You dont have javascript enabled! Please enable it! ১ম পর্ব যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা - মেজর নাসির উদ্দিন - সংগ্রামের নোটবুক

মেইল ট্রেন একটানা ছুটে চলেছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রথম শ্রেণীর একটি কক্ষে আমি একা। সিলেট থেকে রংপুরে যাচ্ছি। মাঝখানে ট্রেন বদলির কারণে ঢাকায় কিছুক্ষণের জন্যে যাত্রা বিরতি। ঢাকা ছাড়ার পর এক ঘুমেই সকাল। এটেনডেন্টের ডাকাডাকিতে যখন ঘুম ভাঙলাে ট্রেন তার আগেই বাহাদুরাবাদ ঘাটে এসে থেমেছে। ওপারে ফুলছড়ি। নদী পারাপারের জন্যে ফেরী অপেক্ষা করছিলাে ঘাটেই। সকালের কাঁচা রােদ মাথায় করে সেই ফেরীতে গিয়ে উঠলাম। এক ঘন্টার জলপথ। তারপরই আবার ট্রেন যাত্রা শুরু। সময় আর কাটছিলাে না। যাত্রাপথ এমনিতেই দীর্ঘ। এই দীর্ঘতাকে সেদিন একটু বেশী প্রলম্বিত বলেই মনে হচ্ছিলাে। একটা বই খুলে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। বই বন্ধ করে অপলক তাকিয়ে আছি জানালার বাইরে। ভালই লাগছিলাে। আনমনে দেখছিলাম দূরের আকাশ। সবকিছু থেকে আকাশের বৈচিত্রই বেশী। কখনাে স্বচ্ছ নীল, আবার কখনাে হালকা মেঘ আর নীলের লুকোচুরি। সেখানে মেঘের রকম আর আকারেরও যেনাে শেষ নেই। মেঘের আকারকে কল্পনার আঙ্গিকে সহজেই যে কোনাে কিছুর সাথে এক করে দেখা যায়। খােলা মাঠের ভেতর দিয়ে সার বেঁধে হেঁটে যাওয়া গ্রামগুলাে ভীষণ ভালাে লাগছিলাে। এমন দৃশ্য দেখিনি গত প্রায় এক বছর। এই একটি বছরের মতাে আমার কেটেছে সেনা প্রশিক্ষণে পশ্চিম পাকিস্তানে। এই ভালাে লাগার পাশাপাশি ভেতরে ভেতরে আমি এক অনাগত ভবিষ্যতের আগাম শিহরণ অনুভব করছিলাম। এক ধরনের ভালাে লাগা বােধ এবং তার পাশাপাশি অজ্ঞাত ভবিতব্য—এই উভয় উপলব্ধি একই সাথে আমার ভেতর তােলপাড় করছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সেকেণ্ড লেফটেনান্ট হিসেবে কমিশন পাবার পর সিলেটে বাবামায়ের সান্নিধ্যে টানা ১৫ দিন ছুটি কাটিয়ে এই প্রথম চাকরিতে যােগ দিতে যাচ্ছি। এটা আমার চাকরি জীবনে প্রথম পােস্টিং, বাংলাদেশের একটি জেলা শহর রংপুরে অবস্থিত সেনানিবাসে। বিষয়টি ভাবতে আমার খুব ভালাে লাগছে এই জন্যে যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অফিসার হিসেবে চাকরি জীবনের প্রথম পােস্টিং পেলাম আমার নিজ জন্মভূমিতে। এদিক থেকে আমাকে খুব ভাগ্যবানই বলা যায়।

ভাগ্যবান আমি আরাে একটি কারণে। আর তা হচ্ছে আমার চাকরি জীবনের শুরুটাই হলাে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এলিট কোর’ হিসেবে পরিচিত সাঁজোয়া বাহিনীতে অথাৎ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্যাংক বহরের একটি রেজিমেন্টে। কখনাে বইয়ের পাতা উল্টিয়ে আবার কখনাে আকাশে মেঘের লুকোচুরি দেখে এবং গত এক বছরের অতীত ও আগামী সময়ের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে এক সময় হঠাৎ মনে হলাে ট্রেনের গতি শ্লথ হয়ে আসছে। কিছুটা ক্লান্তবেই ট্রেন রংপুর রেলস্টেশনে প্রবেশ করলাে। মধ্য এপ্রিলের একটি রােদলা বাসন্তী দুপুরে আমি রংপুরের লালরঙ্গা মাটিতে পা রাখলাম। স্টেশনে আমাকে স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করছিলাে সাজোয়া বাহিনীর কালাে ইউনিফর্ম পরিহিত লেফটেনান্ট সাজেদ মাহমুদ। ২৯ ক্যাভেলরী রেজিমেন্টের সুদর্শন এক পাঞ্জাবী অফিসার। আমাকে খুঁজে নিতে তার খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। সম্ভবতঃ আমার ছােটো করে ছাটা চুলের জন্যেই তা সহজতর ছিলাে। সহাস্যে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলাে সে। শুরুটা বেশ আনন্দঘন বলেই মনে হলাে। রংপুরে আমার সৈনিক জীবনের শুরু একটি অনাকাক্ষিত হোঁচটের মধ্যদিয়ে। এমন একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখােমুখি হতে হবে তা আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। একজন সদ্য কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারের কোনাে সেনা ইউনিটে যােগদানের পর প্রথমেই রেজিমেন্টের অধিনায়ক বা কমাণ্ডিং অফিসারের সাথে তার সৌজন্য সাক্ষাৎকার সেনাবাহিনীর প্রচলিত রেওয়াজেরই অংশবিশেষ। স্বাভাবিক নিয়মে আমাকেও কাজে যােগদানের পর রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসারের সাথে দেখা করতে যেতে হলাে। ঐ সময় ২৯ ক্যাভেলরী রেজিমেন্টের কমাণ্ডিং অফিসার ছিলেন লেফটেনান্ট কর্নেল সাগির হােসেন সৈয়দ। দীর্ঘদেহী এক পাঞ্জাবী সেনা অফিসার। ভারিক্তি মেজাজ, গম্ভীর ব্যক্তিত্ব এবং খুব সদাচারী মানুষ তিনি—অন্ততঃ প্রথম দর্শনে সে রকমটি মনে হবে। আমারও তাই হয়েছিলাে। কিন্তু তার আপাতঃ দৃশ্যমান সামগ্রিক ব্যক্তিত্বের আড়ালে আসল যে রূপটি লুকানাে ছিলাে, তা আবিষ্কার করতে খুব বেশী সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। প্রথম দিনের সাক্ষাতের সময়েই ওই লুকানাে রূপটি আমার পর্যবেক্ষণে আংশিক ধরা পরে।

আগের দিন নতুন তৈরী খাকি রংয়ের উর্দি যথারিতি আয়রণ করে পরিপাটি করা হয়েছে। শার্টের দুকাধে দুটো পিতলের তৈরী স্টার বসানাের কাজ সম্পন্ন করেছে আমার সদ্য নিয়ােগপ্রাপ্ত ব্যাটম্যান সফদর জামান। সে পাঞ্জাব প্রদেশের ঝেলামের অধিবাসী। রেজিমেন্টের ক্যান্টিন থেকে সে নিজেই স্টার দুটো আমার জন্যে নিয়ে এসেছিলাে। মনে হলাে তার জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞান আর পরম যত্ন দিয়ে সে স্টার দুটোকে ঘষেমেজে ঝকঝকে করছে। তারপর একসময় সফদর জামান বিদায় নিলে অনেকক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকলাম হ্যাঙ্গারে ঝােলানাে নিখুঁতভাবে প্রস্তুত উর্দির দিকে। দুর্কাধে দুটি পিতলের তৈরী স্টারের কি মাহাত্ব! ১৮ বছর আয়তনের জীবনের মধ্যে ৮ মাসের এই প্রশিক্ষণে জীবনের কতাে ত্যাগ-তিতিক্ষা আর গ্লানি জড়িয়ে আছে এই দুটি স্টারের প্রাপ্তির প্রক্রিয়ায়, তাই ভাবছিলাম। রাত পােহালেই প্রত্যাশিত সেই দিনটির আগমন ঘটবে। সকালে স্টার লাগানাে সেই উর্দি পরবাে। মেসের সামনে দাড়িয়ে থাকা গার্ড আমাকে দেখামাত্রই সােজা হয়ে দাড়িয়ে স্যালুট করবে। রেজিমেন্টের পথে যেতে যেতে এমনি অজস্র স্যালুটে ধয়েমুছে যাবে বিগত ৮ মাসের ক্লেদময় সব স্মৃতি। রেজিমেন্টে পৌঁছেই নির্ধারিত সাক্ষাতের জন্যে আমি কর্নেল সাগিরের দফতরে পৌছলাম । তার রুমে ঢুকে সামরিক কায়দায় অভিবাদন সেরে বসার অনুমতির অপেক্ষায় থাকলাম। কিছুটা বিলৰে আমার দিকে না তাকিয়ে তিনি বসার নির্দেশ দিলেন। এরপর টেবিলের ফাইলপত্র ঘাটতে ঘাটতে ঠিক একই ভঙ্গিতে প্রথম যে প্রশ্নটি করলেন, তা হলাে তােমার প্রিয় পানীয় কোনটি ? এই প্রশ্নে প্রথমে আমি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম। প্রথম সাক্ষাতের শুরুতে এমন একটি প্রশ্ন আমার মােটেও কাম্য ছিলাে না। কর্নেল টেবিলে মুখ রেখে আগের প্রশ্নটাই আবার একটু ঘুরিয়ে বললেন। কী ধরনের পানীয় তুমি পছন্দ কর? আমি এবারেও কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতাে চেয়ে থাকলাম। বেশ অনেকক্ষণ।

মনে মনে ভাবছিলাম কি জবাব দেয়া যায়। আসলে সে মুহূর্তে আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না তিনি আমার কাছে কোন পানীয়র বিষয়ে জানতে চাইছেন। কমাণ্ডিং অফিসারের সাথে দেখা করতে আসার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমার মধ্যে একটা সাধারণ ধারণা ছিলাে যে উনি বড় জোর আমাকে পারিবারিক কোনাে প্রশ্ন করবেন এবং সেই সাথে চাকরি সংক্রান্ত কোনাে সদুপদেশ দেবেন। অথবা এ জাতীয় অন্যকিছু। এ সব প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য সাধারণতঃ কোনাে পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়ােজন পড়ে না। কর্নেলের প্রথম প্রশ্নের জবাবে তাই আমি কিছুটা আমতা আমতা করে বললাম, পানীয় হিসেবে ফানটা স্কোয়াশ—এ সবই আমার পছন্দ। | বােঝা গেলাে কর্নেল সাগির আমার এ ধরনের উত্তরে মােটেও খুশী হতে পারেননি। এই প্রথম তিনি সরাসরি আমার দিকে তাকালেন এবং নির্বিকারভাবে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, আমি হার্ড ড্রিংকসের বিষয়ে তােমার পছন্দ-অপছন্দ জানতে চেয়েছি। সফট ড্রিংকস্ নয়। বুঝতে পেরেছাে? এবার আমার হতবাক হবার পালা। হার্ড ড্রিংকস্ সেনাবাহিনীতে তেমন দোষণীয় কিছু নয়। কিন্তু বােঝার বয়স হবার পর থেকে আমি কখনােই এ ধরনের কোনাে হার্ড ড্রিঙ্কসে আসক্ত হইনি। ছাত্র জীবনে তাে নয়ই। এমনকি সেনা প্রশিক্ষণে পাকিস্তানে অবস্থানকালেও এদিকে আমার আকাক্ষা তাড়িত হয়নি এবং তা সম্ভবও ছিলাে না। ফলে স্বভাবতঃই এ ব্যাপারে আমার কোনাে অভিজ্ঞতা থাকার কথা নয়। এমনকি ড্রিংকস্ সংক্রান্ত সাধারণ আলােচনায়ও আমার অংশ গ্রহণের স্মৃতি নিতান্তই সামান্য। যে কারণে যথারীতি বিনয়ের সাথে আমাকে বলতে হলাে, আমি কখনােই হার্ড ড্রিংকসে অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি স্যার। এ কথায় আবার আমার দিকে তাকালেন কর্নেল সাগির। কুঞ্চিত ভ্র। চোখেমুখে এক ধরনের বিস্ময়। কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন, হার্ড ড্রিংকসে অভ্যস্ত নয় এমন ধরনের অফিসারের কাজ করার সুযোেগ আমার রেজিমেন্টে নেই। চাওতাে আমি তােমাকে অন্যত্র বদলির ব্যবস্থা করে দিতে পারি। কথা বলা শেষ করে উত্তরের প্রত্যাশায় কর্নেল আমার দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইলেন। | বিস্ময়ের ঘাের আমার তখনাে কাটেনি। অসহায়ের মতাে আমিও তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সম্বিত ফিরে পেলাম প্রস্থানের নির্দেশে।

২৯ ক্যাভেলরী রেজিমেন্টের কমাণ্ডিং অফিসার কর্নেল সাগির হােসেন সৈয়দের সাথে প্রথম সাক্ষাৎকার এবং সেই সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে চাকরির প্রথম দিনটি আমার এভাবেই সমাপ্ত হলাে। এতে একদিকে অবশ্য ভালােই হয়েছিলাে-কল্পনার রাজ্য থেকে নিমিষেই ধরায় ফিরে আসতে পেরেছিলাম। আর তখন থেকেই শুরু হয়েছিলাে আমার সৈনিক জীবনের অস্থির যাত্রা। কার্যতঃ তখন থেকেই আমি জেনে গিয়েছিলাম যে আমার এই যাত্রা অনাগত দিনগুলােতে খুব একটা সুখকর কিংবা স্বাচ্ছন্দ্যময় হবে না। আরও জেনে গিয়েছিলাম যে আমি ব্যারাকের একটি সীমাবদ্ধ নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থেকে হৃদয়ের ভেতর স্বাধীনতা বা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবােধ নামের ক্ষুদ্র পাখিটিকে পােষ মানানােও সম্ভব হবে না। যেখানে নিজের মুখের খাবারটা পর্যন্ত নির্ধারিত হবে অন্যের ইচ্ছা এবং পছন্দ অনুযায়ী সে অবস্থানকে প্রকৃতপক্ষে একটি বন্দীশালা না বলে আর কিইবা বলা যায়। এ অবস্থায় আমার সামনে তখন দুটা মাত্র পথই খােলা থাকে। একটি হলাে নিজের সত্তা ও স্বকীয়তা বজায় রাং কন্যে সেনাবাহিনী থেকে বিদায় নেয়। আর অপরটি হলাে নিজের সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে অন্য দশ জনের মতাে গলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়া।  দেখতে দেখতে দুতিন দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেলাে। পরিবর্তিত জীবনযাত্রার সাথে একাত্ম। হবার চেষ্টার পাশাপাজি খলিত জীবনের বিপরীতমুখী স্রোতের প্রভাবে তখনাে আমি দোদুল্যমান। বিগত কয়েকদিনে এই দ্বিমুখী টানাপােড়েন সত্ত্বেও নিজেকে প্রবােধ দেয়ার চেষ্টা করেছি, অহরহ এবং একমাত্র বিকল্প হিসেবে সেনাবাহিনীর এই জীবনকেই মেনে নেয়ার চেষ্টা করেছি। কেননা ঠিক তখন থেকেই এই বোেধও আমার মধ্যে জেগেছিলাে যে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতে নিজেকে সমর্পণ করার চেয়ে এই সৈনিক জীবনকে প্রাধান্য দেয়ার মানসিক স্বামীর মধ্যে গড়ে নিতে হবে। | ভােরে স’ায় বাহিনীর জমকালাে উর্দি পরে যথারীতি ঘড়ির কাটা ধরেই রেজিমেন্টে এসেছি তারপর নিয়মমাফিক দিনের কাজকর্ম শেষ করে যথাসময়ে ফিরে গেছি অফিসার মেসে, এই দিনগুলােতে এম-২৪ সেফী ট্যাংকের নিপ্রাণ লােহালক্কড় আর যন্ত্রপাতির সান্নিধ্যেই কেটেছে বেশির ভাগ সময়। সুবােধ ঘােষের ‘অযান্ত্রিক’-এর মতাে লােহালক্কড়ের সাথে এক অদ্যান’ গইর ভালবাসায় নিজেকে যেনাে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছিলাম।

তিনটি ট্যাংকসহ জনা বিশেক বাঙালী-পাঞ্জাবী সংমিশ্রিত সৈন্যের একটি দলকে ইতিমধ্যে আমার অধীনস্থ করা হয়েছে। এই সেনাদল বা ট্যাংক টুপের নেতৃত্ব লাভের মধ্য দিয়েই শুরু হলাে আমার সেনা অফিসার জীবনের প্রথম অধ্যায়। ট্যাংক টুপের সৈন্যরা প্রতিদিন ভােরে আমার আগমনের সাথে সাথেই যথারীতি শখলার সাথে এক সারিতে দাঁড়িয়ে প্রথমে আমাকে অভিবাদন জানাতে। তারপর চলে যেতাে যে যার কাজে। বলা বাহুল্য এই শতহীন অভিবাদনটুকুই আমাকে স্বপ্নবিষ্টর মতাে মােহাচ্ছন্ন করে ফেলেছিলাে পরিবর্তিত এই জীবন প্রবাহের প্রতি। সেনাবাহিনীতে একজন অফিসার হিসেবে পরিতৃপ্তি লাভের সার্থকতা আপাত দৃষ্টিতে এই অভিবাদনটুকুর মধ্যেই সীমিত বলে মনে হলাে আমার। সৈনিকদের এই অভিবাদনের মধ্যে কোথাও এতটুকু কার্পণ্য বা শৈথিল্য নজরে আসেনি আমার। বরং মনে হয়েছে নেতৃত্বের প্রতি নির্দ্বিধা সমর্পণের এ যেনাে এক নিবেদিত মানসিকতারই যথার্থ। বহিপ্রকাশ। | ১৯ ক্যাভেলরা রেজিমেন্টে যােগদানপরবর্তী কয়েক দিনে রেজিমেন্টের সহকর্মীদের কেউ। কেউ স্বতঃপ্রণােদিত হয়ে পরিচিত হয়েছেন। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে আমি নিজে থেকেই পরিচিত হয়েছি তাদের সাথে। এই পরিচয় পর্বে একটি বিষয় প্রায়ই আমাকে ব্যথিত করতাে। আর তা হলো কোনাে কোনাে পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারের অহমিকাপূর্ণ আচরণ। এদের প্রায় প্রতিজ্ঞনের আচরণের মধ্যেই এক ধরনের অযাচিত দাম্ভিকতা লক্ষ্য করেছি—যা এর আগেও আমি এবার দেখেছি প্রশিক্ষণ শিবিরে অনেকের মধ্যেই। একজন সহকর্মীর প্রতি এ ধরনের আচরণ কখনােই আমার কাছে প্রত্যাশিত ছিলাে না। এটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি। যে শালীদের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করাটাই এই শ্রেণীর অফিসারদের স্বভাবজাত একটি। বিশেষ দিক। এদের চরিত্রে এই অনভিপ্রেত দাস্তিকতার উৎস আসলে তাদের রক্তের মধ্যেই নিহি। অথবা বলা যায় এটা তারা উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছে। এই শ্রেণীভুক্ত অফিসারদের প্রায় সকলে হয় আরাে ওপরের স্তরের সামরিক আমলাদের উত্তরসুরি নয়তাে বৃহৎ সামন্ত দুপানা অথবা ধনিক পরিবারের সন্তান-যারা একাধারে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের প্রতিভূ। এবং শােষক শ্রেণীর কর্ণধার।

ফলে রক্তের ধারাবাহিকতায় প্রাপ্ত এই উন্নাসিকতা সেনাবাহিনীতে এসেও তারা ত্যাগ করতে পারেনি। এরা সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি অভিজাত শ্রেণী হিসেবে নিজেদেরকে সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করার নিরলস প্রচেষ্টায় ব্যাপৃত থেকেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্মলগ্ন থেকেই। এটা আসলে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত নির্যাতক শ্রেণীর বৈষম্যমূলক আচরণেরই একটি দিক যা কেবল পাকিস্তান রাষ্ট্রের সামাজিক সমতার আদর্শকেই কলংকিত করেনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সমমর্যাদার কথিত আদর্শকেও কলুষিত করেছে সর্বত্রই। ইতিমধ্যে আমার চাকরি জীবনের প্রথম সপ্তাহের সমাপ্তি ঘটলাে। এরপর দ্বিতীয় সপ্তাহে | আরেকটি নতুন পর্বের অভিজ্ঞান এসে যােগ হলাে আমার পেশা জীবনের ব্যাপ্তির সাথে। সপ্তাহের শেষ দিন অর্থাৎ শনিবার সন্ধ্যায় নৈশ অনুষ্ঠানের আয়ােজন হয়েছে রংপুর সেনানিবাসের অফিসার মেসে। প্রত্যেক শনিবার সন্ধ্যায় যথারীতি অনুষ্ঠানের আয়ােজন সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিনের অনুসরণীয় ঐতিহ্য। এ ধরনের অনুষ্ঠান আসলে সেনা কর্মকর্তাদের একটি বিনােদনমূলক সম্মিলনেরই নামান্তর, যার মূল কর্মকাণ্ডের সাথে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মৌলিক আদর্শের প্রভেদ ছিলাে বিস্তর। আর এ ধরনের অনুষ্ঠানে আমার অংশ গ্রহণ এই প্রথম। । এ সব সপ্তাহান্তিক নৈশ অনুষ্ঠানে হরেক রকম সুরা পানের আয়ােজন তাে থাকেই, উপরন্তু একটি পর্যায় অতিক্রান্ত হওয়ার পর নারী সাহচর্যমূলক বিনােদনের ব্যবস্থাও এখানে একটি খুব সাধারণ ও প্রচলিত ব্যাপার। অথচ সামরিক একাডেমীতে প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময় এই আমাদেরকেই অর্থাৎ বর্তমানে যারা সেনাবাহিনীর অফিসার পদমর্যাদায় অভিষিক্ত, তাদেরকে সততা সচ্চারিত্রিক জীবনযাপন তথা ইসলামী জীবন বিধানের আওতায় আদর্শিক ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের ছবক দেয়া হতাে প্রতিনিয়ত। প্রশিক্ষণ জীবনের এই আক্ষরিক ছবক বাস্তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যে কতটা অর্থহীন তা আমি বুঝতে পারলাম প্রশিক্ষণ উত্তর আমার পেশাজীবনের শুরু থেকেই। T সন্ধ্যা নাগাদ নৈশ অনুষ্ঠানের পুরাে আয়ােজন প্রায় সমাপ্ত। অফিসার মেস সংলগ্ন বিশাল চত্বর জুড়ে লন চেয়ার পাতা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ একটি বারের ব্যবস্থা করা হয়েছে চত্বরের মাঝামাঝি স্থানে।

সেখানে বারম্যান বিভিন্ন প্রকার মদের সমাবেশ ঘটাতে ব্যস্ত। সম্ভবতঃ অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণই এটি। [ সূর্যাস্ত গেছে খানিকটা আগেই। চৈত্রের প্রচণ্ড গরমকে তুচ্ছ করে এ্যাবােটাবাদ থেকে অতি সম্প্রতি কেনা আমার একমাত্র লাউঞ্জ স্যুটটি পরে অভ্যাগতদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে প্রধান ফটকের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। সেখানে আরাে বেশ ক’জন জুনিয়র অফিসার অপেক্ষা করছে একই কারণে। রেওয়াজ অনুযায়ী সেনাবাহিনীতে জুনিয়ার অফিসাররাই অভ্যর্থনার দায়িত্ব পালন করে থাকে। এরই মধ্যে একজন ঊর্ধ্বতন পাঞ্জাবী অফিসার আমাকে আদ্যপান্ত পর্যবেক্ষণ শেষে টাইয়ের নটটি একটু সােজা করে দেয়ার চেষ্টা করলেন এবং মুখে সামান্য হাসির রেশ তুলে বিদায় হলেন। ভাবখানা এরকম যে আমার খুব বড় একটা ভুল ধরিয়ে দিতে পেরে তিনি ভারি পরিতৃপ্ত হয়েছেন। অথচ তার নিজের নটের অবস্থা ছিলাে আমারটির চেয়েও করুণ। কিন্তু কে তাকে ধরিয়ে দেয়। নীরবে আমার ত্রুটি মেনে নিলাম। সেনাবাহিনীর নিয়মই এমন যে উর্ধ্বতনরা সব সময়ই নির্ভুল। | অল্প সময়ের মধ্যে অভ্যাগতরা একে একে আসতে শুরু করলাে। প্রথমেই আসলেন ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেঃ কর্নেল এরশাদ। সাথে তার স্ত্রী রওশন। এরপর সস্ত্রীক গাড়ি থেকে নামলেন ২৩ পদাতিক ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ক্যানেণ্ডার। পরবর্তীতে এলেন ২৩ গােলন্দাজ ও ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের অধিনায়কদ্বয় এবং সেনানিবাসের অন্যান্য কর্মকর্তা। একই সময় কর্ণেল সাগিরও এলেন। স্মিত হাস্যে হেলেদুলে চত্বরের হালকা অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন কর্নেল সাগির।

এরই মধ্যে সামরিক বাহিনীর একটি জলপাই রঙের ঝকঝকে জীপ এসে থামলাে প্রধান ফটকের সামনে। মার্জিত পােশাকে সজ্জিত একজন মহিলা নেমে এলেন সেই জীপ থেকে। মনে হলাে মুহূর্তেই প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে রংপুরের সমস্ত সন্ধ্যা। এই মহিলাকে আমি এর আগে আর কখনাে দেখেছি বলে মনে হলাে না। কিন্তু সে সামনে এসেই সহাস্যে আমার নাম উচ্চারণ করে সাবলিল ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলাে, তােমার কথা আমি শুনেছি। তােমার সাথে পরিচিত হবার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম। তুমি নিশ্চয়ই আমার পরিচয় জানতে চাইবে। এটা আমার দুর্ভাগ্য কি সৌভাগ্য জানি না, আমি তােমার কমাণ্ডিং অফিসার কর্নেল সাগিরের স্ত্রী-সাদেকা। যাক সে কথা, কেমন আছাে? কেমন লাগছে সবকিছুএই জীবন? আমার অধিনায়কের স্ত্রী সাদেকা একনাগাড়ে এতগুলাে কথা বলে তার পরিচয় পর্বের পালা শেষ করলাে। ঔৎসুক্য নিয়ে অনেকেই শুনছে সাদেকাকে। তার বিমুগ্ধ করা উচ্ছাসিত বাচনভঙ্গি উপভােগ করছে সবাই। | আমি প্রথমতঃ কিছুই বললাম না, বলতে পারলাম না। শুধু দুচোখ ভরা অপার বিস্ময় নিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকলাম তার মুখের দিকে। অদ্ভুত রূপসী এই মহিলা। সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে পরিপূর্ণ যেনাে তার সমস্ত অবয়ব। দৃষ্টির পরিতৃপ্তি যেনাে এখানে পার পায় না। অব্যক্ত বােধ নীরব কাব্যে কেবলই আকুতি জানায়, থেমে থাক পৃথিবীটা এখানে এখন, অন্ততঃ কিছুক্ষণের জন্যে হলেও। সাদেকার কথা বলা শেষ হতে না হতেই তার সৌভাগ্যের সাথী কর্নেল সাগির আমাদের মাঝে এসে দাড়ালেন। হাতে তার পানপাত্র। তিনি তার ইষণীয় স্ত্রী সাদেকার সাথে আমাকে দ্বিতীয় দফায় পরিচয় করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন। আমার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ওর নাম নাসির। রেজিমেন্টের নতুন সংযােজন। ওর কথা আগেই তােমাকে বলেছি। এ পর্যন্ত এসেই কর্নেল সাগিরের মধ্যে তাচ্ছিল্যের সুর বেজে উঠলাে। তিনি চোখ ছােটো করে আমার দিকে তাকিয়ে সাদেকাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ও হ্যা, ও কিন্তু বাঙালী।

সাগিরের এই বাঙালী’ শব্দটির পুনরুক্তি করা বােধ করি তেমন প্রয়ােজন ছিলাে না। আমি যে বাঙালী এবং তার স্বজাতীয় নই এই সত্য কথাটি কোনাে সন্দেহ নেই যে তিনি আগেভাগেই সাদেকাকে জানিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তারপরও বাঙালী শব্দটি নিয়ে তাচ্ছিল্য করার সুযােগটি তিনি হাত ছাড়া করলেন না। বলাই বাহুল্য, কর্ণেল ইংরেজীতে কথা বলছিলেন। কিন্তু তার ইংরেজী বলার ঢংয়ে এবং উচ্চারিত শেষ বাক্যটির মধ্যে আমার জন্যে মনােক্ষুন্ন হবার মতাে যথেষ্ট কারণ ছিলাে। তার কথায় মনে হচ্ছিলাে বাঙালী হওয়াটাই যেনাে অপরাধ। জন্মসূত্রে বাঙালী হয়ে আমি যেনাে খুব একটা বড় ধরনের ভুল করে ফেলেছি। | কর্নেল সাগিরের এই আচরণে আমার সাথে সাথে সাদেকাও যেনাে খানিকটা বিব্রত হলাে। বিষয়টি সহজ করার জন্যে সহাস্যে বললাে, তােমাকে পেয়ে ভালােই হলাে। পূর্ব পাকিস্তান ঘুরে দেখবার জন্যে একজন সঙ্গী অন্ততঃ পেলাম। কর্নেল সহসাই তার কথার প্রসঙ্গ পাল্টে নিলেন। সাদেকার দিকে তাকিয়ে অভিযােগের সুরে বললেন, জানাে সাদেকা, এই ছােকড়া আবার মদে অভ্যস্ত নয়। অবিশ্বাস্য তাচ্ছিল্য তার চোখেমুখে। | আমি মদে অভ্যস্ত নই এটাও যেনাে কাঙ্খিত কোনাে আচরণ নয়। সেই তাচ্ছিল্য নিয়েই তিনি সরাসরি আমার দিকে তাকালেন। সাদেকাকে শুনিয়ে বললেন, আমি ওকে স্পষ্ট করে। বলে দিয়েছি মদপানে অভ্যস্ত হতে না পারলে আমার রেজিমেন্টে ওর কোনাে জায়গা হবে । আমি বরং ওকে ওর ইচ্ছে মতাে অন্যত্র বদলি হয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দেবাে। কর্নেল সাগিরের মুখের কথা শেষ না হতেই বিশালদেহী পাঞ্জাবী একচোখা ওয়েটার নজর আলী রকমারী মদে ভর্তি গ্লাস সাজিয়ে ট্রে হাতে আমাদের সামনে এসে দাড়ালাে। কর্নেল সাগির সেদিকে ইঙ্গিত করে আমাকে নির্দেশের স্বরে বললেন, তােমাকে এটা পান করতে হবে এবং তা এখনই। আমি খুব একটা অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলাম। কেননা ইতিপূর্বে এই ‘অতি প্রয়ােজনীয় বস্তুটি আমি কখনােই স্পর্শ করিনি এবং সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে হলে এই মদ পান করেই যে আর্মার্ড কোরে যােগ্যতার পরীক্ষা দিতে হবে এমনটিও কখনাে ভাবিনি। ফলে এক কঠিন এবং সম্পূর্ণ নতুন পরীক্ষার মধ্যে পড়ে যেতে হলাে আমাকে। শেষ পর্যন্ত কমাণ্ডিং অফিসারের কমাণ্ডিং ভয়েস অনুসরণ করতে গিয়ে দ্বিধান্বিত হাতে ওয়েটার নজর আলীর ট্রেতে সাজানাে একটি অপরিচিত মদ ভর্তি গ্লাস স্পর্শ করতে হলাে আমাকে।

আমার প্রতি সাগিরের এহেন কঠোরতার মধ্যে সাদেকাকে কিছুটা বিব্রত মনে হলেও আমাদের পাশে ট্রে হাতে স্থির দাড়িয়ে থাকা ওয়েটার নজর আলী কিন্তু ব্যাপারটি বেশ কৌতূহলের সাথেই উপভােগ করছিলাে। বিশালদেহী এই আদম সন্তান নজর আলী সারাক্ষণ তার এক চোখ খুলে উৎসাহ ছড়িয়ে দিচ্ছিলাে আমার দিকে। শেষ পর্যন্ত আমার হাত তার ট্রের দিকে প্রসারিত হলে সে যেনাে খানিকটা আশ্বস্তই হলাে। রাত বাড়ছে। সাথে সাথে গভীরতর হচ্ছে হল রুম থেকে ভেসে আসা পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্রের সুরেলা আওয়াজ। সারা হল রুম আর চত্বর জুড়ে মদের গ্লাস হাতে মানুষগুলাে তখন বেসামাল ‘। এক চোখা ওয়েটার নজর আলী তার সাজানাে ট্রে হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক হাত থেকে অন্য হাতে। সাদেকাকেও দেখলাম টেবিল বদলাচ্ছে ঘনঘন। মনে হলাে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে একটি ক্ষীণ আলাে জোনাকী উড়ে বেড়াচ্ছে চতুর্দিক সুবাসিত করে।  ক্রমেই পরিবেশ পৃথিবীর এক রহস্যময় আদিম মাদকতায় ভরে উঠছে। আর সাথে সাথে দুস্তর হচ্ছে শালীন মনুষ্য প্রবৃত্তির সাথে পাকিস্তানের সামরিক এলিটদের মধ্যকার ব্যবধান। নেশায় উন্মাতাল এখন সবাই। অপ্রকৃতস্থ মানুষগুলাের অকৃত্রিম সৈনিক বৃত্তির পদমর্যাদার এই স্খলিত অহংকার দেখে অবাক বিস্ময়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে রইলাম বাকি রাতটুকুর জন্যে। আর ঠিক এভাবেই যখন মধ্যরাত তখনই দেখা গেলাে সেই রহস্যময় আদিমতার ভেতর থেকে উঠে এলাে খ্রীষ্টীয় ঈভের নানা বর্ণ ও আকৃতির সব অপ্সরীরা। এই শহরের কোন স্থান থেকে এদের আগমন আমার জানা নেই। তবে ওই মুহুর্তেই বিষয়টি আমি সম্যক জেনেছিলাম যে সেনা অফিসার মেসের নৈশকালীন অনুষ্ঠান তখনাে শেষ হয়নি—তার আরাে একটি পর্যায় বাকি রয়ে গেছে, এখনই যার শুরু। নেশায় ডুবুডুবু বেসামাল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীর অফিসারদের একেকজন অসুরীদের একেকটিকে সাথে করে অস্পষ্ট আলােয়। সযত্নে নিজ নিজ আশ্রয়ে চলে যেতে শুরু করলাে। রাত শেষ হতে আর বেশী বাকি নেই। চত্বরের কোলাহল আর মদের মদির গন্ধ স্তীমিত হয়ে আসছে ক্রমেই।

ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে পশ্চিমা সংগীতের মুছনা এবং আমার। চারপাশে সব কিছুর এই হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে কখন হারিয়ে গেছে সফেদ পােশাকসজ্জিত একচক্ষু ওয়েটার নজর আলী খেয়ালই করিনি। যখন এইসব খেয়াল হলাে অবাক বিস্ময়ে দেখলাম সারা চত্বর জুড়ে আমি একা, আর কেউ নেই কোথাও। দুদশক আগে ৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে এই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি। যে আদর্শ আর। উপলব্বির ওপর ভিত্তি করে দেশটির পদচারনা তা ছিলাে “ইসলাম’। এই ‘ইসলামের মূল কথা হচ্ছে ঈমান সততা এবং শৃখলা। পাকিস্তান তার রাষ্ট্রীয় নীতিতে এই বৈশিষ্ট্যগুলাে অন্তর্ভুক্ত করেই যাত্রা শুরু করে। এই আদর্শের প্রবক্তারা যখন যেখানে সুযােগ পেয়েছে ইসলামের এই মর্মবাণী বােঝাতে সচেষ্ট হয়েছে দেশের জনগণকে। একইভাবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও গড়ে উঠেছে এই আদর্শেরই ওপর। যে কারণে সামরিক একাডেমীতে প্রশিক্ষণার্থীদেরকেও শেখানাে হয়েছে সমান সততা এবং শৃখলার বুলি। এই আমিও মাত্র সেদিন সেই একই আদর্শকেই পুঁজি করে এখানে এসেছি এর যথার্থ প্রয়ােগের জন্যে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এই আদর্শের বুলি যে কতােটা অর্থহীন তা বােঝাবার জন্যে কোনাে দৃষ্টান্ত প্রয়ােগের প্রয়ােজন পড়ে । এই বৈপরীত্যে এটাই প্রমাণিত হয় যে, মানব জীবনের এমন কোনাে কুরুচি নেই যার চর্চা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে হয় না। মদ এবং নারী সম্ভোগ থেকে শুরু করে ইন্দ্ৰীয় বৃত্তির প্রায় সকল নেতিবাচক দিকগুলােই তাদের চরিত্রে সম্পৃক্ত রয়েছে সমানভাবে। জীবনের অস্তঃপ্রবাহে এই সবই যেনাে বৈধ। কেবল বৈধ নয় এই সত্যতার স্বীকারােক্তি। শুধুমাত্র সেনাবাহিনীই নয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নীতিতেও এই স্বীকারােক্তি দোষণীয়। সেখানে অবৈধ সব কিছুরই চর্চা করা যাবে। কেবল যাবে না তাকে স্বীকার করা। স্বীকারােক্তির সময় বলতে হবে, আমরা মুসলমান এবং ইসলামী আদিশই হচ্ছে আমাদের একমাত্র অনুসরণীয় জীবন বিধান।

চার ডিসেম্বর, ১৯৮৮ সাল। বিক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তান। যেনাে হঠাৎ বিস্ফোরিত এক ভূমিকম্পের শব্দে নড়েচড়ে উঠলো পূর্ব পাকিস্তানের মাটি। আইউব বিরােধী আন্দোলনের গর্জনে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র তখন প্রকম্পিত। নিদ্রালু বাঙালীরা যেনাে হঠাৎ করেই জেগে উঠেছে। বলা যায় সে এক মহাজাগরণ। বাঙালী জাতিসত্তায় এ জাগরণ সূচিত হয় গত দুই দশকের লাগাতার পশ্চিমা শােষণকে কেন্দ্র করে। দেখতে দেখতে জনপদ মুখরিত হয়ে উঠলাে বিক্ষুদ্ধ জনতার মিছিলে, শ্লোগানে। শহরনগরীর রাজপথ রঞ্জিত হলাে নিরীহ বাঙালীর রক্তে। ধীরে ধীরে এই আন্দোলন এক ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলাে। জনগণের চেতনায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠলাে বাঙালী জাতীয়তাবাদ। পাকিস্তান নামক একটি ভৌগােলিক উপলব্ধির অভ্যন্তরে এতােদিনের লুকিয়ে থাকা পূর্ব বালাে’ তার সহাবস্থান গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে। এই গণজাগরণ কার্যতঃ প্রতিটি বাঙালীর  ঘরে ঘরে পৌঁছে দিলাে একটি আহবান, এবার আমরা হিসেব চাই, আর তােমাদের মানি না। | আমি সিলেট এম সি কলেজের ছাত্র। একাধারে অধ্যয়ন এবং সিলেট বেতারে অনুষ্ঠান ঘােষকের চাকরি। ছাত্র জীবনের একটি দীর্ঘ অধ্যায় কেটেছে আমার প্রত্যক্ষ রাজনীতির বাইরে—শুধুই বিদ্যাভ্যাসের মধ্য দিয়ে। কিন্তু ৬৮’তে এসে সেই আমার মধ্যেই হঠাৎ করে জেগে উঠলাে এতােদিনের ঘুমন্ত চৈতন্য। জড়িয়ে গেলাম সহসাই প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক তৎপরতায় । ৬৮-৬৯’র আন্দোলনে সিলেট কোনােক্রমেই পিছিয়ে ছিলাে না। আন্দোলনের পুরােভাগে সিলেটের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। প্রতিদিনই মিছিল মিটিং বিক্ষোভ। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে আমরা সিলেটের আন্দোলনকে একটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হলাম। সেই সাথে আন্দোলন সহিংস রূপও ধারণ করলাে। বিক্ষোভ চলাকালে একদিন ইপিআর এবং পুলিশের দু’টি জীপে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গুলিও বর্ষিত হলাে। ছাত্র-জনতার ওপর সিলেটে এই প্রথম গুলিবর্ষণ। ঠিক তার পরের দিন আমার বাবার এক সহকমী ও বন্ধু, যিনি পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে চাকরি করছিলেন, আমাকে অবিলম্বে সিলেট ছেড়ে গা ঢাকা দিতে বললেন। অন্যথায় সরকারী সম্পত্তিতে অগ্নিসংযােগের অভিযােগে আমার জন্যে নিশ্চিত হয়ে আছে কারাব্যস—তিনি এমন আভাসও দিলেন। | অনন্যোপায় হয়ে আমাকে শ্রীমংগলের নিকটবর্তী মধুপুর চা বাগানে গিয়ে আশ্রয় নিতে হলাে।

সেখানে আমার এক খালা থাকতেন। তার কর্তা ছিলেন চা বাগানের মহাব্যবস্থাপক। কিন্তু মধুপুরে সাতদিন যেতে না যেতেই অস্থির হয়ে উঠলাম। অপেক্ষাকৃত উত্তপ্ত ঘটনাপ্রবাহ থেকে যেনাে এক শীতল জীবনযাত্রার মধ্যে এসে পড়েছি। প্রকৃতির এই নীরবতা আর চা বাগানের একঘেয়েমীর মধ্যে আমি ক্রমেই হাপিয়ে উঠলাম। এক সময় হঠাৎ করেই আমি ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা তখন বিক্ষোভ আর। মিছিলের নগরী। প্রতিদিন মিছিল। হাজার হাজার মানুষের খণ্ড খণ্ড মিছিল। বিক্ষোভ পরিণত হয়েছে আন্দোলনে। আন্দোলন রূপ নিয়েছে গণঅভ্যুত্থানে। চারদিকে চাপা উত্তেজনা। স্বাধিকারের প্রশ্ন আপামর বাঙালীর কণ্ঠে একই ধ্বনি সােচ্চারিত সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে। | ঢাকায় অবস্থানকালে এ সময় একদিন চোখে পড়লাে পত্রিকার একটি বিজ্ঞাপন। পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীর ২১ ওয়ার কোর্সে কমিশন পদের জন্যে ক্যাডেট বাছাইয়ের প্রথম পর্বে মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে ঢাকা সেনানিবাসে। অনেক ভেবে-চিন্তে ইন্টারভিউ বাের্ডের মুখােমুখি হবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। জীবনের সবকিছু একই ধারায় প্রবাহিত হয় না। মানব চরিত্রের কিছু দিক আছে যা কখনাে কখনাে সঘাতপূর্ণ বলে মনে হয়, যার অর্থ খুঁজে পাওয়া বাস্তবিকই দুষ্কর। একদিকে যেমন ছিলাে আমার সেনাবাহিনীতে যােগদানের প্রবল স্পৃহা, ঠিক তার পাশাপাশি জন্মেছিলাে আন্দোলন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর প্রতি এক ধরনের চাপা বিদ্বেষ। সেনাবাহিনীতে প্রবেশের জন্যে ইন্টারভিউ বাের্ডের মুখােমুখি হবার সিদ্ধান্ত গ্রহণকে সেই মুহূর্তে আমার কাছে। কিছুটা আত্মহঠকারী বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু তারপরও আবাল্য লালিত সৈনিক জীবনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের একটি সুযােগ এসে গেলাে এভাবেই। | দেশব্যাপী তখনাে অপ্রতিরােদ্ধ গতিতে এগিয়ে চলছে গণআন্দোলন। জেগে ওঠা। রাজনৈতিক চেতনাবােধের পাশাপাশি আমার মধ্যে কাজ করছে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের অনিশ্চয়তার দুর্ভাবনা।

যে কারণে আমার আবাল্য লালিত সৈনিক হবার সুযােগকে কাজে লাগাবার দুর্বার তাড়নাও অনুভব করতে লাগলাম। চলমান গণজাগরণে গণমানুষের ভিড় থেকে যেনাে মনে হলাে বারবার আমার মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে প্রচণ্ড এক মানসিক দ্বন্দ্ব। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবার সীমিত আয়ের সংসারে প্রায়ই লেগে থাকা আর্থিক টানাপড়েনের করুণ চিত্র আমার সামনে অহরহ একটি যন্ত্রণা হয়েই ভেসে উঠছিলাে। এ অবস্থায় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি সেনাবাহিনীতে যােগ দেবাে। আসলে ব্যাপক হিসেব নিকেশ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযােগ বা সময় তখন ছিলাে না বললেই চলে। ছােটোবেলা থেকেই সৈনিক জীবনের প্রতি আমার দুর্বলতা ছিলাে প্রচণ্ড। পেশা হিসেবে এই জীবনকেই আমার কাছে মনে হতাে সব থেকে অধিক আকর্ষণীয়। আমার বাবাও ছিলেন সৈনিক। ব্রিটিশ ভারত সেনাবাহিনীতে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেশ কয়েক বছর চাকরি। করেছেন। ওই সময় তিনি আসাম ও বার্মায় জাপানের বিরুদ্ধে লড়েছেন। বলা যায়, সৈনিক জীবনের প্রতি আমার আবাল্য মােহাবিষ্টতার নেপথ্যে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই জীবনবােধও কাজ করেছিলাে বহুলাংশেই। সেই কৈশাের থেকেই নিয়ম শৃংখলিত সৈনিক। জীবন আমাকে আকর্ষণ করতে থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই স্পৃহাও বাড়তে থাকে। সমান তালে। আমার কৈশােরের একটি অংশ কেটেছে কুমিল্লায়। বাবা তখন চাকরি করতেন সেখানে। এ সময় আমি কুমিল্লার লেডী ফাতেমা স্কুলের ছাত্র। আমাদের নিবাস ছিলাে রেলস্টেশন সলগ্ন প্রফেসর পাড়াতে। এই স্টেশনে প্রায়ই কুমিল্লা সেনানিবাসের সৈনিকদের আনাগােনা চোখে পড়তাে আমার। রেলষ্টেশন থেকে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের দূরত্ব খুব একটা বেশী ছিলাে না। কোথাও যাতায়াতের জন্যে সৈনিকদেরকে এই রেলস্টেশনে আসতেই হতাে। সত্যি বলতে কি, সৈনিক জীবনের প্রতি এ সময় থেকেই আমার মধ্যে প্রচণ্ড দুর্বলতা জমে। উঠতে থাকে। রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে থাকতাম তাদের দিকে। কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে লক্ষ্য করতাম তাদের গতিবিধি। চোখেমুখে বিরাট বিস্ময় নিয়ে সেনাবাহিনীর অফিসারদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আনমনে ভেতরে রচনা করতাম আমার আগামী দিনের সৈনিক জীবন। এ সময় কেবলি মনে হতাে আমিও একদিন সৈনিক হবাে। | পরবর্তীকালে আমার এক নিকট আত্মীয় অফিসার হিসেবে যােগ দেন সেনাবাহিনীতে। ১৯৫১ সালে কুমিল্লায় ক্যাপ্টেন হিসেবে তাকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলাে। এই ঘটনা সৈনিক জীবনের প্রতি আমার উৎসাহ আরাে বাড়িয়ে দেয় এবং এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই পরবর্তী সময়ে আমি সৈনিক নিয়ম-শৃংখলার প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ের ছাত্র সংগঠন তৎকালীন ইউওটিসিতে যােগ দেই। বলা যায় প্রাক সৈনিক জীবন পর্বে এই ইউওটিসি জীবনের অধ্যবসায় এবং অনুশীলনই ছিলাে আমার ভবিষ্যৎ স্বপ্নের পরীক্ষা ক্ষেত্র। সম্ভবতঃ মানসিক ইচ্ছার দৃঢ়তাই এ ক্ষেত্রে আমাকে সহায়তা করে থাকবে। যে কারণে একজন বিশিষ্ট ইউওটিসি ক্যাডেট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতেও আমি সক্ষম হই।

১৯৬৯ সালের পহেলা জানুয়ারি। ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য ঢাকা সেনানিবাসে হাজির। হলাম। ইন্টারভিউ অনুষ্ঠিত হচ্ছিলাে সেনানিবাসের শেষ প্রান্তে অবস্থিত সিগনাল ব্যাটালিয়ান কেন্দ্রে। ইন্টারভিউ বাের্ডের পরিচালনায় ছিলেন ব্রিগেডিয়ার রাও ফরমান আলী খান। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন নির্ভরযােগ্য অফিসার হিসেবে তার সুনাম ছিলাে গােড়া। থেকেই। লম্বা টেবিলের দুপাশ জুড়ে বসে আছেন আরাে জনা ছয়ক বিভিন্ন পদের সেনা অফিসার। খুটিনাটি দু’একটা প্রশ্ন। কিন্তু তার বেশীর ভাগই ছিলাে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার  মতাে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিলাে প্রায় সকলেরই মুখ্য প্রশ্ন। অনায়াসেই প্রাথমিক যােগ্যতা যাচাইয়ের সবগুলাে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম। ঠিক এই সময় দেশে জারি হলাে ইয়াহিয়ার সামরিক আইন। ভাবলাম, আমার সৈনিক হবার স্বপ্ন বুঝি এখানেই শেষ। কিন্তু । ভবিতব্য আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করলাে। যথারীতি এবং যথাসময়ে আইএসএসবি’তে উপস্থিত হবার একটি চিঠি আমার হাতে এসে পৌঁছলাে। পরিশেষে ইন্টার সার্ভিসেস সিলেকশন বাের্ড কর্তৃক চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়ে সামরিক একাডেমীতে পাড়ি জমাবার কাক্সিক্ষত দিনটির জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলাম। ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি একটি দিনে কাকুল সামরিক একাডেমীর ২২ ওয়ার কোর্সে যােগ দেয়ার জন্যে এবােটাবাদে এসে পৌঁছলাম। কাছেই কাকুল সামরিক একাডেমী। পশ্চিম পাকিস্তানের হাজারা জেলার অন্তর্গত এই জায়গাটিকে খুবই চিত্তাকর্ষক মনে হলাে। চারদিকে পর্বতবেষ্টিত এক অপূর্ব সুন্দর উপত্যকা জুড়ে প্রশিক্ষণ শিবিরের অবস্থান। প্রাণবন্ত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি বাতাসেও যেনাে জীবনের গন্ধ। শ্বাস নিলেই মনে হয় জীবনটা ভরে উঠছে। চারদিকে সুউচ্চ পর্বতমালা। গ্রীষ্মকালেও দেখলাম সেগুলাের শিখর দেশ বরফে আচ্ছাদিত। চারপাশের প্রাকৃতিক নির্জনতা আর সৌরভ মিশ্রিত মৃদু বাতাসে শ্বাস টেনে মনে হলাে এখানে সুখ ছাড়া অন্য কিছু নেই। এমন একটি সুন্দর নৈসর্গিক পরিবেশবেষ্টিত কোমল অনুভূতি জাগানিয়া স্থানে কঠোর শৃঙ্খলাধীন এ ধরনের একটি প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপনের কর্তৃপক্ষীয় সিদ্ধান্তকে মনে মনে বেরসিক অখ্যা না দিয়ে পারলাম না।

তবুও এখানেই এ সুদৃশ্য নিসর্গ সৌন্দর্যের আঙিনাতেই মধ্য জুলাই থেকে শুরু হলাে আমার সামরিক জীবনের। প্রশিক্ষণ পর্ব। | কাকুল সামরিক একাডেমীর প্রথম কর্ম দিবসে একাডেমীর কর্মাধ্যক্ষ কর্নেল সাদুল্লাহ্ প্রশিক্ষণে অভ্যাগত নবীনদের উদ্দেশে স্বাগত ভাষণ দেন। ইংরেজীতে প্রদত্ত তার ভাষণটি ছিলাে প্রাণবন্ত এবং নাটকীয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দর্শন ছিলাে এই বক্তৃতার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। ঈমান একতা ও শৃংখলা—পাকিস্তানের জাতীয় মৌলিক আদর্শের কথা প্রাধান্য পেলাে তার বক্তৃতার শুরু থেকে শেষ অবধি। তিনি আবেগ জড়িত কণ্ঠে অভ্যাগতদের জানালেন যে দেশ এবং জাতি নবীনদের নেতৃত্বের প্রতি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। একই আবেগভরা কণ্ঠে তিনি ‘ইসলাম রক্ষার তাগিদের কথাও বললেন। তিনি এও বললেন, হিন্দু রাষ্ট্র ভারত পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি হুমকিস্বরূপ এবং সামরিকভাবে মােকাবেলাই ভারতকে শায়েস্তা করার একমাত্র পথ। ভারতীয় আগ্রাসন প্রতিহত করা এবং ভারত অধীকত কাশ্মীর মুক্ত করাই আজকের নবীন এবং আগামী দিনের সেনা অফিসারদের একমাত্র লক্ষ্য। বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি দৃঢ়তার সাথে জানালেন যে, একজন পাকিস্তানী সৈনিক অন্ততঃপক্ষে ১০ জন ভারতীয় সৈনিকের সমকক্ষ। সুতরাং সম্ভাব্য যে কোনাে পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের জয় একরকম অবধারিত আখ্যা দিয়ে কর্নেল সাদুল্লাহ তার দীর্ঘ বক্তৃতা শেষ করলেন এই বলে যে, তােমারা এখন থেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সেনাবাহিনীগুলাের একটিতে অন্তর্ভুক্ত হলে। বক্তৃতা শেষ করে সাদুল্লাহ সদম্ভে তাকালেন পার্শ্বে উপবিষ্ট তার সহকর্মীদের দিকে। সবার মুখেই ছিলাে তখন আত্মতৃপ্তির এক দুর্লভ হাসির ছটা। ২২ ওয়ার কোর্সে সম্ভবতঃ আমিই ছিলাম সর্ব কনিষ্ঠ প্রশিক্ষণার্থী। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর পরই এখানে আসার সুযােগটি ঘটেছে আমার। বয়স সবে আঠারাের সীমা পেরিয়েছে। এ বয়সে সেনা প্রশিক্ষণের মতাে কঠোর পরিশ্রমের কাজ কায়িকভাবে আমাকে দুর্বল করে ফেললাে। অল্প দিনেই কাবু হয়ে পড়লাম। এতােদিনের চিন্তা-চেতনায় লালিত সৈনিক জীবনের স্বপ্ন-সাধ সব ফিকে হয়ে আসতে শুরু করলাে। প্রায় দিনই প্রশিক্ষণ শেষে রাতে বিছানায় শুয়ে এ সব কথা ভেবে ভেবে চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়ে চললাম। নিসর্গের সকল শােভা, পর্বত শীর্থে জমে থাকা শুভ্র তুষার ঢেউয়ের সৌন্দর্য, সবুজ উপত্যকার স্নিগ্ন সােহাগ, ভাবী সৈনিক জীবনের মােহনীয় আকর্ষণ—সব কিছুই বিস্বাদ হয়ে উঠলাে। থেকে থেকে অতীতের সুখ-দুঃখের নানা স্মৃতি, আন্দোলন প্রতিরােধে জড়িত থাকা দিনগুলাের নানা কথা ভেতরে তােলপাড় করতে শুরু করলাে। কোনাে কোনাে সময় এমন ইচ্ছেও জাগতে শুরু করলাে যে প্রশিক্ষণ নিয়ে আর কাজ নেই।

কোনাে রকমে বাড়ি ফিরে যেতে পারলেই বাঁচি। মনে শান্তি নেই। বিমর্ষতা সার্বক্ষণিকভাবেই আমার ওপর ভর করে চললাে। প্রায়ই মনমরা থাকতে দেখে একদিন আমার এক সহকর্মী, সিনিয়র বাঙালী ক্যাডেট আমাকে ধরে বসলেন। স্নেহের সাথে জানতে চাইলেন আমার সার্বক্ষণিক বিষন্নতার কারণ। আমি তাকে আমার দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছের কথা খুলে বললাম। আমার কথা শুনে প্রথমে তিনি খুব। অবাক হয়ে তাকালেন আমার দিকে। পরে ধীরে ধীরে নানা কথা বলে আমাকে আশ্বস্ত করা। শুরু করলেন। অনেক কথার মধ্যে এক পর্যায়ে তিনি বললেন, আমাদের অর্থাৎ বাঙালীদের জন্যে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে চাকরির সুযােগ একটা বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার। এমনিতেই আমরা জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের তুলনায় পিছিয়ে আছি। এর পেছনে ক্রিয়াশীল রয়েছে বৈষম্য। যে বৈষম্যের কারণে আমাদের দেশের ব্যাপক জনমনে জন্ম নিয়েছে অন্তর্ভেদী বিক্ষোভ। এ অবস্থায় তুমি বাড়ি ফিরে গেলে সঙ্গত কারণেই পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন উঠবে যে সুযােগ দেয়া সত্ত্বেও সে সুযােগের সদ্ব্যবহার করার যােগ্যতা বাঙালীদের নেই। বিষয়টি হয়ে দাঁড়াবে পুরােপুরি রাজনৈতিক চালবাজির হাতিয়ার। আর তুমি এবং তােমার মতাে পিছুটান বাঙালীর কারণে গােটা বাঙালী জাতি হবে তার অসহায় শিকার। কাজেই তােমার ফিরে যাওয়া চলবে না। কথা হচ্ছিলাে প্রশিক্ষণ একাডেমীরই অভ্যন্তরে অবস্থিত একটি রেস্তোরাঁয় বসে। কথা শেষ করে তিনি আমাকে খুব করে খাইয়ে দিলেন। তার যৌক্তিক বিশ্লেষণ, সান্ত্বনা এবং সাহসপূর্ণ কথাবার্তা শুনে অলক্ষণের মধ্যেই নিজেকে ভীষণ হালকা মনে হলাে। ভেতরের অসহনীয় বেদনার ভার নিমেষে কোথায় যেনাে উবে গেলাে। ধীরে ধীরে মনে সাহস এবং বল ফিরে পেতে শুরু করলাম। ক্রমান্বয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে এলাে। সিদ্ধান্ত নিলাম। এভাবে বাড়ি ফিরে যাবাে না কিছুতেই। বহুল আকাক্ষিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে যােগ দেয়ার যে বিরল সুযােগ আমি পেয়েছি তাকে হেলায় হাতছাড়া করা যাবে না।

প্রশিক্ষণ এবং সামরিক কর্তৃপক্ষের আচরণ যতাে রুঢ়, শ্রমসাধ্য এবং কঠোই হােক না কেনাে আমাকে তা কাটিয়ে উঠতেই হবে। | পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক প্রশিক্ষণে আসার আগে পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র আন্দোলনের সাথে আমার যে প্রত্যক্ষ সংযােগ সাধিত হয়েছিলাে, প্রশিক্ষণে আসার পর তা আমার দৃষ্টি হাসি এবং চিন্তাভাবনাকে বেশি মাত্রায় রাজনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ করে তােলে। পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠীর ধারণা সম্পর্কে একটা নিজস্ব বিশ্লেষণ আমার আগেও ছিলাে। কিন্তু কাকুলের সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আসার পর প্রত্যক্ষ অভিঞ্জতার আলােকে আমার আগের সেই ধারণা এবার আরাে পরিপূর্ণ হলাে। দেখলাম, কাকুলের সামরিক একাডেমীও বৈষম্যের প্রশ্নে পিছিয়ে নেই। এখানে সাধারণতঃ কোনাে একটি কোর্সে গড়পরতা ১৫০ জন শিক্ষানবিস ক্যাডেটের মধ্যে বাঙালীর সংখ্যা প্রায়শঃই ৭ থেকে ৮ জনে সীমিত থাকতাে। খুব বেশি হলে এই সংখ্যা কখনাে সখনাে ১২ থেকে ১৫ পর্যন্ত উঠেছে, তার ওপরে নয়। এই স্বল্প সংখ্যকের ওপর আবার বাড়তি উপদ্রব ছিলাে ছাঁটাইয়ের। বিভিন্ন ছােটোখাটো অজুহাত দেখিয়ে প্রশিক্ষণ কোর্স থেকে যখন তখন বাঙালী ক্যাডেটদের নির্ধিধায় বের করে দেয়া হতাে। অথচ সমান অপরাধে কিংবা তার চেয়েও গুরুতর অপরাধে পশ্চিম পাকিস্তানী ক্যাডেটদের বের করে দেয়া। তাে দূরের কথা, প্রায় ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে কোনাে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হতাে না। এভাবে দেখা যেতাে যে প্রশিক্ষণ কোর্স শেষ হতে হতে একটি দলে হয়তাে বাঙালীর সংখ্যা কমে ন্যূনতম একটা অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বলাই বাহুল্য, বাঙালীদের প্রতি প্রদর্শিত বৈষম্য ধারায় আরােপিত অসংখ্য সূক্ষ্ম কৌশলের মধ্যে এটি একটি মাত্র।  ২২ ওয়ার কোর্সের এমন একটি ঘটনার কথা আমার জানা আছে যে ঘটনায় অত্যন্ত লঘু মাপের অপরাধে দুজন বাঙালী ক্যাডেটকে বহিস্কার করা হয়। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানী ক্যাডেটদের বেলায় অনুরূপ অপরাধ হিসেবের মধ্যেই গণ্য হতাে না। যেমন প্রশিক্ষণের মাঝামাঝি সময়ে একটি বিশেষ সামরিক মহড়া চলাকালে এক পশ্চিম পাকিস্তানী শিক্ষানবিস তার রাইফেলের বােল্ট হারিয়ে ফেলে। ওই ক্যাডেটকে এরপর লাণ্ডিকোটালের নিকটবর্তী উপজাতীয় এলাকা থেকে তার হারানাে বােল্ট সংগ্রহ করে ঘাটতি পূরণের সুযােগ দেয়া হয়। বাঙালীদের বেলায় এ ধরনের শৈথিল্য প্রদর্শনের কোনাে সুযােগই ছিলাে না।

কঠোর কর্তৃপক্ষীয় সিদ্ধান্তের ফলে একজন বাঙালী ক্যাডেটকে এ ক্ষেত্রে সন্দেহাতীতভাবেই একাডেমী থেকে বিদায় নিতে হতাে। খাবার সংগ্রহের প্রশ্নেও বাঙালী ক্যাডেটদের নানা ধরনের অবাঞ্ছিত বিদ্রুপের মুখে নাজেহাল হতে হয়েছে প্রায়শই। একাডেমীতে প্রশিক্ষণ শুরু হবার প্রথম দিকে আমাদেরকে ভাত দেয়া হতাে না। বাঙালীদের ভাত খাওয়া নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের অশালীন মন্তব্য একটি রেওয়াজে পরিণত হয়ে গিয়েছিলাে। এই বিতর্কে কখনাে কখনাে নৈতিকভাবে হেরে গেলে অন্য উপায়ে তারা বাঙালীদের জব্দ করে তার শােধ নিয়ে ছাড়তাে। এমন একটি ঘটনার কথা আমার আজও মনে আছে। একদিন কাকুল প্রশিক্ষণ শিবিরের অধিনায়ক জেনারেল বিলগ্রামী নিয়মমাফিক আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে এলেন। সাক্ষাতের এক পর্যায়ে ২২ ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণরত ক্যাডেটদের কোনাে অসুবিধা আছে কি না তা তিনি জানতে চাইলেন। আমি তাকে বিনয়ের সাথে জানালাম যে এখানে আমাদের অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানীদেরকে ভাত দেয়া হয় না। এটা আমাদের জন্যে একটি বড় ধরনের অসুবিধার কারণ। এ অভিযােগ শুনে জেনারেল প্রথমে কিছুটা বিব্রত বােধ করলেন বলে মনে হলো। কিন্তু কি ভেবে তিনি কোয়ার্টার মাস্টারকে তাৎক্ষণিক নির্দেশ দিলেন যেনাে আমাদেরকে রুটির সাথে ভাতও পরিবেশন করা হয়। কিন্তু এই ঘটনা পরবর্তীকালে যে পরিণাম বয়ে আনলাে তা আমাদের জন্যে আরাে বেশি হতাশার কারণ হয়ে দাড়ালাে। দেখা গেলাে পরদিন নিদেশ। অনুযায়ী ভাত ঠিকই পরিবেশন করা হয়েছে কিন্তু সে ভাত একেবারেই খাবার যােগ্য নয়। খুব নিম্ন মানের এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া চালের সেই ভাত থেকে এক ধরনের দুর্গন্ধ বের হচ্ছিলাে। খুব সম্ভব পশুখাদ্য হিসেবে সংরক্ষিত চালই আমাদের জন্যে বরাদ্দ হয়েছিলাে। অথচ কে না | জানে যে পশ্চিম পাকিস্তানে উৎকৃষ্ট মানের চাল জন্মে। প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের ন্যক্কারজনক আরও অনেক আচার আচরণ খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিলাে। পূর্বাঞ্চলীয়দের প্রতি তাদের অশালীন অঙ্গভঙ্গি এবং বাঙালীত্বের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন প্রায়ই যন্ত্রনার কারণ হয়ে দাড়াতাে।

আমার একজন ড্রিল ইস্ট্রাক্টর সুযােগ পেলেই এ ধরনের আচরণ করতেন। একাডেমীতে উপস্থিতির কিছুদিনের মধ্যেই তিনি একদিন আমাকে ‘কামিনে’ বলে গালি দেন। এই বিশেষ উর্দু শব্দটির মর্মার্থ না জানার কারণে সে সময় তা উপেক্ষা করতে আমার জন্যে সহজ হয়েছে। কিন্তু পরে আরাে একদিন এই ইন্সট্রাক্টর আমার জাতিসত্তা নিয়ে ব্যঙ্গ করে বললেন, সেনাবাহিনীতে অফিসার হওয়া তােমার কাজ নয়। তােমাকে তােমার দেশের জলায় মাছ ধরার জন্যে পাঠিয়ে দেয়াটাই হবে ঠিক কাজ। কথাটা তিনি এমনভাবে বললেন যেনাে মাছ ধরাটাই জাতিগতভাবে বাঙালীদের মূল পেশা। | পুরাে কোর্সের মধ্যে ক্যাডেট হিসেবে আমি ইতিমধ্যেই নিজের যােগ্যতা প্রমাণে সমর্থ হয়েছি। সুতরাং সেনাবাহিনীতে অফিসার হওয়া আমার কাজ নয় এই অভিযােগে অন্ততঃ আমাকে হেয় করা চলে না। অথচ ওই ইসট্রাক্টর কথাগুলাে এমন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে উচ্চারণ। করলেন যে তা শুনে আমি নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলাম না। অতীতেও এই ব্যক্তি বহুবার আমাকে এভাবে খোঁচা দিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু প্রায় প্রতিবারই প্রাণপণে আমি তা হজম করে গেছি। মাঝেমধ্যে মনের এই সব কষ্ট ধিক্কার আর যন্ত্রনা চেপে রাখতে গিয়ে মানসিক অস্থিরতায়ও ভুগেছি। | ড্রিল ইন্সট্রাক্টরের কথা শেষ হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই বেশ কঠোরভাবে তার জবাব দিলাম। বললাম যদি আবার কখনাে আমাকে এবং আমার জাতিসত্তাকে নিয়ে এ ধরনের ব্যঙ্গ করা হয় তাহলে বিষয়টি আমি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে বাধ্য হবাে। আমার এই স্পর্ধিত। জবাবে প্রথমে তিনি কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়েন। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে নিপ হয়ে যান। এরপর সেই ইন্ট্রাক্টর আর কখনাে অন্ততঃ আমার সাথে দুর্ব্যবহার করেন নি। | এখানেই শেষ নয়। কাকুলের সামরিক একাডেমীতে আরাে এক ধরনের বৈষম্য আমি লক্ষ্য করেছি। খুবই স্পষ্ট এবং ঘৃণিত বর্ণবাদী মানসিকতায় আক্রান্ত ছিলাে এখানকার সামরিক অফিসাররা। বাঙালীদের মিশ্র বা কালাে বর্ণের প্রতি তাদের অবজ্ঞা ছিলাে সুস্পষ্ট। সুযােগ পেলেই তারা এই বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে নানাভাবে বাঙালীদের হেয় এবং তুচ্ছ করার। প্রয়াস পেতাে। তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হতাে বাঙালীরা মনুষ্য জাতির পর্যায়ভুক্তই নয়। এদের জাতিগত পরিচয় হচ্ছে এরা নিকৃষ্টমানের জীব এবং ভিন্ন কোনাে জগৎ থেকে পাকিস্তানের পবিত্র(1) মাটিতে তাদের আবির্ভাব ঘটেছে।

পাশাপাশি নিজেদের জাতিসত্তা সম্বন্ধে তাদের ধ্যানধারণা ছিলাে একেবারেই অতিরঞ্জিত এবং কল্পনাপ্রসূত। তাদের আচরণ থেকে এটাই প্রতীয়মান হতাে যে নিজেদের জাতিসত্তার উৎপত্তিগত সত্য সম্পর্কে হয় তারা ছিলাে পুরােপুরি অঞ্জ নয়তাে সেই সত্যকে গায়ের জোরে উল্টে দেয়ার এক অন্ধ মাদকতায় পুঁদ হয়ে থাকাটাকেই তারা কর্তব্যজ্ঞান মনে করতাে। অথচ এটা ইতিহাসেরই কথা যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আক্রমণকারী বিদেশী জাতিগােষ্ঠীর রক্তের সংমিশ্রণেই উদ্ভব ঘটেছে পশ্চিম পাকিস্তানের তথাকথিত অভিজাত জনগােষ্ঠীর এক বৃহৎ অংশ। ভাবলে অবাক হতে হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে অর্থাৎ সিন্ধু প্রদেশের অধিবাসীদের গায়ের রং কুচকুচে কালাে। অথচ তাদের এই গাত্রবর্ণের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম কালাে হওয়া সত্ত্বেও বাঙালীদের গায়ের রং নিয়ে তাদের এলার্জির অন্ত ছিলাে না। | পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দাপ্তরিক কর্মকাণ্ডেও এই জাতি বৈষম্যের প্রতিফলন ঘটতাে। কাকুলে এ ধরনের একটি ঘটনা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যায়। একাডেমীর প্রশিক্ষণার্থী ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণের শুরুতেই কয়েকটি বিশেষ ফর্ম পূরণ করতে হতাে। এ ফর্মগুলােতে। একটি নির্দিষ্ট ঘর ছিলাে যেখানে শরীরের রঙ উল্লেখ করতে হতাে। আমি এই ঘরটি পূরণ করতে গিয়ে ইংরেজীতে লিখলাম ‘মিডিয়াম কমপ্লেকশন’। অর্থাৎ মিশ্র বর্ণ। আঞ্চলিক ভাষায় শ্যামলা। ফর্সাও নয়, আবার কালােও নয়—এ দুয়ের মাঝামাঝি পর্যায়ের একটি বড়–যা আমাদের দেশের গড় মানুষের শরীরের রঙের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অথচ এই শ্যামলা শব্দটি ব্যবহারেও তাদের আপত্তি। এই রঙটিকে তারা কালাে বলার পক্ষপাতী। যার ফলে দেখা গেলাে ওই একটি মাত্র ঘর পূরণ মনােপুত না হবার কারণে আমার গােটা ফর্মটিই ফেরত পাঠানাে হয়েছে তা পরিশুদ্ধ করে আবার লিখে পাঠাবার জন্যে। আমি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম ওই নিদিষ্ট ঘরটি লাল কালিতে কেটে দিয়ে গােলাকার রেখায় চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তার পাশে দুটি প্রশ্নবােধক চিহ্ন। ব্যাপারটির মর্মার্থ হলাে আমার শরীরের রঙ মিডিয়াম কমপ্লেকশন বা শ্যামলা হলেও তাদের চোখে তা আদৌ শ্যামলা নয়, কালাে। কাজেই আমাকে ‘ডাক’ বা ‘কালাে লিখতে হবে। প্রশিক্ষক প্লাটুন কমাণ্ডার মেজর শাহেদ আহম্মেদ আতাউল্লাহ এই নির্দেশ দিয়ে সাথে আরাে একটি নতুন ফর্ম পাঠিয়ে দিয়েছেন। এ অবস্থায় আমার জেদ বেড়ে গেলাে। আমি এবারাে ওই নির্দিষ্ট ঘরটিতে ‘কালাে’ না লিখে ‘মিডিয়াম কমপ্লেকশন’ লিখলাম এবং বাহক মারফত তা যথারীতি যথাস্থানে পাঠিয়ে দিলাম। আমার ধারণা ছিলাে ফর্মটি আবারাে ফেরত আসবে। কিন্তু এলাে না। কেননা এলাে না, জানি । পরবর্তী সময়ে তা জানার চেষ্টাও করিনি। কেননা ততােদিনে আমি তাদের এই বর্ণবাদী মানসিকতার পরিচয়ও মােটামুটি জেনে গেছি। এটা বেশ বুঝে গেছি যে সুযােগ পেলেই তারা বাঙালীদের লাঞ্ছিত করবে। |

প্রশিক্ষণের এক পর্যায়ে আমাদেরকে বিশেষ ট্রেনিংয়ের জন্যে তিন-চার দিনের মেয়াদে দুর্গম অঞ্চলে পাঠানাে হতাে। এই তিন-চার দিন প্রত্যেককে যার যার খাবারের ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হতাে। এ সময় দেখেছি পশ্চিম পাকিস্তানের ক্যাডেটরা প্রত্যেকে শুকনাে জাতীয় খাবার খেয়ে কোনাে রকমে সময় পার করে দিতাে। কিন্তু আমার পক্ষে এর কোনােটাই সম্ভব হতাে না। এ সময় আমি চিড়া ভিজিয়ে খেতাম। অসুবিধার কথা জেনে আমার বাবা কিছু চিড়া আমার জন্যে পাঠিয়েছিলেন সুদূর সিলেট থেকে। একদিন আমার এই চিড়া খাওয়ার দৃশ্য দেখে প্রশিক্ষক বিস্ময়ে যেনাে আকাশ থেকে পড়লেন। এটা কোনাে মানুষের খাবার হতে পারে তিনি তা মানতেই চাইলেন না। আমি তাকে খানিকটা খেয়ে দেখার প্রস্তাব করায় তিনি দারুণভাবে ক্ষেপে উঠলেন। বললেন, তােমার এই চিড়া খাওয়ার চেয়ে। আমি বরং বিষ খেতে রাজি আছি। তার এই কথায় অপ্রস্তুত হয়েছিলাম তবে দুঃখ পাইনি। এদের কারো কাছ থেকেই ভালাে কোনাে আচরণ পাবাে এমন প্রত্যাশা থেকে নিজেকে আমি মুক্ত করে নিতে পেরেছিলাম ততােদিনে। অথচ কেবল বাংলাদেশেই নয় পাশ্চাত্যের অনেক দেশে এই চিড়া বা ‘ফ্লাটেণ্ড রাইস’ একটি অতি সুস্বাদু খাবার হিসেবে সমাদৃত।

অন্য একদিন কোনাে এক অবসর মুহুর্তে একই প্রশিক্ষকের সাথে আমার কথা হচ্ছিলো। এখানে বলে নেয়া দরকার যে মেজর শাহেদ আহম্মেদ আতাউল্লাহ নামের এই প্রশিক্ষক চিরাচরিত বাক্তালী বিদ্বেষী হলেও মাঝে মাঝে আমার সাথে স্নেহপূর্ণ আচরণও করতেন। খুব সম্ভব প্রশিক্ষণ কোর্সে বয়সের দিক থেকে আমি সর্বকনিষ্ঠ ক্যাডেট হবার কারণে অথবা কোর্সে মােটামুটি ভালাে ক্যাডেট হিসেবে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবার কারণেই। এমনটি ঘটে থাকবে। মেজর শাহেদের সাথে কথাবার্তার এক পর্যায়ে খুব আন্তরিকভাবে প্রশ্ন করলাম, আপনি কখনাে পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছেন? জবাবে তিনি যা বললেন তা শুনে আমি রীতিমতাে চমকে উঠলাম। মনে পড়ে আজও তার সেই দাম্ভিক জবাব। তিনি বললেন, আল্লাহ যেনাে আমাকে কোনােদিন সেখানে না নেন। | সেদিন আমি তার সামনে আর কেনাে’ শব্দটিও উচ্চারণ করতে সাহসী হইনি। ইচ্ছেও জাগেনি। বাংলা ভাষার প্রতি শ্রেণী নির্বিশেষ প্রায় প্রতিটি পশ্চিম পাকিস্তানীর অশ্রদ্ধাবােধ ছিলাে বিস্ময়কর। বাঙালীদের প্রতি পুঞ্জীভূত ঘৃণাবােধ থেকেই সম্ভবতঃ তাদের এই আক্রোশের উৎসারণ। সেনা প্রশিক্ষণ শিবিরে ভাষাগত এই বৈষম্যের প্রকাশ ছিলাে তুলনামূলকভাবে অনেক। বেশি প্রকট। একাডেমীতে কখনাে দুজন বাঙালী একত্রিত হলে এবং তাদের মধ্যে কথােপকথন কোনাে ক্রমে বাংলায় হলে তা সহসাই পশ্চিম পাকিস্তানীদের আপত্তির কারণ। হয়ে দাঁড়াতাে। এ অবস্থায় প্রায়শই মনে করিয়ে দেয়া হতাে যে, ইংরেঞ্জীই হচ্ছে প্রশিক্ষণ শিবিরে কথা বলার একমাত্র বৈধ মাধ্যম। প্রশিক্ষণের এই ৮ মাসে আমাদের অনেককেই এই বিরূপ আচরণের শিকার হতে হয়েছে অনেকবার। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানীদের ক্ষেত্রে উর্দু পাঞ্জাবী পশতু বা সিন্ধী ভাষা ব্যবহারের অধিকার ছিলাে অবাধ। এটা কখনােই কারাে। আপত্তির কারণ হয়নি।

এ থেকে এমনটি মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে, এসব ভাষা রাষ্ট্রীয় আনুকুল্যেই সেনাবাহিনীতে প্রতিষ্ঠিত। বাংলা ভাষায় কথা বলা যাবে না—এই নিয়মের প্রবক্তাদেরকেও অর্থাৎ যারা একাডেমীর ইন্ট্রাক্টর তাদেরকেও প্রায়ই প্রকাশ্যে উর্দু ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানী প্রশিক্ষণার্থীদেরকে অনুশীলন সূচী বােঝাতে সচেষ্ট দেখা। গেছে।  ভাষাগত এই বৈষম্যের উৎসস্থল নিহিত মূলতঃ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নেতৃবর্গের রাজনৈতিক হীনমন্যতার মধ্যেই। পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্ণধার মােহাম্মদ আলা জিন্নাহকেই ভাষাগত বৈষম্যের প্রধান পৃষ্ঠপােষক বলা যায়। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে যাত্রা শুরুর প্রাথমিক পর্যায়েই পাকিস্তানের প্রাদেশিক জাতিসত্তাগুলাের স্বকিয়তা পদদলিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। পাকিস্তান অর্জনের এক বছরের মধ্যেই তিনি ঘােষণা করেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। তার মতে উপমহাদেশে উর্দুই একমাত্র মুসলমানী ভাষা এবং উর্দু ছাড়া অন্য কোনাে ভাষার এই মুসলমানিত্ব নেই। প্রসঙ্গতঃ মনে রাখা দরকার যে, ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান রাইটির প্রতিষ্ঠা হয় তখন  তার প্রদেশের সংখ্যা ছিলাে পাঁচটি এবং এই পাঁচটি প্রদেশেই আলাদা আলাদা জাতীয় ভাষা প্রচলিত ছিলাে। কিন্তু জাতিসত্তাসমূহের এই স্বকিয় ভাষার স্বীকৃতি সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে। গােটা পাকিস্তানের ওপর একতরফা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলাে উর্দু ভাষা। জাতিগত ভাষাসমূহের তুলনামূলক সমৃদ্ধি এবং ভাষাভাষীর সংখ্যাধিক্যের প্রশ্নে বাংলা ভাষার গুণগত প্রাধান্য থাকার কারণে উর্দুর পাশাপাশি মাতৃভাষার প্রতি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে প্রদেশগুলাের মধ্যে একমাত্র পূর্ব পাকিস্তানের জনগণই মরণপণ সংগ্রাম করে। পাক-ভারত উপমহাদেশেই শুধু নয় বিশ্বের ইতিহাসেও এই ঘটনার দৃষ্টান্ত বিরল।

কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের প্রস্তাবিত রাষ্ট্রীয় ভাষার সমর্থনে উর্দুকেই ইসলামী ভাষা হিসেবে দাবি করলেন এবং এর বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলায় যখন বাংলা ভাষার প্রতি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের দাবি উঠলাে তখন তারা এই ভাষাকে হিন্দুদের ভাষা বলে দোষারােপ করলেন। কেননা পাকিস্তান সৃষ্টির আদিকথা দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিচারে বাংলা হচ্ছে বিজাতীয় ভাষা। তাদের মতে এই ভাষা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের সংস্কৃত ভাষা থেকেই এসেছে। ফলে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে তাদের বক্তব্য অনুযায়ী বাংলা ভাষার কোনাে গ্রহণযােগ্যতা নেই। অথচ এই খােড়া যুক্তি বরং তাদের আঞ্চলিক ভাষা পাঞ্জাবীর ক্ষেত্রেই বেশি প্রযােজ্য। পাঞ্জাবী ভাষা পাকিস্তানের পশ্চিম পাঞ্জাবের মতােই ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবের বিশাল এক জনগােষ্ঠীর মধ্যেও প্রচলিত, যাদের প্রায় এক শ’ ভাগই অমুসলমান। এই অজুহাতে নিশ্চয়ই বলা যাবে না যে পাঞ্জাবী ভাষা বিধর্মী প্রভাবিত। মূল কথা পূর্ব বাংলার ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের অভিজাত চক্রের শােষণের ভিত্তিতে চাপিয়ে দেয়া আগ্রাসী নীতির এটি ছিলাে একটি অন্যতম দিক। কার্যতঃ এই আগ্রাসী নীতির কঠোর প্রয়ােগের মাধ্যমে তারা চেয়েছিলাে পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারী বাঙালী জনগােষ্ঠীর জাতিসত্তার যথাসম্ভব নিষ্কণ্টকিত পাকিস্তানীকরণ। পাকিস্তানের পাঁচটি অঞ্চলে বসবাসকারী মােট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা ছিলাে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে বাংলা বিশ্বের অষ্টম ভাষা হিসেবে নির্দিষ্ট। এ উপমহাদেশে যতােগুলাে ভাষার প্রচলন আছে তার মধ্যে বালাই একমাত্র ভাষা যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে। উপরন্তু এ ভাষার সাহিত্যিক মূল্যও সমসাময়িক অন্যান্য যে কোনাে ভাষার তুলনায় সমৃদ্ধ। বলা হয়েছিলাে বাংলা ভাষা একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। মর্যাদা পাবার যােগ্য নয়। অথচ কেবল ভাষাভাষীর সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবেই নয় সমৃদ্ধির বিচারেও সুদীর্ঘ দিনের ঐতিহ্যে লালিত এই বৈয়াকরণসিদ্ধ ভাষার সমমর্যাদার ভাষা উপমহাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। | উল্লেখ্য ৪৭’র ভারত বিভক্তির সময় সম্পূর্ণ একটি আলাদা জাতিসত্তার স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অবিভক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়েছিলাে।

যদি এই অবিভক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবি সেদিন কার্যকর হতাে তাহলে এটা কি কল্পনা করা যায় যে এই বাংলা ভাষার বাইরে অন্য কোনাে ভাষাকে সেই দেশের জাতীয় ভাষা কিংবা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হতাে? নিশ্চয়ই না। সেই যুক্ত বাংলারই বৃহত্তর অংশ ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয় পরিপূর্ণ আলাদা একটি জাতিসত্তা এবং ভাষার বৈশিষ্ট্য নিয়েই। ফলে ভাষা বৈশিষ্ট্য এবং জাতিসত্তার প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীরা পুরােপুরি স্বনির্ভর এটাই ঐতিহাসিক সত্য। এর বিপরীতে উর্দুকে বলা যায় একটি উপভাষা। ঐতিহাসিকভাবে এই ভাষার কোনাে একক উৎসভূমি নেই। ইতিহাসের কোনাে এক সময় এই ভাষার প্রচলন প্রথম শুরু হয় সেনাশিবিরে এবং এই সেনাশিবিরগুলােকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন ভাষাভাষী কিছু জনগােষ্ঠীর মধ্যে উর্দু বিস্তার লাভ করে বলে কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন। উদু হিন্দীরই একটি পরিভাষা’—এমন কথাও অনেকেই বলেন। উর্দু ভাষার হরফ ও লিখন পদ্ধতিতে আরবী ভাষার কৌশল লক্ষণীয় থাকার কারণে সম্ভবতঃ পরবর্তীকালে এই ভাষাকে মুসলমানদের ভাষা হিসেবে ইসলামীকরণ করা সহজ হয়ে পড়ে। ” গােটা পাকিস্তানে শতকরা মাত্র ছয় ভাগ মানুষের কথ্য ভাষা ছিলাে উর্দু। এই ছয় ভাগ। মানুষের অধিকাংশই ছিলাে আবার ভারত প্রত্যাগত বাস্তুত্যাগী। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটা ছিলাে পাকিস্তানের নিয়তি যে, এই ছয় ভাগ মানুষের প্রতিনিধিরাই ৪৭ সালে নবজাত এই রাষ্ট্রটির কেন্দ্রীয় ক্ষমতা এবং কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে প্রাদেশিক ক্ষমতাও কুক্ষিগত করে বসে। বিভিন্ন পেশার এই দখলদারী শ্রেণীকে পাকিস্তানের অভিজাত শ্রেণী হিসেবেও ধরে নেয়া যেতে পারে—যাদের মধ্যে ছিলাে রাজনীতিক, বেসামরিক ও সামরিক আমলা, আইন, ব্যবসায়ী। এবং সামন্ত ভূস্বামী। এই ক্ষমতালিসু সংখ্যালঘু মহল পাকিস্তানের শতকরা ৯৪ ভাগ মানুষের ওপর একটি মাত্র। শ্রেণী অভিজাতদের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে।

অথচ হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে এই উপমহাদেশে বসবাসকারী উর্দুভাষী জনগােষ্ঠীর একটি বৃহৎ অংশ তখনাে বসবাস করছে ভারতে। পাকিস্তানের কোনাে প্রদেশেই প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে এই ভাষার স্বীকৃতি কখনােই ছিলাে না এবং এখনাে নেই। আবার উর্দু যে মুসলমানদের ভাষা কিংবা ইসলামী ভাষা তার যুক্তি একেবারেই নেই। কেননা ইসলামী বিশ্বের একক কোনাে ভাষা নেই। সেখানে দেশগুলাের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান হলেও তাদের জাতীয় বা রাষ্ট্রভাষা পরস্পর আলাদা এবং নিজস্ব। তবে ‘ইসলাম’ এই ধমটির সমসাময়িক প্রচলিত ভাষা হিসেবে আরবী ভাষাকেই গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু উর্দুর সাথে এই আরবী ভাষার আদৌ কোনাে সম্পর্ক নেই।  পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রায়শঃই বলতে শােনা যেতাে যে, বাংলা ভাষা মুসলমানদের ভাষা নয়, এটা উপমহাদেশের দুি সম্প্রদায়ের ভাষা এবং হিন্দু পুরােহিতদের সংস্কৃত ভাষা থেকেই এর আগমন। বিষয়টি নিষ্পত্তির প্রয়ােজনে সংক্ষিপ্ত পরিসরে এটা খতিয়ে দেখা দরকার।  ভাষাতত্ত্বের বিচারে ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাই হচ্ছে আজকের বিশ্বের স্বীকৃত ভাষাগুলাের আদিভাষ্য। সংক্ষেপে বলা যায়, এই ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষার দুটি শাখার একটি ‘কেম” থেকে পরবর্তীকালে যে ভাষাসমূহের বিস্তার ঘটে তার প্রচলন রয়েছে আজকের পশ্চিম ইউরােপ জুড়ে। যেমন ইংরেজী, ফরাসী, স্পেনীয়, জার্মান, ডাচ, পর্তুগীজ প্রভৃতি ভাষাসমূহ। অপরদিকে আজকের পূর্ব ইউরােপ এবং এশীয় অঞ্চলের ভাষাগুলাের উৎপত্তি হয় ইন্দোইউরােপীয় ভাষার দ্বিতীয় শাখা ‘শতম’ থেকে। কেম ও শতম ভাষার যুগ অন্ততঃ খ্রীষ্টপূর্ব। সাড়ে ৩ হাজার বছরের পুরনাে। শতম ভাষার পরবর্তী রূপায়ণ হচ্ছে ইন্দো-আর্য ভাষা। এই ইন্দো-আর্য ভাষার তিনটি শাখার অন্যতম দু’টি শাখা হচ্ছে ইন্দো-ইরানীয় এবং প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা। ইন্দে-ইরানীয় ভাষা থেকেই আধুনিক পশতু, ফারসী, বালুচ প্রভৃতি ভাষাগুলাের সৃষ্টি। অন্যদিকে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার শাখাটি পরবর্তীকালে বিভিন্ন অঞ্চলভেদে বিভিন্ন উচ্চারণে বিকশিত হয়ে হিন্দী, সিন্ধি, পাঞ্জাবী, অসমী, ওড়িয়া, সংস্কৃত, বাংলা প্রভৃতি ভাষাসমূহের জন্ম দেয়। ইন্দো-আর্য ভাষা বৈদিক যুগ পার হয়ে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার পরবর্তীকালের  শাখা-প্রশাখায় পুঁথিগত সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত হয়। এর পাশাপাশি অঞ্চল ভিত্তিতে বিকশিত হয় বিভিন্ন কথ্য ভাষা। সংস্কৃত ভাষা কার্যতঃ হিন্দু পুরােহিতদেরই ভাষা এবং এ ভাষার প্রচলন তাদের মধ্যেই সীমিত ছিলাে, এখনাে আছে। সংস্কৃত কখনােই সাধারণ অশিষ্ট বা অনার্য’ মানুষের মুখের ভাষা ছিলাে না। বলা যায় সাধারণ গণমানুষের জন্যে এ ভাষা ছিলাে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

ভারতবর্ষে হিন্দু রাজত্বকালেও এই সংস্কৃত ভাষারই আভিজাত্যিক মর্যাদা ছিলাে। গণমানুষের বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপােষণ এই যুগে কেউই করেনি। হিন্দু সেন রাজবংশীয় অবাঙালী রাজারা সংস্কৃত ভাষার উৎসাহদাতা ছিলাে এবং এই রাজবংশ বাংলাদেশে একনাগাড়ে সুদীর্ঘকাল রাজত্ব করেছে। কিন্তু অচ্ছুতদের কথ্যভাষা বাংলাকে তারা কখনােই রাজদরবারে স্থান দেয় নি। অথচ পাল বংশীয় বাঙালী বৌদ্ধ রাজারা বাংলা ভাষার প্রতি তাদের আনুকূল্য দেখিয়েছে। বাংলা ভাষার পরিপূর্ণ পৃষ্ঠপােষকতা হয়েছে বস্তুতঃ বিজাতীয় মুসলমান শাসকদের আমলেই। বলা চলে বাংলা ভাষা তার প্রয়ােজনীয় গ্রহণযােগ্যতা এবং বিকাশে সন্ধিযুগ ও মধ্যযুগের মুসলমান শাসকদের অকৃত্রিম আনুকূল্যেই সমৃদ্ধি লাভ করেছে। উল্লেখ্য ইখতিয়ারউদ্দিন মােহাম্মদ বখতিয়ার খিলজীর সময় থেকে সন্ধিযুগের সূচনা। বাংলা ভাষার আদিরূপ হচ্ছে গৌড়ী প্রাকৃত এবং গৌড়ী অপভ্রংশ। এই আদি স্তর ‘প্রাকৃত যুগ পরবর্তী অপভ্রংশের কালপর্ব পার হয়েই বাংলা ভাষার শুরু। এই ভাষার আধুনিককাল পর্বের যাত্রা শুরু হয়েছে উনবিংশ শতক থেকে। সুতরাং বােঝাই যাচ্ছে যে বাংলা ভাষার সুতিকাগার সংস্কৃত, এই অনুমানের কোনাে ঐতিহাসিক মূল্য নেই। বরং বলা যায়, বাংলা ভাষার পূর্ববর্তী রূপ অপভ্রংশ এবং তার আগে প্রচলিত প্রাকৃত ভাষার যুগে সংস্কৃত ভাষা হচ্ছে সমসাময়িক একটি সাহিত্যিক ভাষা। হিন্দু পুরােহিতদের তন্ত্রমন্ত্র এবং শিষ্ট ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় গ্রন্থ রচনায় এই ভাষার ব্যবহার সীমাবদ্ধ থেকেছে। ব্রাত্য বা সাধারণ জনগণ কখনােই এই ভাষায় কথা বলার যােগ্য বিবেচিত হয়নি। কাজেই উপমহাদেশীয় ইতিহাসে সংস্কৃত যুগ বলে কোনাে একক ভাষার যুগ নেই। বাংলা ভাষা প্রকৃত অর্থেই প্রাকৃত ভাষা এবং তার পূর্ববর্তী অপভ্রংশেরই উত্তরাধিকার। সুতরাং নিশ্চিত করেই বলা চলে যে, বাংলা ভাষার সাথে সংস্কৃত ভাষা কিংবা হিন্দুয়ানী দূষণের কোনাে সুযােগ নেই। বিষয়টি পুরােপুরি অযৌক্তিক এবং অনৈতিহাসিকও বটে। পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদীরা পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর তাদের বৈষম্যমূলক ঔপনিবেশিক শােষণ প্রক্রিয়া নিরংকুশ রাখার অজুহাত হিসেবেই বাংলা ভাষা এবং বাঙালী। জাতির অস্তিত্ব অস্বীকার করার ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছে। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের শতকরা মাত্র ছয় ভাগ অভিজাত শ্রেণীর মানুষের পছন্দনীয় ভাষা উর্দুকে তারা জাতীয় ভাষা | হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। দুঃখজনক যে ইতিহাসের নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক কোনাে যুক্তিই পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার প্রতিভূদের মনােপুত হয়নি। কারণ তারা পাকিস্তানের অঙ্গীভূত জাতিসমূহের বিশেষ করে বাঙালীদের আলাদা জাতিসত্তার পরিচয় বিলুপ্ত করে দিয়ে সেখানে তাদের কল্পনাপ্রসূত মুসলমানী ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাে।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নীতিতে ঐক্যের নামে যে অস্পৃশ্য দর্শনের চর্চা করা হতাে তার একটি দিক ছিলাে যেমন দৃশ্যমান, অন্য দিকগুলাে তেমনি সূক্ষ্ম। বলা যায় অনেকটা মনােগত। দৃশ্যমান এই দর্শনের মধ্যে জাতিগত বৈষম্য এবং দমনমূলক আচরণের যে প্রাবল্য ছিলাে তা সাদা চোখেই দেখা যেতাে। কিন্তু এর বাদবাকি যে অংশটি মনােগত তা কেবলই উপলব্বির ব্যাপার। পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালী জনগােষ্ঠীর মধ্যে এই উপলব্বিরই ভাঙচুর হয়েছে একটানা ২৩ বছর ধরে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নীতিতে জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হলেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে তারা শ্রেণী নির্বিশেষে ছড়িয়ে দিতাে চরম অবিশ্বাস এবং ঘৃণাবােধ। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সময় থেকেই বাঙালীদের প্রতি তাদের এই অবিশ্বাস আর সন্দেহ প্রকাশ পেতে থাকে বিভিন্নভাবে। পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে প্রশিক্ষণ গ্রহণের দীর্ঘ আট মাসব্যাপী সময়ে এই নীতি ও আচরণের প্রকাশ ঘটতে দেখেছি নানাভাবে নানা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে। বাঙালী জনগােষ্ঠীর প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানীদের অবিশ্বাস আর সন্দেহ সৃষ্টির যে দায়ভার -তার সমূহ দায় দায়িত্ব তাদেরই। যেহেতু এই বােধ সৃষ্টিতে একচেটিয়া অবদানও তাদের। বৈষম্যের এই মনােগত বােধ বাঙালীদের বিব্রত করলেও বিষয়টির প্রতি বাঙালীরা বরাবরই তেমন একটা আমল দেয়নি। কারণ এতে তাদের তেমন কিছুই এসে যায়নি। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানীরাও বুঝতে পেরেছিলাে যে তাদের অবিশ্বাস আর সন্দেহ প্রবণতার আদৌ কোনাে গুরুত্ব বাঙালীদের কাছে নেই। কিন্তু তারপরও তারা বাঙালীদের প্রতি তাদের এই হীনমন্যতাবােধ কোনােদিনই কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

পাকিস্তান সামরিক একাডেমীর প্রশিক্ষণ শিবিরে আমার উপস্থিতি এমন একটি সময়ে ঘটেছিলাে যখন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি রাজনৈতিকভাবে তার ইতিহাসের একটি অতি জটিল ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিলাে। একদিন যার শুরু হয়েছিলাে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য থেকে বাঙালীদের সেই আত্মােপলদ্ধি এরপর ‘৬২ ও ৬৬’র গণচৈতন্যের ভেতর দিয়ে খুব দ্রুত এগিয়ে গেছে। স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ের রক্তাক্ত পথ মাড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীরা ততােদিনে অনেকখানি পথ পার হয়ে এসেছে তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে। এই পর্যায়ে ১৯৬৯ সালের গণজাগরণের মধ্যদিয়ে গত প্রায় দুই দশকের তিক্ত অভিৱতায় এবার তারা নিজেদেরকে জাতিগতভাবে গুটিয়ে ফেলার আয়ােজনও শুরু করেছে ঐতিহাসিক প্রয়ােজনের দাবি মেটাতে গিয়েই। আন্দোলনের এই সুদীর্ঘ পথ অতিক্রমণে বাঙ্গালীদের যে দৃঢ় প্রত্যয় লক্ষ্য করা গেছে প্রধানতঃ তাকে কেন্দ্র করেই পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যক্ষ সংঘাতের সূচনা হয়। শুরু থেকেই পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী এবং তাদের রাষ্ট্রীয় দর্শনের মধ্যে যে ব্যবধান লক্ষ্য করা যায়-অচিরেই তা পাকিস্তান সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্যকে প্রকাশ্য করে তােলে সাধারণ মানুষের সামনে। এরপর সময় যতােই এগুতে থাকে এই ব্যবধানের বিশালতা ততােই স্ফীত হতে থাকে নানা রূপে এবং নানাভাবে। এই ব্যবধান সৃষ্টির সুযােগ থেকে কার্যতঃ লাভবান হয় তারাই যারা এর স্রষ্টা এবং লালনকর্তা। এই শ্রেণী হচ্ছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় জেঁকে বসা কিছু সুবিধাভােগী ব্যক্তি এবং তাদের আশ্রিত একটি বিশেষ সম্প্রদায়ভূক্ত কোটারি। এ ক্ষেত্রে ভারত প্রত্যাগত বাস্তুত্যাগী এবং পাঞ্জাবের সুযোগ সন্ধানী শ্রেণীর এক অভিন্ন স্বার্থ একীভূত হয়ে যায় ব্যাপক সংখ্যক সাধারণ জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে। সমন্বিতভাবে এরাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নির্বাহী কর্মকাণ্ডের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের একচেটিয়া প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করে নেয়। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীরা তাে গােড়া থেকেই জাতীয় শত্রু হিসেবে নিন্দিত-সমালােচিত। এমন কি পশ্চিম পাকিস্তানের বাদবাকি প্রদেশগুলাের সাধারণ মানুষদেরও এদেরই উচ্ছিষ্ট ভােগ করে পরিতৃপ্ত থাকতে হয় রাষ্ট্রটির যাত্রালগ্ন থেকে। | এই পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অত্যন্ত স্বল্পতম সময়ের অভিজ্ঞতাতেই এটা বুঝে নেয় যে ভারত বিভক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্যে তাদের ভাগ্য পরিবর্তিত হবার কোনাে সুযােগ নেই।

এটা শুধুমাত্র একচেটিয়া প্রভূত্বরই নির্লজ্জ হাতবদল। পূর্ব পাকিস্তানের সাথে কেন্দ্রের শাসকদের দ্বন্দ্বের শুরু প্রধানতঃ ভাষার অধিকার এবং স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে। কেন্দ্র থেকে দীর্ঘ এক হাজার মাইল দূরবর্তী একটি প্রদেশ পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানের অভিজাত গোষ্ঠী তাদের শাসন শােষণ নিরংকুশ রাখার স্বার্থে বিশেষত দুটি বিষয়ের ওপর সর্বাধিক প্রাধান্য দেয়ার নীতি অবলম্বন করে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ভারত ভীতি এবং অপরটি ধর্ম অর্থাৎ ইসলাম। ভারত ভীতির প্রশ্নে বিতর্কিত কাশ্মীর ইস্যুটিকে ব্যবহার করে এবং ধর্মের নামে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে হিন্দুয়ানীর দোষে দুষ্ট করে অপেক্ষাকৃত এই পশ্চাৎপদ অঞ্চলটির ওপর তারা তাদের কায়েমী শাসন চালিয়ে যেতে থাকে। যে কারণে দেখা গেছে পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু স্বাধীনচেতা জনগণ যখনই তাদের ন্যায্য পাওনা কিংবা অধিকারের প্রশ্নে কোনাে দাবি তুলেছে অথবা পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণের অভিযােগ এনেছে, তখনই তাদেরকে কাফের কিংবা ভারতের চর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কথিত প্রাদেশিকতার ধারণা সৃষ্টিকারী হিসেবে পূর্ব বাংলার আশ্রিত জনগণকে (!) তারা প্রকাশ্যেই দেশদ্রোহী বলে অভিযুক্ত করেছে। এরপরও যখন বাঙালীদেরকে নিবৃত্ত করা যায়নি তখন মনােগতভাবে ইসলামের আবেগ এবং বাহ্যিক ক্ষেত্রে কম্পিত ভারতীয় আগ্রাসনের ধূয়া তুলে তাকে নিষ্ক্রিয় করার উদ্যোগ নেয়া হয়। কৌতুহলােদ্দীপক যে, যখন ভারতভুক্ত কাশ্মিরী জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হতাে দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামগুলােতে, এ সময় পাকিস্তানের ভৌগােলিক সীমার মধ্যে মূল জনগােষ্ঠীর শতকরা ৫৬ ভাগেরও বেশী। মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার থেকে ছিলাে নির্দয়ভাবে বঞ্চিত। ‘৪৭ সাল থেকে ‘৭১- দীর্ঘ ২৩ বছরে পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠীর এই উদ্ভট মানসিকতার ব্যাপক প্রয়ােগ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নে প্রকারান্তরে বিরূপ প্রতিক্রিয়ারই সৃষ্টি করে। ‘৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে যুক্তছন্টের বিজয়, পরবর্তীকালে ৬ দফার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ৬৮-৬৯’র গণজাগরণ এবং ৭০’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয়—এ সব ঘটনার মধ্যে বাঙালীর আপােসহীন মনােভাবেরই খােলাখুলি বহিঃপ্রকাশ ঘটে। |

পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই সেনাবাহিনী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া। কোটারিস্বার্থের প্রতিভূ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর ফলে সংগত কারণেই সেনাবাহিনী তাদেরই প্রণীত রাষ্ট্রীয় দর্শনের প্রথম কাতারের অনুসারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ‘৫৮ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের সাথে সাথে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী একদিকে তাদের ভাষায় নির্ভেজাল শাসক এবং অন্যদিকে প্রকাশ্যেই সার্বভৌমত্ব রক্ষার একক মালিকানা গ্রহণ করে। এই পর্যায়ে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় দর্শনের ক্ষেত্রে আরাে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ঘটে এবং এভাবেই পাকিস্তানে সেনাবাহিনী প্রভাবিত ধ্যান-ধারণা এবং রাষ্ট্রীয় চিন্তা-চেতনা প্রতিষ্ঠার একটি ধারা গড়ে ওঠে। একাডেমীতে প্রশিক্ষণের আট মাসে নিয়মিতভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার ও ক্যাডেটদের আচরণে এই উদ্ভট মানসিকতার প্রকাশ আমি দেখেছি। আর অবাক হয়েছি এই ভেবে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুই অংশের ব্যবধানের এই বিশালতা সত্ত্বেও রাজনৈতিক অখণ্ডতা। নামক সংহতি তখনাে অবধি কী অলৌকিক শক্তির বলে অটুট থাকলাে। খুব কাছ থেকে আমার মনে হয়েছে যে ধর্মের প্রশ্নে তেমন আন্তরিকতা না থাকার পরও সেনাবাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানী প্রতিটি সদস্য প্রথমে একজন মুসলমান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হয়েছে এবং তারপরই সে নিজেকে একজন পাকিস্তানী হিসেবে গণ্য করেছে। এ অবস্থাটা ছিলাে শ্রেণী নির্বিশেষ পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সকলের মধ্যে সমানভাবে ক্রিয়াশীল। পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তানের একজন বাঙালীর অনুভূতি ছিলাে সম্পূর্ণ বিপরীত। সে প্রথমে নিজেকে একজন বাঙালীই ভাবে। বাঙালী বৈশিষ্ট্য, ভাবধারা বা চিন্তা-চেতনা বিসর্জন দিয়ে কোনাে চেতনাসমৃদ্ধ বাঙালীই পাকিস্তানের প্রচলিত মতাদর্শের সংগে নিজেকে। একাত্ম করতে সম্মত নয়। | পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তারা বাঙালীদের এই স্বকিয়তা এবং আলাদা জাতিসত্তার। উপলব্বিকে কখনােই উদার মনে মেনে নিতে পারেনি। বরং বাঙালীদের কাছ থেকে তারা যা আশা করতাে তা হচ্ছে পাকিস্তান এবং এর দর্শন ও নীতি সম্পর্কে তারা যা ভাবে তারই অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গি। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে বাঙালীদের আলাদা চিন্তা-চেতনার কোনাে সুযােগ নেই। বিষয়টি এ রকম যেনাে পাকিস্তান রাষ্ট্র তাদেরই দয়ার সৃষ্টি এবং এক হাজার মাইল দূরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীরা আশ্রিত জনগােষ্ঠীমাত্র। কিন্তু আসলে প্রকৃত ইতিহাস এই ধারণার সম্পূর্ণ উলে। বাঙালীদের আলাদা জাতিসত্তাকে অস্বীকার করা বা পাকিস্তানী কিবাে। মুসলমান বলতে ( কোনাে একক জাতিসত্তাকে বুঝায় না—এই ঐতিহাসিক সত্যকে। প্রত্যাখ্যান করার প্রবণতার মধ্যেই কার্যতঃ নিহিত থেকে যায় পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ খণ্ডিত। রূপ এবং বাঙালী জাতির অভ্যুদয়ের প্রাণবন্ত অংকুর।

আট পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই এর রাষ্ট্রীয় নীতিতে যে দর্শন যােগ করা হয় তার দুটি মৌলিক । দিকের একটি ছিলাে ধর্মীয় মূল্যবােধের অনুসরণ। প্রতিবেশী দেশ ভারতকে চিরকালের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা এর দ্বিতীয় দিক। তাদের মতে এই দর্শনের মধ্যেই পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থ ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার নিশ্চয়তা সংরক্ষিত ছিলাে। কাজেই এই দর্শনের যারা বিরােধী, খুব বােধগম্য কারণেই তারা কাফের ও বিধর্মী এবং সােজাসুজি হিসেবে ভারতীয়দের দোসর হিসেবে গণ্য হয়েছে। এক কথায় তারা ছিলাে দেশদ্রোহী।  পাকিস্তানের এই অভিনব রাষ্ট্রীয় দর্শনের উৎসে একটি ঐতিহাসিক পটভুমি অনায়াসেই চোখে পড়ে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটির সৃষ্টি হয়েছে ভারতকে ভাগ করে এবং ভাগাভাগির এই দাবিটি তখন তােলা হয়েছিলাে মুখ্যতঃ ধর্মের দোহাই দিয়েই। সম্ভবতঃ এ কারণেই পাকিস্তান জন্মের পর পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে এমন একটি ধারণার সৃষ্টি হয় যে ইসলামের কথা বলে যখন ভারতকে টুকরো করে পাকিস্তান সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে তখন এই ধর্মের নাম করেই পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখা যাবে। | পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় দর্শনে ইসলামকে অঙ্গীভূত করার ক্ষেত্রে এই ছিলাে গােড়ার দিককার উপলবি। এরপর আছে ভারত বৈরীতা। পশ্চিম পাকিস্তানী বিশেষ করে ওই অঞ্চলের সেনা অফিসারদের এই ভারত বৈরীতা ভারত জয়ের দুঃস্বপ্ন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়ে পড়ে একসময়। ভারত জয়ের বীর হিসেবে নিজেকে কল্পনা করার ফ্যান্টাসির মধ্যে তারা সুখানুভব করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে দারুণভাবে। পাকিস্তানী দর্শনের এই অধ্যায়েও সেই একই ইতিহাস। কাজেই পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণের মধ্যে চিরবৈরী হিসেবে ভারতকে যতাে বেশী প্রতিষ্ঠিত করা যাবে পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রশ্নে তা ততােই কল্যাণকর। এটাই ছিলাে তাদের সামগ্রিক মূল্যায়ন। কিন্তু এই দর্শনের ঐতিহাসিক ভিত্তি যাই হােক না কেনাে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যে বাস্তবতা ও পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে তার গুরুত্ব তাদের কাছে অর্থাৎ বাঙালীদের কাছে অনেক বেশী। পশ্চিম পাকিস্তানের তথাকথিত রাষ্ট্রনীতিকদের এই দার্শনিক বুলি মিথ্যে এবং অসার হয়ে যায় নিষ্ঠুর বাস্তবতার কাছে। স্বাধীন পাকিস্তানে পরাধীন ভারতের জীবন দর্শন এবং সামাজিক উপলব্ধি বাঙালীদের কাছে অর্থবহ হতে পারে না, হয়নি কখনােই। উপরন্তু এই দর্শনের কপচানাে বুলির ফাঁকফোকর দিয়ে খুব সুস্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছিলাে কেন্দ্রীয় পাকিস্তানের আসল চেহারা—তা আর যাই হােক পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের জন্যে মােটেও সুখকর ছিলাে না, সহনীয় তাে নয়ই। |

বিশ্বের দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশবাদবিরােধী জাতীয় আন্দোলন সৃষ্টির সময়কাল থেকেই আধুনিক রাজনীতিতে এই ধারণাটি বদ্ধমূল হয়েছে যে স্বাধীনতা কখনােই কোনাে স্বতােৎসারিত পাওনা নয়। কার্যতঃ এটি এমনই একটি দাবি যা বহু ত্যাগ তিতিক্ষা আর আত্মবিসর্জনের মধ্যদিয়ে আদায় করে নিতে হয়। ১৯৭১ সালে আমরা যে স্বাধীনতা লাভ করি স্বভাবতঃই তারও সেই একই ইতিহাস। এই স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যে তাই একদিকে যেমন রয়েছে অজস্র রক্ত ও জীবন বিসর্জনের মর্মন্তুদ ঘটনাপ্রবাহ তেমনি অন্যদিকে রয়েছে এর এক বিস্তৃত সংগ্রামী পটভূমি। সংক্ষিপ্ত পরিসরে ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান সৃষ্টির সময়কাল থেকে এই পটভূমির ব্যাপ্তি হিসেব করা হলেও বস্তুতঃ এই ব্যাপ্তির শুরু হয়েছিলাে অবিভক্ত ভারতবর্ষ থেকেই। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেপথ্য ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গেলে অনিবার্য শর্ত হিসেবে আমাদেরকে চোখ ফেরাতে হয় অবিভক্ত ভারতের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে। | ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ এবং শতাব্দীকাল পর ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহােত্তর ব্রিটিশ-ভারতীয় পরিস্থিতিতে সঙ্গত কারণেই ভারতের মুসলমানদের সার্বিক অবস্থা খুব দ্রুততার সাথে অর্ধেপতিত হতে থাকে। উপরােক্ত দু’টি যুদ্ধেই উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ শক্তি ক্ষমতাসীন মুসলমান রাজশক্তির মােকাবেলা করে। ফলে স্বভাবতঃই বৃটিশ ভারতের মুসলমানরা বিজয়ী শক্তির সব ধরনের আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হয় এবং এই শূন্যস্থানে দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে হিন্দু সম্প্রদায়ের আধিপত্য। বলা যায় ১৮৫৭ সালের পরবর্তী প্রায় আড়াই দশক সময়কালটি মূলতঃ ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের পুনরােদয়ের দুই যুগ। ব্যবসা বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি এমনকি জমিদারীও এ সময় প্রায় একতরফা পাওনা হয়ে যায় হিন্দু সম্প্রদায়ের। পক্ষান্তরে ইংরেজ বিদ্বেষী মুসলমানদের পশ্চাৎপদতা ক্রমেই তাদেরকে হিন্দু জনগােষ্ঠীর সাথে প্রতিযােগিতায় পিছিয়ে পড়তে বাধ্য করে। উত্তরকালে ব্রিটিশ ভারতের শেষ দিকে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ভারত বিভক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান নামক ধর্মভিত্তিক একটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্মের কাহিনী মুখ্যতঃ এখান থেকেই শুরু। এটা অবশ্যই স্বীকার্য যে, এই দু’টি বিষয়ের নেপথ্যেই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ রাজশক্তির পরােক্ষ ও প্রত্যক্ষ আনুকুল্য সক্রিয় ছিলাে এবং এটা ছিলাে তাদেরই নিজস্ব সুবিধাদি অক্ষণ ও নিরাপদ রাখার স্বার্থে।

মুর্শিদাবাদের পলাশীতে বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বক্সারের প্রতিরােধ যুদ্ধের পর পরই কার্যতঃ ভারতবর্ষে ইংরেজ বণিকদের আধিপত্ত মােটামুটি বড় দু’টি বাধা অতিক্রম করে। আর ঠিক তখন থেকেই উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে শত্ৰু নির্ধারনে মতভেদ দেখা দেয় স্থানীয় দেশপ্রেমিকদের মধ্যে, যদিও সর্বত্র প্রধান শত্রু হিসেবে তারা চিহ্নিত করে ঔপনিবেশিক বৃটিশ বণিক শক্তিকে। কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্যবাদের আনুষ্ঠানিক শাসনদণ্ড অধিগ্রহণের মধ্যদিয়ে পরবর্তীতে এই অবিচ্ছিন্ন বণিক শক্তির শেকড় প্রােথিত হয় তার মূল বেদী বৃটিশ পার্লামেন্টে। ভারত শাসনরত এই একক শক্তির বিরুদ্ধেই প্রধানতঃ দীর্ঘ দুই শতক ধরে দেশপ্রেমিক স্বাধীনতাকামীদের যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে উপমহাদেশে। এই সময়ের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও সামন্তবাদ বিরােধী বিদ্রোহের একটি স্রোতও প্রবাহিত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী আন্দোলনের পাশাপাশি। বৃটিশ বিরােধী দেশীয় রাজনীতিতে প্রথম দিককার কর্মকাণ্ডে মুখ্যতঃ দু’টি ধারার প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়। এই ধারা দু’টির প্রধান লক্ষ্য ইংরেজ রাজশক্তি হলেও নিজেদের মধ্যে শক্ত নির্ধারণ সংক্রান্ত মত পার্থক্য এবং পারস্পরিক কলহ বিদ্যমান থাকার কারণে ভারতীয়। রাজনীতিতে তখনাে পর্যন্ত জাতীয় ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। এ সময় দুটি রাজনৈতিক ধারার একটি প্রবাহিত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী দেশপ্রেমিক সামন্ত প্রভুদের নেতৃত্বে। এই নেতৃত্বের নেতারা হচ্ছেন বাংলার শেষ নবাব, দিল্লীর শেষ সম্রাট, হায়দার আলী, টিপু সুলতান প্রমুখ। এর কাছাকাছি দ্বিতীয় ধারায় পরিচালিত হয়েছে ফকির বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ কিংবা সঁওতাল বিদ্রোহের মতাে আন্দোলন। দ্বিতীয় ধারার এই আন্দোলনগুলাের শত্রু নির্ধারণ করা হয় একাধারে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ এবং দেশীয় সামন্তবাদকে। প্রধানতঃ কৃষকরাই ছিলাে এই সব আন্দোলনের বীর সৈনিক। তারা দেশীয় সামন্ত প্রভু এবং ইংরেজ বণিক যুগপৎ উভয়ের দ্বারাই ক্রমাগত নির্যাতিত হচ্ছিলাে। এই সামন্তীয় রাজনৈতিক ধারা প্রবাহের ব্যাপ্তী হচ্ছে ১৭৫৭ থেকে ১৮৮৫ সাল অর্থাৎ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্মের আগ পর্যন্ত। | ভারতীয় রাজনীতিতে এরপরই শুরু হয় দেনদরবারভিত্তিক নিয়মতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের ধারাটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় সামন্ত ও পুঁজিবাদের মদদপুষ্ট হয়েই। কার্যতঃ সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী জাতীয় রাজনৈতিক চৈতন্যের তাগিদ এই ধারাতেই প্রথম প্রবাহিত হবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত অধ্যুষিত পুনরুজ্জীবনবাদী। কংগ্রেস তার চরিত্রে জাতীয় লেবাস সেঁটে রাখতে না পারার কারণে এই রাজনীতির ধারায় প্রায় অনুরূপ আরাে একটি সংগঠনের জন্য অচিরেই অনিবার্য হয়ে পড়ে।

উনিশ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশ শাসন শােষণের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের সাধারণ জনগণ। ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক কারণেই ব্রিটিশ ভারতের এই সাধারণ জনগণ তখনাে পর্যন্ত আধুনিক রাজনীতি অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাজনীতির শান্তিপূর্ণ নিয়মনীতি সম্পর্কে পুরােপুরি অল্প ছিলাে। উপরন্তু তখনাে তাদের স্মৃতিতে বেনিয়া ইংরেজদের ভারতভূমি দখলের অসংখ্য নৃশংসে যুদ্ধের কাহিনী জেগে আছে। এ অবস্থায় ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশ বিরােধী দাবিদাওয়ার আন্দোলনকে সম্ভাব্য যুদ্ধংদেহী অবস্থা থেকে অপেক্ষাকৃত নিম শৃঙ্খলার পথে আটকে রাখার জন্যে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ সহযােগিতায় ভারতে ভূমিষ্ঠ হয়। প্রথম নিয়ম-শঙ্খলিত রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেস। ১৮৮৫ সালে ভূমিষ্ঠ এই কংগ্রেস প্রাথমিক পর্যায়ে একটি অসাম্প্রদায়িক সর্বভারতীয় গণতান্ত্রিক চরিত্র নিয়ে তার যাত্রা শুরু করলেও অচিরেই এই রাজনৈতিক সংগঠনটি তার সর্বভারতীয় গণতান্ত্রিক চরিত্রটি হারিয়ে ফেলে। এ সময় কংগ্রেসের চরিত্রে আমরা দু’টি বিশেষ অবস্থার আমদানী লক্ষ্য করি। এই পরিবর্তিত অবস্থার একটি ইতিবাচক হলেও অপরটি ছিলাে চরম নেতিবাচক। ইংরেজদের প্রত্যক্ষ সহযােগিতায় কংগ্রেসের জন্ম হলেও অল্পকালের মধ্যেই কংগ্রেস ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে ওঠে। সর্বভারতীয় জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে এটি তার ইতিবাচক দিক। কিন্তু একই সাথে কংগ্রেস তার সর্বভারতীয় জাতীয় চরিত্রটি হারিয়ে বসে সংগঠনের কর্মসূচীতে সমাজের ব্যাপক সাধারণ জনগণের চাহিদার বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত না করে। অবাক হলেও এটি সত্য যে এই সময়টিতে কংগ্রেসের রাজনীতিতে ভারতের ব্যাপক কৃষক-শ্রমিক, নিম্ন আয়ের গণমানুষ এবং বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনাে আকুতি প্রকাশ পায়নি। বরং খুব অল্প সময়ের মধ্যে কংগ্রেস এই সময় ইংরেজী শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত এবং বুর্জোয়ঃসামন্তদের স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। সংগঠনের গােড়ার নেতৃত্বে ক্রমেই সম্প্রদায় বিশেষ, হিন্দু জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান প্রকাশ পেতে থাকে। ফলে ভারতের অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ মুসলমান জনগােষ্ঠীর জন্যে অপর একটি আলাদা সংগঠন মুসলিম লীগের জন্মের পথ সুগম হয় এবং এ উপলব্বির প্রেক্ষিতেই ১৯০৬ সালে সম্প্রদায়ভিত্তিক মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইতিমধ্যে ইংরেজ ভীতি থেকে মুসলমানদের বাংশেই মােহমুক্তি ঘটেছে এবং তাদের মধ্যেও একটি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণী ও বুর্জোয়া সামন্ত শ্রেণীর উন্মেষ ঘটে। এদিকে কংগ্রেসের ক্রমবর্ধমান ইংরেজ স্বার্থবিরােধী হুমকির মুখে কৌশলী ব্রিটিশ রাজশক্তি সঙ্গত কারণেই সম্প্রদায়ভিত্তিক সংগঠন মুসলিম লীগের জন্মকে স্বাগত জানায়। ঐতিহাসিকভাবে বিশাল দেশ ভারতের ঐক্যবদ্ধ জনগণের মধ্যে অনাকাক্ষিত বিভেদ সৃষ্টির হীন উদ্দেশ্যটি এভাবেই শেষ পর্যন্ত সফল করে নেয় ইংরেজরা। তারা কংগ্রেস মুসলিম লীগের মধ্যে এই প্রথম সৃষ্ট সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্বের আড়ালে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজত্বের দীর্ঘস্থায়িত্বের স্বপ্ন দেখে। ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু-মুসলমান রাজনৈতিক প্রতিযােগিতার পাশাপাশি একটি অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্রও অসন্তোষ বাড়িয়ে তােলে মুসলমানের মধ্যে। সন্দেহ নেই যে এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টিও ইংরেজ শাসকদেরই সৃষ্টি এবং এটি মুসলমানদের সম্প্রদায়গত উপলধিরই একটি উল্লেখযােগ্য অংশ। স্বাধীনতা পূর্ব অবিভক্ত ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ছিলাে কার্যতঃ ঔপনিবেশিক এবং সামন্ততান্ত্রিক। এই সামন্তরা আবার ঔপনিবেশিকদের সৃষ্ট ইংরেজদের পাশাপাশি এক স্থানীয় শােষক শ্রেণী। এর সাথে রয়েছে বিকাশমান একটি দেশীয় বুর্জোয়া শ্রেণী। ভারখেই উভয় অর্থাৎ সামন্ত ও বুর্জোয়া শ্রেণী জন্মসূত্রেই ইংরেজদের সেবাদাস হবার কারণে তাদের মধ্যকার ঐতিহাসিক সামন্ত-বুর্জোয়া দ্বন্দ্বটি এখানে কখনাে প্রকাশ পায়নি। একটি পর্যায় অতিক্রান্ত হবার পর তারা বরং একযােগে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দিয়েছে অষ্টাদশ শতকের ফরাসী বিপ্লবে যেমন ফ্রান্সের যাজক ও সামস্তুদের ‘অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে সহিংস গণঅভূত্থান ঘটায় দেশের বিকাশশীল বুর্জোয়া শ্রেণী। অথাৎ এখানে সামন্ত বুর্জোয়া ঐতিহাসিক দটি কঠোর মেজাজে ক্রিয়াশীল। কিন্তু ভারতে তা হলাে না।

হলো না এই জনাে যে সেখানে একটি দখলদার ঔপনিবেশিক শক্তির দীর্ঘকালীন অবস্থিতি তখনাে বিদ্যমান। ফলে সামন্ত-বুর্জোয়া এই দ্বিসত্তার অখণ্ড শ্রেণী সেখানে একই অবস্থানে থেকে দেশের ব্যাপক জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার হাতিয়ে নেয়। যে কারণে সামন্তদের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ভারতে হয়নি। তারা বরং নিজেদের শ্রেণীগত স্বার্থে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বটিকে সামনে এনে জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে ভারত বিভক্তির জন্যে। কাজেই বলা যায়, ভারত বিভক্তির জন্যে মুসলিম লীগকে যতাে দায়ীই করা যাক না কেনাে এ কাজে জাতীয় কংগ্রেসের দায়-দায়িত্ব কোনাে অংশেই কম নয়। আবার হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান বিঘ্নিত করার জন্যে আমরা যে ইংরেজ রাজশক্তির দোষারােপ করে থাকি সেখানে কংগ্রে*মুসলিম লীগের দায়-দায়িত্বও কম নয়। এর আগে দিল্লীর মসনদে অতীতে বহু রাজবংশের উত্থান-পতন হয়েছে, কিন্তু হিন্দু-মুসলমান। সম্প্রদায়গত সহাবস্থান তাতে কখনােই বিঘ্নিত হয়নি। সম্পূর্ণ একটি আলাদা জাতি হিসেবে ভারতীয় মুসলমানদের স্বার্থ সমুন্নত রাখার প্রতিশ্রুতির মধ্যদিয়ে এবং ইংরেজ রাজশক্তির বিভেদনীতির সমর্থন নিয়েই ভারতে মুসলিম লীগ এগিয়ে চললাে। আর একই সাথে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিখিল ভারতীয় জনগােষ্ঠী বিভক্ত হয়ে পড়লাে ধর্মের ভিত্তিতে। অর্থাৎ উপমহাদেশীয় রাজনীতির এই পর্বে জাতীয় বিভাজনের মানদণ্ড হয়ে উঠলাে ধর্ম। আর এই সবকিছুর নেপথ্যে ডিভাইড এণ্ড রুল’-এর ফলপ্রসূ নীতির পথ ধরে ভারতবর্ষে সাম্রাজ্যবাদ তার রাজদণ্ড সমানে চালিয়ে গেলাে এরপরও সুদীর্ঘ কাল ধরে।

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মূল দলীয় চরিত্র অভিন্ন হলেও মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে মত পার্থক্যের প্রশ্নে দুটি ধারা লক্ষ্যনীয় হয়ে ওঠে প্রথম থেকেই। দলের অভ্যন্তরে এর একটি ধারার আলীগড় পন্থীরা দেনদরবার এবং আপােসের পথ ধরে। লক্ষ্যে পৌছার নীতি গ্রহণ করলেও দেওবন্দ পন্থীদের কারাে কারাে মধ্যে সাম্রাজ্যবাদের। বিরােধীতার পাশাপাশি সামন্ত বিরােধীতাও লক্ষ্যনীয় হয়ে ওঠে। সামন্ত-বুর্জোয়া অধ্যুষিত মুসলিম লীগে যে কারণে নিগ্রহিত কৃষক প্রজাবাদী সংগঠকের অস্তিত্বও চোখে পড়ে। যদিও সামন্তবাদ বিরােধী রাজনৈতিক এই প্রবক্তাদের সংখ্যা দলীয় সংকীর্ণতার কারণে খুব বেশী একটা বেড়ে উঠতে পারেনি। বিপুল জনগােষ্ঠী অধুষিত বিশাল দেশ ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিভক্তি করনের মাধ্যমে। শাসন’ নীতিকে সুকৌশলে কাজে লাগিয়ে লীগ নেতা জিন্নাহ ভারতীয় রাজনীতিতে তার অবাঙালী পূর্বসূরীদের চিন্তার ফসল দ্বিজাতি’ নামক এক অসাড় তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার সুযােগ পেয়ে গেলেন। ভারতীয় রাজনীতির প্রতি হঠাৎ বিতশ্রদ্ধ জিন্নাহ এবার ধর্মের ছুরি দিয়ে অবাধে দ্বিখণ্ডিত করলেন ভারতীয় জনগােষ্ঠীকে। এর এক খণ্ড জনগােষ্ঠী অর্থাৎ মুসলমানদেরকে এবার তিনি পাকিস্তান নামক একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের নামে মুসলিম লীগের পতাকার নিচে সমবেত করলেন। পাশ্চাত্যবাদী আধুনিক শিক্ষায় দিক্ষিত জিন্নাহ তার ব্যক্তি জীবনে ধর্ম। ভীরু না হয়েও মুসলিম লীগের রাজনীতিতে ধর্মকেই অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগালেন। শেষ পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসও জিন্নাহর ভারত বিভক্তির দাবির কাছে নতজানু হয়ে পড়লাে। গান্ধী-নেহেরু চক্র হিন্দু অধ্যুষিত ব্যবচ্ছেদকৃত স্বাধীন ভারতের অস্তিত্ব হৃষ্ট চিত্তেই মেনে নিতে সম্মত হলেন। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের কনভেনশনে লাহােরে সমবেত হলেন তৎকালীন ভারতের কয়েক কোটি মুসলমান জনগােষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী নেতারা। এই কনভেনশনেই ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব গৃহীত হয়—যার সার কথা ভারত বিভক্তি এবং দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামের একটি মুসলমান প্রধান রাষ্ট্রের সৃষ্টি। মাত্র সাত বছর আগে ১৯৩৩ সালেও মুসলিম লীগের কাছে যে আলাদা রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বপ্ন ছিলাে অসার ও অবাস্তব’ ৪০’র লাহাের প্রস্তাবে তাকেই অতিবাস্তব বলে সর্বসম্মতিতে মেনে নেয়া হলাে। তবে এই প্রস্তাবে ভারতের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ নিয়ে যে রাষ্ট্র কাঠামাের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছিলাে ১৯৪৭ সালের স্বাধীন পাকিস্তান কিন্তু সেই প্রস্তাবের রূপরেখা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পরবর্তীতে গােড়ায় গলদ’ অখণ্ড পাকিস্তান ভেঙ্গে যে খণ্ডকাপ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে দক্ষিণ এশীয় মানচিত্রে, কয়েকটি কারণের মধ্যে তার নেপথ্যে এটিও ছিলাে অন্যতম একটি কারণ। 

১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবে বলা হলাে ভারতের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলাে নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রপুঞ্জ গঠন করা হবে। অর্থাৎ এখানে রাষ্ট্র হবে একাধিক এবং এর প্রতিটি হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম। এই প্রস্তাবের রূপরেখা অনুযায়ী প্রস্তাবিত রাষ্ট্রসমূহের (পাকিস্তানের) অন্তর্ভুক্ত ইউনিটগুলো হবে ভিন্ন ভিন্ন স্বকিয়তার। অথচ আবার এই মুসলিম লীগই মাত্র ৩ বছর আগে ১৯৩৭ সালে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের ফেডারেশন স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠার জন্যে আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলাে। যাহােক বাঙালী ফজলুল হকের ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিকৃত হয়ে গেলাে জিন্নাহর অভিৱ হস্তক্ষেপে। স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর আগে ১৯৪৬ সালের এপ্রিলে জিন্নাহ পূর্বতন পাকিস্তান প্রস্তাবে সংশােধনী আনলেন। তিনি তার এই সংশােধিত প্রস্তাবনায় বললেন, স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের ফেডারেশন নয়, এক ইউনিট পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে। তিনি এখানে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের এক নতুন রূপরেখা সুকৌশলে পাশ করিয়ে নিলেন। এই নতুন প্রস্তাবনার রূপরেখা অনুযায়ী ভারতের উত্তর-পূর্বে বাংলা ও আসাম এবং উত্তর-পশ্চিমে। পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানসহ অন্যান্য মুসলমান অধ্যুষিত। অঞ্চলগুলাে নিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম একটি মাত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। উল্লেখ্য যে পরবর্তীকালে এই সংশােধিত প্রস্তাবনার ভিত্তিতেই স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় ভারত বিভক্তির মধ্য দিয়ে এবং তথাকথিত হিন্দু জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস নিজস্ব স্বার্থে এই পাকিস্তান সৃষ্টি মেনে নিয়ে ইংরেজের সাথে আপােস করে। এর বিপরীতে জিন্নাহর আপােস ছিলাে পাকিস্তান সৃষ্টির মূল দর্শনের সঙ্গে। দ্বিজাতি তাত্বের আধুনিক প্রবক্তা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ, উপমহাদেশের এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম জনগােষ্ঠীকে ভারতে রেখেই পাকিস্তান সৃষ্টি মেনে নেন। অর্থাৎ চার কোটি মুসলমানকে হিন্দু রাষ্ট্র ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে রেখে পাকিস্তানের অভাদয় হলাে। এই পরিসংখ্যান থেকেই ৪৭ পূর্ব স্যার সৈয়দ আহম্মেদ, মওলানা মােহাম্মদ আলী, আল্লামা ইকবাল এবং জিন্নাহী। দ্বিজাতি তত্বের অযৌক্তিকতার বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায়। 

আসলে ভারতের দুটি প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃত্ব মুখ্যতঃ দেশের ধর্ম নির্বিশেষ বুর্জোয়া ও সামন্ত শ্রেণীর প্রতিনিধিরাই আজঘ দখল করে রাখে। ফলে এ সত্যকে আর উড়িয়ে দেয়া যায় না যে, ভারত বিভক্তির নেপথ্যে কংগ্রেস ও মুসলিম। লীগ প্রায় সমান সমানই দায়ী ছিলাে। ভারত বিভক্তির অর্থনৈতিক ভিত্তিটি খতিয়ে দেখলে বিষয়টি আরাে পরিষ্কার হয়ে যায়।  সেখানে একদিকে যেমন মুসলমান বুর্জোয়া-সামন্ত শ্রেণী তাদের একচেটিয়া শােষণের স্বপ্নময় আবাসভূমি পাকিস্তান দাবির পেছনে ব্যাপক মুসলমান জনগােষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে মুসলিম লীগের পতাকাতলে, তেমনি অন্যদিকে অমুসলমান সমশ্রেণী প্রচলিত আর্থ-সামাজিক অবস্থানে তাদের পূর্ব প্রতিষ্ঠিত প্রাধান্য ধরে রাখার জন্যে কংগ্রেসের পতাকাতলে সমবেত করে হিন্দু জনগােষ্ঠীকে। অবিভক্ত ভারতের অবাঞ্ছিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার উৎস মূলতঃ এখানেই। আজকের পাক-ভারতীয় ইতিহাসে এমন একটি কথা প্রচলিত আছে যে, ভারতভূমি কার্যতঃ ভাগ করেছে অবিভক্ত ভারতের সামন্ত বুর্জোয়া এবং ব্যবসায়ীরাই। এর আগে ১৯০৫ সালে অবিভক্ত বঙ্গদেশ বিভক্তির ব্রিটিশ পদক্ষেপ বােধগম্য কারণেই বঙ্গদেশীয় অনগ্রস মুসলমানদের জন্যে ছিলাে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। অর্থনীতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে হিন্দু ভূস্বামী এবং দ্রুত স্ফীত হিন্দু শিক্ষিত শ্রেণীর তুলনায় পিছিয়ে পড়া বাঙালী মুসলমানরা স্বভাবতঃই এই বঙ্গভঙ্গের মধ্যে তাদের জীবনযাত্রা বিকাশের স্বপ্ন দেখতে পায়। এই প্রক্রিয়ার তাৎক্ষণিক ফলস্বরূপ পূর্ববঙ্গীয় মুসলমান জনগােষ্ঠীর ভাগ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক উন্নয়ন এবং সুযােগ সুবিধার আগমন ঘটে। কিন্তু অচিরেই ব্রিটিশদের এই বঙ্গভঙ্গ নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গদেশ তাে বটেই, সারা ভারতবর্ষের হিন্দু জনগােষ্ঠী সমস্বরে সােচ্চার হয়ে ওঠে। হিন্দু বুর্জোয়া সামন্তবাদীরা বঙ্গভঙ্গকে তাদের শ্রেণীগত বিকাশের পথে একটি বড় ধরনের অন্তরায় বলে মনে করে। কেননা বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ব বাংলায় একটি আলাদা জাতিসত্তা বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়-যা কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু বুর্জোয়া সামন্তদের মনােপুত হয়নি। বঙ্গদেশ বিভক্তির বিরুদ্ধে তাদের এই আন্দোলন যুগপৎ অহিংস এবং সৃহিংস উভয় ক্ষেত্রেই ব্রিটিশ শাসন প্রক্রিয়ায় এমন চাপের সৃষ্টি করে যার ফলে বঙ্গভঙ্গের ৬ বছর পর ১৯১১ সালে ব্রিটিশদেরকে তাদের বঙ্গবিভাগ নীতির সিদ্ধান্ত পাল্টে নিতে হয়।

বৃহত্তর ভারতে ব্রিটিশদের বঙ্গভঙ্গ নীতির প্রয়ােগ এবং তা প্রত্যাহারের ঘটনা বঙ্গীয় মুসলমান জনগােষ্ঠীর মধ্যে যে অসহায় বােধের জন্ম দেয় তার অনিবার্য পরিণতি পরবর্তীকালে সৃষ্ট পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালী মুসলমানদের অত্যুৎসাহী করার প্রশ্নে যথেষ্ট প্রভাব রেখে থাকবে—এটা বলা নিশ্চয়ই খুব অসঙ্গত হবে না। ৪৮’র সংশােধিত লাহাের প্রস্তাবে ভারত বিভক্তির প্রায় সর্বসম্মত একটি সিদ্ধান্তমূলক রূপরেখা গহীত হলেও বঙ্গদেশ বিভক্তির বিষয়টি তখনাে থেকে যায় অমীমাংসিতই। এ সময় এই অঞ্চলের কোনাে কোনাে নেতা মুসলমান জাতীয়তা’র জিন্নাহী তত্ত্বের মধ্যেও অনেকটা বিচ্ছিন্নভাবে হলেও উপলদ্ধি করেন বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রয়ােজনীয় অস্তিত্ব। অর্থাৎ অবিভক্ত ভারতের সামগ্রিক মুসলমান জনগােষ্ঠীর মধ্যে বঙ্গদেশের অধিবাসী বাংলা ভাষাভাষীদের একটি আলাদা জাতিসত্তারও অস্তিত্ব আছে—এটি এই বাস্তবতার সার কথা। উল্লেখ্য যে, ভারত বিভক্তির প্রাক্কালে বাঙালী মুসলমান নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদা চেয়েছিলেন ভারত বিভক্তির প্রস্তাবিত প্রক্রিয়ায় বঙ্গদেশকে ভাগ না করতে। অর্থাৎ ভারত কিংবা পাকিস্তান কোনাে রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে একটি সম্পূর্ণ আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বঙ্গদেশের স্বাকয় অস্তিত্ব বজায় রাখা। এ ক্ষেত্রে অপর বাঙালী নেতা মওলানা ভাসানা এ গিয়েছিলেন আরাে বেশী। তিনি অবিভক্ত বাংলার সাথে আসামের মুসলমান অধ্যুষিত এল অন্তর্ভুক্ত করে স্বপ্ন দেখেছিলেন এক সুবিশাল বাংলার। পশ্চিম বাংলায় অবিভক্ত বা অপর স্বপ্নদষ্টারা তখন গতায়ু। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস পরলােকে। সুভাস চন্দ্র বসু নিবাে ফলে, বাংলা ভাগ না করার দাবি নিয়ে হিন্দু-মুসলমান নেতৃবৃন্দের সমস্বর আওয়া মুসলিম লীগের সামনে তেমন সােচ্চার করে জাগানাে সম্ভব হলাে না। অত্যন্ত ক্ষীণকষ্ঠে উচ্চারিত অবিভক্ত বাংলার দাবি শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস কিংবা মুসলিম লীগের নেতারা অগ্রাহ্য করে তার স্থলে তাদের খেয়াল খুশি অনুযায়ী বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করলেন। উল্লেখ্য যে কংগ্রেস এবং তার স্থলে মুসলিম লীগ উভয় সংগঠনের নেতৃত্ব তাদের বুর্জোয়া-সামন্তবাদী স্বার্থ অবিভক্ত বাংলার রূপরেখার মধ্যে বিঘ্নিত হয়ে পড়ার যথেষ্ট কারণ আছে বলে আশংকা করলেন। অন্যদিকে, বাংলা নামক এই অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদ অঞ্চলটিতে ততােদিনেও বুর্জোয়া কিংবা ব্যবসায়ী শ্রেণীর শাসন ব্যবস্থা প্রয়ােজন অনুপাতে বিকশিত হয়নি।

অবিভক্ত বাংলার বিশাল অর্থনৈতিক পটভূমিতে সমাজ বিকাশের প্রবাহ বহুলাংশেই সহজতর হবেএমন ধারনা পােষণ করতেন বাঙালী নেতারা। কিন্তু তারপরও ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদীরা বাংলা ভাগের পক্ষে তাদের মত দিলেন। ১৯৪৬ সালের ২০ জুন সােহরাওয়ার্দী। আনিত স্বাধীন বঙ্গদেশের প্রস্তাব অবিভক্ত বাংলার আইন সভায় হিন্দু এলাকার সদস্যরা ৫৮২১ ভােটে বাতিল করে দেয়। কিন্তু স্মরণযােগ্য যে, এই আইনসভার মুসলমান সদস্যরা ওই সময় ১০৬-৩৫ ভােটে বঙ্গদেশ বিভাগ সংক্রান্ত প্রস্তাবনার বিপক্ষে তাদের রায় প্রদান করে। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস-মুসলিম লীগের চক্রান্তে সকল প্রস্তাব তুচ্ছ করে বাংলাও ভাগ হলাে এবং পাকিস্তানের পক্ষে বাংলার যে অংশ এলাে তা আর বাংলা থাকলাে না, রাতারাতি পরিণত হলাে পূর্ব পাকিস্তানে। তাই বলা যায় যে, খণ্ডিত বাংলার বিকৃত জন্মের সময়কাল থেকেই এ অঞ্চলের জনগােষ্ঠীর মধ্যে একটি আলাদা জাতিসত্তার অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিলাে, যাকে মুসলমান জাতীয়তার জিন্নাহী তত্ত্বের ধুয়া দিয়ে বেশী দিন আর ঢেকে রাখা সম্ভব হয়নি।  ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পর নবজাত এই রাষ্ট্রটির জনগণ বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ধীরে ধীরে মুসলিম লীগের আসল চেহারা। আবিষ্কার করতে সক্ষম হলাে। আসলে অবিভক্ত ভারতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনরত মুসলিম লীগ নেতৃত্ব এবং সেই নেতৃত্বের নেপথ্যে মুসলমান জনগােষ্ঠীর মেীল চাহিদার মধ্যে এক বড় ধরনের ব্যবধান রয়ে গিয়েছিলাে শুরু থেকেই। সেখানে মুসলিম লীগের সমস্তু ও বুর্জোয়া নেতৃত্ব যে অর্থে পাকিস্তান দাবি করেছিলাে উপমহাদেশের মুসলমান জনসাধারণ কিন্তু সে অর্থে পাকিস্তান চায়নি। তারা যে পাকিস্তান চেয়েছিলাে, সেখানে তাদের স্বপ্ন ছিলাে একটি সামন্ত বুর্জোয়া শােষণমুক্ত স্বাধীন পরিবেশ এবং নিজস্ব জাতিসত্তার অবাধ বিকাশের নিশ্চয়ত। পক্ষান্তরে প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ নেতৃত্ব চেয়েছিলাে এমন একটি স্বাধীন পাকিস্তান যেখানে তারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আশ্রয়ে থেকে ব্যাপক জনগােষ্ঠীর ওপর তাদের সামন্ত বুর্জোয়া ঔপনিবেশিক শােষণ নিরংকুশ রাখতে সক্ষম হবে। ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই এই ঐতিহাসিক ৮শ্ব প্রকট হয়ে ওঠে দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিমণ্ডলে। | অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসন এবং দেশীয় ভূস্বামীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ অনগ্রসর বাঙালী মুসলমানরা মুসলিম লীগ প্রদত্ত দ্বিজাতি তত্ত্বকে নিজেদের মুক্তির একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নিয়েছিলাে।

কিন্তু এই দ্বিজাতি তার স্বপ্নের ফসল পাকিস্তান সৃষ্টির পর অচিরেই তারা বুঝলাে যে পূর্বাপর তাদের শােষণ করার জন্যে প্রভুর পরিবর্তন হয়েছে মাত্র, প্রভুত্বের কোনাে পরিবর্তন হয়নি। স্বাধীন পাকিস্তানে তারা এবার পরিবর্তিত প্রভুদের বিজাতীয় শােষণের নিল পরিচয় পেতে শুরু করলাে। আর ঠিক তখন থেকেই তাদেরকে স্বজাতীয় প্রভুদের ক্রমবর্ধিষ্ণু শােষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্যেও প্রস্তুতি নিতে হলাে। পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্বদানের সুযােগ নিয়ে প্রাথমিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির পর জিন্নাহ পাকিস্তানের প্রধান ব্যক্তিত্ব অর্থাৎ গভর্নর জেনারেল পদে আসীন হলেন। ক্ষমতায় প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার সহযােগী হলেন ভারত প্রত্যাগত লিয়াকত আলী খান। এই পর্বে কোনাে বাঙালী নেতা কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ পেলেন না। যদিও পাকিস্তান সৃষ্টির প্রশ্নে বাঙালী মুসলমান জনগােষ্ঠী এবং বাঙালী নেতাদের অবদান ছিলাে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া এ কথা ঐতিহাসিকভাবেই স্বীকৃত যে ১৯৪০ সালে লাহাের মুসলিম লীগের অধিবেশনে যে পাকিস্তান প্রস্তাব আনা হয়েছিলাে তার রূপকার ছিলেন এ কে ফজলুল হক। চল্লিশের দশকে ভারতবর্ষে জিন্নাহ সাহেবের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ যে পাকিস্তান আন্দোলন চালায় তার পথিকৃতদের মধ্যেও ফজলুল হক এবং শহীদ সােহরাওয়ার্দী ছিলেন অন্যতম। অবিভক্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইতিহাস পর্যালােচনার প্রয়ােজনে ৪৭ থেকে ‘৬৯ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ সামরিক নেতা ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা গ্রহণের সময়কাল পর্যন্ত দীর্ঘ এই ২২ বছরের কালপর্বকে দুটি ভাগে ভাগ করে নেয়া যায়। এর প্রথম ভাগের ১১ বছর অর্থাৎ ১৪৭ থেকে ‘৫৮ সালের ইস্কান্দার মীর্জার সামরিক শাসনের আগ পর্যন্ত সময়কালকে পাকিস্তানে সংসদীয় পদ্ধতির রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কালপর্ব বলা যেতে পারে। যদিও এই পদ্ধতিটি ছিলাে গণতান্ত্রিক প্রশ্নে কার্যতঃ সম্পূর্ণতঃই লােক দেখানাে প্রকৃতির। দ্বিতীয় পর্বের ১১ বছর বিশেষভাবে চিহ্নিত আইউব খানের ‘নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক’ (বেসিক ডেমােক্র্যাসি) শাসন ব্যবস্থার জন্যে। পরবর্তী শাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন প্রায় তিন বছর। তার শাসনামলে ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে পূর্ব বাংলায় স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়। | স্বাধীন পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে আরােহণ করে জিন্নাহ রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় লক্ষণীয়ভাবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি পরিহার করে চলতে থাকেন শুরু থেকেই। রাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামােয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা তিনি গঠন করলেন বটে, কিন্তু মন্ত্রীদের চেয়েও একটি আমলাচক্রকে তার নৈকট্য লাভের সুযােগ করে দিলেন তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।

রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এই আমলাচক্র এমনকি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদেরকে অতিক্রম করে সরাসরি জিন্নাহর কাছে জবাবদিহি করতাে। জিন্নাহর নির্দেশও ছিলাে তাই। অবিভক্ত ভারতবর্ষের তুখােড় রাজনীতিক জিন্নাহ স্বাধীন পাকিস্তানে এভাবেই ক্ষমতার রাজনীতি শুরু করলেন স্বেচ্ছাচারী কুটকৌশলের মধ্য দিয়ে। এরই ফলে পাকিস্তানে এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা সৃষ্টির পাশাপাশি রাজনৈতিক শুন্যতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে এবং পরিণতিতে উদ্ভব ঘটে সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখলের সুপ্ত প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। কার্যতঃ এই পদ্ধতিতেই জিন্নাহ সাহেব নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের সামগ্রিক প্রশাসন ক্ষমতা তার হাতে কেন্দ্রীভূত করার উদ্যোগ নেন। এই কেন্দ্রীভূত অসীম ক্ষমতার জোরে এ সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের প্রত্যক্ষ মদদে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালি গুনগােষ্ঠীর জাতিসত্তায় প্রাথমিক পর্যায়ের চরম আঘাতটিও হানতে সক্ষম হন। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষাকে তিনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করলেন প্রকাশ্যেই। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানও তার কণ্ঠে সুর মেলালেন। কোনাে কোনাে বাঙলী নেতার কণ্ঠেও ধ্বনিত হলাে একই সুর। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় প্রধান ব্যক্তি জিন্নাহ’র স্থায়িত্ব দীর্ঘায়িত হলাে না। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র এক বছরের মাথায় তিনি মারা গেলেন। মুসলমানদের ভাষা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার বস্তবায়ন আর করে যেতে পরলেন না জিন্নাহ। অল্প কিছুদিনের মধ্যে লিয়াকত আলীও বিদায় নেন গুপ্তঘাতকের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের বিরুদ্ধে ক্ষমতালিপু মােহাজের ও পাঞ্জাবী শােষক চক্রের ষড়যন্ত্র বেগবান হয়ে ওঠে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রযন্ত্রে। দুঃখজনক হলেও এ কথা স্বীকার করতেই হয় যে এই চক্রের ষড়যন্ত্রে বাঙালী মুসলিম লীগ নেতাদের অনেকেই যােগ দেন এ সময়। অন্যদিকে রাওয়ালপিণ্ডির সামরিক-বেসামরিক আমলা চক্রও ক্ষমতায় রদবদলের গােপন মহড়া শুরু করে। এ ধরনের একটি মহড়ার মূল হােতা ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন উর্ধত অফিসার জেনারেল আকবর খান। এই মহড়ার প্রথম উদ্যোগ পিণ্ডি ষড়যন্ত্রে ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত বেসামরিক সরকার পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ উল্টে দিয়ে সে স্থলে সরাসরি সামরিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলনের আলামত ছিলাে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তবে আকবর খানের নেতৃত্বে যড়যন্ত্রকারীরা তৎকালীন লিয়াকত আলী খানের সরকারকে যে অপদার্থ ও অযােগ্য মনে করতাে তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। সম্ভবতঃ এই ষড়যন্ত্রের মূল লক্ষ্য ছিলাে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় একটি শক্তিশালী সরকারের প্রতিষ্ঠা। বােধগম্য কারণেই এই সরকারে আকবর খান কিংবা ষড়যন্ত্রের অপর নেতা ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক খানের অংশীদারিত্বের অভিলাষ থাকলেও থাকতে পারে।

কথিত এই ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার দায়ে স্বনামধন্য বামঘেষা উর্দু কবি ফয়েজ আহম্মদ ফয়েজকে গ্রেফতার করা হয়। যে কারণে পিণ্ডি ষড়যন্ত্রে বামপন্থী বা সমাজতান্ত্রিক সােভিয়েট সমর্থনের বিষয়টিকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সরকার ব্যবস্থাপনার প্রতি অসন্তুষ্ট সামরিক জান্তার এই প্রথম প্রকাশ্য যড়যন্ত্রটি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে যায়। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের তৎকালীন গভর্ণর আই আই চুম্বীগড় গােয়েন্দাসূত্র মারফত প্রাপ্ত এই ষড়যন্ত্রের তথ্য প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি যথারীতি প্রতিরক্ষা সচিব ইস্কান্দার মীর্জা এবং একই সাথে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইউব খানকে অবহিত করেন। ফলে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের পূবেই এর হােতারা গ্রেফতার হন এবং আদালত অভিযােগ প্রমাণিত হবার পর বিভিন্ন মেয়াদে তাদের কারাদণ্ডও হয়। উল্লেখ্য যে, এই বিশেষ আদালতে বিবাদী বা ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষে কৌসুলি ছিলেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। আর তার এই কৌসুলির ভূমিকাকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে শুরু হয় আইউব-সােহরাওয়ার্দী রাজনৈতিক বিভেদ। অর্থাৎ পিণ্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় শহীদ সােহরাওয়ার্দীর কৌতূহলী ভূমিকা আইউব খানের একেবারেই মনােপুত হয়নি। কেনাে হয়নি তা আরাে কৌতুহলােদ্দীপক। এমনও হতে পারে যে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর প্রকৃত ঘটনার রহস্য উদঘাটনের প্রচেষ্টার মধ্যে আইউব খান তার জন্যে। বিপজ্জনক কোনাে আলামত অনুমান করে থাকবেন যা এই ষড়যন্ত্রের সাথে তাকেও জড়িত ‘ করে ফেলতে পারে। আইউব খান আদালতে সােহরাওয়ার্দীর মন্তব্য এবং ভূমিকা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্যে অপমানকর বলে জোরালাে অভিযােগ উত্থাপন করে তাকে এ ব্যাপারে আর অগ্রসর না হবার বন্দবস্ত করেন। ১৯৫১ সালে রাওয়ালপিণ্ডির জনসভায় বেসামরিক প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের প্রকাশ্যে আততায়ীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণের ঘটনা পাকিস্তানের গােপন প্রাসাদ ষড়যয়েরই প্রথম সাফল্য বলে মনে করা হয়। বলা বাহুল্য, এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য আর কোনােদিনই উন্মোচিত হয়নি। লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্রে কেন্দ্রীয় আমল-সামরিক চক্র নেপথ্যে পাকিস্তানী রাজনীতির মূল শক্তি করায়ত্ত করে নিতে সমর্থ হয়। এর আগে জিন্নাহ’র মৃত্যুর পর পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী মুসলিম লীগ নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন তার স্থলাভিষিক্ত হন।

খাজা নাজিমউদ্দিন গভর্ণর জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত হলেন বটে, কিন্তু ক্ষমতায় জিন্নাহ’র সামগ্রিক কর্তৃত্বের সিকিটুকুও পেলেন না। লিয়াকত আলী নিহত হবার পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আবারাে পরিবর্তন এলাে। এবার খাজা। নাজিমউদ্দিন লিয়াকত আলীর পদাভিষিক্ত হলেন। অর্থাৎ গভর্ণর জেনারেল থেকে প্রধানমন্ত্রী। উল্লেখ্য যে জিন্নাহ উত্তর পাকিস্তানে খাজা নাজিমউদ্দিনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার প্রত্যাশী বাঙালী জনগােষ্ঠীর আন্দোলনের মুখে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে উর্দুর পাশাপাশি বাঙলা ভাষাকেও রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিতে হয়। এই ঘটনা ১৯৫২ সালের। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের দু বছরের মধ্যেই খাজা নাজিমউদ্দিন সদলবলে। পাঞ্জাবী কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে বহিষ্কৃত হন। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ অপ্রয়ােজ্জনীয় মনে করে আকস্মিকভাবে ৫৩’র এপ্রিলে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভাকে অপসারিত করেন যদিও এ সময় খাজা নাজিমউদ্দিন গণপরিষদের বেশীর ভাগ সদস্যেরই আস্থাভাজন ছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তার এই পদক্ষেপটি ছিলাে একাধারে বাঙালী জাতিসত্তা এবং পাকিস্তানের কথিত সংসদীয় পদ্ধতির গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপর অদৃশ্য ষড়যন্ত্রকারী শাসক চক্রের প্রথম প্রকাশ্য আক্রমণ। উল্লেখ্য যে, খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সেই মুসলিম লীগ নেতা। যিনি ‘৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বাঙালী জাতিসত্তার দাবি প্রতিষ্ঠার বিরােধিতা করেছিলেন। যদিও তার শাসনামলেই বাংলা রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি লাভ করে। ঠিক একই কায়দায় কিংবা বলা যায় এর চেয়েও অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় এরপর এই শাসক চক্র পূর্ব পাকিস্তানে হক-সাহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন নির্বাচন বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকেও ভেঙে দেয়। এভাবেই ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ধারাকে রুদ্ধ করা হয় এবং পূর্বাঞ্চলে আমলা শাসন প্রবর্তনের অভিপ্রায়ে এরপর অবাঙালী বেসামরিক আমলা ইস্কান্দার মীর্জাকে পাঠানাে হয় গভর্নর করে। 

এই পর্যায়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি ব্যাপক নেতিবাচক মেরুকরণ পরিলক্ষিত হয়। কেন্দ্রে সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের অভিন্ন স্বার্থ একীভূত হওয়ার পাশাপাশি পাঞ্জাবের প্রভাবশালী ও শিক্ষিত ভূস্বামীরাও এই কেন্দ্রীয় প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সাথে নিজেদের স্বার্থের অভিন্নতা খুঁজে পায়। এ ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তর সম্প্র হিসেবে পাঞ্জাবী স্বার্থই প্রাধান্য পেলাে সবচেয়ে বেশি। বলা যায়, উগ্র পাঞ্জাবী জাতীয়তাবাদের এটা ছিলাে পাকিস্তানের ব্যাপক জাতিসত্তাগুলাের ওপর এক ধরনের জাতিগত আগ্রাসন এদিকে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় একটার পর একটা বেসামরিক অভ্যুত্থানের মহড়া পথাঃ অব্যাহত থাকে। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে খাজা নাজিমউদ্দিনকে অপসারণ করে সে ২’ মােহাম্মদ আলী বগুড়াকে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ করা হয়। এই সময় মােহাম্মদ আলী ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু মাত্র কয়েক ব্যবধানেই প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে তাকে তার পূর্বাবস্থায় ওয়াশিংটনে ফেরত পাঠানাে হয়। উল্লেখ্য যে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়ে মােহাম্মদ আলী বগুড়া পাকিস্তানের গণপরিষদে গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা হ্রাসের একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। এর ফলে গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ তার ওপর নাখােশ হন এবং তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করেন। এবার মােহাম্মদ আলী বগুড়ার স্থলাভিষিক্ত হলেন পাঞ্জাবী আমলা চৌধুরী মােহাম্মদ আলী। এরই মধ্যে আবার অসুস্থ গােলাম মােহাম্মদের হলে ক্ষমতার শীর্ষে উঠে এসেছেন ইস্কান্দার মীর্জা। তার সময়ে অর্থাৎ ১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে গভর্নর জেনারেল’ শব্দটি সংশােধন করে তার স্থলে প্রেসিডেন্ট শব্দের প্রচলন করা হয়। ইস্কান্দার মীর্জা হলেন পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট। চৌধুরী মােহাম্মদ আলী ছিলেন খুবই উচ্চাভিলাষী প্রকৃতির ব্যক্তি যা অদৃশ্য কুচক্রীদের জন্যে বিপদসংকুল বলে মনে হতে থাকে। ফলে বাধ্য হয়েই তারা অপর বাঙালী নেতা সােহরাওয়ার্দীকে দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী হবার সুযােগ করে দিলেন। সােহরাওয়ার্দী ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্ট মীর্জা এবং নেপথ্য সামরিক চক্রের সাথে আপােস রফায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। 

একদা যুক্তবাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা সােহরাওয়ার্দী এবার পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে পশ্চিমী কুচক্রীদের তাবেদারে পরিণত হলেন। নিছক ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যেই তিনি বাঙালীদের মতামত সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এমনকি তার নিজ দল আওয়ামী লীগের আদর্শকেও পদদলিত করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্রে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রতিও সমর্থন দিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদে বহাল হয়েই ঘােষণা করলেন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আর স্বায়ত্তশাসনের প্রয়ােজন নেই। বলা বাহুল্য বাঙালী নেতা সােহরাওয়ার্দী তার এই নতজানু আপােসের মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে পূর্ববঙ্গের বাঙালী জনগােষ্ঠীর সাথে সুস্পষ্ট বিশ্বাসঘাতকতাই করলেন। এটা সর্বজন স্বীকৃত যে তার এই বিভ্রান্তিসূচক অবস্থানকে কেন্দ্র করেই পরবর্তী কালে আওয়ামী লীগে ভাঙন ধরে। | ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের একমাত্র বিরােধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগের সংশােধিত অসাম্প্রদায়িক রূপ আওয়ামী লীগ তার মতাদর্শে প্রধানতঃ তিনটি বৈশিষ্ট্য। ধারণ করে। এই তিনটি মৌল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা প্রবর্তন, পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির অনুসরণ। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ভিত্তি তৈরী হয়েছিলাে এই তিনটি বৈশিষ্ট্যকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতালিপু আওয়ামী নেতা শহীদ সােহরাওয়ার্দী কেন্দ্রে ক্ষমতা পাবার লােভে আওয়ামী লীগের এই তিনটি দাবিকেই অকাতরে জলাঞ্জলি দেন।

উল্লেখ্য যে ১৯৫৫ সালে মারী প্যাক্টের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আপােস ফর্মুলা সম্পন্ন হবার পর বছর শহীদ সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এ সময় তিনি তার দল আওয়ামী লীগের দাবি দাওয়ার চেয়ে অধিকতর মনােযােগী হয়ে ওঠেন ক্ষমতায় নিজের অবস্থান পাকাপােক্ত করার প্রতি। মারী প্যাক্টের পর বিপ্র রাজনীতিক সােহরাওয়াদী বােধ করি। তার পাকিস্তানী প্রভুদের প্রতি একটু বেশী মাত্রায় আস্থাশীল হয়ে পড়েছিলেন। যে কারণে তিনি তার ক্ষমতার স্থায়িত্বের প্রতিও বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তিনি মাকিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার অনুগত পাকিস্তানী মুৎসুদ্দী পুঁজিপতিদের সেবাদাসে পরিণত হন। এ ক্ষেত্রে তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অপরিসীম প্রজ্ঞাও তাকে সাম্রাজ্জ্যবাদী অপশক্তির ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ করে তুলতে পারেনি। যে কারণে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনযন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীর লােভনীয় পদটি পেয়েই তিনি তার অবস্থানের সমর্থনে তাৎক্ষণিকভাবে দু’টি তত্ত্ব দাড় করাতে সচেষ্ট হন। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী অধিবাসী বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযােগ্যতার প্রশ্নে এই তত্ত্বের সম্ভবতঃ প্রয়ােজন ছিলাে। বস্তুতঃ এই তত্ত্ব দিয়েই তিনি আওয়ামী লীগের দাবি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি বিতর্কের মীমাংসা করতে ব্রতী হন। আওয়ামী কর্মসূচীর প্রথম কথা গণতন্ত্রের দফা তিনি রফা। করেন ক্ষমতায় যাবার পথেই। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তার পাকিস্তানী দোসরদের ষড়যন্ত্রে শহীদ সােহরাওয়ার্দী যখন। ক্ষমতায় বসলেন সেই সময় পাকিস্তান গণপরিষদে মােট ৮০ জন সদস্যের মধ্যে তার সমর্থনে ছিলাে মাত্র ১৩ জন। এই ১৩ জনের অগণতান্ত্রিক সমর্থন নিয়েই তিনি গণতন্ত্রের কুশ পুত্তলিকা দাহ করে কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী হন। আর তার এই ক্ষমতারােহনে পাকিস্তানী কেন্দ্রীয় প্রভুদের সহযােগিতা ছিলাে অনস্বীকার্য। গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার শর্ত এখানে অবান্তর। এই অগণতান্ত্রিক পথ ধরে ক্ষমতায় আরােহনের পর পরই শহীদ সােহরাওয়ার্দী সদম্ভে ঘােষণা করলেন তার প্রথম তত্ত্ব। বললেন, আমার ক্ষমতায় যাবার মধ্য দিয়েই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের স্বায়ত্তশাসন দাবির শতকরা ৯৮ ভাগ পেয়ে গেছে। কাজেই স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে কোনাে আন্দোলনের আর বিশেষ প্রয়ােজন নেই। আওয়ামী লীগের ঘােষণাপত্রে এরপর বাকি থাকে স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি। এই নীতি খণ্ডনের প্রশ্নে সােহরাওয়ার্দী তার দ্বিতীয় তত্ত্ব দাড় করালেন এভাবে ০+0+ ৫ = ৫। বলাইবাহুল্য এই তত্ত্ব দিয়েই তিনি পাক-মার্কিন চুক্তিসহ মার্কিন সমর্থনপুষ্ট পাকিস্তানের অন্যান্য সামরিক চুক্তিগুলাের পক্ষে তার সমর্থন ব্যক্ত করলেন। অর্থাৎ তার এই উক্তির মধ্যদিয়ে তিনি প্রকারান্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই একমাত্র শক্তি ধরে নিয়ে বাদবাকি দেশগুলােকে শূন্যগর্ভ হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু এতাে বিসর্জনের পরও ক্ষমতায় অধিক কাল টিকে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হলাে না। প্রয়ােজন ফুরিয়ে যাবার পর পরই পাকিস্তানী প্রভুদের ধাক্কায় তিনি আবার ক্ষমতাচ্যুৎ হলেন।

অন্যদিকে দলের সাথে তার বিশ্বাসঘাতকতা করার কারণে দলের অভ্যন্তরে দেখা দেয় দ্বিধাবিভক্তি। দলের অনেকেই তার এইসব অসার তত্ত্বের পক্ষে সায় দিলেন না। মাওলানা ভাসানী স্বয়ং বেকে বসলেন। ফলে পাকিস্তানের অদ্বিতীয় বিরােধী দল আওয়ামী লীগে ভাঙ্গন অনিবার্য হয়ে উঠলাে। | পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় রদবদলের এই পর্যায়ে সােহরাওয়ার্দীর স্থলাভিষিক্ত হলেন বােম্বের ব্যারিস্টার আই, আই চন্দ্রিগড়। মাত্র ৫৯ দিন ক্ষমতায় থাকার পর চুড়িকেও ক্ষমতাচ্যুত করে পাকিস্তানের সপ্তম প্রধানমন্ত্রীর পদে ডেকে আনা হলাে পাঞ্জাবী ভূস্বামী মালিক ফিরােজ খান নুনকে। ফিরােজ খান নুন ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। এর আগে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় তিনি স্বল্পকালের জন্যে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরােজ খান নুন ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন মাত্র এক বছর। ১৯৫৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। এরপর ফিরােজ খান নুনের অপসারণ উত্তর পাকিস্তানের রাজনীতিতে বেসামরিক পর্বকে আর এগিয়ে যেতে দেয়া হয়নি। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা রাষ্ট্রযন্ত্রের লােক দেখানাে গণতান্ত্রিক অবকাঠামােগুলাে বাতিল করে দিয়ে ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে দেশব্যাপী সামরিক শাসন জারি করলেন। এবার

দেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইউব খান মনােনীত হলেন প্রধানমন্ত্রী এবং একই সাথে । প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। ফলে যা হবার তাই হলাে। জেনারেল আইউব মাত্র তিন সপ্তাহের মাথায় প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জাকে শুধু ক্ষমতা থেকেই নয় দেশ থেকেও বিতাড়িত করলেন। এখন তার সামনে আর কোনাে প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বিশাল রাষ্ট্রযন্ত্রের সামগ্রিক ক্ষমতা একহাতে মুঠিবদ্ধ করে এবার তিনি জেঁকে বসলেন বহুদিনের বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দুতে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ সাল—এই হলাে পাকিস্তানী রাজনৈতিক তৎপরতায় বেসামরিক পর্বের প্রথম ১১ বছর। এই ১১ বছরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা থেকে পর পর সাত জন প্রধানমন্ত্রীকে প্রয়ােজনীয় যে কোনাে উপায়ে অপসারণ করা হয়। এর মধ্যে লিয়াকত আলী খানই প্রথম এবং একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি হিংসাত্মক উপায়ে ক্ষমতাচ্যুত হন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই ১১ বছরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কখনাে কোনাে সরকারের পরিবর্তন হয়নি। | ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানে ইসকান্দার মীর্জার সামরিক শাসন জারি এবং আইউবের ক্ষমতা দখলের মধ্যদিয়ে নতুন এক দশকের দুর্বিষহ পদচারণার সূচনা হয়। পাকিস্তানে বেসামরিক লেবাসে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের প্রথা চালু করেন এই আইউব খানই। গণতন্ত্রের শেষ চিহ্নটুকু তিনি মুছে ফেললেন পাকিস্তানের মাটি থেকে। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ সাল—এই ১১ বছরে কালাে অধ্যায় জুড়ে তিনি একাই পাকিস্তানের ক্ষমতায় দোর্দণ্ড প্রতাপ নিয়ে বিচরণ করেন এরপর ১৯৬১ সালে দেশ জুড়ে আইউব বিরােধী গণঅভ্যুত্থানের মুখে পাকিস্তানের এই লােহমানব মতা থেকে সরে দাড়াতে বাধ্য হন। এই পর্যায়ে পাকিস্তানের শীর্ষ ক্ষমতায় একই সামরিক ছড়ি বগলে চেপে উঠে আসেন জেনারেল আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান।

এই ব্যক্তিই শেষ পর্যন্ত বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে প্রতিহত করতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে নারকীয় গণহত্যা লীলার জন্ম দিয়ে ইতিহাসে কুখ্যাত স্বৈরাচারী একনায়ক হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করেন এবং এখানেই মুসলিম রাষ্ট্র অখণ্ড পাকিস্তানের ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটে। জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তান তুলনামূলকভাবে একটি বড় আকারের সশস্ত্র বাহিনীর অধিকারী হয়। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী মূলতঃ ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীরই ঔরসজাত এবং এই মূল বাহিনী থেকে ভারত বিভক্তির একই সমীকরণে বিভক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালে একটি নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী গড়ে ওঠে পাকিস্তানের ভৌগােলিক সীমানায়। ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসন ও শােষণ নিরংকুশ করার স্বার্থেই ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ভারতীয়দের সমন্বয়ে একটি দেশীয় বাহিনী গঠনের প্রয়ােজন অনুভব করে। আর এই প্রয়ােজনের কথা ভেবেই সৃষ্টি হয় ব্রিটিশের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীনে ভারতীয় বাহিনী। ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীর জন্মলাভের দিনক্ষণ সঠিকভাবে নির্ণয় করা কিছুটা কষ্টসাধ্য। তবে শুরু থেকেই অর্থাৎ ভারতে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ভারতীয়দের সমন্বয়ে গঠিত একটি ভাড়াটে বাহিনী তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে নিয়ােজিত থাকে। ইতিহাসে এই

তাবেদারী বাহিনী সিপয়’ বা ‘সিপাহী বাহিনী নামেই সমধিক পরিচিত। তাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্রের যােগান ইংরেজরা নিজেরাই দিতাে এবং সংগত কারণেই দেশীয় বাহিনীর তুলনায় ইংরেজদের গড়া এই বাহিনীর দক্ষতা এবং কর্মক্ষমতা ছিলাে অনেক উন্নত মানের। ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের সঙ্গে সংঘটিত পলাশীর ছােটোখাটো একটি যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন। এই যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যদের পাশাপাশি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর। সেই ভাড়াটে বাহিনীও শরিক হয়। এর কিছুদিন পর ১৭৬৪ সালে দিল্লির মােঘলদের বিরুদ্ধে। বক্সারের যুদ্ধেও একই তাবেদার ভারতীয় বাহিনী ইংরেজের নেতৃত্বে যুদ্ধ করে এবং এই যুদ্ধের পরিণতিতেই দিল্লির সম্রাট ইংরেজের বশ্যতা স্বীকার করে বৃত্তিভােগী হন। | ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইংরেজের কর্তৃত্বাধীন ভারতীয় বাহিনী দ্বিধাবিভক্ত। হয়ে পড়ে। ফলে ভারতে ইংরেজ শাসনব্যবস্থা অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ভারতীয়। সৈনিকদেরই একটি অংশ অপর অংশের এই বিদ্রোহ দমন করে। | ভারতীয় বাহিনীর শিখ ও গুর্খা সম্প্রদায় ছিলাে সাধারণভাবে ইংরেজের অনুরক্ত। তারাই স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হয়ে ইংরেজদের পক্ষে মরিয়া হয়ে লড়ে এবং শেষাবধি সিপাহীদের বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে যায়। সিপাহী বিদ্রোহের ব্যাপ্তী ছিলাে আড়াই থেকে তিন বছর। ১৮৫৯ সালে এই বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে।

১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতে সরাসরি তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ফলে ইংরেজ অধীনস্থ ভারতীয় বাহিনী এক ভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। প্রভু ভক্তির কারণে। এরপর বেশ কয়েক দশক পর্যন্ত এই ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীতে শিখ ও গুর্খা সম্প্রদায়ের। প্রাধান্য অব্যাহত থেকে যায়। ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনী বিশ শতকের প্রথম দিকেও একটি ঔপনিবেশিক বাহিনীর অনুকরণে প্রতিষ্ঠিত ছিলাে। ছােটোখাটো বিদ্রোহ দমন এবং ঔপনিবেশিক স্বার্থ সংরক্ষণই ছিলাে এই বাহিনী লালনের মূল লক্ষ্য। এই পর্যায়ে কমাণ্ড বা নেতৃত্বে ইংরেজরাই ছিলাে। একচেটিয়া। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ভারতীয় বাহিনীর ব্যাপক রূপান্তর ঘটে। ব্রিটিশের প্রয়ােজনে এবং অবস্থার প্রেক্ষিতে ভারতীয় বাহিনীকে আধুনিক যুদ্ধোপযােগী করে গড়ে তােলার পাশাপাশি সংখ্যাধিক্যেও ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীর দ্রুত স্ফীতি ঘটানাে হয়। কৌশলগত কারণে সেনাবাহিনীর সাধারণ মানের ইউনিটসমূহের অফিসার পদে স্বল্প সংখ্যক ভারতীয়কে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া ততােদিনে শুরু হয়ে গিয়েছিলো। | প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীতে ভারতীয় অফিসারদের নিযুক্তির হার ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯১৮ সাল থেকে ইংল্যান্ডের স্যাণ্ডহার্স্ট সামরিক একাডেমীতে বছরে ১০ জন করে ভারতীয় প্রশিক্ষণার্থীর স্থান নিয়মিতভাবেই সংরক্ষণ করা হয়। এই পর্যায়ে ক্রমেই সেনাবাহিনীতে বর্ধিত সংখ্যায় ভারতীয় অফিসারদের প্রয়ােজন অনুভূত হতে থাকে। স্বল্প সময়ের মধ্যে অধিক সংখ্যক অফিসারের প্রশিক্ষণের প্রশ্ন প্রাধান্য পাওয়ায় ১৯৩২ সালে স্যাণ্ডহ্যান্টের অনুরূপ একটি সামরিক একাডেমী স্থাপন করা হয় উত্তর ভারতের হিমালয় সংলগ্ন দেরাদুনে। একটি ঔপনিবেশিক বেনিয়া শাসনের প্রতি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ভারতীয় অংশের সৈনিকসুলভ আনুগত্য ঠিক কতােখানি আন্তরিক ছিলাে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পরাধীন ভারতবণে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ আশ্রয়ে একটি সুশৃংখল এবং সুশিক্ষিত ভারতীয় বাহিনী গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির সময়কাল পর্যন্ত এই বাহিনী একটি ঐক্যবদ্ধ সামরিক শক্তির দৃঢ় ভিত্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলাে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ দিকে ১৯৪৫ সাল নাগাদ বিশাল এই বাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা ছিলাে প্রায় ২৫ লাখ। এই বাহিনীর ভারতীয় সৈন্যরাই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইংরেজদের হয়ে উত্তর আফ্রিকা, ইতালী, বার্মা প্রভৃতি রণাঙ্গনে অক্ষশক্তির মােকাবেলায় অভূতপূর্ব সাফল্য প্রদর্শন করে। ব্যাপক প্রশিক্ষণ এবং আধুনিকীকরণের সুবাদে বিশাল ভারতীয় বাহিনী এই সময় একটি আন্তর্জাতিক মানের কনভেনশনাল সেনাবাহিনীতে পরিণত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সাথে ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীও ভাগ হয়ে যায়।

ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর অধিকাংশ মুসলমান সদস্যই পাকিস্তানের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করে। ফলে উত্তরাধিকার সূত্রে পাকিস্তান ৬টি পদাতিক ডিভিশন ও একটি সাঁজোয়া ব্রিগেডের মালিকানা লাভ করে। অবশ্য উল্লিখিত সেনা ফরমেশনগুলাের কোনােটিই অস্ত্রশস্ত্র বা সন্ধ্যায় স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাে না। থাকবারও কথা নয়। কেননা ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীর কোনাে সেনা। ইউনিটই শুধুমাত্র মুসলমান সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয়নি। কৌশলগত কারণেই পাঠান, পাঞ্জাবী মুসলমান, শিখ এবং ডােগরা এই চার সম্প্রদায়ের সদস্যদের প্রতিটি সেনা ইউনিটে সমানভাবে ভাগ করে দেয়া হতাে। দেশ বিভক্তির ফলে শিখ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা নতুন সৃষ্ট ভারতীয় বাহিনীতে যােগ দেয়। ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীতে এই শিখ ও হিন্দু সম্প্রদায়ভূক্ত সৈন্য সংখ্যা বেশি থাকায় পাকিস্তানের চেয়ে ভারতীয় সসস্ত্র বাহিনীর আয়তন তুলনামূলক বড় হয়ে ওঠে। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশকেই একটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এবং এই সমস্যাটি দেখা দেয় বাহিনীর ফরমেশনগুলােতে সৈন্যসংখ্যার ঘাটতি নিয়ে। সমস্যা যাই থাকুক, পাকিস্তান এবং ভারত উভয়ই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি আধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর অধিকারী হয় শুরু থেকে। | ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীর বিভক্তি কালের উল্লেখযােগ্য ঘটনা ছিলাে পাকিস্তানের প্রতি ভারতের একটি অভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীর প্রস্তাব। ভারতীয় বাহিনীর জেনারেল কারিয়া ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীকে ভাগ না করার প্রস্তাব করলেন। তিনি ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের জন্যে ভারতের পক্ষ থেকে একটি অভিন্ন বাহিনী রাখার জোর সুপারিশ করেন। পাকিস্তান সরাসরি ভারতের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

| পাকিস্তান রাষ্ট্রের যাত্রার শুরু থেকেই তার সশস্ত্র বাহিনীর সিংহ ভাগেরও বেশি পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপনা গেড়ে বসে। প্রয়ােজনে নতুন নতুন সেনাছাউনির সৃষ্টি করা হয়। এর বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানে যেখানে রাষ্ট্রের ৫৬ শতাংশেরও বেশি জনগােষ্ঠীর বাস সেখানে মাত্র দু’টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন স্থানান্তর করা হয়। এই দুটি ব্যাটালিয়নের একটিতে ছিলাে আবার তিনটি কোম্পানী এবং অপরটিতে ছিলাে মাত্র দু’টি। অর্থাৎ দুটি ব্যাটালিয়নের একত্রিত সৈন্যসংখ্যা ছিলাে দেড় ব্যাটালিয়নেরও কম। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্যে এই দু’টি অসম্পূর্ণ ব্যাটালিয়নকে নিয়েই গঠিত হলাে একটি ব্রিগেড এবং এই ফন্ন সমর শক্তির নেতৃত্ব দিতে ঢাকায় এলেন জেনারেল আইউব খান জানুয়ারিতে। | সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম কমাণ্ডার-ইন-চীফ পদে অধিষ্ঠিত হন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর লেঃ জেনারেল স্যার ফ্রাংক মেসারভী। পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অক্টোবর ৪৭’র শেষ স রাহে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্রশস্ত্র কেনার উদ্দেশ্যে তার ইংল্যাণ্ড যাবার। কথা। সস্তি হলাে যে, মেসারভীর অবর্তমানে সেনাবাহিনীর কমাণ্ডার-ইন-চীফ পদে কাজ। চালাবেন মেজর জেনারেল ডগলাস গ্রেসী। তখনাে পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেশির ভাগ উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলাে ব্রিটিশ অফিসাররাই। | লণ্ডনের উদ্দেশে জেনারেল মেসারভীর প্রস্থানের পর যথারীতি জেনারেল গ্রেসী তার। স্থলাভিষিক্ত হন এবং মেজর জেনারেল রস ম্যাকে সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ হিসেবে নিয়ােগ পান। আর ঠিক তখনই অর্থাৎ ৪৭ সালের ২৪ অক্টোবর অন্তত ৫০ হাজার পাঠান। উপজাতির সমন্বয়ে গঠিত বিশাল এক বাহিনী নিয়ে পাকিস্তান কাশ্মীর আক্রমণের সূচনা করে। কাশ্মীরে পাকিস্তানের এই আক্রমণ ছিলাে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সময়ােচিত। জেনারেল মেসারভীর অনুপস্থিতি কাশ্মীর আক্রমণ প্রশ্নে পাকিস্তানের সামরিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টিকে সহজ করে দেয়। কেননা কাশ্মীর আক্রমণের প্রস্তুতিতে গােপনীয়তা রক্ষা। এবং একই সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যবহারে জেনারেল মেসারভীর সক্রিয় সমর্থন পাবার ব্যাপারে পাকিস্তানী নেতাদের মধ্যে যথেষ্ট সংশয় ছিলাে। শুরু থেকেই জিন্নাহ পাকিস্তানের সঙ্গে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর রাজ্যের অন্তর্ভূক্তিকে অবধারিত বলে ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু কাশ্মীরের অভ্যন্তরে বিরাজমান অবস্থা ছিলাে এই অনুমানের সম্পূর্ণ বিপরিত। রাজা হরি সিং চাচ্ছিলেন কাশ্মীরের জন্য এক ভিন্নতর অবস্থান। যদিও তার ওপর ভারতসহ বৃটিশের চাপ ছিলাে ভারতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিতে।

ঘটনার সূত্রপাত তখনই ঘটে যখন ৪৭ সালের আগস্টের শেষের দিকে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভূস্বর্গ কাশ্মীরে সংক্ষিপ্ত অবকাশ যাপনের জন্যে তার ব্রিটিশ সামরিক সচিব কর্নেল বিরুনীকে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা সম্পাদনের জন্য শ্রীনগর পাঠান। সামরিক সচিব পাচ দিন পর ফিরে এসে জানান যে রাজা হরি সিং জিন্নাহকে গভনর জেনারেল হিসেবে তাে নয়ই একজন সাধারণ পর্যটক হিসেবেও কাশ্মীরে প্রবেশের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। ঘটনার আকস্মিকতায় জিন্নাহ বেশ শংকিত হন এবং কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিচলিত হয়ে ওঠেন। জিন্নাহ রাজা হরি সিংয়ের প্রকৃত অভিপ্রায় জানার জন্যে গােপনে একজন দায়িত্বশীল দূতকে কাশ্মীরে পাঠান। দুত ফিরে এসে জানালেন যে রাজা হর সিং ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযুক্তির ব্যাপারে মােটামুটিভাবে মনস্থির করে ফেলেছেন। | জিন্নাহ’র পাঠানাে দূতের ব্যক্ত মতামতের মধ্যে বিস্তর অসঙ্গতি ছিলাে। রাজা হার সিংয়ের সিদ্ধান্ত জানার জন্য জিন্নাহর দূত কাশ্মীরের অভ্যন্তরে যে সমস্ত মাধ্যমের প্রায়ই হয়েছিলেন, তাদের নির্ভরযােগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে রাজা হরি সিং তথ্য পর্যন্ত ভারত কিবাে পাকিস্তানের সঙ্গে তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে কোনো ‘ই সিদ্ধান্তে পৌছতে পারেননি। | আসলে হার সিং এ সময় চরম বিভ্রান্তিতে ভুগছিলেন। তার সমস্যা ছিলাে একদিকে তা রাজ্যের বিশাল মুসলিম জনসংখ্যা। তার ধারণা ছিলাে ভারতের পক্ষে যােগদানের সিক এই ব্যাপক মুসলমান জনগােষ্ঠী প্রকারান্তরে বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। এর বিপরীতে পাকিত পক্ষে যােগ দিলে ভারতের দিক থেকেও যে আগ্রাসনের কি ছিলাে না, তা নয়। তাই রাজ্যের সর্বময় কর্তা হরি সিং চট করে নিজের স্বকীয়তা বা দীর্ঘদিনের রাজকীয় জীবন ও মর্যাদার কোনােটিই ত্যাগ করার পক্ষপাতি ছিলেন না। তার সম্ভবত এমন এক ছিলাে যে ভারত ও পাকিস্তানের মতাে কাশ্মীরও একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রে পরিণত হােক।’ এতে ইংরেজদের ঘাের আপত্তি ছিলো। লর্ড মাউন্টব্যাটেন নিজে শ্রীনগরে চারদিন থেকে সিংকে বােঝাতে চেষ্টা করলেন যে তাকে দুটোর মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে : হয় ভারত নয় পাকিস্তান।

১৫ আগস্ট ক্ষমতা হস্তান্তরের পর লর্ড ইসমে বৃটিশের প্রতিনিধি হয়ে আবারও শ্রীনগর গিয়ে হরি সিংকে আরও একদফা বােঝাতে সচেষ্ট হলেন। কিন্তু লর্ড ইসমের গৃহীত সেই উদ্যোগও ব্যর্থ হলাে। আর ঠিক তখনই জিন্নার দূত খবরাখবরের জন্যে গিয়ে পৌছলেন শ্রীনগরে। | এর আগে জিন্নাহকে অবকাশ যাপনের আমন্ত্রণ জানাতে হরি সিংয়ের ‘না’ সূচক সিদ্ধান্ত সঠিক ছিলাে এই অর্থে যে জিন্নার এই সময় শ্রীনগরে অবকাশ যাপন হরি সিংয়ের নিরপেক্ষ অবস্থানকে ভারত এবং বৃটিশ, এই দুই শিবিরেই প্রশ্নবােধক করে তুলতাে। বর্ধিত যে বিভ্রান্তি হরি সিং’র অভিপ্রায়কে ভুল বুঝতে পাকিস্তানকে তাড়িত করেছিলাে, তা ছিলাে কাশ্মীরে পাঠানাে জিন্নাহ’র দূতের সংগ্রহীত বিভিন্ন অসম্পূর্ণ তথ্য যার অনেকটাই ছিলাে অনুমান নির্ভর। | জিন্নাহ আর কালবিলম্ব না করে আধাসামরিক বাহিনী ও সীমান্ত প্রদেশের পাঠান উপজাতিদের সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী দিয়ে কাশ্মীর আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। সংগত কারণেই জিন্নাহ পাকিস্তানের নিয়মিত বাহিনীকে ব্যবহার করতে চাননি। তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তারা কাশ্মীর আক্রমণের ব্যাপারে সহযােগিতা করবে না। শুধু তাই নয়, কাশ্মীরে নিয়মিত বাহিনীর ব্যবহার পাকিস্তানকে সরাসরি ভারতে অবস্থিত ব্রিটিশ বাহিনীর মুখােমুখি করে তুলবে বলেও তিনি মােটামুটি নিশ্চিত ছিলেন। | ২৫ অক্টোবর রাজা হরি সিং আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যে ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং ২৬ অক্টোবর ভারতের সঙ্গে কাশ্মীর রাজ্যের সংযুক্তির কথাও ঘােষণা করেন। ২৭ অক্টোবর থেকে ভারতীয় নিয়মিত বাহিনী শ্রীনগরের উপকণ্ঠে অগ্রাভিযানরত পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিহত করে। পাকিস্তান প্রেরিত উপজাতীয় বাহিনীর পশ্চাদপসরণ রােধে গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ এ পর্যায়ে তার নিয়মিত বাহিনী ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন।

কিন্তু জেনারেল গ্রেসী সুপ্রীম কমাণ্ডার মাউন্টব্যাটেনের অনুমতি ছাড়া কোনাে রকম সামরিক পদক্ষেপ নিতে রাজি হলেন না যেমনটি আগেই আশংকা করা গিয়েছিলাে। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারী মাসে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের ফলে কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এ সময় ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীরের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশ নিজেদের দখলে রাখে। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হয় উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমের এক-তৃতীয়াংশ পর্বতসংকুল ভূখণ্ড অর্থাৎ আজাদ কাশ্মীর। কৌতূহলােদ্দীপক যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকগােষ্ঠী যখন কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ভারতের সাথে যুদ্ধে জড়িত হওয়ার মতাে ঝুঁকি নেয় তখন তার পূর্বাঞ্চল ছিলাে সম্পূর্ণ অরক্ষিত। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানের ৫৫ হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ড রক্ষায় নিয়ােজিত ছিলাে নিয়মিত বাহিনীর মাত্র ৫ টি রাইফেল কোম্পানী। অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে জিন্নাহ কাশ্মীরের বিনিময়ে তখন পূর্ব পাকিস্তানকে হারাতেও প্রস্তুত ছিলেন। | কমাণ্ডার ইন-চীফ হিসেবে জেনারেল গ্রেসীর কার্যকাল শেষ হওয়ার পর বেশ কিছু সিনিয়র জেনারেলকে ডিঙিয়ে আইউব খানকে উক্ত পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। আইউব খান ইতিমধ্যেই জেনারেল গ্রেসীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং গ্রেসীর আনুকূল্যই সম্ভবতঃ তাকে সেনাবাহিনীর এই উচ্চ পদটিতে আরােহণে সহায়তা করে থাকবে। এর আগে ১৯৪৯ সালের নবেম্বরে আইউব খান পূর্ব পাকিস্তানে তার দায়িত্ব পালন শেষে। রাওয়ালপিণ্ডিতে সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে ফিরে যান এবং এডজুটেন্ট জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৫১ সালের ১৭ জানুয়ারী আইউব খান সেনাবাহিনীর কমাণ্ডার-ইন-চীফ হিসেবে গ্রেসীর স্থলাভিষিক্ত হন। তার এই দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়েই পাকিস্তানে সেই ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সূচনা হলাে যে অধ্যায়ের ধারাবাহিকতায় তারই রােপিত বীজ অনৈক্য আর বিশৃংখলার মধ্য দিয়ে কালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের খণ্ডিতকরণের মহান কাজটি সম্পন্ন হয় । ১৯০৭ সালের ১৪ মে রাওয়ালপিণ্ডির ৫০ মাইল উত্তরে হাজারা জেলার অন্তর্গত রেহানা গ্রামে। আইউব খানের জন্ম। তার পিতা ছিলেন ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সেনাবাহিনীর হডসন অশ্বারােহী রেজিমেন্টের একজন জুনিয়র কমিশনড অফিসার-রিসালদার মেজর (সুবেদার মেজরের সমকক্ষ)।

স্বাধীন পাকিস্তানে আইউবের চালচলনে একটি রাজকীয় ভাব লক্ষ্য করা গেলেও আদতে তিনি ছিলেন খুবই সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তার শৈশব এবং কৈশাের এই দুই-ই অতিবাহিত হয়েছে রক্ষণশীল পরিবেশের মধ্য দিয়ে। আইউব ছিলেন তারিন বংশােদ্ভূত । এরা ছিলাে মূলতঃ একটি উপজাতীয় গােষ্ঠী এবং এদের আগমন ঘটেছিলাে আফগানিস্তান থেকে। দীর্ঘদিন ধরে এই উপজাতির লােকেরা প্রতিবেশী শিখদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত থেকেছে। ফলে মানসিকভাবে এরা বংশানুক্রমে শিখ বা হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি বৈরী থেকে যায়। কালের ক্রমবিবর্তনেও এই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেনি। পর্বতবেষ্টিত রেহানা গ্রামের মতােই তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও ছিলাে সংকীর্ণতায় আবদ্ধ। এই দৃষ্টির সীমা কখনােই চারদিকের সফেদ বরফে আচ্ছাদিত সুউচ্চ পর্বতের শৃঙ্গ ভেদ করে উদার আকাশকে স্পর্শ করতে পারেনি। ছাত্র হিসেবে আইউব ছিলেন খুবই সাদামাটা। কৈশােরে একের পর এক স্কুল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অবশেষে ১৯২২ সালে তিনি কোনােক্রমে মাধ্যমিক স্তর অতিক্রম করেন। এরপর আইউব খান আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের জন্যে সেখানে যান। কিন্তু আইউবের স্নাতক ডিগ্রী লাভ করা আর হলাে না। ভাগ্যক্রমে ইংল্যাণ্ডের স্যাগুহাষ্ট সামরিক একাডেমীতে শিক্ষা লাভের এক দুর্লভ সুযােগ ঘটে যায় তার জীবনে। আর এভাবেই জীবন প্রবাহের চাকাও ঘুরে যায় আইউবের। বলা যায়, অনায়াসলব্ধ আশীর্বাদই নিয়মিত বর্ষিত হয় তার ওপর। | ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২০ বছরের চাকরি জীবনে আইউব খান খুব সাধারণ মানের একঙ্কন অফিসার হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। বার্মার যুদ্ধক্ষেত্র বা শান্তিকালীন সেনা। কর্মকাণ্ডের কোথাও তেমন কোনাে কৃতিত্বের স্বাক্ষর তিনি রাখতে পারেননি তার এই দীঘি সৈনিক জীবনে। | ৪৭ সালে স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকে শুরু হয় আইউবের অব্যাহত উত্থানের পালা। প্রথমেই পশ্চিম পাঞ্জাবের ওয়াজিরিস্তানে একটি ব্রিগেডের নেতৃত্ব লাভের সুযােগ হয় তার।

সেখান থেকে পদোন্নতি লাভ করে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি নিযুক্ত হন। পূর্ব পাকিস্তানে জিওসি থাকাকালীন সময়ই খুব কাছ থেকে রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের প্রত্যক্ষ করেন আইউব। সম্ভবতঃ তার মনে তখন থেকেই নিজস্ব নেতৃত্বে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রীয় অবকাঠামাের জ্বণ জন্মলাভ করে। পরে আইউব খান সেনা সদর দপ্তরে এডজুটেন্ট জেনারেল হন এবং সবশেষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে তার উত্থান ঘটে। এরপর পাকিস্তানে একটি সৈনিকরাজ কায়েম করে তবেই তার এই দীর্ঘ বিজয় যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটে। | পিণ্ডি ষড়যন্ত্র এবং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর আততায়ী কর্তৃক নিহত হওয়া এই দু’টি ঘটনাই ঘটে প্রধান সেনাপতি হিসেবে আইউব খানের কার্যভার গ্রহণের অল্প কয়েক মাসের মধ্যে। এ সবের দায়দায়িত্ব একেবারে ঝেড়ে ফেলা আইউবের পক্ষে কখনােই সম্ভব হয়নি। একাধারে প্রধান সেনাপতি এবং সেনা গােয়েন্দা সংস্থার খবরদারী তার হাতে থাকা সত্ত্বেও লিয়াকত আলীকে পিণ্ডি ষড়যন্ত্রের কথা জানতে হয় উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের গভর্নর আই আই চুন্দ্রিগড়ের কাছ থেকে। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এই তথ্য জানার পরই আইউব খান সমস্যাটির সমাধানে তৎপর হন। ফলে পিণ্ডি ষড়যন্ত্র আপাততঃ ব্যর্থ হয়। কিন্তু এর কিছুদিন পর ঘাতকের হাতে লিয়াকত আলী খানের মৃত্যু এটাই প্রমাণ করে যে ষড়যন্ত্রের বিস্তৃতি একেবারে উপড়ে ফেলা হয়নি। তার শেকড় তখনাে পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিলাে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের উৎসমূলে।

এই পিণ্ডি ষড়যন্ত্রকে সামনে রেখে বেশ কিছু উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাকে সেনাবাহিনী থেকে বিতাড়িত করা হলাে। আইউব খান সুকৌশলেই এই কার্যটি সম্পাদন করেন। ফলে আইউবের কোনাে প্রতিদ্বন্দ্বীই সেনাবাহিনীতে আর রইলাে না। এর কিছুদিন আগে আইউবের প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী জেনারেল ইফতেখার ও জেনারেল শের খান এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। রাহু যেনাে প্রভাবমুক্ত রাখলাে আইউবকে আগাগোড়াই। আইউব খান যখন প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পেলেন তখন ইস্কান্দার মীর্জা ছিলেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব। দুজনের অভিন্ন স্বার্থের কারণে তাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। দুজনই বুঝে নেন যে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌছবার প্রয়ােজনে দু’জনই দুজনার। আর এভাবেই শুরু হয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কক্ষপথে আইউবমীর্জার যৌথ পরিক্রমণ। | ‘৫৩ সালে গােষ্ঠীগত দাঙ্গা দমনে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে জারিকৃত সামরিক আইন সেনাবাহিনীকে প্রথমবারের মতাে ক্ষমতার স্বাদে প্রলুব্ধ করে। সেই সাথে সেনাবাহিনীও বুঝে নেয় যে শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের মধ্যে যে ঝুঁকি থাকে সেখানে কার্যতঃ জনগণ তেমন কোনাে বাধার সৃষ্টি করে না। আইউব খান ব্যক্তিগতভাবে এই উপলব্ধিতে প্রভাবিত হন। পূর্ব পাকিস্তানে থাকাকালীন রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের আলােকে এবং পাঞ্জাবে সামরিক আইনের কঠোর বাস্তবায়নে ব্রতী হবার মধ্য দিয়ে আইউব খান তার ব্যক্তিগত অভিলাষকে আরাে পরিপূর্ণ করে তােলার অবকাশ পেলেন। তার এই পথ পরিক্রমায় আর যে একজন তাকে সাহায্য করলেন তিনি হলেন বয়ােবৃদ্ধ গভর্ণর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ। এককালের বেসামরিক আমলা অথর্ব এই পাঞ্জাবী কুচক্রী গােলাম মােহাম্মদ জেনারেল আইউব খানকে ক্ষমতায় আরােহণের সিড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেন। গভর্ণর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ ইতিমধ্যেই একমাত্র পাঞ্জাব ব্যতীত পাকিস্তানের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের কাছে একজন অযােগ্য শাসক হিসেবে পরিচিত হয়েছেন।

এ ছাড়াও কুচক্রী হিসেবেও তার অপবাদের সীমা ছিলাে না। সবসময়ই তিনি বাঁকাপথ অনুসরণ করাকেই শ্রেয় কূটনৈতিক চাল বলে মনে করেছেন। পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় পাঞ্জাবের শুটিকে শক্ত করার জন্যে তিনি জিন্নাহর ফেলে যাওয়া অবশিষ্ট গণতান্ত্রিক অবকাঠামােকে সাফল্যজনকভাবেই বিনষ্ট করতে থাকেন। পূর্ব পাকিস্তান প্রশ্নে তিনি ছিলেন সাংঘাতিক রকম। বিদ্বেষপরায়ণ। ‘৫৩ সালের নাজিমউদ্দিন মন্ত্রিসভাকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করে তিনি বাঙালীদের প্রতি তার এই বৈষম্যমূলক বিদ্বেষী আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। এটা সহজেই অনুমেয় যে কমাণ্ডার-ইন-চীফ জেনারেল আইউব খানের সমর্থন ছাড়া এই ঘটনা ঘটানাে গভর্ণর জেনারেলের পক্ষে সম্ভব ছিলাে না। সব থেকে মজার ব্যাপার হলাে এই গােলাম মােহাম্মদই সেই ব্যক্তি যিনি সেনাবাহিনী প্রধান আইউব খানকে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্যে মনােনীত করেছিলেন। শুধু পাকিস্তানের জন্যেই নয় সমকালীন ইতিহাসে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা সম্ভবতঃ এটাই প্রথম। ‘৫৪ সালের ২৪ অক্টোবর গােলাম মােহাম্মদ পাকিস্তানের গণপরিষদ ভেঙে দেন। কেননা গণপরিষদে ইতিমধ্যে সর্বসম্মতিক্রমে একটি বিল গৃহীত হয় যার আওতায় গভর্ণর জেনারেলের মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়ার ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, কেন্দ্রে নিরংকুশ ক্ষমতার সমর্থক সেনাপতি আইউবের সমর্থন ছাড়া গণপরিষদ ভেঙে দেয়ার এই পদক্ষেপ গ্রহণ গভর্ণর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদের পক্ষে একেবারেই সম্ভব ছিলাে না। বিলুপ্ত গণপরিষদ সভাপতি বাঙালী তমিজউদ্দিন খান এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সিন্ধু হাইকোর্টে এক মামলা দায়ের করেন, যার রায় তমিজউদ্দিন তার পক্ষেই পেলেন। কিন্তু পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টে তিনি হেরে যান। সুপ্রীম কোর্টের চীফ জাষ্টিস মুনির প্রদত্ত এই রায় ছিলাে পক্ষপাতদুষ্ট এবং পাকিস্তানের সকল মহলই সে বিষয়ে অবগত ছিলাে। গণপরিষদ ভেঙে দেয়ার পর মুহম্মদ আলী বগুড়ার নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভায় কমাণ্ডার– . ইন-চীফ জেনারেল আইউব প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং ইসকান্দার মীর্জা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যােগ দেন। আইউব খান কিন্তু একই সাথে সেনাবাহিনী প্রধানের পদটিও ধরে রাখলেন। মন্ত্রিসভায় যােগদানের প্রশ্নে এটাই ছিলাে তার শর্ত।

এর ফলে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আমলাতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রের সফল বাস্তবায়ন ঘটলাে এবং সেই সাথে পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে রাজনীতিবিদদের বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠলাে। ইতিমধ্যে গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ চিকিৎসার জন্যে বিদেশে গমন করনে। ইস্কান্দার মীর্জা অস্থায়ীভাবে গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। ফলে আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আরাে একধাপ অগ্রসর হলাে। ক্ষমতায় আসার পর পরই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হিসেবে ইস্কান্দার মীর্জা তার ক্ষমতা অধিকতর সুসংহত করার জন্যে ব্যাপক কুটকৌশল গ্রহণ করেন। ” পূর্ব অভিবতা এবং নীরব আঁতাতের কারণে জেনারেল আইউব খানকে প্রথমতঃ তিনি। ক্ষমতায় প্রতিধী মনে করলেন না। তিনি বরং মনােযােগ দিলেন দেশের বিশংখল। রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে যতােটা সম্ভব নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার প্রতি। আর এই উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কূটকৌশলী ইস্কান্দার মীর্জা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী রাজনীতিকদের মধ্যে নতুন মেরুকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। এ সময় তিনি হক-ভাসানীসােহরাওয়ার্দীর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা করেন। আর এই পরিকল্পনার রূপায়ন করতে গিয়ে তিনি ফজলুল হকের বিরুদ্ধে সােহরাওয়ার্দীকে একান্ত আস্থাভাজন হিসেবে কাছে টানলেন। অথচ এই ঘটনার অল্প কিছুদিন আগে তিনি এই সােহরাওয়ার্দীকেই দেশদ্রোহী হিসেবে প্রকাশ্যে চিহ্নিত করেছিলেন। কিন্তু গােল বাধলাে ক্ষমতায় ইস্কান্দার মীর্জার আধিপত্ত সুসংহত করার উদ্যোগ নিয়ে। দূরদর্শী আইউব খান তার এই উদ্যোগকে স্বভাবতঃই সুনজরে দেখেননি। ফলে ইস্কান্দার মীর্জা ও আইউব খানের মধ্যে। সম্পর্কের চিড় ধরতে শুরু করে। দুজনের মধ্যে অবিশ্বাসের পাহাড় গড়ে উঠতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। সম্পর্ক আরাে শীতল ও জটিল আকার ধারণ করে যখন ইস্কান্দার মীর্জা ‘৫৬ সালে প্রণীত শাসনতন্ত্রের অধীনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কার্যতঃ এ সময় থেকেই তাদের অভিন্ন স্বার্থে প্রকাশ্য ফাটল ধরতে শুরু করে এবং রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। একের পর এক ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের হেয় প্রতিপন্ন করার কাজ ইতিমধ্যে সফলভাবেই সমাপ্ত হয়। রাজনীতিকদের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টির মাধ্যমে জনমনে প্রচলিত রাজনীতির প্রতি চরম অনীহার ভাব গড়ে ওঠে।

আইউবের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী এবং স্বয়ং ইস্কান্দার মীর্জা ভালভাবেই এই বাস্তবতা সম্বন্ধে ওয়াকেবহাল ছিলেন। বেসামরিক আমলা মদদপুষ্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিরাজমান বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক অবস্থার প্রথম দিকেই ক্ষমতা দখল করে নিতে পারতাে। কিন্তু চতুর আইউব খান তা করলেন না। তিনি লােভ সংবরণ করলেন এবং ক্ষমতা গ্রহণের ব্যাপারে আরাে কিছু সময় নিতে চাইলেন। আইউব চাইলেন জনমনে অসন্তোষের ব্যাপক বিস্তার ঘটুক। সেই সঙ্গে পর্দার আড়াল থেকে সুতাের টানও অব্যাহত রাখলেন। পানি আরাে ঘােলা করা হলাে। রাজনীতির স্বাভাবিক ধারা আপনা আপনিই রুদ্ধ হয়ে এলাে। এ অবস্থায় সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল কোনাে সমস্যারই সৃষ্টি করলাে না। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর ইস্কান্দার মীজা পাকিস্তানের সংবিধান বাতিল করে দেশে সামরিক শাসন জারি করলেন। একই সাথে জাতীয় পরিষদ এবং মন্ত্রিসভাও বিলুপ্ত করা হলাে। ইস্কান্দার মীর্জা প্রেসিডেন্টই থেকে গেলেন আর কমাণ্ডার-ইন-চীফ আইউব হলেন একই সাথে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং প্রধানমন্ত্রী। | সামরিক শাসন জারিতে ইস্কান্দার মীর্জার বিলম্ব আর সইছিলাে না। কেননা ‘৫৯ সালের বসন্তে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে তার পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি ছিলাে এক রকম অসম্ভব। এর বিকল্প হিসেবে তিনি সামরিক শাসনের পথকেই বেছে নেন। কিন্তু ইস্কান্দার মীর্জা শেষ রক্ষা করতে ব্যর্থ হলেন। তিনি চেয়েছিলেন আইউবকে তুড়ি মেরে সফলভাবেই পার পেয়ে যাবেন। এর বিপরীতে বাস্তবতা ছিলাে ভিন্ন যা তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারেন নি। ইস্কান্দার মীর্জা নিঃসন্দেহে ধূর্ত ছিলেন কিন্তু বুদ্ধিমান না। পক্ষান্তরে আইউব ছিলেন ধীরস্থির বুদ্ধিদীপ্ত এবং অত্যন্ত সুচতুর। তিনি ঠিকই অনুধাবন করেছিলেন যে কোনাে এক সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আপনা আপনিই তার হাতে এসে যাবে এবং ইস্কন্দার মীর্জাই এ কাজটি তার জন্যে সহজ করে দেবেন। সে জন্যে আইউব সব সময়ই বিতর্কের উর্ধ্বে থাকার নীরব পথ ধরে এগিয়েছেন। ৭ অক্টোবর ইস্কান্দার মীর্জা যখন সামরিক শাসন জারি করতে চাইলেন তখন আইউব বাধা দিলেন না। বরং সুকৌশলে প্রধান সামরিক শাসকের পদটি বগলদাবা করে নিলেন। আর এভাবেই পাকিস্তানের রাজীতিতে ষড়যন্ত্রের ধারাটি অক্ষত্র থেকে যায় পূর্বাপর । পাকিস্তানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে এভাবেই ষড়যন্ত্রকারীদের ওপর নিজেদের সৃষ্ট ভূত এসে আছড় করেছে বারবার। এটাই ইতিহাসের অমােঘ সত্য। | পাকিস্তানে সামরিক আইন জারির কিছুদিনের মধ্যেই ইস্কান্দার মীর্জা বুঝতে পারলেন যে, যেহেতু শাসনতন্ত্র নাকচ ও সামরিক আইন ঘােষিত হয়েছে এবং দেশে একজন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত আছে, সে অবস্থায় ক্ষমতা প্রয়ােগের প্রশ্নে প্রেসিডেন্টর পদটি বান্তর। আইউব বানও এ বিষয়ে সম্যক অবগত ছিলেন। ইস্কান্দার মীর্জা নিজের অসহায়ত্বের কথা ভেবে ষড়যন্ত্রের অজুহাতে প্রথমেই আইউবের অনুরক্ত ব্রিগেডিয়ার ইয়াহিয়া খান, ব্রিগেডিয়ার হামিদ ও ব্রিগেডিয়ার মালিক শের বাহাদুরকে গ্রেফতারের উদ্যোগ নেন। এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য ছিলাে প্রধান সেনাপতি আইউব খানকে শক্তিহীন করে তাকে শায়েস্তা করা। কিন্তু ইস্কান্দার মীর্জা ভূলে গেলেন যে, পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কখনােই তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি এবং সেনাবাহিনীও কখনােই সাংবিধানিক কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রণে ছিলাে না। সুতরাং সেনা নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা ছাড়া বিকল্প কোনাে কর্তৃত্ব বা আদেশ সেনাবাহিনীর কারাে কাছেই গ্রহণযােগ্য নয়। ফলে এই সব উচ্চপদস্থ সেনা অফিসারদেরকে আটক করার নির্দেশ সংগত কারণেই কার্যকর হলাে না। ইস্কান্দার মীর্জার এই উদ্যোগ আইউব খান ঠিক সময় মতােই আঁচ করতে পেরেছিলেন। এ ছাড়া তখন সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ মােসাহেবদের প্রায় সকলেই ক্ষমতা দখলের প্রতিযােগিতায় অধৈর্য হয়ে ওঠেছে এবং এ লক্ষ্যে ক্রমাগত আইউব খানকে প্রভাবিত করতে থাকে। আইউব খান বুঝে নিলেন আর নয়, পাকিস্তানী রাজনীতির নাট্যমঞ্চে এবার তার পালা শুরু। দীর্ঘ অপেক্ষার শেষ পরীক্ষাটি পার হয়ে এরপর তিনি পাকিস্তানের পরবর্তী এক দশকের স্বৈরতান্ত্রিক ইতিহাসের স্রষ্টা হিসেবে আবির্ভূত হলেন।|

২৭ অক্টোবর রাত আনুমানিক ১০টার সময় আইউব খান মেজর জেনারেল বারী, মেজর জেনারেল আজম খান, মেজর জেনারেল শেখ ও ব্রিগেডিয়ার মালিক শের বাহাদুর—এই চার জনের সমন্বয়ে গঠিত একটি দলকে পাঠালেন ইস্কান্দার মীর্জার পদত্যাগ নিশ্চিত করার জন্যে। ইস্কান্দার মীর্জা যেনাে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। ঘুমের পােশাকেই নীচে নেমে এলেন তিনি এবং একটিও বাক্য ব্যয় না করে হাত বাড়িয়ে স্বাক্ষরের জন্য কাগজ চাইলেন। আর এভাবেই যবনিকা ঘটলাে পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক অধ্যায়ের। আইউব ক্ষমতায় এলেন কোনাে প্রকাশ্য বিরােধিতা ছাড়াই। বিশাল রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রতাপে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য আইউব সমসাময়িক ইতিহাসের অন্যতম স্বৈরশাসক হিসেবে আবির্ভূত হলেন। প্রথমেই তিনি রাজনীতির অবশিষ্টাংশকে নির্বাসনে পাঠালেন। রাজনীতির নাম গন্ধ মুছে ফেললেন পাকিস্তানের মাটি থেকে। তারপর। আমদানী করলেন নাম না জানা এক কাল্পনিক বিপ্লবকে। এবং তার সামরিক শাসনকেই। তিনি বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করলেন। পাকিস্তানই সম্ভবতঃ পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে বুর্জোয়া ধ্যান-ধারণাসিক্ত একটি সেনাবাহিনী রাজনীতিতে তথাকথিত এক বিপ্লব ঘটাবার কৃতিত্বের দাবিদার। | আইউব ‘উদ্ভূত এই বিপ্লব বাস্তবায়নের দায়িত্ব ঘাড়ে নিলেন সেনাবাহিনীর আমলারা। জনগণকে এরা কিছুই দিতে পারলাে না। দেশে তথাকথিত বিপ্লব পূর্ব বেসামরিক আমলাতন্ত্রের পরিবর্তে সামরিক আমলাতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটলে মাত্র। আচার-আচরণে এরা| ছিলাে বেসামরিক আমলাদের চেয়েও উন্নাসিক। এদের ধ্যান-ধারণা ছিলাে বাস্তবতা বর্জিত। এবং মধ্যযুগীয়। একদিকে পাশ্চাত্য মানসিকতা এবং এর বিপরীতে ধর্মীয় গােড়ামির সংমিশ্রণে তাদের নেতৃত্বে এক নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটলাে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়। আর এই দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলাে নিরংকুশ শাসন-শােষণ এবং ভারত বিদ্বেষ। এই ভারত বিদ্বেষ ক্রমেই যুদ্ধোন্মাদনায় পরিণত হলাে। নাদির শাহ’র অনুকরণে ভারত আক্রমণ করে তাকে ধ্বংস করার কল্পনাবিলাস শ্রেণী নির্বিশেষ পাকিস্তানী সেনা অফিসারদের সহজাত মানসিকতায় পরিণত হলাে। কাল্পনিক ভারতীয় আগ্রাসনের ধুয়া তুলে পাকিস্তানে সামরিক ব্যয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করা হলাে। ফলে সশস্ত্র বাহিনীর স্ফীতি ঘটতে লাগলাে জ্যামিতিক হারে। একটির পর একটি সেনাছাউনি গড়ে উঠতে লাগলাে দেশে। আর এর সবই হলাে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে পাশ্চাত্যের সামরিক উপকরণে সজ্জিত করা হলাে সশস্ত্র বাহিনীকে। বলা বাহুল্য, এই বিশাল ব্যয়ের ছিটেফোটাও পূর্ব। পাকিস্তানের ভাগ্যে এলাে না। কেবল পশ্চিম পাকিস্তানকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠলাে পাকিস্তানের বিশাল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। সামগ্রিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর শতকরা পঁচ ভাগেরও কম নির্ধারিত হলাে পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে। পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিরক্ষা বাহিনীর উপস্থিতি ছিলাে কেবল ‘প্রক্সি’রই নামান্তর। পূর্ব পাকিস্তান বরাবরের মতাে অরক্ষিতই রয়ে গেলাে। আকারে ইংগিতে এটাই বােঝানাে হলাে যে, পূর্বাঞ্চলের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের আশ্রিতরই সমমর্যাদাভুক্ত। কাজেই তাদের জন্যে বিশেষ কিংবা আলাদা কোনাে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়ােজন নেই। | ১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধের আগ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের ৪৪ শতাংশ মানুষের। প্রতিরক্ষার জন্যে নিয়ােজিত করা হয় ১২টি পদাতিক ডিভিশন ও বেশ কিছু স্বতন্ত্র ব্রিগেডসহ আনুমানিক ২টি পূর্ণাঙ্গ ট্যাংক ডিভিশন। এর বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ জনগােষ্ঠীর জন্যে বরাদ্দ ছিলাে ৩টি পদাতিক ব্রিগেডের সমন্বয়ে গঠিত ১টি মাত্র পদাতিক ডিভিশন। বিমান বাহিনীর ১৫ শতাংশই ছিলাে পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে ছিলাে সামরিক উপস্থিতির নিদর্শনস্বরূপ মাত্র ১০টি স্যাবর এফ৮৬ জঙ্গী বিমান। নৌবাহিনীর সবটাই ছিলাে পশ্চিমে। পূর্ব পাকিস্তানের জলসীমায় ছিলাে গােটা তিনেক সেকেলে ধরনের গানবােট। এ অঞ্চলের অরক্ষিত প্রতিরক্ষার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে নির্লজ্জের মতাে তাদেরকে প্রায়শঃই বলতে শােনা যেতাে, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিহীত। তাদেরকে এমন কথাও বলতে শােনা যেতাে যে, পূর্ব পাকিস্তান আক্রান্ত হলে কাশ্মীর দখল করে তার প্রতিকার করা হবে ! সুতরাং এই সম্ভাব্য পরিণতির মধ্যেই নিশ্চিত করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা।

১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আইউব খান এবং তার সশস্ত্র বাহিনী দ্বিতীয়বারের মতাে সামরিক পন্থায় কাশ্মীর দখলের উদ্যোগ নেয়। রেহানার পর্বতবেষ্টিত ছােট্ট গ্রামের মতাে সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা আচ্ছন্ন মানসিকতা নিয়েই আইউব খান দেখেছেন ভারতকে। ভারতের বিশালতা বা স্বাধীনতা পরবর্তী তার উন্নত প্রযুক্তি অর্জনের বিষয়টি বেমালুম দৃষ্টির আড়াল করে দেন আইউব ও তার সেনা কর্মকর্তারা। নিখুঁত পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণ চালিয়েও ১৭ দিনের যুদ্ধে কাশ্মীরের অভ্যন্তরে ছয় মাইল প্রবেশ করাও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। পক্ষান্তরে আজাদ কাশ্মীরের উরী, পুঞ্চ, টিথওয়াল এবং হাজীপীর এলাকার বিশাল ভূখণ্ডসহ পশ্চিম পাকিস্তানের স্থলভাগের এক বিরাট অংশও ভাবতের করতলগত হয়। একজন পাকিস্তানী সেনা সদস্য দশ জন ভারতীয় সেনার সমান এই পৌরাণিক গাথার আপাতঃ মৃত্যু ঘটে ৬৫ সালের যুদ্ধে। যুদ্ধের ফলাফল যাই হােক এবং পশ্চিম পাকিস্তানে এই যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি যেভাবেই বিবেচতি হােক, ‘৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধটি ছিলাে বিশেষভাবে বাঙালী মুসলমানদের চৈতন্য ফিরে পাবার এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার কথা বিন্দুমাত্র না ভেবেই পাকিস্তানের অভিজাত শাসকগােষ্ঠী কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় যুদ্ধের ১৭ দিন পর্যন্ত পাকিস্তানের পূর্বাংশ ছিলাে পশ্চিম থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন। অসহায়ত্বে নিমজ্জিত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ নিয়তির ওপর নির্ভর করেই উৎরে যায় এই সংকটকাল। ‘৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ বাস্তবিক অর্থেই বাঙালীদের জন্যে তাদের অবস্থানের প্রশ্নে এক নতুন রাজনৈতিক মূল্যায়ন বয়ে আনে। তারা এবার নিশ্চিত হয়ে যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নিরাপত্তার জন্যে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর আর নির্ভর করা। যায় না!’ পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত—এই সত্য জেনেও বাঙালী সেনা সদস্যরা ‘৬৫ সালের এই যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন রণাঙ্গনে বীরত্বের সাথে লড়ে। বাঙালী বৈমানিক, ট্যাংক তু এবং পদাতিক সৈন্যরা উন্নত মানসিকতার সর্বাত্মক বহিঃপ্রকাশ ঘটায় স্বল্পস্থায়ী এই যুদ্ধে ; কিন্তু এতাে কিছুর পরও যুদ্ধপরবর্তী পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালীদের সামগ্রিক অবস্থার তেমন কোনাে উন্নতি ঘটলাে না।

ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনের বদৌলতে এবং অভ্যুথান উত্তর দেয়া তার রাজনৈতিক অঙ্গিকারের প্রেক্ষিতে সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি পেয়ে মাত্র সাত শতাংশে গিয়ে পৌঁছতে সমর্থ হয়। এটা হলাে পাকিস্তান। সেনাবাহিনীতে বাঙালীদের ২৩ বছরের প্রাপ্তি। তারপরও পূর্ব পাকিস্তান আগের মতােই অরক্ষিত থেকে গেলাে। | ৬৫’র পাক-ভারত যুদ্ধ আইউবের সাত বছরের একটানা স্বৈরশাসনকে হঠাৎ করেই যেনাে খানিকটা বিতর্কিত করে তুললাে। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের চাপা অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে শুরু করে। একই সাথে পশ্চিম পাকিস্তানেও তুলনামূলক সুখে থাকা মানুষেরা কিছুটা অধৈর্য হয়ে উঠলাে। এমনকি আইউবের এককালের প্রিয়ভাজন উচ্চাকাকী ভুট্টো সাহেবও পাক-ভারত যুদ্ধে আইউবের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহ করে বসলেন। এটা ছিলাে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকগােষ্ঠীর মধ্যকার চরম মতান্তরের প্রাথমিক পর্যায়ের একটি বহিঃপ্রকাশ। যার পরিণতিতে ১৯৬৮ সালে পেশােয়ারে এক জনসভায় ভাষণ দানকালে আইউবের প্রতি গুলিও বর্ষিত হয়। আইউব খান তার নিজের মাটিতেও এরপর বিভিন্ন ইস্যুতে বিরােধিতার মুখােমুখি হতে থাকেন। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের বাঁচার দাবি ৬ দফাকে ভিত্তি করে ১৯৬৬ সালে আইউবী শােষণের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন পরবর্তীকালে ” বালার ছাত্রদের দাবি-দাওয়ার সাথে একীভূত হয়ে তীব্র আকার ধারণ করে এবং ৬৯ এ এ তা চুড়ান্ত বিস্ফোরণের মতােই গােটা পূর্বাঞ্চলের সর্বস্তরে গণজাগরণের সূচনা করে। দেশ পূর্ব-পশ্চিম উভয় অংশেই এ জাগরণ ছড়িয়ে পড়ে এবং একই সাথে শুরু হয় চা পরপাকড়। কিন্তু এই প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়েই উখিত গণআন্দোলন তার সংগ্রাম বা অব্যাহত রাখে। এ অবস্থায় সারা দেশে বিশেষ করে পূর্ব বাংলায় লাগাতার গণআন্দোলন””

অনিবার্য পরিণতিতে দেখা দেয় ব্যাপকতর প্রশাসনিক বিলা । এ অঞ্চলের জনগণ এক পর্যায়ে এমনকি সাংবিধানিক আইন প্রয়ােগের দায়-দায়িত্বও নিজেদের হাতে তুলে নেয়। গ্রামগঞ্জে চিহ্নিত সামাজিক শক্রদের বিরুদ্ধে তারা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। ৬৯’র ফেব্রুয়ারীতে শেষ রক্ষার চেষ্টা হিসেবে বিরােধী বলয়ের সাথে একটি রাজনৈতিক ঐকমত্যে পেীছার উদ্যোগ নেন চতুর আইউব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই অসময়ােচিত উদ্যোগের বাস্তবায়নে শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন তিনি। ক্ষমতার শিখরে ঠিক যেভাবে আইউবের উত্থান ঘটেছিলাে ঠিক সেভাবেই ইয়াহিয়া খান শনি গ্রহের মতােই উদয় হলেন পাকিস্তানের ভাগ্যাকাশে। তিনিও অপেক্ষা করছিলেন তার। অনুকুল সময়ের জন্যে। অর্থাৎ এতােদিনে তিনিও বুঝে গেছেন যে ইতিহাসে তার অনুপ্রবেশের সময় এসে গেছে। সেনাবাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খান তার অধীনস্থ গােয়েন্দা সংস্থা মারফত আইউব খানকে বােঝালেন যে, দেশ ধ্বংসের মুখােমুখি এবং এ অবস্থায় একটি সাধারণ। নির্বাচন পাকিস্তানের বিপর্যয়ই ডেকে আনবে। এবার সামরিক আইন জারি করা ছাড়া আইউবের সামনে আর কোনাে বিকল্প রইলাে না। | আইউব চাইলেন তিনি ক্ষমতায় থেকেই সামরিক আইন বলবৎ করবেন। কিন্তু তিনি ভুলে গেলেন যে ৫৮ সালের অক্টোবরেও এটা সম্ভব হয়নি। দশ বছর আগে আইউব যেভাবে ইস্কান্দার মীর্জাকে বলেছিলেন ইয়াহিয়া ঠিক একইভাবে আইউব খানকে বললেন যে সামরিক শাসন বলবৎ হলে সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে তিনিই থাকবেন তার মুখ্য কর্ণধার। আইউবের বুঝতে বাকি রইলাে না যে ইয়াহিয়া তার এই বক্তব্যে কি বােঝাতে চান। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটলো ঠিক এক যুগের মাথায় এসে। বয়ােবৃদ্ধ আইউব ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভাগ্যের চাকা হয়াহিয়া খানের দিকে ঘুরে গেলাে। সারাদেশে সামিরক আইন জারি করে ইয়াহিয়া খান ৬৯’র ২৫ মার্চ ক্ষমতা দখল করলেন। আবারাে উদি শাসনের ভূত চেপে ধরলাে পাকিস্তানকে। আইউব খানের জন্ম হয়েছিলাে রেহানায়, রাওয়ালপিণ্ডি থেকে ৫০ মাইল দূরে। ইয়াহিয়ার জন্ম চাকওয়ালে, রাওয়ালপিণ্ডি থেকে ৬৫ মাইল দূরে। আইউবের জন্ম হয়েছিলাে ১৯০৭ সালে আর ইয়াহিয়ার জন্ম ১৯১৭তে। জন্মগতভাবে দু’জনই ছিলেন সাধারণ পরিবারের সস্তান। দুজনের জন্মকালের ব্যবধান ১০ বছর হলেও শাসন ক্ষমতায় আইউবের ১০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরই ইয়াহিয়া পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসেন। এখানে দুজনের অভিন্ন এক দৈব মিল খুঁজে পাওয়া যায়। | ১৯৩৬ সালে ইয়াহিয়া পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। এরপর শুরু হয় তার সৈনিক জীবন। ১৯৩৮ সালে দেরাদুন সামরিক একাডেমী থেকে ইয়াহিয়া বৃটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি উত্তর আফ্রিকা রণাঙ্গন ও ইতালীতে বৃটিশের হয়ে যুদ্ধ করেন। ইতালীতে তিনি বন্দী হন। পরে অবশ্য পালাতেও সক্ষম হন এবং ১৯৪৪ সালের ভারতে ফিরে আসেন। ‘৪৭ সালে ভারত ভেঙে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলে লেঃ কর্নেল হিসেবে ইয়াহিয়া খানকে স্টাফ কলেজের অধিনায়ক নিয়ােণ করা হয়। ৫১তে ইয়াহিয়া ব্রিগেডিয়ার হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন এবং একটি পদাতিক ব্রিগেডের অধিনায়ক নিযুক্ত হন।

আর তখন থেকেই আইউবের সাথে গড়ে ওঠে তার সখ্যতা।  নারী এবং সুরাসক্তি ছিলাে ইয়াহিয়া খানের মজ্জাগত। এর পাশাপাশি আচরণে তিনি বরাবরই তার চরিত্রে কিছুটা ঔদাসীন্য ভাব ধরে রাখতেন। আসলে তার এই উদাসিনতার ভাবখানা ছিলাে অনেকটাই লােক দেখানাে। অত্যন্ত ধড়িবাজ প্রকৃতির লােক ছিলেন তিনি এবং প্রয়ােজনের তুলনায় অতিরিক্ত সুচতুর। তার এই বিশেষ চরিত্র উদাসীনতার আবরণে আর উচ্ছংখলতার আড়ালে ঢাকা পড়ে যেতাে অনায়াসেই। কালক্রমে ইয়াহিয়ার চরিত্রের এই বিশেষ কৃত্রিম দিকটাই তার জীবনের সর্বশেষ স্বপ্নের আসনটিতে তাকে প্রতিষ্ঠিত করে। | ‘৫৮ সালের অক্টোবরে আইউবের ক্ষমতার উচ্চাসনে আরােহণের পেছনে ইয়াহিয়ার অবদান ছিলাে খুবই উল্লেখযােগ্য। ক্ষমতা দখলের পুরাে ষড়যন্ত্রটাই ইয়াহিয়া যথেষ্ট নিপুণতার সাথে বাস্তবায়ন করেন আইউবের নির্দেশে। পরিকল্পনার কোথাও কোনাে বিচ্যুতি ঘটেনি। অভ্যুত্থানের সংগে জড়িত সবাই পুরস্কার গ্রহণ করলেও ইয়াহিয়া খান কিন্তু সৈনিকসুলভ আচরণের স্বীকৃতিস্বরূপ এই প্রাপ্তির লােভ থেকে সে যাত্রা দূরে থাকেন। ফলে তিনি আইউবের ব্যাপক আস্থা অর্জনে সমর্থ হন। ১৯৬৬ সালে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে জেনারেল মুসা অবসর নিলে সংগত কারণেই মদ ও নারী আসক্ত এবং আইউবের জন্যে নিরাপদ ইয়াহিয়া সেনাবাহিনী প্রধানের পদে নিয়ােগের জন্য প্রাধান্য পেলেন সকলের ওপর। আইউব আস্থার সঙ্গেই কয়েক জন সিনিয়র জেনারেলকে ডিঙিয়ে ইয়াহিয়ার এই নিয়ােগ অনুমােদন করলেন। | ‘৬৯’র মার্চে ইয়াহিয়ার ক্ষমতা দখলের ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সেনা শাসনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলাে আগের মতােই। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়া আন্দোলন হঠাৎ করেই যেনাে স্তমিত হয়ে গেলাে। কিন্তু পুরােপুরি স্তব্ধ হলাে না। দেয়ালের লিখন এবং রাজপথের রক্তের দাগ তখনাে জ্বলজ্বলেই থেকে গেলাে। ক্ষমতায় এসেই ইয়াহিয়া খান চমক সৃষ্টি করলেন। ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে। তিনি প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বললেন। ‘৫৮ সালে ক্ষমতায় এসে আইউব কিন্তু এমন কথা বলেননি।

তিনি অবজ্ঞা ভরে রাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। জনসমক্ষে এটাই আইউব আর ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনের মধ্যকার পার্থক্য। ‘৬৯ সালে এসে পিণ্ডির গােলটেবিল বৈঠকে শেষ রক্ষার জন্য আইউব সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছিলেন পুশ পাকিস্তানের বাঙালী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি সে সময় সাধারণ নিবাচন অনুষ্ঠানউত্তর পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্র কায়েমের কথাও বলেন। তখন ইয়াহিয়া খাল দেশের বিরাজমান বিস্ফোরণােন্মুখ পরিস্থিতির কথা বলে আইউব খানকে নিবাচন থেকে নিবৃত্ত করেন। কিন্তু আইউবের সেই কথাই ইয়াহিয়া জনগণকে বললেন কয়েক সপ্তাহে ব্যবধানে, ক্ষমতা দখলের অব্যবহিত পর। দেশের মানুষ বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীরা নতুন কিছু খুঁজে পেলাে ইয়াহিয়া, ভাষণে । তার কথাবার্তায় কিছুটা আশান্বিত হবার মতাে এক ধরনের ভিন্নতা দেখতে তারা। পাকিস্তানের ২২ বছরের ইতিহাসে গণতন্ত্র প্রবর্তনের জন্যে এমন করে প্রকাশ। কোনাে শাসক তখন অবধি করেনি। সঙ্গত কারণেই শ্রেণী নির্বিশেষ বাঙালীরা হয়া কঠোরতা এবং স্পষ্টবাদীতার মধ্যে প্রচ্ছন্ন আন্তরিকতার বাড়তি কিছু আলামত আবিষ্কার করলাে। একই কারণে বিদেশেও ইয়াহিয়া খান সমাদৃত হলেন। এমন কি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন কথা প্রসঙ্গে গ্রীসের রাষ্ট্রদূতকে তার দেশ গ্রীসে গণতন্ত্র উত্তরণে ইয়াহিয়া সৃষ্ট নীতিমালা অনুসরণের আহবান জানান। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্য মিঃ সাইকসও জেনারেল ইয়াহিয়ার আচরণে তুষ্ট হয়ে বলেই ফেললেন যে, গণতন্ত্রে উত্তরণের লক্ষ্যে ইয়াহিয়া প্রণীত বিরল দৃষ্টান্তের উপলব্ধি এবং অনুসরণ উভয়ই তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রহীন দেশগুলাের জন্যে অপরিহার্য। | ‘৬৯ সালের ২৮ নবেম্বর ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ এক নীতি নির্ধারণী ভাষণ দেন। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তৈরী এই ভাষণ ছিলাে মূলতঃ পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র করেই। প্রথমেই তিনি বললেন যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি আইনগত কাঠামাে বা’ লিগ্যাল ফ্রেইমওয়ার্ক অর্ডার (এল এফ ও) সৃষ্টির প্রয়ােজনীয়তা তিনি অনুভব করছেন। দ্বিতীয়তঃ সাংবিধানিক প্রশ্নে, বিশেষ করে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, সার্বজনীন ভােটাধিকার, জনগণের মৌলিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং সংবিধানের ইসলামী রূপ—এই সব প্রশ্নে তার মতে তিনি দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোনাে মতানৈক্য দেখতে পাননি। সুতরাং ভবিষ্যৎ সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে এ সব প্রশ্ন মীমাংসিত বলেই তিনি ধরে নিচ্ছেন।

তৃতীয়তঃ তিনি এক ইউনিট’ প্রথা বিলুপ্তির প্রয়ােজনীয়তার কথা বললেন। ফলে পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এবং বেলুচিস্তান স্বতন্ত্রভাবে প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃত হলাে। পরিশেষে ‘এক ইউনিট প্রথা বিলুপ্তির প্রেক্ষাপটে ইয়াহিয়া এক ব্যক্তি এক ভােট’-এর ভিত্তিতে দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ঘােষণা করলেন। | এই ভাষণের উপসংহারে তিনি সংবিধান তৈরীর বিষয়টি সুকৌশলে জাতীয় পরিষদের জন্যে রেখে দিলেন। অর্থাৎ পরিষদকে এই সমস্যার সমাধান এমনভাবে করতে হবে বা জাতীয় পরিষদ এমন এক সংবিধান প্রণয়ন করবে যা সকল প্রদেশের বৈধ চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে। অর্থাৎ সংবিধান আশানুরূপ না হলে জাতীয় পরিষদকে সেই অজুহাতে সহজেই বাতিল বলে গণ্য করা যাবে, এমন একটি নেতিবাচক অস্পষ্ট আভাস তিনি তার ভাষণে সুকৌশলে লুকিয়ে রাখলেন। এই ভাষণে ইয়াহিয়া খান ৭০ সালের পয়লা জানুয়ারী থেকে দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরুর অনুমতি দেন এবং অক্টোবরের ৫ তারিখ জাতীয় পরিষদ। নির্বাচনের দিন ঘােষণা করেন। | প্রকৃতপক্ষে ইয়াহিয়ার এই ভাষণ ছিলাে শর্তসাপেক্ষে সাধারণ নির্বাচনের অঙ্গীকার এবং একইভাবে শাসন ক্ষমতার হস্তান্তর। অন্তর্দষ্টি মেলে ধরলেই দেখা যেতাে যে এই ভাষণের নেপথ্যে নিহিত আছে আর এক ষড়যন্ত্রের উৎসারণ। ইয়াহিয়ার এই ভাষণ পশ্চিম পাকিস্তানে সমাদৃত হলেও পূর্ব পাকিস্তানে তা মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবের পক্ষে ইয়াহিয়ার ভাষণের মর্মার্থ অনুধাবনে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। তবে সংখ্যাসাম্যের বেড়াজাল থেকে মুক্তি লাভ ছিলাে বাঙালীদের জন্যে অপ্রত্যাশিত এক বিজয়। অন্ততঃ এই ক্ষেত্রে ইয়াহিয়া খান অজ্ঞাতসারে হলেও বাঙালীদের এই একটি মাত্র বিজয় মেনে নেন। | ইয়াহিয়ার ক্ষমতা দখলের পর ২৬ মার্চ প্রদত্ত তার ভাষণে চমক সৃষ্টি হয়েছিলাে, সন্দেহ। নেই। সামরিক জান্তার সদস্যরা চেয়েছিলােও তাই।

কারণ ছিলাে একটিই, জনগণকে তারা দেখাতে বা বােঝাতে চেয়েছিলাে যে আইউবের শাসন এবং তাদের শাসনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। কিন্তু সমস্যার মূল সম্ভাবনা দেখা দিলাে ‘এক ব্যক্তি এক ভােট’ প্রশ্নে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান সংখ্যাসাম্য নীতির প্রতি এই ঘােষণা ছিলাে আমূল পরিবর্তনের সামিল। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে এই ঘােষণার মধ্যে একটি ঝুঁকির প্রশ্ন থেকে গেলাে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে বাঙালীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের সম্ভাবনার মধ্যে। | পাকিস্তানের নীতিনির্ধারক মহল নির্বাচনে বাঙালীদের সম্ভাব্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের বিষয়টি সরাসরি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরশীল বলে ধরে নেয়। এর আগে ৬৮-৬৯ সালের সৃষ্ট আন্দোলন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছিলাে। আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ৬ দফা ইতিমধ্যেই বাঙালীদের জাতিগত দাবিতে পরিণত হয়েছে। ৬ দফার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ই হলাে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন। আর এই স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারটিই পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠীর অস্বস্তির মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাদের মতে স্বায়ত্তশাসনের অর্থই দাঁড়াবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দ্বিখণ্ডিতকরণ। কেননা, এর মধ্যে তারা পাকিস্তানের কেন্দ্রে একটি শিথিল ফেডারেশন এবং পূর্ব-পশ্চিম উভয় অংশে দু’টি আলাদা জাতিসত্তার বাস্তব আবির্ভাবের সম্ভাবনা দেখতে পায়। এ ছাড়াও পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারটি ছিলাে আরাে জটিল। রাষ্ট্রীয় চরিত্রের এই সম্ভাব্য পরিবর্তনকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের | প্রচলিত চরিত্রের সাথে মিলিয়ে নিতে পারলেন না। অর্থাৎ দীর্ঘদিনের চেষ্টা ও কূট-কৌশলের মারপ্যাচে পাকিস্তানে যে একটি একপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় চরিত্র তারা দাঁড় করিয়েছিলেন তার সাথে আওয়ামী লীগের ৬ দফার দুস্তর এবং আশংকাজনক একটি ব্যবধান আবিষ্কার করে তারা খুব শংকিত হয়ে উঠলেন অচিরেই। আসলে দেশের ব্যাপক জনগােষ্ঠীর আশা-আকাক্ষার বিষয়টি পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কর্ণধারদের কাছে কখনােই তেমন গুরুত্ব বহন করেনি। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের অনুশীলন বা গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ বিকাশের প্রশ্নটি তাদের কাছে বরাবরই একটি অশালীন ব্যাপার হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা ছিলাে পরিবর্তন বিরােধী। সে কারণে প্রচলিত রাষ্ট্রীয় দর্শন বা প্রচলিত রাষ্ট্রীয় ধ্যানধারণা, যা ছিলাে মূলতঃ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বহির্ভূত এবং হীনমন্যতা থেকে সৃষ্ট, সেখান থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি বাস্তবসম্মত পদ্ধতি গ্রহণে তাদের ছিলাে প্রচণ্ড অনীহা। নির্বাচন প্রশ্নে পিণ্ডির শাসকগােষ্ঠী আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য বিজয়ের ব্যাপারে কিছুটা হলেও নিশ্চিত ছিলাে। এর ফলাফল যা দাঁড়াবে তা হলাে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ কতৃক ৬ দফা ভিত্তিক একটি সংবিধান প্রণয়ন। আর সে কারণেই পাকিস্তানের সামরিক জান্তা নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেভাগে একটি আইনগত কাঠামাে আদেশ জারির প্রয়ােজনীয়তা অনুত্ব করে। তাদের ধারণা এই আইনগত কাঠামাে আদেশ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ প্রণীত ভবিষ্যৎ সংবিধানে পাকিস্তানের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা বিষয়টি নিশ্চিত করবে।

ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ৭০ সালের ৩১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া আইনগত কাঠামাে আদেশ জারি করলেন। এই আদেশের মধ্যেই নিহিত ছিলাে না অনুষ্ঠান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের শর্তসমূহ। জারিকৃত এই আইনগত কাঠামাে আদেশকে ! পাকিস্তানের বাঙালীরা এক ধরনের প্রতারণা বলেই ধরে নিলাে। ইয়াহিয়ার ‘৬৯ সালের মার্চের ভাষণ আর এই শ্রাদেশের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হলাে। আইনগত কাঠামাে আদেশের ২৫ এবং ২৭ অনুচ্ছেদ ছিলাে আদতেই দূরভিসন্ধিমূলক। শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সংবিধানে তার ঘােষিত ৬ দফার প্রয়ােগ থেকে নিবৃত্ত করাই ছিলাে মুখ্যতঃ এই আদেশ জারির উদ্দেশ্য। এতে বলা হলাে যে জাতীয় পরিষদ গৃহীত সংবিধান বিল প্রেসিডেন্টের অনুমােদনের জন্যে উপস্থাপন বাধ্যতামূলক। তবে সংবিধান বিলের অনুমােদন প্রেসিডেন্টের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। প্রেসিডেন্ট যদি কোনাে কারণে সংবিধান বিল অনুমােদন না করেন তবে জাতীয় পরিষদই বাতিল বলে গণ্য হবে। এখানেই শেষ নয়। আদেশে বলা হলাে শাসনতান্ত্রিক কোনাে বিষয়ে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। | শুধু তাই নয়, সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র এবং ইসলামী জীবনদর্শন ও ভাবধারার কথা বলা হলাে। এ ছাড়াও কেন্দ্র ও প্রদেশগুলাের মধ্যে ভারসাম্যের বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রাধান্য পেলাে এই আদেশে। আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্টের জারিকৃত ক্ষমতা সম্পর্কিত দুটি ধারার (২৫ ও ২৭ ধারা) সংশােধন দাবি করে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার বা আইনগত কাঠামাে আদেশ মেনে নিলেও অনিশ্চয়তা দেখা দিলাে পুরাে বিষয়টির প্রয়ােগের সম্ভাবনা নিয়ে। নির্বাচন তখনাে অনেক দূরের পথ। তাছাড়া নির্বাচনের অর্থই বিজয় নয়। নির্বাচনে জয়ী হলেও বিজয় আসে না। ‘৫৪ সালের নির্বাচনেও বাঙালীরা জয়ী হয়েছিলাে। সে বিজয়কে ধরে রাখা যায়নি। জয়ী হয়েও বাঙালীদের পরাজিত হতে হয়েছে। এবারের নির্বাচনের লক্ষ্যই হলাে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, আর সেই স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা নিহিত পূর্ব বাংলার স্বার্থসম্বলিত একটি সংবিধান প্রণয়নে মধ্যে। এই সংবিধানের প্রশাসনিক অনুমােদন আবার নির্ভরশীল পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের মর্জির ওপর। আর সেখানেই যতাে অনিশ্চয়তা, যতো সন্দেহ। পূর্ব বাংলার সচেতন জনগােষ্ঠীর বুঝতে বাকি রইলাে না যে ইয়াহিয়া খান মূলাে দেখিয়ে গাধা তাড়াচ্ছেন। সােনার হরিণ গণতন্ত্র প্রবর্তনে সামরিক জান্তার সদিচ্ছার প্রশ্নে এবার নিশ্চিতভাবেই সন্দেহ দেখা দিলাে। আইনগত কাঠামাে আদেশের এই ইঙ্গিত বাঙালীদের জন্যে ছিলাে হতাশাব্যঞ্জক। ‘৬৯’র ২৫ মার্চ থেকে যা কিছু বলা হলাে সহসাই যেনাে তার সবকিছু স্তমিত হতে লাগলাে ইয়াহিয়ার এই আইনগত কাঠামাে আদেশ ঘােষণার মধ্য দিয়ে। তবুও পূর্ব বাংলার জনগণ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে রইলাে সাধারণ নির্বাচনের দিনটির জন্যে।

 

সূত্র : যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা – মেজর নাসির উদ্দিন