You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৯শে এপ্রিল, মঙ্গলবার, ১৬ই বৈশাখ, ১৩৮১

বাংলাদেশ-বার্মা যুক্ত ইশতেহার

বাংলাদেশের অন্য আর একটি নিকটতম প্রতিবেশী দেশ বার্মা। বার্মার রাষ্ট্রপতি জেনারেল নে উইন গত ছাব্বিশ তারিখে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে। গতকাল তিনি ঢাকা ত্যাগ করেছেন। জেনারেল নে উইনের ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে বাংলাদেশ-বার্মা যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছে। এ যুক্ত ইশতেহারে বাংলাদেশ ও বার্মার পারস্পরিক সহযোগিতা, এ উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা কল্পে বাংলাদেশের গঠনমূলক ভূমিকা, ভারত মহাসাগরকে শান্তি এলাকা হিসাবে গন্য করা, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা, প্যালেস্টিনীদের মত্স অধিকার ও শুষ্ক এলাকা পুনসংস্কারের জন্য স্মারকদের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন, কাঁচামালের উপর জাতিসংঘের আগত সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকে সমর্থনে নিয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় নতুন কাঠামো সৃষ্টির প্রতি আশা প্রকাশ ইত্যাদি বিষয়ে বিশদভাবে আলোচনা করা হল। যুক্ত ইশতেহারে ৫টি দেশের মধ্যে সমঝোতা ও বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন মজবুত করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
বার্মার রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল নে উইন গত ছাব্বিশ তারিখে ঢাকায় পৌঁছানোর পর আমাদের রাষ্ট্রপতি জনাব মুহম্মদুল্লাহের সঙ্গে চল্লিশ মিনিট কাল স্থায়ী এক বৈঠকে মিলিত হন। ঐ দিন সন্ধ্যার সময় রাষ্ট্রপতি নে উইন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে পঞ্চাশ মিনিট এর মত সাক্ষাৎকারে মিলিত হন।
ছাব্বিশ তারিখ সন্ধ্যায় মহামান্য অতিথির সম্মানে রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদুল্লাহ এক ভোজ সভার আয়োজন করেন। তাতে তিনি জেনারেল নে উইন এর বর্তমান সফরকে অভিনন্দন জানিয়ে উল্লেখ করেন- “দু’দেশের মৈত্রী দিন দিন সুদৃঢ় হবে।” জনাব মুহাম্মদুল্লাহ আরো বলেন, “জেনারেল নে উইন কেবল রস্মঙ্গদের মহান জনগণের নেতাই নন, একজন মহান এশীয় রাজনৈতিক হিসেবে তিনি বিরাট শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি।” বার্মার রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল নে উইন সেদিনের সেই ভোজসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “সুযোগ্য ও নিবেদিতপ্রাণ এর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে তার বন্ধুত্বের নিবিড় আগ্রহ নিয়ে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।” তিনি আরো বলেছেন, বাংলাদেশ ও বার্মা এই দুটি নিকটতম প্রতিবেশী দেশের জনগন ভৌগলিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনে পরস্পর সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের অগ্রগতি ও নব্যতার সাফল্যই তার কাম্য।
জেনারেল নে উইন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে গত সাতাশ তারিখে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি ছিল এ আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। প্রায় দেড় ঘন্টা এ বৈঠক স্থায়ী হয়েছিল। মুখপাত্রীর এক সংবাদে বলা হয়েছে উভয় দেশের নেতার মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিতে ঐক্যমত সৃষ্টি হয়েছে এবং বাংলাদেশের অগ্রগতিতে বার্মা তাঁর সহযোগিতা আন্তরিকতার সঙ্গে সম্প্রসারিত করবে বলেও জানানো হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কতৃ’ক দের ভোজসভার উপর দেশের নেতাই ঘোষণা করেন- দু’দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার কথা ও উভয় দেশের উন্নতিতে সাহায্য ও সহযোগিতা সুস্থির করা। আগামী দিনে উপমহাদেশের সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে শান্তি প্রগতি আর পারস্পরিক সময়ে তারা আরও সুদৃঢ় সম্প্রসারিত ও সুদুরপ্রসারি হবে বলেও তাঁরা আশা প্রকাশ করেছেন। গতকাল রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল নে উইন বাংলাদেশ সফর শেষ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় ও মি.নে উইন পুনরায় আশা প্রকাশ করে গেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর দেশের সম্পর্কোহরনের ব্যপারে। আমরাও বার্মার নেতার এই গুরুত্বপূর্ণ সফরের সানন্দে সাফল্য কামনা করছি। উভয় দেশের মধ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাক এটাই আমাদের কাম্য। সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া তথা এশিয়ার জনগনের প্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য প্রত্যেকটি এশীয় দেশের মধ্যে সম্পর্কোহরণ করা আজ অপরিহার্য বলে আমরা মনে করি।

কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এর ঋণ

কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবার তার ঋণ শোধের তাগাদায় উঠে পড়ে লেগেছেন। পাকিস্তানি আমলে যে কৃষকরা কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন কৃষি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এখন অনেকটা চক্র বৃদ্ধি হারে সেই টাকা আদায়ে তত্পর হয়েছেন। দৈনিক ‘বাংলার বানী’ পত্রিকার মারফত জানা যাচ্ছে কোন কোন ক্ষেত্রে টাকা আদায় না হওয়াতে ঋণ গ্রহণকারীর বন্ধকী জমি, অস্থাবর সম্পত্তি ইত্যাদি ক্রোকের নির্দেশে বডিওয়ারেন্ট ও ইস্যু করা হচ্ছে।
১৯৭১ এর শেষের দিকে দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে গত মার্চ মাস এই সোয়া দুই বছর কাল পর্যন্ত কৃষি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঐ ঋণের টাকা আদায়ের ব্যাপারে ঋণগ্রহনকারীদের কোনো নোটিশ দেননি বলে খবরে প্রকাশ। এমনকি কোনো প্রকার তাগাদাও দেননি। অথচ এপ্রিল মাসের শুরু থেকেই প্রায় আচমকা তারা ঋণ শোধের ব্যাপারে এ ধরনের কড়াকড়ি ব্যবস্থা গ্রহন করতে শুরু করেছেন।
আমরা জানি পাকিস্তানি আমলে ১৯৬০ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক দেশের প্রায় সব মফস্বল শহরেই সম্প্রসারিত হয়। সাড়ে চার হাজার টাকা হার সুদে কৃষকরা ঐ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারতেন। জমি বন্ধক দিয়ে নির্ধারিত সুদে কৃষকরা ঋণ গ্রহন করতেন। কিন্তু ১৯৬০ সালের পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ এগারো বছরের মধ্যে যারা কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে শতকরা ৮০ জনের পক্ষে সুদসহ ঋণের দায় পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। জনৈক কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা সূত্রে এই খবর জানা যায়। অতএব সমগ্র ঋণ পরিশোধের উপায় হিসাবেই তারা নাকি এহেন কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছেন।
এ কথা অবশ্য স্বীকার্য যে, ঋণ গ্রহণ ও ঋণ দানের পারস্পরিক সমতা রক্ষার আবশ্যিক শর্ত হলো সময় মত চুক্তি অনুযায়ী ঋণ পরিশোধ করা। বস্ততপক্ষে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার স্থিতাবস্থাও এর অন্যতম সহায়ক শর্ত বলে বিবেচ্য। সে ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭১ সাল এর একেবারে শেষ ভাগ পর্যন্ত দেশে অসহযোগ আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলে কৃষক সমাজের পক্ষে আত্মনিয়োগ করা সম্ভব হয়নি। তার সঙ্গে রয়েছে প্রতি বছরের বন্যা, খরা, অজন্মা ইত্যাদির ক্রুর ছোবল।
অন্যদিকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ১৯৭১- এর শেষ থেকে আজ অবধি সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক অস্থিতাবস্থা এখন চুড়ান্ত পর্যায়ে অবস্থান করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্যব্যাদিসহ সকল প্রকার দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবন প্রায় বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নাগরিক জীবনে যারা বাস করছেন, তারা রেশনিং সহ অন্যান্য অনেক সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। যেমন যে চালের সরকারি ক্রয়মূল্য হলো একশ টাকার উপরে, সেই চাল রেশনে কিনতে হয় ৪০ টাকা মণ দরে। সম্প্রতি সরকারের ভরতুকি যাচ্ছে প্রায় ৭০ টাকা। গ্রামাঞ্চলে কৃষক সরকারের এই ভরতুকি থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। বাজার দরেই তাদের চাল কিনে খেতে হয় ফলে সরকারী ভরতুকির সুফল ও প্রধানতম শহরাঞ্চলের অধিবাসীরাই ভোগ করতে পারেন। এতে তাদের যথেষ্ট ব্যয় সাশ্রয় হয়। গ্রামাঞ্চলের কৃষক শ্রেণী এ সকল সুযোগের কল্পনাই করতে পারেন না। ফলে নিত্যনিয়ত দ্রব্যমূল্য ড্রাগনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে তাদের লিপ্ত থাকতে হয়। সীমিত আয়ের লোকেদের তবু একটি নির্দিষ্ট আয় থাকে। যে করে হোক সেই আয়ের ছকে তার ব্যয়ের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজাতে হয়। কিন্তু কৃষক কূলের তেমন কোনো নির্দিষ্ট আয় নেই। তদুপরি দেশের অনুন্নত চাষাবাদ ব্যবস্থার সৌজন্যে মূলতঃ প্রকৃতির দয়ার উপরেই তাদের নির্ভর থাকতে হয়। ফলে খরা, অজন্মা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্লাবন ইত্যাদিতে বাংলাদেশের সমগ্র কৃষক কূলকে নিদারুণ অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনানিপাত করতে হয়। সেক্ষেত্রে তারা কোনো আয়-ব্যয়ের ছকে তাদের জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রিত করার কথা ভাবতে পারে না।
বলতে গেলে কৃষকদের জন্য পাটই হলো একমাত্র অর্থকরী ফসল। এই পাট বেচা টাকা দিয়েই তারা বছরের বাড়তি কেনা-কাটা, ঋণ শোধ ইত্যাদি কাজ করে থাকে। সেই পাটের ন্যায্য দাম থেকেও তারা বঞ্চিত । চালের মূল্য যেখানে ১২০/১২৫ টাকা, পাটের মণ সেখানে ৬০ টাকা। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত এই দামও যথার্থ নয় বলে তারা অভিযোগ করেন। কারণ এক মন চাউলের চেয়ে এক মন পাটের উত্পাদন ব্যয়, সময় ও শ্রম অধিক প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে অনুরূপ মূল্যে তারা পাট উত্পাদনের ব্যয়ভার কুলোতেই পারে না। তদুপরি গ্রাম ফড়িয়া, অসৎ ব্যবসায়ী ইত্যাদির চক্রান্তে সরকার নির্ধারিত ঐ নূন্যতম মূল্য ও পাট চাষীদের হাতে গিয়ে পৌঁছায় না। এমনি ধরনের নানা অসুবিধা, অনিশ্চয়তা, অসহায়তা দেশীয় অর্থনীতির অস্থিতাবস্থা ও মুদ্রাস্ফীতির কুটিল চক্রে পড়ে গ্রামাঞ্চলের কৃষক কূল এখন প্রায় সম্পূর্ন দিশেহারা। শুধুমাত্র খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার প্রশ্নেই আজ তাদের জীবনের অস্তিত্বটুকু যেন টিকে আছে।
এই অবস্থার প্রেক্ষিতে ঋণ শোধ করার জন্য বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক কর্তৃক এই জোর তাগাদায় তাদের অস্তিত্ব বিলোপের সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে বলে আমাদের শঙ্কা জাগছে। পূর্বেও বলেছি, এখনও বলছি, ঋণ অবশ্যই শোধনীয় । কিন্তু পূর্বাপর পরিস্থিতি বিবাচনা করে এই ঋণ শোধের ব্যাপারে কিছু একটা সহনীয় নীতি এখন প্রয়োগ করা হোক এটাই আমাদের প্রধান বক্তব্য। যেন তাঁরাও একেবারে অচলাবস্থায় না পড়েন এবং কৃষি ব্যাংকের ঋণ গুলোও ধীরে ধীরে শোধ হতে পারে এবং পাকিস্তানি আমলে দেওয়া কৃষি ঋণের চক্রবৃদ্ধি সুদের হার মওকুফ করে দীর্ঘমেয়াদী ও সহজ কিস্তিতে এই ঋণের হার পরিশোধের জন্য কৃষক কূলকে সুযোগ দেওয়া হয়। আমরা জানি একটা কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কৃষি মেরুদণ্ড ই হল এই কৃষক সমাজ। এদেরকে ঋণ দেওয়ার উদ্দেশ্যও তাদের সাহায্য করা। অতএব এখন চিন্তা করে একটা পথ বের করতে হবে-কি করে সুষ্ঠুভাবে ঋণও আদায় করা যায় এবং যার ফলে কৃষক সমাজও বাঁচার আশা থেকে বঞ্চিত হবেন না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!