সাধারণ বেসামরিক পাঞ্জাবিদের মনােভাব :
শেষের দিকে যখন বন্দিদের মুক্তি দেয়া শুরু হয়ে গেছে, তখন আমাদের অনুমতি দেয়া হতাে ২/৪ জন করে বাজারে যেতে অর্থাৎ মন্ডি বাহাউদ্দিন বাজারে গিয়ে প্রয়ােজনীয় সামগ্রী কিনে আনতে। ক্যানটিনে ছিল যেমনি গলাকাটা দাম, তেমনি ছিল বহু জিনিসের অপ্রাপ্যতা। বাজারটি ছিল মাইলখানেক দূরে। বাজারে সাধারণ লােকজনের সাথে কথা হতাে। ওরা প্রায়শই বলতাে, ‘যা যা হয়েছে ভেতরের ব্যাপার, আমরা কিছুই জানতাম না। এতােদিনে আমরা কিছু কিছু জানতে পারছি। আপনাদের ওপর (অর্থাৎ বাঙালিদের ওপর) অনেক অন্যায় করা হয়েছে। আমরা আন্তরিকভাবেই দুঃখিত। আমরা বলতাম, ‘১৯৭১ সালে যখন ঘটনাগুলাে ঘটছিল তখন জানতে পারাে নি কেন? উত্তরে কেবলি বলতাে, “আমাদের জানতে দেয়া হয় নি। ওদের সাথে তর্ক করে লাভ নেই জানতাম। এও জানতাম যে ওরা জানতেও চায় নি। কোথায় ১২০০ মাইল দূরে কোনাে অজানা বাঙালিদের ওপর এদের সৈনিকরা কি অত্যাচার করছিল এ খবরে তাদের উৎসাহও ছিল না। পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে ছিল এক হাজার মাইলের ব্যবধান। মাঝখানে বিশাল একটি দেশ ভারত। পাকিস্তান নামক উদ্ভট দেশটির জনসাধারণের মধ্যে তেমন যােগাযােগ ছিল না। তাছাড়া জাতিগতভাবে, ভাষা ও সংস্কৃতিতে, দুটি অংশে যে মানবগােষ্ঠীদ্বয় বাস করে তারা পরস্পর থেকে একেবারেই ভিন্ন। সর্বোপরি দেশে ছিল না গণতন্ত্র, ছিল সামরিক শাসন অর্থাৎ পাঞ্জাবি শাসন। প্রচার মাধ্যমগুলাে সামরিক শাসনের যাঁতাকলে আবদ্ধ এ অবস্থায় কিই-বা আশা করা যায় এই সাধারণ লােকের, বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের কাছ থেকে। ২/৪ জন যারা বাইরের রেডিও যেমন বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা শুনতাে তারা হয়তাে জানতাে কি হচ্ছে। কিন্তু তাঁদের মধ্যেও অনেকেই মনে করতাে যে সামরিক অপারেশনে তাে এটা হয়েই থাকে। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের যে রাজনৈতিক প্রত্যাশা অর্থাৎ স্বাধিকার—না হলে স্বাধীনতা, এ কথাটা প্রায় কেউ বুঝতে না বললেই হয়। তবে ব্যাপারটার গুরুত্ব তাদের মন প্রথম অনুধাবন করে যখন তারা শুনলাে যে, ভারতীয় সৈন্যের হাতে তাদের পাঞ্জাবি সৈন্যদের শােচনীয় পরাজয় ঘটেছে এবং দেশটা ভেঙে গেছে। সামরিক শাসকরা একটি বছর ধরে সমস্ত প্রচার মাধ্যমগুলাে থেকে কয়েকটি ব্যাপারে এদের মগজ ধােলাইয়ের প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং অনেকটা সক্ষমও হয়েছে।
তা হলাে, বাঙালিরা বিহারিদের ওপর অত্যাচার করেছে, বাঙালিরা ভারতের প্ররােচনাতে পাকিস্তান ভাঙতে চায়, অতএব তারা গাদ্দার (দেশদ্রোহী) এবং পাকিস্তানের শােচনীয় পরাজয় ও পূর্ব পাকিস্তানে নব্বই হাজার অজেয়দের। চরম কাপুরুষসুলভ আত্মসমর্পণ, হঠাৎই পাকিস্তানের জনসাধারণকে করে তুলেছে ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ। এই প্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ ও বাঙালি বলে একটি জনগােষ্ঠী সম্বন্ধে এদের ঔৎসুক্য ও কৌতূহল। তবে এদের কারাে ভেতরেই সত্যিকার জানার ইচ্ছা ও উদগ্রীবতা ছিল বলে আমার মনে হয় নি। এদের মধ্যে। আমি বারাে বছর বাস করেছি। সে সূত্রে আমার ধারণা, এরা আজও আসল সত্য জানে না এবং জানার খুব ইচ্ছেও তাদের নেই। তবে হ্যা, এদের মধ্যে ব্যতিক্রম নেই তা বলবাে না। এই সময় বাংলাদেশ বেতার আমাদের বন্দিদের জন্য একটি অত্যন্ত। চিত্তাকর্ষক ও অভিনব প্রােগ্রাম চালু করলাে। সন্ধ্যায় একটি সময়ে দেশে আমাদের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুরা আমাদের উদ্দেশ্যে বাণী পাঠাতেন। আমরা ভালাে আছি, আমি অমুক বলছি, অমুক তুমি কেমন আছাে, তােমাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা হচ্ছে’ ইত্যাদি। কোনাে কোনাে দিন প্রখ্যাত শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীরের স্বর ভেসে আসতাে তার সাবলীল পৌরুষসুলভ ভঙ্গিতে, খলিল ভাই, আমি সম্রাট বলছি (জাহাঙ্গীর নামের বদৌলতে আমি ওঁকে সম্রাট বলে ডাকতাম, এখনও ডাকি)। সম্রাটে’র কোনাে সাম্রাজ্য ছিল না আর প্রাসাদের পরিবর্তে ছিল দু’খানি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কামরার একটি বাড়ির ক্ষুদ্র একটি অংশ, যা একটি প্রাসাদের হাস্যকর তুলনাও নয় কিন্তু সম্রাটের ছিল একটি সম্রাট-প্রমাণ হৃদয় এবং একটি সম্রাজ্ঞী-প্রমাণ অর্ধাঙ্গিনী, অতুলনীয় অতিথিপরায়ণা। বেতার প্রােগ্রামের পরপরই আসতেন আশপাশের বন্ধু-বান্ধব, জানাতেন ‘অভিনন্দন’। জিনিসটা অভিনন্দন পাওয়ার উপযুক্ত বটেই। সুদূর স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে আপনার নাম ধরে কেউ স্মরণ করছে। বাংলাদেশ তখনও আমাদের জন্য স্বপ্নের দেশ। কবে কিংবা আদৌ যাওয়া হবে কিনা, রক্তমণ্ডিত সবুজ পতাকাটি দেশের মাটিতে উড্ডীন দেখবার অন্তিম সৌভাগ্য হবে কিনা এ সন্দেহ পুরােপুরি ছিল সবার মনে। প্রতিদিন অনেক পরিচিতজনের নাম শুনতাম বেতার তরঙ্গে ও ‘আপনাদের স্মরণ করছি’ প্রােগ্রামে। অনাবিল আনন্দে ভরে যেত মন।। সম্রাট ও তার স্ত্রী আনিস উভয়ে ছিলেন রাওয়ালপিণ্ডিতে আমাদের প্রতিবেশী । ছবি আঁকায় তার জুড়ি ছিল না ওই সময় পিণ্ডিতে। সেই সুবাদে কেউকেটা সবার সাথে দোস্তি। সম্রাট ও আনিস ছিলেন আতিথেয়তার প্রতীক বিকেলে তাদের বাসার ছােট অলিন্দে বসে আনন্দ ভােজ ও পান আমাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাদেরকে কোনাে বন্দিশিবিরে যেতে হয় নি। জাহাঙ্গীর সেই সুযােগের সদ্ব্যবহার করে কাবুল হয়ে পালিয়ে আসেন ১৯৭২/৭৩ সালে ।
সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা