You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৪শে মার্চ, রোববার, ১৯৭৪, ১০ই চৈত্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

আজ থেকে নগর পরিষ্কার অভিযান

আজ রোববার। ২৪শে মার্চ, ঊনিশ শ’ চুয়াত্তর। রাজধানী ঢাকায় নোংরা নাভিশ্বাস জীবনে একটি বিশেষ উল্লেখ্য, ব্যতিক্রম দিন। কারণ, আজ থেকে নিয়ে মোট ৩৫ দিন পর্যন্ত প্রাচ্যের রহস্য শহর ঢাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় এক বিপুল মহোৎসব ও প্রাণ-চাঞ্চল্য শুরু হবে। এর মুন্সিয়ানায় রয়েছে ঢাকা পৌরসভা ও আরো কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান।
অভিযানের নাম রাখা হয়েছে ‘সমাজ পরিচর্যায় তরুণ’। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৭০০ তরুণ এ অভিযানে অংশ নেবে বলে জানা গেছে। অভিযানটি যাতে সর্বতোভাবে সফল হয় সেজন্যে পৌরসভার প্রশাসককে সভাপতি করে একটি বোর্ডও ইতিমধ্যে গঠন করা হয়ে গেছে।
পৌর প্রশাসক সাংবাদিকদের বলেছেন, এ অভিযানের মৌল উদ্দেশ্যেই হচ্ছে ঢাকা শহরকে নির্মল ও পরিষ্কার রাখা এবং বিভিন্ন জাতীয় ও সেবামূলক কাজে তরুণ শক্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো।
এ অভিযানকালে ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্ত, অলি-গলি পথ, দালান-কোঠা, বাড়ী-ঘর এবং ময়লা লাইন ইত্যাদি পরিষ্কার করা হবে। এছাড়া রাস্তার পাশে আইল্যান্ডে চুনকাম করা, দেয়ালের লেখা দাগ মোছা, রাস্তার পাশের ঝোপ-ঝাঁপ পরিষ্কার করা, ফুটপাত পুনঃনির্মাণ করা এবং রাস্তার ধারে গড়ে ওঠা বিভিন্ন বেআইনী দোকানপাটকে উচ্ছেদ করা হবে। নিঃসন্দেহে পৌরসভার এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। অন্ততঃ এতদিনে যে তার কান থেকে তুলো সরে মানুষের কল্যাণে কিছু একটা করার সদিচ্ছা জেগেছে, সেটাও কম লক্ষণীয় নয়।
তবে, এতে কিছু ভাববার দিকও আছে। আমরা আগেও বলেছি যে, ঠিক যে যে মানসিকতা সদিচ্ছা, চেষ্টা ও পরিবেশ কিম্বা ঠিক যে যে বাস্তব ব্যবস্থা থাকলে কোনো শহর বা অঞ্চলকে নির্মল, পরিষ্কার বা ব্যাধিহীন রাখা যায়, সে সব আগে এক স্থায়ী ভিত্তিতে নিশ্চিত করতে না পারলে কোনো আচম্বিৎ ঢাকঢোল অভিযান দিয়ে কোনো অঞ্চলকে স্থায়ীভাবে পরিষ্কার বা ব্যাধিহীন রাখার আশা করা যায় না। পৌরসভা কি সেদিক থেকে কোনো স্থায়ী কর্মসূচী নিয়েছেন? তা না থাকলে দেখা যাবে যে, অভিযানের ৩৫ দিন পর্যন্ত শহর হয়তো ঠিকই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে আর সবার চোখে এক অবাক বিস্ময়ের ঝাঁঝ লাগবে, কিন্তু পরবর্তী ৩৫ দিনে হয়তো আবার সেই যে লাউ সেই কদু হবে। অর্থাৎ শহর আবার জঞ্জালের ভাগাড়ে পরিণত হবে। মানুষ আবার নাভিশ্বাস হয়ে উঠবে।
অবশ্য, এ কথা ঠিকই যে, জনসাধারণের নিজস্ব সদিচ্ছা, চেষ্টা ও সহযোগিতা ছাড়া একা পৌরসভার পক্ষে শহরে স্থায়ী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। পরিষ্কার নির্মল জীবনে জীবনের রূপ ও মান কেমন হয়, আবার অপরিষ্কার-নোংরা জীবনে জীবনের রূপ ও মানই বা কেমন হয়, তা’ নাগরিককে নিজেরই উপলব্ধি করতে চেষ্টা করতে হবে। এরই সঙ্গে পৌরসভারও সর্বতোভাগে ব্যবস্থা নিয়ে চেষ্টা করতে হবে যাতে অচিরেই সাধারণ মানুষের মাঝেও সদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার একটা সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত মানসিকতা তৈরী হয়। আর এই মানসিকতাই সমস্ত সমস্যা সমাধানের পেছনে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান।
পৌরসভা যদি নিয়মিতভাবে জনসাধারণকে পৌর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পর্যাপ্তভাবে দিয়ে যায়, কিম্বা জনসাধারণের কাছ থেকে যেকোনো অসুবিধার অভিযোগ পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবেই তার একটা বিহিত করে, অসুবিধা দূর করতে সচেষ্ট হয়, তাহলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার মানসিকতা খুব সহজেই জনসাধারণের মধ্যে গড়ে উঠতে পারে।
অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, দিনের পর দিন বার বার পৌরসভার কাছে অসুবিধার কথা জানিয়েও যখন জনসাধারণ পৌরসভার কাছ থেকে কোনোই সাড়া না পায়, একমাত্র তখনই সে বিরক্ত হয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার সমস্ত উচ্ছ্বাস ও মানসিকতা হারিয়ে ফেলে।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে যে, শুধুমাত্র মৌলভীর ফতোয়া দেবার মতো জনসাধারণকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার হিতোপদেশ দিলেই কোনো বাস্তব সুফল পাওয়া যায় না। এজন্যে, পৌর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পৌরসভাকেও সব সময়ে সত্যিকারভাবে উদগ্রীব ও সচেষ্টও থাকতে হয়। অথচ দুঃখের বিষয়, দেশের অপরাপর পৌরসভার মতো ঢাকা পৌরসভাও জনসাধারণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দানের ব্যাপারে কানে তুলো দিতে একেবারে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। তাই পৌরসভা গৃহীত আজকের এ অভিযান অনেকের কাছেই অনেকটা ‘ব্যাঙের সর্দি’র মতোই ঠেকছে।
যা হোক, স্থায়ী ব্যবস্থা ও কর্মসূচী পৌরসভার হাতে কতটুকু আছে জানা নেই, তবে, এ ধরনের অভিযান যে একটা উন্নতির লক্ষণ কিম্বা এ ধরনের অভিযানের যে যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা আছে সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আর এইভাবেই ‘হাত আসে’ বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। এতে জনসাধারণও সর্বতোভাবে পৌরসভাকে সহযোগিতা দেবে বলেই আমরা আশা করছি।
তবে, সব শেষে একটি কথা বলতেই হয়। তা’ হচ্ছে এ অভিযানে রাস্তার পার্শ্বদ্ধ বেআইনী দোকানপাট উচ্ছেদ সম্পর্কে যে কর্মসূচী নেয়া হয়েছে তার সম্পর্কে। আমাদের মনে হয়, এটা একটা বৃহৎ সমস্যা এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুতরাং, একে এ অভিযানের অন্তর্ভুক্ত না করে অন্য একটি বিশেষ পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করলে সবচেয়ে ভালো হয়। কারণ, শুধু উচ্ছেদ করণের দিকে দেখলেই চলবেনা। উচ্ছেদ করার পর আক্রান্তদের কেমন অবস্থা দাঁড়াবে বা তারা কোথায়ই বা মাথা গুঁজবে সে সম্পর্কেও ভেবে নেবার প্রয়োজন আছে। তা’ না হলে, এক সমস্যা দূর করতে গিয়ে আরো হাজারো সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।
তাছাড়া, তরুণদের হাতে এ গুরুভার দেয়া ঠিক হবেনা। কারণ, বয়সের প্রবলতাকে অবস্থানুসারে তরুণেরা কতটুকু মানিয়ে নিতে পারবে, সেটাও ভাবনার বিষয়। মনে হয়, এ কাজ পুলিশের হাতে দিলেই সবচেয়ে ভালো হয়। তবে, আগেই উচ্ছেদ পরবর্তী সমস্যাগুলোকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমাধানের জন্যে যাবতীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তা, না হলে প্রকৃত সুফল পাওয়া সম্ভব নয়।

মরার ওপর খাঁড়ার ঘা!

এবার ঔষধের দামও বাড়লো। নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদির ঊর্ধ্বমূল্যের সঙ্গে জীবন রক্ষাকারী প্রায় সবরকম ঔষধেরই দেড় থেকে দু’গুণ দাম সরকার কর্তৃকই স্বীকৃতি পেলো। বলা বাহুল্য ঔষধের এই অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশের জনগণ চিকিৎসা লাভের আশা ত্যাগ করার কথাই ভাবছেন বাধ্য হয়ে। দেশে ন্যায্যমূল্যের ঔষধের দোকানের মাধ্যমে সরকার যে সব অতি প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবরাহ করছেন সেগুলোর মধ্যে গত ২১শে জানুয়ারী ও ১৮ই মার্চ এই দুই দফায় যথাক্রমে ৩৯টি ও ৪৪টি ঔষধের মূল্য বৃদ্ধি করেছেন।
সভ্যতার অনেক আশীর্বাদের সঙ্গে অভিশাপরূপে আছেন টেনশন। যার ফলে অম্লপিত্ত বা এ্যাডিটি হয় এবং দেহাভ্যন্তরস্থ যান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। অথচ ধাঁচতে হবে, কাজও করতে হবে। তাই এন্টাসিড ট্যাবলেট আজকাল প্রায় সবারই সঙ্গী। এই ধরনের ট্যাবলেট যথা—জেলোসিল-যার ৫০টার দাম ছিল ৬.৭৮ টাকা তার দাম হয়েছে দশ টাকা। বাইরে তার দেড় গুণ। এমনি ভ্যালিয়াম-৫ ৩০টি ট্যাবলেট এক লাফে ১২ থোক ১৮ টাকায় পৌঁছেছে। বাইরে আরো চড়া দামে এই ভ্যালিয়াম-৫ বিক্রি হচ্ছে অবাধে। এমনিভাবে ইনসুলিন, বাসকোপ্যান, লিব্রিয়াম সহ ৮৩টি ঔষধের দামই ঊর্ধ্বে স্থিতি পেয়েছে। এবং এতদিন কালোবাজারে যে দামে ঔষধগুলো বিক্রি করা হতো—নতুন আমদানীকৃত ঔষধের ধার্যকৃত মূল্য তার চেয়েও বেশী স্থির করা হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে বলতে হয় যে, প্রতিক্ষেত্রেই দেখা যায়, যখন কোনো দ্রব্যমূল্য বা ঔষধের মূল্য কতিপয় স্বার্থচক্রীদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে এক অজানা কারণে বৃদ্ধি পেতে পেতে জনগণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তখন হঠাৎ সংশ্লিষ্ট মহলের নিদ্রাভঙ্গ হয়। অতঃপর দাম যেটা বাঁধা হয়—সেটার তুলিত মান রূপে গণ্য করা হয় বর্তমান বাজার দর তথা মুনাফাখোরদের সৃষ্ট ঊর্ধ্বমূল্য। ফলে সরকার কর্তৃক দাম বেঁধে দিলেও তখন আর পেছন ফেরার উপায় থাকে না।
শুধু তাই নয়। কালোবাজারীদের লক্ষ্য হ’লো সর্বদা ন্যায্য দামের চেয়ে বেশী মূল্যে দ্রব্যাদি সরবরাহ করা। তাই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে তারা ন্যায্যমূল্যের দোকানে জিনিস ঘাটতি ফেলে এবং চড়াদামে অবাধে তা বাজারে বিক্রি করতে থাকে। সেক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক যে ঔষধের দাম ১০ টাকা বা ১৮ টাকা বেঁধে দেওয়া হবে তা কালোবাজারে যে তার দেড়গুণ দামে বিক্রি হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই-ই হয়ে আসছে এ যাবত।
আরো আশ্চর্যের কথা, ঔষধের মূল্য বৃদ্ধির কোনো কার্যকারণ বাংলাদেশ মেডিকেল সাপ্লায়ার্স বলতে পারেন না। তবে মূল্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সূত্র থেকে বলা হয় যে, বাংলাদেশের মুদ্রামান হ্রাস পাবার ফলে আমদানীকাররা আগের নির্ধারিত মূল্যে বিদেশ থেকে ঔষধ আনতে রাজী নয়, ফলে মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, মূল্য নির্ধারণ ও মূল্য নিয়ন্ত্র বিভাগের প্রদর্শিত যুক্তি ও ঔষধের বর্ধিত মূল্যের মধ্যে সঙ্গত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো সম্বন্ধ নেই।
এরই প্রেক্ষিতে আমাদের বক্তব্য হ’লো, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এমনিতেই জন-জীবনকে প্রায় পঙ্গু করে ফেলেছে। অন্ন-বস্ত্র যোগানোর প্রাণান্ত সংগ্রামে জীবনী শক্তির অধিক অপচয় হচ্ছে এবং এই অসহায় পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে গিয়ে অন্ধকার বিদিশায় জনগণ বার বার বিভ্রান্ত হচ্ছে। দিন দিন খাদ্যের অভাবে এবং পুষ্টির অভাবে ক্ষীণজীবী মানুষগুলোর উপর এই ঔষধের মূল্য বৃদ্ধির চাপ প্রায় মরার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতোই হয়েছে।
এই প্রসঙ্গেই বলতে চাই যে, কোনো পরিস্থিতি মুঠোর বাইরে চলে যাবার আগেই তার জন্যে যথাযোগ্য পদক্ষেপ নিতে পারলে বা অন্ততঃপক্ষে সচেতন থাকতে পারলে সব ব্যাপারেই এমন হযবরল হয় না। এবং সাধারণ মানুষের জীবন দ্রব্যমূল্যের অক্টোপাস বন্ধনে ক্রমশঃ এমন পিষ্ট হয় না।
অতঃপর আমাদের আবেদন সংশ্লিষ্ট মহলগুলো যেন একটু তৎপর হন। কারণ, মরার উপর খাঁড়ার ঘা মারায় কোনো বাহাদুরী নেই—অবস্থাকে আয়ত্তে আনার জন্যেই নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো অস্তিত্ব। আমরা তাদের অস্তিত্বের প্রমাণই চাই।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!