You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.03.26 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | চতুর্থ স্বাধীনতা দিবস | চোরকে চিহ্নিত করাই বাঞ্ছনীয় | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৬শে মার্চ, মঙ্গলবার, ১৯৭৪, ১২ই চৈত্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

চতুর্থ স্বাধীনতা দিবস

দারিদ্র, বিক্ষোভ, লক্ষ্যহীন কর্মকান্ড আর আলাদীনের প্রদীপ বিতরণের মধ্য দিয়ে তিন তিনটি বছর চলে গেলো। সমস্যা-সংকটগুলো পাশ কাটিয়ে দুনিয়ার যতো সব ভালো ভালো কথা, আদর্শ আর বক্তব্যের মালা গেঁথে গেঁথেই জাতির সব দিশারী কর্তাব্যক্তিরা, মাস বছর গুণলেন। আর সহজ সাধারণ মানুষ নেতা কর্তাদের কর্মযজ্ঞের তুগলকী যন্ত্রে পিষ্ট হয়ে কাটালেন প্রায় হাজারটি রাত।
আজ সেই তিন বছর আগে ঘোষণা করা স্বাধীনতা দিবস। ঐক্যবদ্ধ এবং সিদ্ধান্তে অটল একটি জাতির পরম আকাঙ্ক্ষিত দিন। অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর সকাতর ধ্বনি আর সর্বাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের তান্ডব শব্দের মধ্যে একটি সিদ্ধান্তের ঘোষণা, একটি লক্ষ্য পথের সুস্পষ্ট এবং স্বার্থহীন নির্দেশ। সাড়ে সাত কোটি মানুষ নেতার কন্ঠে ঘোষণা করলো স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু।
সেই শুরু। মধ্যযুগীয় বর্বরতা আর প্রত্যয়দীপ্ত প্রতিরোধ। একদিকে পাশবিকতা, মৃত্যু আর বিভীষিকা অপরদিকে জীবন। দুইয়ের লড়াইয়ে পশু শক্তি পরাজিত। মুক্তি পাগল জনতার বিজয়ে উচ্চকিত বাংলা। নতুন যাত্রাপথের শুরু ১৬ই ডিসেম্বর।
ধ্বংস, যুদ্ধ আর রক্তের স্বাক্ষর নিয়ে কালের ইতিহাস খোদিত ন’টি মাস। এরপর নবনির্মাণের আয়োজন। সাড়ে সাত কোটি মানুষ যে নেতার কন্ঠে ঘোষণা করেছিল স্বাধীনতা সেই নেতাই দিক নির্দেশ করলেন নতুন যাত্রাপথের। এক এক করে গড়িয়ে গেলো ছাব্বিশটি মাস। স্বাধীনতা পূর্বকালীন স্বপ্ন আর কল্পনায় আঁকা বছর।
সংসারে স্বপ্ন আর কল্পনা যেমন ঠাঁই করে নিতে পারে না তেমনি পারেনি ঔপনিবেশিক শাসন পিষ্ট জাতির আকাঙ্ক্ষা স্বাধীনতাত্তোরকালীন বাস্তবতায় জায়গা করে নিতে। বর্তমানের লক্ষ্যহীন কর্মকান্ড ভবিষ্যত প্রত্যাশাকেও নিমজ্জিত করেছে নিকষ কালো অন্ধকারে। মানুষ তাই আজ দিশেহারা। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই যে শুরু একশ্রেণীর লোকের নির্লজ্জ ভোগলিপ্সা তা আজ বলগাহীন হয়ে উঠেছে নেতা কর্তাদের সস্নেহ আশ্রয়ে। দিন দিন বাড়ছে লোভাতুর পশুর সংখ্যা আর ক্রমান্বয়ে নৈরাজ্য আর হতাশা আচ্ছন্ন করছে মানুষের মন। প্রশ্ন এখনই উঠেছে এই স্বাধীনতা কি আমরা চেয়েছিলাম?
নবনির্মাণের যাত্রাপথে যে প্রতিশ্রুতি, অঙ্গীকার এমনকি পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা হয়েছিল আজ মাত্র ছাব্বিশ মাসে তা প্রায় ব্যর্থতা আর বিপর্যয়মুখী। বলা হয়েছিল উৎপাদন যন্ত্রে শ্রমজীবী মানুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কথা। হয়নি। বিগত ছাব্বিশ মাসে ‘এক্সপেরিমেন্টাল বেসিসে’ যে একটা শ্রমনীতি ঘোষিত হয়েছিল তা বাতিল হয়ে যাবার পর আজ পর্যন্ত কোনো সুষ্ঠু শ্রমনীতি ঘোষণা করা হয়নি। শ্রমমন্ত্রী পিঠ চাপড়িয়ে শুধু বলছেন হবে হবে সব হবে।
কল কারখানা জাতীয়করণ করার পর বলা হয়েছিল এটা সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পদক্ষেপ। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রবিরোধী লোকের হাতে সে সব পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে মাত্র ছাব্বিশ মাসেই তা লাটে উত্তরণের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। ব্যবস্থাপক কর্তাদের দুর্নীতি, চুরি, কাঁচামাল আমদানীতে গড়িমসি আর শ্রমজীবী মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে সুষ্ঠু সাংগঠনিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে প্রকারান্তরে সমাজতন্ত্রের ভাবমূর্তি বিনষ্টের কাজেই জাতীয়করণকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সরকারী নিয়ন্ত্রণে দ্রব্য আমদানী এবং ন্যায্যমূল্যে বিতরণের মধুর বুলি আওড়িয়ে এবং তা বাস্তবায়নে এতোটুকু আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ না করে ক্রেতা সাধারণের বের হওয়া জিভটা টেনে একেবারে সর্বশেষ প্রান্তে নিয়ে আসা হয়েছে। এর সঙ্গে মিলেছে রাতারাতি ধনী হতে আগ্রহী একশ্রেণীর সামাজিক কীট। জাতীয় নেতৃবৃন্দের স্নেহাশ্রয়ে লালিত এই নর কীটগুলো মওজুতদারী, কালোবাজারীর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে।
এসব স্বাধীনতাত্তোর ছাব্বিশ মাসের বাস্তব চিত্র। আরো ছবি রয়েছে। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার সুযোগে গ্রামবাংলায় দুর্বৃত্ত-দৃষ্কৃতিকারীদের সশস্ত্র আক্রমণ মানুষের জীবনের সাধারণ নিরাপত্তাটুকু কেড়ে নিয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের আশ্রয়ে সংঘবদ্ধ হচ্ছে সামাজিক দুশমন আর দেশী বিদেশী চক্রান্তকারীরা। সার্বিকভাবে তারা আক্রমণ পরিচালনা করছে এমনকি আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধেও।
বর্তমানের এই চিত্র এড়িয়ে যে মানুষ ভবিষ্যতের ‍দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আশ্বস্ত হবে এমনটিও যেন হবার নয়। জাতীয় নেতারা আগামী দিনের কোনো সুস্পষ্ট ছবি তুলে ধরতেও পারছেন না। বক্তৃতা বিবৃতিতে যতটুকু আঁচ করা যায় তাতে মনে হয় তারা নিজেরাই বিভ্রান্ত। একে অন্যের সঙ্গে ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে পারছেন না। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের একটা নীল নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদদের। পাঁচ বৎসরে দেশ কিভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রসর হবে তারই একটা পরিকল্পনা করতে গিয়ে ঢাউস একটা বই ছাপিয়েছেন তারা। অথচ এই ক’দিন আগে সেই বিজ্ঞ রচয়িতাদেরই একজন বলেছেন এই পরিকল্পনা প্রণয়নে তাদের সামনে কোনো স্থির এবং সুস্পষ্ট লক্ষ্য ছিলনা। একটা মাঝামাঝি পথ বেছে নিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারাবদ্ধ একটি দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তারা প্রণয়ন করেছেন।
মোটামুটি সর্বক্ষেত্রেই গত ছাব্বিশ মাসের ‘অগ্রগতির’ ছবি এক রকমের। শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হবে বলা হয়নি, শিল্প সম্বন্ধে একটা দ্বিধান্বিত পদক্ষেপ, কৃষিক্ষেত্রে সব বৈপ্লবিক পরিবর্তনের গালভরা বুলির আড়ালে প্রায় ‘যথা পূর্বং তথা পরং অবস্থা’।
এসব কর্মকান্ডের মধ্য দিয়েই আমরা স্বাগত জানাচ্ছি আমাদের চতুর্থ স্বাধীনতা দিবসকে। আসলে স্বাধীনতা পূর্বকালীন লক্ষ্য সম্বন্ধে যে সুস্পষ্ট ধারণা আমাদের ছিল স্বাধীনতা পরবর্তীকালীন নয়া সমাজ গঠনের রূপরেখা সম্বন্ধে শিক্ষার অভাবই আমাদের দিনের পর দিন নৈরাজ্যের পথে নিয়ে চলেছে। একটা জাতির পক্ষে এর চাইতে মারাত্মক ক্ষতিকর অবস্থা আর কিছু হতে পারে বলে আমরা মনে করিনা। লক্ষ্যহীনতা যে সর্বনাশা ব্যাধির জন্ম দিয়ে চলেছে তা থেকে মুক্তির পথ অতি শীঘ্রই বের করতে হবে। আমরা মনে করি নয়া সমাজ গঠনের যে নীতি রেখা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছেন তা থেকে জাতীয় নেতৃবৃন্দের একাংশ এবং প্রশাসনিক কর্তাদের বিচ্যুতিই দেশের বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী। আজকের এই স্বাধীনতা দিবসে তাই বিগত ছাব্বিশ মাসের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার আলোকে বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের সুস্পষ্ট নির্দেশকে মনে প্রাণে গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে সঠিক এবং বৈজ্ঞানিক কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে বিপ্লব কারো পথ চেয়ে বসে থাকেনা। যে বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে আমরা মাঝপথে আটকিয়ে রেখেছি তাকে সম্পূর্ণ করতে আজকের নেতৃবৃন্দ যদি ব্যর্থ হন তবে ইতিহাস তার নিজের পথ বেছে নেবে। স্বাধীনতা দিবসে অতীতের সব গ্লানি, ভ্রান্তি আর মোহগ্রস্ততা কাটিয়ে উঠে জাতীয় নেতৃবৃন্দ নতুন পথের সন্ধান দেবেন, ঐক্যবদ্ধ জনতার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বৈপ্লবিক প্রক্রিয়া অনুশীলনের পথ প্রশস্ত করবেন—গোটা জাতির সঙ্গে আমরা সেই কামনাই করি।

চোরকে চিহ্নিত করাই বাঞ্ছনীয়

শেষে বন্ধ বস্তার ভেতরের মাল চুরি! সম্প্রতি সিমেন্টের বস্তার ওজনের ক্ষেত্রে ব্যাপক চুরি ধরা পড়েছে। চুরির পরিমাণটা হলো বস্তা প্রতি ৬ পাউন্ড। থাকা উচিত ১১২ পাউন্ড, থাকছে ১০৬ পাউন্ড। তবে কে বা কারা প্রকৃতপক্ষে এই চুরির সঙ্গে জড়িত সে ব্যাপার এখনো অজ্ঞাত।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, সিমেন্টের বস্তার ওজন হ্রাস সম্পর্কে সংবাদপত্রে একাধিকবার খবর প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও এ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আরও উল্লেখযোগ্য এই যে, এ ব্যাপারে জনগণ ছাড়া ডিলারদের পক্ষ থেকে হ্রাসকৃত সিমেন্টের বস্তা সম্বন্ধে কোনো অভিযোগ পূর্বে পাওয়া যায়নি।
অতঃপর ক্রেতা সাধারণের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সিমেন্ট মেপে নেয়ার জন্যে এক সরকারী আবেদন প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা জেলা সিমেন্ট ব্যবসায়ী সমিতি সোচ্চার হয়েছেন। তারা জানাচ্ছেন যে, ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরী থেকেই ১০৬ পাউন্ডের বস্তা আসছে। অতএব ১১২ পাউন্ড সিমেন্ট প্রতি বস্তায় সরবরাহ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়।
অপরপক্ষে টিসিবি বেতার মারফত ক্রেতা সাধারণের প্রতি এক আহ্বানে বলেন যে, ডিলারদের কাছ থেকে তাঁরা যেন প্রতি বস্তা সিমেন্টের ওজন ১১২ পাউন্ড বুঝে নেন।
আমাদের প্রশ্ন হলো, একদিকে সিমেন্ট ব্যবসায়ীদের পরিষ্কার কথা প্রতি বস্তায় ১০৬ পাউন্ডের বেশী সিমেন্ট দেওয়া সম্ভব নয়, অন্যদিকে টিসিবি’র আহ্বান ১১২ পাউন্ড ওজনের বস্তা মেপে নিতে হবে এবং নিরপেক্ষ আবেদনে সরকারের সিমেন্ট মেপে নেবার নির্দেশ—এই তিনের কোন্ দিকে যাবে ক্রেতাসাধারণ?
এরই প্রেক্ষিতে আমাদের অভিমত হ’লো, সিমেন্টের ওজন হ্রাসের কোনো বাস্তব সমাধানই ঐ ত্রিমুখী আবেদন নিবেদনে বা ঘোষণায় নেই। ক্রেতাসাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে—এই হ’লো মূল কথা। এবং এই চুরির পেছনে যে কোনো কুচক্র আছে সে কথাও স্বচ্ছ। অতঃপর হেঁয়ালি ছেড়ে মূল কারণ অনুসন্ধানের দিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নজর দিলে আমরা আশান্বিত হবো। কারণ অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, এই সিমেন্ট চুরি দেশের অন্যান্য দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এতে দেশে সিমেন্টের অভাবের সুযোগ নিয়ে একদিকে অস্বাভাবিক দাম এবং অন্যদিকে ওজনে কম দিয়ে এতদিন অবাধে জনগণকে প্রতারিত করা হয়েছে। তাই এতবড় সুপরিকল্পিত চক্রান্তকে উপেক্ষা করা যায় না কিছুতেই।
পরিশেষে আমাদের ঐকান্তিক আবেদন, সিমেন্ট সংক্রান্ত চুরির প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের যেন ‍খুঁজে বের করা হয়। কারণ চোরকে চিহ্নিত করাই বাঞ্ছনীয় এবং এদেশের জনগণ হতাশার গহ্বরে ক্রমশঃ আর নিমজ্জিত হতে চায়না—তারা যে কোনো একটা সূত্রকে অবলম্বন করে আশার আলো দেখতে চায়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন