কতিপয় পাকিস্তানি অফিসারের মানবিক আচরণ :
বন্দিজীবনে সবাই যে আমাদেরকে কেবল অপমানই করেছে তা নয়। দু’চারজন। আমাদের সাথে মানুষের মতাে আচরণ করেছে। তাদের কথা না বললে কাহিনী একতরফা হয়ে যাবে এবং বিধাতার সর্বোত্তম সৃষ্টি মানুষের চরিত্র সম্যকভাবে চিত্রিত হবে না। একদিন বসে আছি বসার ঘরে (অর্থাৎ বসা-শােয়ার ঘরে)। হঠাৎ চিৎকার, ‘খলিল, খলিল, ইয়ার আপ কিধার হাে?’ বলতে বলতেই ঘরে ঢুকলেন মেজর আশরাফ। লেফটেন্যান্ট থেকেই আমরা একসাথে চাকরি করেছি। প্রথমে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তুই তুকারি সম্পর্ক বহু হাসিকান্নায় দিন কেটেছে একসাথে। শেষের দিকে আমি যখন কর্নেল তখন আশরাফ আমার দ্বিতীয় অধিনায়ক হিসেবে চাকরি করেছেন। আমাকে সর্বতােভাবে সাহায্য করেছেন। বর্তমানে এই বন্দিশালার উর্ধ্বতন হেড কোয়ার্টার্সে চাকরিরত। পরিদর্শন করতে এসেছেন বন্দিশিবিরটি। অর্থাৎ আমাদের ঠাকুরদা, কর্তৃপক্ষের কর্তৃপক্ষ এই উচ্চস্তরের অফিসার আশরাফ আমাকে ডেকে না নিয়ে একেবারে আমার ঘরে। আমার ও আমার স্ত্রীর তাে চক্ষুস্থির। ততােক্ষণে আশরাফ বসে পড়েছেন আমার অবাক হয়ে থাকা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেহ্ কিয়া রাহি হাে ভাবি? চায়ে নেই পিলাওগি?’ ‘জরুর জরুর’ বলে উনি চা করতে চলে গেলেন আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘স্যার, বাতাও ক্যায়সে হাে?’ বলেই একটি পােটলা এগিয়ে দিলেন। আমাদের নেহাত পছন্দের দু’একটি খাবার। দেখে কান্না পেল। সামলে নিয়ে জিগ্যেস করলাম ওঁর ছেলেপুলের কথা, ওঁর স্ত্রীর কথা। বললেন, “কেউ ভুলতে পারে না রংপুরে আমাদের সেই দিনগুলাে।’ কিন্তু মেজর আশরাফ সন্তর্পণে এড়িয়ে গেলেন বর্তমান ও নিকট অতীত হালকা কথাবার্তাই চললাে, যেমন চলতাে পুরনাে দিনে। ওঠার সময় আমাকে দাওয়াত দিলেন রাতের খাবার একসাথে খাবেন। জিগ্যেস করলাম, কোথায়। উত্তর শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। গেটের সামনে কারা কর্তৃপক্ষের অফিসারদের জন্য যে মেস সেই মেসে। বন্দির সাথে কারা কর্তৃপক্ষের একসাথে খাওয়া? নিজের কানকেও বিশ্বাস হচ্ছে না। তবে কি পাকিস্তানিরা এখন তাদের নীতির পরিবর্তন করছে। দ্বিতীয় চিন্তায় আশরাফের জন্যই ভয় হলাে। নিতান্তই পুরনাে দিনের ভালােবাসার প্রতিদান দিতে এসেছেন পাঞ্জাবের প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা ও চিরজীবন গ্রামবাসীর মতােই সরল এই আশরাফ; কিন্তু অন্য অফিসাররা তাে একে ভালাে চোখে দেখবে না। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাে জানবেই।
জানলে আশরাফের ক্ষতি হবে নিশ্চিত। কিন্তু আশরাফ অনেকটা লা-পরােয়া গােছের মানুষ বরাবরই। আমি সজোরেই বললাম, না আশরাফ, এটা ঠিক হবে না। তােমার ক্ষতি হােক আমি চাই না। তােমার স্ত্রী-পুত্র আছে। তারা আমাদের অত্যন্ত প্রিয়। শেষে অনুনয়ই করলাম; কিন্তু আশরাফ আবেগপ্রবণ হয়ে গেল হঠাৎ। আবেগপ্রবণ হয়ে গেলে দেখেছি লােকে মাতৃভাষা বলে, বিশেষ করে পাঞ্জাবিরা। পাঞ্জাবিতে বললেন, তুছি কিও ফিকর করদেও। দায়িত্ব আমার। হারামজাদারা এই সুন্দর দেশটা ভেঙে খানখান করে দিলাে। ভবিষ্যতে আর কি করবে জানি না। আমার শরীর ভালাে যাচ্ছে না, কতােদিন বাঁচবাে জানি না। তােমার সঙ্গে কোনােদিন দেখা হবে না, আমার মন বলছে। একদিন দুই বন্ধুতে বসে খাবার খাবাে না তা কি করে হয়?’ তারপর হাত ধরে বললেন, “চাকরি জাহান্নামে যাক। তােমাকে আসতেই হবে। আর না করতে পারলাম না। সন্ধ্যার পর নিজেই এসে নিয়ে গেল। সেখানে মেজর আসালত বসে। মেজর আশরাফের মতাে মেজর আসালতের সাথেও আমি বহুদিন চাকরি করি ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে এবং আমরা তাকেও আমাদের একজনই ভাবতাম কিন্তু তিনি ছিলেন আশরাফের একেবারেই উলটো-প্রতিহিংসাপরায়ণ। আমাদের বর্তমান বন্দি অবস্থা তার জন্য অত্যন্ত আনন্দদায়ক ও উপভােগ্য ব্যাপার ছিল। তার চাইতে সিনিয়র ও সর্বদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ বাঙালি অফিসারদের তার হুকুমে চলতে হয়, তাঁর কাছে হাত পাততে হয়, এ ছিল তাঁর কাছে যেন বিধাতার আশীর্বাদ। তাই তিনি জুনিয়র অফিসারদের, খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েও কটুকাটব্য করতে তৎপর ছিলেন ও প্রায়শই অপমান করতেন। আমরা তাকে ঘৃণা করতাম। আসালত, মনে হতাে বহু আশা করে বসে থাকতেন যে ইস্ট বেঙ্গলের কোনাে বন্দি অফিসার তাকে এসে কোনাে ব্যাপারে মিনতি করুক। কিন্তু তার সে আশা পূরণ হয় নি। ইস্ট বেঙ্গলের অফিসাররা কেউ কোনােদিন তাঁর কাছে। যায় নি। “সিনিয়র বাঙালি অফিসার’ নামক সেই সংগঠনই আমাদের আত্মসম্মান অনেকটা বাঁচিয়েছে। মেসে গিয়ে দেখলাম আসালত ছাড়া আরও দু’একজন ক্যাপ্টেন আছেন; কিন্তু কর্নেল রেজা নেই। রেজাই ছিলেন ক্যাম্পের অধিনায়ক। ক্যাডেট জীবনে আমার দু’মাসের সিনিয়র। পাকিস্তান জাতীয় দলের কৃতী হকি খেলােয়াড়। সকলেই নামে চেনে। অতবড় খেলােয়াড়—তাই খেলােয়াড়সুলভ ভদ্রলােক। আমাদের ভাগ্য ভালাে ওঁ না থাকলে আসালতের (২য় অধিনায়ক) অত্যাচারে হয়তাে আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে যেত। ভালাে খাবার পরিবেশন করা হলাে। বােঝা গেল খরচ আশরাফের। কথাবার্তা শুরু হলাে। আশরাফ একাই বলছিলেন কথা একবার আসালত যুদ্ধ ইত্যাদি ও ক্যাম্পের বিষয়ে কি যেন বলতে গেলেন।
সঙ্গে সঙ্গে আশরাফ, ‘তু চুপ কর। হামে বার্তে করনে দে।’ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্যার সুনাও বাল বাচ্চো কি পড়াই তাে বরবাদ হুয়ি হােগি, ইস ক্যাম্পে মে। আসালত আবার বলে উঠলেন, না এরা বড় সংগঠিত। নিজেরাই পড়াশােনা করিয়েছেন বাচ্চাদের।’ পুনরায় আশরাফ ক্ষেপে উঠলেন, বললেন, ‘তােমাদের মতাে অফিসারদের পাল্লায় পড়ে এরা কেমন ছিলেন আমি অনুমান করতে পারি।’ আরও যেটা বলতে যাচ্ছিলেন তা হয়তাে এই যে, এই আসালতদের মতাে লােকদের দ্বারাই এমনি আত্মধ্বংস সাধিত হয়েছে, এই আসালত শ্রেণীর লােকদের হাতেই আজ সামরিক বাহিনী তথা পাকিস্তান। এখানে আশরাফ শ্রেণীর লােকদের স্থান নেই, ভবিষ্যৎও নেই। কিন্তু মুখ ফুটে কথাগুলাে বললেন না আশরাফ আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম। এই বুঝি একটি সংঘর্ষ বেঁধে ওঠে; কিন্তু না, মানবতার নৈতিক শক্তি পশুসুলভ দৈহিক শক্তির চেয়ে শক্তিমান আসালত চুপ করে গেলেন। ক্যাপ্টেনদ্বয় শুনছিলেন। অনেকক্ষণ গল্প হলাে। মাঝে মাঝে আসালতকে দু’একটা গালাগালি দেয়া ছাড়া আর তিক্ততা কিছু হয় নি। শেষের দিকে মেজর আসালত কিছুটা নমনীয় সুরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্যার, আপনারাও তাে আমাদেরকে তেমনভাবে আপন করে নেন। নি।’ তখন উত্তর আশরাফের, “কেন আমার তাে তেমন মনে হয় নি। খলিল, মশহুর, সালাহউদ্দিন এরা তাে আমার আপন ভাইয়ের চেয়ে কম ছিল না কি খলিল, তাই না?’ আমি ধীর কণ্ঠে বললাম, ভালােবাসাতেই ভালােবাসার জন্ম দেয়। শ্রদ্ধাই শ্রদ্ধার জন্ম দেয়। আসালত, তুমি যদি আমাকে আন্তরিকভাবে ভালােবেসে থাক, তবে এটা সম্ভবই না যে আমি তােমাকে ভালােবাসবাে না। তবে পাকিস্তানের বর্তমান ও অতীতের সমস্যা ভিন্ন। সামরিক শাসন যেকোনাে দেশের জন্যই দুর্ভাগ্যজনক । যদি সামরিক শাসন না থাকতাে, যদি গণতন্ত্র থাকতাে তবে পাকিস্তান ভাঙতাে না বলেই আমার বিশ্বাস। ভাঙার দরকার হতাে । ‘৭০-৭১ সালে গণতন্ত্রের একটি সুযােগ এসেছিল; কিন্তু সামরিক শাসন ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়লাে। মানুষের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখালাে না। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে তােমার হয়তাে এমন কোনাে দোষ নেই। তােমরাও দাবার খুঁটি ছাড়া কিছু নও। আমার বিদায়ী শুভেচ্ছা তােমাদের প্রতি, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কর। নইলে তােমার বর্তমান পাকিস্তানও টিকবে কিনা সন্দেহ। আমার কথাগুলাে আসালত বুঝবে আমি আশাও করি নি। তবে আশরাফকে সান্ত্বনা দেয়াই ছিল আমার উদ্দেশ্য। বাসা পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দিলেন আশরাফ। চলে যাওয়ার আগে উষ্ণ আলিঙ্গন করে বিদায় নিলেন। কয়েক বছর পরে শুনেছি আশরাফ মারা গেছেন।
কেবল আশরাফ একাই নন, আরও পাঞ্জাবি অফিসার আমাদের খবর নিয়েছেন। মারী পর্বতের অধিবাসী মেজর আশফাক আমাদের সিনিয়র ছিলেন ১ম ইস্ট বেঙ্গলে। বাহ্যিকভাবে কঠোর প্রকৃতির লােক আশফাক। আলসেমি সহ্য করতে পারতেন না। বাইরে-ভেতরে প্রতি ইঞ্চি একজন সৈনিক । অধস্তন সৈনিকদের ক্রটির জন্য যেমন করতেন গালাগালি, তেমনি কৃতিত্বের জন্য করতেন সােহাগ। বাঙালি সৈনিকরা স্বভাবগতভাবেই গালাগালি অপছন্দ করতেন। তবে আশফাক এবং আশফাকের মতাে দু’একজনের গালাগালি এরা সহ্য করতাে। কারণ কোনাে বিপদ-আপদে পড়লে কিংবা অনিচ্ছাপ্রসূত দোষ করে অনুতপ্ত হলে নিজের কোম্পানির লােকদের পক্ষ হয়ে আশফাক ঝাপিয়ে পড়তেন। সেখানে তিনি সূক্ষ্ম ন্যায়বিচারের ধার ধারতেন না। তার অধস্তন সৈনিক হলেই হলাে। তার জন্য তিনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবেন। নিজের চাকরিটি বিপন্ন করে হলেও। এরকম লােককে সৈনিকরা কেন, সবাই পছন্দ করে থাকে। একবার কোয়েটার পাকিস্তান পদাতিক স্কুলে একজন পাঞ্জাবি হাবিলদার প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। বেয়নেট (সঙিন) চার্জ শিক্ষা। একজন বাঙালি সৈনিক (ইস্ট বেঙ্গল নয়, পদাতিকও নয়) অপটুতা দেখাচ্ছিল। আসলে তার সংস্থাপনায় তাকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দিয়েই পদাতিক স্কুলের উচ্চতর কোর্সে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। সে অবস্থায় যেকোনাে পাঞ্জাবি কিংবা পাঠানও অনুরূপ অথর্বের মতােই বেয়নেট চার্জের নমুনা দেখাতাে; কিন্তু ছেলেটির দুর্ভাগ্য যে সে বাঙালি। তাই পাঞ্জাবি হাবিলদার শিক্ষক তাঁকে বাঙালি বলে গাল দিলাে ও স্বভাবজাত কাপুরুষতার ইঙ্গিত দিলাে। অদূরে দাঁড়িয়ে অলক্ষ্যে ক্যাপ্টেন আশফাক তাই শুনে গর্জে উঠলেন, “দেখ সুয়াের দা পুত্রা, ম্যায় ভি বাঙালি বলেই কাঁধে ‘ই বেঙ্গল’ লেখা ধাতব চিহ্নটি দেখালেন। “তু বাঙালি নু বুজদিল সামঝা? ম্যায় দেখাতাহু বাঙালি কিয়া চিজ হ্যায়, ক্যায়সা শের দা পুত্রা হ্যায় বাঙালি।’ এই বলে উচ্চকণ্ঠে মাঠের অন্য প্রান্তে প্রশিক্ষণরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন বাঙালি সিপাহিকে নাম ধরে ডাকলেন, “ছালাম, ইধার আও, দৌড়কে আও। সামনে আসতেই বললেন রাইফেলে বেয়নেট ফিট করতে। হাবিলদারকেও বললেন তার রাইফেলে বেয়নেট ফিট করতে। দু’জনকে দাঁড় করালেন দু’দিকে। বললেন, ‘হাবিলদার এবার খড়ের বস্তায় বেয়নেট চার্জ করার মহড়া নয়, তাজা সিনায় বেয়নেট চার্জ। দেখবাে কে বাঘের বাচ্চা। ছালাম, এই শুয়াের তােমার অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ভাইকে বাঙালি বলে গাল দিয়েছে। তুমি ওর বুকে তােমার বেয়নেট বসিয়ে দাও। চার্জ।’ সকলেই বুঝলাে রাগের মাথায় ক্যাপ্টেন আশফাকের দিগ্বিদিক জ্ঞান লুপ্ত হয়ে গেছে।
সবাই এসে দাড়ালাে মাঝখানে। অনেক কাকুতি-মিনতি করে আশফাককে থামালাে। তারপর ঠিক হলাে জ্যান্ত টার্গেট নয়, খড়ভরা বস্তা দিয়েই প্রদর্শনী ম্যাচ হবে বাঙালি ও পাঞ্জাবির। তাই হলাে। ছালাম প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে মনােনীত হয়ে এসেছে এই কোর্সে। আশফাক তাঁকে চিনতেন ও তার দক্ষতার ওপর পুরােপুরি বিশ্বাস ছিল তাঁর। ছালাম অপূর্ব দক্ষতা ও বিক্রমে আক্রমণ করলাে টার্গেট। তার তুলনায় হাবিলদারের দক্ষতা নেহাতই মধ্যম। সকলে একবাক্যে ঘােষণা করলাে ছালামের বিজয়। হাবিলদার লজ্জায় মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে। আশফাক বললেন, মাফি মাঙ্গ ও বাঙালি কুল (নিকট)। হাবিলদার মাফ চাইলাে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতীক তিনি কাঁধে পরেছেন ও টুপিতে লাগিয়েছেন। তার সামনে বাঙালি সৈনিককে গালাগাল! কোনাে ন্যায়শাস্ত্রের ব্যাপার নয়। ন্যায়শাস্ত্র পড়েছেন বলে মনে হতাে না তাঁকে দেখলে। তার ধারও ধারতেন না তিনি। মেজর আশফাক অবসর নিয়ে এখন থাকেন মারী পর্বতের গায়ে। তার নিজস্ব গ্রামে। একমাত্র ছেলে এখন ক্যাপ্টেন। বেশ কয়েকজন মেয়ের পর সর্বকনিষ্ঠ এই ছেলে। ঘােড়াগলি পাবলিক স্কুলের ছাত্র ছিল। বাপের মতােই সুশ্রী চেহারা। মারী পাহাড়ের পাকা কমলালেবুর মতাে গায়ের রঙ। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে; কিন্তু বাবার মতাে উগ্র নয়, খুব ভদ্র ও নম্র। হঠাৎ আমার বন্দিবাসায় এসে হাজির। উর্দি পরেই। পরিচয় দিয়ে অত্যন্ত লাজুকভাবে বললাে, চাচা আমি এখানে আপনাদের কয়েকজনকে দেখতে এসেছি। আব্বাই বলে দিয়েছেন আসতে। নিজেই আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি অসুস্থ, ভ্রমণ করা নিষেধ। এই ক্যাম্পে আমার পােস্টিং হয়েছে শুনেই তিনি বললেন, আপনাদের কয়েকজনকে ও চাচি আম্মাদের সালাম করে যেন চাকরি শুরু করি। আর যেন আপনাদের দেখাশােনা করি। আমার চোখটা ছলছল করে উঠলাে। সামলে বললাম, “দেখা শােনার তেমন দরকার নেই (অর্থাৎ তুমি জুনিয়র। ক্যাপ্টেন হিসেবে আমাদের কোনাে উপকারেই আসতে পারবে না)। তবে তােমার আব্বা-আম্মাকে আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে বলাে যে, আমরা তাদের কোনাে দিন ভুলবাে না।’ | ছেলেটা চলে গেল। তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম মানবতা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার নয়।
আমার সঙ্গে দুর্ভাগ্যক্রমে দেখা হয় নি, কিন্তু কর্নেল খিজির হায়াত একদিন দেখা করে গেছেন আমাদের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের সঙ্গে। বন্দিশিবিরে আসা ও বন্দিদের সঙ্গে দেখা করা নিশ্চয়ই সহজ ছিল না ওদের পক্ষে। চাকরিতে ক্ষতির আশঙ্কা ছিল সমূহ। তদ্সত্ত্বেও কর্নেল খিজির হায়াত এসেছিলেন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। খিজির হায়াত ছিলেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের অফিসার, প্রায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন লে, কর্নেল ও চতুর্থ বেঙ্গলের অধিনায়ক। আখাউড়া অঞ্চলে ছিল ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল। ২৬ মার্চের পর সেই উত্তাল ও ভয়ঙ্কর দিনগুলােতে স্বভাবতই মেজর খালেদ মােশাররফ নিজের অধিনায়ককে বন্দি করতে বাধ্য হয়েছিলেন; কিন্তু হত্যা করেন নি। হত্যা করা সহজ কাজও ছিল না হয়তাে। খিজির হায়াত সমস্ত অন্তঃকরণ দিয়ে ভালােবাসতেন ইস্ট বেঙ্গলের প্রত্যেকটি সৈনিককে। আগেই বলেছি, ভালােবাসা ভালােবাসার জন্ম দেয়। সৈনিকরাও অত্যন্ত সাদাসিধা, খােদাভক্ত সৎ মানুষটিকে ভালােবাসতাে। অতএব, খালেদ মােশাররফও হয়তাে বিপদেই ছিলেন এই পুণ্যাত্মাটিকে নিয়ে কি করবেন তাই ভেবে। অবশেষে তিনি তাকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিলেন। প্রায় বছরতিনেক বন্দি থাকার পর বন্দি বিনিময়ের সময় খিজির হায়াত দেশে ফেরেন। কালক্ষেপণ না করেই তিনি এসেছিলেন আমাদেরকে দেখতে, খোঁজ-খবর নিতে। সবকিছু সত্ত্বেও বাঙালির ওপর তার কোনাে আক্রোশ ছিল না। মানবতা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয় না।
সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা