You dont have javascript enabled! Please enable it!

উপেক্ষিত তিন ভাষাশহীদ

ভাষাসংগ্রামীদের স্মৃতিচারণ, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা এবং পত্র-পত্রিকার সংবাদ থেকে, সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউর ছাড়া আরও তিনজন ভাষাশহীদের নাম ও পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তারা হলেন কিশাের ভাষাশহীদ অহিউল্লাহ, রিকশাচালক আবদুল আওয়াল এবং সিরাজুদ্দিন। তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলাে।

ভাষাশহীদ অহিউল্লাহ
ক. পরিচিতি, জীবনাবসান ও বিবিধ প্রসঙ্গ
ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের তালিকায় একজন ১০ বছরের কিশাের রয়েছেন যার নাম হলাে অহিউল্লাহ। তিনি ছিলেন রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমানের ছেলে। শহীদ হবার সময় অহিউল্লাহ তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। অহিউল্লাহ শহীদ হন ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখে। এইদিন নবাবপুর রােডে অনেক সেনা মােতায়েন ছিল। মূলত ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর সরকার এ ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছিলেন। ঘটনার সময় অহিউল্লাহ মনের আনন্দে নবাবপুর রােডের পার্শ্বে ‘খােশমহল’ রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে কাগজ চিবুচ্ছিলেন। আসলে তিনি নবাবপুর রােড দিয়ে জনতার ঢল দেখে কৌতূহলবশত দেখতে এসেছিলেন। এ সময় একটি গুলি তাঁর মাথার খুলি উড়িয়ে দেয়। গুলিতে মারা যাবার পর পুলিশ অহিউল্লাহর লাশ গুম করে ফেলে। ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিকের শহীদ দিবস সংখ্যা-১৯৫৪ অনুযায়ী শহীদ হবার পর অহিউল্লাহর পকেটে এক টুকরাে কাগজ পাওয়া গিয়েছিল। এতে খুব সুন্দর শৈল্পিক গুণসহ প্রজাপতি ও জীব-জন্তুর ছবি আঁকা ছিল। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখের দৈনিক আজাদে তাঁর শাহাদাতের খবর ছাপানাে হয়। তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। কিন্তু কবরের কোনাে চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘর-এর উদ্যোগে ২০০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বর্ণনাভিত্তিক অহিউল্লাহর মূল ছবিটি এঁকেছেন শিল্পী শ্যামল বিশ্বাস।
ভাষাশহীদ অহিউল্লাহ সম্পর্কে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক বলেন, ‘অহিউল্লাহ শহীদ হন ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। তখন তার বয়স মাত্র আট বছর এবং তিনি তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। তিনি ছিলেন রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমানের ছেলে। ১৯৫২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নবাবপুর রােডে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখের দৈনিক আজাদে তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়। (সূত্র : ভাষা আন্দোলন ও ভাষাসংগ্রামীগণ, গণ প্রকাশনী, মার্চ, ২০১২, পৃ২৬)।

ভাষাশহীদ অহিউল্লাহর মরদেহ প্রত্যক্ষকারী ছিলেন তৎকালীন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ভাষাসংগ্রামী ডা. মেজর (অব) মােহাম্মদ মাহফুজ হােসেন। তিনি বলেন, “সেইদিনই (২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২) দুপুর বেলায় নবাবপুর রােডের মানসী হতে সম্মুখে স্কুলের ছাত্রদের একটি মিছিলের উপর টহল মিলিটারির গাড়ি হইলে গুলি ছােড়া হয়। সেই জায়গায় সফিউল্লা (হবে অহিউল্লাহ) নামে ০-২ বয়সের একটি ছাত্র গুলিবিদ্ধ হইয়া মারা যায়। তাহার লাশ মেডিকেল মর্গে দেখিয়াছি। বুকের পকেটে তাহার নিজ হাতে থাকা প্রজাপতি সংবলিত এক টুকরা কাগজে ছিল।’ (সূত্র : আমার জীবনের সত্তর বছর-সেবা পাবলিশার্স ডিসেম্বর, ১৯৯৬, পৃ-২৮)।

লেখকের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ বিষয়ে আরও জানান, ২১ ফেব্রুয়ারি, ৯৫২ তারিখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমার জরুরি কক্ষে বেলা ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ডিউটি ছিল। আমি সেদিন ভাষাশহীদ রফিক ও বরকতের মৃতদেহ প্রত্যক্ষ করি। ২২ তারিখেও গুলি হয়। সেদিন শফিউর ও একজন কিশাের বালক মারা যায়। পুলিশ মরদেহ গােপনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে আসে। অহিউল্লাহ নবাবপুর রােডে মিলিটারির গুলিতে মারা যায়। আমি তার মরদেহ প্রত্যক্ষ করি হাসপাতালের মর্গে। তার জামার পকেটে এক টুকরা কাগজ দেখতে পাই। পরে জেনেছি। কিশােরটির নাম অহিউল্লাহ। আমি এ দৃশ্য দেখে ভীষণ মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ হই। পুলিশ অনেক মরদেহ গুম করে ফেলে। আজিমপুর কবরস্থানে অনেককেই গণকবর দেয়া হয়েছিল। সম্ভবত অহিউল্লাহর শেষ গতি হয়েছিল গণ কবরে’ লেখকের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে ভাষাসংগ্রামী মেজর (অব) মােহাম্মদ মাহফুজ হােসেন, ১৬ জুলাই, ২০০৭)।
ভাষাশহীদ অহিউল্লাহ সম্পর্কে গবেষক, লেখক ও কথাশিল্পী বশীর আল হেলাল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গ্রন্থে (পৃ: ৪৮৩) সাপ্তাহিক নতুন দিনে প্রকাশিত খবরের উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘অহিউল্লাহ নামক ৮/৯ বছরের একটি ছেলের মৃত্যুর খবর অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে। অন্য কয়েকজন শহীদের পরিচয়ের সঙ্গে অহিউল্লাহর শাহাদাতের খবরটি রয়েছে ১৩৬২ সালের ১১ ফাল্গুনের সাপ্তাহিক ‘নতুন দিনে। এতে কেবল এইটুকুই বলা হয়েছে যে, রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমানের ছেলে ২২ ফেব্রুয়ারি নবাবপুর রােডে খােশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে হঠাৎ মাথায় রাইফেলের গুলি লেগে নিহত হয় এবং তার লাশ অপসারিত হয়।
সাংবাদিক আহমেদ নূরে আলম ‘অহিউল্লাহ’ বায়ান্নর একটি বিস্মৃত কিশােরশহীদ’ শীর্ষক এক নিবন্ধে বলেন, অহিউল্লাহর বাসার ঠিকানা ছাপা হয় ১৫২ লুর রহমান লেন। পুরানাে ঢাকার এই ঠিকানায় ও মহল্লায় এক বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতাে অনুসন্ধান করতে গিয়ে উন্মােচিত হয় এক বিস্মৃত কিশাের-শহীদ সম্পর্কে অজানা তথ্য। কথা হয় কিশাের শহীদের আত্মীয়স্বজন ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক বন্ধুর সঙ্গে। জানা যায়, সরকার থেকে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে বলা হলেও সত্যি ১৫২ লুৎফর রহমান লেনের বাসাটির এক কিশাের বায়ান্নতে শহীদ হয়েছিলেন। তার বয়স ছিল দশ বছর। তিনি নওয়াবপুর রােডের যে স্থানে গুলিবিদ্ধ হন, তার অদূরেই প্রায় একই সময় ঘটনাস্থলেই নিহত হন শফিউর রহমান। অহিউল্লাহও গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মারা গিয়েছিলেন। আর মিলিটারি ও পুলিশ সঙ্গে সঙ্গেই লাশটি ঘটনাস্থল থেকে। তুলে নিয়ে গিয়েছিল। প্রচারপত্রে অহিউল্লাহ নাম ভুল ছাপা হলেও তার পিতার নাম ও পরিচয়টি ছিল ঠিক। তার পিতা পেশায় ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রি। তিনি ছিলেন ঢাকার আদি বাসিন্দা।’ (সূত্র : কিশাের ভাষাশহীদ অহিউল্লাহ খালেদ বিন জয়েন উদ্দিন, শিশু, শহীদ দিবস সংখ্যা, ২০০৯)
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত বর্ণমালার গল্প : অতে অহিউল্লাহ’ শীর্ষক এক লেখায় সেলিনা হােসেন ভাষাশহীদ অহিউল্লার কথা উল্লেখ করেছেন। ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠের শিশুকিশাের ম্যাগাজিন ‘টুনটুন টিনটিন’ এ প্রকাশিত ‘অহিউল্লাহকে সবাই ভুলে গেছে’ শিরােনামে ওমর শাহেদ লিখেছেন, বড় বড় ঝাঁকড়া চুল ছিল তার মাথা ভর্তি। ভালােবাসত ছবি আঁকতে। সময় পেলেই কাগজ, পেন্সিল নিয়ে বসে পড়ত আঁকাআঁকি করতে। নাম ছিল তার অহিউল্লাহ। অহিউল্লাহ থাকত ঢাকার নবাবপুর। খুব অল্প মানুষই তখন এই এলাকায় থাকতেন। ফাঁকা, একেবারেই জনবিরল ছিল এলাকাটি। বড় বড় পথঘাট, দুই-চারটি গাড়ি-ঘােড়া অনেকক্ষণ পর পর ছুটে যেত রাস্তা দিয়ে সাঁ সাঁ করে। আট কী নয় বছরের ছেলে অহিউল্লাহ তার কৌতুহলী মন নিয়ে রাস্তা দিয়ে কারা চলাচল করছে তা দেখত দিনভর।।
অহিউল্লাহর বাবার নাম হাবিবুর রহমান। তিনি ছিলেন রাজমিস্ত্রি। অন্যের দালানকোঠা বানিয়ে দেওয়াই ছিল তার পেশা। খুব গরিব ছিলেন তিনি। তাঁর বড় আশা ছিল, ছেলে বড় কিছু হবে। মানুষের মতাে মানুষ হয়ে বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করবে। অভাব দূর করবে। ছেলেকে তাই তিনি পড়তে পাঠিয়েছিলেন স্কুলে।
স্কুলে যাওয়ার পাশাপাশি ছবি আঁকার দিকে প্রবল ঝোঁক ছিল অহিউল্লাহর। ১৯৫২ সালে যখন আমাদের দেশে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন হয়, তখনকার গল্প বলছি আমরা। অহিউল্লাহ তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ত। বাবা-মায়ের সঙ্গে নবাবপুর রােড দিয়ে যদি কোনােদিন যাও, তাহলে ঠিক ঠিক অহিউল্লাহকে কল্পনার চোখে দেখতে পারবে তােমরা।
২২ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই পুরাে শহরটা থমথমে। খুবই অল্প লােকজন। রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করছেন। বালক অহিউল্লাহ ঢাকা শহরের এই থমথমে পরিবেশ দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেল। তাদের এলাকায় নতুন আসা কিছু মানুষ নিয়েও সে খুব চিন্তিত। এসব খয়েরি রঙের পােশাক পরা, লম্বা লােকদের আগে কখনাে এই এলাকায় দেখা যায়নি। এই অদ্ভুত লােকদের দেখে খুব মজা পেয়ে গিয়েছিল নবাবপুরের খােশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়ানাে অহিউল্লাহ। সে ভাবতে লাগল, এদের কিভাবে ছবি আঁকার বিষয়বস্তু করে তােলা যায়। মনটা তার এত খুশি হয়ে গেল যে, এক টুকরা কাগজ মুখে পুরে সমানে চিবুতে লাগল। আমাদের অহিউল্লাহ। যাদের দেখে সে অবাক ও বিস্মিত তারাই শত্রু হয়ে গেল হঠাৎ। বলা নেই, কওয়া নেই একটা রাইফেলের গুলি এসে অহিউল্লাহর মাথা গুড়িয়ে দিল। মাটিতে পড়ে গেল সে। রক্তে ভেসে গেল চারপাশ। এরপর সরকারি অ্যাম্বুলেন্স এসে গরিব রাজমিস্ত্রির ছেলেটার লাশ নিয়ে গেল ঢাকা মেডিকেল কলেজে।
পুলিশ নিজেদের মতাে করে অহিউল্লাহর লাশ দাফন করল, নাকি মাটিচাপা দিয়ে দিল—সে তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে অহিউল্লাহর পকেটে পাওয়া গেল।
একটি রঙিন কাগজের টুকরাে। যেখানে বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু আর প্রজাপতির ছবি আঁকা ছিল। খুব ভালােবেসে এই ছবিগুলাে এঁকেছিল সে। রফিক, সালাম বরকত, জব্বার আর শফিউরের সঙ্গে আরেকটি নাম অহিউল্লাহ-আমাদের ভাষার জন্য রক্ত দেয়া ৬ প্রাণ। অহিউল্লাহর কোনাে কবর নেই। তাকে কোথায় দাফন করা হয়েছিল সেটাও কেউ জানে না। অহিউল্লাহর কবর কোথায় সে কথা জানতে ঢাকা সিটি করপােরেশন গিয়েছিলেন ভাষা আন্দোলন মিউজিয়ামের এম আর মাহবুব। লাশ দাফনের খাতায় তার নাম পেলেও তার কবর খুঁজে পাননি। অহিউল্লাহর কবর শনাক্ত করার কোনাে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে তার কবর নেই।
নানা জনের কাছ থেকে অহিউল্লাহর শারীরিক বিবরণের কথা শুনে শুনে ভাষা আন্দোলন মিউজিয়ামের উদ্যোগে আঁকা হয়েছে অহিউল্লাহর ছবি। ২০০৭ সালে ছবিটি আঁকেন চিত্রকর শ্যামল বিশ্বাস। এই ছবিটিই ভাষাশহীদ অহিউল্লাহর একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন।

ভাষাশহীদ অহিউল্লাহর ছবি অংকন
ভাষাশহীদ অহিউল্লাহর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ এবং ছবি উদ্ধারের প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয় ২০০৬ সালে। ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘর এর পক্ষ থেকে এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। জাদুঘর-এর পক্ষে আমি (লেখক) ভাষাশহীদ অহিউল্লাহর পুরানাে ঢাকার বাসা লুৎফর রহমান লেনে গিয়ে তার আত্মীয়স্বজনের সন্ধান করি এবং সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। ২০০৭ সালে ভাষা আন্দোলন জাদুঘরএর পক্ষ থেকে শিল্পী শ্যামল বিশ্বাসকে বিষয়টি অবহিত করে ভাষাশহীদ অহিউল্লাহ একটি বর্ণনাভিত্তিক ছবি অংকন করার জন্য অনুরােধ করা হয়। শিল্পী শ্যামল বিশ্বাস ভাষা আন্দোলন জাদুঘর-এ সংরক্ষিত তথ্যাবলি পর্যবেক্ষণ করে ভাষাশহীদ অহিউল্লাহর আত্মীয়স্বজনের সাথে কথা বলে একটি ছবি অংকন করেন। এ প্রসঙ্গে ২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদ, পত্রিকায় প্রকাশিত এই আমাদের ভাষাশহীদ অহিউল্লাহ’র ছবি’ শিরােনামে এক প্রতিবেদনে বলা হয়—‘ভাষা আন্দোলন মিউজিয়ামের উদ্যোগে ভাষাশহীদ অহিউল্লাহর ছবি এঁকেছেন শিল্পী ম্যামল বিশ্বাস। তার কোনাে ছবি বা পারিবারিক পরিচয় আমাদের জানা ছিল না। ভাষাশহীদ অহিউল্লাহর যে বিবরণ ভাষা আন্দোলন মিউজিয়ামের কাছে রয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে শিল্পী শ্যামল বিশ্বাস একটি ছবি আঁকেন। এখন থেকে এই ছবিটিই শহীদ অহিউল্লাহর পরিচয় বহন করবে। এর আগে ভাষাশহীদ আবদুস সালামের ছবিও একই প্রক্রিয়ায় ভাস্কর রাশা অঙ্কন করেছিলেন।
মাত্র আট বছর বয়সের বালক অহিউল্লাহ রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে শহীদ হন। তিনি ছিলেন ঢাকার নবাবপুর রােডে বসবাসকারী রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমানের ছেলে। শহীদ হওয়ার সময় তিনি তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। অহিউল্লাহ শহীদ হন ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নবাবপুর রােডে খােশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে। শহীদ হওয়ার সময় তার মুখে এক টুকরাে কাগজ ছিল। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে এবং ২ ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় যে মিছিল বের হয় নবাবপুর রােড দিয়ে সেই মিছিলটি অতিক্রম করার সময় বালক অহিউল্লাহ কাগজ চিবুতে চিবুকে মিছিলে শরিক হন। এমন সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।
১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় অহিউল্লাহর শাহাদাতের খবর ছাপা হয়। তার লাশটি পুলিশ গুম করে ফেলেছিল বলে কোথায় তাকে কবর দেয়া হয়েছে তা আজও অজ্ঞাত রয়ে গেছে। ১৯৫২ সালের শহীদ দিবস সংখ্যা সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকায় শহীদ অহিউল্লাহর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ছাপা হয়। জ্ঞাত ভাষাশহীদের সংখ্যা অনেকে ৫ জন বলে উল্লেখ করলেও শহীদ অহিউল্লাহকে নিয়ে জ্ঞাত ভাষাশহীদের সংখ্যা হবে ৬ জন। প্রামাণ্য ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গ্রন্থগুলােতেও শহীদ অহিউল্লাহ সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে।

ভাষাশহীদ আব্দুল আওয়াল
ক. পরিচিতি ও জীবনাবসান। ভাষাশহীদদের তালিকায় আব্দুল আওয়ালের নামটি বরাবরই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। দৈনিক আজাদ এবং দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, ২২ ফেব্রুয়ারি রিকশা চালক আব্দুল আওয়াল (রিকশার লাইসেন্স নং-৩৪০২) শহীদ হন। ৪ মার্চ, ১৯৫২ইং তারিখে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপাের্ট থেকে জানা যায়, আব্দুল আওয়ালের পিতার নাম মােহাম্মদ হালিম। মােটর দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট জনাব ওবায়েদউল্লার উপস্থিতিতে মাওলানা আব্দুল গফুর তার জানাজা পড়ান। ২৫ মার্চ, ১৯৫২ ইং তারিখে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি নিম্নরূপ-আব্দুল আওয়াল, C/O মােহাম্মদ হালিম। তাহার বয়স ২৬ বৎসর। সে রিকশা চালাইত এবং ৯ নম্বর হাফিজুল্লা লেন মৌলভী বাজার ঢাকায় বাস করিত। মােটর দুর্ঘটনায় তাহার মৃত্যু হয়। জানাজার সময় তাহার কোনাে আত্মীয় উপস্থিত ছিল না। প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা জনাব ওবায়েদউল্লাহ জানাজার সময় উপস্থিত ছিলেন।’
২২ ফেব্রুয়ারি সকালে একুশের ভাষাশহীদদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ব্যারাক হােস্টেল প্রাঙ্গণে। উক্ত জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন আবদুল আওয়াল। জানাজা শেষে বিশাল শােক মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। সেই শােক মিছিলেও অংশ নেন তিনি। মিছিলটি যখন কার্জন হলের সামনের রাস্তা অতিক্রম করছিল, তখন অতর্কিতভাবে একটি মিলিটারির টাক মিছিলের এক পাশে উঠিয়ে দেয়া হয়। ট্রাকের আঘাতে সরকারি নির্যাতনের শিকার হয়ে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন রিকশাচালক আবদুল আওয়াল। সরকারি প্রেস নােটে অবশ্য বলা হয়েছে, এটা নেহায়েত একটা সড়ক দুর্ঘটনা মাত্র। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, শােক।
মিছিল ছতভঙ্গ করতেই সরকারি নির্দেশে মিছিলের উপর দিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর ট্রাক চালিয়ে দেয়া হয়েছিল। আবদুল আওয়ালের সাথে সেদিন কার্জন হল এলাকায় আরও নাম-পরিচয়হীন এক বালকও ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে শহীদ হয়েছিল। আবদুল আওয়াল ছিলেন বিবাহিত। বসিরন নামে তার ৬ বছরের একটি কন্যাসন্তানও ছিল। ভাষাশহীদ আবদুল আওয়াল সম্পকে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক বলেন, দৈনিক আজাদ এব দৈনিক মিল্লাতে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায় যে, ২২ ফেব্রুয়ারি রিকশাচালক আবদুল আওয়াল (রিকশা লাইসেন্স নং-৩৪০২) গুলিতে নিহত হন (সূত্র : ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব, পৃষ্ঠা-৯৭)। তিনি আরও বলেন, ভাষা আন্দোলনে আবদুল আওয়াল নামে একজন রিকশাচালক ২২ ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) নবাবপুর রােডে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তার পিতার নাম মােহাম্মদ হালিম। তাকে আজিমপুর গােরস্থানে সরকারি তত্ত্বাবধানে অজ্ঞাত স্থানে সমাহিত করা হয়। (সূত্র : ভাষা আন্দোলন ও ভাষাসংগ্রামীগণ পূর্বোক্ত পৃ-২৬)।
বশীর আল হেলাল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৪৮৩) বলেন, ‘আবদুল আওয়াল সম্পকে উক্ত সরকারি বিবরণে বলা হয় : মােহাম্মদ হাশিমের ছেলে মােটর দুর্ঘটনায় মারা যান। জনাব ওবায়দুল্লাহর উপস্থিতিতে পূর্বোক্ত ইমামই তাহার জানাজা পড়েন।

ভাষাশহীদ আবদুল আওয়ালের কন্যা বসিরনকে দিয়ে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন
বর্তমান শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ভাষাশহীদ আবদুল আওয়ালের ৬ বছরের কন্যা বসিরন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, “শহীদ মিনারের স্থান নির্বাচন সম্পর্কে ছাপ্পান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি সংবাদে লেখা হয়, এপিপি পরিবেশিত এক খবরে বলা হইয়াছে যে, পূর্ত সচিব (মন্ত্রী) জনাব আবদুল সালাম খান মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে ‘শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য চূড়ান্তভাবে একটি স্থান নির্বাচন, এবং পরিকল্পনা প্রণয়ন করিয়া উহা যত সত্বর সম্ভব সরকারের নিকট পেশ করার জন্য সরকারি স্থপতিকে নির্দেশ দিয়াছেন।
পূর্তমন্ত্রী আবদুস সালাম কর্তৃক শহীদ মিনারের স্থান নির্বাচন এবং পরের দিন। অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের উদ্যোগ আয়ােজন করার সংবাদটিতে প্রচার হয়ে পড়ে যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের যে স্থানটিতে পুলিশের গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত নিহত হইয়াছিলেন সেখানে সরকার রাতারাতি একটি শহীদ মিনার’ গড়িবার আয়ােজন করিতেছেন। খবরটি প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক বিরাট জনতা ঘটনাস্থলে ভিড় জমাইয়া দেখিতে পায় যে জনৈক মন্ত্রী প্রস্তাবিত মিনারটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন প্রস্তুত হইতেছেন। জনতা ইহাতে প্রবল আপত্তি জানায়… ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ রিকশাচালক আওয়ালের ৬ বৎসর বয়স্কা কন্যা বসিরনকে দিয়া জনতা ইহার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করায়। এভাবে ছাপ্পান্ন সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্রজনতা কর্তৃক বায়ান্নোর শহীদ আওয়ালের কন্যা বসিরনকে দিয়ে অনানুষ্ঠানিকভঅবে বর্তমানে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। (সূত্র : অমর একুশে ও শহীদ মিনার, পরমা, ফেব্রুয়ারি, পৃ-৫০-৫১)

ভাষাশহীদ সিরাজুদ্দিন
১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সিরাজুদ্দিন নবাবপুরে ‘নিশাত’ সিনেমা হলের | বিপরীত দিকে মিছিলে থাকা অবস্থায় টহলরত ইপিআর জওয়ানের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন। মিছিলে তার সহযাত্রী কলতাবাজারের সেরাজুদ্দিন ওরফে নান্না মিয়ার সাক্ষ্যে জানা যায় তার আবাসস্থান ছিল বাসাবাড়ি লেন, তাঁতিবাজার। দৈনিক আজাদের প্রতিবেদনেও উল্লিখিত স্থানে এক যুবকের গুলিবিদ্ধ হবার খবর রয়েছে। এ সম্পর্কে এর বেশি কোনাে তথ্য জানা যায়নি। তবে ভাষাশহীদ সিরাজুদ্দিন-এর তথ্য উদঘাটন করার ব্যাপারে ভাষাসংগ্রামী, লেখক ও গবেষক আহমদ রফিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার সংগৃহীত গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে তিনি ১৯৭৫ সালের দৈনিক বাংলা পত্রিকার একুশে সংখ্যায় ‘ইতিহাস : মিছিলে হারানাে নাম’ শিরােনাম একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। উক্ত প্রবন্ধে সিরাজুদ্দিন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংযােজন করা হয়েছে।
তাছাড়াও আহমদ রফিক ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব’ শীর্ষক গ্রন্থে (পৃ : ৯৭) বলেন, “কলতাবাজার মহল্লার অধিবাসী সেরাজুদ্দিন ওরফে নান্না মিয়া একাধিক মৃত্যুর ঘটনা উল্লেখ করেছেন তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে। তিনি ১৯৭২ সালে (তিনি তখন স্টেডিয়ামে দোকান-ব্যবসা চালান) এক সাক্ষাৎকারে লেখককে জানান যে, তিনি বাবুবাজার থেকেই চলমান মিছিলে অংশ নিয়ে সদরঘাটে রাস্তার মােড়ে পৌছান। সেখান থেকে ভিক্টোরিয়া (বাহাদুর শাহ পার্ক হয়ে রথখােলায় পৌছাতেই দেখেন চকচকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সেনাবাহিনীর কয়েকজন জওয়ান ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে। তা সত্ত্বেও মিছিল স্লোগানে রাজপথ মুখরিত করে এগিয়ে চলে।
সেরাজুদ্দিন মিছিলে চলতে চলতে দেখতে পান উল্টো দিক থেকে সৈন্য বােঝাই একটি ট্রাক ‘চৌধুরী সাইকেল মার্ট বরাবর এসে থেমে যায়। এদিকে ‘মানসী’ সিনেমা হলের গলি থেকে পুলিশ ও জওয়ানদের একটি অংশ গলির মুখে এসে দাঁড়ায়। তখনি ট্রাক থেকে গুলি ছুটে আসে মিছিল লক্ষ্য করে। তার কিছু দূরে একজন তরুণ গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। শার্ট-প্যান্ট পরা ঐ তরুণের কোমরের উপর গুলি লাগে। রক্তে কাপড় ভিজে যায়। ঐ মিছিলের কয়েকজন তাকে ধরাধরি করে মানসী’র গলিপথে নিয়ে বলে যায় তরুণেরও নাম সিরাজুদ্দিন, ঠিকানা বাসাবাড়ি লেন, তাঁতিবাজার।

সেরাজুদ্দিন এরপর গুলিতে লাঠিচার্জে ছত্রভঙ্গ মিছিলের একাংশের সঙ্গে ‘মানসী’-র গলিপথ ধরে বংশালের দিকে চলে যায়। নবাবপুর রােড ধরে চলতে ভরসা পাননি তিনি। সেরাজুদ্দিন আরাে জানান, মিছিল থেকেই তিনি দেখেছেন নবাবপুরে স্টুডিও এইচ এর সামনে গুলিতে একজনকে আহত হতে। সেখানে রাস্তায় দাঁড়ানাে লাইটপােস্টে বুলেটের ক্ষতিচিহ্ন বহুদিন ছিল। নবাবপুর দিয়ে পরবর্তীকালে আসা যাওয়ার পথে বুলেটের সেই চিহ্ন তাকে বহুদিন ২২ ফেব্রুয়ারির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। অরাজনৈতিক এই যুবা নিছক একুশে ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণ ও আবেগের টানে পরদিনের মিছিলে শামিল হন।
সেরাজুদ্দিন ওরফে নান্না মিয়া ছিলেন ভাষাশহীদ সিরাজুদ্দিন এর মৃত্যুদৃশ্য প্রত্যক্ষকারী একমাত্র সাক্ষী। ভাষা সংগ্রামী লেখক ও গবেষক আহমদ রফিক ১৯৭২ সালে নান্না মিয়ার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারের ভাষাশহীদ সেরাজুদ্দিন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। উক্ত সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে আহমদ রফিক ‘ইতিহাস : মিছিলে হারানাে নাম’ শিরােনাম একটি প্রবন্ধ লেখেন, যেটি ১৯৭৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। উক্ত প্রবন্ধের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ তুলে ধরা হলাে : … বাইশে ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) শাণিত জল্লাদ দিনটি বাস্তবিকই ছিল কল-গর্জন-মুখর। বিশাল ধনুকের ছিলার মতাে টান টান। ইস্পাতের ঝলসানি নিয়ে নিষ্ঠুর রােদ সকাল থেকেই হেঁটে বেড়াচ্ছিল কালাে পিচের ওপর। সামরিক বাহিনী মােতায়েন, ১৪৪ ধারা …কাফু…. ইতাদি কিছুই যেন শহরটিকে স্পর্শ করছে না। স্বতঃস্ফূর্ত জলপ্রপাতের মতাে মানুষ সব কিছু অগ্রাহ করে বেরিয়ে পড়েছে। সে দিনের ঢাকা ছিল মিছিলের শহর … মিছিলে ভেসে নিজের অজান্তেই সদরঘাট বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছে যায় নান্না। ঘাের লাগে তার চোখে। ছােট্ট একটি দলের সাথে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। রায়সাহেব বাজারের পুলের একপাশে দাঁড়িয়ে চারদিকটা একবার দেখে নেয়। একটু এগােয় সে, রথখােলার মােড়ে টাক ভর্তি সামরিক বাহিনীর জওয়ান সশস্ত্র, উদ্ধত, যেন কারাে প্রতীক্ষায় তৈরি, পেছন ফেরে সে। মিছিল আসছে একটা বাহাদুর শাহ পার্কের দিক থেকে। চারজনের সারিতে বিনস্ত বলিষ্ঠ পৃথুল অবয়ব, স্লোগানে, গর্জনে দৃপ্ত পদক্ষেপের ভঙ্গিতে যেন একটি সশস্ত্র জলপ্রপাত। মনে সাহস জোগায়। দেখতে দেখতে রক্তে নেশা ধরে যায়। কী এক আকর্ষণে মিছিলে নেমে পড়ে নান্না। সুদীঘ বিশাল জনস্রোত এঁকে বেঁকে এগিয়ে চলেছে দ্রুত পায়। রথখােলা পেরিয়ে গেল-ওরা চেয়ে ছিল তীক্ষ্ণ চোখে। কিন্তু কই ওরা বাধা দেয়নি তাে, কিন্তু আরও বিস্ময় বাকি ছিল তার জন্য। কিছু দূর এগিয়ে যেতেই ওর চোখে পড়ল উত্তর দিক থেকে সৈন্য বােঝাই একটি ট্রাক আসছে, তখনি পেরিয়ে যাচ্ছে মিছিল। কিন্তু না চৌধুরী সাইকেল কোম্পানি বরাবর এসে হঠাৎ সেটা থমকে দাঁড়াল। জওয়ানগুলােকে পজিশন নিতে দেখেই চমকে উঠে নান্না। ওর সজাগ দৃষ্টি বরাবরই ন্যস্ত ছিল ওদের উপর। ঘাড় বাড়িয়ে দেখে মিছিলের মুখ ইতােমধ্যে মতিলাল পেরিয়ে গেছে। অই নিরস্ত্র প্রতিরােধের হিংস্র জবাব দিতে কি তৈরি হচ্ছে ওরা। ইতিমধ্যে কেমন করে জানি মিছিলেরও সে চেতনা সঞ্চারিত হয়ে গেছে। মিছিল দ্রুত এক সারিতে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু নিজেদের বিন্যস্ত করার কাজ শেষ হওয়ার আগেই সশস্ত্র গর্জনে আসে মৃত্যুএরই মধ্যে কখন যেন নিশাত সিনেমার গলিতে ঘাপটি মারা জওয়ান ও পুলিশদল রাস্তার ঠিক মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। বেশ হিসাব নিকাশ করা কাজ। ঠিক মিছিলের পাশেই কয়েকজন লুটিয়ে পড়ল মাটিতে আর তক্ষুনি ধুপধাপ ট্রাক থেকে নেমে এল কয়েকটি সশস্ত্র জওয়ান, পাশ থেকে কয়েকজন পুলিশ। উদ্দেশ্য মুমূর্ষ বা আহতদের নিয়ে পালাবে। কিন্তু ক্ষিপ্ত জনতা ছেড়ে দেবে না ওদের। আরাে কয়েক রাউন্ড সশব্দ ঝলকানি। স্টুডিও এইচ এর বন্ধ দরজা এবং সামনে লাইটপোেস্টটির দেহ ক্ষত-বিক্ষত করে কোন দিক দিয়ে যেন বেরিয়ে গেল। মিছিলে বিশৃঙ্খলা জেগে উঠেছে। ওর আশেপাশে এখন কোলাহল স্লোগান ইতস্তত ছােটাছুটি আরেকটি সশব্দ গর্জনের মাঝে হঠাৎ চোখে পড়ল পাশেই জোয়ান একটি ছেলে মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে। বুকটা ধপ করে বন্ধ হয়ে যেতে লাগলাে।
খােশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে কালাে পিচের সাদা শার্ট-প্যান্ট ক্রমেই লাল হয়ে যাচ্ছে। কোমরের ঠিক উপরে লেগেছে গুলিটা। কে যেন আটকে দিয়েছে নান্নার পা দুটো। নুয়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করল নাম। জবাব এল এক অচেনা স্বরধ্বনিতে। সিরাজুদ্দিন, বাসাবাড়ি লেন… ইত্যাদি। হঠাৎ চিৎকার শুনে সজাগ হলাে সে লাশ নিয়ে পালাচ্ছে শালারা, দ্রুত অপসৃয়মাণ ট্রাকের গর্জন, আর সেই সাথে অন্তত কয়েকটি ছাত্র-অছাত্র শহীদ নাম, কোনােদিন হয়ত জানা যাবে না। বুকটা মােচড় খেয়ে গেল তার।
কিন্তু সিরাজুদ্দিন? একে কেমন করে হাসপাতালে পাঠাবাে? শৃঙ্খল মিছিল এখন কিছুটা ছত্রভঙ্গ। কয়েকজন এগিয়ে এল তাকে ঘিরে। হা লক্ষ্মী বাজারের ছেলে ওরা, ঝুকে পড়ল অসহায় ওর মুখের ওপর। ওদের মধ্যে থেকে ইব্রাহিম ছুটে বেরিয়ে গেল। যে ভাবেই হােক বন্ধ গ্যারেজ মুখে একটা রিকশা বের করে আনতে হবে। এতদূর পথ কাঁধে ফেলে নেয়া যাবে না। ঝিমিয়ে পড়ছে সিরাজুদ্দিন। জামাটা আরাে লাল, মুখটা সাদা বিবর্ণ। নান্না এমন আর যেন মিছিলে নেই, ওর কানে ভাসছে ছেলেটির হতাশ কণ্ঠস্বর, চেনা পরিবেশে ফিরে যাবার ব্যাকুলতা, সিরাজুদ্দিনের রক্তমাখা শার্ট হাওয়ায় উড়ে মিছিলের পথ দেখাচ্ছে। সিরাজুদ্দিনের শার্ট মিছিলের মুখে রঙিন পতাকা, তাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতাে টেনে নিয়ে চলল, ওর শেষ কথা গুলাে তার কানে জল তরঙ্গের মতাে বেজে চলেছে। সিরাজুদ্দিন আরাে অনেকের সাথে একাকার হয়ে মিছিলের মুখ হয়ে গেছে।’

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!