You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.01.19 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ | দেশের প্রথম চক্ষু ব্যাংক | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৯শে সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার, ২রা আশ্বিন, ১৩৮১

জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করেছে। গতকাল মধ্যরাতে এ সংবাদ পাওয়া গেছে। জাতিসংঘের উনত্রিশ তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশন নিউ ইয়র্কে শুরু হলে প্রথমেই তিনটি দেশের সদস্য পদ দেয়া হয়। এই তিনটি দেশ হল গ্রেনাডা, গিনি-বিসাউ ও বাংলাদেশ। জাতিসংঘের একশত ছত্রিশ তম সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেছেন। স্বাধীনতা লাভের প্রায় চৌত্রিশ মাস পরে আমরা এই জাতিসংঘের সদস্য হতে পেরেছি। নিঃসন্দেহে গোটা জাতির জন্য এটা অত্যন্ত আনন্দের খবর। আজ আমাদের দেশ একটি পরিপূর্ণ রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হবে। এ পর্যন্ত আমরা শতাধিক দেশের স্বীকৃতি পেয়েছি, জাতিসংঘের অধিকাংশ এবং বিশ্বের অন্যান্য কয়েকটি সংস্থার সদস্য হয়েছি। পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সদস্যপদ লাভ করা সত্ত্বেও এতদিন আমরা জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। ১৯৭২ সালের ৮ই আগস্ট যখন প্রথম বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ চেয়ে আবেদন জানায় তখন নিরাপত্তা পরিষদের অন্যতম সদস্য চীন সে আবেদনের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করে। ফলে সদস্যপদ লাভের বিষয়টি পিছিয়ে যায়।
এরপর একুশ মাস পরে গত জুনে পুনরায় বাংলাদেশ জাতিসংঘের কাছে আবেদনপত্র পেশ করে। ইতিমধ্যে উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। সর্বোপরি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করেছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতির পট ভূমিতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘের কাছে সদস্য হবার আবেদন জানালে গত দশই জুন নিরাপত্তা পরিষদের সম্মতিক্রমে বাংলাদেশের আবেদনপত্র গ্রহণ করে সাধারণ পরিষদে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করে। চলতি সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সেই আবেদনপত্র গ্রহণ করে পরিষদের সদস্য দেশ সমূহ আমাদের কৃতজ্ঞভাজন হয়েছেন। বস্তুত জাতিসংঘ আমাদের দেশের সদস্য হবার এ ঘটনা জাতীয় জীবনে একটি গভীর তাৎপর্য বহন করবে। ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য গোটা জাতির জীবনে সেদিন একটি বিশেষ স্মৃতি বহন করে এনেছিলো তেমনি তাৎপর্য বয়ে নিয়ে এসেছে জাতিসংঘে আমাদের অন্তর্ভুক্তির এ সংবাদ। উপমহাদেশীয় তথা এশীয় রাজনীতিতেও এ ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ।
একথা অনস্বীকার্য যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বাধীনতার পর পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশে ফিরে এসে সরকারের দায়িত্বভার তুলে নিয়েছিলেন তখন পৃথিবীর বহু দেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিভিন্ন আশঙ্কা কেটে গিয়েছিল। যার দরুন বিশ্বের বহু দেশ যেমন ঘোষণা করেছিল আন্তরিক স্বীকৃতি, তেমনি এগিয়ে এসেছিল তারা বাস্তব সাহায্য ও সহানুভূতি নিয়ে। জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ মূলত বঙ্গবন্ধুর অতুলনীয় আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রজ্ঞারই ফল। দেশের বিভিন্ন সংকটে জনগণ ইতোপূর্বে যেসকল সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল এটাও তাদের তেমনি একটি বিজয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এদেশের মানুষ তাদের আন্তর্জাতিক বন্ধু এবং শত্রু চিহ্নিত করেছিল স্বাধীনতা অর্জনের পর জোটনিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতির অনুসারী বাংলাদেশ বিশ্বের সকল দেশের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা কামনা করে বিশ্বসভায় তার সদস্যপদ লাভের জন্য কাজ করে গেছে। এমনকি যে সকল দেশ একদিন আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল তাদেরকেও আমরা বাস্তবতা অনুধাবন করার জন্য বার বার আহ্বান জানিয়ে এসেছি। পাকিস্তান দেরিতে হলেও বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিয়েছে, উপমহাদেশের শান্তি, নিরাপত্তা ও প্রগতি কামনা করেছে। আমরা আজও আশাবাদী গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের জনগণ বাংলাদেশের অভ্যুত্থান ও তার বাস্তবতা মেনে নিয়ে উপমহাদেশের শান্তি ও প্রগতির সংগ্রামে সহযাত্রী হবেন। সরকারের নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার বাংলাদেশে বিদ্যমান শক্তির মাঝে দাঁড়িয়ে ও শক্তির সাজুজ্য ঘটাতে সক্ষম হয়েছে জাতিসংঘের তার সদস্যপদ লাভের প্রশ্নে। তাছাড়া সাম্রাজ্যবাদী দেশ, জোট নিরপেক্ষ দেশ সমূহ আজ আমাদেরকে যে পরম বন্ধু হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে তাও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তাঁর বিশেষ প্রগতিশীল ভূমিকা গ্রহণের জন্যই।
স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে সকল সুফল আমরা অর্জন করেছিলাম এবং স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা যে সকল সুফল লাভ করেছি এবং আরো লাভ করতে পারতাম তা আজ নানা প্রতিকূল কারণ এর দরুন বিনষ্ট হতে বসেছে। স্বাধীনতার সুফল জাতীয় নির্মাণ কার্যে নিয়োগ করার চাইতে একশ্রেণীর তোষামোদি চরিত্রের মানুষ তাকে সার্থোদ্ধারের কাজে ব্যয় করেছে। বঙ্গবন্ধুর আশেপাশের গুটিকতক সুযোগ সন্ধানীদের ঘৃণ্য লিপ্সার কাছে আজ আমাদের সেই সকল সাফল্য ব্যর্থতার গ্লানি তে রুপান্তরিত হতে বসেছে। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও প্রজ্ঞার দ্বারা আমরা জাতীয় জীবনের জন্য যা অর্জন করতে পারতাম তার গুটিকতক দুর্নীতিবাজ উচ্চভিলাষী অযোগ্য নেতৃত্ব তারা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। এমনিভাবে গোটা প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক পরিস্থিতি আজ একটা বন্ধ্যাত্ব অবস্থার মধ্যে এসে পড়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে যে সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশের উপর দিয়ে বয়ে গেছে তার মোকাবেলা করতে গিয়ে আমরা সততা-নিষ্ঠা উদাহরণ স্থাপন করতে পারিনি। বর্তমান বিশ্বের একটি স্বাধীন দেশের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যতগুলো আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে থাকে যাত্রী জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের পর আমাদের তা পূর্ণ হয়েছে। একে সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে বিশ্বসভায় মর্যাদাশীল করে গড়ে তোলার দায়িত্ব সরকারের। আমরা আশা করব কর্তৃপক্ষ কিছু মানুষের দুর্নীতি এবং দুর্নীতির আশ্রয় দান কারীদের স্বার্থোদ্ধারের পাঁয়তারর কাছে আমাদের গর্বের অতীত ও বর্তমান সাফল্যকে বিসর্জন দেবেন না।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ ভুক্তির প্রশ্ন বিশ্বের যে সকল দেশ আমাদের সাহায্য-সমর্থন ও সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন আমরা দেশের জনগনের পক্ষ থেকে আজ তাদেরকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সকল সমাজতান্ত্রিক দেশ, জোট নিরপেক্ষ দেশ সমূহ বিশ্বের গণতান্ত্রিক মানুষ উপমহাদেশের সহযাত্রী বন্ধু দেশ এবং পাকিস্তানের প্রগতিশীল জনগণকেও আজ আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি। বিশ্বশান্তি উপমহাদেশ তথা এশিয়ার শান্তি ও প্রগতির সংগ্রামে আজ আমরা পুনরায় একাত্মতা ঘোষণা করছি।

দেশের প্রথম চক্ষু ব্যাংক

একদিন সব আলো নিভে যাবে। ফুরাবে সংসারের লেনদেন হিসেব-নিকেশ। কিন্তু বেঁচে থেকে যারা আলো থেকে বঞ্চিত থাকেন সেই হতভাগা দৃষ্টিহীনদের জীবনের বিড়ম্বনা অসহ্য। সেই বিড়ম্বনা নিয়ে এদেশে বেঁচে আছেন প্রায় দশ লক্ষ নর-নারী। এ তথ্য প্রকাশ করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ চক্ষু বিভাগের অধ্যাপক ডঃ এম এ জলিল। বিশেষজ্ঞদের অভিমত পুষ্টিহীনতা ও প্রয়োজনীয় ভিটামিন এর অভাবে উন্নয়নশীল এবং অন্যান্য দেশ গুলির জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ দৃষ্টিহীনতা এবং দৃষ্টিশক্তির অস্বচ্ছতায় ভোগেন। আমাদের দেশে এর রোগের যে ব্যাপক প্রসার বলাবাহুল্য তা পুষ্টিহীনতা এবং ভিটামিনের অভাব এর ফলে ঘটে থাকে। যে দেশের অনাহার প্রাত্যহিক ঘটনা যা কিছু পাওয়া যায় তাই গলধকরণ করে কোনরকমে জীবন ধারণ করাই যে দেশে সমস্যা, সে দেশে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ অথবা ভিটামিন সেবনের আবশ্যকতা নিয়ে আলোচনা করা অর্থহীন। তবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন এমন সব ব্যক্তির দৃষ্টি ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও দেশি-বিদেশি চিকিৎসকরা মাঝেমধ্যে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
এই প্রচেষ্টার অন্যতম মূল সমস্যা ছিল চোখের অভাব। মৃত ব্যক্তির চোখ দৃষ্টিহীনদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে পাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ প্রয়োজনীয়। অথচ আমাদের দেশে সামাজিক বাধা-নিষেধ ও কুসংস্কার এর ব্যাপারে বিশেষ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। এতকিছুর পরও কোন সহৃদয় ব্যক্তি চক্ষুদানের রাজি থাকলে সে সমস্যাটি প্রকট হয়ে উঠত তা ছিল চক্ষুর সংরক্ষণ সমস্যা। দেশে কোন চক্ষু ব্যাংক ছিল না। গত মঙ্গলবার জাতীয় জীবনের সেই অভাবটাই পূরণ করার লক্ষ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন লায়ন্স ক্লাব উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। মূলতঃ তাদেরই প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের প্রথম চক্ষু ব্যাংক।
মেট্রোপলিটন লায়ন্স ক্লাবের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। জাতীয় জীবনের এমন একটা অভাব মোচনে তারা যে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তা জাতির কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। চক্ষু ব্যাংক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়ে কথা উল্লেখ করেছেন। বেসরকারিভাবে এ ধরনের মহৎ উদ্যোগে তাঁর সরকারের সাহায্য এবং সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। এটা দৃষ্টিহীন লক্ষ লক্ষ মানুষের মনের নতুন জীবনের স্পন্দন সৃষ্টি করবে।
চক্ষু ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা এবং অন্যান্য সমাজ কল্যাণ সংস্থা গুলোর ওপর বাড়তি দায়িত্ব এনে দিয়েছে। চক্ষুদানে সমাজ জীবনের বাধা নিষেধ এবং কুসংস্কার দূরীকরণে তাদের উদ্যোগী হতে হবে। মন্ত্রী মহোদয় নিজেও স্বেচ্ছায় চক্ষু দানের ব্যাপারে জনগণকে ‘মোটিভেটেড’ করে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা এবং মানব কল্যাণ মূলক প্রতিষ্ঠান সমূহ এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
আমাদের দেশে নানাবিধ সামাজিক সমস্যা সমাধানে সামাজিক সংস্থা গুলোর যে পরিমাণ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা উচিত তার নিতান্তই অভাব রয়েছে। সেবামূলক কাজে বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণের নানা দৃষ্টান্ত রয়েছে বিদেশে। বিশেষ করে বিত্তবানেরা এসব ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন। বাংলাদেশের সম্প্রদায় লায়ন্স ক্লাবের উদ্যোগে উদ্বুদ্ধ হবেন। সমাজে পতিত এবং বঞ্চিত শ্রেণীর কল্যাণে তারা এগিয়ে আসবেন-এটা সবাই আশা করেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন