মুক্তি ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
অক্টোবর ১৯৭৩ থেকে শুরু হলাে বন্দিদের প্রত্যাবর্তন। আন্তর্জাতিক অরেডক্রসের ব্যবস্থাপনায় উড়ােজাহাজে করে দেশে ফেরা। ফেরত পার্টির তালিকা করতে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। সে তালিকা অনুযায়ী বন্দিরা প্রস্তুত হতাে দেশে ফেরার জন্য। আমাদের মন্ডি বাহাউদ্দিন বন্দিশিবির থেকে বন্দিদের যেতে হতাে রেলপথে লাহাের। সেখানে ট্রানজিট ক্যাম্পে অবস্থান এবং তারপর প্লেনে ঢাকা।
মুক্তি বিলম্বিত আমাদের তিন
পরিবার অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত বেশির ভাগ বন্দি বাংলাদেশে চলে গেলেন। আমাদের শিবির প্রায় খালি হয়ে এলাে। একে একে সিনিয়র অফিসার ও তাদের পরিবারবর্গও চলে গেলেন। অধীর আগ্রহে আমার পরিবারের সবাই দিন গুণছিল; কিন্তু না, আমার নামটি আর আসে না। আমি বললাম, শেষ তালিকায় তাে থাকবেই নাম—এতাে চিন্তা কিসের? কিন্তু একটা অজানা অনিশ্চয়তা মনকে অভিভূত করতে লাগলাে। শেষ পর্যন্তও আমার নাম এলাে না। আমাদের ‘বি’ বিভাগে একমাত্র আমার পরিবার। ভয় পেয়ে গেলাম। মুখ শুকিয়ে গেল তবে বিকেলে আরও দুটি পরিবারকে অন্য বিভাগ থেকে এনে আমার পাশে ব্রগেডিয়ার মজিদুল হক কর্তৃক ছেড়ে যাওয়া বাসা ও তার পরের বাসাটিতে রাখা হলাে। তারা ক্যাপ্টেন (ডাক্তার) আবু বকর সিদ্দিক এবং ক্যাপ্টেন হারেস। কিছুই বুঝতে পারলাম না। ছেলেমেয়েদেরও কাদাদ অবস্থা। বড়দের মুখ কালাে; কিন্তু হারেস ও আবু বকরের পরিবারের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলাম ভয়ে, দুশ্চিন্তায় ওরা উদ্ৰান্ত সন্ধ্যা হয়ে এলাে চারদিক নিস্তব্ধ একটু দূরে রাস্তায় একটি টিমটিমে বাতি। চারদিক অন্ধকার। স্বল্প আলােকে দেখা যায় ওখানকার সান্ত্ৰী পােস্ট। যতাে রাত বাড়ে ভয়ও ততাে বাড়ে। ক্যাপ্টেনদ্বয়ের। দুটি করে ছােট বাচ্চা আর ঘরে তরুণী স্ত্রী । আমরা তিন পরিবার ছাড়া এখানে কেবল ওই সান্ত্রীরা আশপাশে আর কোনাে বসতিও নেই, লােকজনও নেই। এখানে আমাদেরকে মেরে-কেটে ফেললেও কেউ দেখার নেই। শত চিকার। করলেও কেউ শােনার নেই। ভয়ে রাতে কেউ ঘুমােতে পারলাে না। পুরুষরা বাইরে পায়চারি করে বেশির ভাগ রাত কাটিয়ে দিলাম। মনে মনে একমাত্র সান্ত্বনা এসে উকি দেয়-হয়তাে কাল সকালে আমাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আদেশটি আসতে পারে। কিন্তু না, পরদিনও কোনাে খবর নেই। ক্যাপ্টেনরা সান্ত্রীদের কাছে গেল খবর নিতে। না, ওরাও জানে না। তবে এখন পাহারা আরও কড়া। আমাদের ওপর হুকুম বাড়ির আঙিনা ছেড়ে এক পাও বাইরে না যাওয়া। বােঝা গেল আপাতত আমাদের মুক্তির কোনাে আশা নেই। কেন, কিছুই বুঝতে পারলাম না। ক্যাপ্টেন দুজন কথায় কথায় ওদের মনের সন্দেহ প্রকাশ করলেন। ওদের মনে হয় আমাকে বিচার ও শাস্তির জন্য রাখা হয়েছে ওদের জিগ্যেস করলাম।
যে, ওঁরা এমন কিছু কি করেছেন যার জন্য বিশেষ করে তাদের দু’জনকে আমার সাথে আটকে রেখেছে। তারা পরিষ্কার করেই বললেন, ক্যাম্পে আসার আগে এবং ক্যাম্পে আসার পরে এমন কিছু ঘটে নি যার জন্য তাদের দু’জনকে বেছে বেছে আটকে রাখতে পারে। তবে তাদের মনে হয় যে আমাকে অর্থাৎ একলা একটি পরিবারকে আটকে রাখলে কেমন খারাপ দেখায় বিধায় বাইরে একটি স্বাভাবিকতার প্রলেপ লাগানাের জন্য তাদের দু’জনকে রাখা। কথাটা খুব অযৌক্তিক মনে হলাে না। বিচার ও শাস্তি দেয়ার জন্য আমাকে আটকে রাখার ব্যাপারটা পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে যৌক্তিক হতেও পারে। একাত্তর সালে বেশ কয়েকজন বাঙালি অফিসার পলায়ন করেছিলেন, যারা পলায়নের আগে আমার বাসায় এসেছেন। কর্তৃপক্ষ সেটা জানতাে। এছাড়া আমার পলায়নের প্রচেষ্টা বিশেষ করে, মেজর জিয়াউদ্দিন ও তাহেরের পলায়নের সমস্ত ব্যাপারটা ওরা তদন্ত করেছে। মেজর মনজুরের পলায়নের পর শিয়ালকোট থেকে সামরিক কর্তৃপক্ষ আমাকে টেলিফোনও করেছিল যে, এ সম্বন্ধে আমি কিছু জানি কিনা। আমি উত্তরে বলেছিলাম, কোথায় শিয়ালকোট আর কোথায় পিণ্ডি।
আমি কি করে জানবাে? তখন উত্তর অপর প্রান্ত থেকে কিছুটা কঠিন গলায় বলা হয়েছিল, হ্যা, তবে অনেক বাঙালি অফিসারই আপনার সঙ্গে যােগাযােগ রাখে। তাই কর্তৃপক্ষ বললেন, আপনার তাে জানার কথা। ওরা যে আমার ওপর চোখ রাখছে। একথাটা বলাই উদ্দেশ্য ছিল সেদিন। বুঝেছিলাম ভালাে করেই। এসব ঘটনার চাইতেও বড় একটা কারণ ছিল আমাকে বিচার করার। কর্নেল তাহের যিনি আমার বাসা হয়ে পালিয়ে এসেছিলেন, তিনি নাকি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে নাকি সবিস্তারে ও অত্যন্ত সহৃদয়তার সাথে আমাদের পালানাের ষড়যন্ত্রটির উল্লেখ করেছিলেন। পরে দেশে ফেরার পর তাহের আমার হাত ধরে মাফ চেয়ে বলেন, ‘স্যার, আবেগের বশবর্তী হয়ে লিখেছিলাম। পরে বুঝলাম আপনার ক্ষতি করেছি।’ আগেই বলেছি, বেছে বেছে আমাদের কিছু অফিসারের প্রহসনের বিচার করা হতে পারে। কিন্তু এদিকে যাদের বিচার করার কথা ছিল যেমন জেনারেল ওয়াসিউদ্দিন এবং অন্যান্য সিনিয়র অফিসার, সকলকে মুক্তি দেয়া হয়েছে, সকলে এখন বাংলাদেশে। সিমলা চুক্তি ততােদিনে হয়ে গেছে। বন্দি বিনিময়ের চুক্তিও হয়ে গেছে। আমাকে একা বিচার করার তাে কোনাে যৌক্তিকতা বােধগম্য হয় না। মনে মনে এসব ভাবছি আর আমার সামনে তখন বসা দুই অফিসার ও তাদের পরিবারবর্গ এবং আমার পরিবারের লােকেরা। ওদের দিকে তাকানাে যায় না। ভবিষ্যতে কি বিচার-আচার হবে, কি শাস্তি হবে সে দুশ্চিন্তা তাদের তেমন বেশি ঘায়েল করতে পারে নি। ঘায়েল করেছে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দৈহিক নিরাপত্তা, বিশেষ করে মহিলাদের নিরাপত্তা। এ ভয়টি যে কেমন তা ভুক্তভােগী ছাড়া কারাে সম্যক হৃদয়ঙ্গম করা হয়তাে সম্ভব নয়। এইভাবেই কাটল আরেকটি দিন। আরেকটি রাত্রি, আরও একটি দিন-রাত্রি।
সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা