বাংলার বাণী
ঢাকা: ২২শে সেপ্টেম্বর, রোববার, ৫ই আশ্বিন, ১৩৮১
তরল সোনা আমাদের মান বাড়াবেই
তরল সোনায় এবার বাংলাদেশ ভাসবে। এ যে কত বড় সমৃদ্ধি ও সম্ভাবনার কথা তা বলাই বাহুল্য। গত পরশু শুক্রবার উপকুলে তেল অনুসন্ধানের জন্য বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদ ও বিজ্ঞান গবেষণা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দুটি বিদেশী কোম্পানীর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর ফলে এতকাল যা ছিল শুধু আশা এবং প্রত্যাশার ব্যাপার তা নিশ্চিত সমৃদ্ধি ও সম্পদের আশ্বাস দিয়েছে। আমরা আমাদের তেল সম্পদের জন্য গর্বিত ও আনন্দিত হয়ে এখন একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারি আর কি । এর বেশি কিছু আর এখন বলা ঠিক নয়।
যে দুটি কোম্পানীর সঙ্গে বাংলাদেশ তেল অনুসন্ধানের ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে সেগুলো হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক রিচফিল্ড অয়েল কোম্পানী ও কানাডার সুপিরিয়র অয়েল কোম্পানী। এই দুটো কোম্পানী বাংলাদেশের সর্বমোট সাড়ে দশ হাজার বর্গমাইল এলাকা ও সমুদ্রের ২ শত মিটার গভীরে তেল অনুসন্ধান কাজ চালাবে। চুক্তিতে এদের অনুসন্ধান চালানোর মেয়াদ ২১ বছর পর্যন্ত ধার্য করা হয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদী এই চুক্তির স্বাক্ষর বোনাস হিসেবে মোট ১ কোটি ৫ লাখ মার্কিন ডলার বাংলাদেশ পেয়েছে। এর মধ্যে ৭৪ লাখ ২০ হাজার ডলার চুক্তির সাথে সাথেই নগদে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রামানে যার মূল্য ৫ কোটি ৯৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বিদেশী তেল কোম্পানী দুটি আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই তাদের অনুসন্ধান কাজ শুরু করবে বলে জানা গেছে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কোম্পানী দুটি তাদের নিয়োগকৃত পূঁজি প্রত্যাহার করতে পারবেন। চুক্তিতে বর্ণিত এলাকা থেকে আহরিত পরিশোধিত তেলের শতকরা ৩০ ভাগ থেকে ২৫ ভাগের মাধ্যমে এই পুঁজি প্রত্যাহার করা যাবে। বাকী তেল ৭৬ : ২৪ আনুপাতিক হার থেকে ১০ : ১০ হারে সরকার ও কোম্পানীর মধ্যে বণ্টন করা হবে। এই চুক্তির কয়েকটি লাভজনক দিকও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তা হলো (ক) প্রত্যেক কোম্পানীকে তেল অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কাজে প্রতি বছর একটা নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে। এবং এই অর্থের অব্যবহৃত অংশ দিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে । (খ) তেল অনুসন্ধানের কাজে যত কর্মচারী ও শ্রমিক লাগবে সেগুলো বাইরে থেকে আনা হবে না-বাঙালী নাগরিকদেরই নিয়োগ করা হবে। এবং চুক্তিতে আধুনিক তেল শিল্প বাঙ্গালী নাগরিকদের প্রশিক্ষণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে । (গ) প্রত্যেক কোম্পানীই প্রতি বছর বাঙ্গালী নাগরিকদের প্রশিক্ষণের জন্য ১ লাখ মার্কিন ডলার শর্তহীনভাবে ব্যয় করবেন। এবং তেল উৎপাদনের ভিত্তিতে কোম্পানীসমূহ গবেষণা ও কল্যাণ কাজে একটি নির্ধারিত অর্থ ব্যয় করবেন। (ঘ) উৎপাদন শুরু হলে কোম্পানীগুলো তাদের প্রাপ্য অংশের শতকরা ১৫ ভাগ অশোধিত তেল বাংলাদেশের প্রয়োজন মেটাতে সরবরাহ করবেন। এই তেলের প্রতি ব্যারেলের দাম হবে ২০ সেন্ট।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, তেল অনুসন্ধানের ব্যাপারে আরও ৫টি বিদেশী কোম্পানীর সাথে বাংলাদেশ অতিসত্বর অনুরূপ চুক্তিতে আবদ্ধ হবে। কোম্পানীগুলো হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ার ইউনিয়ন অয়েল কোম্পানী, জাপানীজ পেট্রোলিয়াম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন, যুগোশ্লাভ অয়েল কোম্পানী, আমেরিকার এ্যাশল্যাও অয়েল কোম্পানী এবং রুবিনা অয়েল কোম্পানী। সর্বমোট ৭টি কোম্পানী বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে প্রায় ৩০ হাজার বর্গমাইল এলাকায় তেল অনুসন্ধান চালাবে। বস্তুতঃপক্ষে প্রায় একশতাব্দীকাল ধরেই বিভিন্ন দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের ভূগর্ভে প্রচুর খনিজ সম্পদ রয়েছে বলে অনুমান করেছেন ও মত প্রকাশ করেছেন। ১৯৪২ সালে তদানীন্তন বৃটিশ সরকার বার্মা শেল কোম্পানীর সহায়তায় চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে তা অনুসন্ধানের সামান্য চেষ্টা চালায়। সত্যি কথা বলতে কি বাংলাদেশের ভূমি সম্পদ শোষণ করেই তারা ছিল তৃপ্ত। খনিজ সম্পদ উত্তোলনের কোন তৎপরতা তারা ইচ্ছে করেই চালায়নি। এবং ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের পেষণে ক্লিষ্ট এ জাতি তখন নিজস্ব সম্পদ ব্যবহারের স্বপ্ন দেখতেও সাহস করতো না। সে সামর্থ বা প্রকৌশলী বিদ্যাও তখন বাঙালীর ছিল না। এরপর এলো পাকিস্তানের যুগ। ১৯৫২ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারও চট্টগ্রামের পাহাড়ী এলাকায় ও কক্সবাজারে তেল অনুসন্ধানের প্রকল্প নেয়। কিন্তু ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির নিরীখে তাও চাপা পড়ে যায়। অতঃপর ১৯৬৭ সালে একটি সোভিয়েট তেল অনুসন্ধানী দল আবার কক্সবাজারের উখিয়া অঞ্চলে তেল অনুসন্ধানের কাজ চালাতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। বলা বাহুল্য, বাঙালী জাতির জীবনে তরল সোনার সম্ভাবনা সত্যিই দেখা দিক তা উপনিবেশবাদী তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কিছুতেই চান নি। অতএব সে আবেদনও অচিরে বাতিল হয়ে যায়।
এখন আমরা স্বাধীন। নিজেদের সম্পদকে সর্বোচ্চহারে কাজে লাগানোর পূর্ণ অধিকার এখন আমাদেরই। আমরা জানি আধুনিক সভ্যতার মাপকাঠিতে তেল, লোহা ও বিদ্যুতের মাথাপিছু গড় উৎপাদনের প্রাচুর্যই একটি দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদাকে চিহ্নিত করে। একটি দেশকে আভিজাত্য ও মাতব্বরীর শক্তি জুগিয়ে দেয়। সে দিক থেকে বিচার করলে বলা যায় বাংলাদেশের সঞ্চিত প্রায় অফুরন্ত তেল ভাণ্ডার যার নিশ্চিত আশ্বাস আজ বিদেশী তেল কোম্পানীগুলোকে উপকূল অঞ্চলে তেল অনুসন্ধান কার্যে আকৃষ্ট করেছে-তার জন্য আমরা উৎফুল্ল হতে পারি বই কি। বিশ্বব্যাপী জ্বালানী সংকটের দিনে বাংলাদেশ অচিরেই একটি তেল সমৃদ্ধ দেশ বলে চিহ্নিত হবে বলে আমরা বিশ্বাস রাখি। বিদেশী কোম্পানী গুলোর তেল অনুসন্ধানে ঐকান্তিক আগ্রহই তার প্রমাণ। তাই কামনা করছি-সেই সুদিন আসুক। তরল সোনা আমাদের অভিজাত্য দিক । সব অভাব মোচন করুক।
প্রবাসীদের উপার্জিত মুদ্রায় আমদানী বাণিজ্য
সরকার প্রবাসী বাঙ্গালীদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানী বাণিজ্যের একটি বিশেষ স্কীম সম্প্রতি চালু করেছেন। ইতিমধ্যে উক্ত স্কীমের অধীনে বেশ কিছু দ্রব্য সামগ্রী বিদেশ থেকে আসা শুরু হয়েছে। বিদেশে অবস্থানরত বাঙ্গালীরাও এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য উৎসাহ দেখিয়েছেন। সরকার আশা করেছিলেন এ স্কীমে প্রয়োজনীয় শিল্প উপকরণ আমদানী সম্ভব হবে, কিন্তু সরকারের আশা আজ পর্যন্ত পূরণ হয়নি। খুচরা যন্ত্রাংশ, বা অন্যান্য শিল্প উপকরণ আমদানীর চাইতে বিদেশে অবস্থানরত বাঙ্গলীর প্রসাধন দ্রব্য, কাপড়, ব্লেড ইত্যাদি বেশী পরিমাণে আমদানী করছেন। আমাদের পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদে জানা গেছে, ১৯৭৩ সালের নভেম্বর মাস থেকে চলতি বছরের আগষ্ট মাস পর্যন্ত মোট সাড়ে তিন কোটি টাকা মূল্যের বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য প্রবাসী বাঙ্গালীরা দেশে পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে গত জুলাই-আগষ্ট মাসেই দুই কোটি টাকার দ্রব্যসামগ্রী আমদানী হয়েছে। গত জুলাই-আগষ্ট শিপিং মৌসুমে প্রবাসী বাঙ্গালীদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানী বাণিজ্যের স্কীমের বিধিনিষেধ আরো শিথিল করা হয়েছে। আমদানী পণ্যের সংখ্যা পুনরায় বাড়িয়ে চল্লিশ করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষীয় সূত্রে জানা গেছে, যে সকল দ্রব্যসামগ্রী প্রবাসী বাঙ্গালীরা আমদানী করছেন। তার অধিকাংশই হংকং, জাপান, সিঙ্গাপুর ও লণ্ডন থেকে। দেশের বর্তমান প্রয়োজন ও চাহিদার জন্য শিল্পের উপকরণ সি, আই সীট প্রভৃতি জিনিস বেশী পরিমাণে আমদানী করা হোক এটাই কর্তৃপক্ষ আশা করছেন।
প্রবাসী বাঙ্গালীদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানী বাণিজ্য সম্পসারণের যে পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করেছেন তাতে করে সুফল পাওয়া গেছে নিঃসন্দেহে। তবে যে সকল দ্রব্য আমদানী তুলনামূলকভাবে বেশী হচ্ছে তার চাইতে অন্যান্য কয়েকটি বিষয় আমদানী করা অত্যন্ত প্রয়োজন। দেশের বিপর্যস্ত মিল কারখানাকে পূনর্জীবিত করার জন্যে মিল-কারখানার উপকরণ আমদানী করা দরকার। এ ব্যাপারে প্রবাসী বাঙ্গালীরা উদ্যোগী হবেন—এটাই কর্তৃপক্ষের আশা। কিন্তু তারা তুলনামূলকভাবে কয়েকটি প্রসাধনী দ্রব্য ও কাপড় চোপড় বেশী আমদানী করছেন। দেশের কোন জিনিসটির অভাব বর্তমানে সবচেয়ে বেশী এবং মূল্য অস্বাভাবিক সেদিকে দৃষ্টি রেখে অল্প মূলধনে অধিক মুনাফা অর্জনের পথ সবাই বেছে নিয়েছেন। ফলে কোন সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দিকে দৃষ্টি রেখে কেউ আমদানী করতে এগিয়ে আসছেন না। এদিকে যে সমস্ত দ্রব্যসামগ্রী আমদানী করা হচ্ছে তার মূল্য নির্ধারণ বা মূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোন পূর্ব সিদ্ধান্ত নেই। প্রবাসীরা যে সকল জিনিস আমদানী করছেন তা লাভজনক দামে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চড়াদামে সে সকল দ্রব্য বিক্রির চেষ্টা করছেন। অবশ্য কিছু কিছু জিনিসের দাম কমেছে তবে তা জিনিসের প্রতুলতার জন্যেই। এছাড়া আমদানীকৃত জিনিসের বিক্রির ব্যাপারে সরকারী কোন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই বলে অধিকাংশ দ্রব্যসামগ্রী স্থানীয় ব্যবসায়ীরা মজুত করার চেষ্টা করছেন। তাদের ধারণা কিছুদিন পরেই দাম বাড়বে। অথবা বিদেশে পাচার করার সুযোগও কিছুদিন পরেই হবে। যে পরিমাণে ব্লেড, দুধ, কাপড়-চোপড় ও প্রসাধনী দ্রব্য আমদানী হয়েছে তাতে করে মূল্য অনেক হ্রাস পাবার কথা। কিন্তু সে তুলনায় মোটেই কমেনি। আর এর কারণ হলো মজুত করার প্রবণতা বৃদ্ধি। কর্তৃপক্ষ প্রবাসী বাঙ্গালীদের মাধ্যমে যে আমদানী বাণিজ্য চালু করেছেন তার সুফল জনগণ যাতে পায় তার জন্য আমদানীকৃত দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও পরীক্ষা করে দেখবেন বলে আমরা মনে করি। আমদানীকৃত জিনিস মজুত না হয়ে বাজারে এসে যাতে পৌঁছায় তার জন্যও ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন-নইলে জিনিসের মূল্য জনগণের ক্রয় ক্ষমতার সীমানায় এসে পৌঁছুবে না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক