You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ৬ই আগস্ট, মঙ্গলবার, ২০শে শ্রাবণ, ১৩৮১

রিলিফ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলবে না

স্মরণাতীতকাল এর ভয়াবহ বন্যার তান্ডব গত দুই সপ্তাহ ধরে যেমন ছিল, সেই বিভীষিকাময় অবস্থার পরিবর্তন এখনো ঘটেনি। উপরন্তু নতুন নতুন লোকালয়, জনপদ, শহর-বন্দর আর গ্রামের উপর সর্বগ্রাসী বন্যার উদ্যত বাহু বিস্তার করে আছে। এই মুহূর্তে স্পষ্ট করে বলা মুশকিল বানের পানি কবে নেমে যাবে। তবুও অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা মনে করছি এ ভয়াল বানের পানি অতি শীঘ্র নেমে যাবে এবং রেখে যাবে আমাদের জন্য বহুবিধ সমস্যার পাহাড়। ইতিমধ্যে আমরা খবর পেয়েছি, দুর্গত এলাকায় সংক্রামক ব্যাধির উপদ্রব শুরু হয়ে গেছে এবং ছয় শতাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। বন্যার পানি একেবারে শুকিয়ে গেলে দুর্গত এলাকার মানুষের দুর্দশা আরও কত শত গুণ বৃদ্ধি পাবে তা আশঙ্কা করে প্রতিটি বাঙালির প্রাণ বিচলিত হয়ে উঠেছে। বন্যা কবলিত এলাকা গুলোতে ত্রাণকার্য চলছে পুরোদমে এবং এই সাহায্য চলছে সম্পূর্ণভাবে সীমিত সাধ্যের মধ্যে থেকে। কারণ বিগত বছরগুলোর ন্যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আশানুরূপ সাহায্য এখনো আমরা পাইনি। তাই স্বনির্ভরতার মাধ্যমে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরশু দুর্গত এলাকা গুলো স্বচক্ষে দেখে এসেছেন এবং কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, যারা ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সরকারের দেয়া ত্রাণ সামগ্রী যাতে করে অভাব ও দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের কাছে পৌঁছায় তা নিশ্চিত করণের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এছাড়া বন্যার পানি শুকিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই যাতে কৃষকরা নতুন করে চাষ শুরু করতে পারেন, সে জন্য আগামী ১৫ই আগস্টের মধ্যে বিচার ব্যবস্থা করার জন্য জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু আশ্বাস দিয়ে বলেছেন যে, কৃষকরা যাতে বীজ ও চারা সংগ্রহ করতে পারেন সেজন্য সরকার সম্ভাব্য সব কিছুই করবেন। দূরদূরান্ত এবং মারাত্মকভাবে বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানোর ব্যাপারে সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করণের জন্য তিনি সেনাবাহিনী, বিডিআর এবং রক্ষী বাহিনীর প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।
ত্রাণকার্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে সে খবর অর্থ পত্রিকায় বারান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাদকীয়তেও ইতিমধ্যে নানাভাবে আমরা এ একই কথা ব্যক্ত করেছি। প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারিতে একথা সুস্পষ্ট যে, দুর্গত এলাকার জন্য বরাদ্দকৃত সাহায্য সামগ্রী নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু হয়েছে এবং দুষ্কর্মের তাদেরকে তিনি পরিণাম সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো, সমাজ ও মানবতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ এই প্রথমবার নয়। অতীতেও দেখেছি সরকারের তরফ থেকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দেওয়া সত্ত্বেও দুষ্কর্ম অব্যাহত রয়েছে এবং যার ফলে এ ধরণের হুঁশিয়ারীও সমাজ দস্যুদের গা সওয়া হয়ে গেছে। আইন ও তার প্রয়োগ এর ক্ষেত্রে কোন রকম তারতম্য ঘটলে সে আইনের যেমন কোন মূল্য থাকে না, বঙ্গবন্ধুর হুঁশিয়ারিও যেন ওই একই পন্থায় সমাজ শত্রুদের গা সওসা না হয়ে যায় সরকার প্রতি আমাদের সেই আবেদন। তবে বলার আমাদের আরো আছে। কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ যেমন একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তেমনি বন্যার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলা একা করা সরকারের পক্ষেও সম্ভব নয়। দলমত নির্বিশেষে সবাইকেই একাজে সরকারের নেতৃত্বে এগিয়ে আসতে হবে। সুষ্ঠুভাবে ত্রাণসামগ্রী যাতে প্রতিটি দুর্গত মানুষের কাছে যেতে পারে বাংলাদেশের প্রতিটি লোককে সেই কাজে উদ্বুদ্ধ এবং অনুপ্রাণিত হতে হবে।

আফ্রিকার উপনিবেশগুলোর স্বাধীনতা

পর্তুগিজ উপনিবেশ গুলোর স্বাধীনতা প্রাপ্তির খবর এবার সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। ৪ঠা আগস্ট জাতিসংঘ মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ডহেইম লিসবনে পর্তুগাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারিও সোরেসের সাথে দু’দফা অধিবেশনে মিলিত হন। এবং আলোচনা শেষে লিসবন ত্যাগের প্রাক্কালে এক যুক্ত ইশতেহারে প্রণীত হয়। এতে বলা হয়, পর্তুগাল, আফ্রিকান, উপনিবেশগুলো গিনি-বিসাউ ,মোজাম্বিক, কেপভার্দে দ্বীপ এবং শাওতোন ও প্রিন্স সাইপ দ্বীপকে স্বাধীনতা প্রদানে সরকারিভাবে সম্মত হয়েছে। ইশতেহারে আরও বলা হয়, পর্তুগিজ সরকার অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য গিনি-বিসাউ রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরে প্রস্তুত আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৭৩ সালে গিনি-বিসাউ স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং আফ্রিকান ঐক্য সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। এছাড়াও গিনি-বিসাউ বহির্বিশ্বের কতিপয় দেশের স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং এখনো কিছু সংখ্যক দেশ তাদের স্বীকৃতি দেবার কথা গুরুত্ব সহকারে ভাবছে। এই ইশতেহারে একথা বলা হয়েছে যে, পর্তুগিজ সরকারিভাবে জাতিসংঘ ভুক্তির ব্যাপারেও সহায়তা দান করবে।
সরকারি দলিল আরো উল্লেখ থাকে যে, প্রেসিডেন্ট স্পিনোলা দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকান উপনিবেশের ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য মোজাম্বিক মুক্তি সংস্থার সঙ্গে অবিলম্বে চুক্তিতে আবদ্ধ হবেন। ৩রা আগস্টের মোজাম্বিক হাইকমান্ডের এক ইসতেহারে উপনিবেশিক কয়েকটি এলাকায় গত কয়েকদিন থেকে যুদ্ধবিরতি পালিত হচ্ছে বলে জানানো হয়। অ্যাঙ্গোলার সঙ্গেও পর্তুগিজ সরকার সত্বর যোগাযোগ করবেন এবং অ্যাঙ্গোলার মুক্তি সংস্থা গুলোর সঙ্গে তাদেরকে স্বাধীনতা দেয়া প্রসঙ্গে পর্তুগাল বাস্তব ভিত্তিক আলোচনা চালাবেন বলেও দলিলে উল্লেখ করা হয়।
অবক্ষয়প্রাপ্ত সাম্রাজ্যবাদ শক্তির অবসান ঘটবে-এ হল উদার মানবতাশ্রয়ী সংবাদ। উপনিবেশের কাল মানুষরা আবার স্বাধীনতার আনন্দ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার লাভ করবে এবং তাদের এতদিনের মুক্তি সংগ্রামের ফসল ঘরে তুলতে পারবে-এই সুসংবাদ বিশ্বমানবতার কাছেও উল্লেখযোগ্য নয়। বিশেষ করে আমরাও একদিন উপনিবেশিক শাসনের পিষ্ট ছিলাম এবং অবশেষে মুক্তি সংগ্রামের সশস্ত্র পথ ধরেই স্বাধীনতার সুযোগে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। তাই আফ্রিকান উপনিবেশ গুলোর স্বাধীনতা লাভের বর্তমান আশ্বাসে আমরাও আনন্দিত।
তবে অতীতের দিকে তাকাবার প্রয়োজন আছে বৈকি! গত ২৫শে এপ্রিল পর্তুগালে সামরিক জান্তার শাসন ক্ষমতা হাতে নেবার পর পরেই স্পিনোলা সরকার গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার বড় বড় কথা শুনে ছিলেন। নতুন প্রতিশ্রুতির আশ্বাসে উপনিবেশগুলো একটুও যে আশান্বিত হয়েছিল সে কথাও সত্য। এরই প্রেক্ষিতে পর্তুগাল সামরিক জান্তা মুক্তিসংগ্রাম বন্ধের শর্ত দিয়ে উপনিবেশগুলো সঙ্গে তাদের দাবি-দাওয়া প্রশ্নে আলোচনায় বসতে চেয়েছিল। উপনিবেশ গুলির মুক্তি সেনানীরা তা প্রত্যাখান করে। ফলে জান্তার পরিকল্পনা পরিবর্তন করে।
অপরপক্ষে আভ্যন্তরীণ মতবিরোধ এবং উপনিবেশিক প্রসঙ্গের মীমাংসার পটভূমিতে স্পিনোলার মন্ত্রিসভা বাতিল করতে হলো। বিষয় সমাজ আর একবার পর্তুগালের প্রতি সহচকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। আবারো মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। এবারও ঠিক আগের মতোই পর্তুগিজ উপনিবেশ গুলোকে স্বাধীনতা দানের আশ্বাস দেওয়া হল।
প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যায়, উপনিবেশগুলো মুক্তির সংগ্রাম কোন অবস্থাতেই স্তিমিত করেনি মুক্তিসেনানীরা। মাতৃ মুক্তিপণে মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা, গিনি-বিসাউ ও কেপভার্দে মরণপণ সংগ্রামের দুর্জয় শপথের যুদ্ধরত ছিল ও আছে। স্বাধীনতার কোনো বিকল্প শর্তে তারা কোন অবস্থায় রাজি ছিল না-এখনও নেই। উপনিবেশ গুলোর অনমনীয় সংগ্রামী মনোভাব অবশেষে বিশ্ব সমাজকে ভাবিয়ে তুলেছিল। জাতিসংঘ মহাসচিব ও স্পিনোলা সরকারের প্রতি মানবতার দাবিতে উপনিবেশগুলো স্বাধীনতার দাবি মেনে নেয়ার জন্য চাপ দেন। তারই ফলশ্রুতিতে ৪ঠা আগস্ট এর এই-ঘোষণা পর্তুগিজ আফ্রিকান উপনিবেশগুলো স্বাধীনতা পাবে।
আজকের যান্ত্রিক জগতের শুধু কথায় বিশ্বাস রাখা যায় পর্তুগিজ সরকারের এ সিদ্ধান্তকে তাই অভিনন্দন জানালেও পরবর্তী পর্যায়ে তারা কি করছে আমরা তার ই প্রতি উদগ্রীব দৃষ্টি রেখেছি। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সুদিনটির জন্য অপেক্ষা করছি। ওরা স্বাধীনতা পাক -কালো মানুষেরা সমস্ত মানবিক গুণাবলী নিয়ে মানুষের মত বাঁচার অধিকার পাক। তাদের প্রতি সমগ্র বিশ্ব বিবেকের শুভকামনা আজ আশীষ ধারার মতো ঝরছে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!