বাংলার বাণী
ঢাকা: ২১শে সেপ্টেম্বর, শনিবার, ৪ঠা আশ্বিন, ১৩৮১
কৃষকদের সঙ্গে কি মর্মান্তিক তামাশা!
রবিশস্যের মৌসুম বয়ে যাচ্ছে অথচ বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে নাকি প্রয়োজন মাফিক বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে না। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অভিযোগে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, বগুড়া, ও রাজশাহী এই পাঁচটি জেলায় রবি শস্য বীজে দারুণ অভাব দেখা দিয়েছে। ফলে এসব জেলার শতকরা ৫০ ভাগ আবাদি জমিই বেকার পড়ে থাকবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রতিবেদন তথ্যে আরও বলা হয়েছে উত্তরাঞ্চলের ওই পাঁচটি জেলায় প্রায় ৫ লক্ষ ১১ হাজার একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের ১১ লক্ষ ১৫ হাজার ৫৯ মণ রবিশস্যের বীজ প্রয়োজন। এর মধ্যে ১ লক্ষ ৩৮ হাজার ৮২০ একর জমির জন্য ১ লক্ষ ৪ হাজার ১১২ মণ গমের বীজ, ২ লক্ষ ১৫ হাজার ৭৩৫ একর জমিতে সরিষা উৎপাদনের জন্য ২৫৭৩ মণ বীজ, ৭৫ হাজার ৮২০ একর জমিতে আলু চাষের জন্য ৯০ হাজার মণ আলু বীজ, ৬২ হাজার ১১০ একর জমির জন্য ৩৯ হাজার ১০৫ মণ মসুর কালাই এর বীজ, ৪৪ হাজার ৭৬০ একর জমির জন্য ২২ হাজার ৩৮০ মণ ছোলার ডালের বীজ, ৫ হাজার একর জমির জন্য মুগ কালাই এর বীজ আড়াই হাজার মণ, ৪৬ হাজার ৩৯৫ একর জমির জন্য মাস কালাইয়ের বীজ ২৩ হাজার ১৯৭ মণ, ২২ হাজার একর জমির জন্য ৪৫০ মণ টমেটো বীজের প্রয়োজন।
সাধারণত আমাদের দেশের কৃষকরা নিজের চেষ্টায় স্ব স্ব জমিতে ব্যবহারের জন্য অধিকাংশ পরিমাণ বীজ সংরক্ষণ করে থাকে। এবারও এসব বীজের শতকরা ৯৫ ভাগ তাদের গোলায় ছিল যার সবটুকুই ধুয়ে মুছে নিয়ে গেছে রাক্ষসী বন্যা। ফলে রবি শস্য চাষের প্রাথমিক পর্যায়েই কৃষকরা কৃষি বিভাগের কাছে বীজ সরবরাহের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে বসে আছে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দপ্তর যে পরিমাণ বীজ সরবরাহ করেছে তাতে কৃষকদের চাহিদার অর্ধেকও পূরণ হচ্ছে না।
এছাড়াও প্রতিবেদন সূত্রের অভিযোগে আরও বলা হয়েছে যে, ওই সরবরাহকৃত বীজের অনেকাংশ নাকি পুরাতন বীজ। যা নরম মাটির পেলব স্পর্শে কোনোদিনই উপ্ত হবে কিনা সন্দেহ। স্থানীয় বাজারেও পাওয়া যায় না এবং সরকারি পর্যায়ে এখনো সকল স্থানে সরবরাহ শুরু হয়নি। কি মর্মান্তিক তামাশা! একথা অনস্বীকার্য যে বন্যার করাল ছোবলে এবারের কৃষি অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়েছে। মাঠের পাকা ফসল সব বিনষ্ট হয়েছে। আবাদযোগ্য জমি প্লাবিত হওয়ার পর এখনো তা অনেক স্থানে পানির নিচেই রয়েছে। অতএব অপেক্ষাকৃত উঁচু অঞ্চল যেখানে প্রথমে পানি সরে যাবার কথা সেসব অঞ্চলে সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টা নিয়োগ করে শস্য উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া আজ শুধু আবশ্যিক নয় জীবন মরণের প্রশ্ন। আমরা জানি উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় প্রচুর রবি শস্য উৎপাদিত হয়। ধান-চালের ক্ষতি পূরণ না হলেও ওই সব অঞ্চলে প্রচুর আলু, ডাল, গম ইত্যাদি উৎপাদন করে ভাত ও রুটির বিকল্প খাদ্য আমরা তৈরি করতে পারি। আলু ভাতের অভাব কিছুটা পূরণ করতে পারে আর মাসকালাইয়ের রুটিও আমাদের অপরিচিত খাদ্য নয়। একথা সত্য যে সমুদ্রে ভাসমান থেকেও মানুষ আশাদীপের মোহ ছাড়তে পারে না। তাই বন্যা ক্লিষ্ট সর্বহারা কৃষকরা কৃষি কাজের প্রতি আগের মতোই আগ্রহী রয়েছে এবং ভবিষ্যৎ ফসলের সম্ভাবনাময় স্বপ্নও দেখে। এরই প্রেক্ষিতে ঐ সকল অসহায় কৃষককুলকে সংশ্লিষ্ট দপ্তর হতাশ করেছে। সময়মতো সরবরাহের জরুরী কাজ তারা ফালতুক্রিয়া মনে করেছে। সংশ্লিষ্ট মহলের কর্মচারীরা হয়তো ফসলের মৌসুম চলে যাবার পর তাদের অক্ষমতার একটা ফিরিস্তিও দিতে পারেন যার কোন মূল্য জনসাধারণের কাছে নেই।
গত কয়েক বছর থেকেই দেখা যাচ্ছে নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি সঙ্গে তাল রেখে চাল, ডাল, আটা, গম, সবজি ইত্যাদি সব জিনিসের দাম শুধু হু হু করে বাড়ছে আর বাড়ছে। এসময় দেশের উৎপাদন বৃদ্ধির সর্বাত্মক সক্রিয় পরিকল্পনা প্রণয়ন আবশ্যক। সেজন্য প্রায় প্রতিটি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আয়তনও বেড়েছে। নামের বাহারে প্রতিটি জব্বের শাখা-প্রশাখা হয়েছে কুসুমিত। কিন্তু তাতে গন্ধ নেই, দুর্গন্ধ।
তর্কাতীতভাবে একথা আজ প্রতিষ্ঠিত যে, দেশের অর্থনৈতিক, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি নির্ভর করছে কৃষি সাফল্য ও শস্য উৎপাদন প্রাচুর্যের ওপর। এই সার সত্য কথাকে আমল দেবার কোন প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের যেন নেই। শুধু কি এই? কীটনাশক ওষুধ গাফিলতি, সার ও কৃষি ঋণ সরবরাহে দুর্নীতি এসব তাদের আচরণে ভূষণ। সামগ্রিকভাবে কৃষি কাজের অন্তরায় সৃষ্টি করাই তবে এই দপ্তরের কাজ? এ প্রশ্ন জনসাধারণের, এ প্রশ্ন বুভুক্ষ অথচ কৃষি কাজে আগ্রহী কৃষকদেরও।
সরকারের প্রতিটি ভাঁড়ারই যদি এমন ফুটো হয়ে যায়!
দেশের কৃষি ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন গঠন করা হয়েছে। বহুদিন ধরে এই সংস্থাটি কাজ করে আসছে। কিন্তু সংস্থাটির কাজকর্ম সম্পর্কে নানা প্রকার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এর অধিকাংশই দুর্নীতি সম্পর্কিত। যেহেতু দেশের মূল আর্থিক কাঠামো কৃষির উপর নির্ভরশীল সেহেতু কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন এর দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক। কতৃপক্ষ যদি যথার্থ আন্তরিকতা এবং যথাযথ প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনকে স্বাধীনতার পর পুনর্গঠিত করতে করতেন তাহলে দেশের কৃষি উন্নয়নের ব্যাপারে কর্পোরেশন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারতো। কিন্তু সে দায়িত্ব কর্তৃপক্ষ সঠিক ভাবে পালন করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। সরকারের অন্যান্য প্রশাসনিক অব্যবস্থার মতই কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনও আজ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। গতকাল আমাদের পত্রিকায় কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন এর অভ্যন্তরে বিপুল পরিমাণ দ্রব্য সামগ্রী ও বিভিন্ন প্রকার স্বজনপ্রীতি চাঞ্চল্যকর ঘটনা সম্পর্কিত একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কর্পোরেশনের বেশ কিছুসংখ্যক পদস্থ ব্যক্তি এ সকল দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বলে সরকার কর্তৃক নিযুক্ত এক ব্যক্তির তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে জানা গেছে। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী যে তথ্য পাওয়া গেছে তা হলো বারো হাজার ব্যাগ টিএসপি সার এবং সাত লাখ টাকা মূল্যের সার আত্মসাৎ, দুই লাখ টাকার বেশি মূল্যের একাত্তরটি পাম্প ও ইঞ্জিন চুরি, বিক্রয় বিধির বরখেলাফ, অফিস কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কাজের জন্য সিমেন্ট ব্যবহার এবং ঠিকাদার কর্তৃক দুই হাজার একশত পঞ্চাশ ব্যাগ সিমেন্ট সরানোর প্রত্যক্ষ অভিযোগ। এ ধরনের দুর্নীতি চোখে পড়া সত্ত্বেও কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের প্রশাসন কর্তৃপক্ষ কোনো শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহন করেননি। তদন্ত রিপোর্ট রাজধানীর কেন্দ্রীয় স্টোর ও চট্টগ্রামের বালুরঘাট স্টোর থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার মালামাল উধাও হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশাসন কর্তৃপক্ষ পুলিশের কাছে একটি এফ আই আর করা ছাড়া কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করেননি। তবে কোন কোন বিষয়ে কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ দুর্নীতি দমন বিভাগে মামলা দায়ের করলেও সে সকল মামলার প্রতিক্রিয়া আজ পর্যন্ত জানা যায় নি। সংবাদে একথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিভাগীয়ভাবে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে পুলিশ কিংবা দুর্নীতি বিভাগের নিকট মামলা দায়ের করা কর্পোরেশনের আইন বিরোধী। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের অভ্যন্তরে বিরাজিত অসংখ্য দুর্নীতির মধ্যে এটা একটি প্রকাশিত নজির। হয়তো এমন আরও অনেক বড় বড় দুর্নীতি কর্মকর্তাদের কারসাজির দরুন চাপা পড়ে আছে। বস্তুত দেশের শুধু কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন অভ্যন্তরেই এ ধরনের দুর্নীতি চলছে না, প্রশাসন ব্যবস্থার সর্বত্রই দুর্নীতি আজ একটি আইনসঙ্গত বিষয়ে পরিণত হতে চলেছে। আমরা ইতিপূর্বে বারবার দেশের বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামো ও চরিত্র সম্পর্কে আমাদের মতামত ব্যক্ত করেছি। ব্রিটিশ ও পরবর্তীকালে পাকিস্তানি উপনিবেশের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে প্রশাসন ব্যবস্থা একদিন একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে উঠেছিল আমরা স্বাধীনতার পরও সেই প্রশাসনের জন্য এবং চরিত্রহীন কাঠামোকে জিইয়ে রেখেছি। কোন সিস্টেম বা নিয়মের প্রবর্তন আমরা করতে পারিনি। ফলে অতীতের প্রশাসনের কাছ থেকে পুরানো ক্রিয়াকলাপ ছাড়া নতুন কিছু আশা করা বৃথা। তার উপর প্রশাসনের এমনই দুর্নীতি ও দুরবস্থার সঙ্গে যখন সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দুর্নীতি এসে সংযুক্ত হয় তখন সে প্রশাসনিক কাঠামোর আর কোন চরিত্রে অবশিষ্ট থাকে না। কর্তৃপক্ষের আজ অবধি হয়তো এ ব্যাপারে কোনো শুভবুদ্ধির উপায় ঘটেনি। যদিও তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে রতবদলের পথ অনুসরণ করেছেন, কিন্তু আমরা মনে করি এ ধরনের পরিবর্তন শুধু চোর তাড়িয়ে ডাকাত আনার পথই সুগম করবে। উল্লেখিত সংবাদে সে চাঞ্চল্যকর চুরি ও স্বজনপ্রীতির নমুনা পাওয়া গেছে তাতে করে জনগণের নিঃসন্দেহে মনে হবে এটা উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নিতান্তই নিজস্ব ব্যাপার, আর এর কোন বিচারও হবে না এটাই বর্তমান প্রশাসনের নিয়ম। তবু আমরা বলব জাতির ভবিষ্যৎ চিন্তা করে, প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রশাসনের বিষয়টিও কর্তৃপক্ষ পুর্নবিবেচনা করে দেখবেন। কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন এর অভ্যন্তরে যা ঘটছে এবং প্রতিনিয়ত যা ঘটে থাকে তা বন্ধ করার নিশ্চয়তা বিধান করে দেশের কৃষকদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অশুভ চক্রান্ত কর্তৃপক্ষ রোধ করবেন, এ ধরনের বিশ্বাস আজও আমাদের রয়েছে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক