কর্নেল মুহাম্মদ ইয়াসিনের ওপর নির্যাতন
ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ও লে. কর্নেল মাসুদ ছিলেন পদাতিক বাহিনীর অফিসার। ১৯৭১ সালে তারা দুজনেই ছিলেন সৈনিকদের কমান্ডার । হয়তাে বলার প্রয়ােজন নেই যে, পদাতিক বাহিনী প্রধানত যুদ্ধক্ষেত্রে সর্বাগ্রে থাকে ও সম্মুখ সমরে যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত হয়। এদিকে কর্নেল ইয়াসিন ছিলেন সাপ্লাই কোরের অর্থাৎ যেসব সৈনিক পশ্চাতে থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য সরবরাহ ও সরঞ্জাম পাঠায়, তাদের অফিসার। ১৯৭১ সালে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সম্ভাব্য বিদ্রোহের ব্যাপারে তার কোনাে ভূমিকা থাকার কথা নয়। তবুও ১৯৭১ সালের মার্চের পরপরই কর্নেল ইয়াসিনকে গ্রেফতার করা হয়। অবশ্য মার্চ মাসে কর্নেল ডা. আবদুল হাই এবং অন্য অনেক বাঙালিকে তাদের অফিসে উর্দি পরা অবস্থাতেই গুলি করে খুন করা হয়েছিল। অতএব, কর্নেল ইয়াসিনের গ্রেফতার এমন আলাদা কোনাে ব্যাপার ছিল না। কর্নেল ইয়াসিন ঢাকায় পাকবাহিনীর দ্বারা আটক হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছিলেন। বিভিন্ন প্রকারের বারুদ, বিস্ফোরক ইত্যাদি আলাদা করে রাখার জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েক ডজন কুঠুরি করা হয় ঢাকা অ্যামুনিশন ডিপােতে। এই কুঠুরিগুলাে ফুট আটেক লম্বা ও ফুট চারেক চওড়া। ওপরে ছাদের নিকট দেয়ালে এক বর্গফুট খানেক খােলা-যে রকম পায়খানায় থাকে—দুর্গন্ধ বের হয়ে যাওয়ার জন্য। ঢাকার সেনাছাউনির অ্যামুনিশন ডিপােতে এই কুঠুরিগুলাের একটিতে রাখা হয়েছিল কর্নেল ইয়াসিনকে। এসব কুঠুরিতে আরও কয়েকজন লে. কর্নেল এবং মেজর পদবির অফিসারকে রাখা হয়। তাছাড়া ঢাকায় যে অনেক বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মচারী এবং ব্যক্তিদের বন্দি করা হয়েছিল তাদেরকেও রাখা হয়েছিল এই কুঠুরিগুলােতে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের রৌদ্রে এই ক্ষুদ্র কুঠুরিগুলাে এমন তেতে উঠতাে যে, তাতে কোনাে পশুও অসুস্থ না হয়ে পারতাে না; কিন্তু বিধাতার অদ্ভুত সৃষ্টি মানুষ। মানুষ যেমন চরম নারকীয় অবস্থায়ও বেঁচে থাকে, আবার এই নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবকে আটক করে রাখে অপর কিছু মানুষরূপী শয়তানই। অথচ এসব দুর্ভাগার কথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে তেমনভাবে স্থান পীয় নি। আমাদের বর্তমান প্রজন্ম এদের কথা হয়তাে শােনেও নি।
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এঁদের ইতিহাস জানবে কি না তা ভবিষ্যৎই জানে তবে একটা কথা পরিষ্কার করে বলা যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানের তখনকার জনগণ কল্পনাও করে নি যে নির্দোষ বাঙালিদের ওপর তাদের বিশ্ববিজয়ী সােনার সৈন্যরা কিরূপ অমানবিক জন্তুর আচরণ করেছে। পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাে আর জানবে এই সত্যগুলাে। এই কুঠুরিগুলাে দিনের বেলা খােলা হতাে কেবল বন্দিদের অনুরােধে, প্রকৃতির ডাকে তাদের সাড়া দেয়ার জন্য। সঙিন উচিয়ে পাহারাদার পেছন পেছন যেত। সন্ধ্যার পর বাইরে থেকে তালা দিয়ে ঘরগুলাে বন্ধ করে দেয়া হতাে। এরপর প্রস্রাব-পায়খানার প্রয়ােজন হলে সেজন্য ছিল একটা টিনের পাত্র। পেট খারাপ হলেও এর ব্যতিক্রম হতাে না। দু’বেলা খাবার দেয়া হতাে সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত মেস টিন’ বলে দু’ইঞ্চি তিন ইঞ্চি মাপের একটি অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে। দু’বেলাই ভাত আর ডাল। ভাতে কাঁকর ও ডাল পানির মতাে। এই মেস টিনটি দরজা না খুলেই দরজার নিচ দিয়ে চালান করে দেয়া হতাে। প্রহরীর কাছে কোনােরূপ অনুরােধ ও নালিশ করলে ছিল একই জবাব, ‘দেখ গাদ্দার (বিশ্বাসঘাতক), চুপরাহ। খানা হায় তাে খা, না হাে তাে জাহান্নামে যা।’ কর্নেল সাহেব তাঁরই অধস্তন সিপাহির মুখে কখনাে এমনি বাণী শুনবেন, তা নিশ্চিতভাবেই কল্পনাও করতে পারেন নি। কর্নেল ইয়াসিন ছিলেন সরল স্বভাবের লােক। যেসব লােক বিপদের চিন্তা করেই যা বিশ্বাস করেন তাই খােলাখুলি বলে থাকেন, কর্নেল ইয়াসিন ছিলেন তাঁদের একজন। ১৯৭০ সালের দিকে অনেক ‘বিচক্ষণ’ গােছের লােক বাঙালি জাতির অধিকারগুলাের কথা খােলাখুলিভাবে বলতেন না; কিন্তু ইয়াসিন বলতে দ্বিধা করতেন না। অতএব তাঁর পাকিস্তানি সহযােগী ও ঊর্ধ্বতন অফিসাররা জানতাে যে, ইয়াসিন মনেপ্রাণে একজন বাঙালি। অন্য আর যে বাহানাই দেখানাে হােক না কেন, ইয়াসিনকে ১৯৭১ সালের মার্চের পর বন্দিশালার অন্ধ কুঠরিতে নিক্ষেপ করার আসল কারণ এটিই ছিল। তিনি বাঙালি, তিনি মনেপ্রাণে বাঙালির অধিকারের পক্ষে। অতএব, তিনি বাঙালি-পাঞ্জাবি’ সংগ্রামে পাঞ্জাবের পক্ষে কাজ করবেন না—এটাই তার অপরাধ, এটাই তার বিশ্বাসঘাতকতা। হ্যা, তিনি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে ছিলেন একজন সৎ পাকিস্তানি; কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। ইয়াসিনকে হতে হবে একজন সত্যিকারের পাঞ্জাবি-ভক্ত অফিসার—তাতে যদি পাকিস্তানের অনিষ্ট হয় তবুও। অতএব, ইয়াসিন পাঞ্জাবি প্রভাবিত পাকবাহিনীর বন্দি। পরে এপ্রিল/মে মাসের দিকে পরিকল্পনা করা হলাে যে, দেশদ্রোহিতার দায়ে শেখ মুজিবের প্রহসনমূলক বিচার করে ফাসি দেয়া হবে।
এই মামলার জন্য সাক্ষী দরকার। সাক্ষী পাওয়া খুব কঠিন নয়, জামায়াতে ইসলামীর মতাে বহু পাঞ্জাবি-ভক্ত সাক্ষী পাওয়া সম্ভব; কিন্তু তাদের সাক্ষ্যের দাম কম। কারণ মামলাটি একটি সামরিক ষড়যন্ত্র ঘিরে। প্রমাণ করতে হবে যে, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে একটি ষড়যন্ত্র হয়েছিল, যাতে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিকদের হঠাৎ আক্রমণ করে নিরস্ত্র করা হবে। কাজটি করবে বাঙালি সৈনিকরা এবং এর নেতৃত্ব দেবেন কিছু প্রবীণ বাঙালি অফিসার। অতঃপর সহজেই পাঞ্জাবি সৈন্যরা বন্দি হবে পূর্ব পাকিস্তান বাঙালি সৈন্যদের কমান্ডে এসে যাবে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। | শেখ মুজিবের বিচারকারী আদালতের কাছে এই কল্পকাহিনীর পক্ষে তথাকথিত ষড়যন্ত্রে সম্পৃক্ত অফিসারগণ নিজ মুখে স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি দেবেন। অতএব, পদলেহী বেসামরিক বাঙালি দ্বারা কাজ হবে না, কিছু প্রবীণ বাঙালি সেনা অফিসারকে অত্যাচারে বিপর্যস্ত করে সাক্ষী বানাতে হবে। মজুমদার ও মাসুদকে তাে পাওয়াই গেছে। প্রবীণ অফিসার লে. কর্নেল ইয়াসিনকে পেলে মামলাটি খাড়া করা যায়। অতএব, ইয়াসিনকে নিয়ে যাওয়া হলাে পশ্চিম পাকিস্তানে। প্রথমে পাকবাহিনীর গােয়েন্দা অফিসার দ্বারা জিজ্ঞাসাবাদ। পরে মজুমদার ও মাসুদের সাথে লাহাের ফোটে অবস্থিত স্পেশাল ইন্টারােগেশন সেলের ওই মনুষ্যরূপী পশুর দল অর্থাৎ ইন্সপেক্টর দুররানি, ইন্সপেক্টর সরওয়ার ও ইন্সপেক্টর ইসলামের হাতে তুলে দেয়া হলাে। প্রচণ্ড চড়, মারপিট, নখের নিচের সুচ, পায়খানার রাস্তায় তপ্ত ডাণ্ডা ঢােকানাে থেকে বৈদ্যুতিক শক সবই দেয়া হলাে। এ যাত্রায়ও সবচাইতে বড় ট্রাজেডি ও অসহায়ত্ব ছিল একই-ইয়াসিন যতােই বলেন কী বলতে হবে বলাে—আমি সবই বলবাে, লিখেও দেবাে। কিন্তু ওদের একই উত্তর, “নেহি জি, কর্নেল সাহাব। হাম তেরা সােনেরি (সােনালি) মু সে সুননা চাহতে হ্যায় কিয়া কিয়া হুয়া।’ নিশ্চয়ই সকল মানুষের প্রার্থনা হবে যে, বিধাতা যেন পরম শত্রুকেও অনুরূপ পরিস্থিতিতে না ফেলেন। এখানে বলে রাখা দরকার, যখন এই তিন হতভাগ্যের ওপর এমনি চরম নির্যাতন চালানাে হচ্ছিল তখন দু’একদিন পরপরই কোনাে পাকিস্তানি সিনিয়র অফিসার এই জিজ্ঞাসাবাদ সেলে আসতাে ও জেরার অগ্রগতি সম্বন্ধে অবগত হতাে।
অতএব, অমানুষের তালিকায় কেবল দুররানি, সরওয়ার ও ইসলাম প্রমুখ ছিল না- এদের পরিচালক ছিল পাকিস্তানি সামরিক অফিসার। এদের উচ্চতম পর্যায়ে ছিল একজন ব্রিগেডিয়ার। ব্রিগেডিয়ারের নামটি ছিল রফিক (সঠিক নামটির ব্যাপারে আমার ভুলও হতে পারে)। অবশেষে একটি কাগজে টাইপ করা চার-পাঁচ পৃষ্ঠা লম্বা স্বীকারােক্তি এনে হাজির করা হলাে ইয়াসিনের সামনে। ইয়াসিন ছিলেন সরল স্বভাবের । কাগজটা পড়ে দেখলেন সর্বৈব মিথ্যে কথা। এই মিথ্যেতে স্বাক্ষর দিতে তার মন সেই অন্তিম মুহূর্তেও সায় দিচ্ছিল না। অথচ এইরূপ একটি কাগজের ওপর দস্তখত করার জন্য ইতােপূর্বে কতাে না তিনি অনুরােধ করেছেন। এখন তাে অনেক স্বস্তির সাথেই দস্তখত করার কথা। স্বস্তি যে তিনি পান নি তা নয়। তবে বিবেকের দ্বন্দ্বের যন্ত্রণা শারীরিক নির্যাতনের চেয়ে খুব কম ছিল না। ইয়াসিন দস্তখত করে দিলেন। তাকে বলা হলাে কাগজটার বয়ান মুখস্থ করতে। সম্ভাব্য প্রশ্ন ও তার উত্তরগুলাে ইয়াসিন মুখস্থ করতে শুরু করলেন। ঢাকায় অবস্থিত ইয়াসিনের স্ত্রী ও তিন পুত্র-কন্যার মুখ নতুন করে ভেসে উঠলাে তার স্মৃতিতে। | এর দু’একদিন পর লাহাের ফোর্টে এলেন একজন পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার ইয়াসিনকে নিয়ে যাওয়া হলাে ব্রিগেডিয়ারের সামনে। ব্রিগেডিয়ার নিজের পরিচয় দিলেন যে, তিনি পাকবাহিনীর ডেপুটি অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল। কোর্ট মার্শাল ও অন্যান্য আইন-আদালত বিভাগ সামরিক বাহিনীর এই শাখাটির অধীনস্থ। অতএব, শেখ মুজিবের মামলার ভারও তার ওপর বর্তিয়েছে। ব্রিগেডিয়ার ইয়াসিনকে বললেন, তুমি তাে এই কাগজটায় দস্তখত করেছে। অতএব, তুমি যে এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলে তা তুমি স্বীকার করেছে। এর অর্থ এই যেকোনােদিন তােমাকে এই ষড়যন্ত্রের অপরাধে কোর্ট মার্শাল করে ফাসির আদেশ দেয়া যেতে পারে। তুমি কি তা ভালােভাবে উপলব্ধি করাে?’ সত্যি বলতে কি কাগজে দস্তখত করায় যে তার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে ইয়াসিন তা কখনাে ভেবে দেখে নি। এ কয়দিন কাগজটি মুখস্থ করার ব্যাপারে তিনি ব্যস্ত ছিলেন।
ফাকে ফাকে মনে হতাে ঢাকায় তাঁর পরিবারবর্গকে হয়তাে আবার দেখতে পাবেন। ইয়াসিন ঢােক গিলে উত্তর দিলেন, ‘হ্যা স্যার। ‘আমরা অবশ্য তােমার প্রতি অতােটা নির্দয় হবাে না। তবে শর্ত এই যে, যে কাগজটিতে তুমি স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে তার প্রতিটি অক্ষর লায়ালপুরের ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকার করে সই দিয়ে আসতে হবে। কয়েকদিনের মধ্যে তােমাকে লায়ালপুরের ওই ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে হাজির করা হবে। সেখানে তুমি এই কাগজে যা লেখা আছে হুবহু তাই জবানবন্দি। হিসেবে বলবে, ঠিক আছে?’ ব্রিগেডিয়ার বললেন। ঠিক আছে স্যার’, পুনরায় ঢােক গিলে ইয়াসিন বললেন। ইয়াসিন জবানবন্দিটি মুখস্থ করছিলেন। এক জায়গায় দেখলেন যে লেখা আছে—অমুক দিন শেখ মুজিবের ধানমণ্ডির বাড়িতে একটি ঘরে মিটিং হচ্ছিল। সেখানে কর্নেল ইয়াসিন উপস্থিত ছিলেন। ইয়াসিন পড়লেন বিপদে। শেখ মুজিবের ধানমণ্ডির ৩২ নং সড়কের বাড়িতে কখনাে যান নি, বাড়িটি তিনি দেখেনও নি। এদিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ব্রোহি হয়েছেন বিবাদি অর্থাৎ শেখ মুজিবের আইনজ্ঞ । তিনি নিশ্চয় জিগ্যেস করবেন মুজিবের বাড়ির কোন্ কামরায় সভাটি হয়েছিল । উত্তরটি অন্য সাক্ষীদের বক্তব্যের সাথে মিলিয়ে দেখবেন। অতএব, ইয়াসিন তার এই সমস্যার কথা কর্তৃপক্ষকে বললেন ও কর্তৃপক্ষের কাছে শেখ মুজিবের বাড়ির একটি নকশা চাইলেন। কয়েকদিন পর নকশা এলাে। নকশাটি শেখ সাহেবের বাড়ির ভেতরের বিভিন্ন কামরার বিন্যাসের নকশা নয়, এটি ৩২ নং সড়কের নকশা ও সেখানে সারিবদ্ধ সবগুলাে বাড়ির মধ্যে শেখ মুজিবের বাড়িটি চিহ্নিত করা। ইয়াসিন। কর্তৃপক্ষকে পুনরায় বােঝালেন যে তিনি জানতে চান, শেখ মুজিবের বাড়ির কামরাগুলাের কোনটা কোথায়। বৈঠকখানায় যেতে হলে গেট থেকে কিভাবে কোন্ কামরা পার হয়ে যেতে হয়। বৈঠকখানার পরিধি কতােটা ইত্যাদি। | কর্তৃপক্ষ আবার নকশাটি ফেরত নিয়ে গেল। দু’একদিন পরে একজন এসে ইয়াসিনকে বললাে যে, ইয়াসিনের এতােটা দুশ্চিন্তা করার কোনাে কারণ নেই। ব্রোহি বলেছেন যে তিনি এ প্রশ্ন ইয়াসিনকে জিগ্যেস করবেন না। উত্তর শুনে ইয়াসিন বাকরুদ্ধ। এমন বিখ্যাত ও বিদ্বান আইনজীবী ব্রোহিও এই সামরিক বাহিনীর দলে! অথচ তিনি রাষ্ট্র কর্তৃক শেখ মুজিবের আইনজীবী। নিযুক্ত হয়েছেন। সেজন্য নিয়মিত উচ্চভাতাও নিশ্চয় পাচ্ছেন। অথচ কাজ। করছেন মুজিবের প্রতিপক্ষ সামরিক বাহিনীর হয়ে মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে
ঝােলানাের বন্দোবস্ত করতে? ইয়াসিন ছিলেন উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ কলেজ কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের স্নাতক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রিপ্রাপ্ত। বলা যেতে পারে বিদ্বান ব্যক্তি। অথচ ব্রোহি ছিলেন আরও অনেক বিদ্বান। অতাে বড় বিদ্বান এমন চরিত্রহীন! সামান্য অর্থের জন্য এতােটা নিচে নামতে পারেন! সরলমনা ইয়াসিন বিশ্বাস করতেন যে, বিদ্যা ও চরিত্র সর্বদাই একসাথে। অবস্থান করে। তিনি জানতেন না যে, চরিত্রের ওপর বিদ্যার প্রভাব নেহায়েই ভাসা ভাসা। ব্রোহি বিদ্বান হতে পারেন, কিন্তু লােভ-লালসার ব্যাপারে পদলেহী। পশুর ওপরে নয়। এমন চরিত্রের লােকের ওপর বিদ্যার পাহাড় চাপিয়ে দিলেও তার মৌলিক চরিত্রের পরিবর্তন হয় না। অবশেষে বিচারপর্ব শুরু হলাে। ব্রোহি বলতে গেলে কোনাে জেরাই কাউকে করলেন না। দু’একটা প্রশ্ন বরং ব্রিগেডিয়ার রহিম, যিনি ছিলেন প্রিসাইডিং বিচারক, তিনিই করলেন। মানবেতিহাসের হাস্যকর এই বিচারকার্য দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। প্রয়ােজনও ছিল না। কর্নেল মাসুদকে তাে বিপদাপন্নভাবে অসুস্থ ছেলেকে দেখার জন্য ঢাকায়। তার পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মজুমদার ও ইয়াসিন, যাদের দু’জনেরই পরিবার ছিল ঢাকায়, তাদেরকে পরে আমাদের সাথে বন্দিশিবিরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। তবে ১৬ ডিসেম্বর ‘৭১ থেকে মধ্য ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তারা মুক্তই ছিলেন। তখনই তাদের মুখে এই নির্যাতন কাহিনীগুলাে আমার শােনা। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর একদিন ইয়াসিন আমার বাসায় এসে হাজির। এসে অভিনন্দন ও কুশল বিনিময়ের আগে তিনি আমাদের বুকে পিন। দিয়ে কাগজের একটি ক্ষুদ্র ব্যাজ সেঁটে দিলেন। ব্যাজটি ছিল বাংলাদেশের পতাকার ছবি হাতে আঁকা। প্রতিটি ব্যাজ ইয়াসিন নিজের হাতে এঁকেছেন। এবং সবুজ, লাল ও হলুদ রঙ দিয়ে চিহ্নিত করেছেন। লাল রঙটি সূর্যের, আর হলুদের মধ্যে আমাদের বাংলাদেশের মানচিত্র চিহ্নিত। সবাই জানেন যে পরে। আমাদের পতাকা থেকে বাংলাদেশের মানচিত্রটি অপসৃত হয়। | ইয়াসিন আনন্দে আত্মহারা। অত্যুৎসাহী ধরনের লােক। কয়েকদিন আমরা গর্বের সাথে ব্যাজটি বুকে ধারণ করেছিলাম। এরপর ১০ জানুয়ারি ‘৭২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঢাকায় প্রত্যাবর্তন। ঢাকা থেকে সেই ঘটনা রেডিও সরাসরি সমপ্রচার করছিল। খুব ভালােভাবে না হলেও মােটামুটি বােঝা যাচ্ছিল ভাষ্যকারের মন্তব্য। বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে, বিমানবন্দর থেকে রাস্তার দু’পাশে দাড়িয়ে লক্ষ লােক। তারপর সােহরাওয়ার্দি উদ্যানে বিশাল জনসভা। রেডিওতে কান লাগিয়ে সবাই শুনছিলাম।
কর্নেল ইয়াসিনও ছিলেন। শেখ সাহেবের বক্তৃতা শুরু হলাে। প্রতিটি কথা মন দিয়ে শুনছিলাম। শেষের দিকে শেখ সাহেব বললেন, “আমার বিরুদ্ধে প্রহসনের মামলায় কয়েকজন বাঙালি মিথ্যে সাক্ষী দিয়েছেন। তাদেরকেও ক্ষমা করা হবে না।’ সেদিনের সেই আনন্দের মুহূর্তে এমন একটি কথা শুনবাে আমরা কেউ কল্পনা করি নি। কি অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এই ‘মিথ্যে সাক্ষীগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সে সম্পর্কে কিছু জানানাে হয় নি। ইয়াসিনের মুখের দিকে সেই মুহূর্তে তাকাতে পারে নি কেউ। বিনা কারণে এতাে বড় শাস্তি ভােগ করার পরও এরা সবাই ভাবছিলেন নবীন স্বাধীন দেশে ছােটো-বড় যাই হােক কোনাে কাজে আসবেন তারা। দু’বেলা খাওয়ার জন্য কোনাে কাজের প্রয়ােজন এদের কারােরই ছিল না তারা শুধু চেয়েছিলেন অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সামান্য হলেও কোনাে অবদান রাখবেন স্বাধীন কিন্তু ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। সবাই জানতেন প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লােকের নিদারুণ অভাব হবে সদ্য স্বাধীন দেশে। দেশের স্বাধীনতার জন্য অমানুষিক নির্যাতন তারা সহ্য করেছেন, আজ স্বাধীনতার আনন্দে সে নির্যাতনও ভুলতে চেষ্টা করছেন, অথচ তাদের কপালে জুটলাে এই কলঙ্কের টিপ। কেদে। ফেললেন কর্নেল ইয়াসিন। আমাদেরও চোখ ভিজে উঠলাে। তবে স্বস্তির কথা বঙ্গবন্ধু পরে সঠিক তথ্য জানতে পেরেছিলেন এবং এই তথাকথিত ‘মিথ্যে সাক্ষীগণকে সাদরে রাষ্ট্রের কাজে লাগিয়েছিলেন। কিন্তু ইতােমধ্যে কর্নেল ইয়াসিনের আর একটি ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল সে ক্ষতি ছিল অপূরণীয় ও চিরদিনের জন্য। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় ইয়াসিনের ৮/৯ বছরের ফুটফুটে ছেলেটি তার খালাতাে ভাইয়ের সাথে গিয়েছিল পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান দেখতে। সােহরাওয়ার্দি উদ্যানের। কাছাকাছি পৌছানাে এই শিশুদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। লক্ষ লক্ষ লােক। এক বছর নানা অত্যাচার সহ্য করেছে এই জনগণ। আজ তারা স্বাধীন। ঢাকার জনতা আনন্দে আত্মহারা ওরই মধ্যে দূর থেকে হলেও এই শিশুটি দেখতে গিয়েছিল আত্মসমর্পণ । কিন্তু কোথা থেকে এলােপাতাড়ি গুলি, গুলি বিদ্ধ হলাে শিশুটির বুকে। মুহূর্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লাে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, যেদিন ইয়াসিনের জন্য এই ‘মিথ্যে সাক্ষী। দেয়ার কলঙ্ক ঘােষণা করা হচ্ছিল, সেদিন তিনি তার এই ক্ষতিটির খবর জানতেন না। তাকে জানতে দেয়া হয় নি।
সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা