ব্রিগেডের পশ্চাদপসরণের কোনাে পবেই কাদের সিদ্দিকী বাহিনীর কাউকে তাদের বাধা দেয়ার জন্যে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পলায়নপর পাকিস্তানী সেনাদের ঘায়েল করার এমন একটি মােক্ষম সুযােগ এভাবেই হাতছাড়া হয়ে যায়। যদিও কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ওই এলাকায় ২০ হাজার মুক্তিযােদ্ধার একটি বিশাল বাহিনী গড়ে তােলা এবং তাদের অনেক যুদ্ধজয়ের কৃতিত্বের কথা বলা হয়েছে যুদ্ধের নয় মাসে।

১২ ডিসেন্সর ভােরে মধুপুর এবং সন্ধ্যায় টাঙ্গাইলের পতনের ফলে কালিয়াকৈরের কাছে তুরাগ নদীর পার পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া ভারতীয়দের জন্যে কষ্টসাধ্য হবে না বলে ধরে নেয়া উত্তরবঙ্গের বিস্তৃত রণাঙ্গনে পাকিস্তানের ১৬ পদাতিক ডিভিশনের অবস্থানেও ভিন্নতা ছিলাে না। পঞ্চগড়-ঠাকরা অচ্ছে ভারতীয় ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেড গ্রুপের চাপে সেখানকার প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত পাকিস্তানের ২৩ পদাতিক ব্রিগেডের মূল অংশ সৈয়দপুর-রংপুর। অঞ্চলে এবং এর অপর অংশ দিনাজপুরে সড়ে পড়ে। তবে এ সময় তিস্তা পকেট পুরােপুরি শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে রংপুর দিনাজপুরের উপরিভাগ থেকে পাকিস্তানীদের সমূলে উচ্ছেদ সম্ভব হয় এবং তা তেমন কোনাে ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই। তবে তাদের দিনাজপুর-সৈয়দপুর-রপুর সমান্তরাল প্রতিরক্ষা রেখা ভেদ করা ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে তখনাে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ৬ ডিসেম্বর ৭১ মাউন্টেনের অগ্রবর্তী দল কান্তানগর সেতুর কাছে এসে থেমে পড়ে। এরপর ৯ ডিসেম্বর ব্রিগেড অধিনায়ক কাথালিয়া ১২ রাজপুতনা রাইফেল’র দুটো পদাতিক কোম্পানীকে দিনাজপুর শহরের দিকে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। এই সেনাদলটি ১০ ডিসেম্বর ভােরে অপ্রশস্থ ধিপা নদী অতিক্রম করে দিনাজপুর শহরের ৮ কিলােমিটার দূরত্বে পেীছে যায়। এখানে দিনাজপুরের শহরতলীতে পাকিস্তানী বাহিনী ভারতীয়দের মােকাবেলা করে। তীব্র প্রতিরােধের মুখে ভারতীয় বাহিনী পেছনে আবার কাস্তানগর এলাকায় ফিরে আসে। এই পর্যায়ে ৭১ মাউন্টেনের যুদ্ধ পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হলাে। এবার দিনাজপুরের পরিবর্তে সৈয়দপুর দখলে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী বীরগঞ্জ থেকে সঞ্চালন ঘটিয়ে খানসামার দখল নেয়া হবে এবং সেখান থেকে সৈয়দপুর। ১৩ ডিসেম্বর বিকেল নাগাদ সৈয়দপুরের নিকটবর্তী খানসামার দখল নিশ্চিত করতে সমর্থ হলাে ৭১ মাউন্টেন। 

হিলি অক্ষের উপরিভাগের চরকাইতে ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যার আগেই ২০ মাউন্টেন ডিভিশনের এক বিশাল সমাবেশ গড়ে ওঠে পাকিস্তানীদের অজান্তেই। সেখানে ইতিমধ্যে সমবেত হয়েছে ৬৬ ও ৩৪০ মাউন্টেন ব্রিগেড এবং ২০২ মাউন্টেন ব্রিগেডের একাংশ। এ ছাড়াও ৬৯ ক্যাভেলরীর দুটি ট্যাংক স্কোয়াড্রনকেও সংযুক্ত করা হয়েছে এই সমাবেশের সাথে। ২০ মাউন্টেন ডিভিশনের এই আক্রমণ শলাকা করােতােয়া অতিক্রম করে ধাবিত হবে গুরুত্বপূর্ণ সংযােগস্থল পীরগঞ্জে এবং সেখান থেকে সঞ্চালন ঘটবে প্রয়ােজনে রংপুর অথবা বগুড়া বা উভয় স্থানেই। পাকিস্তানীদের হালকা প্রতিরােধ গুড়িয়ে ৭ ডিসেম্বর বিকেলের মধ্যে রংপুর-বগুড়া মহাসড়কের পীরগঞ্জ মিত্রবাহিনীর দখলে এসে যায়। মিত্রবাহিনীর পীরগঞ্জ দখলের ফলে উত্তরাঞ্চল তথা রংপুর-সৈয়দপুরে অবস্থিত পাকিস্তানী ২৩ পদাতিক ব্রিগেড বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাে ডিভিশনের পর ব্রিগেডগুলাে থেকে। একই দিন বিকেলে পীরগঞ্জের ভারতীয় এমবুশে আটকা পড়েন পাকিস্তানের ১৬ পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক জেনারেল নজর হুসেন শাহ স্বয়ং। অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন তিনি। এমবুশ থেকে দৈবক্রমে অক্ষত বেরিয়ে যান বিশালদেহী পাকিস্তানী এই জেনারেল। এই এমবুশের ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে পাকিস্তানীরা তখনাে পর্যন্ত হিলির মধ্যাঞ্চলে ভারতীয়দের উপস্থিতির ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাে না বা উত্তরঙ্গের এই গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটির নিরাপত্তা বিধানে মােটেও সক্ষম ছিলাে না। পীরগঞ্জ হারাবার পর তা পুণরুদ্ধারে পাকিস্তানীরা পর পর দুটি পাল্টা আক্রমণ চালায় একটি ৭ ডিসেম্বর রাতে এবং অপরটি তার পরদিন অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর ভােরে। কিন্তু তাদের দুটি আক্রমণই ব্যর্থ হয় মিত্রবাহিনীর দৃঢ়তার মুখে। এই শেষােক্ত আক্রমণে নিহত হন ৩২ বালুচের অধিনায়ক কর্নেল সুলতান। ৯ ডিসেম্বর ৩৪০ ব্রিগেডের একটি অংশ ছাদুল্লাপুর হয়ে গাইবান্ধা ও ফুলছড়ি ঘাট দখল করে নেয়। আর এই দখলের মধ্য দিয়ে উত্তরাঞ্চলের উপরিভাগ বিচ্ছিন্নকরণ প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটলাে।  গাইবান্ধা দখলে এসে যাবার পর অধিনায়ক লছমন সিং এবার বগুড়ার দিকে ধাবিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং সেই লক্ষ্যে ৬৬, ২০২, ৩৪০—এই তিনটি ব্রিগেডকেই পাশাপাশি তিনটি ভিন্ন অক্ষে বগুড়ার দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। ৩৪০ ব্রিগেডের একাংশ সেদিনই ট্যাংকের সহায়তায় তার নিদের্শিত অক্ষের পলাশবাড়ীতে আক্রমণ চালায় এবং দুপুরের আগেই তা দখল করে নেয়। ফলে রংপুর-বগুড়া মহাসড়কের অপর গুরুত্বপূর্ণ সংযােগস্থল পলাশবাড়ীর দখলও নিশ্চিত হলাে। তবে হিলির মূল অক্ষের পূর্ব-পশ্চিম সমান্তরাল রেখায় অবস্থিত ভাদুরীয়া এবং ঘােড়াঘাটে তখনাে পর্যন্ত পাকিস্তানীরা তাদের জোরালাে প্রতিরােধ অব্যাহত রেখেছে।

পলাশবাড়ী দখলে এনে লছমন সিং দ্রুত তার ডিভিশনের ভারসাম্যসুচক শলাকা ধাবিত করতে চাইলেন বগুড়ায়। যে কারণে হিলির দখল নিয়ে তিনি আর বিলম্ব ঘটাতে চাইলেন । হিলিতে তখনাে ভারতীয় ২০২ ব্রিগেডের একাংশ সংঘর্ষের কারণে আটকে আছে এবং এর অপর অংশকে নিয়ম বহির্ভূতভাবেই ব্যবহার করা হচ্ছে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় যত্রতত্র। রণাঙ্গনের সামগ্রিক এই প্রেক্ষাপটে জেনারেল লছমন সিং ২০২ ব্রিগেডের অধিনায়ক ভাট্টিকে যে কোনাে মূল্যে হিলি দখলের নির্দেশ দিলেন। একই সাথে তিনি ৬৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক শর্মাকেও ভাদুরীয়া এবং ঘােড়াঘাটের দখল নিশ্চিত করে গােবিন্দগঞ্জের দিকে এগিয়ে যেতে বললেন। নির্দেশ অনুযায়ী শর্মাকে আঘাত হানতে হবে গােবিন্দগঞ্জের পাকিস্তানী অবস্থানের পশ্চাতে। ৩৪০ মাউন্টেন করতােয়ার পূর্ব তীর ধরে ইতিমধ্যেই এগিয়ে গেছে অনেকটা পথ এবং গােবিন্দগঞ্জের পাকিস্তানী অবস্থানের কাছাকাছি পৌঁছে গৈছে তখন। ব্রিগেডটির অপর অংশ। একই সময় পীরগঞ্জ এলাকাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। পীরগঞ্জ দখলের পর এটিকে ইতিমধ্যেই একটি শক্তিশালী সঞ্চালন ঘাটিতে পরিণত করা হয়েছে। | ব্রিগেডিয়ার ভাট্টি ৯ ডিসেম্বর হিলির ওপর তার সর্বশেষ আক্রমণের সূচনা করেন। পাঁচটি গােলন্দাজ ব্যাটারীর বিরামহীন গােলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে চারটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন এবং এক স্কোয়াড্রন টি ৫৫ মাঝারী ট্যাংক হিলির পাকিস্তানী অবস্থানে সরাসরি আঘাত হানে। ১১ ডিসেম্বর ৪৮ ঘণ্টার রক্তাক্ত যুদ্ধের পর হিলিতে পাকিস্তানী প্রতিরােধের অবসান ঘটে। অন্যদিকে ৬৬ মাউন্টেন ব্রিগেডও ৯ ডিসেম্বর ভাদুরীয়াতে তাদের নির্দেশিত আক্রমণের সূচনা করে। ভােরের দিকে এক স্কোয়াড্রন ট্যাংকের সহায়তায় ১৭ কুমায়ন পদাতিক ব্যাটালিয়ন ভাদুরীয়ার পাকিস্তানী অবস্থানে আক্রমণ চালায়। সেখানে পাকিস্তানীদের একটি মিশ্র পদাতিক ব্যাটালিয়ন এবং তিনটি ট্যাংক ভাদুরীয়া আগলে রেখেছিলাে। হিলির অনুরূপ এক রক্তাক্ত যুদ্ধের পর ১১ ডিসেম্বর ভাদুরীয়ারও পতন হলাে। হিলি আর ভাদুরীয়ার পতনের সাথে সাথে পাকিস্তানীদের পশ্চাদ্ভুমির গুরুত্বপূর্ণ বিচলন ঘটি ঘােড়াঘাটে প্রবেশের সরাসরি পথ উন্মুক্ত হলাে ভারতীয়দের জন্যে। ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা নাগাদ শর্মার ৬৬ ব্রিগেডের একটি অগ্রসরমান দল ঘােড়াঘাট দখল করে নেয়। এরপর ৬৬ ব্রিগেডের মূল অংশ ৩৪০ ব্রিগেডের সাথে সমান্তরালভাবে করোতােয়ার পশ্চিম পাড় ধরে বগুড়ার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। অর্থাৎ করােতােয়ার দু’পাড় ধরে দু’টি ব্রিগেড তখন অগ্রসরমান। এ পর্যায়ে উভয় আক্রমণ শলাকারই আশু লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। গােবিন্দগঞ্জ।  অপর দিকে হিলি দখলে এনে ২০২ ব্রিগেডকে হিলির খানিকটা দক্ষিণ-পূর্বে ক্ষেতলাল হয়ে বগুড়ার দিকে অগ্রসর হতে বলা হলাে। ব্রিগেডিয়ার ভাট্টি মােটামুটি একটু গুছিয়ে নিয়েই নতুন অক্ষ বগুড়ার দিকে ধাবিত হলেন। অর্থাৎ ২০ মাউন্টেন ডিভিশনের তিনটি ব্রিগেডই তিনটি ভিন্ন অক্ষ ধরে বগুড়ার দিকে অগ্রসর হতে লাগলাে। | এর বিপরীতে বিভিন্ন প্রতিরক্ষা অবস্থানসমূহ থেকে উচ্ছেদ হবার পর পাকিস্তানের ২০৫ ও ৩৪ পদাতিক ব্রিগেডের অধিকাংশ সেনাদল বগুড়ায় কেন্দ্রিভূত হতে থাকে।

বগুড়ায় তাদের মূল প্রতিরক্ষাব্যুহের উত্তরে দু’টি স্থানে তারা যুদ্ধে লড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর একটি গােবিন্দগঞ্জ এবং অপরটি বগুড়া শহর থেকে ১৪ কিলােমিটার উত্তরে ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়। এই দুটি স্থানকেই পাকিস্তানীরা বিলম্বিতকরণের শক্ত অবস্থান হিসেবে গড়ে তােলে বেশ দ্রুত গতিতেই। ১১ ডিসেম্বর ভারতীয় ৩৪০ ব্রিগেডের একাংশ মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় কাজলার কাছে করােতােয়া অতিক্রম করে পশ্চিম পারে চলে আসে। তারপর নিঃশব্দে গােবিন্দগঞ্জের পাকিস্তানী অবস্থানের পশ্চাতে পৌঁছে যায়। মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয়দের এই আকস্মিক উপস্থিতিতে পাকিস্তানীরা বরাবরের মতােই চমকে যায় এবারাে। ছােটো খাটো যুদ্ধের পর গােবিন্দগঞ্জেরও পতন হলাে ১১ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে। | গােবিন্দগঞ্জ দখলে এনে লছমন সিং তার সামগ্রিক পরিকল্পনায় পরিবর্তন ঘটালেন আবার। রংপুর দখলের লক্ষ্যে তিনি ৬৬ মাউন্টেন ব্রিগেডের আক্রমণ শলাকা উত্তরে ঘুরিয়ে দিলেন। প্রথমে মিঠাপুকুর দখলে এনে ৬৬ ব্রিগেড রংপুরের দিকে অগ্রসর হবে। পীরগঞ্জ এলাকায় ইমিধ্যেই ভারতীয়দের যে শক্তিশালী সমাবেশ গড়ে উঠেছে ৬৬ ব্রিগেডের সঞ্চালন ঘটবে। সেখান থেকে অপরদিকে লছমন সিং ৩৪০ ও ২০২ ব্রিগেডের বিচলন অব্যাহত রাখলেন বগুড়ার দিকে। ৩৪০ ব্রিগেডের অগ্রবর্তী দল সন্ধ্যার আগেই মহাস্থানগড়ের করােতােয়া সেতুটির দখল অক্ষত নিয়ে নেয়। সেই সাথে ১২ ডিসেম্বর মহাস্থানগড়েরও পতন ঘটলাে। ওদিকে ভাটির ২০২ ব্রিগেডের আক্রমণ শলাকা পাকিস্তানী ৩৪ ব্রিগেডের একাংশের প্রতিরােধ ভেঙ্গে ক্ষেতলাল হয়ে বগুড়ার দিকে তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। এ সময় লছমন সিং তার অপর অব্যবহৃত ১৬৫ ব্রিগেডকে প্রথমবারের মতাে যুদ্ধে নিয়ােজিত করলেন। ব্রিগেডটিকে তিনি হিলির দক্ষিণ-পূর্ব দিক বরাবর নওগার সাধারণ অঞ্চলের দিকে ধাবিত করলেন। কোনাে প্রতিরােধ ছাড়া এখানেও ১৩ ডিসেম্বর পাঁচবিবি এবং একই দিন জয়পুরহাটও তাদের দখলে এসে যায়। ফুষ্টের আরও কিছুটা দক্ষিণে ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিংয়ের নেত্বত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালী দল মহানন্দা অতিক্রম করে ইতিমধ্যে নওয়াবগঞ্জ দখল করে নিয়েছে। রণাঙ্গনের এই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে উত্তরবঙ্গের প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত পাকিস্তানের ১৬ পদাতিক ডিভিশন কার্যতঃ অস্তিত্বহীন হয়ে পরেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ডিভিশনের সেনাদলগুলাে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, সৈয়দপুর-এ সমস্ত দূর্গশহরগুলােতে আশ্রয় নিলাে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে। | উত্তরবঙ্গের এই হিলি কমপ্লেক্সের যুদ্ধে ভারতীয়দের যুদ্ধ পরিকল্পনার বিষয়টি সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে আগাগােড়াই ছিলাে বিভ্রান্তিমূলক। প্রথমতঃ ১৫ থেকে ২০ মাইলের একটি ক্ষুদ্র ফুটে গােলন্দাজসহ সাতটি ব্রিগেডের সঞ্চালন অনেকটাই ছিলাে যুক্তিহীন।

দ্বিতীয়তঃ ডিভিশন অধিনায়ক লছমন সিং এলােমেলােভাবে তার বাহিনীর বিচলন ঘটাতে থাকেন যুদ্ধের শুরু থেকেই। আক্রমণ রেখার ঘন ঘন পরিবর্তনের কারণে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাকে সময় ক্ষেপণ করতে হয়েছে প্রয়ােজনের তুলনায় অনেক বেশী। এ ছাড়াও ২০ মাউন্টেন ডিভিশনের সেনা সঞ্চালন পরিকল্পনাও ছিলাে ত্রুটিপূর্ণ। গোয়ার্তুমির আশ্রয়ে লছমন সিং যখন একের পর এক আঘাত হেনে চলেছেন হিলির ওপর তখন হিলির দক্ষিণ দিক দিয়ে বগুড়ায় যাবার অপর একটি পথ সম্পূর্ণ উমুক্তই ছিলাে। পত্নীতলায় আত্রাইয়ের পূর্ব পাড় ধরে ক্ষেতলাল, ধূপচাচিয়া ও মহাস্থানগড় হয়ে লছমন সিং অনায়াসেই তার অব্যবহৃত ১৬৫ ব্রিগেডকে বগুড়ায় ধাবিত করতে পারতেন। এই অগ্রাভিমুখি পথের পুরােটাই ছিলাে কণ্টকহীন এবং তা প্রকৃতিগতভাবেই ছিলাে সুগম। লছমন সিং শেষাবধি তার লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হয়েছেন সন্দেহ নেই, তবে এই বিজয় অর্জনের পেছনে দেয়া খেসারত সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনাে যৌক্তিকতাই বহন করে না। 

পরবর্তী লক্ষ্যস্থল নির্ধারিত হয় ফরিদপুর।

এ পর্যায়ে পরিত্যাক্ত বিস্তৃত রণাঙ্গন দখলের একতরফা মালিকানা এসে বর্তালাে ভারতীয় কোর অধিনায়ক রায়নার ওপর। এখন ভূমি দখল অথবা চিরশত্রু নিধন-দুটির একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে রায়নাকে।

 

সূত্র : যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা – মেজর নাসির উদ্দিন

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!