বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৩০শে ডিসেম্বর, সোমবার, ১৪ই পৌষ, ১৩৮১
জরুরি অবস্থা
দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে এরূপ একটি ঘোষণা সরকার করবেন বলে শোনা যাচ্ছিল। স্বাভাবিক প্রচলিত বিধিমতে রাষ্ট্রশাসন দুরূহ বলে প্রমাণিত হলে জরুরি আইন জারি করা হয়ে থাকে। আমাদের ক্ষেত্রে তাই করা হয়েছে। এই ব্যবস্থা দিনে জনসাধারণ কতিপয় মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। একথা সুস্পষ্ট, সরকারের পক্ষ থেকে দেশের জনসাধারণের কাছ থেকে ওই সকল অধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রাথমিক কোন পরিকল্পনা ছিল না। পরিস্থিতি অত্যন্ত ঘোলাটে এবং স্বাভাবিক আইন-কানুনের অধীনে নিয়ন্ত্রণ করা সমাজ ব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে সুবিন্যস্তভাবে এগিয়ে নেয়ার দুঃসাধ্য বলে প্রমাণিত হওয়ার ফলেই সরকারকে বিশেষ আইনের আশ্রয় নিতে হলো। বর্তমান সরকারের যদি মৌলিক অধিকার সমূহের প্রতি অশ্রদ্ধা থাকতো তাহলে দেশ স্বাধীন হবার পর পরেই সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে তারা অন্য পন্থায় দেশ শাসনের ঝুঁকি নিতে পারতেন। তা করা হয়নি। এ থেকে বোঝা যায়, অনেকটা বাধ্যতামূলক পরিস্থিতির চাপে পড়ে সরকারকে কতিপয় গণতান্ত্রিক বিধান স্থগিত রাখতে হয়েছে।
জরুরী আইন কোনক্রমেই সামরিক শাসন নয় বা একনায়কত্ববাদের হাতিয়ার নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বেসামরিক ব্যবস্থাধীনে সামরিক কালের জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ গৃহীত হতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরিপন্থীরা মৌলিক অধিকারসমূহের সুযোগ গ্রহন করে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল যার ফলে দেশে একটি অসম্ভব পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। এই জাতীয় শত্রুদের নিরস্ত্র ও নির্বংশ করাই জরুরি আইনের ঘোষণার প্রাথমিক লক্ষ্য বলে সরকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এধরনের সীমিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য জরুরী আইন প্রয়োগ করে জাতিকে সুস্থ্য ও সাবলীল প্রগতিশীল ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলে কিংবা উৎপাদন প্রবাহকে সফল করে তোলার জাতীয় অর্থনীতিকে গড়ে তোলার কাজটি সম্পন্ন করা হলে এ ধরনের আইনের প্রয়োগ অর্থবহ হবে এবং জনসাধারণ শান্তি ফিরে পাবে। সরকার সেরূপ আশ্বাস আমাদের দিয়েছেন।
পাশাপাশি এই ধরনের অস্বাভাবিক আইনের একটি অভ্যন্তরীণ প্রবণতা হল-তা রাষ্ট্রের কতিপর শাখা-প্রশাখাকে অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান করে থাকে এবং সেগুলি হঠকারী ও নির্যাতনমূলক কাজে ব্যবহৃত হয়। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সুবিন্যাস্ত কর্মসূচি গ্রহণ করা না হলে পরিণতিতে এসকল রাষ্ট্রীয় এজেন্সিগুলোর বেড়ে ওঠে এবং বিভিন্ন নিয়ন্ত্রনহীন হস্তক্ষেপ চালিয়ে জনসাধারণের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। এদিকটার প্রতি সরকারের তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। আওয়ামীলীগ বা বঙ্গবন্ধু বরাবর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি আস্থা প্রকাশ করে এসেছেন এবং এর জন্য নির্যাতনও ভোগ করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়ে ছিলেন এবং ওই ব্যবস্থাধীনে দেশ শাসনের জন্য চেষ্টাও চালিয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানি আমলের পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তি সমূহ এবং অতি বামপন্থী সন্ত্রাসবাদীরা শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা জন্য ক্ষতিকর তৎপরতা চালিয়ে পরিস্থিতিকে ক্রমাগত আয়ত্বের বাইরে ঠেলে দেয়ার অভিযান চালাতে থাকে। কিছু বিদেশি শক্তি তাদের আর্থিক ও বাস্তবিক সাহায্য দিয়ে উস্কানি প্রদান করেছিল। ঘুষ, দুর্নীতি ও মুনাফার পাহাড় গড়ে কিছু লোক মানুষের দুঃখ বাড়িয়েছে। বামপন্থী সন্ত্রাসবাদীরা এমন কতগুলি তৎপরতা চালিয়েছে এবং এমন সমস্ত বক্তব্য পেশ করেছে যা বস্তুতঃ জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি ছিল একটি চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক নীতিমালায় বিশ্বাসী’ বলে কথিত রাজনৈতিক সংগঠনগুলো এদের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালিয়ে বেআইনি, অগণতান্ত্রিক খুন-খারাবি ও লুটতরাজ বন্ধ করতে এগিয়ে আসেনি। ফলে জনসাধারণকে এদের উৎপীড়ন থেকে রক্ষা করার অনিবার্য দায়িত্ব থেকে সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থার আশ্রয় নিতে হয়েছিল। আমাদের একান্ত কামনা জরুরী আইন এ দেশের জন্য একটি সামরিক বিধান হবে এবং সরকার দক্ষতা ও নিরপেক্ষ তার সাথে জাতীয় শত্রুদের নিরস্ত্র ও নির্মূল করে জনগণের নিরাপত্তা, শৃংখলা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সমাজদেহে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে।
আন্তর্জাতিক আদালতের প্রয়োজনীয়তা
রাজধানীতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার উদ্বোধনী ভাষণে বলেন যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ তথা গণহত্যার ধ্বংসযজ্ঞ মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধে অপরাধীদের বিচার ও সাজা প্রদানের জন্য একটি কার্যকর আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে আরো বলেন যে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ও মর্যাদাপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠনের ব্যাপারটি একটি আদর্শ স্বরূপ। এবং পূর্বে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত সম্পর্কিত খসড়া কনভেনশনের উল্লেখ করে যদি একটি পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন করা সম্ভব হয়, তাহলে বিভিন্ন জাতীয় সংস্থা গুলির মাধ্যমে বিশ্বের সকল প্রকার মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করে শাস্তি দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
একথা অনস্বীকার্য যে, বিশ্বশান্তি আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য আধুনিক বিশ্বের ছোট-বড় ভেদাভেদ অথবা শক্তিধর ও দুর্বল দেশ নির্বিশেষের জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের ভিত্তিতে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। গ্রহান্তরে গমনের যুগে একক অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকার অহংকার এখন চলে না। কারণ সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বমানবতার প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই এসেছে। আর এখন থেকে দেশকাল সমাজ ও বহির্বিশ্বের পটভূমিতে স্বেচ্ছাচারমূলক কাজ কারবার অবকাশ নীতিগতভাবে এসেছে কমে। সভ্যতার ধারক হিসেবে সহানুভূতি ও মানবতার প্রশ্ন করে তুলে ধরতে হয়েছে উচ্চে। আদিম যুগের হানাহানি বিসর্জন দিতে দিয়ে প্রগতি, সমৃদ্ধি ও শান্তির লক্ষ্য অর্জনে তখন প্রয়োজন হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গঠন ও সহ-অবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করা। সেই কাঙ্খিত শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য তাই আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী কাজের শাস্তি প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠার আত্যন্তিক প্রয়োজন।
আমরা জানি, যুদ্ধ প্রতিরোধ ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার তাগিদে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘের গঠন করা হলে তখন থেকেই নীতিগতভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন সারা বিশ্বের সভ্য মানুষ ক্ষুব্দ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমের বীভৎসতায়। সেই ধ্বংসযজ্ঞের মানবতাবিরোধী এবং ইতিহাস কলঙ্কিত ঘটনাবলীর কোন বিচারই হয়নি মানবসভ্যতার ও নীতির ন্যায়দন্ডে। কারণ ওদের শাস্তি বিধানের জন্য তখন ছিল না কোনো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। দুঃখের বিষয় এখন পর্যন্ত তার বিশেষ কোনো উন্নতি হয়নি।
আমাদের বাংলাদেশে যে নারকীয় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বিশ্বের ইতিহাসে যার নজির বিরল-তারো যথার্থ বিচার হয়নি। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নিরীহ লোকের জীবন নাশ করার প্রত্যক্ষ কর্মে যারা জড়িত ছিল তারা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নিন্দিত হলেও এবং বিশ্ব বিবেকের কাছে ধিকৃত হলেও তাদের বিচারের ব্যবস্থা পর্যন্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বলিষ্ঠ ভূমিকার অভাবে।
এমনই ঘটনা ঘটেছে চিলিতে, ভিয়েতনামের মাইলাইয়ে, কঙ্গোতে। এবং এখনো করছে পর্তুগাল উপনিবেশগুলোতে ও দক্ষিণ আফ্রিকায়। সাধারণ মানুষের ন্যায্য দাবীতে নস্যাৎ করে ওইসব জায়গায় চলেছে নিশংস হত্যাকাণ্ড ও অত্যাচার। ক্ষমতা বর্গী সাম্রাজ্যবাদী সরকার নির্লজ্জের মত চালিয়েছে মহাধ্বংস লীলা। রক্তের বন্যায় ডুবে গেছে মানবতার বানীর শান্তির ললিত আশ্বাস। বিশ্ব বিবেক প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে, বিশ্ব শান্তির পরিবেশ কলঙ্কিত হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অবমূল্যায়ন। তাই আমরা আজ একটা বলিষ্ঠ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্বারোপ করি।যেন মানবতা বিরোধী কোন কাজেই সভ্যতার আইনে প্রশ্রয় না পায়। বিশ্ব শান্তির পরিবেশকে নির্মল করে তুলবার জন্যে আপনদেশ ও গন্ডির সীমাবদ্ধতার ভেতরেও যেন কেউ কোন প্রকার স্বেচ্ছাচারিতা তথা মানবতাবিরোধী অপকর্ম করতে সাহস না পায়।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক