দ্বিতীয় বিপ্লব
স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতীয় সংসদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করা হয়েছেঃ বাংলাদেশে প্রবর্তন করা হয়েছে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার। নতুন ব্যবস্থার প্রজাতন্ত্রের শাসন ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে। তিনি একজন উপ-রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী পরিষদ নিয়োগ করবেন। মন্ত্রিসভার একজন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। জাতীয় পরিষদে গৃহীত সংশোধনী আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি দেশে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল রাখার আদেশ দিতে পারবেন।
জাতীয় সংসদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার ফলে দেশের রাজনৈতিক জীবনে যে বিশাল পরিবর্তন সংঘটিত হল তা আপামর মানুষের জীবনে শান্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে বলে প্রতিটি মানুষের মনে দৃঢ় প্রত্যাশা রয়েছে। বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলায়, শৈথিল্য থেকে কর্মতৎপরতায়, অবক্ষয় থেকে সৃজনশীলতায়, হতাশা থেকে আশাময়তায় উত্তরণের জন্য এই তাৎপর্যমণ্ডিত পরিবর্তন। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, এই পরিবর্তন হচ্ছে তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লব। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলাই এই বিপ্লবের লক্ষ্য। শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে এই নতুন পদক্ষেপ।
আজকের এই পরিবর্তনের পটভূমি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বিগত তিন বছর ধরে এক শ্রেণীর মানুষের হাতে গণতান্ত্রিক অধিকারের অপব্যবহার ঘটেছে; দেশে সন্ত্রাসের আবহাওয়া সৃষ্টি করা হয়েছে। এক শ্রেণীর লোভী স্বার্থান্ধ মানুষ দুর্নীতির পিচ্ছিল, অন্ধকার, চোরাপথে গড়ে তুলেছে অবৈধ অর্থের স্তুপ। অন্যদিকে দেশের দরিদ্র, নিরীহ আইনমান্যকারী সাধারণ মানুষ তাদের এই হীন লোভের শিকার হয়েছে। ছিনিমিনি খেলা হয়েছে মুখের অন্ন নিয়ে, শিশুর খাদ্য নিয়ে, দরিদ্র মানুষের ভোগ্যপণ্য নিয়ে।
প্রতিটি মানুষ এই অবস্থার অবসান কামনা করেছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও প্রজ্ঞায় আস্থাশীল এদেশের মানুষ অপেক্ষা করেছে। তিনি নতুন বিপ্লবের ডাক দেবেন, সমাজের বুক থেকে দুষ্ট শক্তি উৎখাতের আহ্বান জানাবেন, সমগ্র জাতিকে নতুন জীবনের স্পর্শে স্পন্দিত করে তুলবেন। সেই প্রত্যাশিত আহ্বান আজ উচ্চারিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে দল, মত, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, দেশকে যারা ভালবাসেন, দেশের জন্য যাঁরা কাজ করতে চান, রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিতে যাঁরা বিশ্বাসী, তাঁরা সবাই এগিয়ে আসুন, দেশ গঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করুন। দেশের কল্যাণকামী প্রতিটি মানুষকে তাঁর এই আহ্বানে সাড়া দিতে হবে।
তাঁর নেতৃত্বে গড়ে তুলতে হবে সুখী, সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। জাতির জনকের ঔদার্য নিয়ে, ধৈর্য নিয়ে বঙ্গবন্ধু অপেক্ষা করেছেন, সুযোগ দিয়েছেন, ভ্রান্তপথগামী মানুষ হয়ত সংশোধিত হবে, দুষ্কৃতিকারীরা সংযত হবে। কিন্তু বিপথগামী দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিরা সেই ঔদার্যের ভিন্ন অর্থ করেছে, স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপের মাধ্যমে তারা অতিষ্ঠ করে তুলেছে জনজীবন। তাই দুঃখী মানুষের স্বার্থ রক্ষার্থে জাতির জনক এগিয়ে এসেছেন তাঁর স্বভাবসুলভ বলিষ্ঠ পদক্ষেপ, বৈপ্লবিক কর্মসূচী নিয়ে। এ কর্মসূচী বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা উচিত প্রতিটি মানুষের— তাদের আপন স্বার্থে, জাতীর স্বার্থে।
শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই সংবিধান সংশোধনের উদ্দেশ্য। যে গণতন্ত্র দেশ ও মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করে না, যে গণতন্ত্র জনগণের স্বার্থবিরোধী মহলকে সংযত করতে সক্ষম নয়, সে গণতন্ত্র সাধারণ মানুষের কাছে তাৎপর্যহীন। অর্থনৈতিক মুক্তির উপায় ছাড়া গণতন্ত্রের কথা অর্থহীন। সংবিধানের পরিবর্তনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু দেশের শোষিত মানুষের অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। দুর্নীতি, ঘুষ, চোরাচালান কালোবাজারী ইত্যাদি সমাজবিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্যে সর্বাত্মক অভিযান পরিচালিত হবে। দুষ্কৃতিকারীদের দমন করার জন্যে নেয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা। জনগণের দৃঢ় বিশ্বাস, দেশ জুড়ে সৃষ্টি হবে গঠনমূলক পরিবেশ। জনগণকে উপলব্ধি করতে হবে, নতুন ব্যবস্থায় তাদের প্রত্যেকটি শোষিত মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষিত।
জাতীয় সংসদে সংবিধানের সংশোধনী গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। দেশের দায়িত্ব ও শাসনক্ষমতা অর্পিত হয়েছে সেই অসামান্য মানুষটির উপর যিনি বাঙ্গালী জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে পরিচালিত করেছেন এবং পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টি করেছেন। দেশের মানুষ তাঁর উপর গভীরভাবে আস্থাবান, তাঁর নেতৃত্বে বিশ্বাসী, তাঁর উপরই সর্বময় দায়িত্ব ও ক্ষমতা ন্যস্ত করেছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিরূপে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করায় জনগণ যেমন আশ্বস্ত হবে, তেমনি তা জনগণের আস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দ্বিতীয় বিপ্লব সার্থক ও সফল করে তোলার দায়িত্ব প্রতিটি মানুষের। সৎ ও শুদ্ধভাবে প্রতিটি মানুষের এখন থেকে দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করা উচিত। দেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু প্রত্যাশিত পরিবর্তন সাধন করেছেন, রাষ্ট্রের কর্ণধাররূপে স্বয়ং দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, দলমত জাতিধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের প্রতি দিয়েছেন দেশ গঠনের ডাক। তাঁর এই বৈপ্লবিক পদক্ষেপ জনগণ কর্তৃক অভিনন্দিত হয়েছে, জনগণকে উদ্ধৃদ্ধ করে তুলেছে। বাংলাদেশের প্রতি গৃহ থেকে তাঁর এই আহ্বানে সাড়া ধ্বনিত হবে, এই দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের আছে। দ্বিতীয় বিপ্লব সাফল্যমন্ডিত হোক, বাংলাদেশের ইতিহাসে সংযোজিত হোক পরম উজ্জ্বল অধ্যায়। (দৈনিক বাংলা)